গাভীন গাইয়ের মত উঁচা প্যাট বাধিয়ে সারাটাদিন শুয়ে-বসে কাটায় নবাবজাদী। আমরা যেন তার চাকর! এই সবুরন,খবরদার আর ধানে পা দিবিনা৷ মাগী আর মাগীর মা এসে ধানে পা দিক। আমাদের এত কিসের ঠেকা বল দেখি। জোহরা রাগে গজগজ করে কথাগুলো বলেই ক্ষান্ত হয়নি,বাঁ পায়ে ধানের ডালা লাথি মেরে হনহনিয়ে পুকুর ঘাটের দিকে হাঁটা শুরু করে।
পাশাপাশি দুটো ছনের ঘর, ছনগুলো বেশ পুরোনো হয়েছে। সামনেই মাঝারি আকারের গোল উঠান,উঠানের এক কোণে জাপানি পেয়ারা গাছ। সবুরন জোহরার কথাতে ধানে আর পা দেয়না,কোমরে গোঁজা শাড়ির আঁচল খুলে মুখটা মুছে নিতে নিতে পেয়ারা তলায় বসে। সাড়ে সাত মাসের অন্তঃসত্ত্বা হালিমাকে বাড়ির ভেতর ঢুকতে দেখেই সবুরন ঠিক করে নেয় আজ চারটে কথা শুনিয়ে দেবে ননদকে । সবুরনের সদ্য ঘামে ভেজা কপাল মুহূর্তেই কুঁচকে আসে। এ যেন যুদ্ধের প্রস্তুতি।
ভাবি,খুব খিদে লেগেছে। ভাত রাঁধোনি? সবুরন উত্তর দেয়না,অগোছালো কথাগুলোকে মনে মনে শাণ দিচ্ছে,একটু গুছিয়েই আজ ধুয়ে দেবে হালিমাকে। হালিমা বারান্দার বাঁশের খুঁটিটাতে ভর দিয়ে মাটির বারান্দায় ধপাস করেই বসে পড়ে৷ আঁচলে বাঁধা হেলেঞ্চা শাকগুলো দ্রুত হাতে বারান্দার খোলা মাটিতে ঢেলে দেয়।আঁচলের শেষ মাথা দিয়ে ক্লান্ত হাতে রোদে পোড়া লালচে মুখখানা মুছে নেয়। না, সবুরন কিছু একটা বলতে গিয়েও বলতে পারেনা৷ শাকগুলো বুঝি যুদ্ধ বিরতির সন্ধি প্রতীক, হালিমার ফর্সা লালচে মুখখানা হয়তো সবুরনের ভেতরটা টলিয়ে দেয়। সবুরন উঠে এসে আবার ধানে পা লাগায়।যন্ত্রের গলায় বলে, ভাত রাঁধা হয়নি,হেঁশেল ঘরে গিয়ে দেখ কটা পান্তা পাস কিনা৷
সবুরনের পা চলছে পাগলা ঘোড়ার খুরের মত৷ একরোদে ধানগুলো সবুরনের পায়ে পরে দিক বিদিক ছুঁটে যাচ্ছে, হালিমা খানিক্ষন ধানগুলোর দিকে চেয়ে রয়৷ ধানগুলোর সাথে নিজের বেশ মিল পায় হালিমা৷ বাঁশের খুঁটিটা ধরে কোনরকম উঠে কচ্ছপ গতিতে হেঁশেলে ঢোকে হালিমা। গলা ভাঙা হাঁড়ির তলার দিকে মুঠ তিনেক পান্তা ভাত পেয়েই যেন খুশি সে।মাচায় থাকা কুটি বাটিটা নামিয়ে এনে হাতের আঙ্গুলকে ছাঁকনি করে প্রতিটা ভাত বাটিতে তুলে নেয়৷ বাটির আধবুক সমান ভাতে হাঁড়ির পানি ঢেলে নিয়ে ধীর পায়ে বারান্দায় এসে বসে হালিমা। পেটের ভেতর থাকা অবুঝ প্রাণটা জোরেশোরেই লাথি মেরে চলেছে,দাঁতে দাঁত চেপে লেবুর পাতা ছিঁড়ে নিয়ে এক হাতে পেটটা আলতো করে চেপে ধরেই বারান্দায় এসে বসে সে। দু চিমিটি লবণ ছিটিয়ে নিয়েই গপাগপ করে পান্তা গুলো গিলে নিয়ে কলপাড়ে যেয়ে বাটি ভরে পানি নিয়ে এক চুমুকে সবটা খেয়ে নেয়।
এতক্ষণ গোয়ালঘরের গোবর তুলছিল সাজু। হালিমাকে দেখেই গলা উঁচিয়ে বলল,টইটই স্বভাব আর গেলোনা । ধানে একটু পা লাগাতে তো পারিস,নাহলে কটা ভাত তো চড়িয়ে দিতে পারতিস৷ নিজেও কথা শুনবি আর আমাকেও শোনাবি । তুই বাপু গলায় দড়ি ঝোলাতে পারিস না? এত যন্ত্রণা, গালিগালাজ আর সহ্য হয়না৷ সাজু গোবরের ঝুড়িটা কোমরে তুলে নিয়েই হেঁশেলের পেছনের দিকে পা বাড়ায়।
হালিমা করুণ চোখে মায়ের চলে যাওয়া দেখে৷ কলের ডাঁটিটা বাঁ হাত দিয়ে ধরে সাবধানী ভঙ্গিতে কলপাড় থেকে নেমে আসে। হালিমার বিয়ে হয়েছে গফফারের বড় ছেলে ইলিয়াসের সাথে৷ বিয়ের দু মাসের মাথায় ইলিয়াস কালামের বোনকে নিয়ে ভেগে ঢাকা চলে গিয়েছে। কি কেলেঙ্কারির অবস্থা সে। দু দফায় ঢাকায় গিয়েছিল হালিমা,ইলিয়াসের কোন খোঁজ পায়নি।
একটা সময় হালিমার পেছন পেছন জোঁকের মত লেগে রইত সে। হালিমা গাঙ্গে গোসলে গেলে সেও পেছন পেছন যেত,সার্কাস দেখতে গেলে সেও সেখানে যেত। একবার হালিমা তার ফুপুর বাড়ি গিয়েছিল দিন চারেকের জন্য,বান্দা সেখানেও হাজির! ব্যাপারখানা এমন হয়েছিল হালিমা শ্মশানে গেলেও সেখানে তাকে পাওয়া যেত৷ মানুষের জীবনের অনেকগুলো হঠকারী সিদ্ধান্তের ভেতর একটা সিদ্ধান্ত হল, “একজন আমার পেছনে জোঁকের মত লেগে রয়েছে৷ আমি বলতে সে অজ্ঞান, অতএব সে আমাকে প্রচুর ভালোবাসে!সারাজীবন এভাবেই সে আমার পেছনে জোঁকের মত লেগে রইবে,এই ভেবে সে জোঁকের কাছে নিজেকে সঁপে দেয়া ” কিন্তু জোঁকের স্বভাব যে রক্ত শুষে খেয়ে চুপিসারে সরে পড়া এটা আমরা ভুলে যাই। একজনের প্রতি আরেকজনের বিস্তর পাগলামি কিংবা উন্মাদনাকে আমরা ভালোবাসা বলে চালিয়ে দিই আর বিপত্তিটা ঠিক তখনই বাধে৷
হালিমা ইলিয়াসের কাছে নিজেকে সঁপে দিল। আশ্বিনের বিকেলে যেদিন ইলিয়াস এসে জানালো সে হালিমাকে ঘরে নিতে চায় তখন কেউ না করেনি৷ হালিমার দু ভাই,তার মা সবাই খুশিতে গদগদ হয়ে গেল এমন গৃহস্থ বাড়ির প্রস্তাবে। কার্তিকের এক দুপুরে হালিমাকে ঘরে তুলে নিল ইলিয়াস । মাস খানেক যেতে না যেতেই যে ইলিয়াস দেবী ভেবে হালিমাকে পূজো দিত সে ইলিয়াস পারলে দেবীর মুখে লাথি মারে! রুপের টান খুব কাছে গেলেই ফিকে হয়,নেশা কেটে যায়৷ বোকা হালিমা তা বুঝে ওঠার আগেই নিজের ভেতরে অবুঝ প্রাণ এলো, স্বামী অন্য মেয়ের হাত ধরে লাপাত্তা হল।
