কাছের মানুষ

কাছের মানুষ

ডাক্তার বললেন, ” অনুমতি দিলে আপনার বাবাকে এবার মেরে ফেলতে পারি। ”
আমি ডাক্তার সাহেবের দিকে তাকালাম। আমার দষ্টিতে হয়ত অদ্ভুত কিছু ছিল, তাঁকে দেখলাম একটু থতমত খেয়ে গেছেন। তিনি আমার দিকে ভালো ভাবে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করছেন তাঁর কথাটা আমার কানে গিয়েছে কিনা।

আমি নিজেও বুঝতে পারছিনা তাঁর কথা আমার কানে গিয়েছে কিনা ! তিনি কি সত্যিই বাবাকে মেরে ফেলার অনুমতি চাইছেন আমার কাছে ? এটা কি করে হয় ! এত বড় একজন ডাক্তার এমন নির্লিপ্ত মুখে কাউকে মেরে ফেলার অনুমতি চাইতে পারেন! তিনি কি ডাক্তার না খুনি ? না, তিনি তো আমার অনুমতি চাইছেন। আমি অনুমতি দিলেই তিনি বাবাকে মারতে পারবেন। খুনি তো আমি !

আইসিইঊ’র ঝাপসা কাচের ভেতর দিয়ে বাবাকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছেনা। আরেকটা কাচের ক্যাপসুলের মত ছোট্ট একটা খুপড়ির মত বাক্সের ভেতর বাবাকে রাখা হয়েছে। তাঁর সারা শরীরে অসংখ্য নলের ছড়াছড়ি। মুখের উপর বড় একটা মাস্ক। ওটাই কি লাইফ সাপোর্ট ? ডাক্তারি এত ভাষা আমি বুঝি না। গতকালও কি আমি দেখলাম না বাবার বুকটা সামান্য উঠানামা করছিল? নাকি ভুল দেখেছিলাম ? আজ অনেকবার চেষ্টা করে দেখেছি কিন্তু কোনো নিঃশ্বাস নিতে দেখলাম না বাবাকে। এজন্যই কি ডাক্তারটা বাবাকে খুন করতে চাইছে ?

স্ট্রোকের আগে শেষ দিকে বাবার সাথে তেমন একটা কথাই হত না। নাহ, তার সাথে আমার কোনো ঝগড়া ঝাটি, মনোমালিন্য ছিল না। ঝগড়া করার, অভিযোগ করার হয়ত অনেক কিছুই ছিল। আক্ষেপ করে বলতে পারতাম, পরিসংখ্যানে সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়ে জীবনে কি এমন করতে পারলে তুমি ? আর তোমার ছেলেমেয়েদের বলো এখনো আমরা পড়ালেখার মূল্য বুঝি না ! অথর্ব শিক্ষাব্যবস্থার চরকি তে পড়ে চব্বিশ বছর চলে গেলেও এখনো একটা দু’পয়সার চাকরি জোটাবার মত সার্টিফিকেট জোগাঢ় করতে পারলাম না ! এত শিক্ষা কি দিল তোমাকে ? আমি বলতাম মামা-চাচা ছাড়া আজকাল কোথাও কিছু হয় না। বাবা বলত, নিজের যোগ্যতায় সবকিছু পাবে, যোগ্য হও। তখন আমি ঝগড়া করে বলতে পারতাম, হেহ্, অনেক যোগ্য তো তুমিও হয়েছিলে, পেরেছো নিজের স্ত্রী-সন্তানের জন্য কিছু করে রেখে যেতে ? কিন্তু কখনো বলিনি তো ! আমি হয়ত ঝগড়া করে বলতে পারতাম, তোমার মেয়েকে কলেজে যাবার সময় বাসে-ক্যাম্পাসে ভদ্দরলোকেরা গায়ের ধাক্কা লাগায়, স্মার্ট ছেলেরা ওড়না ধরে টান দেয়। তোমার আদর্শের বুলি আওড়াতে গিয়ে সারাজীবন তো রাজনীতিকে ঘৃণা করতেই শিখেছি, তাই সভ্য প্রতিবাদের ভাষা আমার জানা নেই। হয় তুমি কিছু কর না হয় আমার হাতে একটা অস্ত্র দাও ! ওদের কন্ঠনালীতে গিয়ে একটা গুলি করে আসি।…এসবওতো কখনো বলিনি ! তোমাদের শেখানো মত তোমার মেয়ে সবসময় মাথা নিচু করেই চলাফেরা করেছে, আর আমিও তোমার কথা মত চুপ থেকেছি। কারণ আমরা তো নিতান্তই মধ্যবিত্ত কুকুর ! লাথি খেয়ে, হজম করি।

আমিতো ঝগড়া করে বলতে পারতাম, বাবা ! আমার বন্ধুদের তাদের বাবারা সবাইকে কোনো না কোনো ভাবে প্রতিষ্ঠিত করে দিচ্ছে। কেউ বাবার জোরে চাকরি পাচ্ছে, কাউকে ব্যবসায় ধরিয়ে দিচ্ছে। আমি এখনো দিন গুনছি একটা সার্টিফিকেটের। কই কখনো বলিনি তো ! কারণ আমি জানি, মা বরাবরি তোমার বেতনের টাকা গুলোর দিকে করুণ চোখে তাকিয়ে ভাবে, “এতে কি সারা মাস চলবে !”

তারপরও কেন যেন বাবার সাথে কোনো কথা খুঁজে পেতাম না। ভাবতাম কি কথা বলব? আমি কি অনেক বড় হয়ে গিয়েছিলাম! নাকি অন্যরাও আমার মত, বড় হয়ে গেলে ভাবে বাবাদের সাথে আর কি কথা বলবে ? আচ্ছা কত বড় হলে বাবার সাথে কথা বলার কিছু খুঁজে পাওয়া যায় না ? বাবার ইনসমনিয়া রোগ ছিল। রাতে সারা ঘরে হাঁটাহাঁটি করত। প্রায়ই ফ্রিজ থেকে আপেল বের করে কেটে এনে অর্ধেকটা আমায় দিত বাকিটা বাবা খেতো। মাঝেমাঝে হেসে তাকাতাম, মাঝে মাঝে বিরক্তও হতাম, “উফ এত রাতে কেন এত হাঁটাহাঁটি কর !” আমাকে না দিয়ে রাতের বেলা কখনোতো আপেল খাওনি বাবা ! আমি কি একবারো তোমার জন্য কেটে নিয়েছি ? মনে পড়েনা।

বাবার দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে চারপাশে তাকালাম। প্রতিদিনের মত অবিচল ছায়া নিয়ে পাশে দাঁড়িয়ে আছেন ছোটমামা। বাবার বড় ভাইটাকে দেখতে পাচ্ছিনা। জ্যাঠু বলতে যাকে গলায় আটকায়। নিশ্চয় দলিল-দস্তাবেজ নিয়ে এরমধ্যে হিসেব শুরু করে দিয়েছেন। ভিটেমাটির কে কোনদিকে পাবে ! মাকেও দেখছিনা। অপলক ভেজা চোখে আর কত তাকিয়ে থাকবে ওই নিথর দেহটার দিকে ?

ডাক্তার এবার একটু স্পষ্ট করে বললেন, ” আপনি অনুমতি দিলে, পেশেন্টের লাইফ সাপোর্টা এবার সরিয়ে নিয়ে পারি। সবার সাথে তো ইতিমধ্যে কথা হয়েছে। তবুও আপনি যেহেতু একমাত্র ছেলে…..” তিনি কথাটা শেষ করলেন না। ছোটমামা মাথা নিচু করে আমার কাঁধে হাত রাখলেন। এবার তার কথা ঠিকই শুনতে পেলাম। প্রথমে আমিই ভুল শুনেছিলাম । আমাদের ডাক্তাররা অনেক ভদ্র সুশীল। “আপনার বাবাকে মেরে ফেলার অনুমতি দিন” টাইপের কথাবার্তা তাঁরা বলেন না।

মামার চোখের দিকে তাকালাম। অসহায় ছলছলে দৃষ্টি ! কি অদ্ভুত এক পরিবেশ ! সবাই গত দুই দিন ধরে বাবাকে ঘিরে অপেক্ষা করছে তার মৃত্যুর জন্য। গত একসপ্তাহ ধরে তাকে লাইফ সাপোর্ট দিয়ে রাখা হয়েছে। ডাক্তাররাও এখন নিশ্চিত এই লাইফ সাপোর্টের প্রয়োজনীয়তাও এখন ফুরিয়েছে। সবাই তাদের মত দিয়ে দিয়েছেন। মা অবশ্য কিছু বলেননি। অপলক চোখে শুধু চোখের পানি ঝরিয়েছে। তাই ডাক্তার সাহেব এখন আমার কাছে এসেছেন আমার অনুমতি নেয়ার জন্য। আমিইতো একমাত্র ছেলে ! আমার কথাই শেষ কথা ! এটা কি অনুমতি নাকি স্রেফ আনুষ্ঠানিকতা যে, আপনার অনুমতিতেই আপনার বাবাকে মেরে ফেলা হচ্ছে, এ সম্পর্কে আপনারা সজ্ঞানে সকলে অবগত !!!

বাবার দিকে আরেকবার তাকালাম। বাবা ! কখনো তোমার কথার সাথে দ্বিমত করিনি তো ! হাজার আক্ষেপ থাকলেও সবাইকে তো বুক ফুলিয়ে সমসময় বলেছি, “আমার বাবা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বাবা ”

বন্ধুর শুনে খুব অবাক হত যে, আমার বাবা আমাদের ভাই বোনের সাথে বসে একসাথে নাটক সিনেমা দেখত ! ওরা খুব হিংসে করত যে আমাদের কোনো কাজে তুমি কখনো বাঁধা দাওনি। কোনটা ভুল শুধু সেটা বুঝিয়ে দিয়েছ। ওরা বিশ্বাসই করতে চাইনি যে, আমি তোমাকেই সবার আগে বলেছি আমাদের ক্লাসের নীল টিপ পড়া মেয়েটিকে আমার খুব পছন্দ। ওরা ভাবতো এটা কি হয় নাকি ! বাবা বুঝি এমন হয় ? আমি তো জানি, আমার বাবাই প্রতি রাতে আপেল কেটে অর্ধেকটা আমার জন্য নিয়ে আসতো !

তাহলে কেন আমাকে এতো বড় শাস্তি দিচ্ছ বাবা ?? আমি এখন ডাক্তারকে কি বলব ? হ্যাঁ, সরিয়ে ফেলুন ওই যন্ত্র। মেরে ফেলুন বাবাকে। আমি তার খুনি ছেলে বলছি, মেরে ফেলুন বাবাকে !!
এও কি হয় বাবা ?? বল, এটাও কি সম্ভব ???

( পাদদীকাঃ আমার পরিবারের খুব কাছের কিছু মানুষ এখন এরকমই একটা অবস্থার ভেতর দিয়ে যাচ্ছেন। সবাই রোগীকে ঘিরে অপেক্ষা করছেন কখন তার মৃত্যু হবে। কি অদ্ভুত ভয়ংকর এক পরিস্থিতি, তাই না ? হাসপাতাল থেকে তাঁকে দেখে এসে এই লিখাটা মাথায় ঘুরছিল। বছর চারেক আগে এধরনের আরেকটা ভয়াবহ সময় পার করলেও আমার এখন বাবা সুস্থই আছেন। তবে এই বাবার প্রায় প্রতিটি বৈশিস্ট্যই আমার বাবার আছে। আমরাও নিতান্তই মধ্যবিত্ত একটি পরিবার। যে পরিবারে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বাবাটি থাকেন, যিনি প্রতি রাতে আপেল কেটে নিজে অর্ধেক খান, বাকিটা আমার জন্য নিয়ে আসেন !

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত