অটোরিক্সার চাকাটা গগনবাবুর মাথার ঠিক দু’ইঞ্চি তফাতে পিছলে থামল। পেছনে আরও গোটাকতক গাড়ি আচমকা থেমেছে ব্রেকের চিলচিৎকারে চরাচর কাঁপিয়ে। গোটা রাস্তার লোক একসাথে হল্লা করে উঠেছে। আপ-ডাউন অন্তত চার-পাঁচটা ট্রামের টিং-টিং পাগলাঘণ্টি বেজে চলেছে, কিন্তু গগনবাবু তেমন কিছু টেরই পেলেন না। শরীরটা এই মুহূর্তে ঠিক তাঁর নিজের বলে মনে হচ্ছে না। যেন আর কারও! চারপাশ থেকে একটা আবছা মতো হই হই কানে আসছে, এই পর্যন্ত! কিছু একটা হয়েছে। অফিসযাত্রী মানুষগুলো এতক্ষণ কলের পুতুলের মতো ডালহৌসিমুখো চলছিল। চোখের পলকে সব দাঁড়িয়ে গেছে চারপাশে গোল হয়ে।
গগনবাবু চোখ মেলে চাইলেন। এত মানুষ ঠিক এই পারসপেকটিভে দেখা হয়নি কখনও। যেন অজস্র পায়ের জঙ্গল! গগনবাবু অজান্তে শুয়ে শুয়েই ঘাড় ফিরিয়ে এদিক ওদিক চাইলেন। না, ব্যাপারটা ঠিক মাথায় ঢুকছে না। হঠাৎ কী যে হল? ফুট দুয়েক দূরে কাচ ভেঙে মাকড়সার জালের ডিজাইন হয়ে যাওয়া একটা চশমা, আর তারও ফুট দুয়েক তফাতে একটা পেটরোগা মানিব্যাগ উপুড় হয়ে পড়ে আছে। শুকনো পাতার স্টাইলে ইচ্ছেসুখে উড়ে চলা একটা দুয়েকটা নোট আর খানকতক রেজগী। কার? রাস্তায় গলে যাওয়া পিচে গাড়ির টায়ারের চাপে কার একটা ছেঁড়া চটি জলছবি হয়ে আছে। এদের মালিক কোথায়? হঠাৎ পেটের কাছটায় ভয়ংকর যন্ত্রণা করে উঠল তাঁর। আর সেই মুহূর্তেই মিনিটখানেক আগে ঘটে যাওয়া পুরো ব্যাপারটা জলছবির মতো ভেসে উঠল গগনবাবুর মনে।
ঘড়িতে সাড়ে ন’টার ঢং শুনে রোজকারমতো বাড়ি থেকে বেরিয়ে ফটিকের দোকান থেকে একটা পান, তারপর গুরুদাস লেন ধরে বৌবাজার স্ট্রিট। অ্যান্টনি কবিয়ালের কালীমন্দির ডান হাতে রেখে সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ দৌড়ে পার হবার পর বেকুব ঠেলাওয়ালাটাকে পাশ দিতে রাস্তার দিকে একটু ঝুঁকতেই আচমকা পেছন থেকে হর্ন আর মাঝারী ধরনের একটা ধাক্কা! ব্যস। সষ্টাঙ্গে পেন্নামের ভঙ্গিতে হুমড়ি খেয়ে সোজা রাস্তার ওপর। হঠাৎ যেন চটকা ভাঙল তাঁর নিজেরই। ধাক্কা খাবার মোট বিশ সেকেন্ডের মধ্যে দ্বিতীয়বার চারদিক অন্ধকার হয়ে এল গগনবাবুর। পুরো ভোঁ হয়ে যাবার আগে শুধু কানে এল কে যেন তাঁর দিকে ঝুঁকে পড়ে কী বলছে।
নগদ দুটো ক্যাজুয়াল লিভ খরচা করে তৃতীয়দিনে অফিস গেলেন গগনবাবু। আজ আর হেঁটে যেতে ভরসা হল না, পাঁচ টাকা খরচা হয়ে গেল শেয়ার ট্যাক্সিতে। শশধরের কল্যাণে সেদিনকার অ্যাক্সিডেন্টের কথা অফিসে বেশ ভালোই ছড়িয়েছে দেখা গেল। তাঁকে ট্যাক্সি থেকে নামতে দেখে অফিসের দারোয়ান ব্রীজমোহন এগিয়ে এল। “দোতলায় উঠতে পারবেন তো, বাবু? ধরতে হবে?”
তাকে ধন্যবাদ দিয়ে দু’পা এগোতেই সতীশ পিওনের সাথে দেখা। অফিসে এরকম হাড়জ্বালানো আপদ আর দুটি নেই! দেখা হতেই সতীশ তার পানদোক্তা চিবুনো ক্ষয়া দাঁতে একগাল হেসে বললে, “এ বয়সে একটু সামলে না চললে হয়? ছুটিগুলো না জমিয়ে আর দিনকতক আরাম করলে হত না? চাকরির মায়া আর কার জন্যে করছেন মশাই?”
তেতো মেজাজটা মুচকি হেসে ঢাকা দিতে হল। পাশের টেবিলের শঙ্কর সাহাবাবু গোল চোখে বলল, “কবে থেকে বলছি গাঁয়ের ছেলে গাঁয়ে যান। এ কলকাতা শহর মশাই! এ সবাইকার জন্য নয়। হয়েছিল তো আর একটু হলেই!”
পিত্তি জ্বলে গেল গগনবাবুর। “তোমার আর কী হত হে, সতীশ? যদি মরেও যেতাম, বড়োজোর হাফ বেলা ছুটি পেতে। একছড়া গাঁদাফুলের মালা কেনার চাঁদা দিতেও মুখ ব্যাজার করতে। অত কীসের মাথা ব্যথা!” কথাটা অবশ্য মুখে না বলে মনে মনেই বলতে হল। সহবত বস্তুটা সবাই একসাথে শেখে না। কারও মুখের ওপর উচিত কথাটা বলতে কোথায় যেন আটকায় গগনবাবুর। সেগুলো মনে উদয় হয় সময় চলে যাবার পর।
দোতলায় সিঁড়ির ল্যান্ডিংয়ে দাঁড়িয়ে রুমাল বার করে কপাল আর ঘাড়ের ঘাম মুছে তেতলার পথ ধরলেন গগনবাবু। শশধরেরও বাড়াবাড়ি আছে। কী দরকার ছিল সবাইকে জানানোর! আছাড় ওরকম একবার দু’বার সবাই পড়ে। অবশ্য পথ থেকে সেদিন অজ্ঞান অবস্থায় তাঁকে তুলে ডাক্তারখানায় নিয়ে যাওয়া, সেখান থেকে বোর্ডিংয়ে পৌঁছে দেওয়া এসব শশধরই করেছিল। লোকটা পরোপকারী। তবুও এতটা লোক জানাজানি করা ঠিক হয়নি। টেবিলে বসবার একঘন্টার মধ্যে ঠিক সতেরো জন শুভানুধ্যায়ী অযাচিতভাবে এসে মুখচোরা গগনবাবুকে জ্ঞান দিয়ে গেল বয়েস বুঝে সাবধানে চলাফেরার ব্যাপারে। এদের মধ্যে ক’জন তাঁকে সত্যিকারের ভালোবেসে এসেছে তাতে গগনবাবুর যথেষ্ট সন্দেহ আছে।
দুপুর আড়াইটে নাগাদ সুবোধ এল। গড়পারের সুবোধ সমাদ্দার গগনবাবুর ছেলেবেলার বন্ধু। ওরিয়েন্ট্যাল সেমিনারিতে একসাথে পড়াশুনা করেছেন। কলেজে উঠে অবশ্য দেখাটেখা হত না বিশেষ – সুবোধ সিটিতে আর গগনবাবু বঙ্গবাসীতে। তাছাড়া সুবোধ একটু বখেও গিয়েছিল। তারপর বহুকাল বাদে এই অফিসে এসে আবার নতুন করে যোগাযোগ। সুবোধ পারচেজে আর গগনবাবু অ্যাকাউন্টসে। এতক্ষণে যেন ভারি আরাম পেলেন গগনবাবু। ছেলেবেলার বন্ধু বলে কথা! ফাইল-কলম বন্ধ করে বন্ধুর দিকে ঝুঁকে বসলেন।
“আর কী, হয়ে গেছল তো!”
“শুনলাম।”
“কে বলল তোকে?”
“শশধর। শশধর খবর দিলে পরশু। ভারি চিন্তায় পড়েছিলাম।”
“একবার দেখতে গেলে তো পারতি?”
“এক্কেবারে সময় পাইনি রে। পরশু মার্কেটে গেছিলাম, খবর পেতে পেতে রাত্তির।”
“কাল? কাল তো সারাদিন শুয়েই ছিলাম।”
“হল না। কাল সকাল থেকে আবার তোর বৌদি জ্বর বাধিয়ে বসেছে। ডাক্তার-টাক্তার, দৌড়াদৌড়ি। আজ ভাবছিলাম, না এলে বিকেলে যাব।”
“দুটোর বেশি ক্যাজুয়াল লিভ মিলল না। আছেই মাত্র ছ-সাতটা।”
“যাক গে, এখন আছিস কেমন?”
গগনবাবু মুচকি হেসে সোজা হয়ে বসলেন। মোটা ফ্রেমের আড়ালে কোঁচকানো চোখদুটো দেখলেই বোঝা যায় সুবোধ গত দু’দিন কতখানি দুশ্চিন্তা করেছে তাঁর জন্য। একেই বলে আন্তরিকতা।
“ঠিকই আছি।”
“চোরাগোপ্তা চোট-টোট হয়নি তো কোথাও? ডাক্তার কী বলছে?”
“হাঁটু আর পেটে রাস্তার গরম পিচ লেগে ফোস্কা পড়েছে। তাই যা যন্ত্রণা! এছাড়া তেমন আর কিছু…”
মিনিটখানেক কারও কোনও কথা নেই। সুবোধ কেমন অন্যমনস্কভাবে চেয়ে রয়েছে গগনবাবুর দিকে। এবার একটু একপেশে হেসে বললে, “মনে পড়ে, সার্কুলার রোডের ট্রাম-লাইনে মাঞ্জার কাচ গুঁড়োবার কথা? দীনুটাতো ওই কম্মো করতে গিয়ে মারাই পড়ল! সত্যিই কী কপাল ছেলেটার! সেই কোন যুগে মরে-ঝরে সাফ। আর তুই-আমি তো দিব্যি বেঁচেবর্তেই আছি। একেই বলে ভাগ্যের লিখন।”
গগনবাবুর কপালে, গলার কাছে বিন্দু বিন্দু ঘাম। “মনে নেই আবার!”
স্কুল পালিয়ে ক’বন্ধুতে মিলে ঘুড়ির সুতোয় মাঞ্জা দেওয়া হচ্ছিল গোঁসাইবাগানের ভেতর। তাঁকে আর দীননাথকে দলের সর্দার সুবোধ পাঠাল ট্রাম-লাইন থেকে কাচ গুঁড়িয়ে আনতে। বড়োলোকের ছেলে দীনু পথ চলতেই শেখেনি, আর তাঁর নিজেরই বা কী বয়স! কলকাতার রাস্তাঘাট এখনকার মতো না হলেও ভিড় ছিল বৈকি! মনে আছে, ট্রামটা চলে যাবার পরেই পেছন থেকে যমদূতের মতো লরিখানা ছুটে এল। গেল গেল! দীনুর কোনও চিৎকার শুনেছিলাম কী? মনে পড়ছে না এতদিন বাদে। তবে দৃশ্যটা পরিষ্কার মনে আছে। দীননাথের ছোট্ট শরীরটা রাস্তার পিচে সেঁটে গেছিল। গায়ে কাঁটা দিয়েছে গগনবাবুর। দীনুর অবস্থা তাঁরও হতে পারত, হল না। সুবোধের মতে তাঁর ভাগ্য ভালো ছিল বলে সে-যাত্রায় বেঁচে গিয়েছিল। দু’দিন আগে ঘটে যাওয়া ব্যাপারটা তাই। কে জানে ভবিষ্যতে কী আছে। কপাল বারে বারে তাঁকে বাঁচিয়ে দেবে কি না কে বলতে পারে?
পাঞ্জাবির পকেট থেকে রুমাল বার করে কপালের ঘাম মুছতে মুছতে সুবোধের দিকে ঝুঁকলেন গগনবাবু। গলার স্বর যতটা সম্ভব চাপা, “একটা কথার ঠিক জবাব দিবি?”
“কী কথা?”
“ভাগ্যে কী আছে আগে থাকতে সত্যিই জানা যায়?”
“খবরের কাগজ পড়িস?”
“তাতে কী?”
“অতগুলো জ্যোতিষীরর বিজ্ঞাপন গ্রহরত্নের ব্যাবসা, এগুলো কি পুরোটাই ভাওতাবাজি বলে মনে হয় তোর?”
“সোজা কথায় বল না! এরা সবাই কি সৎ?”
“আহা! ওটা তো একটা বিজ্ঞাপন। যে লোক ভালো করে শিখে চর্চা করছে সে সৎ। অবশ্য বেশিরভাগই বুজরুক।”
“ঠিক লোক পেলে কপালের লিখন জানা যায় বলছিস?”
“আলবাত! দোষ থাকলেও কাটানো যায়।”
“ওই গ্রহরত্নে?”
“রত্নই হোক, ধাতু হোক – কিছু দ্রব্যগুণ না থাকলে অমনি চলছে?”
“তোর জানাশোনা সেরকম ভালো আছে কেউ?”
সমাদ্দার দেশলাই বাক্স খুলে কাঠি বার করে আলতো করে কানে সুড়সুড়ি দিতে দিতে আধবোজা চোখে চাইলে। “তাতে বিশ্বাস হবে তোর?”
“আহা, গিয়ে একবার দেখতে আপত্তিটা কোথায়? বিশ্বাস করবার মতো কিছু পেলে করব বিশ্বাস।”
সুবোধ উঠে দাঁড়াল। “ছুটির পর ছক-টক নিয়ে চল আমার সাথে, আজই।”
কলকাতা, বিশেষ করে উত্তর কলকাতার পুরনো বনেদি জায়গাগুলোয় আগে মাঝেমাঝেই বেড়াতে আসতেন গগনবাবু। গড়পারের বাড়ি থেকে বাগবাজার, শোভাবাজার, নিমতলা, আহিরীটোলা কতবার ঘুরে গেছেন স্রেফ পুরনো গন্ধ ভালো লাগে বলে। গড়পারের এজমালি বাড়ি বিক্রি হয়ে যাবার পর অবশ্য আর বিশেষ হয়ে ওঠে না। মেসে থাকতে ইচ্ছে-টিচ্ছেগুলো কেমন মরে যায়। আজ শোভাবাজারের গঙ্গার ঘাট বাঁয়ে রেখে গলির অলিগলি তস্য গলি হয়ে যেখানে এসে পৌঁছলেন সেখানে জীবনে এই প্রথম পা পড়ল তাঁর। সাঁঝের মুখে নির্জন আধপোড়া বাড়িটার সামনে দাঁড়িয়ে গায়ে কাঁটা দিল গগনবাবুর। রাস্তা অথবা বাড়ি কোথাও কোনও আলো নেই। বোধহয় লোডশেডিং চলছে এ এলাকায়। দরজায় কড়া নাড়ার আগেই দরজাটা খুলে গেল। একটু অবাক হয়ে সুবোধের পিছু পিছু ভেতরে ঢুকলেন গগনবাবু। দরজাটা খুলল কে? সে জানল কী করে, এঁরা এসেছেন! অবশ্য ভেতরটা এত অন্ধকারমতো, কাউকে হঠাৎ দেখতে না পাওয়াটাই স্বাভাবিক। অবাক হতে বাকি ছিল তাঁর। চৌকাঠ ডিঙোতেই বাড়ির ভেতর থেকে ভারী গলায় কে যেন বলল, “দু’গ্লাস সরবত পাঠিয়ে দে একতলায়, সুবোধবাবু এয়েচে বন্ধু নিয়ে।”
আশ্চর্য! লোকটা যেই হোক, বন্ধু নিয়ে সুবোধ এসেছে জানল কী করে? সুবোধের দিকে চাইলে সে গগনবাবুর হাতে অল্প চাপ দিয়ে চুপ করে থাকতে ইশারা করল। বাইরের ঘরে বসে সরবত খাবার পর একটি কমবয়সী ছেলে তাঁদের দু’জনকে ভেতরকার আরেকটি ঘরে নিয়ে গেল। জানা গেল, পুজোর ঘরের কাজ সেরে এঅঘরে এসেই দেখা করবেন জ্যোতিষার্ণবমশাই।
ঘরে কোনও আসবাব নেই। মেঝের ওপর সাবেকী চালে জাজিম পাতা, তার ওপর শীতল পাটি। সুবোধের পাশে জড়সড় হয়ে বসলেন গগনবাবু। একটা মাত্র পেতলের প্রদীপের আলোয় ঘরের আধখানাও ভালো করে নজরে পড়ে না। সেই আধো অন্ধকারে চোখ ধাতস্থ হয়ে এলে গগনবাবু দেখলেন, খানিকটা তফাতে একটা বাঘের চামড়ার আসন ঘেঁষে জলচৌকি পাতা আছে। পেছনের দেয়ালের কুলুঙ্গীতে যে বস্তু রাখা তা দেখেই গা শিউরে উঠল গগনবাবুর! প্রমাণসাইজের একটি নরকরোটি! তার সাদা ধপধপে কপালে নানারকম নক্সা আঁকা। চোখের অন্ধকার খোপে অতল দৃষ্টি! বরফের একটা স্রোত যেন মেরুদন্ডের ভেতর দিয়ে বয়ে গেল গগনবাবুর। শরীরের যন্ত্রণার কথা মনেই রইল না তার।
“কী গো সমাদ্দার, বন্ধুর বুঝি বিশ্বাস-টিশ্বাস নেই এ বিদ্যেয়?”
চমকে উঠলেন গগনবাবু। দরজায় এক অদ্ভুত মূর্তি এসে দাঁড়িয়েছে। মাথায় জটা, দাড়িগোঁফে মুখ ঢাকা, রোগা হাড়সর্বস্ব চেহারা। লম্বায় ছ’ফুট তো বটেই। গলায় রুদ্রাক্ষের মালা, পরনে রক্তবস্ত্র, কপালের ঠিক মাঝখানে জ্বলজ্বলে শ্বেত চন্দনের ফোঁটা। অজান্তেই সুবোধের সাথে ফরাস ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছেন গগনবাবু। সম্ভ্রম পাবার মতো চেহারা বটে। দু’পা এগিয়ে এলেন মানুষটি। চোখের মণি গগনবাবুর মুখের ওপর থেকে নড়েনি। প্রদীপের আলোয় কাটা কাটা নাক-মুখ-চোখ। লালচে ছোপ ধরা শাঁখের মতো গায়ের রঙ। বয়সের ভারে ঢ্যাঙা শরীরে সামান্য কোলকুঁজো ভাব এলেও বোঝা যায় মানুষটা মনে মনে একটু উদ্ধত। গগনবাবুর নমস্কারের জবাবে তাঁর ডানহাতটা অল্প উঠল শুধু। সষ্টাঙ্গে পেন্নাম করা সুবোধের দিকে নজর একবারও ফেরেনি। প্রদীপের আলোয় অল্প হাসির ঝিলিক খেলেgolpogogon02 (Large) (Medium)গেল জ্যোতিষার্ণবমশাইয়ের মুখে। “বিশ্বাস অবিশ্বাস হবে এখন, বসুন গগনবাবু। ওঠো হে, সমাদ্দার।”
গগনবাবুর গলা শুকিয়ে কাঠ, হাঁটুর কাছটা তিরতির করে কাঁপছে! বসতে না বললেও দাঁড়িয়ে থাকা সম্ভব হত না তার পক্ষে। গগনবাবু কোনওমতে বলতে পারলেন, “আমার নাম জানলেন কেমন করে?”
সুবোধ কিছু বলার আগেই ঘর কাঁপিয়ে হেসে উঠলেন ভদ্রলোক। “জানতে হয়। কিছু কিছু জানা হয়ে যায় আর কী! যেমন আপনার কপাল দেখেই বুঝতে পারি পরশুর আগের দিন সকালে আপনার মৃত্যুযোগ ছিল, একচুলের জন্য রেহাই পেয়েছেন। চাকরি পাকা হয়েছে বছর তেইশ। তার আগে ছ’বছর ব্যাবসা আর সেই সূত্রে মতলববাজের খপ্পরে পড়ে তিনরাত্তির হাজত বাস। আরও অনেক কথা জানতে পারলাম। মায় আপনার ছেলেবেলার খবর, গত জন্মের খবর।”
গগনবাবু ঢোঁক গিললেন। “গত জন্মের খবর!”
জ্যোতিষার্ণব বাঘছালের আসনে এসে বসেছেন। কোশাকুশির জলে আচমন করে বড়ো বড়ো চোখে চাইলেন গগনবাবুর দিকে। “জন্মান্তর মানেন তো, গগনবাবু? নাকি সেখানেও অবিশ্বাস?”
“আজ্ঞে তা…”
“সহস্র জন্মের শেষে মানব জন্ম। গত হাজার জন্মের ভালোয়-মন্দয় মিলে ছক তৈরি হয়েছে এই মানবজীবনের। সে ছকের বাইরে একটি পাও ফেলার ক্ষমতা কারও নেই। আকবর বাদশা, চেঙ্গিস খাঁ, হিটলার থেকে শুরু করে আপনি-আমি।”
গগনবাবুর পায়ের তলার মাটি সরে গেছে। পাশের দেওয়ালে অসহায়ভাবে কিছু ধরার চেষ্টা করতে করতে শুনলেন, সুবোধ জ্যোতিষার্ণব মশাইকে ওর ছকটা একটু দেখে নিতে বলছে। এই ঘোর গরমেও হিমেল স্রোত বয়ে যাওয়া শিরদাঁড়া কোনওরকমে খাড়া রেখে গগনবাবু এই আশ্চর্য ক্ষমতাধারী মানুষটির কার্যকলাপ দেখতে লাগলেন। বেশ বুঝতে পারছেন, তাঁর মধ্যে যেন আর তিনি নেই।
প্রথমেই মড়ার মাথার খুলিটিকে জলচৌকির ওপর রেখে মৃদুস্বরে কিছুক্ষণ মন্ত্রপাঠ চলল। তারপর সাদা খড়ির দ্রুত টানে অদ্ভুতরকমের একটা ছক এঁকে ধ্যানে বসলেন জ্যোতিষার্ণব। কোত্থেকে যেন মৃদু একটা আওয়াজ কানে আসছে। বহুদূরে খোল-করতাল বাজিয়ে সামবেদী মন্ত্র পাঠ করছে কেউ। অনেকটা ধীর লয়ে গাওয়া গানের মতো। কানে আসে কি আসে না। নির্জনতা যেন আরও বেড়ে উঠেছে তাতে। প্রদীপের কাঁপা আলোয় ঘরের নোনা শ্যাওলার দাগ ধরা দেওয়ালে নানারকম ছায়া কাঁপছে। হঠাৎ কোত্থেকে দমকা বাতাস এসে প্রদীপের শিখাটাকে প্রায় নিভু নিভু করে দিল, আর গগনবাবু একটা অদ্ভুত মৃদু খটখট শব্দ শুনতে পেলেন। নড়ছে! করোটিটা যেন অল্প নড়ে উঠল। শব্দটা তারই। পরক্ষণেই ঘর কাঁপিয়ে, “মা, করালবদনা মা গো,” বলে হুঙ্কার ছেড়ে জ্যোতিষার্ণবমশাই আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন।
বাইরের ঘরে এসে বসবার পর আর অতটা অস্বাভাবিক মনে হল না ভদ্রলোককে। তবে গগনবাবুর চোখে এখন ইনি সাধারণ স্তর ছেড়ে অনেকটাই ওপরে উঠে গেছেন এ-কথাটা শতকরা একশোভাগ সত্যি! আছে, অবশ্যই কোনও কোনও মানুষের কিছু অলৌকিক শক্তি আছে এখনও। আর আছে বলেই এখনও তাঁর মতো সাধারণ মানুষরা বেঁচেবর্তে আছেন। বাপ-মা মরবার পর সত্যিকারের অভিভাবক কারা মানুষের? মন্ত্রীরা? রাজনীতির দাদারা? অফিসের বসেরা? ফুঃ!
সন্ধে গড়িয়ে গেছে বহুক্ষণ। কড়কড়ে একশোটি টাকা দক্ষিণা গুনে দিয়ে সুবোধের সাথে পথে নামলেন গগনবাবু। এতক্ষণে যেন বুকে একটা বল অনুভব করছেন তিনি। এবার থেকে আর ভয় ব্যাপারটা নেই। সামান্য কিছু খরচ আছে বটে, তা সুস্থভাবে বেঁচে থাকতে গেলে ডাক্তারকেও তো কত টাকা গুনাগার দিতে হয়। তাঁর বদলে যা পাচ্ছেন সেটা পেতে ভাগ্য দরকার হয়। ভাগ্যিস সুবোধ ছিল! জীবন সার্থক তাঁর।
গগনবাবু পথ চলতে চলতে আলতো করে অনুযোগের চড় মারলেন সুবোধের পিঠে। “তুই তো নিজের থেকেই বলতে পারতিস এঁর কথা। এঁর ক্ষমতার কথা তো আগে থেকেই জানা ছিল তোর।”
একপেশে হাসল সুবোধ। “নিজের থেকে আগ বাড়িয়ে বলা কি ভালো হত? যা বাজার পড়েছে, তুই হয়তো ভাবতিস আমি ব্যাবসা করতে বসেছি। তাছাড়া বিশ্বাস বস্তুটা নিজের অভিজ্ঞতা থেকেই আসাই ভালো। ওঁর ক্ষমতা নিজের চোখে না দেখলে তোর ভরসা হত?”
“আহা, তুই ছেলেবেলার বন্ধু, তোকে অবিশ্বাসের কী আছে?”
“না ভাই, লোকে দালাল বলে বসলে গায়ে লাগবে।”
দিন কয়েকের মধ্যে সোনা বাঁধানো একটা নীলা ধারণ করলেন গগনবাবু। খরচা পড়ল হাজার তিনেক। নামজাদা দোকান থেকে নিতে হল, নইলে নাকি ঠকতে হতে পারে।
সুবোধ আগাগোড়া সাথে ছিল। অফিসের প্রভিডেন্ট ফান্ড থেকে লোন তোলা হল পাঁচ হাজার। এবার ছকের ব্যাপারটার পর ছোট্ট একটা যজ্ঞ, আরও হাজার খানেক, ব্যস! দিন সাতেক আর লেগে যাবে তাতে। এই সাতদিন কোথাও বার হওয়া চলবে না বলে টানা ছুটি নিতে হল। সুবোধ মালিককে ধরে ব্যাবস্থা না করে দিলে মুস্কিল হত ছুটি পেতেও।
এই বাড়তি খরচাটাকে সামাল দিতে ক’দিন একটু কায়ক্লেশে কাটাতে হতে পারে। যাক গে! আমল দিলেন না গগনবাবু।
আটদিনের দিন গগনবাবু অফিসে গেলেন। ফুরফুর করছে মেজাজ। শরীরটাও বেশ চনমনে। হঠাৎ লম্বা ছুটি নেবার জন্য মালিকের গঞ্জনা গায়ে লাগেনি গগনবাবুর। দোষ কাটানো যজ্ঞ ভালোভাবেই চুকেছে। টিফিনের অবসরে রাশিফলটা শশধরকে ডেকে দেখনোর লোভ সামলাতে পারেননি! উফ্, কী দারুণ ছক! এতে আছে লটারি আর হঠাৎ পাওয়া সম্পত্তি মিলিয়ে একবছরের মধ্যে লাখপতি হবার কথা! গাড়ি-বাড়ি, তায় বুড়ো বয়সে বিয়ে করে সুখের সংসার! গগনবাবুর দু’চোখ কপালে উঠে গেছে পরমায়ুর বহর দেখে – নব্বইয়ের ওপর! বাপ রে! শশধরকে রাজভোগ খাওয়াতে হয়েছে আজ।
বিকেল নাগাদ সুবোধের সাথে অফিসের টেবিলে বসে চা খাচ্ছেন, একটি ছেলে দেখা করতে এল। চিনতে পেরে আদর করে ডেকে বসতে বললেন গগনবাবু। জ্যোতিষার্ণবমশাইয়ের সেই ছেলেটি। কিন্তু তাড়া থাকায় একটা চিরকুট আর খাম ধরিয়ে দিয়ে চলে গেল সে। চিরকুটে লেখা আছে –
‘গগনবাবু, একটু গোলমাল হয়ে গেছে। খাম খুললেই বুঝবেন। আপনার রাশিফলটা আরেকজনের সাথে অদলবদল হয়ে গেছে। ঠিকটা খামে পাঠালাম। কিছু মনে করবেন না, ভুল হয় মানুষমাত্রেই। শুধু রত্নটা পাল্টাতে হবে। নীলার বদলে গোমেদ। নীলাটা পরে আর কাউকে বিক্রি করে দিলেই হবে। নতুন করে আর যজ্ঞের দরকার নেই। বাকি কথা সাক্ষাতে বলব।
আর্শীবাদ,
ইতি – শ্রী শুভঙ্কর জ্যোতিষার্ণব।’
মাথাটা কেমন ঘুরে গেল গগনবাবুর। টেবিলে মেলে রাখা হলদে তুলোট কাগজে আঁকা রাশিচক্রটা দুলছে। ছেলেবেলার কানামাছি খেলার মতো দুর্বোধ্য অক্ষরগুলো যেন অবশ গগনবাবুকে ঘিরে ধরেছে। টেবিলের ওপাশে বসে থাকা সুবোধের মুখটা ঝাপসা হয়ে আসছে। কাঁপা হাতে ধরে থাকা কাপ থেকে খানিকটা চা টেবিলের ওপর চলকে পড়ে রাশিচক্রের কাগজটাকে ভিজিয়ে দিল।