মায়াবতী

মায়াবতী

ভার্সিটির কনফেশন গ্রুপে সবেমাত্র একটা মেয়েকে কে ডেডিকেট করে পোষ্ট দেখছিলাম।
ক্যাম্পাসের জামগাছ তলায় আমি তখন ফোনে ব্যস্ত। শরীর ঘেমে একাকার। একবার নাকের ডগার উপর বিন্দু বিন্দু ঘাম গুলো সরাতে গিয়ে সামনের দিকে তাকিয়ে দেখি হালকা মেরুন রঙের পাঞ্জাবী পরা একটা ছেলে আমার দিকে এগিয়ে আসছে।

আশপাশে খেয়াল করে কাউকেই পেলাম না।তার মানে সে আমার কাছেই আসছে। চুলগুলো একপাশে সুন্দর করে গোছানো,মুখে সামান্য চাপা হাসি।এর চেয়ে অধিক হাসলে নিশ্চয় আইসক্রিমের মত গলে পড়ে যেত। মুখের গড়নেই অনুভব করা যায় ছেলেটার ভিতর একটা প্রেমিকসুলভ ব্যাপার আছে।
কেমন জানি অন্যমনস্ক হয়েই তার দিকে তাকিয়ে রইলাম।

মিস সুহাসিনী, এতটা আগ্রহ নিয়ে তুমি কি সত্যিই কিছু দেখো?

আমি কিছু টা লজ্জায় পড়ে গেলাম।প্রথম দেখায় কারো দিকে চেয়ে থাকাটা ভারী অন্যায়।কিন্তু আমার অন্যায়টাকে তুচ্ছ করে আমার অনুমতির অপেক্ষা না করে উনি পাশে বসে পড়লেন।

দেখো সুহাসিনী,এখন রাগ করে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থেকো না প্লিজ।আমি তোমাকে কিছু টা ভয় পায়।

ভয় পেলে সম্পুর্ণ পাওয়া উচিত।কিছু টা ভয় পেলে বাকিটা কি?

বাকিটা ভালবাসি।এই কিছু টাও ভালবাসি,মানে ভয় ভয় ভালবাসা।

একটু আনকমন লাগছে কথাগুলো।আপনাকে সম্ভবত আমার মা পাঠিয়েছেন? আর কিছু বলার থাকলে সেটা বলে তারপর চলে যান।

আমাকে নিশ্চয় অপছন্দ করেননি?

তা সত্য।এতক্ষণ আপনার দিকে চেয়ে থেকেছি,এটাও সত্য।কিন্তু,আমি একটু স্পেশাল কাউকে চাই। সেটা আপনি নন। আর কিছু বলার না থাকলে আসতে পারেন।

বলার নেই। কিন্তু একটা জিনিস দেওয়ার আছে।

একটা মোটা ডায়েরী আমার হাতে গুঁজে দিয়ে উনি উঠে দাঁড়ালেন। তারপর মাটির দিকে তাকিয়েই বললেন..
আমি চলে গেলে আমাকে অনুভব করতে শুরু করবে।তখন আমি আর তোমার সামনে আসব না। অনেক দিন,মাস,বছর অপেক্ষা করে তোমার সামনে এসেছি।

আর একটা শব্দও সে উচ্চারণ করল না।একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চুপচাপ চলে গেলেন।

ডায়েরীটা একপাশে পড়ে আছে। আমি আবার ফোনের দিকে মনোযোগ দিলাম।
পোষ্টটি অনেক গোছানো লাগছে।যার শুরু টা এমন..

মায়াবতী,
তোমাকে নতুন কোনো উপমা আমি দিতে চাই না।আমার কাছে তুমি আজন্ম মায়াবতী।এই কনফেশনটি পড়ার ঠিক আগের মুহূর্তে আমাকে তোমার সামনে পাবে।আমি জানি, তুমি আমাকে ফিরিয়ে দেবে। কতটা কষ্ট আর পরিশ্রম করে এই সময় আর কনফেশন টুকু মিলিয়েছি, তা তুমি নিশ্চয় অনুমান করতে পারছ?
আমি তোমাকে শুধুমাত্র ভালবাসতে চাই না।ভালবাসাও দিতে চাই না। আমি শুধু চাই,আমার ভালবাসার যত্নে তুমি ভাল থাকো।
ডায়েরীর পাতা খুলে তুমি নিশ্চয় কাদবে?
ওটার ভাজে তোমার স্পর্শ রেখে এসেছি।
বাকি প্রেমটুকু না হয় ভয়ে ভয়েই ডায়েরীর পাতাতেই মিশে যাক।”

এটা আমি কি পড়লাম ঠিক বুঝে উঠতে না পারলেও তা যে একটু আগের পাঞ্জাবী পরা ছেলেটার কাজ, সেটা অনুধাবন করতে পারছি।
ডায়েরীর পুরো পাতা জুড়ে ভালবাসি,ভালবাসি,
ভালবাসি মায়াবতী। প্রতিটা কথায় একটা করে তারিখ দেওয়া। ডায়েরীর মাঝের দিকে পুরনো কাচের চুড়ির টুকরো অংশ।

আমার জীবনের সবচেয়ে রোমাঞ্চকর স্মৃতিরা এসে জমা হলো।এই ছেলেটা সিয়াম ভাই.!
আমার সিয়াম। স্কুলের গেইটে প্রতিদিন যে ছেলে টা দারোয়ানের কাছে আমার জন্য একটি করে চিরকুটে লিখে যেত. “ভালবাসি মায়াবতী।”
শেষ দিন আমি তার কথা শুনেছিলাম মাত্র “আমি মায়াবতীকে ভালবাসি” ।
এর আগে সে আমার কাছে সম্পুর্ণই ধোয়াশা। হাতে সেদিন আমার কাচের চুড়ি। দারোয়ান আমার বাবাকে ডেকে ওর সাথে কি করেছিল তা আমার আজও অজানা। একটাবার তাকে দেখার জন্য আকুতি জানিয়েছিলাম। বাবার থেকে হাত ছাড়াতে গিয়ে চুড়ি ভেঙে হাত দিয়ে রক্ত পড়েছিল।
তাকে দেখার ভাগ্যটা আমার কোনোদিন হয়নি আর।শুধু জানতাম ওর নাম সিয়াম।

আজ সে আমার সামনে এসেছিল, তাও আবার আমাকেই বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে.!
আনমনেই চোখের কোণায় পানি জমে ভারি হয়ে এলো।সুখে নাকি কষ্টে সেটা অনুভব করার শক্তি এখন আমার নেই।

ফোনের মেসেজ বক্সে টুং করে আওয়াজ হলো। একটাবার দৃষ্টি ফেরাতেই স্ক্রিণে একটা অচেনা নাম্বারের টেক্সট জ্বলজ্বল করছে..

মায়াবতী,
হারিয়ে যেতে তো ভালবাসিনি।’

এই ছেলেটা আমাকে সম্পূর্ণ কনফিউজড করে দিচ্ছে।

চিৎকার দিয়ে কেঁদে ফেললাম..
“প্লিজ সিয়াম, আমি তোমার মত না।এতটুকুও সহ্য করতে পারি না।ভালবাসি, আমি তোমাকে ভালবাসি।প্লিজ,তুমি ফিরে এসো।”

একটু পরেই ক্লাসমেটরা সবাই আমাকে ঘিরে ধরে দাঁড়িয়েছে। অথচ, আমার লজ্জা,ভয়,সংকোচ কিছুই অনুভব হচ্ছে না।
ওরা চিৎকার দিয়ে বলছে..
Hat’s of Siam..
সিয়াম ভীড় ঠেলে একেবারে আমার সামনে দাঁড়াল।

এত চিৎকার করে কান্নার কি আছে? তোমার ফ্রেন্ডদের কাছে শুনেছিলাম তোমার লাল পদ্ম পছন্দ। ওটা আনতে গিয়ে একটু দেরী হলো।

মানে? তুমি এদের জড়ো করেছো?

জ্বি মায়াবতী।পরে তুমি যদি বিয়ের দাওয়াত ওদের না দাও,তাই আমিই জানিয়ে রেখেছি। ওরা পাশে না থাকলে তোমার ভার্সিটিতে আমি কি এতকিছু করতে পারতাম?

কিন্তু…

তোমার বাবা? তিনিই আমাকে পাঠিয়েছেন। প্রমাণ চাই?

আমাকে কিছু জিজ্ঞাসা না করেই সে বাবাকে কল দিয়ে আমার কাছে ফোন দিলো। ওপাশে বাবা বলছেন..
“ছেলে পছন্দ হয়েছে?না হলেও ওকেই তোর বিয়ে করতে হবে।ও তোকে অনেক ভালবাসে।”

বাবা ফোন কেটে দিলেন।আমি কিছু প্রশ্ন করার আগেই সিয়াম এক হাতে আমার ঠোট চেপে ধরে চুপ করিয়ে দিয়ে অন্য হাতে লাল পদ্মগুলো এগিয়ে দিয়ে বলল..
“মায়াবতী,হয় আমাকে গ্রহণ করো,
নয়তো নিজেকে উৎসর্গ করো।
দুটো অপশনেই আমি তোমার,
তুমি আমার।”

সিয়াম,এত রোমান্টিকতা ছেড়ে আগে আমার কনফিউশন দূর করো।বাবা সেদিন তোমায় কি বলেছিলেন?

মায়াবতী,
সব রহস্য জানলে জীবন বা গল্প কোনোটাই সুন্দর থাকে না।
অন্য কিছু প্রশ্ন করো।

আমি ততক্ষণে চোখ বন্ধ করে ওর হাত দুটো আলতো করে ধরে অনুভব করার চেষ্টা করছি..
ও মায়াবতীর মায়াবত নাকি মোহ.!

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত