দাদানদার বাঁধানো খাতা

দাদানদার বাঁধানো খাতা

বাবাকে নাকি পাওয়া যাচ্ছে না! নাও, এবার বোঝো ঠেলা! ড্যালা সাক্ষী, মাকে পই পই করে কতবার বলেছিলাম, বাবার সাথে অমন কোরো না! না হয় চিনি, মিছরি, ড্যালার জন্যে আনা জামাগুলো আনফিট হয়েছে, গিঁট দিয়ে তো তবুও পরাই যায়! না হয় মন্টুর দোকানে গিয়ে আধঘন্টা বাদে গোটা সুপুরির জায়গায় লোটা ভরে দুধ এনেছে – তাতেই বা কী এমন অনাসৃষ্টি হল গা, বলি পুজোতে তো দুধও লাগে! ওই তো দাদুতুতুকে সোনামা সকালবেলা পুজোর দুধের জন্যে কেমন পাখিপড়া করছিল, নিজের কানেই তো শুনলাম!

ছোটো বলে আমার কথায় মা তেমন পাত্তা দেয় না। আরে বাবা, তেমন ছোটো তো আর আমি নই! থ্রিতে পড়ি! তিন-তিনটে দস্তুরমত দস্যি মাসতুতো বোনের দাদা। কারাটের কিক জানি, গুলতি দিয়ে ঢ্যালা ছুড়তে জানি, নীল পাহাড়-কমলা সূর্য-হলদে ধানের গোলার মাথায় সবজে কলাপাতা আঁকতে জানি, সকালবেলায় আনন্দলোকে মঙ্গলালোকে বিরাজ সত্যসুন্দর… গাইতেও জানি! এরপরেও ছোট্টটা ভাবা কি ঠিক? কিন্তু মাকে কে বোঝাবে? কিচ্ছু বুঝবে না, উলটে গাল রগড়ে নয়তো নাক মুচড়ে আদর করে চলে যাবে।

বাবাকে যে পাওয়া যাচ্ছে না সে নিয়ে এ-বাড়িতে কিন্তু তেমন হুলুস্থুলু নেই। এটা আমায় বেশ অবাক করছে। একটা জলজ্যান্ত মানুষ সকালে আমার সাথে বাগানে টইটই বেড়াল, কোকিলকে খানিক কুউউ কুউউ করে ভ্যাঙচাল, পুকুরে চারা ছুড়ে ব্যাঙ নাচাল, পুকুরপাড় থেকে গোলাপজাম তুলে আনতে গিয়ে সুড়ুত করে পিছলে পিছনে কাদা মাখল – সেই লোকটা কিনা একঘন্টা ধরে গায়েব! যাকেই জিজ্ঞেস করি কেউ বলতে পারছে না কোথায় গেছে। মা না, আম্মা না, সোনামা না, দাদুতুতু, দাদানদা, মোজোদাদু, টোকাটুলি, ছোদ্দাদু কেউ না! কেবল ড্যালা বলল, কোথায় যেন দেখেছে। তবে কোথায় দেখেছে ঠিক মনে করতে পারছে না। আর চিনি-মিছরির কথা তো ছেড়েই দাও। চিনিকে জিজ্ঞাসা করলাম, তো চোখ গোল্লা গোল্লা করে মাথা-টাথা নেড়ে হাতের মুঠোটা ঘুরিয়ে বলল, ‘উম্মম্ম…উয্যেইইই!’ আর মিছরিকে জিজ্ঞেস করলাম, তো সে ‘ইলিলিলিলিলি’ করে কীসব বলে তলবল তলবল করে ঘুরতে লাগল। তারপর থপ করে মাটিতে বসে চটাচট মাটি থাবড়ে বলল, ‘ইত্তো ইত্তো ইত্তো!’ কেবল ফজুদাদুর কাছে একটা উত্তর পেলাম। ফজুদাদু তখন খড়ির ঘরে উনুনে জ্বাল দিচ্ছিল। গিয়ে যেই জিজ্ঞেস করলাম, “আমার বাবা কোথায় গো?”

তো পাকাচুল থেকে কী একটা পোকা বেছে মাটিতে ফেলে দিয়ে বলল, “তুমার বাবা? সে তো চলি গেল। যাবার কালে বলি গেল যে, বাবু এত্ত জ্বালায়! আর সইহ্য হয় না!”

ধ্যাত! সবকিছু নিয়ে ঠাট্টা। তবে হ্যাঁ, ঠাট্টা নাও হতে পারে। বাবা চলে যেতেও পারে। ওই যে মা বলল না, চোখটা কপালে তুলে নাকি বাবা হাঁটে? সেই শুনেই তো দেখলাম, বাবার মুখটা তুবড়ির খোলের মতো তুম্বো হয়ে গেল। হবে না! চোখ কপালে তুলবে মানে? বাবা কি মনস্টার? না জোম্বি? আমি তখনই জানি, বাবা দুঃখ পেয়েছে। আর দুঃখ পেলেই বাবা হয় কলম নিয়ে ঘচঘচ করে লিখবে নয়তো বনে-বাদাড়ে ঘুরবে। তখন খেলতে বললে আর খেলবে না। ফোঁস ফোঁস করে শ্বাস ফেলবে আর ‘হরি ওম, হরি ওম’ বলবে। গানও শোনাতে পারে।

কথাটা মনে আসার সাথে সাথেই দৌড়োলাম। পিছনের বাঁশবাগান থেকে শুরু করে দক্ষিণের পুকুরপাড়, আমবাগান, লিচুতলা, আমড়াতলা কোত্থাও নেই। নির্ঘাত চলে গেছে। ধুস! এই তো কালই এলাম মামাবাড়ি। সবার সাথে খেলাই হল না। এরই মধ্যে বাবা চলে গেল! আর পারি না।

যাই দেড়তলার ঘরে গিয়ে একটু বসি। ওখানে জানালার পিছনের আমডালে একটা বাসা হয়েছে। কী পাখির কে জানে। তিনটে বাদামি বাদামি হাঁ করা ছানাও হয়েছে! ওদের দেখি গে।

আরে! দেড়তলার ঘরের হ্যাসকলটা খোলা কেন? নিশ্চয়ই ঢ্যালাটা আগেভাগে এসেছে। ঢ্যালা মিছরির চেয়ে বড়ো। কিন্তু তাও তো ছোটোই! ওর থেকে বাঁচাতে এই ঘরে আমার বিশেষ খেলনাগুলো লুকিয়ে রেখেছি। বোধহয় সেগুলোই খুঁজতে এসেছে। বেটাকে হামলে পড়ে ভয় দেখাব, এই ভেবে যেই না দড়াম করে দরজা খুলে হালুম করে পড়েছি অমনি ‘বাপ রে’ বলে যে লাফ দিল সে তো ঢ্যালা নয়! সে যে আমার বাবা!

“ও বাবা! তুমি চুপ করে এখানে কী করছ? আমি গোটা বাড়িতে তোমায় খুঁজে এলাম!”

বাবা বাঁ হাতে বুক ডলতে ডলতে ডান হাতের ইশারায় দরজাটা চাপাতে বলল। বললাম, “কেন?”

বাবা ঠোঁটের উপর আঙুল রেখে ফিসফিসিয়ে বলল, “আস্তে!”

ব্যস, বুঝে গেলাম, একটা মারাত্মক প্ল্যান চলছে। চুপিচুপি দরজাটা চাপিয়ে আসলাম। বাবা আঙুল দিয়ে ইশারায় মেঝের এককোণে দেখাল। দেখি, সেখানে এক কাঠের নক্সাকাটা বাক্স! বাক্সটার ডালাখোলা। ভিতরে অনেকগুলো পুরনোদিনের চিঠিপত্তর। হলুদ কার্ডে নীল কালিতে লেখা। কালি কোথাও কোথাও ঝাপসা। আরেকদিকের খোপে অনেকগুলো ডায়েরি। বাবা বলল, “এগুলো সব তোর বড়োদাদার ডায়েরি। বড়ো হয়ে পড়বি। এত সুন্দর ইংরিজি, দেখবি মনে হবে যেন বড়োদাদা নিজে তোকে তাঁর গপ্প বলছেন।”

বললাম, “তুমি এতক্ষণ এইসব পুরানা জমানার চিঠি পড়ছ!”

বাবা মাথাটা উপরে তুলে ঠোঁট বেঁকিয়ে হেসে বলল, “যেখানে পাইবে ছাই/ উড়াইয়া দেখ তাই/ পাইলেও পাইতে পারো অমূল্য রতন!”

বললাম, “মানে?”

বাবা বলল, “এই দেখ বেলো, কী অমূল্য রতন পেয়েছি!”

সাধে মা রেগে যায়! এতকিছু করে যেটা হাতে নিয়ে দেখাল, সেটা একটা মামুলি খাতা। কমলা-নীল বর্ডার দেয়া খানিক লম্বাটে ছোট্ট একটা বাঁধানো খাতা। সেইটে হাতে নিয়েই একদম নেপোলিয়নের মতো ভাব নিচ্ছে। (এইটেও বাবার ডায়ালগ। আমায় প্রায়ই বলে, সুযোগ পেয়ে বাবাকেই উলটে বলে দিলাম)

বললাম, “ওটা কী? কার খাতা?”

“খুলেই দেখ না।”

হাতে নিয়ে বাঁধানো মলাট উল্টোলাম। প্রথম পাতায় লাল কালিতে লেখা ‘আমার নোটবই’। নিচে নীল কালিতে লেখা – শ্রীমান গিরিশিখর গাঙ্গুলী। আরিব্বাস! এ যে দাদানদার নাম! মানে এটা দাদানদার বাঁধানো খাতা! উৎসাহে পাতা উল্টোলাম। পাতায় পাতায় আঁকা চকরাবকরা মুখ, আর তার নিচে নিচে চার ছ’লাইনের ছড়া। প্রথমেই যে ছেলেটার ছবি তার খালি গা, হাফ প্যান্টুল, মাথায় খান কয়েক চুল আর চিমড়ে রোগা। পিছনে আবার ন্যাজ! ন্যাজের শেষে তিরচিহ্ন দিয়ে ছড়া লেখাঃ

আন্টু বান্টু গা আর পোকায় ধরা দাঁত
লিখতে পড়তে বললে চাঁদু এক্কেবারে কাত
সারাটা দিন খেলায় ধুলোয় তবুও তো আদর!
ন্যাজযুক্ত ভাইটি আমার শশাঙ্কশেখর!

এ বাবা! এ যে মোজোদাদুর নামে লেখা। তারপর একে একে দাদুতুতু থেকে ছোদ্দাদু এমনকি বদ্দিদি ছোদ্দিদি সব্বার নামে পেলাম। তারপর দাদানদার ইশকুলের বন্ধুদের নাম। নিজের খেলনা-টেলনার নাম। তারপর কয়েক পাতা গ্যাপ। মাঝামাঝি এক জায়গায় পেনসিলে কী যেন খুদে খুদে অক্ষরে লেখা। বাবাকে পড়ে দিতে বললাম। বাবা পড়ল, ‘অদ্য সেই অমূল্য দ্রব্যখানি হাতাইলাম। অবশ্য ইহা আমারই প্রাপ্য ছিল। মেজো ছল করিয়া তাহা হস্তগত করিয়াছিল। কিন্তু উহারা তো জানে না, পেটরোগা বলিয়া বল খানিক কম থাকিতে পারে তবে কৌশলে আমি সত্যই উহাদিগের দাদা। হুহুহাহাহাহাহা (অট্টহাস্য)! কী কৌশলে যে উহা হস্তগত করিলাম তাহা লিখিব না। উহা গুপ্তই থাক। এক্ষণে সর্বাগ্রে যাহা প্রয়োজন, তাহা হইল এই দ্রব্যটিকে লুক্কায়িত করা। একখানি মনোরম স্থান আবিষ্কার করিয়াছি, যেইখানে এই ষন্ডবাহিনীর যাতায়াত তেমন নাই। থাকিলেও খুঁজিয়া বাহির করা ইহাদিগের কম্ম নহে। স্থির করিয়াছি, দ্রব্যটি সেই স্থানে লুকাইয়া নিজেও বৎসরকাল সেইদিকে আর যাইব না। পরে ভুলিয়া গেলেও যাহাতে সেই স্থান খুঁজিয়া পাইতে অসুবিধা না হয় তাই সেই স্থানের হদিশ এই নোটবুকের শেষ পাতায় সংকেতে লিখিলাম।

ইতি – শ্রীমান গিশিগাং’

“বাবা, গিশিগাং মানে?”

“বুঝলি না? গিরিন্দ্রশিখর গাঙ্গুলী, ছোট্ট করে গিশিগাং।”

“বাবা! দাদানদার তো দারুণ বুদ্ধি! কিন্তু সংকেতটা দেখলে?”

“দেখলাম বৈকি। নইলে দু’ঘন্টা ধরে করলামটা কী? এই দেখ।” বলে বাবা খাতার এক্কেবারে শেষ মলাটের পাতাটা খুললে।

“যাহ্‌! এ তো পুরো ফাঁকা! তবে যে বললে সংকেত আছে!”

“আছে তো। বলেছে না, শেষ পাতায় আছে!”

“এটাই তো শেষ পাতা।”

“না, বেলোভূষণ! শেষ পাতাটি হল এইটি।” বলেই বাবা মলাটের বাঁধাইয়ের ভিতরের পাতাটা খুলে দেখালেন।

“কিন্তু বাবা, ওখানে যে এত্ত কুদিকুদি লেখা! এত বড়ো সংকেত হয় নাকি?”

“উঁহু। অত বড়ো তো নয়। অনেক লেখার মধ্যে কয়েকটা শব্দ দেখ গোল গোল করা। ওগুলোকে পরপর লিখলেই দেখ, একটা সংকেত হয়। একটা ছড়া। এই দেখ, এই কাগজে সেটা আমি আলাদা করে লিখেছি।”

ভুঁইকেল নিয়ে এল গোপীরাম সরখেল
গাছ থেকে টপাটপ পেড়ে নিল কৎবেল
পাঁচ পা কখন থাকে ওরে মোটু হাতি?
অগ্নিতে পড়ে নাকি কেউ বর্ষাতি?
দুই হাত নাড়ু দেব যদি পাও তল
খুঁড়লে বুঝবে চাঁদু কতখানি জল!

লে হালুয়া! থান্ডারিং টাইফুনস! ক্যাপ্টেন হ্যাডকের মতো মুখ থেকে বেরিয়ে গেল। যত্তসব গেঁড়িগুগলির ঝাঁক। বাবা আমার দিকে চেয়ে মুচকি হেসে ছড়াটা আরেকবার পড়ল। এবার শেষ লাইনের শেষ শব্দটা বলা খতম হতেই মহিষাসুরের মতো হুহুহাহাহাহা করে হেসে উঠলাম।

বাবা বলল, “হাসিস নি, বেলো। একবার ভাব, কী বুদ্ধি তোর দাদানদার মাথায়!”

“ঘোড়াড্ডিম বুদ্ধি! বুঝছ না আবোলতাবোল লিখে মোজোদের ভড়কি দিয়েছে!”

“যাক, জিনিসটা যে লুকিয়েছে ভাইদের জন্যেই সেটা তো তুই বুঝলি। তার মানে তুই বড়ো হচ্ছিস রে, বেলো।”

“বুঝব না কেন? আমিও তো ড্যালার ভয়ে খেলনা লুকোই।”

“তাই নাকি? কোথায় রে?”

“কেন, এই ঘরে!”

“সে কী, দেখতে পাচ্ছি না তো!”

“হুঁ হুঁ, বাবা! এত্ত সহজে মিলে গেলে আর লুকোনোর মজা কোথায়? এই দেখো,” বলে আমি ড্যাক্সোর ভিতর থেকে পুরনো বালিশগুলো টেনে বার করলুম আর তার খোলে হাত ঢুকিয়ে একে একে খেলনাগুলো বার করে আনলুম।

বাবা তালি দিয়ে বলে উঠল, “ব্রাভো! এই না হলে দাদুর নাতি!” তারপর বলল, “তোরটা তো পেলুম, এবার চল তোর দাদানদার দ্রব্যটি দেখে আসি।”

“মানেটা কী? তুমি সংকেতের মানে ধরতে পেরেছ? বলো বলো, ও বাবা! বলো!”

“রোসো, বেলোভূষণ, রোসো! অত হড়বড় করলে কি চলে? এই দেখো, প্রতিটা লাইনের প্রথম একটা বা দুটো শব্দ নিলে কী দাঁড়ায়। কই, একবার পড়ো তো!”

পড়ে দেখি বাবা লিখেছে – ‘ভুঁইকেল গাছ থেকে পাঁচ পা অগ্নিতে দুই হাত খুঁড়লে’

আরিব্বাস! এ যে পুরো গুপ্তধনের হদিশ। “কিন্তু বাবা, ভুঁইকেল গাছটা কী? আর অগ্নি মানে তো আগুন, আগুনে পাঁচ পা দিতে হবে! মানে কার কার পা?”

“ধুস হাঁদা! অগ্নি মানে যেমনি আগুন, তেমনি আবার অগ্নি দশদিকের একটা দিকও। মানে হল ভুঁইকেল গাছ থেকে পাঁচ পা অগ্নিকোণে দুই হাত খুঁড়তে হবে। বুঝলি?” বলেই ঘচঘচ করে খানিক চিবুকের দাড়ি চুলকে বলল, “কিন্তু বুঝলি, ল্যাঠা অন্যখানে।”

“কোথায়?”

“ছাতা, ভুঁইকেল গাছের কথা তো জীবনে শুনিনি! হতে পারে এটাও সাংকেতিক কিছু। এই বেলো…”

“কী?”

“চট করে যা তো, তোর বদ্দিদির কাছে জেনে আয় তো ভুঁইকেল গাছ নামে বাড়িতে কোনও গাছ ছিল বা আছে নাকি।”

বলামাত্র তুড়ড় করে দৌড়োলাম। একদৌড়ে দোতলার হলঘরে। সেখানে তখন আড্ডা জমেছে। দাদানদা, মোজোদাদু, দাদুতুতু, টোকাটুলি সব্বাই আছে। দিদিদি চৌকির উপর বসে। ঘাড়টা টুরটুরিয়ে নড়ছে। দৌড়ে গিয়ে পড়তেই দিদিদি হেসে জিজ্ঞেস করল, “আরে এসো এসো, নটি। বাবাকে পেলে?”

বললাম, “হ্যাঁ। দেড়তলায় ছিল। বাক্স ঘাঁটছিল। ওসব এখন বাদ দাও। তাড়াতাড়ি বলো তো, ভুঁইকেল গাছ কোথায় আছে।”

দিদিদি হাসতে হাসতে বিষম খেল। তারপর বলল, “কিন্তু নটি, ও নামে তো গাছ হয় না।”

দাদানদা গম্ভীরভাবে বলল, “তুমি কার কাছে ওই নাম শুনলে?”

বললাম, “পরে বলব।”

এরই মাঝে হঠাৎ টোকাটুলি বলে উঠল, “কী রে, দিদি! ভুলে গেলি! আরে, পুকুরপাড়ের সেই বাজপড়া ভুয়ো নারকেল গাছটাকে বাবা ভুঁইকেল বলত, মনে নেই? কী রে, দাদা?”

শেষ প্রশ্নটা ছিল দাদানদার জন্যে। দাদানদা রয়ে সয়ে কী উত্তর দিল সেটা জানার মতো সময় আমার নেই। গাছটার কথা জানা হয়ে গেছে, কাজেই আমি বোঁওও করে ফের ছুটলাম বাবার কাছে।

বাবাকে কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে উগরে দিতেই বাবা বলল, “চল।”

দু’জনে মিলে চললাম বাগান পেরিয়ে। বাবার হাতে একটা খন্তা নাকি শাবল! খড়ির ঘর থেকে জুটিয়েছে। কী পাওয়া যাবে সে নিয়ে উত্তেজনায় আমার বুকে ধাপধুপ হচ্ছে। আবার বেড়ে মজাও লাগছে। বাগান পেরিয়ে ওপাশে যাওয়া আমার মানা। তা বলে আসি না যে তা নয়, তবুও নজর এড়িয়ে আসা আর বাবার সাথে বীরের মতো গুপ্তধন খুঁজতে আসার মধ্যে বিস্তর ফারাক। তিড়িং তিড়িং করে নাচতে নাচতে চললাম। খালি হাতে আসাটা খারাপ দেখায় বলে একটা কঞ্চি এনেছি। সে দিয়েই পুকুরপাড়ের জঙ্গলের মুণ্ডছেদ করতে করতে এগোলাম। অন্যসময় হলে হয়তো বাবা ঠিক কিছু বলত, কিন্তু এখন কোনও কথা না বলে সোজা চলল।

পুকুরের শেষ। এখানেই সার সার সুপুরির গাছ। বাবা দাঁড়িয়ে চারপাশটা দেখে বলল, “দেখছিস বেলো, বাড়ি থেকে ঠিক মালুম হয় না, এখানটায় পুরো পুকুরপাড়টা জুড়ে ঠিক তিনটে নারকেল গাছ। তার মধ্যে… ওই যে একদম লাস্টের গাছটা দেখ, বাজে জ্বলা। ঐটাই ভুঁইকেলের গাছ। চল, দেখি।”

এগোতে গিয়েই মার গলা কানে এল। আমায় জঙ্গলে দেখে ডাকছে। বাবাকে বললাম, “মা ডাকছে।”

“উত্তর দিস না। মিশনটা বিগড়ে যাবে। শুনিসনি শুনিসনি ভাব করে চলে আয়।”

“কিন্তু বাবা, পরে যে ঠ্যাঙানি খেতে হবে!”

“সে নয় একটু খাবি। গুপ্তধন খুঁজতে গিয়ে কতজনকে কতকিছু হারাতে হয় আর সামান্য ঠ্যাঙানি খেতে পারবি না? তুই কি আমার সেই ছেলে?”

বাবার কথায় বুকে কী যেন একটা হল। হাতের কঞ্চিটা দিয়ে গাছের গুঁড়িতে দড়াম করে একটা ঘা বসিয়ে ধাঁই ধাঁই করে হাঁটা লাগালাম ভুঁইকেল গাছের দিকে। গাছটা প্রায় সীমানায়। আশপাশে দেদার ঝোপ আর তেমনি মশা। উফ্‌!

বাবা গাছটার গোড়ায় গিয়ে বললে, “এখান থেকে অগ্নিকোণে পাঁচ পা… মানে পুব আর দক্ষিণের মাঝ বরাবর… এই বেলো, এদিকে আয় তো!”

“বলো!”

“এখান থেকে পা গুনে গুনে ঠিক পাঁচ পা যা তো, ঠিক ওই বাবলাগাছটার দিকে।”

“এক… দুই… তিন… চার… পাঁআআ… উফ্‌! উরিবাবা!”

“কী হল রে!”

আর কী হল! পাঁচ গুনতে না গুনতেই কীসে একটা ঠোক্কর খেয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়লাম। বাবা এসে তুলে দিয়ে হাঁটুটা ঝেড়ে দিল। তারপর নিচের দিকে তাকিয়ে হাতের খন্তাটা দিয়ে কী একটা ঘষঘষ করে ঘষেই ভাইকিংদের মতো চেঁচিয়ে উঠল, “ও হো হো!”

“কী রে বাবা! খেপে গেল কেন?”

“হুঁ হুঁ বাবা! তবে? এই দেখ বেলো, এই সেই স্থান। লম্বালম্বি ইট পুঁতে তোর দাদানদার মার্ক! যে ইটে তুই হোঁচট খেয়েছিস, ভালো করে দেখ সেখানে কুঁদে কুঁদে ‘গিশিগাং’ লেখা! দাঁড়া, আর সময় নষ্ট না করে কাজে লাগি।” এই না বলে সেই শাবল নাকি খন্তা দিয়ে হাঁই হাঁই করে গর্ত খুঁড়তে লেগে গেল। খোঁড়ে আর গায় – চল কোদাল চালাই… ধপ… ভুলে রোগের বালাই… ধপ…

golpodadan 1

এমনিই ধপধপানি চলতে চলতে একসময় শব্দ পেলাম, ঠং! বাবা দেখি চোখ নাচিয়ে আমায় ডাকছে। আরিব্বাস! গুপ্তধন! বাবা এবার থেবড়ে বসল মাটিতে। এহ্‌! মা দেখলে যা দেবে না! সাদা পাজামা পরেই হামু খেয়ে পড়ল গর্তে, তারপর মাটি সরিয়ে সরিয়ে আলগোছে বার করে আনল একটা মাটিমাখা কালচে বাক্স। বলল, এটা নাকি অ্যালুমিনিয়ামের সুটকেস। এতে নাকি আগে বইপত্তর রাখা হত। বাবারও ছিল।

সুটকেসের ডালা খুলে পাওয়া গেল আরও একটা বাক্স। সেটাও আগেরটারই মতো, তবে ছোটো। তার ভিতরে রাজ্যের কাগজপত্তর, একটা ছবির বই আর লাল কাপড়ে মোড়া লম্বামতো কী যেন একটা। ওটা কী, সেই কথাটা বাবাকে জিজ্ঞেস করতে যাব, এমন সময় –

“কী! গুপ্তধন মিলল?”

আরি! দাদানদা!

দাদানদার আঙুল ধরে লাফাতে লাফাতে বলতে থাকলাম। “দাদানদা, তোমার লুকোনো জিনিস পেয়ে গেলাম, পেয়ে গেলাম…”

দাদানদার মুখভর্তি হাসি। বাবাকে বলল, “কই, ওটাও খুলে দেখো!”

বাবা মোড়কটা খুলতেই বেরোল তিরের মতো সোনালি ক্লিপের কালো একটা কলম। বাবা বলল, “ফাউন্টেন পেন?”

দাদানদা বলল, “পার্কার। বাপির কলম। মেজো অঙ্কে ভালো করায় বাপি দিয়েছিল। আমিও প্রতিবার ভূগোলে ভালো করতাম। তবুও ওই পেল! হিংসে হয় না? আজ যখন বাবু দোতলায় গিয়ে ভুঁইকেলের খোঁজ করল, তারপর তোমাদের খুঁজতে দেড়তলায় গিয়ে খাটের উপরে বাঁধানো খাতাটা পেলাম অমনি সব পুরনো কথা মনে পড়ে গেল। জানো, ভরদুপুরে একা একা এসে সেই যে লুকিয়েছিলাম, তারপর আর আসা হয়নি। কবে যেন ভুলেই গেছি।” তারপর কলমটার দিকে চেয়ে খানিক চুপ থেকে দাদানদা ফের বললে, “যাই হোক, সবই তো জানলে। যা জানলে তা আর সবাইকেও তো জানাতে হবে। যার কলম তাকে তো দিতেও হবে। কাজেই উঠে পাজামাটা ঝেড়েঝুড়ে নাও। তারপর চলো।”

দাদানদার আঙুল ধরে আমি। আমার পিছনে সুটকেস ধরে বাবা। পাজামার পাশ থেকে মড়া ঘাস না কী একটা শুকনো লতা ঝুলছে। যা বকা খাবে না! হি হি!

ফরোয়ার্ড মার্চ করতে করতে এসে ঢুকলাম ঘরে। ঘরে ঢুকেই সব্বাইকে হাঁকড়ে হাঁকড়ে ডাকলাম। সবাই এসে হামলে পড়ল বাক্সটায়। বদ্দিদি হাসতে হাসতে বলল, “যেমন শ্বশুর তেমনি তার জামাই!”

“ও! আর আমি বুঝি কিচ্ছু না!”

“আরে তুমিই তো সব। তুমিই তো আমাদের ক্যাপ্টেন স্কট!” বলেই মোজো আমার পেটে একটা আদরের ঘুসো ঝেড়ে দিল।

দাদানদা মোজোদাদুর হাতে কলমটা দিয়ে বলল, “নে মেজো, তোর জিনিস ফেরত নে।”

মোজোদাদু বলল, “খেপেছিস? আরে দাদা, তুই লুকিয়েছিলে বলেই না আজ এদ্দিন পর সেই সুখটা ফেরত এল। নইলে তো আমি কবেই ভুলেগুলে খেয়েছিলাম। ও জিনিসের হকদার তুইই। ও তোর কাছেই থাক।”

দাদানদা বলল, “না রে, ও তো আমার নয়। যে ভুলটা না বুঝে ছেলেবেলায় করেছিলাম ঈশ্বর যখন তা বুড়োবেলায় শোধরানোর সুযোগ দিয়েইছে, সে সুযোগ কেড়ে নিসনি ভাই।”

“আরে বল্লাম না, ও কলম তুইই রাখ!” মোজো কপাল কুঁচকে বলে উঠল।

“আমি একটা কথা বলব, ভাই?” ঘাড় নাড়তে নাড়তে বদ্দিদি বলে উঠল।

সবাই তাকাল বদ্দিদির দিকে। বদ্দিদি বলল, “বলি কী, কলমটা বাপির ছবির পাশটায় থাক। ফুলদানিটার পাশে একটা কলমদানি রেখে সেখানেই রাখা থাক।”

সবাই হই হই করে সায় দিল।

তারপর আর কী। হুলুস্থুলু! মামাবাড়িতে নতুন কিছু হলেই যেমন হয়।

অবশ্য তারপরের ধাপটা হল গ্র্যান্ড! পোলাও আর লাল ডিম! আর দাদানদার বাঁধানো খাতা আবিষ্কারের জন্যে দাদানদার তরফ থেকে এবেলার মতো পেল্লাই সাইজের ছানাবড়া! খাবার টেবিলে গপ্প উঠল দাদানদাদের ছোটোবেলার। উরিব্বাবা! সে যা হাসির শব্দ না, সে শুনলে তোমাদের কানে তালা লাগবেই লাগবে। আর সে আসরে যা যা শুনলাম সে বলতে গেলে নির্ঘাত দিন কাবার হয়ে যাবে। কাজেই সে গপ্প অন্য সময়ের জন্যে তাকে তোলা থাক

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত