অন্তু আর ঠাকুমার গল্প

অন্তু আর ঠাকুমার গল্প

অন্তুর মনটা আজ একেবারেই ভালো নেই। স্কুল থেকে ফিরে সে মুখ হাঁড়ি করে বসে রইল ছোট্ট বাগানটার এককোণে। তাদের বাড়িটা শহরের ব্যস্ততম অঞ্চলে হলেও এই বাগানটার জন্যে খানিকটা সবুজ দেখতে পায় তারা। একটা পেয়ারাগাছ, দুটো আমগাছ আর একটা কাঁঠালগাছ আছে এখানে। সঙ্গে খানিকটা খোলা জায়গা। সেখানে ঘাস লাগানো হয়েছে। বিকেলবেলায় অনেক পাখি আর কাঠবেড়ালি এসে ছুটোছুটি করে। সেইদিকে তাকিয়ে মনমরা হয়ে বসে রইল অন্তু।

আসলে অন্তুর ঠাকুমার শরীরটা ভালো যাচ্ছে না কয়েকদিন ধরে। সারাদিন বিছানায় শুয়ে থাকেন তিনি। আগের মতো অন্তুর সঙ্গে গল্পগুজব করা আর লুডো খেলা একদম বন্ধ। মা তাকে ঠাকুমার ঘরে যেতে দেয় না। ঠাকুমার ঠিক কী হয়েছে বুঝতে পারে না অন্তু। দূর থেকে কয়েকবার দেখেছে, শূন্য চোখে ঘন্টার পর ঘন্টা তাকিয়ে থাকে ঠাকুমা। অন্তু মায়ের চোখ বাঁচিয়ে কয়েকবার ঠাকুমার কাছে গিয়ে তার সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেছে। কিন্তু ঠাকুমা শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থেকেছে তার দিকে। কোনও উত্তর দেয়নি।

আজ সকালে অন্তু লুকিয়ে আসল কথাটা জেনে ফেলেছে। মা আর বাবা কথা বলছিল নিজেদের মধ্যে। ডাক্তারকাকু নাকি বলেছেন, ঠাকুমার স্মৃতিশক্তি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে একটু একটু করে। তার সঙ্গে বয়সজনিত নানা রোগ তো আছেই। কিছুদিন পর থেকে তিনি কাউকেই চিনতে পারবেন না। মা বলছিল, “এমন করে তো বেশিদিন চলবে না। তুমি আর আমি দু’জনেই বাড়িতে থাকি না। অন্তু যায় স্কুলে। মা একা একা এই অবস্থায় থাকবেন কী করে?”

বাবা কিন্তু কিন্তু করে বলেছিলেন, “কিন্তু একা একা অ্যাসাইলামে থাকা? বাড়িতে কোনও কাজের লোক রাখা যায় না?”

মা উত্তর দিয়েছিল, “কাজের লোক কি ঠিকমতো দেখাশোনা করবে নাকি? পয়সা দিয়ে অ্যাসাইলামে রাখলে অন্তত চব্বিশ ঘন্টা ডাক্তার-নার্স থাকবে।”

বাবা কোনও কথা বলেননি। নিঃশব্দে উঠে গেছিলেন সেখান থেকে।

অন্তু বুঝতে পেরেছে, ঠাকুমা আর তাদের সঙ্গে থাকবে না। জানা অবধি বার বার তার বুকে মোচড় দিয়ে উঠছে। সে কোনওরকমে চোখের জল আটকে রেখেছে। সেই ছোটোবেলা থেকে আজ পর্যন্ত তাকে কোলেপিঠে করে মানুষ করেছে ঠাকুমা। শুধু তাই নয়, অন্তুর সবচেয়ে ভালো বন্ধুও হল ঠাকুমা। মা যখন তাকে জোর করে রোজ স্বাস্থ্যকর খাবারের নাম করে কর্নফ্লেক্স, দুধ আর ফল নিয়ে চাপাচাপি করেন ঠাকুমা চুপি চুপি তাকে এনে দেয় হজমি, মশলা চানাচুর, টক আম আর কটকটি ভাজা। হোম টাস্কের ফাঁকে তার সঙ্গে লুডো খেলা আর বাগানে বসে পাখি চেনার কম্পিটিশন করা তাদের রোজকার কাজ। আর বিকেলবেলায় ঠাকুমার কোলে বসে গল্প শোনা তো আছেই।

ঠাকুমারা ছোটোবেলায় থাকত কাঁদরসোনা বলে একটা গ্রামে। বর্ধমানের কাছের সেই পাড়াগাঁয়ের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে গাঙুর নদী। কতবার যে তার শৈশবের কথা শুনে সেই গ্রামে পৌছে গিয়েছে অন্তু। ঠাকুমার ছোটোবেলার বন্ধু ছিল তার জেঠতুতো দাদা বলাই। সে নাকি ছিল গাছ বাইতে, সাঁতার কাটতে আর মাছ ধরতে ওস্তাদ। তার সঙ্গে আমবাগানে গিয়ে আম কুড়ানো, জঙ্গলে চড়ুইভাতি করা আর গাঙুর নদীতে মাছ ধরার স্মৃতি গল্প বলার সময় ঝিলিক দিয়ে যেত ঠাকুমার চোখে।

ঠাকুমা বেশি দূর পড়ালেখা না করলেও তার স্মৃতিশক্তি ছিল অসাধারণ। কত ছড়া, কবিতা যে তার মুখস্থ তার যেন অন্ত নেই। কথায় কথায় তাকে কবিতা আবৃত্তি করতে অন্তুরা সবাই শুনেছে। তার ওপর বয়সকালে ঠাকুমা ছিল রাজকন্যের মতো সুন্দরী। সেকালে এমন সুন্দরী বড়ো একটা দেখতে পাওয়া যেত না। কলকাতায় কিম্বা অন্য কোনও বড়ো শহরে থাকলে হয়তো বিলেত-আমেরিকার ছেলের সঙ্গে বিয়ে হত তার। কিন্তু ঠাকুমার বাবা ছিলেন মাটির মানুষ। নিজের ভিটে ছেড়ে কোনওদিন যাবেন না বলে তিনি সারাজীবন কাঁদরসোনা গ্রামেই রয়ে গেছিলেন।

প্রায় ষাট-পঁয়ষট্টি বছর আগের কথা। ঠাকুরদার দাদু যদিও পরে কলকাতায় চলে এসেছিলেন চাকরির কারণে। তখন নদীতে জল ছিল, ছিল পাল তোলা নৌকো। গ্রামের ছেলেমেয়েরা বনে-জঙ্গলে ছোটাছুটি করত। সময়টাই অন্যরকম ছিল। সেই সময়কার গল্প শুনে অন্তুর রূপকথার মতো মনে হয়। ঠাকুমা না থাকলে সে কি জানতে পারত, বাঁশবাগানে হাঁটলে বাঁশ পড়ার মড়মড় শব্দ শুনে গা ছমছম করে – বর্ষাকালে নদীতে জল বাড়লে নদীর পাশে কাদায় গামছা করে মাছ ধরে গাঁয়ের ছেলেমেয়েরা – এপ্রিল-মে মাসে যে কালবৈশাখী হয়, তার নাম হয়েছে বৈশাখ মাসের ঘন কালো মেঘের জন্যে?

অন্তু ধীরে ধীরে উঠে ঠাকুমার ঘরে চলে এল। ঘরে আলো জ্বলছে না এখনও। শেষ বিকেলের আলোয় ঘরের আসবাবপত্রগুলো আবছাভাবে দেখা যাচ্ছে। ঠাকুমা মুখ তুলে বলল, “কে এলি রে? বলাই নাকি?”

অন্তু চমকে বলল, “ঠাকুমা, আমি অন্তু।”

ঠাকুমা চশমাটা ভালো করে পড়ে বলল, “ও তুই, অন্তু? আম পাড়তে গেছিলি বুঝি?”

অন্তু বুঝতে পারল, ঠাকুমা তার সঙ্গে অন্য কাউকে গুলিয়ে ফেলছে। সে ঠাকুমার হাত ধরে বলল, “ঠাকুমা, দেখো, আমি অন্তু। আমাকে চিনতে পারছ না?”

অনেকক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে ঠাকুমা বলল, “হ্যাঁ, দাদাভাই। তুমি তো অন্তু। বলাই এখানে কী করে আসবে? তাকে বড়ো দেখতে ইচ্ছে করে রে! কতদিন তাকে দেখিনি। আর বোধহয় কোনওদিন তাকে দেখতে পাব না।”

অন্তুর হাত ধরে চোখ মুছতে লাগল ঠাকুমা।

মা অন্তুর কথা পাত্তাই দিল না। বলাইদাদুর সঙ্গে দেখা হলে যে ঠাকুমা ভালো হয়ে উঠতে পারে সে-কথা কেউ শুনতেই চাইছে না। অন্তু প্রথমে বাবাকে বলেছিল, “বাবা, ঠাকুমাকে একবার তার ছোটোবেলার গ্রামে নিয়ে চল না। ছোটোবেলার গ্রাম আর বলাইদাদুকে দেখলে ঠাকুমার অসুখ সেরে যাবে।”

বাবা বিষণ্ণভাবে হেসে তার মাথায় হাত বুলিয়ে চলে গেল। তারপর মাকে বলতে গেছিল অন্তু। কিন্তু তার কথা শোনার বদলে মা তাকেই বকাবকি করতে লাগল। তার দিকে কড়া দৃষ্টিতে তাকিয়ে মা বলে দিল, “তোমার আজকাল পড়ালেখাতে একদম মন বসছে না। ঠাকুমার কাছে ওই আজগুবি গল্পগুলোই সারাদিন মাথার মধ্যে কিলবিল করছে তো? পরের টেস্টে যদি তুমি ভালো স্কোর না কর তোমাকে বোর্ডিংয়ে পাঠিয়ে দেওয়ার কথা ভাবা হবে।”

সেই শুনে সেখান থেকে পালিয়ে এসেছে অন্তু। মা খালি কথায় কথায় তাকে বোর্ডিংয়ে পাঠিয়ে দেওয়ার ভয় দেখায়। ঠাকুমাকে ছেড়ে থাকতে হবে বলেই তার বোর্ডিংয়ে যেতে এত ভয়। ঠাকুমা যদি চলেই যায় তাহলে বাড়িতে আর বোর্ডিংয়ে কী তফাত থাকবে? এদিকে তার দৃঢ় বিশ্বাস, বলাইদাদুকে দেখলে ঠাকুমা সেরে উঠবেই। বাবা ফিরলে আবার সে বাবাকে কথাটা বলবে বলে ভেবে রাখল অন্তু।

সারাদিন সে সুবোধ বালকের মতো বইখাতা নিয়ে বসে রইল। আজ থেকে স্কুলে পুজোর ছুটি পড়ে গেছে পনেরো দিনের জন্যে। কোনওরকমে দিনটা কেটে গেল ছবি এঁকে আর বইয়ের ভিতরে টিনটিনের কমিকস রেখে লুকিয়ে পড়ে। বিকেলে বাবা ফিরতেই সে সটান তার কাছে চলে গেল। বাবা তাকে দেখে বললেন, “কী হল, অন্তু? কিছু বলবি নাকি?”

সে মুখ নিচু করে বলল, “ঠাকুমাকে একবার আমার কথা শুনে ওর গ্রামে নিয়ে চল না। ঠাকুমা আমাকে বলেছে, তার বলাইদাদুকে দেখতে ইচ্ছে করছে। তাকে দেখলেই ঠাকুমার সব মনে পড়ে যাবে। ওর অসুখ একদম সেরে যাবে।”

বাবা একটু হেসে তার কাছে একটা চেয়ার টেনে বসলেন। তারপর বললেন, “মা তোকে বলেছে বলাইজেঠুর সঙ্গে দেখা করতে যাবে?”

অন্তু মাথা নেড়ে ‘হ্যাঁ’ বলল। বাবা বলল, “অন্তু, ঠাকুমার যে রোগটা হয়েছে তাকে বলে অ্যালজাইমার। অনেকসময় ঠাকুমা আমাদেরকেও চিনতে পারেন না। সব স্মৃতিই তার মাথা থেকে মুছে যাচ্ছে। এরপর তার আর কিছুই মনে থাকবে না। বলাইজেঠুর কথাই বা তার মনে আছে নাকি?”

অন্তু মাথা গোঁজ করে বলল, “হ্যাঁ। মনে আছে। আমাকে ঠাকুমা বলেছে।”

বাবা তার মাথায় হাত দিয়ে বললেন, “বোকা ছেলে। অমনি হয় নাকি? তুই ছোটোবেলা থেকে ওর কাছে থেকে বলাইজেঠু আর গ্রামের গল্প শুনেছিস, তাই তোর ওরকম মনে হচ্ছে। আর মা যদি তোকে বলেও থাকে ওই কথা, এই অবস্থায় কি তাকে গ্রামে নিয়ে যাওয়া সম্ভব? ডাক্তারকাকু ওকে হাঁটাচলা করতে বারণ করেছেন না!”

অন্তুর বুক ঠেলে কান্না উঠে এল। তাহলে কী হবে? ঠাকুমা গ্রামে যেতে পারবে না। সে কাঁদতে কাঁদতে বলল, “ঠাকুমা যদি না যেতে পারে তাহলে বলাইদাদুকে নিয়ে এস এখানে।”

বাবা আস্তে আস্তে তার চোখের জল মুছিয়ে দিতে দিতে বললেন, “নিয়ে এস বললেই কি আনা যায় রে? সে কতকাল আগের কথা। বলাইদাদু এখনঅ বেঁচে আছেন কি না, থাকলেও সেখানে থাকেন কি না আমরা তো কিছুই জানি না। ওদের সঙ্গে তো কতকাল আমাদের কোনও সম্পর্ক নেই। কাঁদিস না অন্তু, ঠাকুমা যতদিন আমাদের সঙ্গে আছে ওকে একটু সঙ্গ দিস। কতদিন থাকবে আর কে জানে।”

অন্তু ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল।

রাতে শুতে যাওয়ার আগে অন্তু শুনতে পেল, বাবা মাকে বলছে, “অন্তুটা এত করে বলছে বলাইজেঠুর কথা। পারলে আমি একবার নিজেই একবার আসতাম যদি ওকে নিয়ে আসা যায়। মা হয়তো আর বেশিদিন বাঁচবেন না। অ্যালজাইমারে বেশিদিন কষ্ট পেয়ে থাকা আরও খারাপ। বয়সও তো হয়েছে। যদি যাওয়ার আগে একবার বলাইজেঠুকে দেখতে পেতেন।”

মা উত্তরে বলল, “ওদের সঙ্গে কতকাল কোনও যোগাযোগ নেই বলো তো? অমনি হুট করে বেরিয়ে পড়লেই হয় নাকি? ওদের ছেলেময়ে, নাতি-নাতনি কারও খবরই তো জানি না। তুমি অন্তুকে বেশি আশকারা দিও না তো। সে কী না কী বলল বানিয়ে বানিয়ে অমনি তুমিও নাচতে শুরু করলে? ছেলে বড়ো হচ্ছে। ঐরকম কল্পনার জগতে না থেকে একটু পড়ালেখার দিকে মনযোগ দেওয়া দরকার ওর জন্যে। আজকাল চারদিকে যা কম্পিটিশন!”

বাবা চুপ করে বসে রইলেন।

অন্তুর চোখ আবার ভিজে উঠল। কেউ তার কথা বিশ্বাস করছে না। তাহলে কি ঠাকুমা কোনওদিন সেরে উঠবে না? তাহলে কি ঠাকুমা মরে যাবে?

সকালে উঠেই অন্তু মন ঠিক করে নিল। সে একাই যাবে বলাইদাদুকে খুঁজতে। তার বয়স এগারো। সে এমন কিছু বাচ্চা নয়। একা একা সে আগে কোথাও যায়নি বটে, কিন্তু সেটা কোনও ব্যাপার নয়। কত ছেলেমেয়ে তো স্কুলে একলা আসে হেঁটে হেঁটে। অন্তুর মায়ের বড়ো ভয়। চারদিকে নাকি কিডন্যাপার, গুন্ডা আর বাজে লোকে ঘুরে বেড়াচ্ছে বলে মা কক্ষনও অন্তুকে একলা ছাড়ে না। কিন্তু আজকে তাকে বেরোতেই হবে।

সে আগে গুগল ম্যাপ চালিয়ে কাঁদরসোনা গ্রামটা দেখে নিল। আগে তাকে হাওড়া স্টেশনে যেতে হবে, তারপর সেখান থেকে ধরতে হবে বর্ধমান লাইনের ট্রেন। অন্তুরা থাকে সোদপুরে। এখান থেকে হাওড়া যেতে হলে কী করতে হয়? তারা যতবার বেড়াতে গেছে ট্যাক্সি করেই গেছে হাওড়া স্টেশনে। কিন্তু এখন তার সম্বল পিগি ব্যাঙ্কে থাকা একানব্বই টাকা। ট্যাক্সি করে গেলে অনেক টাকা লেগে যাবে। সে ট্রেনেই যাবে।

অন্তু একটা ছোটো ব্যাগে একটা ছাতা, খাতা-পেন্সিল, রঙের বাক্স আর চিপসের প্যাকেট ঢুকিয়ে নিল। আর নিল পুরনো অ্যালবাম থেকে ঠাকুমার জোয়ান বয়সের একটা ছবি। বলাইদাদুকে দেখাতে হবে তো! আজকে তার মিন্টুদের বাড়িতে আঁকা শিখতে যাওয়ার কথা। মিন্টুর বড়োকাকা তাকে আঁকা শেখায়। অন্তু তাদের ফোন করে বলে দিল সে আজকে আসতে পারবে না। তারপর গুটি গুটি এগোল বাইরের দিকে। মিন্টুর বাড়িটা খুব কাছেই বলে মা তাকে একা একা যেতে দেয় বটে, কিন্তু দেরি হলেই বার বার ফোন করতে শুরু করে ওদের বাড়িতে। মায়ের সামনে দিয়ে বেরোতে যাওয়ার সময় মা বলল, “দুটোর মধ্যে ফিরে এস।”

অন্তু গাল চুলকে বলল, “মিন্টুর মা আজকে খেয়ে আসতে বলেছে। বিকেল হয়ে যাবে।”

মা সেই শুনে কিছু বলল না বটে, কিন্তু খুব খুশি হল বলে মনে হল না। যাই হোক, অন্তু হাঁফ ছেড়ে বাঁচল।

সোদপুর স্টেশনে গিয়ে সে একটু হিমশিম খেয়ে গেল। নিজে নিজে লোকাল ট্রেনে করে সে কোথাও যায়নি কোনওদিন। তারপর লোকের ভিড়ে স্টেশন যেন উপচে পড়ছে। একেই তাহলে অফিস টাইম বলে নাকি? যাই হোক, কাউন্টারে গিয়ে অন্তু বলল, “হাওড়ার টিকিট দেবেন।”

কাউন্টারের লোকটা হাই তুলে বলল, “এখান থেকে হাওড়ায় গাড়ি যায় না।”

এই রে! এবার কী হবে? তার দিকে তাকিয়ে লোকটা বলল, “মাঝেরহাট লোকাল আসছে চার নম্বরে। ওতে বসে পড়। বিবাদী বাগে নেমে গঙ্গা পেরোলেই হাওড়া স্টেশন।” বলে তাকে একটা টিকিট ধরিয়ে দিল সে।

অন্তু তাকে টিকিটের টাকা দিয়ে বলল, “থ্যাঙ্ক ইউ।”

মাঝেরহাটের ট্রেন অপেক্ষাকৃত ফাঁকাই আছে। অন্তু গিয়ে বসল একটা জানালার ধারে। ছোটোবেলায় বাবার সঙ্গে এক-দু’বার লোকাল ট্রেনে বসেছিল সে, তারপর থেকে বাইরে বেরোতে হলেই গাড়ি করে যাওয়া। দ্রিদিম দ্রিদিম করে ট্রেন ছুটছে। পিছনে চলে যাচ্ছে গাছপালা, ডোবা, মাটির বাড়ি, খাল, ছোটো ছোটো ছেলেমেয়েরা রবারের টায়ার নিয়ে খেলছে। কয়েক জায়গায় ঢাকের শব্দ শুনে অন্তুর মনে পড়ল, পুজো তো এসে গেল। যদি পুজোর সময়ে বলাইদাদু তাদের বাড়িতে থাকে ঠাকুমার সাথে কী ভালোই না হয়।

ট্রেনের ভিতরে এদিক সেদিক তাকাল অন্তু। তার বয়সী কোনও ছেলে নেই। কয়েকজন কলেজের ছেলে জোরে জোরে কথা বলছে নিজেদের মধ্যে। দু-তিনজন ঝুড়িওয়ালা বিরাট ঝুড়ি নিয়ে মাটিতেই বসে আছে। সামনের লোকটার দিকে তাকিয়ে অন্তু থতমত খেয়ে গেল। ঢ্যাঙা চেহারা, ময়লা একটা জামা পরে পান চিবোচ্ছে। মুখে একগাল দাড়ি। দাঁতগুলো পান খেয়ে খেয়ে লাল হয়ে গেছে। লোকটা একগাল মিচকে হাসি নিয়ে তার দিকেই তাকিয়ে আছে। তার দিকে চাইতেই বলল, “নাম কী, খোকা?”

অন্তুর মা বলে দিয়েছে অচেনা লোকের সঙ্গে কক্ষনও কথা বলতে নেই। কিন্তু কেউ নাম জিজ্ঞেস করলে কি চুপ করে থাকা যায়? সে বলল, “অমলতাস ব্যানার্জি।”

লোকটা খুক খুক করে হেসে বলল, “বাব্বা! নামের বাহার আছে। ভালো ভালো। তা বাড়ি থেকে পালাচ্ছ নাকি?”

অন্তু ঢোঁক গিলল। লোকটা এত কথা জিজ্ঞেস করছে কেন? ও কি সন্দেহ করেছে অন্তু বাড়িতে না বলে বেরিয়েছে? কিন্তু ভয় পেলে চলবে না। হাজার হোক সে শহরের ছেলে। অন্তু জোর গলায় বলল, “পালাব কেন? আমি যাচ্ছি আমার দাদুর বাড়ি।”

লোকটা আবার ফিক ফিক করে হেসে উঠল। তারপর দাঁতের মাড়ি থেকে পানের টুকরো বের করে ফেলে বলল, “দাদুর বাড়ি। তা ভালো ভালো। কোথায় যাওয়া হবে?”

অন্তু একটু ঘাবড়ে গিয়ে বলল, “কাঁদরসোনা।”

এইবার লোকটা ভড়কি খেয়ে বলল, “কী বললে? বাঁদরসোনা? ইয়ার্কি হচ্ছে আমার সঙ্গে?”

অন্তু তো তার কথা শুনে হেসে ফেলে আর কী। লোকটাকে পুরো ক্যাপ্টেন হ্যাডকের মতো লাগছে। সে হাসি চেপে বলল, “বাঁদরসোনা নয়, কাঁদরসোনা। বর্ধমানের কাছে।”

এইবার লোকটা হেসে বলল, “ও, তাই বলো। আমি ভাবলাম কী না কী।”

অন্তু আর কথা বাড়াল না। অজানা লোকের সঙ্গে বেশি কথা না বলাই ভালো। কাগজে আকছার দেখা যায়, ট্রেনে বিষ খাইয়ে লোকেরা জিনিসপত্র লুট করে নিচ্ছে। তার কাছে অবশ্য তেমন কিছু নেই, কিন্তু বলা তো যায় না। তার মনের কথা শুনতে পেয়েই বোধহয় লোকটা পকেট থেকে একটা প্যাকেট বের করে বলল, “নাও। আমলকী খাও। মশলা আমলকী।”

অন্তু ঘাবড়ে গিয়ে বলল, “না না, আমার পেট ভর্তি।”

লোকটা সে-কথা কানেই নিল না। জোর করে তার হাতে কয়েকটা আমলকী ঢেলে দিয়ে বলল, “আরে, পেট ভরার জন্যে কি লোকে আমলকী খায়? তা আগে বর্ধমানে গেছ? হাওড়া থেকে ট্রেন ধরবে বুঝি?”

অন্তুর এবার মনে হতে লাগল, লোকটা সত্যি ছেলেধরা। কোথায় যাবে, কার কাছে যাবে সব জেনে নিচ্ছে। আমলকী খাইয়ে অজ্ঞান করে তাকে তুলে চম্পট দেবে। সে খাওয়ার ভান করে আমলকীগুলো জামার পকেটে রেখে দিল। তারপর বলল, ”হ্যাঁ। ট্রেনে।”

লোকটা দাঁত খোঁচাতে খোঁচাতে বলল, “বেশ। তা তুমি যে প্রথম একা একা যাচ্ছ সেটা তো বোঝাই যাচ্ছে। তা সে তো ভালোই। আমি সেই কোন পুঁচকে বয়স থেকে একা একা ঘুরছি।”

লোকটার কথা শুনে অন্তুর ভয় কেটে গেল। লোকটা যে ছেলেধরা নয় সেটা অন্তত পরিষ্কার। সে বলল, “আপনি বুঝলেন কী করে, আমি একা একা প্রথম যাচ্ছি? আপনি কি গোয়েন্দা নাকি?”

লোকটা চোখ বড়ো বড়ো করে বলল, “বোঝো। না রে, ভাই। আরে তোমাকে দেখেই বোঝা যায়। একে তোমার বয়সী ছেলেরা একা একা ট্রেনে চড়ে না। একে তুমি জামা-প্যান্ট-জুতো পরে আছ, তারপর তুমি জানালার বাইরে হাঁ করে তাকিয়ে সিন-সিনারি দেখছ। বোঝাই যায়, লোকালে চড়ার অভ্যেস নেই।”

অন্তু চুপ করে রইল। এইবার লোকটা খ্যাঁক খ্যাঁক করে হেসে বলল, “কোনও ভয় নেই, খোকা। সবাই কি আর দুনিয়ায় খারাপ? আর টিকিট কাটার সময় বর্ধমানের টিকিট কেটো। ওই বাঁদরসোনা না কাঁদরসোনা কী বললে, ওইখান অবধি নিশ্চয়ই ট্রেন যায় না।”

বাইরে একের পর এক স্টেশন চলেছে। বেলগড়িয়া, দমদম, পাতিপুকুর, কলকাতা, টালা, বাগবাজার, শোভাবাজার। এইসব অঞ্চলে আগে আসেনি অন্তু। ডানদিকে গঙ্গাকে পাশে রেখে চলছে ট্রেনটা। বড়োবাজার আসতেই সামনের লোকটা বলল, “অমলতাসবাবু, পরের স্টেশন বিবাদী বাগ। ওখানে নেমে লঞ্চে করে চলে যাও। গঙ্গা পেরোলেই হাওড়া। আমি যাব সেই খিদিরপুর।”

তড়িঘড়ি উঠে পড়ল অন্তু। বিবাদী বাগ আসতেই নেমে পড়ল। ওই লোকটার নামটা তো জানা হল না।

কাছেই লঞ্চে করে গঙ্গা পেরোনোর লাইন। পাঁচ টাকা দিয়ে টিকিট কেটে লঞ্চে উঠে পড়ল অন্তু। সামনে দেখা যাচ্ছে হাওড়া ব্রিজ। এত কাছ থেকে বোধহয় সে কোনওদিন হাওড়া ব্রিজ দেখেনি। হাওড়া ব্রিজের ওপর থেকে অনেকবার গেছে অবশ্য, কিন্তু সারা ব্রিজটা কি তাতে দেখা যায়। গঙ্গার জল চক চক করছে রোদ্দুর লেগে। অনেক লোকে নৌকোর সারির কাছে জলে স্নান করছে। অন্তুর বেশ মজা লাগল। মা তাকে জলের কাছাকাছিই যেতে দেয় না। সেইবার নিক্কো পার্কে কিছুতেই বোটিং করতে দিল না, যদি জলে পড়ে যায় সেই ভয়ে। আর এখন সে একা একা এই বিশাল গঙ্গা পার করছে। এখন ভালোয় ভালোয় বলাইদাদুকে খুঁজে পেলেই হয়।

হাওড়া স্টেশনে এসে সে টিকিট কাউন্টারের দিকে চলল। এখানে সে অনেকবার এসেছে। সেইবার তারকেশ্বর যাওয়ার জন্যে যেখান থেকে টিকিট কাটা হয়েছিল সেইদিক দিয়ে এগিয়ে লাইনে দাঁড়াল সে। ওই লোকটার কথামতো বর্ধমানের টিকিট কেটে ফেলল একটা। এখনও তার কাছে প্রায় সত্তর টাকা বাকি আছে।

বর্ধমানের গাড়িতে ভিড় নেই। একের পর এক ফেরিওয়ালা এসে বিক্রি করছে লেবুর লজেন্স, পাপড়িভাজা, হজমিগুলি, কাঁচা আমের মোরব্বা,ঝালমুড়ি। এত জিনিসের মধ্যে একটাও অন্তুর বাড়িতে হয় না। সে এক প্যাকেট বাদামভাজা নিল। কট কট করে বাদাম খেতে খেতে সে এদিক ওদিক দেখতে লাগল। এখনও ট্রেন ছাড়েনি।

এমন সময় একটা বুড়োমতন লোক এসে সোজা তার পাশে বসে বলল, “খোকা, টিকিট আছে?”

অন্তু জামার পকেট থেকে টিকিট বের করে বলল, “হ্যাঁ।”

লোকটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “ঠিক আছে। আমি যাব শক্তিগড় পর্যন্ত। টিকিট কাটার সময় পাইনি। চেকার এলে আমি বলব, তুমি আমার নাতি। আমার টিকিটটা কোথাও পড়ে গেছে। যদিও এ-লাইনে চেকার-ফেকার আসে না।”

অন্তু আপত্তি করার কোনও সুযোগই পেল না। ভালোই লোকজন পাচ্ছে বটে সকাল থেকে। লোকটার গাল তোবড়ানো, মাথার চুল সাদা। দাড়ি নেই। গায়ের রং কুচকুচে কালো। কিন্তু চোখটা চকচক করছে। তার দিকে তাকিয়ে লোকটা বলল, “খোকা, ম্যাজিক দেখবে নাকি?” বলে তার উত্তরের অপেক্ষা না করেই পকেট থেকে একতাড়া তাস বের করে ম্যাজিক দেখাতে শুরু করে দিল। ততক্ষণে গাড়ি চলতে শুরু করেছে।

golpoantu o thakuma 2প্রায় আধঘন্টা পর অন্তু বুঝতে পারল, ম্যাজিকবুড়ো থুড়ি দাদু হাতসাফাইয়ের খেলা দেখাতে ওস্তাদ। এই হাতের পাতা থেকে কয়েন অদৃশ্য করে দেয় তো এই একটা কয়েন দুটো করে ফেলে। তাদের চারপাশে ভিড় জমে গেছে। একসময় ম্যাজিকবুড়ো ধমকে বলল, “এত ভিড় করছেন কেন? এটা কি ফ্রিতে ম্যাজিক শো হচ্ছে নাকি? দেখতে চান তো সবাই দু’টাকা করে দিন। নাহলে সরে পড়ুন।”

কয়েকজন দোনামনা করে টাকা দিল বটে। বাকিরা সরে পড়ল। ট্রেন তখন ছুটছে গুরাপ, ঝাঁপডাঙা, নবগ্রাম ছাড়িয়ে।

কথার মাঝে একবার বুড়ো অন্তুকে জিজ্ঞেস করল, “কোথায় যাবে গো তুমি?”

