সেহরি খেয়ে মেসেঞ্জার ঘাটছিলাম।বান্ধুবি অনুকে এক্টিভ পেয়ে মেসেজ দিলাম,’দোস চল,আমরা দুইজন ভাগি।দাজ্জালের সাথে সংসার করা আমার দ্বারা আর সম্ভব হচ্ছে না।’
ও সিন করে কোন রিপ্লে দিছে কিনা সেটা দেখার সৌভাগ্য আমার আর হয়নি।সারারাত নির্ঘুম থাকার কারনে আমি মেসেজ দেয়ার পরপরই ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম।
চেঁচামেচি আর ভাংচুরের শব্দে সকাল আটটায় ঘুম ভাঙলো আমার।বাসায় রীতিমত শুরু হয়ে গিয়েছে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ।বউ বাড়িতে জড়ো করেছে পাশের বাড়ির ভাবিদেরকে।থতমত খেয়ে ঘুম থেকে উঠে বললাম কি হলো? ভাংচুর করছো কেন?
খুশি লাগছে ভাংচুর করতে বলে কর্কশ ভাষায় উত্তর দিলো বউ।তারপর বলে,অনু না তনুর সাথে না তুমি সংসার করবা?এখনই বের হও।তোমার যা যা আছে সে গুলো নিয়ে বাসা ছাড়ো অন্যথায় বাচ্চাটাকে নিয়ে আমি এখনই চললুম বাপের বাড়ি।কোনদিন যোগাযোগ করার চেষ্টা করবা না।তাহলে কিন্তু একদম লাশ ফেলে দিবো।
হতচকিয়ে বললাম,আরে কথা টা তো শুনবে।
…কোন কথা নাই তোমার সাথে। তুমি থাকো তোমার কথা নিয়ে।আমাকে আর বিরক্ত করোনা।
ভাবলাম তারে ঠান্ডা করার মত সাহস বা ক্ষমতা কোনটাই নেই আমার এখন।একমাত্র রিনা ভাবিই পারবে তাকে ঠান্ডা করতে।রিনা ভাবিকে ফোন করে তাড়াতাড়ি বাসায় আসতে বললাম।কিন্তু বিধি বাম! রিনা ভাবি আসতে আসতে সে তল্পিতল্পা গুছিয়ে ফেলেছে।
মহল্লার সিএনজি ড্রাইভারকে ফোন দিলো বউ।কুদ্দুস ভাই গাড়ি নিয়ে চলে আসেন। আমি বাপের বাড়ি যাবো।২০ মিনিট যেতে না যেতে কুদ্দুস গাড়ি নিয়ে হাজির।
কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে আমি শুধু দেখছি তার কান্ড-কারখানা।সকাল দশটা। এতসময় সে তার প্রয়োজনীয় সব জিনিসপত্র গুছিয়ে সিএনজিতে উঠে গেছে।সাথে যাওয়ার সময় আমার ফোনটাও নিয়ে গেছে।যাতে মেসেঞ্জারে কারো সাথে কথা বলতে না পারি।
বউ আজ দশ দিন হলো বাপের বাড়ি।আর এদিকে আমি খেয়ে না খেয়ে কোন রকম রোজাটা পার করলাম।অফিস থেকে আসার পথে কখনো ভাত আর সামান্য ডাল নিয়ে বাড়িতে ফিরি।ফ্রিজে ডাল বা সামান্য সবজি রেখে সেহরির সময় হলে সেগুলো খেয়ে নিই।প্রতিদিন দোকান থেকে ইফতার আর কেক, বিস্কুট খেয়ে রাতটা কাটায় কোন রকম।
আজ ঈদের চাঁদ দেখা গেছে।এই ১০ দিনে বউ কোন খোঁজ-খবর নিলো না আমার। বড় ভাবি কোনদিন উঁকি দিয়েও দেখেনা কি খাচ্ছি না খাচ্ছি।মাঝেমাঝে ভাতিজিটা এসে ভাত আর তরকারি দিয়ে যায়।
কাল ঈদ। মনের দুঃখে আধপেট খেয়ে রাত দশটায় ঘুমিয়ে গিয়েছি।
মোবাইলের রিংয়ের শব্দে ঘুম ভাঙ্গলো আমার।এই রুদ্র কেমন আছিস? আমি অনু বলছি।সেদিন তোর মেসেজ আমার বর দেখে ফেলেছে।তারপর কি কান্ড করেছে জানিস? আমার বাবাকে খবর দিয়ে গ্রামে একটা হুলস্থুল কান্ড ঘটিয়ে ফেলেছে।সেদিন থেকে আমার ফোন ও বরের দখলে।তুই কেমন রে? এতদিন খোঁজ ও নিলিনা আমি কেমন আছি।মেসেজের রিপ্লে দিইনি তাও দেখলি।আসলে বিয়ের পর তুই আমাকে একেবারে ভুলে গেছিস।আরে শোন পাগলি।তোর কি মনে হয় তোরে বিপদে ফেলে আমি সুখে আছি? সেদিন রাতে তোকে মেসেজ দেয়ার পর থেকে ফোনটা আমার কাছে আর নেই।বউ সাথে করে নিয়ে গেছে।গতকাল বাজার থেকে একটা নরমাল ফোন কিনে আনলাম।না হলে আজ ও আমাকে পাইতিস না।
অনু ছিল আমার ভার্সিটি লাইফের সবচেয়ে কাছের বান্ধবি।বিয়ের পর থেকে ওরসাথে আমি বিয়ে নিয়ে খুঁনসুটি করতাম।দুষ্টুমি করতাম নিয়মিত।প্রায় ই বলতাম আমরা চল ভেগে যায়।কিন্তু এটা আমারা দুষ্টুমির ছলেই বলতাম।বাস্তবে কখনো এটা সম্ভব ছিল না।কারন,ওর ও সন্তান আছে আমার ও সন্তান আছে।আমার বউ এগুলো কোনদিন খেয়াল করেনি।অনুকে আমি অনেক ভালোবাসতাম। অনুও অনেক ভালোবাসতো।কিন্তু আমরা কেউ চাইতাম না এটা বিয়ে পর্যন্ত গড়াক।তাই চাকরি জীবনে এসে ও আর আমি পরিবারের পছন্দমত আলাদা আলাদা বিয়ে করি।তবে আমাদের মাঝে এখনো সেই ভালোবাসাটা বিরাজ করছে।
অনু আমাকে ঈদের দাওয়াত দিয়ে সেদিনের মত ফোন রেখে দিলো।ওর সাথে কথা শেষ করে কিছুক্ষণ ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদলাম।তারপর ঘুমের রাজ্যে হারিয়ে গেলাম।কিছুক্ষণ পর আবারো আমার ফোনের রিং বেজে উঠলো।
ঘুমের মধ্যে ফোনটা অনেক কস্টে হাতড়িয়ে খুঁজে পেলাম।ফোন রিসিভ করতেই ওপার থেকে কান্নার আওয়াজ শুনতে পেলাম।ঐ রুদ্র।সরি।আমি তোমার সাথে অনেক বাড়াবাড়ি করে ফেলেছি।কি খাচ্ছো তুমি? রাতে কি খেয়েছো? রান্না কে করে দিচ্ছে? আমি বিশ্বাস করতে পারছিলাম না বউ আমাকে ফোন দিবে।তাই কিছুক্ষণ ওর কথাগুলো শুনছিলাম।
ওপাশ থেকে ও বলছিলো,কথা বলছোনা কেন? বোবা হয়ে গেছো? আমি উত্তরে বললাম,কথা বলবো কীভাবে? অনু আমার পাশে ঘুমুচ্ছে। ও যদি ঠিক পায় রাতে অন্য মেয়ের সাথে কথা বলছি তাহলে আমাকে মেরে ফেলবে।
কি বলো এসব! সত্যি বলছি আমি।তোমার বিশ্বাস হয়না? ওর কান্নার আওয়াজ আরো বেড়ে গেল।ও সত্যি ভেবেছে মনে হলো।
এরপর ও বললো,জানো আমি পুরো রোজার মাস অনাহারে-অর্ধাহারে কাটিয়েছি।তুমি কি খাচ্ছো না খাচ্ছো এটার চিন্তায় আমি ঠিকমত খেতাম না।আমার ওজন এখন আগের চেয়ে দশ কেজি কমে গেছে।তুমি এত নিষ্ঠুর কেন? আমার ফোনে একটা কল ও দিতে পারলেনা? আমি মজা করে বললাম,কেন আমার অনু আছে না? তোমাকে কেন ফোন দিবো? এরপর তার কান্নার গতি আরো বেড়ে গেল।সে বলতে লাগলো।জানো, গতকাল তোমার জন্য আমি নিউ মার্কেট থেকে পাঞ্জাবি-পাজামা,শার্ট,প্যান্ট, জুতা আর টাই কিনে এনেছি।তুমি সকালে ঘুম থেকে উঠে চলে আসবা সরাসরি আমাদের বাড়িতে।না আসলে কিন্তু আমি নিজেকে নিজে শেষ করে দিবো।
এভাবে সারারাত চলছিলো আমাদের ফোনালাপ।মুয়াজ্জিনের আজানে আমাদের ঘোর কাটলো।মোবাইলের দিকে তাঁকিয়ে দেখলাম প্রায় তিন ঘন্টা কথা বলেছি দুইজনে।অবশেষে বললাম,ফোন রাখো।আমি নামাজ পড়ে গোসল করে বের হচ্ছি।তোমাদের গ্রামে গিয়ে ঈদের নামাজ পড়বো।
ফজরের নামাজ পড়ে বর্ষার আর আমার মেয়ের জন্য মার্কেট থেকে কেনা এক লাগেজ কাপড়-চোপড় আর প্রসাধনী নিয়ে বাইক বের করে রওনা হলাম ওদের গ্রামে।আগে থেকেই আমি ওর জন্য ১০ হাজার টাকার শপিং করে রেখেছিলাম।
ঈদের নামাজ পড়ে দুয়েকদিন ওদের বাড়িতে থাকলাম।এবার ঈদে খুব ঘুরলাম দু,জনে।ওর খালা,মামাদের বাড়িতে গেলাম প্রথমবারের মত।বেড়ানো শেষ হলে এরপর থেকে শুরু হলো আমাদের বাকি পথচলা।আমরা শহরে আমাদের বাসায় ফিরে আসলাম ঈদের কয়েকদিন পর।এখন অনেক সুখে আছি আমরা।বর্ষা এখন আর অনুকে নিয়ে হিংসা করেনা।অনুর সাথে আমি দুষ্টুমি করি আগের মতই। বর্ষা ও মাঝেমাঝে সেগুলো উপভোগ করে।