ঝিঁঝিঁর সাথে কোলাব্যাঙগুলোও একনাগাড়ে ডেকে চলেছে। বারান্দায় পাটি ফেলে শুয়েছে হালিমা।পাশেই তার মা সাজু শুয়ে নাক ডেকে চলেছে। ঘরের ভেতর থেকে জোহরার ফিসফিসানির শব্দ ভেসে আসছে।বিয়ের প্রথম মাসটাতে ইলিয়াসের সাথে এমন ফিসফিসানিতে অনেকবারই রাতটাকে ভোর করেছিল হালিমা।জোহরাদের ফিসফিসানির সাথে হালিমার চোখের পানিগুলোও গোটা রাতটাকে ভোর হতে দেখল।
পৌষ পেরিয়ে মাঘ এসেছে।পাটকাঠির আর পলিথিনে মাটির ঘর তুলে আঁতুড়ঘর হয়েছে।মধ্য রাত থেকেই পলিথিনের চালে বৃষ্টির মত টুপটাপ করে শিশির ঝরে পড়ছে।পাতলা কাঁথায় শুয়ে আছে হালিমা।হালিমার মাথার কাছের কুপিটা নিভু নিভু করে জ্বলে চলেছে। দাই এসে পড়েছে প্রথম রাতের দিকে। শেষ রাতের দিকে হালিমা ধবধবে ছেলে সন্তান প্রসব করেছে।দাই বাঁশের চোঁচে নাড়ি কাটতেই হালিমার ছেলে ওয়া ওয়া শব্দ তুলে কেঁদে উঠলো।
ভাগনে হবার খুশিতে প্রথম কয়দিন হালিমার দু ভাই বেশ উল্লাসে থাকলেও সাংসারিক টানাপোড়নে সে উল্লাস সপ্তাহ ঘুরতেই ভাটা পড়ে। নাতিনের দিকে সারাক্ষণ মন পড়ে থাকে সাজুর,ছেলের ভাত খেতে হয় বলেই নাতিনকে ঠিকঠাক যত্নাদি করে উঠতে পারেনা সাজুও। হালিমা ছেলের মুখের দিকে তাকাতে পারেনা। কে দেখবে এই ছেলেকে? বাপ ছাড়া ছেলেকে মানুষ করার পথটা যে কতটা কঠিন তা ভেবেই হালিমা দীর্ঘশ্বাসে বাতাস ভারী করে। উঠানের এক কোণায় সদ্য জন্ম নেয়া কুকুর ছানাগুলো তার মায়ের স্তন লাগাতার চেটে চলেছে।হালিমা ভঙ্গুর দৃষ্টিতে সেদিকে চেয়ে রয়েছে।ঐ ছানাগুলোও হালিমার ছানার মত পিতৃহীন যে।
হালিমার বাঁ হাতে শুয়ে বাঁ স্তন শুষে নিচ্ছে তার ছানাটাও,হালিমা ডান হাতে একমনে তার পিঠে হাত বুলিয়ে চলেছে। হালিমা ছেলের মুখের দিকে তাকাতেই ভয় পেয়ে ওঠে! মুখটা যে ইলিয়াসের মতই হচ্ছে!হালিমার ভয় হতে লাগলো। হয়তো কোন একদিন হালিমার এই ছেলের বউটাও কোন এক মাঘ মাসের আলসে দুপুরে এমনি করেই পিতৃহীন সন্তানকে আগলে রবে মাথার ওপর এক আকাশ সমান কান্নার মেঘ জমিয়ে।