রাশিয়ায় ভল্গা নদীর ধারে ছোটো শহর ‘গোর্কি’। ভল্গার নদীকুল হতে সবুজ ঘাসের গালচে মোড়া তটভূমি উঠে গিয়ে যেখানে ম্যাকসিম গোর্কির পাথরের মূর্তির সামনে শ্যামল প্রান্তর সৃষ্টি করেছে সেখানেই আছে একটি শিশু-বিদ্যালয়। নানান রংয়ের ফুলের বাগান আর লাল-সাদা রংয়ের সুন্দর বিদ্যালয় ভবন দেখে মনে হয় যেন কোনো নিপুণ শিল্পীর আঁকা পটের ছবি। ছোটো ছোটো ছেলেমেয়েরা এখানে পড়তে আসে। সারাদিন তাদের কলকাকলিতে আর দামাল দুরন্তপনায় জায়গাটা মেতে থাকে।
এই বিদ্যালয়েরই তিনটি ছেলেমেয়েকে নিয়ে আমাদের এই গল্প। রুদলা আর গানকা দুটি ছোটো ছেলে আর ইয়ারিন্কা একটি ছোটো মেয়ে। তাদের তিনজনের মধ্যে ভারি ভাব। ক্লাস শেষ হলেই তারা তিনজন একত্র হয়। এইজন্য অনেকে তাদের ঠাট্টা করে বলে ‘তিনমূর্তি’। তাতে তারা মোটেই রাগ করে না। বরং খুশিই হয়।
একদিন ওরা একসাথে স্কুলে ঢুকে দেখে তাদের পেত্রভ কাকা অন্যদিনের মতো কোদাল নিয়ে বাগানের কাজ করছে না। আজ সে খুব মন দিয়ে নানান ফুল দিয়ে একটা সুন্দর তোড়া বানাচ্ছে। তারা তিনজনে এক দৌড়ে গিয়ে পেত্রভ কাকার কাছে জিজ্ঞেস করল যেদিন তাদের ফুলের কোনো উৎসব আছে কিনা। পেত্রভ্ কাকা বলল, “সে কী! তোমরা জান না? তোমাদের নাতাশাদিদি যে আরেক বড়ো কাজে অন্য শহরে চলে যাচ্ছেন? আজ বিকালে তাঁকে বিদায় সম্বর্ধনা দেব আমরা সেইজন্যই এই ফুলের তোড়া বানাচ্ছি।”
শুনে তাদের মন ভীষণ খারাপ হয়ে গেল। নাতাশা দিদি তাদের সবারই খুব প্রিয়। তারা ভাবতেই পারছে না যে তিনি চলে যাবেন।
কিছুক্ষণের মধ্যে বিদ্যালয়ের সব ছেলেমেয়ারা সারি দিয়ে দাঁড়াল প্রার্থনা সমাবেশে। সেখানে বড়দি জানালেন নাতাশা দিদির আরো বড় দায়িত্ব নিয়ে অন্য শহরে যাওয়ার কথা। বিকেল চারটেয় তাকে স্কুলের তরফ থেকে বিদায় সম্বর্ধনা দেওয়া হবে এ-কথাও জানানো হল। তখন আমাদের ‘তিনমূর্তি’ এবং আরো অনেক ছেলে-মেয়ে বড়দিকে বলল তারাও তাদের প্রিয় নাতাশাদিদিকে উপহার দিয়ে চায়। তাদের তিনি অনুমতি দেবেন কিনা। নাতাশা দিদি খুবই আপত্তি করেছিলেন। কিন্তু ছেলেমেয়েরা ভালোবেসে তাঁকে দিতে চায় সেটা নাকচ করা ঠিক হবে না একথা বড়দি বুঝিয়ে বলায় নাতাশা দিদি রাজি হলেন। তবে বড়দি সবাইকে বললেন, “জিনিসটা খুবই কমদামি আর একেবারে শিশুদের মত মজাদার জিনিস হতে হবে।”
এরপর ছুটি হলেই সব ছেলেমেয়েরা ব্যস্ত হলো উপহার সংগ্রহে। তারা ছোটো ছোটো দলে আলোচনা করতে লাগলো কী দেয়া যায়। আমাদের ‘তিনমূর্তি’ ঠিক করল তারা আলাদা ভাবে দেবে। কিন্তু মুশকিল হল তারা তিনজনে একমত হতে পারছে না উপহার কী হবে এই বিষয়ে। রুদলা তো পেটুক। তাই সে চায় নাতাশাদিদিকে একবাক্স বিস্কুট দিতে। অথচ ইয়ারিনকা বলছে সে একগোছা তাজা লাল গোলাপ দেবে। দু’জনের কেউই একে অপরের মত মেনে নিতে পারছে না। আর গানকা যে খুব ভালো নেতার কাজ করতে সে কিছু ঠিকই করতে পারছে না। শেষকালে সে বলল, “যার যা ভালো লাগে সে তাই দেবে।” তাড়াতাড়ি তারা বাড়ি থেকে উপহার নিয়ে আসতে চলল।
গানকা পথে চলতে চলতে ভাবতে লাগলো তাই তো কী দেয়া যায়? হঠাৎ তার মনে পড়ল অনেকদিন আগের এক ঘটনা। সেদিন নাতাশা দিদি তাদের বাড়ি এসেছিল, সে তাঁকে তাদের বাড়ির ‘অ্যাকুরিয়াম্’ দেখাচ্ছিল। তাঁর খুবই ভালো লেগেছিল, গানকার প্রিয় মাছেদের দেখে। বিশেষতঃ দুটো রূপোলি মাছকে। ওরা দুজনে ছুটোছুটি করার মতো চক্রাকারে ঘুরছিল। উনি গানকাকে দেখিয়ে বললেন, “দেখো! দেখো! ওদের ঘুরপাক খাওয়ার সময়ে দূর থেকে দেখে মনে হয় একটা রূপোর হার।”
গানকার মা হেসে বলেছিলেন, “এই হারটা আপনাকে আমার পরিয়ে দিই?”
কিন্তু গানকা ও তার মা বার বার বলা সত্ত্বেও উনি রাজি হননি। পরে অবশ্য বলেছিলেন, “আমি তো নতুন এসেছি, বাড়িটা গুছিয়ে নিই তারপর আপনারা দেবেন।”
তারপর নানান কারণে সেটা আর হয়ে ওঠেনি। গানকার কথাগুলো মনে আসতেই সে ঠিক করে ফেলল এই হবে তার উপহার। এতক্ষণ আনমনে চলছিল, এবার সে দৌড় লাগাল।
ওকে এভাবে হাঁফাতে হাঁফাতে দৌড়ে ছুটে আসতে দেখে গানকার মা ব্যস্ত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “কী ব্যাপার?”
সে তখন এক নিশ্বাসে মাকে জানাল সব কথা। নাতাশা দিদির অন্য শহরে কাজের ডাকে চলে যাওয়ার কথায় তার মাও খুব দুঃখ পেলেন। কিন্তু কী আর করা যায়? বড় হয়ে তো আরো বড় হতে হয়। সুতরাং মেনে নেওয়াই যাক্!
উপহারের ব্যাপারে গানকার প্রস্তাব শুনে তো তার মা অবাক। তিনি প্রথমে কয়েকবার বললেন, “এ কি একটা উপহার হল?” তবে সেদিনের সেই ঘটনার স্মৃতির রেশ নিয়ে গানকা যখন বার বার বলতে লাগল সে এটাই দেবে তখন তিনি রাজি হলেন।
গানকা এরপর তাড়াতাড়ি খাওয়া-দাওয়া সেরে প্রস্তুত হয়ে নিল। এর মধ্যে তার মা একটা সুন্দর হালকা নীল বড়ো মুখওয়ালা বোতল জোগাড় করে নিয়েছেন। মাছদুটিকে জালতি দিয়ে সাবধানে তুলে বোতলে রেখে দিলেন। গানকা একটা রঙিন কাগজ পরিষ্কারভাবে কেটে তাতে গোটা গোটা অক্ষরে লিখল, “নাতাশাদিদিকে অপরূপোহার- ছাত্র গানকা।” তারপরে সেটা সেঁটে দিল বোতলের একদিকে।
যখন মাকে নিয়ে গানকা স্কুলে পৌঁছোল, তখন সভার কাজ শুরু হয়ে গেছে। সবাই দেখতেও পেল না যে তারা একেবারে পেছনে বসল। বড়দি বলছিলেন নাতাশাদিদিকে স্কুলের ছেলেমেয়েরা কী’রকম ভালোবাসে সুতরাং অন্য শহরে যাওয়ায় সবার মনে কিরকম দুঃখ জমেছে সেটা সবাই বুঝবে। অবশ্য দেশের অন্য ছেলে-মেয়েদের কথা ভেবে তাঁদের এ-দুঃখ মেনে নিতে হবে।
তাঁর বলা শেষ হলে, বড়দি নাতাশাদিদির হাতে ফুলের তোড়া তুলে দিলেন। এরপর ছেলেমেয়েদের বলা হল তারা একে একে তাদের উপহার নাতাশাদিদির কাছে এসে দিতে পারে। সবাই আসতে লাগল। সবার শেষে এল গানকা। সে “অপরূপোহার” টেবিলের উপর রেখে তার বন্ধুদের জানাল তাদের বাড়ির সেই আগের দিনের ঘটনা যার মধ্যে রয়েছে রূপোর হার সৃষ্টির কাহিনী। সবশেষে বলল, “নাতাশাদিদি অন্য শহরে দূরে চলে গেলেও তার ভালোবাসা পেতে থাকবে, কারণ এই মাছেদের তিনি যখন খাওয়াবেন আর যত্ন করবেন তখন ওদের মাধ্যমে সেই ভালোবাসা তার কাছে পৌছাবে!”
সবাই গানকার উপহারের তারিফ না করে পারলেন না।