ভজহরি – নামটা কোনওকালে তার বাপ-মা দিয়েছিল। কালক্রমে হরি লোপাট হয়েছে। এখন শুধু ভজ। আমাদের ভজমামা। সে আমার বাবারও মামা। দাদুরও মামা, আমারও মামা – ভজমামা। ওই ভোলেবাবার মতো। যেমন সবাই বলে – ‘ভোলেবাবা পার করেগা’। আমরাও সকাল থেকে উঠে বলতে থাকি, ভজমামা পার করেগা। দাদু চ্যাঁচায়, “ভজমামা, আমার লাঠি কোথায়? আমার মাফলার কোথায়?”
ভজমামা দাদুকে তৈরি করে নিয়ে চলল মর্নিং ওয়াকে। ফিরে এসেই ঠাম্মুর ডাক পড়ে যায়। “ভজমামা, আমার স্নানের জল গরম হল? গতকাল যে শাড়িতে মাড় দিয়েছিলি ওটা ইস্তিরি করা আছে?”
না থাকলেও ভজমামা রাজধানী এক্সপ্রেস চালিয়ে করে দেয়। ঠাম্মুর কড়কড়ে পাটপাট লালপাড় সাদা শাড়ি নিয়ে ভজমামা নিমেষে হাজির। রান্নাঘরের তদারকিতেও ভজমামা। রান্নার মাসি বিমলাকে সমানে বকতে থাকে। “এই বিমলা, খবরদার, লঙ্কাগুঁড়ি দিবি না। কাঁচালঙ্কায় রান্না কর।”
বিমলা রেগে গিয়ে বলে, “ভজমামা, তুমি রান্নাটা করলেই তো পার।”
মা স্কুলের জন্য তৈরি হয়ে খাবার টেবিল বসেছে। মা শুনে বিমলার উপর চ্যাঁচায়, “এই বিমলা, ভজমামা এ-বাড়ির চাকর নাকি যে তুই ওর সাথে অমন করে কথা বলিস?”
ভজমামা একগাল হেসে বলে, “সোনা মা, তুমি রাগ করছ কেন? বিমলা ইয়ার্কি করে রোজই অমন বলে থাকে। কিন্তু ও ভুল কথাও বলেনি গো। আমার রান্না কি খারাপ?”
মা বলে, “আমার চেয়ে ঢের ভালো রান্না করিস। কিন্তু বিমলাই রান্না করবে। তুই হলি এ-বাড়ির ভজমামা।”
ভজমামা হাত কচলাতে কচলাতে বলে, “কাল তো শনিবার, জামাইদাদা আসছে। কাল আর রবিবার আমি রান্নাটা করি?”
মা হেসে মাথা নাড়ায়। “আর বিমলার কী হবে!”
ভজমামা খুব উৎসাহিত হয়ে বলে, “বিমলার নেমন্তন্ন। এই বিমলা, দুপুরবেলায় চলে আসিস। বাঙাল মামার রান্না খেয়ে যাস।”
ভজমামা বাঙাল বলে ভীষণ গর্ব। আর আমাদের গর্ব আমরা ভীষণ ভালো ভালো খাবার খাব বলে। ভজমামা আমাদেরও খবর নিতে ছাড়ে না। “কী রে সোনু-মনু, আজ কি স্কুলে যাবি না? সোনা মা বেরিয়ে গেল, তোদের টিকি নেই।”
আমিও বেণী দুলিয়ে তৈরি। মোড়ের মাথায় সোনুর স্কুল বাস আসে। ভজমামা সোনুকে বাসে তুলে দেয়। আমার স্কুলটা পাড়াতেই। কিন্তু ভজমামার কাছ থেকে ছাড় নেই। তাই ভজমামার সঙ্গে স্কুল যেতে হয়।
তোমরা ভাবছ, কে এই ভজমামা, যার কথা এতক্ষণ ধরে বলে গেলাম? ভজমামা হল আমার মায়ের গ্রাম-সম্পর্কের এক দিদার ছেলে। না, রক্তের সম্পর্ক নয়, প্রাণের সম্পর্ক। দিদা মানে থুড়থুড়ে বুড়ি নয়। দিদা ষোলো বছর বয়েসে ভজহরিকে নিয়ে বিধবা হয়েছিল। তারপর ভজহরি যখন দশ বছরের, দিদাও মরে গেল। লোকে বলত, ডাইনিতে খেয়েছে। কেউ জানল না, না খেয়ে খেয়ে শুকিয়ে মরেছে। আমার মা শহুরে মানুষ। বিয়ের পর প্রথমবার গ্রামের বাড়িতে গিয়েছিল। অষ্টমঙ্গলায় গ্রামের বাড়ির মন্দিরে পুজো দিতে হয় এটাই মামাবাড়ির নিয়ম। তখন ওই ভজহরি ভবঘুরের মতো রাস্তায় ঘুরে বেড়াত। আমার মায়ের দেখে খুব খারাপ লেগেছিল। ভজহরিকে শ্বশুরবাড়িতে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিল। বাবাও ভজহরিকে দেখে ভালোবেসে ফেলেছিল। ভজহরি আমার মাকে সোনা-মা বলে ডাকে প্রথম দেখা থেকেই। আর বাবাকে জামাইদাদা। কিন্তু ভজহরি কেউ ডাকে না। সে মার গ্রাম-সম্পর্কের মামা। তাই ভজমামা। বাবাও তাই ডাকে। দাদু, দিদা সবাই আদর করে ভজমামাই ডাকে। মা অনেক পড়াশোনা শেখাবার চেষ্টা করেছিল। স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছিল। কিন্তু ভজমামার মাথাটা নিরেট গোবর। ক্লাস ফাইভের পর আর এগোল না। তিনবার এক ক্লাসে থেকে বাড়িতে এসে ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কেঁদে মাকে বলেছিল, “আমি আর স্কুল যাব না। সবাই আমায় ক্ষ্যাপায় ফেলু ছেলে বলে।”
ভজমামা একটু বড়ো হলে বাবা কাপড়ের দোকানে ঢুকিয়ে দিয়েছিল। সেখান থেকেও সপ্তাহ না ঘুরতেই আউট। ভজমামা নাকি দোকানের সব কাপড় বের করে খরিদদারকে দেখিয়ে আর গোটাতে পারেনি। ভজমামা বলে, “এতে আমার কী দোষ? খরিদ্দার এটা দেখব, ওটা দেখব বলে সব নামাতে বলে। আর শেষে কিছুই নেয় না। মালিক রেগেই আগুন।”
আরে, খরিদ্দার দেখেই বোঝা যায়, কে নেবে আর কে নেবে না। কিন্তু আমাদের ভজমামা অত তো চালাক নয়। তাই তার ডিউটি এখন ঘর সামলানো। এতেই ভজমামা সন্তুষ্ট।
আজ বাবা এসেছে। শনিবার বাবা নিজের কর্মক্ষেত্র পুরুলিয়া থেকে চলে আসে। আমাদের সঙ্গে রবিবার ছুটি কাটিয়ে সোমবার ভোরে ফিরে যায়। ভজমামা আজ সকাল থেকে ব্যস্ত। বাবাকে আজ সাতদিনের খাওয়া খাওয়াবে। “জামাইদাদা, আর দু’খানা লুচি দিই?” আর সঙ্গে আছে সিদল শুঁটকি। এটা আসলে পুঁটিমাছের শুঁটকি। এ-সব আসামে ভালো পাওয়া যায়। পাশের বাড়ির কাকিমার বাপের বাড়ি আসাম। কাকিমা এবার আসাম থেকে নিয়ে এসেছেন। আমরা অবশ্য ভজমামার পাল্লায় পড়ে শুঁটকিমাছ খাওয়া শিখে ফেলেছি। ভজমামা সিদল শুঁটকির চাটনির রেসিপি কাকিমার কাছ থেকে জেনে নিয়েছে। যতই হোক, ভজমামা বাঙাল। হাতে মনে হয় জাদু আছে। আমরা লুচি আর সিদল শুঁটকির চাটনি বেশ তারিয়ে তারিয়ে খাচ্ছি। বিমলা একটু বেলা করেই এসেছে। ভজমামা বিমলাকেও খেতে দিল। কিন্তু শুঁটকির গন্ধ সে তো একটু থাকেই। বিমলা রান্নাঘর থেকে বাথরুম দৌড়াল ওয়াক ওয়াক করতে করতে। ভজমামা হেসে বলে, “জন্মে শুঁটকি খাসনি?”
বিমলা রেগে গিয়ে বলে, “দরকার নেই তোমাদের বাড়ি নেমন্তন্ন খাওয়ার। তোমরা সবাই শুঁটকি।”
বিমলা গজ গজ করতে করতে চলে গেল। ভজমামা ডেকেই চলেছে, “ওরে বিমলা, আয় তোকে ইলিশ ভাপা খাওয়াব, কচুর শাকের ঘণ্ট খাওয়াব।”
কে কার কথা শোনে। বিমলা চম্পট।
হরিদ্বার থেকে ফোন এসেছে, ঠাম্মুর গুরুদেব আসছেন। তিনি হলেন ভগবানের সমান। আমাদের ঘর, বিছানা, বাসন তিনি কিছুই ধরবেন না। তাই তিনি আসার তিনমাস আগে থেকে ব্যবস্থা হচ্ছে। ছাদে একটা নতুন ঘর হল। একটা নতুন বাথরুম, নতুন বাসন এল। নতুন খাট, বিছানা – এলাহি কারবার। মনে হচ্ছে, ঘরে নতুন জামাই আসছেন। তদারকিতে ভজমামা। ঘরটার নাম হয়েছে গুরুদেবের ঘর। পেল্লাই একটা ঘর। তাতে একপাশে রান্নার ব্যবস্থাও। গুরুদেব সবাইকে নিজের হাতে রান্না করে কৃষ্ণসেবার প্রসাদ খাওয়ায় দিনে দু’বার। সেটাই গুরুদেবের প্রসাদ। কিন্তু নিজে কিছু খান না। যখন কোনও ভক্তের বাড়ি যান শুধু তুলসী আর জল খেয়েই টানা দশদিন থেকে যান। দশদিনের বেশি অবশ্য থাকেন না তিনি।
নির্দিষ্ট দিনে গুরুদেব এলেন তার এক চ্যালার সঙ্গে। আর অনেকে নিমন্ত্রিত। সবার সঙ্গেই গুরুদেব পরিচয় করলেন। এবারে বাবা, মা দীক্ষা নেবেন। আর ভজমামারও ইচ্ছে সে দীক্ষা নেয়। কিন্তু কে জানে, গুরুদেবের মনে হয় ভজমামাকে ঠিক পছন্দ হয়নি। বাবার কানে ফিসফিস করে বললেন, “তোমাদের পরিবারের নয় তো।”
রক্তের সম্পর্ক না হলেও ও আমাদের পরিবারের একজন। কথাটা ঠিক ভালো লাগল না গুরুদেবের, “এই ভজা, তোর দীক্ষা আমি দিতে পারব না। অন্য কোথাও নিয়ে নিস।”
ভজমামার মাথা গরম। এত বড়ো অপমান কেউ করেনি। একেবারে ভজা! দীক্ষা দিক বা না দিক কিন্তু ভজা? ভজমামাও প্রতিশোধের তক্কে তক্কে থাকল।
প্রতিদিন সকালে গুরুদেবের ঘরে সূর্য ওঠার আগে দশ কেজি দুধ, চাল, ডাল, সবজি পৌঁছে যায়। গুরুদেব সবার অলক্ষে নিজে রান্না করে কৃষ্ণসেবা করেন। আর সূর্য যখন মাঝ গগনে তখন দরজা খুলে যায়। সবাই প্রসাদ পায়। আর এই উপকরণ-সামগ্রী পৌঁছায় ভজমামা।
প্রায় পাঁচদিন কাটলে একদিন ভজমামা গুরুদেবের ঘরে পৌঁছেছে। এমন সময় লোডশেডিং। সেই সুযোগে ভজমামা সোজা খাটের তলায় লুকিয়ে পড়ল। একটু পরেই অবশ্য কারেন্ট এল। গুরুদেব তো আর ভজমামাকে দেখেনি। ব্যস, এরপর যা ঘটল! ভজমামা দেখে, শিষ্য আর গুরু মিলে দুধ নিয়ে কাড়াকাড়ি। শিষ্য ক্ষোভ প্রকাশ করছে, “আপনি কী ভেবেছেন? দুধ, মাখন, পায়েস সব একাই খাবেন? আর আমি প্রসাদের নামে অবশিষ্ট পাব? চলবে না।”
শিষ্যর নাম মনে হয় পঁচা। গুরুদেব হুঙ্কার দিলেন, “এই পঁচা, বেশি রংবাজি মারিস না আমার কাছে। আমি যদি তোকে রাস্তা থেকে না উদ্ধার করতাম, তোকে তাহলে ওই ভজার মতো চাকরগিরি করতে হত।”
ভজমামার এবার দ্বিগুণ মাথা গরম হল। ভজমামার পকেটে জোলাপের বড়ি ছিল। ওটা ঠাকুমার ঘরে রাখার কথা ছিল। ভুলে পকেটেই রয়ে গেছে। পাঁচটা বড়ি সুযোগ বুঝে দিল দুধের মধ্যে ঢেলে।
এদিকে ঝগড়া থেমে এখন দুধ ফুটছে। গোবিন্দভোগ চাল, কাজু, কিশমিশ সব একে একে যুক্ত হচ্ছে। চারদিকে সুগন্ধ ছড়াচ্ছে। গুরু আর শিষ্য মিলে পায়েস নিয়ে বসেছে। এদিকে golpobhojomama02
ভজমামা সুযোগ বুঝে জানালা দিয়ে সোজা ছাদে এসে গুরুদেবের বাথরুমে। কারণ, এর পরের পর্ব ভজমামার জানা আছে।
সূর্য উঠে চারদিক আলো হয়ে গেছে। এদিকে গুরুদেব আর তার শিষ্য সমানে বাথরুমের দরজায় ধাক্কা মারছে। “ওরে কে আছিস, বেরো শিগগিরি! আর পারছি না তো!”
চ্যাঁচামেচি আর ধাক্কার চোটে আমরা সবাই ছাদে। মা অবাক হয়ে বলল, “কী হয়েছে, গুরুদেব?”
“আর কী হয়েছে! মা গো বাথরুম নাই আর?”
ঠাকুমা ব্যস্ত হয়ে বলল, “হ্যাঁ, আছে তো। কিন্তু ওতে আপনি যাবেন? আর এই বাথরুমে ঢুকল কে?”
বাবাও চিৎকার করতে থাকে, “চোর নাকি? লুকিয়ে আছে।”
ভিতর থেকে ভজমামার গলা পাওয়া যায়, “আমি গো, তোমাদের ভজমামা।”
গুরুদেব রেগে বলেন, “ওরে ভজা, বেরো এক্ষুনি।”
“না, বেরবো না।”
গুরুদেব উপায় না দেখে বলে, “ও আমার সোনা ভজমামা, একবারটি বাইরে এস। পায়েস যে আমার পেটে নাচছে!”
golpobhojomama03এবার ভজমামা হাসিমুখে বেরোয়। তার মনোকামনা পূরণ হয়েছে। কিন্তু সবাই অবাক। গুরুদেবের পেটে পায়েস? গুরুদেব তখন বাথরুমে ব্যস্ত। আর তার শিষ্য নিচে আমাদের বাথরুমে ব্যস্ত। ভজমামা সবাইকে ঘটনাটি খুলে বলে। ঘরে তখনও এঁটো বাটি পড়ে রয়েছে। তাই কারোর বুঝতে অসুবিধে হয় না।
গুরুদেব কাঁচুমাচু মুখে বাথরুম থেকে বেরিয়ে এক কোনায় দাঁড়িয়ে থাকেন। আর দাদু বলে, “ভজমামা, ওদের হরিদ্বারে ফেরার টিকিট কেটে দিবি কালই। আজ বরং কাঁচকলার ঝোল রেঁধে খেতে বল।”
ভজমামা উৎসাহিত হয়ে বলে, “গুরুদেবকে আর কষ্ট করতে হবে না। আমি রেঁধে দেব, গুরুদেব।”
দাদু হাসতে হাসতে বলল, “আজ তুই রান্না করবি কী? আজ না তোর জন্মদিন? সোনা-মা আজ তোর জন্য পায়েস করবে।”
ভজমামা মাথা নিচু করে বলল, “আমার জন্মদিনে যদি উপহার চাই তো দেবে, দাদু?”
সবাই অবাক হল। এ তো বছরে কখনও কিচ্ছুটি চায়নি। আজ সে উপহার চাইছে। দাদু হেসে বলল, “বল, কী চাস।”
ভজমামা মাথা চুলকে বলল, “গুরুদেবের সেবায় তো বিস্তর খরচ হয়েছে। আজ না হয় ওই রাস্তার ছেলেমেয়েগুলোকে একটু পেট ভরে খাওয়াবে? এটাই আমার উপহার।”
দাদু বুকে জড়িয়ে ধরল ভজমামাকে।