আজকাল আর কলম চুরি হয় না, বড়োজোর হারিয়ে যায়। এই তো সেদিন ব্যাঙ্কে একজন হাতে একটা পে-ইন-স্লিপ নিয়ে আমার কাছে কলম দেখতে পেয়ে, ‘দাদা পেনটা একটু দেবেন’ বলে নিয়ে লিখতে শুরু করল। লিখতে লিখতেই আবার অ্যাকাউন্টেন্টের টেবিলে গিয়ে কথা আরম্ভ করল। ইতিমধ্যে আমার লাইন এগিয়ে কাউন্টারে চলে এলাম। টাকা নিয়ে গোনাগুনতি শেষ করে ব্যাঙ্ক থেকে বেরিয়ে সোজা বাড়ি। ফিরে এসেই মনে পড়ল, কলমটা তো ফেরত নিয়ে এলাম না, গেল। কত কলম যে কতরকমভাবে হারিয়েছি তার ঠিক নেই। একজন বন্ধু ভালো উপদেশ দিয়েছিল। বলেছিল, “পেনের ঢাকনাটা খুলে রেখে তারপর দিবি।” এটা তো ভালো বুদ্ধি! তাই করেছিলাম একবার পোস্ট অফিসে গিয়ে। এবার বাড়ি ফিরে দেখি পকেটে শুধু ঢাকনাটাই আছে, বাকি অর্ধেক আসেনি। পাঁচ-দশ টাকার ডটপেন তো – কিনেছি অনেক, বিভিন্ন সেমিনারে পেয়েছি অনেক, হারিয়েছিও অনেক। কিন্তু হলফ করে বলতে পারি, চুরি যায়নি। হ্যাঁ, চুরি যেত। পকেটমার হত আমাদের ছোটোবেলায় – ফাউন্টেন পেন যাকে বাংলায় বলত ঝর্ণা কলম। আমরা অবশ্য বলার সময়ে ফাউন্টেন পেন বা শুধু কলম বলতাম। অন্নদাশঙ্কর রায়ের ছড়াটা মনে পড়ল –
কলম কিনি চোরকে দিতে,
চোর যে আমার প্রাণের মিতে
বুক পকেটের পাঞ্জাবীতে
কলম রাখি চোরকে দিতে।
শার্ট বা পাঞ্জাবীর বুক পকেটে দামি গোল্ড ক্যাপ পেনের ক্লিপ উঁকি মারছে। পকেটমারের দোষটা কোথায়, নেবে নাই বা কেন? ফাউন্টেন পেনের দিন গেছে এখন। তার জায়গা অধিকার করেছে স্মার্টফোন। পকেটমারেরাও তাই কলম ছেড়ে স্মার্টফোন ধরেছে। কতরকম সুন্দর সুন্দর কলম ছিল তখন। আমরা তো ছোটোবেলা থেকে ফাউন্টেন পেনেই লিখে এসেছি। স্কুলজীবনে ছিল প্রেসিডেন্ট, রাইটার, উইলসন নয়তো অলিম্পিক। দামি কলম বলতে জানতাম জাপানি পাইলট-সুপার আর পার্কার। পরে একটু বড়ো হয়ে নাম শুনেছি ওয়াটারম্যান, শেফার, স্নাইডার পেলিকান, লেমি, মঁ ব্লাঁ, সেইলর সব দামি দামি বনেদি বিলেতি কলমের নাম। স্বপ্ন ছিল, চাকরি করে ওরকম কলম কিনব।
আমার বাবার ছিল একটা পার্কার ফিফটি ওয়ান কলম। নীলচে ছাই রঙের, রোল্ড গোল্ডের ক্যাপ। মুখের কাছে একটা ছোট্ট ফুটো দিয়ে শুধু নিবের সোনালি টিপটা বেরিয়ে থাকত। নিবের সাথে চেপ্টে থাকা কালো ফিডের ডগাটা একটু দেখা যেত। একে বলা হত ‘হুডেড নিব’। কলমটার পেছনের ফিনিয়েলটা ছিল একটা ছোটো ব্লাইন্ড ক্যাপ। সেটা খুললে বেরোত একটা পিস্টনের ডাঁটি। কালি ভরার সময়ে কলমের নিবের মুখটা বোতলের কালিতে ডুবিয়ে পিস্টনের মাথার চাকতিটা বুড়ো আঙুল দিয়ে পাম্প করে কালি ভরতে হত। এ জাতীয় কালি ভরার পদ্ধতিকে বলে ভ্যাকুমেট্রিক ফিলিং।
কলম একটা দেখেছিলাম বটে আমাদের বালিগঞ্জ গভর্নমেন্ট হাই স্কুলের অ্যাসিস্ট্যান্ট হেডস্যার উমাপতিবাবুর। স্যারের কথা বলতেই মনে পড়ে গেল চেহারাটা। মাঝারি লম্বা, খাড়াইয়ের সাথে তাল মিলিয়ে পাশ। কালো মোটা ফ্রেমের চশমা। রীতিমতো রাশভারী দশাসই চেহারা। সেই অনুপাতে তাঁর হুঙ্কার। দারোয়ানের ঘন্টা বাজানো আর স্যারের গলা স্কুলের সব ক্লাস থেকে শোনা যেত। কোঁকড়ানো ঠাসা মাথার চুল – অল্পই পাকা, মানানসই গোঁফ। সাদা ধুতি আর সাদা শার্ট পরতেন। পায়ে মোজা ছাড়া কালো চামড়ার কাবুলি জুতো। সুখতলার হিলটা খুব ভিড় দোতলা বাসের মতন একদিকে হেলে গেছে। বুক পকেটে কলমের চকচকে ক্লিপটা উঁকি মারছে। অদ্ভুত ছিল বটে স্যারের কলমটা। ক্যাপ খুললে নিব দেখা যেত না। ক্যাপটা কলমের পেছনে লাগিয়ে ঘোরালে পর পুরো নিবটা ঘুরতে ঘুরতে বেরিয়ে আসত। আবার লেখা শেষ হলে উল্টোদিকে ক্যাপ ঘোরালে নিবটা ভেতরে ঢুকে যেত। যখনই স্যারের ঘরে যেতাম কেবল লক্ষ করতাম স্যার কখন কলম বার করে লিখবেন।
আমাদের কলমে অবশ্য এতসব কায়দা ছিল না। নিবের সেকশনটার প্যাঁচ খুলে ব্যারেলে ড্রপার দিয়ে কালি ভরতাম। তারপর যত টাইট করে আবার সেকশনটা লাগাতাম না কেন, কী করে জানি না কালি লিক করতই। তর্জনী, মধ্যমা আর বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ সদা সর্ব্বদা মসীলিপ্ত থাকত। স্কুলের সাদা জামার বুকপকেটের নিচটায় প্রায়শই থাকত গোলাকার কালির ছাপ। লেখার সময়ে আবার বেশি কালি এসে যেত, লেখা শুকোতে সময় লাগত। তার জন্য ছিল সাদা ব্লটিং কাগজ। আবার ছিল কাঠের ইংরেজি ডি অক্ষরের মতন ইঙ্ক-ব্লটার, মাথায় বল্টু লাগানো। ডাক্তাররা ওষুধের বিজ্ঞাপন দেওয়া গোলাপি রঙের কার্ডের মতন ব্লটিং কাগজ পেত। আমার এক ক্লাসের বন্ধুর বাবা ডাক্তার ছিল। ও একবার আমাকে কয়েকটা এনে দিয়াছিল। কালি বলতে ছিল ‘সুলেখা কালি’। একসময়ের নামকরা বাঙালি প্রতিষ্ঠান। ভাবতে দুঃখ লাগে, ১৯৩৮ সালের প্রতিষ্ঠিত অত বড়ো সংস্থা আশির দশকের শেষে স্রেফ শ্রমিক অসন্তোষের জেরে বন্ধ হয়ে গেল। এখন সেখানে বহুতল-বিশিষ্ট অভিজাত কন্ডোমিনিয়াম।
বাবা অবসর নিলে পর আমি জানি ঐ পার্কার কলমটা আমিই পাব। তবে তার বহু আগে কলমটা নিব ক্ষয়ে ভালো লেখা যেত না। অনেকদিন পড়ে ছিল আলমারিতে। আমি একদিন চেষ্টা করলাম খুলে জলে ধুয়ে পরিষ্কার করার। খুলতেই পারলাম না। সেই আলমারিতেই পড়ে রইল বহুবছর। তারপর যে সেটা কোথায় হারিয়ে গেল আর পেলামই না।
সত্তরের দশকের প্রথম দিক। কলেজে পড়ি। এই প্রথম একটা ভালো কলম পেলাম – উইং সাং – চাইনিজ কলম। কালচে সবুজ ব্যারেল আর সোনালি ক্যাপ। ব্যারেল খুললে ধাতব টিউব – পেটের দিকে ইঞ্চিখানেক কাটা। ভেতরের ল্যাটেক্সের টিউব যাকে বলে ‘ইঙ্ক স্যাক’ আর কাটা যায়গায় আলাদা ধাতুর সরু পাত। ঐ পাতে ল্যাটেক্সের টিউবে চাপ দিয়ে কালি ভরতে হত। এর নাম ‘এরোমেট্রিক’ পদ্ধতি। কলমটা দেখতে অনেকটা বাবার পার্কারটার মতন। আমার খুব পছন্দের কলম ছিল। পরে অবশ্য আরেকটা চাইনিজ কলম কিনেছিলাম ‘কিন সিন’। এই দুটো কলমই আমাকে আমার ছাত্রজীবনের শেষ দুটো ধাপ পার করে দিয়েছিল।
একট কথা মনে হলে আজও আমার খুব মজা লাগে আর হাসি পায়। ১৯৭১ সাল, বিএসসি পার্ট ওয়ান পরীক্ষা সবে শেষ হয়েছে। লিন্ডসে স্ট্রিট থেকে বেরিয়ে গ্র্যান্ড হোটেলের আর্কেডের নিচ দিয়ে ধর্মতলার দিকে যাচ্ছি। দু’পাশে হকাররা যত ফরেন গুডসের পসরা সাজিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কত কত সেন্ট, লাইটার, ক্যামেরা, ছাতা, সেভিং লোশন আরও সব কত কী। দেখতে দেখতে যাচ্ছি। হঠাৎ একটা একটু বেঁটে কালো লোক সাদা পায়জামা আর শার্ট পরা – মুখে চোখে কীরকম চোরা চোরা চাউনি আমার প্রায় গা ঘেঁষে হাতটা দিয়ে মুখ আড়াল করে ফিস ফিস করে বলল, “ভালো চাইনিস পেন আছে।”
আমি এদিক ওদিক তাকিয়ে আস্তে বললাম, “কত?”
লোকটা আমাকে ইশারা করে একটু সাইডে নিয়ে বলল, “লাস্ট এই একটাই আছে, আশি টাকা। তা আপনি সত্তর টাকা দিন।”
আমি আবার এদিক ওদিক কেউ দেখছে কি না দেখে নিয়ে লোকটার প্রায় কানের কাছে ফিসফিস করে বললাম, “আমাদের পাড়ার বইয়ের দোকানে এখনও গোটা দশেক আছে, তিরিশ টাকা করে। এনে দেব?”
লোকটা সাঁট করে ঘুরে চলে গেল।
সত্তরের দশকের শেষদিক থেকে ফাউন্টেন পেন ব্যবহার করা বন্ধ হয়ে গেল। তখন ডট পেনের রমরমা রাজত্ব শুরু হয়ে গেছে। ফাউন্টেন পেন অস্তমিত। কালি শুকিয়ে, ইঙ্ক স্যাকের রাবার গলে আমার চাইনিজ পেনগুলো একদিন জঞ্জালের সাথে বাড়ি থেকে বিদায় নিল। বড়ো হয়ে চাকরি করে দামি বিলিতি কলম কিনব – সে স্বপ্নের আর বাস্তবায়ন হল না। ভালো ফাউন্টেন পেনের শখটাও কোথায় মিলিয়ে গেল। মনে পড়ে, ছোটোবেলায় অনেক দোকান ছিল যারা শুধু কলম, চশমা আর ঘড়ি বিক্রি করত। সাইনবোর্ডে বড়ো বড়ো করে লেখা থাকত P E W (পেন আই ওয়াচ)। সে সমস্ত দোকানও পরবর্তীকালে আর চোখে পড়ত না।
কেটে গেল অনেকগুলো বছর। তা প্রায় বছর বিশেক তো হবেই। সংসার-সাগরে ভাসমান চল্লিশোর্দ্ধ প্রৌঢ়ত্বের দোরগোড়ায় তখন কাঁচা-পাকা বাবুটি। সেদিন গ্র্যান্ড হোটেলে একটা সেমিনার শেষ হলে পর বেরিয়েছি। বাটার দোকানের সামনে একটা হকারের পসরাতে দেখি চাইনিস হিরো পেন। আমার পুরনো শোক হঠাৎ উথলে উঠল। ভারি সুন্দর রঙটা – সাদাটে রূপালি। হুডেড নিব। লোভ সামলাতে পারলাম না। আরও একটা উজ্জ্বল কমলা রঙের কলম ছিল। বার্মিস কলম – নাম মায়াওয়াদি। এটাও বেশ পছন্দ হল। দরদাম করে দেড়শো টাকায় দুটো কিনে নিয়ে এলাম। পাড়ায় স্কুল স্টেশনার্সের দোকানটা থেকে রয়াল ব্লু আর কালো কুইঙ্ক কালি কেনা হল। শুরু হল নতুন করে ফাউন্টেন পেনে লেখা। সত্যি, ডট পেনে লেখা আর ফাউন্টেন পেনে লেখার মধ্যে কী আকাশপাতাল তফাত এ একমাত্র ফাউন্টেন পেন প্রেমী ছাড়া কাউকে বোঝানো যাবে না। ফাউন্টেন পেনে লেখার আভিজাত্যই আলাদা। আর ডট পেনে লিখতে গেলে মনে হয় তলায় তিন-চারটে কার্বন পেপার রেখে গোডাউন থেকে চালান কাটছি।
আমার কর্মজীবন কাটে ল্যাবরেটরির চার দেওয়ালের মধ্যে। মাঝে মাঝে তিমিমাছের শ্বাস নেবার মতন এদিক ওদিক সেমিনার, ওয়র্কশপ, কনফারেন্স। ঠিক বেড়াতে যাওয়াটা হয় না। আমার ঘনিষ্ঠ সহপাঠী মাঝে মাঝেই হিমালয়ে চড়াই-উৎরাই করে। সেবার তার সঙ্গ ধরলাম গঙ্গোত্রী পেরিয়ে গোমুখ। উপাসনা এক্সপ্রেসেই আলাপ হল ভদ্রলোকের সাথে। গোরাচাঁদ বসাক – ভদ্র, হাসিখুশী, বিনয়ী, বছর পঞ্চাশ-পঞ্চান্ন বয়স হবে। মাঝারি উচ্চতা, ফরসা গোলগাল চেহারা। মাথার চুল একটু পাতলা হয়ে এসেছে। চোখে বাইফোকাল রিমলেস চশমা। পায়জামা আর খদ্দরের পাঞ্জাবী পরা। অ্যান্টিক আর পুরনো ফার্নিচার কেনাবেচার ব্যাবসা। পার্ক স্ট্রিট দিয়ে মির্জা গালিব স্ট্রিট ঢুকে কিছুটা গিয়ে ডান হাতে রয়েড স্ট্রিটে পৈতৃক আমলের দোকান – রূপচাঁদ বসাক অ্যান্ড সন্স। নিবাস শোভাবাজার স্ট্রিটে। কথার মধ্যে বেশ উত্তর কলকাতার টান রয়েছে। ব্যাবসা ছেড়ে কোথাও বেরোতে পারেন না। বড়োছেলে বি.কম পাস করে বছর তিনেক হল ব্যাবসা দেখছে। ছোটোছেলে আর্ট কলেজে পড়ে, ফাইনাল ইয়ার। বড়োছেলে আর পুরনো বিশ্বস্ত কর্মচারীর ওপর দোকানের ভার দিয়ে দীর্ঘকাল পরে এবার বেরোলেন, লক্ষ্য গঙ্গোত্রী-যমুনোত্রী। স্ত্রীর হাঁটুর ব্যথা, যাত্রার ধকল সইতে পারবেন না। তাছাড়া একটু সংসার নিয়ে থাকতেই বেশি ভালোবাসেন। যৌবনে কেদার-বদ্রী আর তুঙ্গনাথ ঘু্রেছিলেন। তারপর পিতৃদেব গত হলে ব্যাবসার ঝক্কি সামলাতে গিয়ে আর বেরোনো হয়নি। গত বছর মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। ছেলেও ব্যাবসায় ঢুকে পড়েছে। অনেকটা ঝাড়া-ঝাপটা হয়ে এবার বেরিয়ে পড়েছেন।
একই পথের পথিক আমরা। হরিদ্বার পৌঁছতে পৌঁছতে গোরাচাঁদবাবুর সাথে গত চব্বিশ ঘন্টায় এতটাই সখ্যতা হয়ে গেল যে আমাদের দলটা স্বাভাবিকভাবেই দু’জন থেকে তিনজন হয়ে গেল। হরিদ্বার, হৃষিকেশ, উত্তরকাশী হয়ে গঙ্গোত্রী যেতে যেতে আর মনে হল না যে আমাদের আলাপ এই দিন কয়েকের। যদিও উনি আমাদের থেকে বয়সে প্রায় বছর দশেকের বড়ো, কিন্ত বেশি বয়সের বন্ধুত্বে বয়সের এই ফারাকটা বাঁধা হয় না। শুধু সম্বোধনে নামের পর বাবু, আপনি করে বলাটা আর কথাবার্তার মধ্যে বয়সোচিত শালীনতাটা রেখে দেওয়া হল। গোমুখ পর্যন্ত একসাথে খুব আনন্দ করেই যাওয়া হল। ফেরার পথে আমরা আমাদের পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী দেরাদুন-মুসৌরির দিকে রওনা হলাম আর গোরাচাঁদবাবু রওনা হলেন যমুনোত্রীর পথে। বিদায়কালে কলকাতায় তাঁর দোকানে ও বাড়িতে যাবার জন্য আমাদের আন্তরিক আমন্ত্রণ জানিয়ে গেলেন।
হৃষীকেশে একদিন দুপুরে হোটেলে খেতে খেতে আমি আমার ফাউন্টেন পেনের প্রতি দুর্বলতার গল্প করছিলাম। আমার বন্ধুটির নেশা ছবি তোলা। সে তার ক্যামেরা, লেন্স, স্ট্যান্ড সব নিয়ে গঙ্গার ধারে ঘুরছে। গোরাচাঁদবাবু বললেন, “বছর কয়েক আগে একবার গড়ানহাটার কোনও এক পুরনো সাবেকী বাড়ির থেকে নানাবিধ সামগ্রী কিনেছিলাম। তার মধ্যে ছিল গোটা তিনেক কলম – সেই যে আগেকার দিনে কালিতে ডুবিয়ে ডুবিয়ে লিখত, তারপর পাখির পালকের ছিল…”
আমি বলে উঠলাম, “হ্যাঁ হ্যাঁ, ওগুলোকে বলত ডিপ পেন। এখনও ব্যবহার হয় ক্যালিগ্রাফিতে আর পালকের কলমকে বলত কুইল।”
“হ্যাঁ, ঠিকই বলেছেন। সেইরকম তিনটে কলম আর তার সাথে কালির বোতল। আসলে তিনটে সেট বুঝলেন। একটা হাতির দাঁতের, একটা পিতলের মীনা করা আর একটা রুপোর। তিনটেই অপূর্ব কারুকার্য করা।”
আমি প্রায় লাফিয়ে উঠে জিজ্ঞাসা করলাম, “আছে এখনও সেগুলো? আপনার ওখানে গেলে দেখা যাবে?”
গোরাচাঁদবাবু বললেন, “না। আনার মাসখানেকের মধ্যেই বিক্রি হয়ে গেল। সান্যাল অ্যান্ড রে বলে যে নামকরা চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট ফার্ম আছে তারই অন্যতম পার্টনার সুকান্ত সান্যাল, রেইনি পার্কে থাকেন, উনি নিয়ে গেলেন।”
আমার খুব কৌতূহল হল। জিজ্ঞাসা করলাম, “কিছু মনে করবেন না। কত দাম দিল?”
উনি বললেন, “তা তিনটে মিলিয়ে সাড়ে ষোলোর মতন ছিল মনে হচ্ছে।”
আমি ভুরু কুঁচকে বললাম, “হাজার?”
উনি হ্যাঁ বলে মাথা নাড়লেন। আমার হাজারের হা আর বন্ধ হয় না দেখে বললেন, “সৌখিন জিনিসের দামটাও সৌখিন হয়। দাম আবার নির্ভর করে জিনিসের শিল্পনৈপুণ্যের ওপর। সান্যালবাবু ধনী এবং সৌখিন। তাছাড়া এ জাতীয় আর্ট অবজেক্টের সম্বন্ধে যথেষ্ট জ্ঞান আছে, নিয়মিত চর্চা করেন। দেশে বিদেশে বিভিন্ন জায়গায় গেলে এ জাতীয় জিনিসের তত্ত্বতালাশ করাটা নেশার মতন। তার ওপর বিলেত থেকে চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্সি পাশ করেছেন। অর্থনৈতিক ব্যাপার-স্যাপার ভালোই বোঝেন। জিনিস যদি পছন্দ হয় আর দাম যদি সঙ্গত মনে হয় তাহলে আর দ্বিতীয়বার ভাবেন না।”
আমি বললাম, “আচ্ছা, আপনি এতসব অ্যান্টিক পান কোথা থেকে?”
জবাবে তিনি বললেন, “উত্তর কলকাতায় বা পশ্চিম বাংলার অনেক যায়গায় বহু পুরনো ধনী বনেদি বাড়ি, জমিদার বাড়ি সব আছে যাদের অবস্থা পড়ে গেছে বা বাড়ি ভেঙে আধুনিক হাল ফ্যাশনের বাড়ি করেছে, তাদের কাছে এসব পুরনো জিনিসের, পুরনো ফার্নিচারের তেমন কোনও কদর নেই। তারা এসব বেচে দিয়ে নিজেদের খরচ চালায়। আমরা দালালের মাধ্যমে সব খবর পাই।”
“তা এত সুন্দর সুন্দর সব অ্যান্টিক জিনিস বেচে দেয় কীভাবে? এসব শখের কোনও নেশা বোধহয় এদের নেই।”
গোরাচাঁদবাবু হেসে জবাব দিলেন, “তাদের অনেকের নেশা আরও উচ্চস্তরের। সেসব রঙিন নেশার খরচ জোটাতে এসব সামগ্রী জলের দরে বেচতে এতটুকুও কুন্ঠিত হয় না।”
আমি হো হো করে হেসে উঠলাম।
গঙ্গোত্রী থেকে ফিরেছি মাস দুয়েক হয়ে গেছে। একদিন পার্ক হোটেলে একটা স্ট্যাটিস্টিক্যাল সফটওয়্যারের ওপর লেকচার আর ডেমনস্ট্রেশন ছিল। সফটওয়্যারের ডিলার বার বার করে অনুরোধ করেছিল আসার জন্য। আমার নিজেরও কিছুটা আগ্রহ ছিল। যদি আমার রিসার্চের কাজের জন্য সুবিধের মনে হয়, প্রোজেক্টের টাকা থেকে কিনতে পারব। বিকেল চারটে নাগাদ লেকচার শেষ হলে বেরিয়ে মনে হল কাছেই তো গোরাচাঁদবাবুর দোকান। হাঁটা পথ। একবার ঢুঁ মারা যাক।
রয়েড স্ট্রিটে ঢুকে কিছুটা এগোতেই বাঁ ফুটপাথে দেখলাম দোকান। সাইনবোর্ডে ইংরেজিতে লেখা – রূপচাঁদ বসাক অ্যান্ড সন্স (অ্যান্টিক ডিলার্স)। দুটো স্টেপ সিঁড়ি দিয়ে উঠে দোকানে ঢুকলাম। আলোয় ভরা ঝাঁ চকচকে নয়। একটু অন্ধকার অন্ধকার। বোঝাই যায়, বেশ পুরনো দোকান। অবশ্য দোকানের সামগ্রীই তো সব আদ্যিকালের। নিয়ন লাইটের আলোর থেকে ষাট পাওয়ারের বাল্বের টিমটিমে আলোতেই তারা বেশি মানানসই। গোরাচাঁদবাবুকে দেখলাম ধুতি-পাঞ্জাবী পরা, জনৈক ধুতি আর নীল শার্ট পরিহিত বয়স্ক কর্মচারীর সাথে কথা বলছেন। আমিও একটু ওঁদের দিকে পেছন ফিরে শিল্পসামগ্রী দেখছি। বাবা রে বাবা, কতরকমের জিনিস আর একেকটার কী সূক্ষ্ম অসাধারণ কারুকার্য! আর আমাদের গিফট আইটেমের দোকানে বা স্টেট হ্যান্ডিক্রাফটসের দোকানে হায় ভগবান, যা সব তথাকথিত ‘আর্ট অবজেক্টস’ থাকে! তাহলে লোকে আর সালারজং মিউজিয়াম দেখতে যেত না। শ্বেতপাথরের পরির স্ট্যাচু, সিরামিকের কিউপিড, মেহগনি কাঠের ছোটোবড়ো মার্বেল টপ টেবিল, হাতির দাঁতের পালতোলা নৌকা, দাবার সেট, ক্রিস্টাল গ্লাসের পানপাত্র, চিনামাটির রঙিন কাজ করা ফ্লাওয়ার ভাস, ব্রোঞ্জের দুই পা তোলা ঘোড়া – কী দৃপ্ত তার ভঙ্গিমা, পিতলের মীনা করা নানারকম ফুলদানি, এতসব বলে বোঝান যাবে না, গিয়ে দেখতে হবে। দাম কী রে বাবা একেকটার! চার সংখ্যার নিচে তো চোখেই পড়ছে না।
“আরে ভাই, আপনি! কী আশ্চর্য! বলেননি কেন? আমি ভাবলাম, কোনও খদ্দের এসেছে, হয়তো পছন্দ হলে নেবে, তাই সব দেখছে। তাহলে এতদিনে এলেন। আমি তো ভাবলাম ভুলে গেছেন, পথের বন্ধুত্ব পথেই ছেড়ে এসেছেন।” এক নিঃশ্বাসে গোরাচাঁদবাবু কথাগুলো বলে এগিয়ে এসে একহাত দিয়ে প্রায় জড়িয়ে ধরে কোনার দিকে যে টেবিলটাতে উনি বসেন সেখানে নিয়ে এলেন। উল্টোদিকে দুটো চেয়ার পাতা। বসলাম।
আমি বললাম, “না, আসলে আমার অফিস তো সেই তারাতলায়। এদিকে বড়ো একটা আসা হয় না। আজ পার্ক হোটেলে একটা প্রোগ্রাম ছিল। তাই এখানে আসার সুযোগ হয়ে গেল।”
“বাদলবাবু, বাহাদুরকে বলুন তো একটু চা-নোনতার বন্দোবস্ত করতে। বলুন, তারপর দেরাদুন-মুসৌরি কীরকম ঘুরলেন?”
“ঐ দু’দিনে যতটুকু হয়। অফিসের ছুটি তো বেশি ছিল না। আপনার যমুনোত্রী কীরকম লাগল?”
“কী আর বলি, বলুন। আপনাদের সাথে গঙ্গোত্রী-গোমুখ অত আনন্দ করে গল্প করতে করতে গেলাম। পথের কষ্ট টেরই পাইনি। আপনাদের ছেড়ে বড্ড ফাঁকা ফাঁকা লাগছিল। তাই যমু্নোত্রী ততটা জমল না।”
“আমি আপনার জিনিসগুলো দেখছিলাম। সত্যি অসাধারণ একেকটা। এখন তো এসব জিনিস করতে পারে বলে মনে হয় না। এত নিখুঁত, এত রিয়ালিস্টিক!”
“আর এখন তো সব সুরিয়ালিস্টিক, মডার্ন আর্ট। আমি তো বাপু কিছুই বুঝি না।” গোরাচাঁদবাবু হেসে বললেন।
ইতিমধ্যে চা-শিঙাড়া এসে গেল। খেতে খেতে গল্প হচ্ছে। শুনছিলাম ওঁর কাছে, এ সমস্ত ক্রিস্টাল গ্লাসের অ্যান্টিকগুলো সব চেকোস্লোভাকিয়ান। এগুলোকে বলত বোহেমিয়ান গ্লাস। সিরামিকের নানারকম ফিগারগুলোও ওখানকার। চিনামাটির বড়ো বড়ো ভাসগুলো সব তখন চিন থেকেই আসত। নানারকম মার্বেলের স্কাল্পচারস, ছোটো ছোটো স্ট্যাচু যাকে বলে ফিগারিনস – সব ইটালিয়ান কারারা মার্বেলের, কিছু কিছু কালো সেমি-প্রেসাস স্টোনের। এগুলো অষ্টাদশ, উনবিংশ শতাব্দীর, ইটালিতেই তৈরী। মীনা করা পিতলের ফুলদানি, মোমের স্ট্যান্ড, পিকদানি, আর ঐ হাতিদুটো আমাদের ভারতবর্ষের, মোরাদাবাদের। এগুলোও কম যায় না।
কথায় কথায় সেই হাতির দাঁত, পেতল আর রুপোর তিনটে ডিপ পেন সেটের প্রসঙ্গ উঠল। গোরাচাঁদবাবু আমায় বললেন, “আপনি কলমগুলো দেখতে পারেন।”
আমি বললাম, “কীভাবে? সুকান্ত সান্যালের বাড়ি গিয়ে? ধ্যাত! চেনা নেই, শোনা নেই। কী মনে করবেন ভদ্রলোক?”
“আরে, আপনি তো আমার সাথে যাবেন। সান্যালবাবু উঁচুতলার লোক হলেও অত্যন্ত ভদ্র ও অমায়িক। কোনও দম্ভ নেই। তাছাড়া আরেকটা জিনিস জানবেন, যাঁদের এ জাতীয় সৌখিন জিনিস সংগ্রহ করার নেশা কেউ যদি তাঁদের জিনিসগুলো দেখতে চায়, তাঁরা বরঞ্চ খুশীই হন, একটু গর্ব বোধ করেন। আমি টেলিফোন করে কথা বলে আপনাকে জানাব। উনি তো আবার প্রায়ই থাকেন না। ছেলে আমেরিকায়, মেয়ে ফ্রান্সে। বছরের তিন-চার মাস তো বিদেশেই কাটে।”
সেদিন প্রায় সন্ধে ছ’টা নাগাদ ওঁর দোকান থেকে বেরিয়ে এসেছিলাম।
মাস খানেক বাদে একদিন উনি ফোন করলেন, “সামনের রোববার সকালের দিকে ফাঁকা আছেন?”
“তা আছি।”
“তাহলে সকাল দশটা বড়োজোর সওয়া দশটার মধ্যে বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডে আজাদ হিন্দ ধাবার সামনে চলে আসুন। সান্যালবাবু দশটা থেকে এগারোটার মধ্যে টাইম দিয়েছেন। উনি মাঝে কিছুদিন ছিলেন না। দিল্লি গিয়েছিলেন। গত বুধবার ফিরেছেন।”
এই রে, গোরাচাঁদবাবু সুকান্ত সান্যালের সাথে অলরেডি কথা বলে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে ফেলেছেন। না গেলে বাজে ব্যাপার হবে। তাই বললাম, “ঠিক আছে। আমি হাজির হয়ে যাব।”
“তাহলে সে কথাই রইল। রাখলাম।”
রবিবার সকাল বেলা সওয়া ন’টা নাগাদ বেরিয়ে গড়িয়া-বিবাদি বাগ মিনিবাসে আজাদ হিন্দ ধাবার কাছে যখন বাস থেকে নাবলাম তখন দশটা বেজে পাঁচ। গোরাচাঁদবাবু দাঁড়িয়ে আছেন। আমি নেমেই জিজ্ঞাসা করলাম, “অনেকক্ষণ?”
গোরাচাঁদবাবু হেসে বললেন, “না। মিনিট পাঁচেকও হবে না। চলুন।”
আমরা বাসরাস্তা পেরিয়ে রেইনি পার্কের রাস্তায় ঢুকলাম। এভারেডির অফিসটা ছাড়িয়ে কয়েকটা বাড়ি পরেই সুকান্ত সান্যালের বাড়ি। হাল্কা সবুজ আর কালচে শ্যাওলা সবুজ মিলিয়ে ওয়েদারকোট রঙ করা। বাইরে পিতলের ফলকে ইংরেজিতে বাঁকা হরফে ওঁর নাম লেখা। বলে দিতে হবে না যে উনি লন্ডন থেকে চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্সি পাশ করেছেন।
দোতলা, কিন্তু বেশ বড়ো বাড়ি। দোতলার বারান্দাতেই তো একটা দু’কামরার ছোটোখাটো ফ্ল্যাট হয়ে যায়। এক পাশ দিয়ে বড়ো গাড়ি ঢোকার মতন লোহার পাতের গেট। দুটো পাল্লায় বড়ো বড়ো দুটো হ্যান্ডেল, গোরুর গাড়ির চাকার মতন গোল, কাজ করা। গেটের একটা পাল্লা কিছুটা খোলা। সেখান দিয়ে ঢুকলাম। একজন নেপালি লোক, মনে হয় দারোয়ান, এগিয়ে এসে প্রায় পথ আটকে জিজ্ঞাসা করল, “কঁহা যাইয়েগা বাবু?”
সুকান্তবাবুর সাথে আগে থেকে টেলিফোনে কথা বলা আছে শুনে ‘আইয়ে’ বলে নিয়ে এল। পুরো উঠান চত্বরটা ফুটপাথ টাইলস দিয়ে বাঁধানো। সোজা প্যাসাজ বাড়ির পেছনে চলে গ্যারেজে গিয়ে শেষ হয়েছে। কালো একটা গাড়ি দেখা যাচ্ছে। বাঁদিকে ছোটো লন, চারদিক দিয়ে ফুলের টব, মালি কাজ করছে। ওপাশে দেওয়ালের ধারে তিন থাকের বেঞ্চির ওপর নানারকমের ক্যাক্টাসের ছোটো ছোটো টব। শ্বেতপাথরের তিন ধাপ সিঁড়ি উঠে চারপাল্লার ওয়ালনাট পালিশ করা দরজা, আদ্ধেকটা কাচের, সান কন্ট্রোল ফিল্ম লাগান।
কলিং বেল বাজাতে একজন ভৃত্যস্থানীয় লোক, বছর চল্লিশেক বয়স, পরিষ্কার সাদা পায়জামা আর শার্ট পরা, দরজা খুলে দিল। ভৃত্যটির মুখ দেখে মনে হল গোরাচাঁদবাবুকে চেনে। বলল, “বসুন, আমি বাবুকে খবর দিচ্ছি।”
ঢুকেই বড়ো হলঘর। ডানদিকে তিনটে ঘর। বাঁদিকে দুটো। মাঝখানে চওড়া পালিশ করা দরজা যেটা দিয়ে ভৃত্যটি ওপরে চলে গেল সুকান্তবাবুকে খবর দিতে। সারাবাড়িই চকচকে শ্বেতপাথরের মেঝে, কালো চওড়া বর্ডার দেওয়া। হলের মাঝখানটা জুড়ে ডবল সোফাসেট। পেছনের দেওয়ালে সাঁটিয়ে লাগানো তিনটে মার্বেল টপ টেবিলে প্রায় হাতখানেক সাইজের ব্রোঞ্জের স্ট্যাচু, মাঝেরটা অ্যাপোলোর আর দু’পাশে দুটো পরি।
golpobhanganib02সুকান্তবাবু ঘরে ঢুকে হাতদুটো একটু তুলে নমস্কার করলেন। আমরাও প্রতিনমস্কার জানালাম। ষাটের ওপর বয়স হলেও ভদ্রলোক এখনও রীতিমতো সুপুরুষ। লম্বা, খুব ফরসা, তেমনি নাক, চোখ, মুখের গড়ন, মাথায় ঠাসা চুল পুরোটা ধবধবে সাদা, চোখে কালো মোটা ফ্রেমের বোঝাই যায় বেশ দামি চশমা। সিল্কের সাদা পায়জামা-পাঞ্জাবী পরা। পায়ে স্লিপার, হাতে পাইপ, বরকুম রিফ টোবাকোর পাউচ আর জিপ্পো লাইটার। আমার দিকে তাকিয়ে মাথা নড করে মৃদু হেসে বেশ ব্যারিটোন ভয়েসে বললেন, “আপনার কথা ওঁর কাছে শুনেছি। আপনি বৈজ্ঞানিক। তা আপনারও কি কিউরিও কালেকশন করা হবি? কোনও পার্টিকুলার অবজেক্ট কালেকশন করেন?”
আমি বললাম, “না। গোরাচাঁদবাবুর সাথে আমার আলাপ গত জুন মাসে গঙ্গোত্রী বেড়াতে গিয়ে। একসাথে কয়েকদিন ছিলাম। একটা হৃদ্যতা হয়ে গেছে। কথা প্রসঙ্গে একদিন ফাউন্টেন পেনের কথা ওঠাতে উনি এই ডিপ পেনগুলোর কথা বলেছিলেন। আমার জাস্ট দেখার আগ্রহ। আর হবি যদি বলেন তো পপুলার সায়েন্সের বই পড়া আর আর্টিকেল লেখা।”
কথা বলতে বলতে লক্ষ করলাম, উনি পাউচ থেকে তামাক নিয়ে পাইপে ভরে একটা ফ্ল্যাট চামচের মতন জিনিস দিয়ে ঠেসে লাইটার দিয়ে ধরালেন। দেখলাম, আগুনটা সোজা না বেরিয়ে পাশ দিয়ে বেরোল। ইতিমধ্যে ভৃত্যটি একটা বড়ো কাঠের ট্রেতে দু’কাপ চা আর দুটো প্লেটে পেস্ট্রি নিয়ে এল। সুকান্তবাবু হাত দিয়ে প্লেটের দিকে ইশারা করে দেখালেন। আমি বললাম, “এ কী, আপনারটা কোথায়?”
উনি পাইপের হাল্কা ধোঁয়া ছেড়ে বললেন, “আমার ব্রেকফাস্ট হয়ে গেছে। আই অ্যাম নাউ সিক্সটি সেভেন। বছরখানেক আগে আমার একটা মাইল্ড স্ট্রোকের মতন হয়। এখন আমার খাওয়াদাওয়া, চলাফেরা সব ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী।”
আমি পেস্ট্রিটা মুখে তুলতে তুলতে ওঁর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, “স্মোকিংটাও?”
সুকান্তবাবু মুখের থেকে পাইপটা সরিয়ে আমার দিকে একটু থমকে তাকিয়ে হেসে বললেন, “দিনে তিনবার লাইট স্মোকিং আর রাত্রে খাওয়ার পর দু’পেগ স্কচ ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন, তবে লিখিত নয়, ভার্বাল। মাঝে মাঝে অবশ্য ওভারডোজ হয়ে যায়। কী করি বলুন, প্রায় পঁয়তিরিশ বছরের অভ্যাস।”
আমরা সবাই হো হো করে হেসে উঠলাম। এতে অবশ্য ভালোই হল। পরিবেশের প্রথম যে গুমোট ভাবটা অনেকটা হাল্কা হয়ে গেল।
আমাদের চা খাওয়া শেষ হলে সুকান্তবাবু বললেন, “চলুন, আপনাদের জিনিসগুলো দেখাই। আমার আবার আজ ক্লাবের কমিটির একটা জরুরি মিটিং আছে, সাড়ে এগারোটায় বেরোব।”
বাঁদিকের প্রথম ঘরটার একপাল্লার দরজার চকচকে পিতলের ল্যাচের হ্যান্ডেল ঘুরিয়ে সুকান্তবাবু ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বললেন, “আসুন।”
বেশ বড়ো ঘরটা। মনে হয় ওঁর প্রাইভেট স্টাডি রুম। বাবা, ঘরটা কী ঠান্ডা! দুটো এসি চলছে।
দরজার উল্টোদিকের দেওয়াল জুড়ে খোপ খোপ শেলফ। নানা বইয়ে ঠাসা। কোনও কোনও খোপে কিউরিও। নিচে প্রায় দু’ফুট ড্রয়ার আর পাল্লা দেওয়া তাক। বাঁদিকের দেওয়ালে দুটো বড়ো জোড়া-জানালা। পেলমেট থেকে ভারি পর্দা ঝুলছে। জানালার ধারে একটা পুরু গদি দেওয়া বড়ো রিক্লাইনার। একটা হাতলের ভেতরদিকে বড়ো স্টিল রঙের বোতাম দেখে বুঝলাম যে ওতে চাপ দিয়ে প্লেনের পুশ ব্যাক সিটের মতন শুয়ে পড়া যায়। পাশে মার্বেল টপ গোল টি-টেবিল। ডানদিকের দেওয়াল ঘেঁষে তিনটে আলমারি। পাল্লা, ধারগুলো কাঠের ফ্রেমে কাঁচ দেওয়া, ভেতরে পেছনটা আয়না। বোধহয় আঠা দেওয়া পলিথিন মিরর ফিল্ম লাগানো আছে। শেলফগুলো সব মোটা কাচের। একটাতে নানাধরনের ছোটো ছোটো কিউরিও। সেটার তালা খুলে ঐ তিনটে ডিপ পেন সেট বের করে করে দেখালেন। সত্যি দেখার মতন শিল্প বটে। যেমন রুপোর জালির কাজ, তেমনি পিতলের মিনার ফুলবাহারি কাজ আর তেমনি হাতির দাঁতের নিখুঁত আঙুরলতার কাজ। সুকান্তবাবু বললেন, তিনটেই আমাদের ভারতবর্ষের শিল্পীদের হাতের কাজ। রুপোর আর হাতির দাঁতের কাজ সম্ভবত আগ্রার, আর পিতলেরটা মোরাদাবাদি।
এ তো গেল। সবচেয়ে বেশি চমক খেলাম পাশের দুটো আলমারি দেখে। একটা ভর্তি স্মোকিং পাইপ, আর দ্বিতীয়টা ঠাসা বুকপকেটে রাখার ঘড়ি। দুটোই কম করে তিরিশ-চল্লিশরকম হবে। কতরকমের যে পাইপ আর ঘড়ি হতে পারে আমার কোনও ধারণাই ছিল না। একটা পাইপ দেখলে হঠাৎ মনে হবে পিস্তল। পাইপের বৌলটা মানে যাতে তামাক ভরে সেটা হল পিস্তলের বাট।
লক্ষ করলাম, ইতিমধ্যে সুকান্তবাবু দু’বার ঘড়ি দেখলেন। আমি বললাম, “সত্যি বলতে আমি ডিপ পেন দেখতে এসেছিলাম বটে কিন্তু এই পাইপ আর ঘড়ি বিশেষত পাইপ – এটা আমার কাছে বিস্ময়। আজ আমরা আসি, আপনিও বেরোবেন।”
সুকান্তবাবু আমাকে বললেন, “পাইপ আর ঘড়ি তো কিছুই দেখলেন না। আমি বলি কী, আপনারা আরেকদিন আসুন। আমি নেক্সট উইকে মাস চারেকের জন্য বাইরে যাচ্ছি। ফিরে আসি, তখন একদিন অবশ্যই আসবেন। সেদিন আমি আপনাকে এই পাইপ সম্বন্ধে অনেক কিছু বলব। সত্যি কথা বলতে, পাইপ আমার প্যাশন। পাইপ আর এর তামাক – অনেক কিছু জানার আছে। আপনি বিজ্ঞানী মানুষ। আপনার অনুসন্ধিৎসু মন, ভালো লাগবে।”
ভদ্রলোকের ভদ্রতা নয়, বলার মধ্যে আন্তরিকতা দেখে আমি বললাম, “ঠিক আছে, নিশ্চয়ই আরেকদিন আসব। আপনি ঘুরে আসুন। খুব ভালো লাগল আজ আপনার এখানে এসে।”
সুকান্তবাবুর বাড়ি থেকে যখন বেরোলাম তখন ঠিক এগারোটা। গোরাচাঁদবাবুর কাছেই শুনলাম, উনি বেঙ্গল ক্লাবের বর্তমান প্রেসিডেন্ট। তাই বোধহয় মিটিংয়ের জন্য ব্যস্ত। আমি বললাম, “ভদ্রলোক এত হাই স্ট্যাটাসের লোক অথচ বেশ অমায়িক।”
দূর থেকে একটা গড়িয়া মিনি আসতে দেখে আমি গোরাচাঁদবাবুকে ‘আসি’ বলে রাস্তা পেরিয়ে বাস স্টপে চলে এলাম।
দেখতে দেখতে তিনমাস কেটে গেল। গোরাচাঁদবাবুর দোকানে আর যাওয়া হয়নি। আমিও অবশ্য ব্যস্ত ছিলাম আমার প্রোজেক্টের কাজ নিয়ে। মাঝেসাঝে ফোনে কথা হয়েছে ঐ ‘কেমন আছেন’, ‘ভালো আছি’ গোছের। ডিসেম্বরের মাঝামাঝি দিল্লি আই.আই.টিতে একটা সেমিনার ছিল। আমার পেপার প্রেজেন্ট করার ছিল, গিয়েছিলাম। বাপ রে বাপ, দিল্লিতে কী ঠান্ডা! ফিরে এসেছি দিন কয়েক হয়ে গেল। বছরের শেষ, ইন্সটিটিউট প্রায় ফাঁকা। ক্যাসুয়েল লিভ, আর্নড লিভ যার যা বাকি পড়ে আছে নিয়ে নিচ্ছে। আমারও দেড় দিন মতন ক্যাসুয়েল লিভ আছে। ছেড়ে দিয়ে কী হবে? নিয়েই নিই। লাঞ্চের পরে নিজের ল্যাবরেটরিতে বসে সায়েন্টিফিক অ্যামেরিকানের একটা আর্টিকল পড়ছিলাম, এমন সময়ে টেবিলে টেলিফোনটা বেজে উঠল। রিসিভারটা কানে দিয়ে ‘হ্যালো’ বলতেই ওপার থেকে শোনা গেল, “একটু সময় করে দোকানে আসতে পারবেন? একটা দারুণ ইন্টারেস্টিং জিনিস পেয়েছি, আপনাকে দেখাব।” নিশ্চয়ই কোনও বিরল অ্যান্টিক কিছু পেয়েছেন। খদ্দের নিয়ে যাবার আগে দেখাতে চান। আসলে এর আগে গোরাচাঁদবাবুর দোকানের সব জিনিস দেখে, সুকান্তবাবুর পাইপ আর ঘড়ির কালেকশনস দেখে আমারও দেখছি এই অ্যান্টিকসের ওপর একটা মোহ জন্মে যাচ্ছে। তবে যা সব দাম কেনার সাধ্য নেই ঠিকই, দেখতে তো বাধা নেই। গোরাচাঁদবাবুর সাথে এতদিনের সখ্যতায় এটুকু বিশ্বাস আছে, আমাকে আসার কথা বলার পেছনে ওঁর কোনও ব্যবসায়িক স্বার্থ নেই। তাই আমি সাথে সাথে বললাম, “কাল দুপুরের পর হাজির হয়ে যাব।”
সেদিনটা ছিল বৃহস্পতিবার। দুপুরে লাঞ্চের পর একটা অর্দ্ধদিবস ক্যাসুয়েল লিভের দরখাস্ত দিয়ে অফিস থেকে বেরিয়ে এলাম। তারাতলার মোড় থেকে, বেহালা চৌরাস্তা থেকে গড়িয়াহাট যে অটোগুলো যায় তার একটা ধরে রাসবিহারী নেমে মেট্রো ধরে এসপ্লানেড। গ্র্যান্ড হোটেলের সামনে রাস্তাটা পেরিয়ে রক্সির রাস্তায় ঢুকলাম। মোড় থেকে ডানদিকে ঘুরলেই বার্ট্রাম স্ট্রিটে অল ইন্ডিয়া টেক্সটাইল, স্যুটিংস অ্যান্ড শার্টিংস-এর দোকান। আমার যখন দশ বছর বয়স তখন থেকে এই দোকানেই শার্ট-প্যান্ট বানাই। ছোটোবেলায় বাবার সাথে আসতাম স্কুলের ড্রেস, পুজোর জামাপ্যান্ট, বাবার যত প্যান্ট-শার্ট, স্যুট সব এখানেই বানানো হত। বড়ো দোকান, একসময়ে বহুদিন ইন্ডিয়ান নেভির স্যুটের সাপ্লায়ার ছিল। এখন রেমন্ডসের এক্সক্লুসিভ ডীলার। দুই ভাই মালিক, জাতে সিন্ধ্রি। আমি আঙ্কল বলে ডাকতাম। দু’জনের সাথেই বাবার খুব হৃদ্যতা ছিল। বড়ো আঙ্কল মারা গেছেন। তাঁর ছেলে এখন বসে। দু’জনেই আমাকে ভালোবাসত। ছোটো থেকে দেখে আসছে তো। ছোটো আঙ্কল খুব হাসিখুশি, ছোটোখাটো চেহারা, অকৃতদার। এখন বয়স পঁচাত্তরের কাছাকাছি হবে। সেদিন আঙ্কল সবথেকে উচ্ছ্বসিত হয়েছিলেন যেদিন আমি আমার দশ বছরের ছেলেকে নিয়ে এসেছিলাম ওর একটা হাফ প্যান্ট আর শার্ট বানাতে।
দোকানে ঢুকলাম। একদিকের কাউন্টারে ছোটো আঙ্কল ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। আমাকে দেখে একগাল স্নেহময় হাসি, একপ্রস্থ কুশল বিনিময় হল। আমি অফিসের ব্যাগ থেকে প্যান্ট আর শার্টের পিসদুটো বার করলাম। পুজোয় শাশুড়িমা দিয়েছিলেন। সেই থেকে পড়ে আছে। এদিকে যে আসাই হচ্ছে না। মাস্টার গলায় টেপ নিয়ে সামনেই কাউন্টারে একটা প্যান্ট-পিসের ওপর স্টেন্সিল দিয়ে চকের দাগ কাটছিল। এই মাস্টারটা নতুন, তাও বছর সাতেক হবে, আগে একজন বুড়ো মাস্টার ছিল। সে এখন খুব বৃদ্ধ আর অসুস্থ। ওর মতন সুন্দর ফিটিংসের স্যুট বানাতে খুব কম ওস্তাদই পারত। মাপ দিয়ে বেরিয়ে আসছি, ভাইয়া মানে বড়ো আঙ্কলের ছেলে ক্যাশ-কাউন্টারের কাচের ওপর দিয়ে একটা বড়ো চাবির রিং আর ডট পেন দিয়ে দিল। এক্সমাস গিফট। এ দোকান থেকে আমি কখনও খালি হাতে বেরিয়েছি বলে মনে পড়ে না। শুরু হয়েছিল টফি দিয়ে।
নিউ মার্কেটের পাশ দিয়ে হেঁটে লিন্ডসে স্ট্রিট, মির্জা গালিব স্ট্রিট হয়ে রয়েড স্ট্রিটে রূপচাঁদ বসাক অ্যান্ড সন্সে প্রবেশ করলাম তখন সাড়ে তিনটে বাজে।
“আসুন আসুন, আপনার জন্যই অপেক্ষা করছি।” টেবিলে বসে বসেই গোরাচাঁদবাবু বললেন। আমি এদিক ওদিক তাকাতে গিয়ে হঠাৎ দেওয়ালে দেখি একটা ওয়াল ক্লক। কাঠের দোচালা ঘর, মাঝে গোল বড়ো ঘড়ির ডায়াল, রোমান হরফ। ডায়ালের ওপর দরজা দেওয়া চৌকো খোপ। চারদিকে ফুল-লতাপাতার ডালপালার জালি কাজ, মাথায় একটা বড়ো ঈগল পাখি ডানা মেলা, যেন উড়ে এসে বসছে। নিচে একটা বড়ো শিংওয়ালা হরিণ, একটা সিংহ ঘাড়ে লাফিয়ে পড়েছে। সবার নিচে তিনটে লম্বা পটোলের মতন ওজন চেন দিয়ে ঝুলছে। বিশাল ঘড়ি, লম্বায় সবসমেত ফুট পাঁচেক হবে। আমি হা করে খানিকক্ষণ দেখে জিজ্ঞাসা করলাম, “এটা তো আগেরবার দেখিনি! কোথায় পেলেন?”
“বলছি বলছি, সব বলছি। আগে চা খান।”
ইতিমধ্যে বাহাদুর চা নিয়ে এসেছে।
চায়ে চুমুক দিয়ে গোরাচাঁদবাবু বললেন, “পেলাম ভবানীপুরের একটা বাড়ি থেকে। পুরনো বাড়ি, প্রমোটার ভেঙে মাল্টিস্টোরিড ফ্ল্যাট বানাবে। যা সব ছিল বেচে দিচ্ছে। আমার ছেলে গিয়েছিল দালালের সাথে। বড়ো গোল ডাইনিং টেবিল সেট, সোফা সেট, একটা বড়ো অর্দ্ধচন্দ্রাকার অফিস টেবিল আর হাই ব্যাক চেয়ার – ভিক্টোরিয়ান স্টাইলের আবলুস কাঠের ফার্নিচার আর তার সাথে এই ঘড়িটা। এ জাতীয় ঘড়িকে বলে কাক্কু ক্লক অর্থাৎ কোকিল ঘড়ি। এগুলো জার্মানিতে তৈরি হত। ওই যে চৌকো দরজা দেওয়া খোপ দেখছেন, প্রত্যেক একঘন্টা অন্তর যখন যতটা বাজবে, ঐ দরজা খুলে গিয়ে একটা পাখি বেরিয়ে এসে ততবার ডাকবে। পুরোটাই মেকানিক্যাল লিভার সিস্টেম। কোনও ইলেক্ট্রনিক সার্কিট নেই। এর নানারকম ধরণ ছিল আর জার্মানি এই ঘড়ি ১৮৫০ সাল থেকে সারা পৃথিবীতে রপ্তানি করত। এই ঘড়ি বলতে গেলে জার্মানির কালচারাল আইকন।”
“এ তো বন্ধ হয়ে গেছে। নাকি খারাপ হয়ে গেছে? সারানো যাবে?”
“হুঁ। তা যাবে। রাধাবাজারে আমার জানা কিছু ঘড়ির ওস্তাদ আছে যারা এধরনের পুরনো ঘড়ি সারাতে পারে। একবার দেখাতে হবে।”
“আচ্ছা, আপনার এতসব ফার্নিচার রাখেন কোথায়? এখানে তো দেখছি না।”
“সে আমাদের পুরনো ফার্নিচারের দোকান, আহিরিটোলায়। বাবা ঐ দোকানটা প্রথম করেন, তারপর এটা। এখন বড়োছেলে ওটা দেখাশোনা করে।”
“তা এই ঢাউস ঢাউস ভিক্টোরিয়ান ফার্নিচার এখনও লোকে কেনে?”
“খুব কম। ছোটোখাটো, ঐ সুকান্তবাবুর ওখানে যেমন মার্বেল টপ টেবিল দেখলেন, ওরকম। উনি তো আমার কাছ থেকেই নিয়েছেন।”
“তাহলে আপনি যে কিনে নিয়ে এলেন? নাকি আপনার ভিক্টোরিয়ান ফার্নিচার কালেকশনের নেশা? সুকান্তবাবুর পাইপের মতন?”
গোরাচাঁদবাবু হো হো করে হেসে বললেন, “আরে না না, পাগল! আমি হলাম গিয়ে বেচারাম দোকানদার। এগুলো প্রপস হিসেবে ভাড়া খাটাই।”
“মানে? বুঝলাম না।”
“ওরিয়েন্টাল সেমিনারিতে আমার এক ঘনিষ্ঠ সহপাঠী ছিল দেবনাথ দত্ত। আমরা দেবু বলে ডাকতাম। আমাদের এক স্যার বলতেন, ওর কোনও নাম নেই, শুধুই পদবি – দেব, নাথ আর দত্ত। তা দেবু ভালো আঁকতে পারত। ইন্টারমিডিয়েটের পর ও আর্ট কলেজে ভর্তি হয়। পাশ করে ও প্রফেশনাল আর্টিস্ট ছিল। কীভাবে জানি না, ও ফিল্ম লাইনে ঢুকে পড়ে। এখন ও সিনেমার বেশ নাম করা প্রোডাকশন ডিজাইনার। ও যখনই সিনেমার সেট ডিজাইন করে আমার থেকে ফার্নিচার, অ্যান্টিকস যেমন যেমন দরকার হয় ভাড়া নিয়ে যায়। ভালোই পয়সা আসে।”
“এবার বুঝলাম। তা ফোনে আমাকে কী ইন্টারেস্টিং জিনিস আছে বলছিলেন? এই ঘড়িটা?”
“ধীরে রজনী, ধীরে। ভবানীপুরের বাড়ি থেকে যে ঐ অর্দ্ধচন্দ্রাকার টেবিল আর চেয়ারটা এনেছি, ওগুলোর কথা আমার বন্ধু দেবুকে বলেছি। সাধারণত এরকম নতুন কোনও ফার্নিচার এলে ওকে জানিয়ে রাখি। ওর মাথায় থাকে, দরকার মতন নিয়ে যায়। তা দেবু আমাকে টেবিলটার বর্ণনা শুনে ওটা ঠিকঠাক করে রাখতে বলেছিল। ও একটা সেটে কাজে লাগাবে। তাই গত পরশু টেবিলের ড্রয়ারগুলো সব খুলে ভেতর-টেতর পরিষ্কার করাচ্ছিলাম টেবিলটা একটু হাল্কা পালিশ করাব বলে। বিশেষ কিছুই ছিল না। কিছু পুরনো ছেঁড়াখোঁড়া কাগজপত্র, পোস্টকার্ডে লেখা চিঠি, জঙধরা জেমস ক্লিপ এইসব। আর এক কোনায় ছিল একটা ভাঙা কলম। সন্তোষ, মানে আমার দোকানের মিস্তিরি-কাম-ম্যানেজার ওটা কাগজপত্তরের সাথে ফেলে দিল। দেখেই বুঝলাম, পুরনো ফাউন্টেন পেন। তা কোনও গা করলাম না। হঠাৎ কেন জানি আপনার কথা মনে হল। কলমটা তুলে নিলাম। ঢাকনার প্যাঁচ খুলে দেখি ভাঙা, নিবটিব কিস্যু নেই, শুধুই খোল। ঢাকনাটা লাগিয়ে ফেলতে যাচ্ছি, হঠাৎ ক্লিপটার দিকে নজর পড়ল। অবাক হয়ে গেলাম। এরকম কলমের ক্লিপ আমার বাপের জন্মেও দেখিনি। ওটা আর ফেললাম না, আপনাকে দেখাব বলে রেখে দিয়ে আপনাকে ফোন করলাম।”
আমি বললাম, “কই, দেখি।”
গোরাচাঁদবাবু তার টেবিলের ডানদিকের ওপরের ড্রয়ারটা খুলে একটা কলম বার করে আমার হাতে দিলেন। আরও শুনলাম বলেই প্রথমেই আমার চোখ গেল কলমের ক্যাপের ক্লিপটার দিকে। দেখেই গাটা কেমন শিরশিরিয়ে উঠল। সোয়া ইঞ্চির মতো সোনালি রঙের ক্লিপ, ইংরেজি এস অক্ষরের মতন একটু বেঁকে নেমে এসেছে একটা সাপ। সারা গাটা কীরকম বরফির মতন ছোটো ছোটো ছোট খোপ, লেজের অংশটা মাথার ফিনিয়েলটাকে আংটির মতন আড়াই প্যাঁচ জড়িয়ে আছে। আর চোখদুটোয় ছোট্ট ছোট্ট দুটো লাল পাথর, যাকে বলে সিন্থেটিক রুবি। আমার মুখ দিয়ে আপনিই বেরিয়ে এল, “বাবা! এ কী?”
কালো রঙের কলম, সওয়া পাঁচ ইঞ্চি সাইজ। ব্যারেলের আর নিবের সেকশনের আংটিদুটো যাকে ট্রিম রিং বলে, সোনালি। ক্যাপের নিচের চওড়া ব্যান্ড বা সেন্টার ব্যান্ডটাও সোনালি। ক্যাপের মাথায় সাদা ছয় পাপড়ির ফুল। কলমের নিচটা ফ্ল্যাট, সোনালি রঙ। ক্যাপটার প্যাঁচ খুললাম। এ কী, নিব বা কালো ফিড – কোনওটাই নেই! এ তো ব্যবহার করা যাবে না। ফিডটা থাকলেও না হয় নিব লাগিয়ে নেওয়া যেত।
গোরাচাঁদবাবু বললেন, “আমি তো ঐজন্যই ফেলে দিতে যাচ্ছিলাম। ক্লিপটা চোখে পড়ায় আপনাকে দেখাব বলে রেখে দিয়েছি।”
কী কলম, কোথাকার কলম, কাদের তৈরি দেখার চেষ্টা করলাম। ক্যাপের ক্লিপের রিংটায় সাপের লেজে একটা নম্বর অনেক কষ্টে পড়া গেল – পি এন ১২৬৫০৪৭। সেকশনের ট্রিম রিঙে কী খোদাই করে লেখা আছে, মনটানা না কী জানি অনেক চেষ্টা করেও পড়তে পারলাম না। নাহ্, চালসে ধরে গেছে। এবার চোখ দেখাতেই হবে।
গোরাচাঁদবাবু ড্রয়ার থেকে একটা আতশ কাচ বার করে দিলেন। ওটা দিয়ে রিংটা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখতে গিয়ে দেখি লেখা আছে – বিওএচইএমআই – ও আচ্ছা, বোহেমি। বেশ, তারপর এমওএনটি – মন্ট, বিএলএএনসি – ব্ল্যাঙ্ক। আরে, এ তো মঁ ব্লাঁ! এ তো জার্মানির খুব নামকরা কলম। আতশ কাচটা দিয়ে হঠাৎ নজর পড়ল কলমটার নিব সেকশনটার ভেতরে। আরে, এই তো নিব আর কালো ফিড! কলমের নিচের দিকে স্ক্রু-এর মতন থ্রেড কাটা। সাথে সাথে আমার উমাপতিবাবুর কলমটা যেন চোখের সামনে ভেসে উঠল। আমি হুররে করে প্রায় চেয়ার থেকে লাফিয়ে উঠেছি। গোরাচাঁদবাবু ‘কী হল’ বলে আমার মুখের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছেন। আমি বললাম, “দাঁড়ান মশাই, আপনাকে একটা মজা দেখাচ্ছি। মাদারি কা খেল।” এই বলে আমি ক্যাপটা কলমের পেছনে লাগিয়ে ঘোরাতে আরম্ভ করলাম। এ তো ঘুরছে না। কিছক্ষণ ধরে চেষ্টা করতে করতে এবার কলমের নিচের প্রায় পৌনে এক ইঞ্চির মতো অংশ ঘুরতে শুরু করল। গোটা তিনেক প্যাঁচ ঘোরাতে ফিডসহ নিবটা পুরো বেরিয়ে এল।
গোরাচাঁদবাবুর হা করা মুখটা স্টিল ছবি হয়ে গেছে। তারপর একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, “সাধে কি আর বলে বিজ্ঞানী!”
আমি বললাম, “না মশাই, এসব বিজ্ঞানী-টিজ্ঞানী নয়। আমার স্কুলের অ্যাসিস্ট্যান্ট হেডস্যারের কাছে এরকম কলম দেখেছিলাম। সেটা মনে পড়ে গেল। কিন্তু নিবটা তো সাঙ্ঘাতিকভাবে বেঁকে আছে। মনে হয় ওপর থেকে সোজা পড়েছিল। এ দিয়ে তো লেখা যাবে না। আর এই কলমের নিব, দাঁড়ান, কী নিব দেখি। সোনালি নিব, ৪৮১০ মঁ ব্লাঁ ১৪ কে। এ নিব পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না।”
গোরাচাঁদবাবু বললেন, “এটা তাহলে আপনিই নিন। কলেজ স্ট্রিটে নিয়ে যান, নিব পেতে পারেন। পুরনো ঘড়ি সারানোর ওস্তাদ যেমন আছে তেমনি পুরনো কলম সারানোর ওস্তাদও পেয়ে যাবেন।”
আমি অবাক হয়ে বললাম, “মানে! এর দাম দেওয়া আমার সাধ্য নেই। এর দাম কত জানেন? গেল বছর আমার এক সিনিয়র কলিগ জার্মানি গিয়েছিল। তাকে বলেছিলাম আমার জন্য একটা ভালো ফাউন্টেন পেন আনতে। ফিরে আসার পর বলল, সেফার, লেমি, মঁ ব্লাঁ আমাদের টাকার হিসেবে দশ হাজার থেকে শুরু, চার লাখ অবধি দোকানে দেখেছি। আমি খুব হতাশ সুরে বলেছিলাম, নিয়ে এলে না কেন? না মানে, ছবি তুলে নিয়ে এলে না কেন? বাঁধিয়ে দেওয়ালে টানিয়ে রাখতাম। আর এই অ্যান্টিক মঁ ব্লাঁ কলম আমাকে এমনিই দিয়ে দেবেন? আপনার কি মাথা খারাপ হয়েছে?”
“মাথা আমার দস্তুরমতো ঠিক আছে। টেবিলটা আমার কেনা, কলমটা তো নয়। এ তো ভাঙা ভেবে ফেলেই দিতে যাচ্ছিলাম। আপনি কলমের সমঝদার, এটা আপনারই প্রাপ্য। এখন এটার নিবের বন্দোবস্ত করুন তো দেখি।”
ইতিমধ্যে বাহাদুর ফ্লাস্কে চা আর একটা বড়ো ঠোঙা নিয়ে এল। পেছনে দরজার ভেতরদিকে ছোটো গোডাউন আছে – বাহাদুর সেখানে থাকে। ভেতর থেকে কাপ-ডিশ আর বড়ো প্লেট নিয়ে এল। বেশ বড়ো সাইজের ফিশ ফ্রাই। বাদলবাবুর জন্য ভেজিটেবল চপ। উনি অনেকদিন হল নিরামিষাশী। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, “আপনার কি রোজই এসব চলে নাকি?”
“ভুলে যাবেন না আমি উত্তর কলকাতার ছেলে। তেলেভাজা, কচুরি, চপ-কাটলেট ছাড়া বাঁচি কী করে?” ফিশ ফ্রাই খেতে খেতে গোরাচাঁদবাবুর জবাব।
সেদিন সন্ধে সাতটা নাগাদ দোকান বন্ধ হলে আমরা একসাথেই বেরোলাম। আমি আর গোরাচাঁদবাবু মেট্রো ধরব। আমি রবীন্দ্র সরোবর নেমে বৈষ্ণবঘাটার মিনিবাস ধরব, গোরাচাঁদবাবু শোভাবাজার। বাদলবাবু উল্টোদিকে লোয়ার সারকুলার রোড থেকে বাস ধরে শিয়ালদা যাবেন। সেখান থেকে ট্রেন ধরে নিউ ব্যারাকপুর। আমরা গল্প করতে করতে আসছি। কার্নানি ম্যানসন আর পার্ক হোটেলের মাঝে কানা রাস্তা, গল্প করতে করতে ফুটপাথ ছেড়ে রাস্তায় পা দিতেই পাটা হঠাৎ ধপ করে পড়ে টাল সামলাতে না পেরে কেমন হুমড়ি খেয়ে পড়ছিলাম। ভাগ্যিস, গোরাচাঁদবাবু সময় মতন হাতটা ধরে ফেলেছিলেন। না হলে ছিটকে গিয়ে সামনে পড়তাম। সামনের দুয়েকজন আহা আহা করে ছুটে এল। আমি, “কিছু হয়নি ভাই, পাটা স্লিপ করে গেছিল।” বলে মেট্রো ঢুকে দু’জনে দু’দিকে চলে গেলাম।
বাড়ি এসে শুনলাম, আমার ডিপার্টমেন্টের হেড ফোন করতে বলেছেন। আন্দাজ করলাম, জরুরি কিছু। ভেবেছিলাম, কাল ছুটি নিয়ে কলেজ স্ট্রিট যাব। হয়ে গেল।
ঠিক তাই। আগামীকাল মিনিস্ট্রি থেকে নতুন সেক্রেটারি আসবেন ইনস্টিটিউট প্রদর্শন করতে। সরকার বাহাদুর যাবতীয় টাকাপয়সা দেয়, এইসব আমলারা ফাইলে সইসাবুদ করেন। না হলে বছরের ফার্স্ট কোয়ার্টারের টাকা আসবে পরের বছর জানুয়ারিতে। আর নতুন কেউ এলেই একবার করে জমিদারের মহাল ঘুরে দেখার মতন দেখে যান, আর তার সাথে একটু সরকারি ক্ষমতা দেখিয়ে যান।
সাড়ে ন’টা নাগাদ গোরাচাঁদবাবু ফোন করে জিজ্ঞাসা করলেন ঠিক আছি কি না, পায়ে লেগেছে কি না। ওঁকে কী করে বলি পাটা সামান্য মচকেছে, ব্যথাও আছে।
পরদিন সারাটা সময় কাটল ফালতু মিটিংয়ের নাটক দেখে।
শনিবার দুপুরে খাওয়াদাওয়া সেরে কলমটা নিয়ে বেরোলাম কলেজ স্ট্রিটের উদ্দেশ্যে। বেশ তিন-চারটে দোকান ঘুরলাম। হতাশাজনক পরিস্থিতি। মহাত্মা গান্ধী আর কলেজ স্ট্রিটের মোড়ের একটা দোকান বলল, “আপনি মার্কেটের ভেতর চলে যান। পেছনের দিকে একটা দোকান আছে মনোরমা পেন স্টোর্স, বহু পুরনো দোকান। পেলে ওখানেই একমাত্র পেতে পারেন। আর কোথাও পাবেন না।”
কলেজ স্ট্রিট মার্কেটে ঢুকে খুঁজতে খুঁজতে অবশেষে পাওয়া গেল মনোরমা পেন স্টোর্স। ছোটো দোকান, স্কুল স্টেশনার্সের। সাইনবোর্ডে লেখাই আছে, প্রপঃ নবীন চন্দ্র দত্ত, স্থাপিত ১৯৩৫। দোকানের সামনে টুলে বসে জনৈক ধুতি-পাঞ্জাবি পরা বয়স্ক ভদ্রলোক আনন্দবাজার পড়ছেন। লম্বা রোগাটে গড়ন, এক কানে হিয়ারিং এইড লাগানো, মাথাজোড়া টাক, পেছনে আর কানের দু’পাশে কিছুটা স্মৃতিচিহ্ন বিরাজ করছে। আর কাউন্টারের পেছনে টুলে বসে হাতদুটো জোড়া করে যিনি ঘাড় নিচু করে আছেন, জেগে আছেন না ঝিমুচ্ছেন বোঝা যাচ্ছে না তিনি ছোটোখাটো, খুব রোগা, গালদুটো ভেতরে ঢোকা, মাথার চুল প্রায় সবই কালো, চোখে হাই পাওয়ারের চশমা, ধুতি-পাঞ্জাবি পরা যা এককালে সাদা ছিল এখন কোরা হয়ে গেছে। বয়স সঠিক বলা মুস্কিল, তবে ষাট থেকে আশির মধ্যে। পত্রিকা পাঠরত ভদ্রলোকই নিঃসন্দেহে মালিক নবীন চন্দ্র দত্ত অথবা তার উত্তরাধিকারী। আমি গিয়ে তাকে কলমটা দেখিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, “দত্তবাবু, এর নিব পাওয়া যাবে?”
ভদ্রলোক মেলে ধরা পত্রিকার আড়াল থেকে মুখ বাড়িয়ে দেখে পত্রিকাটা সযত্নে ভাঁজ করে টেবিলের কাউন্টারে রেখে কলমটা হাতে নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, “এ তো প্রায় পঁয়তিরিশ বছর পর চোখে পড়ল। এ আপনি পেলেন কোথায়? আজকাল এসব পেন দেখাই যায় না। এককালে কত বিক্রি করেছি – মন্ট ব্ল্যাঙ্ক, শেফার, ওয়াটারম্যান, পার্কার – কী ইজ্জত ছিল সে সমস্ত পেনের, লোকে বুকপকেটে নিয়ে ঘুরত।”
আমি বললাম, “আর পিকপকেটও হত।”
অপর ভদ্রলোক একবার মুখ তুলে পিটপিট করে দেখে নিয়ে আবার সমাধিতে ফিরে গেলেন।
দত্তবাবু বললেন, “হবেই তো। চোরবাজারে এসব পেনের কী ডিমান্ড ছিল, ভালো দামও পেত। কেউ কিনবে এখন এসব সেলো, লিঙ্ক ডটপেন চোরবাজার থেকে? কিন্তু মুশকিল হল কী জানেন? এই কলমের নিব। আপনাকে কথা দিতে পারছি না। আমার কাছে তখনকার বিলিতি পেনের কিছু পুরনো নিব আছে। আমাকে দু’দিন সময় দিন। একটু খুঁজতে হবে। আপনি বরং সামনের হপ্তায় একবার আসুন।”
আমি একটু দমে গিয়ে বললাম, “এ কলম সারানো যাবে তো?”
দত্তবাবু তাচ্ছিল্যের সাথে বললেন, “নিব পেয়ে গেলে আপনার আর চিন্তা নেই। এই যে নিত্যবাবু আছেন, মরা পেন জ্যান্ত করতে জুড়ি নেই। আপনি এক কাজ করবেন। পেনটা ঢাকনা খুলে একটা পাত্রে জলে ভিজিয়ে রেখে দেবেন, তারপর কলের জলে কিছুক্ষণ ধরে রাখবেন। ভেতরের ময়লা বেরিয়ে যাবে।”
নিত্যবাবুর অবশ্য কোনও বিকার দেখা গেল না।
পরের দিন রবিবার। আমার তো এখন ধ্যানজ্ঞান মঁ ব্লাঁ। কলমটা ভালো করে ধুয়ে শুকিয়ে রেখে দিলাম। সপ্তাহের পাঁচটা দিনই গেল নতুন রিসার্চ প্রোজেক্টের প্রোপোজাল বানাতে। যথারীতি শনিবার এল। আমিও স্নান করে খেয়েদেয়ে বেরোলাম। সারা রাস্তা একই চিন্তা – নিব পাওয়া গেল না, গেল না। মনোরমা পেন স্টোর্সে আসতে দত্তবাবু প্রথমে কী চাই গোছের মুখ করে দেখে হঠাৎ চিনতে পেরে বললেন, “আপনার ঐ পেনের নিব পেয়েছি। দুটোই ছিল। তবে আপনাকে সত্যি কথা বলি, এগুলো অরিজিনাল না, ডুপ্লিকেট। কাজ আপনার ভালোই চলে যাবে। একটু বসতে হবে, নিত্যবাবু কাছেই গেছেন। এক্ষুনি এসে পড়বেন।”
এই অবসরে দত্তবাবুর কাছ থেকে এই কলম সম্বন্ধে অনেক কিছু জানতে পারলাম। এই মঁ ব্লাঁ বোহেমি জাতীয় কলমকে যেখানে প্যাঁচ ঘুরিয়ে নিবটাকে প্রয়োজন মতন ব্যারেলের থেকে বের করে আনা বা ভেতরে ঢুকিয়ে নেওয়া যায়, বলা হয় রিট্র্যাক্টিং নিব সেফটি পেন (বাংলা করলে কী দাঁড়াবে? প্রত্যাহৃত নিব সুরক্ষা কলম!)। এ কলমে কালি লিক করে না। নিব ভেতরে ঢুকিয়ে কলমের ক্যাপ লাগাতে হয়। ক্যাপের ভেতরটা ব্যারেলের মুখে ঠিক বোতলের কর্কের ছিপির মতন চেপে বসার ফলে যেভাবেই কলম থাকুক না কেন কালি লিক করতে পারে না। নিব ভেতরে থাকা অবস্থায় কালি ভরতে হয় ড্রপার দিয়ে। তারপর নিব বের করে গায়ে লেগে থাকা কালি মুছে নিব ভেতরে নিয়ে ক্যাপ লাগাতে হয়। এরপর আর কালি লিকের ভয় নেই। শুধু খেয়াল করে নিব বের করা বা ঢোকানোর আর কালি ভরার সময়ে কলমটা সোজা খাড়া করে রাখতে হয়। ওয়াটারম্যান, শেফার অনেকেরই এ জাতীয় কলম ছিল।
নিত্যবাবু এসে গেছেন, হাতে একটা বড়ো প্যাকেট। কাউন্টারে রাখলেন। দত্তবাবু ড্রয়ার থেকে একটা নিব বার করে আমার কলমটা নিত্যবাবুকে দিলেন। তিন ধন্যি নিত্যবাবু, কোনওরকম তাপ-উত্তাপ নেই! চোখ পিটপিট করতে করতে (ওটা ওঁর মুদ্রাদোষ) কলম আর নিব নিয়ে বসে গেলেন। আমি শ্যেনদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি কী করেন, টেকনিকটা শিখে নিই, ওঁর পর দ্বিতীয় ওস্তাদ আমিই হতে পারব। পেছনের নবটা ধরে এদিক ওদিক ঘোরাচ্ছেন। এবারে ড্রয়ার থেকে একটা মোমবাতি আর দেশলাই বার করে মোমবাতি জ্বালিয়ে আগুনের শিখা থেকে একটু তফাতে রেখে কলমের ব্যারেলটা ঘোরাতে লাগলেন। তারপর কী করে জানি টুক করে পেছনের নবটা খুলে ফেললেন। ভেতর থেকে বেরিয়ে এল একটা লম্বা স্ক্রুর মতন পেঁচানো রড যার মাথায় নিব আর ফিড লাগানো, দুটো ছোটো ছোটো ও-রিং, একটা ছোটো কর্কের ছিপির মতন কী, বোঝা গেল না। চোখের খুব কাছে নিয়ে কীসব দেখে-টেখে নিলেন। আবার নিব লাগিয়ে, সবকিছু যথাস্থানে লাগিয়ে, কলমের তলার নব ঘুরিয়ে নিব ঠিকমতন ঢুকছে-বেরোচ্ছে কি না দেখে নিয়ে কলমটা দত্তবাবুকে দিয়ে মোমবাতি-দেশলাই-ফ্লানেলের কাপড় সব ড্রয়ারে রেখে আবার সামনে টুলে বসে কাউন্টারে হাত রেখে মাথাটা নিচু করে চোখ পিটপিট করতে লাগলেন।
নাহ্, ব্যাপারটা যত সহজ ভেবেছিলাম তত সহজ নয়। একবার একটা টাইমপিস বন্ধ হয়ে গেছিল বলে নিজেই খুলে ঠিক করতে গেছিলাম। ভেতরের কয়েকটা পার্টসও খুলেছিলাম। কিন্তু ফিরে লাগাতে আর পারিনি। শেষপর্য্যন্ত পুরনো খবরের কাগজের ফেরিওয়ালাকে দু’টাকায় বিক্রি করতে হয়। নিত্যবাবুর পর আমাকে এই কলমের ওস্তাদ হতে হলে হামবোল্ড ফেলোশিপ নিয়ে হামবুর্গ থেকে ট্রেনিং নিয়ে আসতে হবে। আরেকটা যে নিব ছিল সেটাও নিয়ে নিলাম। দুটো নিব, নিত্যবাবুর ভিজিট, সবসমেত দুশো টাকা দিয়ে মার্কেট থেকে বেরিয়ে এলাম। ভাবলাম, একবার কফি হাউসে ঢুকে এক কাপ কফি খেয়ে যাই। রাজাবাজার সায়েন্স কলেজে এমএসসি পড়ার সময়ে শুধু একটা ক্লাস শনিবার দিন প্রেসিডেন্সি কলেজে হত। তারপর চলত কফি হাউসে ম্যারাথন আড্ডা। সত্যি ‘কফি হাউসের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই’। এসব ভাবতে ভাবতে ফাঁকা রাস্তাটা পেরোতে যাব, ট্রামলাইনের ঠিক নিচে একটা গর্ত। আমি খেয়াল করিনি আর যার ফলে পাটা গর্তে পড়ে লাইনে হোঁচট খেয়ে মুখ থুবড়ে রাস্তায় পড়লাম আর সাথে সাথে একটা ট্যাক্সি আমার থেকে ঠিক এক বিঘত দূরে ক্যাঁচ করে ব্রেক কষে থেমে গেল। নেহাত ট্যাক্সিওয়ালাটা একটু দূর থেকে আমাকে পড়তে দেখেছিল, তাই রক্ষে। না হলে আজকেই ঐ মঁ ব্লাঁ কলম চিত্রগুপ্তকে উপহার দিতে হত।
দু’তিনজন লোক হৈ হৈ করে ছুটে এসে আমাকে তুলল। ওদের সাহায্যেই ফুটপাথে এসে উঠলাম। কাছেই একটা ওষুধের দোকান ছিল। দু’জন আমাকে নিয়ে দোকানের বেঞ্চিতে বসাল। সবাই বলল, “জোর বাঁচা আজ বেঁচে গেছেন।” নানারকম মন্তব্য, উপদেশ কানে আসছে। আমার তো এদিকে মাথা ঝাঁ ঝাঁ করছে। দোকানের কম্পাউন্ডার এসে বিটাডাইন লোশন দিয়ে কনুইয়ে, হাতে, হাঁটুতে যেখানে যেখানে ছড়েছে, মুছে-টুছে ওষুধ লাগাল। কনুইটা ব্যান্ডেজ করতে হল। একটা টেট ভ্যাক ইঞ্জেকশনও দিল। একটা ট্যাবলেট দিয়ে বলল, “এটা খেয়ে নিন।”
আমি কত হয়েছে জিজ্ঞাসা করাতে, “ও ঠিক আছে। শুধু টেট ভ্যাকের দামটা দিন।” বলে মাথা নাড়ল।
তাই কী হয়? আমি বরং বিটাডাইন লোশন, নিওস্পোরিন পাউডার, একটা ব্যান্ডেজ, ক’টা ব্যান্ড এইড কিনে নিলাম। আমার সাহায্যকারীদের আমার কৃতজ্ঞতা ও অনেক ধন্যবাদ জানালাম। বেরিয়ে একটা ট্যাক্সি নিয়ে বাড়ি।
যা হয় আর কী। বাড়িতে ঢুকেই ‘কী হল’ ‘কী করে হল’ ‘কখন হল’ – তারই একপ্রস্থ ফিরিস্তি। চুপচাপ শুয়ে রইলাম। মেজাজটা খুব খিঁচড়ে গেছে। এই যে কলমটার নিব লাগান হয়েছে, বাড়ি ফিরেই কালি ভরে লিখতে আরম্ভ করব এইসব ভাবনা কোথায় উবে গেল। কলমটা ড্রয়ারে রেখে দিলাম, পরে দেখা যাবে। ডান পায়ে বেশ ব্যথা। সেরকম একটা ফোলেনি।
সন্ধেবেলা একটা রিক্সা করে পরিচিত ডাক্তারের চেম্বারে এলাম। বেশ ভিড়, একটু বসতে হবে। সামনে সেন্টার টেবিলে একটা আনন্দবাজার পত্রিকা। তুলে নিয়ে শুধু পাতা ওল্টাচ্ছি। চোখে পড়ল ‘আজকের রাশিফল’। জীবনে এসব দেখি না। আজ হঠাৎ মনে হল, দেখি তো আমার রাশি। লেখা আছে – নতুন কর্মের সুযোগ, বিদেশ থেকে শুভ সংবাদ, পিতার স্বাস্থ্যের অবনতি, অর্থলাভ, বিবাদে জড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা ইত্যাদি ইত্যাদি। নাহ্, দুর্ঘটনা, পতনজনিত আঘাত বা অর্থনাশ এসব কিছুই নেই।
আমার টার্ন এসে গেছে। পা টিপেটুপে দেখল ব্যথা আছে কি না। প্রেশার দেখল। পারলে একবার সুগারটা যেন টেস্ট করে নিই। পায়ে একটা ক্রেপ ব্যান্ডেজ বাঁধতে হবে। যতটা সম্ভব রেস্ট, হাঁটাচলা না করলেই ভালো। ক্যাপসুল, দু’বার করে সাতদিন। ব্যান্ডেজ, ব্যান্ড এইড খুলে রেখে তিন-চার বার করে নিওস্পোরিন স্প্রে। দোকান থেকে ওষুধ নিয়ে পুনরায় রিক্সা করে বাড়ি।
পরদিন রবিবার, এমনিতেই ছুটি। সোম-মঙ্গল অফিস কামাই। অধিকন্তু ন দোষায়। দিনে দু’বার করে গরম চুন-হলুদ লাগান হল।
হপ্তা কাবার। এসব ঝামেলার মধ্যে আর কলমটা দেখাই হয়নি। পরের রবিবার ব্রেকফাস্টের পর ড্রয়ার থেকে কলমটা বার করলাম। ক্যাপ খুলে কলম খাড়া করে ড্রপার দিয়ে খুব সাবধানে কালি ভরলাম। নিবের নিচ পর্যন্ত ভরতে হবে। ভেতরটা ভালো দেখা যাচ্ছে না। আন্দাজেই ভরলাম। এবারে ক্যাপটা পেছনে লাগিয়ে ঘোরাতে নিব বেরিয়ে এল কালির বড়ো ফোঁটা সঙ্গী করে। একটা নরম গেঞ্জিছেঁড়া টুকরো হাতের কাছেই রেখেছিলাম, সাথে সাথে মুছে নিলাম। নিবটাও ভালো করে মুছে আবার ক্যাপ ঘুরিয়ে ভেতরে পাঠিয়ে দিলাম। এবার ক্যাপ যথাস্থানে লাগিয়ে কলমটা লাঠিখেলার মতন নানারকমভাবে ঘুরিয়ে ক্যাপ খুলে দেখলাম কোথাও কালি লিক করেনি। যাক, কলমটা ভালোই সারানো হয়েছে। নিত্যবাবু যুগ যুগ জিও।
এবারে খাতা নিয়ে বসলাম। আহা, জীবনে কি ভেবেছিলাম মঁ ব্লাঁ কলম দিয়ে লিখব! যা হয় কলম টেস্ট করতে গেলে, প্রথমেই নিজের নামটা লিখতে গেলাম। এ কী! আচঁড় কাটলে কালি আসে না কেন? ছেলেবেলার অভ্যাস। মাঝে মাঝেই রাইটার্স কলমের নিব কালির সেডিমেন্ট আটকে কালি আসত না। তখন বার দুই কলম ঝাড়া দিলে কালি আসত বটে আর তার সাথে অবশ্য ঘরের, ক্লাশরুমের মেঝে, দেওয়ালও কালির ছিটেতে কালিমালিপ্ত হত। সুতরাং সেই ‘পুরাতন বঙ্গপদ্ধতি’ প্রয়োগ করলাম। এই যাহ্, কী হল? দ্বিতীয়বার একটু জোরে ঝাড়া দিতেই কলমটা হাত থেকে ছিটকে মাটিতে একেবারে মিলিটারি জেটের মতন যাকে বলে নোস ডাইভ দিয়ে পড়ল। আমিও প্রায় ঝাঁপ দিয়ে কলমটা ধরার চেষ্টা করলাম। কিন্তু যা হবার তা হয়ে গেছে। কলমটা তুলে দেখে আমি হতভম্ব। এটা কী হল? বোকার মতন তাকিয়ে রইলাম। নিবটা একেবারে ইংরেজি ‘এল’ অক্ষরের মতন বেঁকে গেছে।
অনেকক্ষণ লাগল প্রাথমিক ধাক্কাটা সামলাতে। আমার কাছে একটা নোস প্লায়ার ছিল। সেটা দিয়ে নিবটা সোজা করার চেষ্টা করলাম। খানিকটা হল বটে। যে সরু স্লিটটা থাকে সেটা ফাঁক হয়ে গেছে। কালিতে ডুবিয়ে লিখলাম বটে, সে বড়োজোর দুটো অক্ষর। আবার কালি শুকিয়ে গেল। তা সে তো কোনও কাঠি ডুবিয়েও লেখা যায়। মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। সবকিছুই কেমন বিস্বাদ লাগছে। কলমটা ড্রয়ারে রেখে চুপচাপ শুয়ে রইলাম। আর সবেধন নীলমণি একটা মাত্র নিব আছে। শেষ চেষ্টা করে দেখি।
সপ্তাহ দুই কাটল। কলমের শোকটা অনেকটা সামলেছি। আমার রিসার্চের কাজেও যথেষ্ট ক্ষতি হচ্ছে বুঝতে পারছি। আরেক শনিবার এল। কলম আর নিব নিয়ে আবার কলেজ স্ট্রিট – মনোরমা পেন স্টোর্স। দত্তবাবু এবার দেখে বললেন, “কী, কাজ হচ্ছে তো?”
আমি কোনও কথা না বলে ক্যাপ খুলে নিবটা বের করে ওঁকে দেখালাম। উনি নিবটা দেখে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, “এ কী! এটা হল কী করে?”
“আর হল কী করে! হাত থেকে ছিটকে পড়ে।” বললাম আমি।
“আরেকটা নিব এনেছেন? এটাকে তো আর ঠিক করা যাবে না।”
আমি পকেট থেকে নিবটা বার করে দিলাম। উনি নিত্যবাবুকে ডেকে নিব আর কলম দিলেন। কথাশিল্পী শরৎচন্দ্রের ভাষায় বলতে হয়, ‘নিত্যবাবুর নির্বিকার চিত্তে দাগ পর্যন্ত পড়িল না।’ যাক গে, না পড়ুক। নিত্যবাবু চুপচাপ তার কাজ আরম্ভ করে দিলেন। কলমের ভেতরে কালি ভরা ছিল। ফেলে দিয়ে ধুয়ে নিতে হবে। নিত্যবাবু কলম নিয়ে দোকান থেকে বেরিয়ে গেলেন। হয়তো মার্কেটের কোথাও জলের কল আছে। আমি দেখলাম, দেরি হতে পারে। তাই দত্তবাবুকে বললাম, “আমি আধাঘন্টা পরে আসছি।”
কফি হাউসে এসে দেখি ঠাসা ভিড়। কোথাও কোনও খালি টেবিল নেই। অল্পবয়সী, মাঝবয়সী, বয়স্ক – তিনজন চারজন কি আরও বড়ো দল। নাহ্, কাদের টেবিলে গিয়ে বসব? ও হবেই তো। আজ যে শনিবার। বেরিয়ে এসে এদিক ওদিক ঘুরতে লাগলাম। রাস্তাতেই স্পেশাল চা খাওয়া গেল। কানের পাশ দিয়ে অনবরত ‘দাদা, কী বই চাইলেন’ ‘দাদা কী বই চাইলেন’ শুনতে শুনতে চললাম। বেশ খানিকটা এদিক ওদিক ঘুরে মনোরমাতে এলাম। দূর থেকে নিত্যবাবুকে কাউন্টারে মাথা নিচু করে বসে থাকতে দেখে বুঝলাম, কলম রেডি। এবার আমি সাথে করে কালির বোতল আর ড্রপার নিয়ে এসেছিলাম। নিত্যবাবুই কালি ভরে দিলেন। নিবটা যখন নব ঘুরিয়ে বের করে আনলেন এক ফোঁটা কালিও পড়ল না। শুধু মুখের কাছে যেটুকু আভাস দেখা গেল, ন্যাকড়া দিয়ে মুছে দিলেন। দত্তবাবু একটা প্যাড এগিয়ে দিলেন। কলম দিয়ে ঢেউয়ের মতন খানিকটা আঁকিবুঁকি কেটে, মনোরমা পেন স্টোর্স এসব লিখে দেখলাম ঠিকই আছে। এবার আর দত্তবাবু কোনও টাকাপয়সা নিলেন না। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, “এবার যদি নিব যায়, কী করব?”
দত্তবাবু একটু যেন ম্লান মুখে বললেন, “আসবেন, দেখব কী করা যায়।”
গলার স্বরে ভরসা পাবার মতন কিছুই পেলাম না।
মার্কেট থেকে বেরিয়ে খুব সাবধানে রাস্তা পেরোলাম। আগেরবার যা হল! দু’বার বাস পালটে প্রায় বিকেল চারটে নাগাদ বাড়ি এলাম। এসে আর ‘নো মোর এক্সপেরিমেন্ট’, কলমটা ড্রয়ারে রেখে দিলাম। কিছুদিন যাক। সময়টা ভালো যাচ্ছে না। এই দেখো, আমি কোনওদিন সময়ের ভালোখারাপ দেখিনি। আমার কাছে সময় মানে সময়। অথচ অবস্থা বিপাকে সময়ের ভালোখারাপ বিচারবোধও তাহলে আসছে। আসলে বুঝলাম, দুর্বল মনেই যত সংস্কার বাসা বাঁধে। তবুও আমার বিজ্ঞান সচেতন যুক্তিবাদী মনের সাহস হল না এখনই কলমটা দিয়ে কিছু লিখি। যাক গে, এখন ক্লান্ত লাগছে, চা-টা তো আগে খাই।
মাস খানেকের ওপর গেল ঝড়ের মতন। অফিসের কাজে প্রথম দিন পনেরো গ্যাংটক, তারপর দিন সাতেক ভূপাল আর ভুবনেশ্বর যেতে হল। ফিরে এসে পুরো রিপোর্ট তৈরি করে ডিরেক্টারের কাছে পাঠাতে হল। দিল্লীতে মিনিস্ট্রিতে যাবে। সবে দু’দিন হল একটু নিষ্কৃতি পাওয়া গেছে। আজ রবিবার। কলমটার কথা মনে এল। গতবছরের একটা নতুন এক্সিকিউটিভ ডায়েরি পড়ে ছিল। অনেকদিন ধরে মাথায় একটা গল্পের প্লট ঘুর ঘুর করছে, সায়েন্স ফিকশন টাইপের। সেটা বরঞ্চ এই কলম দিয়েই শুরু করা যাক। ডায়েরিটা আর কলম নিয়ে বসলাম। একটা বাজে কাগজে হিজিবিজি কেটে দেখলাম, না, ভালোই লেখা পড়ছে।
ডায়েরির পাতা খুলে কলমের নিব বার করে সবে আঁচড় কাটতে যাব, হাতে একটা মশা বসে এক মোক্ষম কামড় বসাল। বাবা, এত বড়ো এটা কীসের মশা! ম্যালেরিয়া, না ডেঙ্গি? হাতের মুঠিটা সাথে সাথে শক্ত করে ফেললাম। মশাটা আর উড়তে পারছে না। এবারে বাঁ হাত দিয়ে জোরসে মারলাম নিজের হাতের ওপর এক চাপড়। মশার পঞ্চত্বপ্রাপ্তি ঘটল বটে, কিন্তু কলমটা হাতের জোর ধাক্কায় ডায়েরির পাতার ওপর দিয়ে ঘষটে পাতা ছিঁড়ে ইঞ্চি দুয়েক সরে গেল। উহ্, শুরুতেই বিপত্তি! ঐ পাতাটা বাদ দিয়ে পরের পাতায় চলে গেলাম। এ কী! লেখা পড়ছে না কেন? না বাপু, আর ঝাড়া-টাড়া দেওয়া নয়। কালির বোতল খুলে কালিতে ডুবিয়ে লিখতে আরম্ভ করলাম। কী ব্যাপার! আধা ইঞ্চিটাক দাগ কেটে যে কে সেই। আর দাগ পড়ে না। নিবটা ঠিক আছে তো? চোখে দেখে ভালো বুঝতে পারছি না। কতদিন ভাবছি ডাক্তার দেখাব, চালসে তো ধরারই কথা। একটা ম্যাগনিফাইং গ্লাস ছিল আমার। সেটা বার করে জানালার ধারে আলোতে নিয়ে গিয়ে দেখি, স্লিট বরাবর নিবের টিপের যে দুটো অংশ থাকে তার এক লাইনে নেই, একটা আরেকটার ওপর উঠে গেছে। আমার ছোটোবেলার ফাউন্টেন পেনের বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে জানি, এ ঠিক হবার নয়। ঘষটে পাতা ছেঁড়ার সময় ব্যাপারটা ঘটেছে।
উফ্! প্রচন্ড রাগ হল। কলমটা জোরে আছড়ে ছুঁড়ে মারলাম। ছিটকে দূরে মাটিতে পড়ে রইল। এটা নির্ঘাত অপয়া, অভিশপ্ত কলম। যার ছিল তার নিশ্চয়ই অপঘাতে মৃত্যু হয়েছে। এটা তার প্রিয় কলম, সে এর মায়া কাটাতে পারেনি। আর কেউ ব্যবহার করুক সেটা সে চায় না।
অনেকক্ষণ চুপ করে বসে রইলাম। ধীরে ধীরে শ্বাস নিতে নিতে সাময়িক উত্তেজনাটা খানিকটা কমল, রাগটাও পড়ে এল। ঠিক করলাম, এই কলমের তত্ত্বতালাশ করতে হবে। কার কলম ছিল? কলমটা মাটি থেকে তুলে ক্যাপ বন্ধ করলাম। ক্লিপের সাপটা মনে হল আমার দিকে নৃশংসভাবে তাকিয়ে হিস হিস করছে। লাল চোখদুটো প্রতিহিংসায় জ্বলজ্বল করছে। নাহ্, এই কলমের একটা গতি করতেই হবে। তবে একথা ঠিক, আমি আর এই কলম সারাবও না, আর ব্যবহারও করব না। থাক আপাতত ড্রয়ারে।
একটা জীবনবীমার পলিসি ম্যাচিওর করেছে। তার টাকাটা বাই পোস্ট এসেছে। ব্যাঙ্কে জমা দিতে গিয়ে সমস্যা। চেকে আমার পদবী বন্দ্যোপাধ্যায়, তার কারণ, আমার যাবতীয় সার্টিফিকেটে তাই আছে। কিন্তু ব্যাঙ্কের অ্যাকাউন্ট ব্যানার্জ্জী নামে। এতদিন কোনও অসুবিধা হয়নি, স্লিপের পেছনে আমি যে একই ব্যক্তি সেটা লিখে দিতাম। কিন্তু এটা বড়ো অ্যামাউন্টের চেক। এটা অসুবিধা হবে। তাহলে এখন উপায়? ব্যাঙ্কের অ্যাকাউন্টেন্ট বলে দিলেন, দশ টাকার নন-জুডিসিয়াল পেপারে একটা এফিডেভিট করে আনুন। চেক ক্লিয়ার হয়ে যাবে। মেরেছে! এখন উকিল পাই কোথা? স্কুলের বন্ধু শান্তনুকে ফোন করলাম। শান্তনু বলল, “আরে আমাদের কল্কে তো আলিপুর কোর্টে আছে। তুই ওর কাছে চলে যা। আমারও একটা একবার করে দিয়েছিল।” তাই তো, কল্কেটার কথা তো একবারও মাথায় আসেনি! কল্কে মানে সুরজিৎ মজুমদারের ফোন নম্বর একটা ডায়েরিতেই আছে। ফোন করলাম। ফোন ধরে বলে, “আরে আইনস্টাইন, কী ব্যাপার রে তোর?” ফিজিক্সে পিএচডি করার পর থেকে স্কুলের বন্ধুরা কিছু আমায় ভালোবেসে আইনস্টাইন বলে। এতে আমার মর্যাদা আকাশচুম্বি হয় বটে, আইনস্টাইনের মর্যাদা যে কোন অতলে লুটায়, হায় ভগবান! আমার কথা শুনে বলল, “ও কোনও ব্যাপারই নয়। আরামসে হো যায়গা। তুই শুক্রবার চলে আয়। পোস্ট অফিসের পরের গেট দিয়ে চলে আসবি। ফাঁকা আছি, করে দেব।” যাক বাবা বাঁচা গেল।
সেদিন রাত্রে এক অদ্ভুত স্বপ্ন দেখলাম। আমি আলিপুর কোর্টে এসেছি, কিন্তু কল্কেকে কোথাও খুঁজে পাচ্ছি না। তারপর কোন একটা ঘরে জানি ঢুকে পড়েছি। একজনকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কল্কেকে দেখেছেন?’ লোকটা বলল, ‘চুপ চুপ, বিচার হচ্ছে, খুনের বিচার।’ আমি কীরকম ঘাবড়ে গেলাম। তাকিয়ে দেখি, ঘরের বেঞ্চিগুলো লোকে ঠাসা। সামনে একটা বড়ো টেবিলে গম্ভীর মুখে বিচারক বসে একটা কাগজ দেখে কী পড়ছেন। ঠিক বুঝতে পারছি না। কাঠগড়ায় একটা লোক। কোঁকড়ানো এক মাথা ঝাকড়া চুল, মুখভর্তি দাড়িগোঁফ, মনে হয় কতদিন স্নান করেনি। লুঙ্গি আর একটা ছেঁড়া শার্ট পরা। বিচারকের দিকে তাকিয়ে আছে। সমস্ত চোখ, মুখ, শরীর দিয়ে ক্রোধ, ঘৃণা, অবজ্ঞা, নিষ্ফল আক্রোশ ঝরে পড়ছে। সমস্ত ঘর একেবারে যাকে বলে ‘পিন ড্রপ সাইলেন্স’। বিচারকের বোধহয় পড়া শেষ হল। লোকেরা সব গুনগুন করে উঠল, ‘ফাঁসি হয়ে গেল, ফাঁসি হয়ে গেল।’ আমি বোকার মতন এদিক ওদিক তাকিয়ে বিচারকের দিকে ফিরে দেখি, জজসাহেব পকেট থেকে কলম বার করে ক্যাপ খুলে পেছনে লাগিয়ে ঘোরাতে লাগলেন আর ক্যাপের ক্লিপটা বাঁকা সাপ, লাল দুটো চোখ। আমি চিত্কার করে উঠলাম, ‘ওটা ভাঙা নিব’, ‘ওটা ভাঙা নিব’, ‘ওটা ভাঙা নিব’। কেউ আমার কথা শুনতে পেল না। জজসাহেব খস খস করে লিখে চলেছেন। হঠাৎ এক ঝটকায় আমার ঘুমটা ভেঙে গেল। আমি ধড়মড় করে বিছানায় উঠে বসলাম। সমস্ত শরীর ঘেমে গেছে। বুকটা ধড়ফড় করছে। সারা ঘর ঘুটঘুটে অন্ধকার। কোনদিকে দরজা, কোনদিকে জানালা ঠাহর করতে পারছি না। বেশ কিছুক্ষণ লাগল ধাতস্থ হতে। আস্তে আস্তে চোখ সয়ে আসছে। বিছানা থেকে নেমে আলো জ্বাললাম। জল খেয়ে আবার আলো নিভিয়ে নাইট ল্যাম্পটা জ্বেলে শুলাম। বেশ কিছুক্ষণ এপাশ ওপাশ করতে করতে কখন যে ঘুমিয়ে গেছি জানি না।
শুক্রবার লাঞ্চের সময় বেলা একটা নাগাদ বসকে বলে ইনস্টিটিউট থেকে বেরিয়ে এলাম আলিপুর ডিস্ট্রিক্ট কোর্টে। খুঁজে খুঁজে বের করলাম সুরজিৎ মজুমদারের ডেরা। একজন বলল, “বসুন, উনি একটু পুলিশ কোর্টে গেছেন। এক্ষুনি আসবেন।” বেঞ্চিতে বসলাম। এক লুঙ্গি পরা মাথায় ফেজ টুপি সাদা লম্বা দাড়ি, মুন্ডিত গোঁফ গ্রাম্য চেহারার বয়স্ক লোক সরে জায়গা করে দিল। পাশে বোধহয় তার জেনানা। নিশ্চয়ই জমিজমাসংক্রান্ত ব্যাপার। টানা লম্বা বারান্দা জুড়ে প্রায় জনা ছয়েক টাইপিস্ট। খটা খট শব্দে মুখরিত। কত লোক শুকনো মুখে বসে আছে। কত লোক আসছে, যাচ্ছে। কালো কোট হাতে কালো গাউন, দেখেই মনে হয় বেশ দুঁদে উকিল যাচ্ছেন, এক্ষুনি গিয়ে ‘মি লর্ড’ মি লর্ড’ করবেন।
হঠাৎ “কী রে, কতক্ষণ? আয়।” শুনে তাকিয়ে দেখি সুরজিৎ এসে গেছে। বারান্দা দিয়ে একটা ঘরে ঢুকলাম। চারদিক ঘিরে গোটা দশেক কালো হয়ে যাওয়া টেবিল আর পঁচিশ-তিরিশটা হাতলওয়ালা, হাতলছাড়া চেয়ার। আট-দশটা কাঠের, স্টিলের মাঝারি সাইজের আলমারি। ঢুকে ডানদিকের জানালার ধার ঘেঁষে সুরজিতের টেবিল। “বোস,” বলে ড্রয়ার থেকে একটা সাদা প্যাড আর ডট পেন দিয়ে বলল, “এতে তোর নাম, বাবার নাম, পুরো ঠিকানা আর জন্মতারিখ লিখে দে।”
তা দিলাম। এবারে, “চল” বলে আবার ঘর থেকে বেরিয়ে সামনে বসে যে ভদ্রলোক টাইপ করেই চলেছেন তাকে কাগজটা দিয়ে বলল, “বিনয়বাবু, একটা এফিডেভিট হবে – ঐ ব্যানার্জ্জী আর বন্দ্যোপাধ্যায়।”
সামনের বেঞ্চিতে রোগা, ছোটোখাটো চেহারার একটা লোক গলায় তুলসীর মালা বসেছিল। সুরজিৎ তাকে দেখিয়ে আমায় বলল, “তুই একে তিরিশটা টাকা দিয়ে দে।” আমি মানিব্যাগ বার করে লোকটাকে তিরিশ টাকা দিয়ে দিলাম। লোকটা টাকা নিয়ে হন হন করে চলে গেল। সুরজিৎ বলল, “চল, চা খেয়ে আসি।”
আমি বললাম, “হ্যাঁ রে, তুই বয়ান-টয়ান কিছু করে দিলি না। উনি কি নিজে বানাবেন?”
“তুই ভাবিস কী? ওঁরা পঁচিশ বছরের বেশি সারাদিন ধরে এই কাজই করছেন। আইনের ভাষা সব মুখস্থ। শুধু বলে দিবি কী চাস। তারপর যা লিখে দেবে কলম চালাতে হয় না।”
একটা ঝুপড়িমতন চায়ের দোকানে বেঞ্চিতে দু’জনে বসলাম। পাশে বসে একজন অতিবৃদ্ধ উকিলবাবু, বরঞ্চ উকিলদাদু বললে বেশি ভালো হয়। রোগা, বিস্তীর্ণ টাক, খাড়া নাক, ফরসা, বয়সের ভারে বেঁকে গেছেন। আশির ওপর তো বটেই। দেখলে মনে হয়, ভালো মানুষ। কেন যে এই বয়সে কোর্টে আসেন জানি না। বোধহয় নেশায়। সুরজিত আমায় বলল, “ব্যাটাচ্ছেলে রিইউনিয়নে এবার এলি না কেন?”
“বা রে, আমি তো অফিসের কাজে গ্যাংটক গিয়েছিলাম।”
“ও হ্যাঁ হ্যাঁ, কে যেন বলল।”
“তোকে একটা ব্যাপার বলি। কাল রাতে একটা স্বপ্ন দেখেছি। একটা খুনি…”
সুরজিৎ চট করে হাত তুলে আমাকে থামিয়ে খুব গম্ভীরভাবে বলল, “কোনও স্বপ্নে দেখা খুনের কেস আমি হাতে নিই না। সরি।”
সুরজিৎ চিরকালই প্রচন্ড উইটি। ওর কথার ধরনে দু’জনেই হেসে উঠলাম। উকিলদাদুও কথাটা শুনেছেন। মাথা নাড়িয়ে রসিকতা বেশ উপভোগ করছেন। সুরজিৎ ওঁর দিকে তাকিয়ে হেসে বলল, “আমার স্কুলের বন্ধু।”
উনি মাথা নাড়লেন। আমি বললাম, “ইডিয়ট, আগে ব্যাপারটা শুনবি তো!”
“আচ্ছা আচ্ছা, বল তোর স্বপ্নের মামলা।”
আমি স্বপ্নে ঠিক যা যা দেখেছি বললাম। আমার মঁ ব্লাঁ কলমের কথা অবশ্য কিছু বললাম না। সব বলে ওকে জিজ্ঞাসা করলাম, “তুই কখনও কোনও ফাঁসির রায় দেওয়া শুনেছিস?”
ও মাথা নাড়ল। উকিলদাদু তখন বললেন, “আমি দু-তিনটে শুনেছি। এই ধরুন পঞ্চাশ-ষাটের দশকে। তখন একজন জজসাহেব ছিলেন নামকরা জাস্টিস কাশীনাথ মিত্র। উনি একাই প্রায় দশ-বারোটা ফাঁসির হুকুম দিয়েছিলেন। লোকে বলত ফাঁসিনাথ মিত্র। শেষবারেরটা তো আমার সিনিয়রের কেস ছিল। কেসটা এমনভাবে সাজানো ছিল যে লোকটাকে বাঁচানো গেল না। কিন্তু আমাদের, শুধু আমাদের কেন, অনেকেরই বদ্ধমূল বিশ্বাস ছিল লোকটা অপরাধী বটে কিন্তু খুনটা ও করেনি। জাস্টিস কাশীনাথ মিত্র যাবজ্জীবন দিতে পারতেন, কিন্তু ফাঁসির হুকুম দিলেন।”
আমি জিজ্ঞাসা করলাম, “আচ্ছা যত ফাঁসির হুকুম দিয়েছিলেন, সবারই ফাঁসি হয়েছিল?”
উনি বললেন, “গোটা তিনেক হয়েছিল। আপীল কেসে বাকিদের যাবজ্জীবন হয়। আর ঐ যে আপনি ভাঙা নিব বলছিলেন, ওটা তো রীতি।”
আমি ঠিক বুঝলাম না ব্যাপারটা। সেটা শুনে উকিলদাদু বললেন, “প্রথাগতভাবে ফাঁসির হুকুমনামায় সই করার পর বিচারক যেটা দিয়ে সই করেন সেই কলমের নিবটা, টেবিলে চাপ দিয়ে বেঁকিয়ে দেন যাতে ঐ কলম দিয়ে আর লেখা না যায়।”
আমার বুকটা অজান্তেই কেমন ধক করে উঠল। আমি বললাম, “কেন?”
উনি বললেন, “এটা প্রচলিত প্রথা। ইংরেজ আমল থেকেই আমাদের দেশে চলে আসছে। বাইবেলে বা জেসাসের লাইফে দেখেননি, রোমান শাসক পন্টিয়াস পাইলেট যীশুকে ক্রুশে বিদ্ধ করে মৃত্যুদন্ড দেবার পর একটা পাত্রে জল নিয়ে হাত ধুয়ে ফেলে এই বলে যে এই ব্যাক্তির মৃত্যুর জন্য আমি আর দায়ী নই? এর থেকে ইংরেজি ভাষায় একটা ইডিয়ম আছে ‘টু ওয়াশ ওয়ানস হ্যান্ড’ – অর্থাৎ কোনওপ্রকার দায় থেকে মুক্ত হওয়া। তবে এই কলমের নিব ভাঙার প্রথা কবে কোথায় শুরু হয়েছিল বলা মুশকিল। শোনা যায় ১৬০০ শতাব্দীতেও হাঙ্গেরি ও জার্মানিতে এই প্রথা ছিল। এই প্রথার অবশ্য কোনও নাম নেই। আমাদের দেশে এই প্রথা এখনও চালু রয়েছে। এটা আসলে প্রতীকী ক্রিয়া। এর অর্থ অনেকে বলেন যে বিচারক যে রায় দান করে একবার স্বাক্ষর করেন, সেই রায়কে বদল করবার ক্ষমতা স্বয়ং বিচারকেরও নেই। সেই কথায় বলে না, হাকিম নড়ে তো হুকুম নড়ে না? একমাত্র হাইকোর্ট বা সুপ্রীমকোর্ট বা দেশের রাষ্ট্রপতির সে ক্ষমতা আছে। তাই নিব ভাঙার অর্থ হল প্রদত্ত রায় আর এখানে বদলানো যাবে না।”
আমি উকিলদাদুকে বললাম, “বাহ্, আজ একটা নতুন ব্যাপার জানলাম।”
সুরজিৎ বলল, “আমি নিব ভাঙার ব্যাপারটা শুনেছি, অর্থটা জানতাম না।”
হঠাৎ ঘড়ি দেখে সুরজিৎ বলল, “চল দেখি, তোরটা কতদূর হল।”
দু’জনে আবার ফিরে এলাম। দশ টাকার স্ট্যাম্প পেপারে টাইপ করা বয়ানে সই করলাম। সুরজিত আবার নোটারিও। ও সই করে লাল মোহর লাগিয়ে দিল। এফিডেভিট তৈরি। ঠিক হল, দিন কয়েকের মধ্যে ওর বাড়িতে আমরা স্কুলের কিছু পুরনো বন্ধু মিট করব। সুরজিৎকে অজস্র ধন্যবাদ দিয়ে অফিস ফিরে এলাম।
এসেই আগে গোরাচাঁদবাবুকে ফোন করলাম। আমার গলা পেয়েই উনি বললেন, “কী খবর? কলম চলছে কীরকম?”
“ঠিকই আছে। কিন্তু আমার মাথায় ঢুকেছে এই কলমটা কার ছিল সেটা জানা। ঐ টেবিলটা যে বাড়ি থেকে পেয়েছেন তার ঠিকানা চাই।”
“সে কী! এতদিন তো কলম নিয়ে রিসার্চ করলেন। এখন কলমের মালিক? কিন্তু মুশকিল হল, আমি তো সেটা জানি না। আমার ছেলে বাবলু আনতে গিয়েছিল। ও বলতে পারবে। আচ্ছা, আপনাকে রাত্রে জানিয়ে দেব।”
রাত্রি সাড়ে আটটা নাগাদ বাবলুর ফোন, “কাকু, আমি বাড়ির নম্বরটা বলতে পারব না। আমাদের এজেন্টের সাথে গিয়েছিলাম। ভবানীপুরে যে হরিশ পার্ক আছে, ওটা ছাড়িয়ে বা ফুটপাথ দিয়ে যাবেন। একটু গেলে বাঁদিকে দেখবেন গলি রাস্তা – গোবিন্দ বোস লেন। রাস্তায় ঢুকে বাঁ হাতেই দু-তিনটে বাড়ি পরেই একটাই খুব পুরনো বড়ো তিনতলা বাড়ি আছে। নিচে অফিস। যে ভদ্রলোক সব বিক্রি করেছিলেন উনি ঐ অফিসেই বসেন।”
আমি বললাম, “ঠিক আছে বাবলু, আমার কাজ হয়ে যাবে।”
পরদিন শনিবার। দশটা নাগাদ ব্যাঙ্ক খুলতেই এফিডেভিট আর চেক জমা দিলাম। বাড়ি ফিরে স্নান, খাওয়াদাওয়া সেরে বেরোলাম। গন্তব্যস্থল গোবিন্দ বোস লেন। হাজরার মোড়ে নেমে একটা নাকতলার মিনিবাস ধরে হরিশ পার্ক যেই শেষ হয়েছে, নেমে পড়লাম। বাবলুর কথা মতন বাঁ ফুটপাথ ধরে কিছুদূর গিয়ে পেয়ে গেলাম গোবিন্দ বোস লেন। গোটা চারেক বাড়ি পরেই পুরনো তিনতলা বেশ বড়ো বাড়ি। সামনে খানিকটা ইটের পাঁচিলের ওপর মোটা লোহার নক্সা করা রেলিং শেষ হয়েছে দুটো ছ’কোনা পিলারে, মাঝে মোটা লোহার গেট। একদিকে পাথরের ফলকে কী নাম লেখা আছে পড়া যাচ্ছে না। কালো দাগ সব উঠে গেছে। অন্য পিলারে কাঠের ফলকে সাদা দিয়ে লেখা, রণজয় গুহ বি.আর্ক। বোঝা গেল, আর্কিটেক্ট। সামনের খানিকটা জায়গা ছেড়ে খাড়া তিনতলা উঠে গেছে। দোতলার তিনতলার সমস্ত জাফরি দেওয়া জানালা, ব্যালকনির দরজা মনে হয় বহুকাল ধরে সাঁটিয়ে বন্ধ। অনেক জায়গায় দেওয়ালের প্লাস্টার খসে গেছে। বাড়ির রং যে কী ছিল বোঝবার কোনও উপায় নেই। শ্যাওলা শুকিয়ে শুকিয়ে পুরোটাই প্রায় কালচে মেরে গেছে। নিচের তলার ঢোকার দরজা। দু’পাশের ঘরের জানালা খোলা, আলো জ্বলছে, লোকেদের গলার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। এটাই তাহলে রণজয় গুহর অফিস।
দরজা দিয়ে ঢুকেই দোতলা, তিনতলা যাবার সিঁড়ি উঠে গেছে। একতলার দরজা খোলাই ছিল। ঢুকেই জায়গাটা একটা হলের মতন। কোনায় একটা বেসিন, পাশে দেওয়ালে ওয়াটার ফিল্টার, একটা টেবিল, তার ওপর হিটার আর কেটলি। পাশে ছোটো মিটশেফ। হলের দু’পাশে গোটা চারেক বড়ো ঘর। একটা ঘরে গোটা তিনেক ড্রাফটিং বোর্ড সহ টেবিল, গোটা দুই বড়ো স্টিলের আলমারি। একটা বড়ো টেবিলে রোল করা কাগজের ডাঁই, টি-স্কোয়ার, কম্পাস। দুটি লোক সেট স্কোয়ার লাগিয়ে ড্রইং করছে। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, “রণজয় গুহ…”
বলার সাথে সাথে একজন উল্টোদিকের প্রথম ঘরটা দেখিয়ে দিল। ঘরে ঢুকে ‘রণজয়বাবু’ বলতেই যিনি ঘুরে তাকালেন, আমার কোনও সন্দেহ রইল না যে ইনিই রণজয় গুহ। লম্বা, ফর্সা, স্বাস্থ্যবান যুবক – একমাথা চুল, নিখুঁত দাড়িগোঁফ কামানো। চোখে বাদামি রঙের চশমা, মোটামুটি পাওয়ার আছে। বয়স চৌত্রিশ-পঁয়তিরিশের বেশি নয়। ফুল শার্টের হাতাদুটো দুই ফোল্ড গোটানো। বোঝাই যায় চিরকালই শান্ত, ভদ্র, লেখাপড়া করা ধনীর ছেলে। বড়ো অফিস টেবিল, হাই ব্যাক চেয়ার। পাশে আরেকটা টেবিলে নতুন ডেস্কটপ কম্পিউটার আর ডট ম্যাট্রিক্স প্রিন্টার। দুটো ছেলে – তাদের একজন দূর থেকে একঝলক দেখে বুঝলাম উইন্ডোজ ৩.১ লোড করছে। তখনকার বাজারে ওটাই নবতম। আমি আমার পরিচয় দিয়ে বললাম, “আমার একটা ব্যাপারে কৌতূহল আছে যার জবাব আপনিই একমাত্র দিতে পারেন। সে কারণেই এসেছি।”
উনি আমাকে হাতের ইশারায় বসতে বলে বললেন, “হ্যাঁ হ্যাঁ, বলুন।”
আমি বললাম, “মাস দুয়েক আগে আপনি বোধহয় কিছু পুরনো ফার্নিচার বিক্রি করেছেন। একটা সেমি-সারকুলার টেবিল…”
“ও হ্যাঁ, সে তো ঐ আহিরিটোলা কি ওরকম একটা কোনও জায়গা থেকে এসেছিল…”
“হ্যাঁ আমারই খুব পরিচিত বন্ধু ভদ্রলোক কিনেছেন। কিন্তু কথা তা নয়। ঐ টেবিল পরিষ্কার করতে গিয়ে একটা পুরনো বিদেশি কলম পাওয়া গেছে। আসলে আমার ফাউন্টেন পেনের ওপর খুব দুর্বলতা আছে বলে উনি আমায় দিয়ে দিয়েছেন।”
এই বলে আমি পকেট থেকে মঁ ব্লাঁ কলমটা বার করে ওঁকে দিয়ে বললাম, “আচ্ছা এই কলমটা কার ছিল আপনি কি বলতে পারেন?”
রণজয়বাবু কলমটা হাতে নিয়ে খানিকক্ষণ দেখে বললেন, “এ-কলম অবশ্য আমি কখনও দেখিনি। তবে নিঃসন্দেহে বলতে পারি আমার দাদুর কারণ, ওটা যখন দাদুর টেবিলের ভেতর ছিল। আমার দাদু খুব সৌখিন আর বিলাসী ছিলেন। তাঁর অনেকরকম কলম ছিল। তবে হ্যাঁ, উনি ফাউন্টেন পেন ছাড়া আর কোনও কিছু দিয়ে লিখতেন না।”
“তাহলে এ-কলম আপনারই প্রাপ্য। আপনি টেবিল বিক্রি করেছেন, কলমটা তো করেননি। আর এখন এই কলমের কত দাম!”
“না না না, মাথা খারাপ! ও-কলমে আমার কোনও ইন্টারেস্ট নেই। টেবিল একবার বিক্রি হয়ে গেছে, ওর ভেতর সোনাদানা পাওয়া গেলেও আমার আর হাত নেই। ও স্যার আপনিই রাখুন। এ-বাড়ির যাবতীয় সব বেচে দেওয়া, ফেলে দেওয়া, দিয়ে দেওয়া হয়ে গেছে। এ-বাড়ি ভেঙে এখন মাল্টিস্টোরিড ফ্ল্যাট উঠবে।”
“তাহলে আপনার এই অফিস, বা আপনি নিজে কোথায় থাকছেন?”
“অফিস আমি সামনের মাসে কাছেই একটা ফ্ল্যাটে শিফট করব। আর আমাদের তো নিজেদের বাড়ি আছে সিআইটি রোডে, লিন্টন স্ট্রিটে। আমার বাবা আমি ক্লাস সেভেনে পড়তে পড়তে মারা যান। তখন আমার মা আমাকে নিয়ে এ-বাড়িতে চলে আসেন। মা গোখেলে পড়াতেন। বছর আটেক আগে দাদু মারা যান প্রায় পঁচাশি বছর বয়সে। আমার বিয়ের পর আমি মাকে নিয়ে লিন্টন স্ট্রিটের বাড়ি চলে যাই।”
সফটওয়্যার লোড হয়ে গেছে। ছেলেগুলো রণজয়বাবুকে বোধ করি কিছু দেখাবে। আমার যা জানার, বোঝার সব হয়ে গেছে। অযথা ফালতু দুর্ভাবনা যত মাথায় চেপে বসছিল। আমি, “আচ্ছা, অনেক ধন্যবাদ! আজ তাহলে উঠি,” বলে হাতজোড় করে নমস্কার করে বেরিয়ে এলাম। উনিও হাসিমুখে প্রতিনমস্কার করলেন। ঘর থেকে বেরোতেই কী মনে হল, ঘুরে জিজ্ঞাসা করলাম, “সরি! আচ্ছা, আপনার দাদু কী করতেন?”
কম্পিউটারের মনিটর থেকে মুখ ঘুরিয়ে জবাব দিলেন, “আমার দাদু জজ ছিলেন, জাস্টিস কাশীনাথ মিত্র।”
আমার হৃৎপিন্ডটা লাফ দিয়ে গলায় এসে আটকে গেল আর শিরদাঁড়া দিয়ে যেন একটা ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল। আমার মুখ দিয়ে আচমকা বেরিয়ে গেল, “কাশীনাথ মিত্র! তার মানে? আ-আপনি তো গুহ!”
রণজয়বাবু একটু স্তম্ভিত হয়ে বললেন, “হ্যাঁ, উনি আমার মায়ের বাবা।”
আমি এতটা ভাবিনি। তাড়াতাড়ি “ও, আচ্ছা আসি” বলে দ্রুতপায়ে বেরিয়ে সোজা রাস্তা দিয়ে হন হন করে হেঁটে হরিশ মুখার্জ্জী রোড দিয়ে একটা মিনিবাস যাচ্ছিল, উঠে পড়লাম। সামনের সিট ফাঁকা। জানালার ধারে বসে রইলাম চুপচাপ। মানসিকভাবে এরকম ঝটকা আমি কখনও খাইনি। আসলে গত দু’মাসের ঘটনাবলী আমার বিজ্ঞানী ও যুক্তিবাদী মনে মারাত্মকভাবে আঘাত হেনেছে।
এটা নাকতলা-হাওড়ার মিনিবাস। আমি স্ট্র্যান্ড রোডের মুখটাতে নেমে গেলাম। মাথাটা খুব ভার হয়ে আছে। কপালের রগের দু’পাশটা টিক টিক করছে। বাবুঘাটের কাছে একটা চায়ের দোকানে দুটো বড়ো গ্লাস বিটনুন দেওয়া লেবু-চা খেলাম। হাওড়া যাব বলে একটা লঞ্চের টিকিট কেটে জেটিতে নেবে এলাম। ডানদিকে যে বড়ো লোহার প্ল্যাটফর্মটা ভাসছে তার রেলিংয়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। আমার মনে যে ঝড়টা খানিকটা শান্ত হয়েছিল তা আবার প্রবল বেগে বইতে আরম্ভ করল।
গত দু’মাসের সব ঘটনাগুলো পর পর চোখের সামনে ভেসে যেতে লাগল। কোনওরকম বিচার-বিশ্লেষণ করে আমি এর কোনও অর্থই খুঁজে পাচ্ছি না। এইরকম পঞ্চাশ-ষাট বছরের পুরনো বিদেশি ফাউন্টেন পেনের নিব পাওয়া সত্যিই ভাগ্যের ব্যাপার ছিল। সেটাও পেয়েছিলাম। তাও আবার একটা না, দু-দুটো। দুটো নিবই ভেঙে গেল? কোনও আঁচড় কাটার আগেই? ক্লাস ফাইভ থেকে এমএসসি পর্যন্ত তো ফাউন্টেন পেনেই লিখে এলাম। জীবনে কোনওদিন দোকান থেকে আলাদা করে নিব তো কিনতে হয়নি। কতরকম স্বপ্নই দেখি – ঘুমিয়ে হোক, জেগে হোক। হ্যাঁ, সুরজিতের কাছে আলিপুর কোর্টে যাব, মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল – অবচেতন মনে লেখা ছিল, স্বপ্নে নাট্যরূপ পরিগ্রহ করেছে। কিন্তু তা বলে একেবারে ফাঁসির বিচারের দৃশ্য! বিচারকের হাতে আমার সাপের ক্লিপওয়ালা মঁ ব্লাঁ কলম? এ স্বপ্নের কী ব্যাখ্যা? এটা কি কোনও ভবিষ্যৎ ঘটনার ইঙ্গিত? প্রথম আমি সত্যিই চমকেছিলাম যখন উকিলদাদুর কাছে শুনলাম যে মৃত্যুদন্ডের হুকুমনামায় স্বাক্ষর করার পর প্রচলিত রীতি অনুসারে বিচারক কলমের নিব ভেঙে ফেলেন। আমি কিন্তু ঘুণাক্ষরেও সুরজিৎ বা উকিলদাদুর কাছে আমার কলমের প্রসঙ্গ তুলিনি। তখন থেকেই আমার মাথায় এক নতুন দুশ্চিন্তার উদয় হয়েছিল। যার জন্য পরদিনই ছুটেছিলাম কলমের মালিকের সন্ধানে। কিন্তু জোর ধাক্কা খেলাম যখন জানলাম জাস্টিস কাশীনাথ মিত্র যাঁকে আড়ালে বলা হত ফাঁসিনাথ মিত্র, এই মঁ ব্লাঁ কলমটা তাঁরই ছিল। আমি জানি আমার বিজ্ঞান-সচেতন যুক্তিবাদী মন কখনওই এর কোনও ব্যাখ্যা দিতে পারবে না। তবুও এই ঘটনাগুলো আমার জীবনে সম্প্রতি ঘটেছে। কোনও অনুমান-টনুমান নয়, আমার স্থির সিদ্ধান্ত, এই মঁ ব্লাঁ কলমটা দিয়েই জাস্টিস কাশীনাথ মিত্র একটি নির্দোষ ব্যাক্তির ফাঁসির হুকুমনামায় সই করে নিবটি ভেঙে এরও অপমৃত্যু ঘটিয়েছিলেন।
পশ্চিম আকাশে হাল্কা ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘের মাঝে বিশাল থালার মতন রক্তবরণ অস্তগামী সূর্য। আরও একটি দিন চলে যাচ্ছে। এই দিনটি আর ফিরে আসবে না। প্রকৃতির নিয়মে যার শুরু আছে তার শেষও আছে, যার সৃষ্টি হয় তার বিনাশও হয়। এর কোনও ব্যতিক্রম নেই। যার যখন সময় আসে তাকে এ সংসার থেকে চলে যেতেই হয়। সে কখনও ফেরে না। তাকে ধরে রাখার প্রচেষ্টা নিষ্ফল। তাই তাকে সসম্মানে বিদায় দেওয়াই রীতি। পকেট থেকে সাপের মাথার ক্লিপ দেওয়া মঁ ব্লাঁ কলমটা বের করলাম। সাপটা মনে হল নিষ্প্রাণ। চোখের লাল পাথরদুটো নিষ্প্রভ। কলমটা ডান হাতে নিয়ে শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে ছুড়ে দিলাম। উড়তে উড়তে কিছুটা দূরে গিয়ে কলমটা টুপ করে পড়ল গঙ্গার জলে।