অন্তু উত্তর দিল, “বর্ধমান। সেখান থেকে যাব কাঁদরসোনা।”

বুড়ো ভারি আশ্চর্য হয়ে বলল, “সে কী হে? তা কাঁদরসোনা যাবে তো বর্ধমান নামবে কেন? এই আমি নামব শক্তিগড়, তারপরেই পড়বে গাংপুর। সেখানে নেমে পড়। সেখান থেকে ভ্যান নিলেই পৌঁছে দেবে কাঁদরসোনা। এই রে, শক্তিগড় এসে গেল। আমি নামি খোকা, বুঝলে? তুমি পরের স্টেশনে নেমে পড়ো।”

গাড়ি থামতেই ব্যস্তসমস্ত হয়ে নেমে পড়ল লোকটা।

শক্তিগড় পেরোতেই ট্রেনে গোলমাল শুরু হয়ে গেল। অনেকের মানিব্যাগ আর জিনিসপত্র পাওয়া যাচ্ছে না। সবাই বলতে লাগল যে ওই ম্যাজিকবুড়োই খেলা দেখানোর ফাঁকে সব নিয়ে পালিয়েছে। সকলে মিলে চ্যাঁচামেচি করে সে এক মহা হট্টগোল। একসময় একজন লোক অন্তুকে দেখিয়ে বলল, “ওই বুড়োটা এই ছোকরার সঙ্গে কথা বলছিল। ওদের চেনা আছে। এই ছেলেটাকে পুলিশের কাছে নিয়ে যাওয়া যাক।”

সেই শুনে অন্তু প্রবল প্রতিবাদ করে উঠল। লোকটাকে সে চেনেই না। কিন্তু কেউ তার কথা শুনতে রাজি হচ্ছে না। একজন বলল, “দেখেছ? পুলিশের নাম শুনেই ভয়ে অবস্থা খারাপ। তার মানে এই ছোকরাও ওই বুড়োর দলে আছে।”

শেষমেশ কয়েকজন বয়স্ক লোক এসে অন্তুকে উদ্ধার করল। এমন সাজগোজ করা শহুরে ছেলে চোর হতেই পারে না। একজন জিজ্ঞেস করল, “তোমার বাড়ি কোথায়, খোকা?”

অন্তু তখন মহা বিপদে পড়েছে। সত্যি বললে সে এই বিপদ থেকে উদ্ধার পাবে বটে, কিন্তু এই লোকগুলো নিশ্চয়ই তার বাড়িতে জানিয়ে দেবে তার এখানে আসার কথাটা। আবার মিথ্যে বললে পুলিশ ধরবে। সে হুট করে বলে দিল, “খিদিরপুর।”

একজন বলল, “ওই বুড়ো তোমাকে খেলা দেখানোর নাম করে জিনিসপত্র চুরি করে চম্পট দিয়েছে। তোমার জিনিসপত্র কিছু হারায়নি তো?”

অন্তুর এতক্ষণ সে কথা খেয়াল হয়নি। তাদের কথা শুনে খুঁজতে গিয়ে সে দেখল, তার সঙ্গের ব্যাগটা বেমালুম উবে গেছে হাওয়ায়।

ট্রেনের লোকগুলোই তাকে কাঁদরসোনা যাওয়ার ভ্যানে বসিয়ে দিল গাংপুরে ভ্যানওয়ালার সাথে কথা-টথা বলে। অন্তুর পকেটে কিছু খুচরো ছাড়া আর কিছু নেই। ষাট টাকাই ছিল তার ব্যাগে। এই অভাবনীয় বিপদে সে একেবারে হতভম্ব হয়ে গেছে। সে এখনও ছোটো। এরকম অবস্থায় একলা কোনওদিন পড়েনি। অন্তু আশা করল, কাঁদরসোনা গেলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। সে বলাইদাদুকে নিয়ে আজই ফিরে যাবে বিকেলের মধ্যে। দেরি হলে বলাইদাদু নিশ্চয়ই তার বাড়িতে ফোন করে জানিয়ে দেবে। তার সঙ্গে কথা বললে মা-বাবাও তাকে বকবে না।

ভ্যান নাম হলেও এটা আসলে একটা ঠেলাগাড়ির মতো। অনেকে পা ঝুলিয়ে বসে আছে তিনদিকে। বাকিরা মাঝখানে বাবু হয়ে বসেছে। ভ্যানওয়ালা গানের কলি ভাঁজতে ভাঁজতে প্যাডেল করছে। ঝাঁকুনির চোটে অবস্থা খারাপ অন্তুর। মুখের মধ্যে তেতো জল উঠে আসছে। পকেটে হাত দিয়ে সকালে ট্রেনে দেওয়া লোকটার আমলকী পেয়ে গেল সে। সেগুলো মুখে দিয়ে অন্তু চারদিকে দেখতে লাগল ঘাড় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে। চারদিকে ধানের ক্ষেত দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। মাঝে মাঝে গাছের জঙ্গল। তার মাঝ থেকে কাঁচা রাস্তা চলে গেছে সামনের দিকে। ক্ষেতের ওপর চরতে থাকা গরুর গলার ঘন্টার শব্দ শুনতে পাওয়া যাচ্ছে টুং-টাং করে। আকাশে হালকা একটা মেঘ এসে গরমের ভাবটা কমে গেছে অনেক। মাঝে মাঝে একটা ঠান্ডা হাওয়া দিচ্ছে। অন্তু কোনওদিন গ্রামে আসেনি আগে। এরকম খোলা মাঠ আর সবুজ তার চোখে নতুন। তার ভালো লাগছে। সে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল।

ভ্যান গাড়ি যখন কাঁদরসোনা এসে পৌঁছল তখন দুলুনিতে অন্তুর কোমর ব্যথা হয়ে গেছে। সে লাফ দিয়ে নেমে এদিক সেদিক তাকাল। এই তার ঠাকুমার গ্রাম, সেই জায়গা যার কথা শুনে আসছে কত বছর ধরে। এখানেই ঠাকুমা সারা শৈশব কাটিয়েছে, বলাইদাদুর সঙ্গে ঘুরে বেরিয়েছে বনে-জঙ্গলে। কোথায় সেই বাঁশের জঙ্গল, সেই আম বাগান, সেই গাঙুর নদী? কিন্তু সবচেয়ে আগে বলাইদাদুর বাড়ি খুঁজতে হবে। ঠাকুমার ছবিটাও তার ব্যাগের সঙ্গে বেপাত্তা হয়ে গেছে। কিন্তু তার পরিচয় দিলে দাদু আর তার বাড়ির লোকেরা নিশ্চয়ই তাকে চিনতে পারবে।

সে খানিকটা এগিয়ে গেল সামনের দিকে। একটা বড়ো অশ্বথগাছের কাছে একটা শিবমন্দিরে কয়েকজন মানুষ জটলা করেছে। দুপুরবেলায় গল্পগুজব করছে বোধহয়। সেদিকে এগোতে সবাই তার দিকে চাইতে লাগল। বাচ্চা একটা ছেলে, পরনে শহুরে পোশাক, লোকেরা তো আশ্চর্য হবেই। একজন মাঝবয়েসী লোক এসে তাকে জিজ্ঞেস করল, “কার বাড়ি যাবে গো, ছেলে?”

অন্তু একটু সময় নিয়ে বলল, “বলাইদাদুর বাড়ি। কোনদিকে ওঁর বাড়িটা?”

লোকগুলো নিজেদের মধ্যে একটু মুখ চাওয়াচাওয়ি করে বলল, “ও নামে তো কেউ থাকে না এ-গাঁয়ে। ওর পুরো নাম কী?”

অন্তু বুঝল, বিরাট একটা ভুল হয়ে গেছে। বলাইদাদুর ভালো নাম তো সে জানে না। কিন্তু তার ঠাকুমার বিয়ের আগে নাম কমলা মুখার্জি ছিল। সে লোকগুলোকে বলল, “আমি ভালো নাম জানি না। আমার ঠাকুমা ছোটোবেলায় এই গ্রামে থাকত। আমার ঠাকুমার নাম কমলা মুখার্জি। ওর ভাই হত বলাইদাদু।”

ততক্ষণে লোকগুলো তাকে ঘিরে ধরেছে। একজন বলল, “তুমি কলকাতা থেকে একা এসেছ তাকে খুঁজতে?”

অন্তু বুঝল, এদের কাছে সব খুলে না বললে বলাইদাদুকে কিছুতেই খুঁজে পাওয়া যাবে না। আর একটা ভয় করতে লাগল তার, দাদু বেঁচে আছে তো? এত বছর তো কেউ তার সঙ্গে যোগাযোগ করেনি। সে সবকথা খুলে বলল লোকগুলোকে।

লোকগুলোর মধ্যে একজন চুকচুক শব্দ করে বলল, “আহা রে, বেচারা এত দূর থেকে একা একা এসেছে ওকে নিয়ে যেতে। বয়সটাও তো অল্প। সকাল থেকে বোধহয় কিছু পেটে পড়েনি। কিছু খেতে দাও একে।”

অন্তু বারণ করবার আগেই একটা বাড়ির উঠোনে তাকে বসিয়ে তার জন্যে পুঁটিমাছের ঝোল আর ভাত নিয়ে এল একজন। সঙ্গে একটা পাতিলেবু। লোকটা বলল, “খেয়ে নাও, বাছা। আমরা তো গরিব, বেশি কিছু দিতে পারলাম না তোমাকে। খালি পেটে থাকলে দাদুকে খুঁজবে কী করে?”

অন্তু আর মানা করল না। তার সত্যি খিদে পেয়েছিল। লেবু দিয়ে মেখে গরম গরম মাছের ঝোল দিয়ে ভাত খেতে চমত্কার লাগছে। একজন লোক তাকে হাতপাখা দিয়ে হাওয়া করতে লাগল। অন্তুর ভারি লজ্জা করছে, কিন্তু সে কিছু বলতেও পারছে না। সবাই যেন তাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে বড়ো। একটা বুড়োমতো লোক বলল, “মুখার্জি-বাড়িতে একটা খবর পাঠা তো। মুখার্জি-বাড়ি বলতে তো ওই খেঁদি-ভুঁদিদের বাড়ি। ওদের দাদুকে ডেকে আন। যদি ওরা কিছু বলতে পারে।”

খেয়ে নিয়ে গাছের তলায় বসে রইল অন্তু। সকলে গাঁয়ে রটিয়ে দিয়েছে, একটা বাচ্চা ছেলে তার দাদুকে খুঁজতে কলকাতা থেকে এসেছে। সেই শুনে অনেক মেয়ে-ছেলে-বুড়ো-বুড়ি দেখতে এসেছে তাকে। কেউ কেউ তার গালে-মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে দিচ্ছে। একজন বুড়ি বলল, “এমন নাতি ভাগ্য করলে হয়। কলকাতা থেকে ঐটুকু ছেলে একা একা এসেছে।”

অন্তু গ্রামের বাড়িগুলো দেখছিল। বেশিরভাগই কাঁচা বাড়ি, মাটির তৈরি। খড়ের ছাদ। এরা যে খুব গরিব সে দেখেই বুঝতে পারছে। কিন্তু অন্তুকে কেউ কলা দিচ্ছে, কেউ আনারস কেটে আনছে। কেউ ডাবের জল দিচ্ছে। মনে হচ্ছে সে যেন রাজপুত্র।

খানিকক্ষণ পরে একজন ধুতি-পাঞ্জাবি পরা লোককে নিয়ে এল কয়েকজন। তিনি এসে অন্তুকে জিজ্ঞেস করলেন, “কাকে খুঁজছ, বাবা? কার ছেলে তুমি? কী নাম তোমার?”

অন্তু তার নাম আর বাবার নাম বলল। তার কাছে সব শুনে ভদ্রলোক বললেন, “কমলার নাতি তুমি? সে তো আমার খুড়তুতো বোন হয়। তার মানে তুমিও আমার নাতি। আমার নাম জগন্নাথ। কিন্তু তুমি বলাইকে খুঁজতে এসেছ, সে তো ওর ভাই ছিল না। আমাদের বাড়িতে কাজ করত বলে একসঙ্গে খেলাধুলো করতাম আমরা। কমলার সঙ্গে তার খুব ভাব ছিল, খুব। বলাইও তাকে ছোটোবোনের মতো ভালোবাসত।”

বলাইদাদু যে ঠাকুমার রক্তের সম্পর্কের কেউ নয় এই খবর শুনে অন্তুর বেশি কিছু মনে হল না। ভাইই হোক আর বন্ধুই হোক, সে এসেছে বলাইদাদুকে নিয়ে যেতে। সে বলল, “দাদু, আজকাল বলাইদাদু কোথায় থাকে? ঠাকুমার খুব অসুখ। বলাইদাদুকে দেখতে চাইছে।”

ভদ্রলোক কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলেন। তারপর বললেন, “অন্তু, তোমাকে আমি বলাইদাদুর বাড়িতে নিয়ে যাব। কিন্তু আগে তুমি আমাদের বাড়ি চল। তুমি আমার নাতি, আমার বাড়িতে না গেলে কি হয়? তোমাকে তো কেউ দেখেনি আগে। আমাদের কলকাতায় তো যাওয়া হয় না। বলাই আজকাল আর এ-গাঁয়ে থাকে না। সে থাকে দামোদরের ওই পারে বামুনিয়াতে। তোমাকে বিকেলে সেখানে নিয়ে যাব। তোমার বাড়িতে ফোন করে দিচ্ছি। কাল সকালেই তুমি বাড়ি ফিরবে। কেউ তোমাকে কিচ্ছু বলবে না।”

অন্তু জগন্নাথদাদুর সঙ্গে চলল মুখুজ্যে-বাড়িতে। গাঁয়ের লোকেরা সবাই তাদের সঙ্গে এগিয়ে চলল পৌঁছে দিতে। সকলে কত আদর করে দিল অন্তুকে। তাদের চোখের দিকে চেয়ে অন্তুর মনে হল, গাঁয়ের সবাই যেন তার নিজের আত্মীয়।

জগন্নাথদাদুর বাড়িতে মেলা লোক। তার দুই ছেলে, তাদের স্ত্রী, তাদের ছেলেমেয়ে সকলে মিলে একটা হুলুস্থুলু পড়ে গেল অন্তুর সঙ্গে কথা বলবে বলে। জগন্নাথদাদুর নাতির নাম দিলু। সে অন্তুর সঙ্গে ভাব জমিয়ে ফেলেছে। রোদ একটু পড়ে আসতে অন্তু দিলুকে ফিস ফিস করে বলল, “এখানে বাঁশবন আছে?”

দিলু ঠোঁট উল্টে বলল, “থাকবে না কেন? বাঁশবন, আমবন, পেয়াবাগান সব আছে। দেখবে নাকি?”

অন্তু মাথা নাড়াল।

জগন্নাথদাদুকে বলে তারা চলল বাঁশবাগানের দিকে। আকাশ একটু মেঘলা হয়েছে। হয়তো বিকেলে দুয়েক পশলা বৃষ্টি হতে পারে। ঠান্ডা ফুরফুরে হাওয়া দিচ্ছে। অন্তু দিলুকে জিজ্ঞেস করল, “তুমি এখানেই থাকো?”

দিলু বলল, “না। আমরা থাকি দুর্গাপুর। এখানে দুর্গাপুজো হয় তো প্রতিবছর, তাই এই সময়টা এখানে এসে থাকি।”

কিছুক্ষণ কথা বলেই অন্তু বুঝল, দিলু মোটেই গ্রামের ছেলে নয়। সে শহরের সবকথাই জানে। শুধু দাদুর বাড়ি ছুটি কাটাতে চলে আসে বলে এখানে সে সব চিনে গেছে। তাহলে তারা কেন কলকাতা থেকে কোনওদিন এখানে আসে না? দু-তিন ঘন্টার তো বেশি লাগে না। এত বছর ধরে ঠাকুমা, বাবা, মা কেউ কোনওদিন এখানে আসেনি কেন তাহলে? দিব্যি তারাও পুজোর ছুটিতে দুয়েকবার এখানে ঘুরে যেতে পারত। সে তাহলে আগে থেকেই চিনত তার দাদু, দিদা, কাকা জ্যাঠা, ভাইবোনদের।

আলপথ বেয়ে ঝুপসি গাছের জঙ্গল পেরিয়ে এক জায়গায় এসে দিলু বলল, “এই যে বাঁশবাগান। আগে পুরোটাই জঙ্গল ছিল।”

অন্তু কোনওদিন বাঁশগাছ দেখেনি। একেকটা ঝোপে প্রায় কুড়ি-পঁচিশটা করে লম্বা বাঁশগাছ উপরের দিকে উঠে গেছে। হাওয়ায় এমন দুলছে সেইগুলো, মনে হয় ভূতে নাড়াচ্ছে। খানিকটা এগোতেই জঙ্গলটা আরও ঘন হয়ে গেল। টি-টুয়া টি-টুয়া করে একটা পাখি ডাকছে। এই দুপুরেও ঝিঁঝিঁর শব্দ শুনতে পাওয়া যাচ্ছে। মড় মড় করে বাঁশ পড়ার শব্দ হচ্ছে। ঠাকুমা আর বলাইদাদু এই জঙ্গলেই ঘুরে বেড়াত। একবার নাকি ভূতও দেখেছিল। অন্তু অবাক হয়ে দেখতে লাগল চারদিকে। বাঁশবাগানের পর আমবাগান, পেয়ারাবাগান সব দেখা হল একে একে।

দিলুর সঙ্গে তার বন্ধুত্ব হয়ে গেছে ইতিমধ্যে। সে জিজ্ঞেস করল, “গাঙুর নদীতে মাছ ধরেছ তুমি কোনওদিন?”

দিলু বলল, “গাঙুর নদী তো কবেই শুকিয়ে গেছে। বর্ষাকালে শুনেছি খানিকটা জল হয়। কিন্তু দামোদর আছে কাছেই। সেখানে আমরা অনেকবার মাছ ধরতে গেছি। নদীর ধারে চড়ুইভাতিও হয়েছে কতবার।”

অন্তুর এবার দিলুর ওপর হিংসে হতে লাগল। ঠাকুমার গল্প শুনে সে ভেবেছিল এ এক রূপকথার জগৎ, আজকাল আর এইসব পাওয়ার কোনও উপায় নেই। আর এই ছেলেটা প্রায় পঞ্চাশ বছর পরেও একইরকম মজা করে যাচ্ছে। বাবা-মায়ের ওপর তার খুব অভিমান হতে লাগল। তারা কেন আগে এখানে আসেনি?

বিকেলবেলায় জগন্নাথদাদুর সাথে বেরোনোর সময় দিলু তার হাতে এক ঠোঙা জামরুল ধরিয়ে দিল। বলাইদাদুর বাড়ি থেকে ফিরে আজ রাতে সে এখানেই থাকবে, তারপর সকালে দাদুর সঙ্গে ফিরবে কলকাতায়। সাইকেলে করে যেতে যেতে জগন্নাথদাদু বলল, “অন্তু, আমি তোমাকে নৌকোয় চড়িয়ে দেব। মাঝিই তোমাকে পার করে নিয়ে যাবে বলাইদাদুর বাড়ি, কিন্তু আমি যাব না। আমি এই পারে তোমার জন্যে অপেক্ষা করব। আমার একটা কাজ আছে। তাড়াতাড়ি ফিরে এস।”

অন্তু অবাক হলেও কিছু জিজ্ঞেস করল না। একটা বাঁক পেরোতেই সামনে বিশাল নদী দেখতে পাওয়া গেল। ওই পারে ঘন জঙ্গল দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। একপাশে দাঁড়িয়ে আছে ছইওয়ালা কয়েকটা নৌকা। সেইদিকে এগিয়ে একটা নৌকোয় অন্তুকে তুলে দিলেন জগন্নাথদাদু। বললেন, “শামু, দাদুভাইকে ঠিক করে নিয়ে যেও আর তাড়াতাড়ি ফিরে এস। সাবধানে যেও, দাদুভাই।”

অন্তু হাত নাড়ল। আকাশে কালো মেঘ করেছে। নৌকো চলতে শুরু করেছে। বৈঠায় গুলুপ গুলুপ শব্দ হচ্ছে জল কাটবার। শান্ত জলের ওপর আস্তে আস্তে এগিয়ে চলছে নৌকো। অন্তু পিছনে ফিরে দেখল, জগন্নাথদাদু তখনও দাঁড়িয়ে আছেন নদীর পাড়ে।

বামুনিয়া গ্রাম নদী থেকে মিনিট পনেরোর হাঁটা পথ। অন্তু মাঝির সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে জিজ্ঞেস করল, “তুমি বলাইদাদুকে চেন?”

মাঝি বলল, “হ্যাঁ গো, চিনি। কিন্তু মানুষটা অর্ধেক সময় বাড়িই থাকেন না। সারাক্ষণ বাইরে বাইরে। এত বয়স হল তবুও যেন ছেলেমানুষের মতো রয়ে গেলেন।”

অন্তু বলল, “ওঁর বাড়িতে কে কে আছে?”

মাঝি হাঁটতে হাঁটতে বলল, “ছেলে ছিল। এখন আর নেই। ছেলের বউ আছে, আর কতগুলো নাতিনাতনি। খুব গরিব গো ওরা। সেইবার বামুনিয়া গাঁয়ে বন্যা হল, তাতে ওদের বাড়িঘর সব ভেসে গেছিল।”

অন্তুর মনখারাপ হয়ে গেল। আগে যদি সে জানত তাহলে তো বলাইদাদুকে কলকাতাতেই থাকতে বলতে পারত। আগে যে কেন সে এখানে আসেনি।

একসময় বামুনিয়া গ্রামে পৌঁছে গেল তারা। এত ছোটো গ্রাম যে পাঁচ মিনিট হাঁটলেই শেষ হয়ে যায়। একদিকে রাধাকৃষ্ণ বিদ্যালয় বলে একটা স্কুল। কয়েকটা মন্দির আর কাঁচাপাকা কয়েকটা বাড়ি। হাঁটতে হাঁটতে একটা বাড়ির সামনে এসে মাঝি হাঁক পাড়ল, “বলাইজ্যাঠা, ও বলাইজ্যাঠা, আছ নাকি?”

অন্তু অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে লাগল। কয়েকবার ডাকাডাকির পর একজন ঘোমটা পরা মেয়ে বাইরে এসে বলল, “উনি তো নেই। পরশু বেরিয়েছিলেন। দেখেন কতদিনে ফেরে।”

অন্তুর মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। বলল, “বলাইজেঠু নেই?”

তার দিকে তাকিয়ে বউটা বলল, “এই ছেলেটা কে গো?”

মাঝি উত্তর দিল, “আরে, বলাইজ্যাঠার আরেক নাতি গো, সরুদি। ছোটোবেলায় ওর ঠাকুমা বলাইজ্যাঠার সাথে কাঁদরসোনায় একসাথে খেলাধুলা করত। ওর ঠাকুমার শরীর খারাপ, জ্যাঠাকে দেখতে চেয়েছেন। তাই খোকাবাবু একা একাই চলে এসেছেন ওকে খুঁজে নিয়ে যেতে।”

শুনে ঘোমটা সরিয়ে তাকে দেখে মেয়েটা বলল, “এস এস, ভিতরে এস। তোমার দাদুর কোনও আক্কেল নেই। সেই যে বেরোয় আর হুঁশ থাকে না। কোথায় কোথায় চলে যায়। ঘরে থাকতেই চায় না। তুমি এতদূর থেকে এসেছ, তোমাকে কী দিই বলো তো?”

অন্তুর তখন আর কিছু শুনতে ভালো লাগছে না। তার এত কষ্ট করে এখানে এসে কোনও লাভ হল না। বলাইদাদু নেই। তাহলে সে একা একা ফিরবে কী করে?

ততক্ষণে কয়েকটা ছেলেমেয়ে এসে তাকে দরজার ফাঁক দিয়ে দেখছে। অন্তু দেখল, ঘরে একটা চৌকি পর্যন্ত নেই। তার জন্যে একটা চাটাই পেতে মেয়েটা তাকে বলল, “তোমার নাম কী গো?”

অন্তু নাম বলল। মেয়েটা বলল, “আমি তোমার সরুকাকিমা। এখানে কাজকম্ম নেই তো, তাই দাদু মাঝে মাঝে বাইরে চলে যায় কাজ করতে।”

কিছুক্ষণের মধ্যেই অন্তুর আড়ষ্টভাব কেটে গেল। এদের ব্যবহার এত আন্তরিক যে বোঝাই যায় না তাকে এরা আজ প্রথম দেখছে। ছেলেমেয়েদুটোর নাম ঝন্টু আর পিঙ্কি। তার চেয়ে বয়সে একটু ছোটো। তারা অন্তুর সঙ্গে নানা গল্প করতে লাগল। অন্তু ওদের জামরুল দিতে গেল, সে ওরা কিছুতেই নেবে না। সে এক কান্ড!

সরুকাকিমা তাকে কিছুতেই না খাইয়ে ছাড়ল না। মুড়ি আর চিনি দিয়ে নারকোল কোরা খেতে হল অন্তুকে। অন্তু দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেমেয়েদুটোকে বলল, “তোমরা স্কুল যাও না?”

“স্কুল কোথায় গো, দাদাবাবু? ওই বাড়িটা এমনি এমনি দাঁড়িয়ে আছে। তোমার বলাইদাদু ওখানেই কাজ করত গো আগে। সেবার বন্যায় সব ভাসিয়ে নিয়ে গেল, তারপর থেকে স্কুল বন্ধ হয়ে গেল।” তার দিকে তাকিয়ে বলল সরুকাকিমা।

সন্ধে হয়ে আসছে। বাইরে কোনও ঘর থেকে শাঁখের শব্দ শোনা যাচ্ছে। যাওয়ার আগে সরুকাকিমা তাকে বলল, “তুমি কিছু ভেবো না গো, দাদাবাবু। আমি দাদু এলেই ওকে তোমার কাছে পাঠিয়ে দেব সোজা। তোমার ঠাকুমা ভালো হয়ে যাবে দেখো।”

ফিরে যাওয়ার সময় সকলে অন্তুর সঙ্গে সঙ্গে ঘাটের কাছে অবধি এল। ওঠার সময় তার হাতের মুঠো খুলে জোর করে কিছু একটা গুঁজে দিল সরুকাকিমা। নৌকো ততক্ষণে ছেড়ে দিয়েছে। তার দিকে হাত নাড়তে নাড়তে সরুকাকিমা বলল, “আবার এস।”

হাত খুলে অন্তু দেখল, কতগুলো নারকেলের নাড়ু। তার গলার কাছে ভারী হয়ে উঠেছে। হঠাৎ তার মনে হল, সে অনেক বড়ো হয়ে গেছে।

কাঁদরসোনা ঘাটের কাছে জগন্নাথদাদু দাঁড়িয়ে ছিলেন। অন্তু তাকে সব খুলে বলল। তাকে সঙ্গে নিয়ে তিনি হাঁটতে লাগলেন বাড়ির দিকে। তাকে বললেন, “তোমার বাবাকে মোবাইলে ফোন করে দিয়েছি। কোনও চিন্তা নেই। কালই তোমাকে আমি নিজে গিয়ে গাড়িতে তুলে দেব। তোমার বাবা হাওড়ায় তোমাকে নামিয়ে নেবে। আর বলাইদাদুকে নিয়ে ভেবো না। সরুকাকিমা যখন বলেছে, বলাইদাদু তোমার ঠাকুমার সাথে দেখা করবেই।”

মুখুজ্যে-বাড়িতে পুজোর জন্যে তোড়জোড় শুরু হয়ে গেছে। কাল মহালয়া। দিলু আর বাকিদের সঙ্গে উঠোনে বসে ঢাকের শব্দ শুনতে শুনতে অন্তুর মন কেমন কমে যাচ্ছিল অনেকেটা।

রাতে অন্তু দিলুর সঙ্গে শোবে এক ঘরে। মশারির ভিতরে ঢুকেই সে চমকে দেখল, তার ব্যাগটা রাখা আছে শিয়রের কাছে। তাড়াতাড়ি খুলে দেখল সবকিছুই যেমন ছিল তেমনই আছে। শুধু একটা খামের ভিতরে কেউ রেখে গেছে একটা চিঠি। চিঠিটা খুলে সে পড়তে শুরু করল। চিঠিতে লেখা আছে –

‘দাদুভাই,

ট্রেনে তোমার ব্যাগ চুরি করেছিলাম আমিই। ব্যাগের ভিতর কমলার ছবি দেখেই চমকে উঠেছিলাম। তুমি যে কমলার নাতি সেটা বোঝার উপায় ছিল না। তারপর মনে পড়ল, তুমি কাঁদরসোনা যাবে। তখনই ব্যাপারটা আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে যায়। কাঁদরসোনায় জগন্নাথদাকে ফোন করে জানতে পারি, তুমি আমার খোঁজেই এসেছ। কিন্তু তোমাকে আমার এই পাপী মুখ দেখানোর সাহস আমি করতে পারলাম না, দাদুভাই। যখন তুমি আমার বাড়ি গিয়েছিলে তখন তোমার জগন্নাথদাদুর সঙ্গে দেখা করে আমি সবই জানতে পেরেছি। তোমার বাড়ির ঠিকানা নিয়েছি। কাল তোমার ঠাকুমার সাথে দেখা করে আসব। পারলে এই গরিব অসহায় বুড়োকে ক্ষমা করে দিও। বাড়ির খালিপেটা ছেলেমেয়েদুটোর মুখ চাইলে এই পাপ কাজ করতে আমার বাধত না। কিন্তু আর পারব না, দাদাভাই। আর কোনওদিন এ-কাজ করতে পারব না আমি, সে আমার যা হয় হোক। এই তোমাকে কথা দিলাম।

তোমার বলাইদাদু’

খামের মধ্যে রাখা আছে আরও কয়েকটা ছবি। দেখেই অন্তু চিনতে পারল ট্রেনের সেই ম্যাজিকদাদুকে যে তার সঙ্গে সম্পর্ক পাতিয়েছিল। কুচকুচে কালো রং, সাদা চুল তখন কালো ছিল, কিন্তু চোখটা উজ্জ্বল ছিল একইরকম। অন্তুর চোখের কোণ তার অজান্তেই জ্বালা করে উঠল।

আজ মহালয়া। সকাল থেকে ঢাকের শব্দ শুনতে পাওয়া যাচ্ছে। জগন্নাথদাদু আর দিলু তাকে বর্ধমান স্টেশনে গাড়িতে তুলে দিতে এসেছিল। জগন্নাথদাদু তাকে বলাইদাদু সম্পর্কে আর কিছু বলেননি। শুধু চোখ টিপে হেসে তার পিঠ চাপড়ে দিয়েছিলেন সকালে। জানালার বাইরে থেকে যাওয়ার আগে দাদু বলল, “দাদুভাই, ফিরবে তো?”

অন্তু বলল, “হ্যাঁ, এবার ফিরব সকলকে নিয়ে।”

প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে থাকা দিলু আর দাদুর দিকে তাকিয়ে রইল অন্তু হাত নাড়তে নাড়তে যতক্ষণ না তারা হারিয়ে গেল চোখের সামনে থেকে।

হাওড়া স্টেশনে বাবা তাকে নিতে এসেছিলেন। অন্তু একচোট ধমক আশা করেছিল, কিন্তু বাবা তাকে দেখেই বললেন, “তাড়াতাড়ি চল, অন্তু। তোর বলাইদাদু এসেছে। ঠাকুমা আবার আগের মতো কথা বলছে রে। তাড়াতাড়ি চল।”

অন্তু ভ্যাবাচ্যাকা হয়ে গেল। বলাইদাদু এসেছে? সত্যি? ঠাকুমা আবার ভালো হয়ে গেছে? যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বাড়িতে পৌঁছে ওরা দেখল, নিচে থেকেই শুনতে পাওয়া যাচ্ছে হাসির আওয়াজ। ঠাকুমা হেসে হেসে গল্প করছে বলাইদাদুর সঙ্গে। মা দাঁড়িয়ে আছে দরজার কাছে। তার মুখেও হাসি।

ঘরে ঢুকে অন্তু দেখল, ঠাকুমা কোনও একটা কবিতার লাইন আবৃত্তি করছে আর বলাইদাদু চোখ বন্ধ করে শুনছে হাসি মুখে।

কিছুক্ষণের মধ্যে কত স্মৃতি জীবন্ত করে তুলেছে বাড়িটাকে। অন্তু বলল, “পরের পুজোয় কাঁদরসোনা যাবে, বাবা? আর বলাইদাদুর বাড়িতে? সবাইকে নিয়ে?”

বাবা নিঃশব্দে তার মাথায় হাত রেখে ‘হ্যাঁ’ বললেন। ততক্ষণে ঘরের ভিতর হাসির রোল বয়ে যাচ্ছে। ঠাকুমার বয়স যেন এক ঝটকায় তিরিশ বছর কমে গেছে। একবার বলাইদাদু হেসে উঠছে, একবার ঠাকুমা। অন্তু অবাক হয়ে দেখল, মায়ের চোখে জল। বাবা হাত দিয়ে চোখ মুছছে। অন্তু বুঝল, এইবার পুজো সত্যি খুব ভালো কাটবে।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত