শেষ ভেলকি

শেষ ভেলকি

বধৰ্মান থেকে আটটা সাঁইত্রিশের লােকাল ধরে কলকাতা ফিরছিল বিনায়ক দলুই। ডিসেম্বর মাসের শেষ, কামরা প্রায় ফাঁকা। গুটি কয়েক যাত্রী মাত্র আছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। শাল-আলােয়ানে আষ্টেপৃষ্ঠে মােড়া। খােলা দরজা দিয়ে ছুরির ফলার মতাে হাওয়া ঢুকছে, বিধে যাচ্ছে গায়ে, যাত্রীরা সব কাঁপছে হিহি। এমন ঠান্ডা বহুকাল পড়েনি। কাচের পাল্লা নামিয়ে দিয়ে জানলার ধারে বসেছিলেন বিনায়ক। গুটিসুটি মেরে বিরস মুখে। মেজাজ আজ তাঁর বেজায় খাট্টা হয়ে আছে। বর্ধমানে ভাই-ভাই সঙেঘর ডাকে ম্যাজিক দেখাতে এসেছিলেন, সেটা আজ মােটেই তেমন জমল না। অথচ কী না খেলা দেখিয়েছেন। তাসের ভেলকি, পামিং পাসিং, পালকের ঝাড়ন থেকে গােলাপ ফুল বার করা, ওয়াটার অব ইন্ডিয়া, দুধ ভ্যানিশ, চাকা হাপিস, থট রিডিং, চোখে ময়দার পুলটিশ এঁটে বাের্ডের লেখা পড়ে দেওয়া, কঙ্কালের নাচ, আরও কত কী! কোনও কিছুতেই দর্শকদের মন পাওয়া গেল না? কচিকাচারা মাঝে মাঝে হাততালি দিচ্ছিল বটে, কিন্তু বড়রা স্রেফ হাই তুলছিল। বিনায়ক স্বচক্ষে দেখেছেন। জাদুকরের ইন্দ্রজালে মানুষের যদি তাই না লাগল, তা হলে আর মিছিমিছি খেটে কী লাভ!

সঙ্গে কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে, বিনায়কের প্রাপ্য টাকাটাও পুরাে দিল না ক্লাবের ছেলেরা। পাঁচশোর কথা হয়েছিল, মাত্র আড়াইশাে টাকা ঠেকিয়ে দিয়ে আবার চোখ রাঙানি।

মানে মানে এই নিয়েই কেটে পড়ন। যত্তসব বস্তা পচা খেলা দেখিয়ে টাকার জন্য ঘ্যানঘ্যান! বেশি বেগড়বাই করলে ম্যাজিকের বাক্সপ্যাটরা সব আটকে রেখে দেব। একেই বলে কপাল। ভাবতে ভাবতে বিনায়ক একটা এক মাইল লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। ম্যাজিক এখনও তার নেশা নয় পেশী। মিলিটারিতে পাক্কা দশ বছর চাকরি করেছেন বিনায়ক। অবসর নেওয়ার পরও তিনি বসে নেই, এখন তিনি এক ব্যাঙ্কের সিকিউরিটি গার্ড। মাইনেপত্র যা পান তাতে দিব্যি হেসে খেলে সংসার চলে যায়। ম্যাজিক দেখান তিনি হৃদয়ের টানে। ব্যথাটা আজ ওখানেই বড় বেজেছে। ছ্যা ছ্যা, ল্যান্সনায়েক বিনায়ক দলুই-এর মানসম্মান ধুলােয় মিশে গেল।

অবশ্য দর্শকদেরও পুরােপুরি দোষ দিতে পারেন না বিনায়ক। আজব আজব খেলা দেখাতে পারলে, তারাই বা খুশি হবে কেন ? নাহ, নতুন খেলা ভাবতে হবে। হাড়কাঁপানাে গা শিরশির করা ভেলকি আবিষ্কার করতে হবে। নইলে ম্যাজিক আর নয়। অফিস আর বাড়ি,বাড়ি আর অফিস, এই করেই নয় বিনায়ক কাটিয়ে দেবে বাকি জীবনটা।

রাতের আঁধার চিরে ছুটছে ট্রেন। ঝমঝম ঝমাঝম । থামছে স্টেশনে, ছাড়ছে আবার। যাত্রীরা নেমে যাচ্ছে একে একে, নতুন করে উঠছে না কেউ। শক্তিগড়ে কামরা একদম খালি হয়ে গেল।

চলমান ট্রেনের দুলুনিতে একটু ঝিমুনি মতন এসেছিল বিনায়কের। হঠাৎ কাশির শব্দে চটকা ছিড়ে গেল। আপাদমস্তক কম্বল মুড়ি দিয়ে সামনের সিটে এসে বসেছে একজন। খুকুর খুকুর গলা বাজাচ্ছে।

কখন উঠল? কোখেকে উঠল? যা শুনশান কামরা, চোর-ডাকাত নয় তাে? বিনায়ক চোখ খুলতেই লােকটার কাশি থেমে গেছে। মুখের ওপর থেকে কম্বল আলগা সরিয়ে দিল।

অমনি বিনায়ক টানটান। কামরার এদিকটায় আলাে নেই, আবছায়ায় লােকটার মুখ স্পষ্ট বােঝা যায় না, তবু কেমন যেন চেনা চেনা লাগে? লম্বা পানা চৌকো মুখ। বুরুশ বুরুশ গোঁফ। গােল্লা গােল্লা চোখ।

বিনায়ক অস্ফুটে বলে উঠলেন, -সুবেদার সাহেব না?

লােকটার অন্ধকার মাখা মুখে হাসি ফুটল সামান্য। ফঁাসফেসে গলায় বললেন, চিনতে পেরেছিস তা হলে?

আপনাকে চিনব না? বলেন কী ওস্তাদজি? বিনায়কের চোখ জুলজুল করে উঠল,—আপনার শেখানাে ম্যাজিক আজও তাে আমি দেখিয়ে বেড়াই।

ডাকসাইটে ম্যাজিশিয়ান বলে সুবেদার হামিদ আলির খ্যাতি ছিল মিলিটারিতে। তাঁকে রীতিমতাে ডরাতেন অফিসাররাও। কখন কার টাকা কার পকেটে চালান করে দেন, কাকে কীভাবে বুদ্ধ বানান.. একবার ব্রিগেডিয়ার রমেশ পান্ডের সে কী নাকাল দশা। বুক পকেট থেকে কাগজ বার করে গম্ভীর বক্তৃতা দিতে যাবেন, বেরিয়ে এল একটা আস্ত হাঁসের ডিম। এমন অবস্থা হয়েছিল, অফিসাররা হামিদ আলিকে দেখলেই চেঁচাতেন,—দূর সে বাত করাে আলি, নজদিক মত আও। মিলিটারির নানান অনুষ্ঠানে ডাক পড়ত হামিদ আলির। সঙ্গে কীভাবে যেন ল্যাঙবােট হিসেবে জুটে গিয়েছিলেন বিনায়ক দলুই। দুজনে মিলে বেশ একটা টিম গড়ে উঠেছিল। প্রতিটি প্রােগ্রামের পর তারিফ মিলত খুব। বখশিশও। বিনায়কের উপরি পাওনা ছিল হামিদ আলির কাছে ম্যাজিক শিক্ষা। সহকারীকে চৌকস করে না তুলতে পারলে হামিদ আলির ম্যাজিকই বা কাটবে কী করে?

হামিদ আলি মিটিমিটি হাসছেন। বললেন,—গুরুর শেখানাে বিদ্যে তাে জাহির করে বেড়াস সর্বত্র, গুরুর নাম করিস তাে?

বিনায়ক ধরা-পড়া অপরাধীর মতাে মাথা চুলকোলেন,“আজ্ঞে.মানে…

বুঝেছি।…শােন বেটা, গুরুর নাম না করলে নিজের বিদ্যায় আস্তে আস্তে মরচে ধরে যায়, জানিস তাে?

বিনায়ক মাথা নাড়লেন,–প্রায় সতেরাে বছর পর। …তুই ফৌজ ছাড়লি কবে?

তাও তাে প্রায় আট বছর হয়ে গেল। বিনায়ক বিনীত স্বরে প্রশ্ন করলেন, আপনি এখন আছেন কেমন ওস্তাদজি?

ভালাে তাে, ভালােই। ছেলেরা জমিজমা দেখছে, চাষবাস করছে…

আর আপনি ?

এই, এদিক-সেদিক মৌজ করে ঘুরে বেড়াই। এখন আমার ভ্রমণেই সুখ। ম্যাজিক দেখান না?

নাহ। ছেড়ে দিয়েছি।

কেন ওস্তাদজি ?

সে অনেক কথা। বলতে গেলে রাত ভাের হয়ে যাবে। হামিদ আলির গলা কেমন উদাস উদাস, -বেটা, তুই আসছিস কোত্থেকে?

আজ্ঞে, বর্ধমান। ওখানে আজ একটা ম্যাজিকের শাে ছিল।

কেমন হল শাে ?

বিনায়কের মন খারাপ ভাবটা ফিরে এল। ভার গলায় বললেন, -ভালাে নয়। কেন রে?

আমার খেলা সব পুরনাে হয়ে গেছে। লােকে এখন নতুন জাদু দেখতে চায়। তাে বানা নতুন ভেলকি। মাথা খাটা।

আমার মাথা কি আপনার মতাে সরেস ওস্তাদজি? বিনায়ক ফোঁস করে আর একটা লম্বা শ্বাস ফেললেন,—ভাবছি, আমিও আপনার মতাে খেলা দেখানাে ছেড়ে দেব।

সে কী! তা হলে তাে দুনিয়ায় আর হামিদ আলির খেলাই থাকবে না। হামিদ আলির চোখ ছােট হল,নতুন একটা ভেলকি শিখবি? ইচ্ছে আছে ?

কী ভেলকি ওস্তাদজি ?

বিনা অস্ত্রে পেট কাটা। ছুরি কাচি ছাড়াই মানুষের পেটের ভেতর হাত ঢুকে যাবে, গলগল করে রক্ত বেরােবে..! আবার হাত বুলিয়ে দিবি, বেবাক জুড়ে যাবে পেট। তাের হাতে রক্তের ছিটেও থাকবে না..

বিনায়ক আনন্দে প্রায় লাফিয়ে উঠলেন, -শেখাবেন ওস্তাদজি? আসব আপনার বাড়ি একদিন?

একদিন কেন, আজই শিখে নে। এইতাে আমার স্টেশন আসছে, চল এখনই তােকে প্ল্যাটফর্মে বসে খেলাটা বুঝিয়ে দিই।

এখন? বাড়ি ফিরতে অনেক দেরি হয়ে যাবে যে?

কী এমন রাত হয়েছে এখন? সবে তাে সাড়ে নটা। চল, চল, দশটা মিনিট তাে লাগবে। পরেরর ট্রেনটাই ধরে নিবি’খুন।

ট্রেনের গতি কমতে শুরু করেছে। স্টেশন এসে গেল। ভাবনা চিন্তার অবকাশ পেলেন না বিনায়ক, বাক্সপার্টরা সমেত নেমে পড়েছেন হামিদ আলির পিছু পিছু।

খাঁ খাঁ করছে শীতের রাতের প্ল্যাটফর্ম। কোথাও কোনও জনমনিষ্যি চোখে পড়ে না। বাতি আছে বটে প্ল্যাটফর্মে, তবে পােস্টগুলো বেশ দূরে দূরে। ঘন কুয়াশায় হলদেটে আলােগুলােকে বড় আবছা আবছা লাগে। ঠান্ডার দাপট আশপাশের দোকানপাটও সব বন্ধ হয়ে গেছে। শুন্য স্টেশন আরও যেন নিঝুম তাই। কুকুর ঘুরছে দু-একটা। ছায়ার মতাে। করুণ সুরে ঘেউ ঘেউ করতে করতে কুকুরগুলাে অনেক তফাতে চলে গেল।

দীর্ঘদেহী হামিদ আলি লম্বা লম্বা পা ফেলে হাঁটছেন। তাল রাখতে বিনায়কের হিমসিম দশা। একটা লিচুগাছের নীচে গিয়ে বসলেন হামিদ আলি। বাঁধানাে বেদিতে। কম্বলখানা নামিয়ে দিলেন গা থেকে। পাশে রাখলেন। পরনে এখন তার ফৌজি ওভারকোট। হাঁটু ঝুল গলাবন্ধ।

চোখ বুজলেন হামিদ আলি। হাতে হাত ঘষছেন। হঠাৎই হুকুম ছুড়লেন, -দলুই, এদিকে আয়। শুয়ে পড়।

কনকনে ঠান্ডায় বিনায়কের প্রায় দাঁতকপাটি লেগে যাওয়ার জোগাড়। কঁপতে কাঁপতে বললেন,—এখানে শােৰ কোথায়, ওস্তাদজি?

আমার পাশে এসে শো।

বেদিতে পলক হাত ছুইয়েই বিনায়ক আঁতকে উঠেছেন,—ও বাবা, ঠান্ডায় মরে যাব।

ডরপকদের মতাে কথা বলিস না। এর চেয়ে অনেক বেশি শীতে আমরা খােলা জায়গায় রাত কাটিয়েছি। মনে আছে, জানুয়ারির শীতে আমাদের একবার নদীতে সাঁতার কাটতে হয়েছিল? মনে আছে ওস্তাদজি! আমাদের তখন যুদ্ধের মহড়া চলছিল। দু-ঘণ্টায় আমরা একটা পেন্টুন ব্রিজ বানিয়েছিলাম।…আসামে। তা হলে? সৈনিক কখনও রােদ জল ঝড়কে ভয় পায় ? শীত গ্রীষ্মকে ডরায়?

অগত্যা বেদিতে লম্বমান হচ্ছিলেন বিনায়ক, আবার হামিদ আলির গমগম আদেশ, আগে সােয়েটার জামা সব খুলে ফ্যাল।

হামিদের স্বরে সেই পুরােনাে দিনের কর্তৃত্ব। অমান্য করার সাহস পেলেন না বিনায়ক। রা-টি না কেড়ে সুবােধ বালকের মতাে শুয়ে পড়েছেন। গা সম্পূর্ণ খালি। কাপছেন ঠকঠক।

 

এগিয়ে এলেন হামিদ আলি। ঝুঁকলেন বিনায়কের ওপর। আচমকা সাঁ করে বিনায়কের পেটে একবার হাতখানা ঘষে দিলেন হামিদ আলি। সঙ্গে সঙ্গে চামড়ায় কী তীব্র জ্বালা। এবার হামিদ আলি চাপ দিচ্ছেন পেটে। আঙুল দিয়ে। যেন পেটের মধ্যে ঢুকিয়ে দেবেন আঙুলগুলাে। আশ্চর্য, সত্যিই বুঝি আঙুল ঢুকে গেল। কুলকুল করে রক্ত বেরিয়ে আসছে। ঝড়াক হাত তুলে শূন্যে কী দোলাচ্ছেন ওটা? ছালচামড়া? মাংস? নাড়িভুড়ি ? শীতবােধ উবে গেছে বিনায়কের। ঘামছেন দরদর! হামিদ আলি পিশাচসিদ্ধ হয়েছেন নাকি?

হামিদ আলি যেন বিনায়কের মন পড়ে ফেলেছেন। রাতের নিস্তব্ধতা ছিড়ে চকিতে হাহা হেসে উঠলেন,–তুই কী রে? আমার চ্যালা হয়ে ভয় পেয়ে গেলি? বলেই বিনায়কের পেটে আবার তালু ঘষছেন। ঠান্ডা ঠান্ডা লাগছিল বিনায়কের।

দেখতে দেখতে রক্ত একদম সাফ। হামিদ আলি দু-হাত তুলে দেখালেন। সেখানেও আর শােণিতচিহ্ন নেই।

বিশ্বাস হয় না। নিজের পেটে বেশ কয়েকবার হাত বােলালেন বিনায়ক। সত্যিই কোন ক্ষতের দাগও নেই কোথাও! হামিদ আলির গোঁফ ঝিকমিক করে উঠল,—কী রে, বুঝতে পারলি কিছু?

দ্রুত জামা সােয়েটার গলিয়ে নিলেন বিনায়ক। ভ্যাবলার মতাে মাথা নাড়লেন,— আজ্ঞে না, ওস্তাদজি। এত সােজা হাতের কাজটা ধরতে পারলি না ?…প্রথমে পাতলা একটা গ্লাভস পরে নিৰি হাতে। গ্লাভসে লাগানাে থাকবে মাথা ধরার বাম। মলমটা পেটে ঘষলেই জ্বালা জ্বালা করবে। তারপর চার আঙুল খাড়া রেখে পেটে চাপ দিবি, একই সঙ্গে দুমড়ােতেও থাকবি আঙুলগুলােকে ঠিক মনে হবে আঙুল বুঝি পেটের মধ্যে সেঁধিয়ে গেল। তখনই পামিংয়ের কায়দায় চেটোয় সেঁটে রাখা ঘন লাল তরল ভরা বেলুনটাও ফেটে যাবে, রক্ত হয়ে ছড়িয়ে যাবে গােটা পেটে। রং মাখা ফাটা বেলুন আঙুলে ঝুলিয়ে দেখাবি, শিউরে শিউরে উঠবে লােকজন। আবার পামিংয়ের কায়দায় বেলুন সরিয়ে ফেলবি, তার জায়গায় হাতে নিয়ে নিবি স্পিরিট মাখা তুলল। ব্যস, স্পিরিট ঘষে দিলেই রং উধাও। আর হ্যা, লােকে যখন রক্ত দেখায় ব্যস্ত থাকবে, তখন কিন্তু গ্লাভসটাকে শার্টের হাতায় লুকিয়ে ফেলতে ভুলিস …কী রে, খুব কঠিন? পারবি না?

বিনায়ক মন্ত্রমুগ্ধের মতে ঘাড় দোলালেন,—পারব।

তা হলে এখনই প্র্যাকটিস শুরু করে দে। এই নে গ্লাভস, আর এই একটা রংভরা বেলুন। বলতে বলতে হামিদ আলি কম্বলে আবার মুড়ে নিচ্ছেন নিজেকে।

বিনায়ক মৃদু স্বরে জিজ্ঞেস করলে,-এ খেলা আপনি নিজে কেন দেখাচ্ছেন না ওস্তাদজি?

ইচ্ছে করে না রে। ভাল্লাগে না। হামিদ আলি হিমশীতল হাত বিনায়কের কঁাধে রাখলেন,—আমার দেখানাে না দেখানােয় কী আসে যায় ? আমার জাদুবিদ্যে আমি তােকে দিলাম, তুই দিবি তাের চ্যালাকে… এই পরম্পরার মধ্যে দিয়েই হামিদ আলি বেঁচে থাকবে। বিনায়ক অভিভূত। নির্বাক।

হামিদ আলি হাসিমাখা মুখে বললেন,—তুই ততক্ষণ মকশ কর, আমি গিয়ে খোঁজ নিয়ে আসি তাের ট্রেন কখন আসছে।

গাঢ় কুয়াশায় ক্রমশ মিলিয়ে যাচ্ছেন হামিদ আলি। লম্বা ছায়াটা এক সময়ে অদৃশ্য বিনায়ক মনে মনে ভারি উদ্দীপিত বােধ করছিলেন, গ্লাভস গলিয়ে আঙুল মুড়ছেন, খুলছেন, বেলুন চেপে চেপে ফাটাতে চেষ্টা করলেন। পারলেন না। আবার চালাচ্ছেন চেষ্টা। আবার। শব্দহীন প্ল্যাটফর্মে লিচুগাছের তলায় বসে গভীর মনােযােগে চালিয়ে যাচ্ছেন অনুশীলন। মিনিট দশ পনেরাে পর বিনায়কের হুঁশ ফিরল। হামিদ আলি ফেরেন না কেন?

বাড়ি চলে গেলেন ? পরের ট্রেনেরও তাে দেখা নেই। চিন্তিত মুখে স্টেশন মাস্টারের ঘরের দিকে হাঁটা শুরু করলেন বিনায়ক। স্টেশনের নামটাও চোখে পড়ল তখন। বেলমুণ্ডি! যাহ বাবা, এ তাে সেই বিখ্যাত অপয়া স্টেশন!

বেলমুণ্ডির নাম করলে নাকি ঘরে হাঁড়ি চড়ে না, স্থানীয় লােক তাই এই স্টেশনকে মাঝের গাঁ বলে। বিনায়কের হাসি পেয়ে গেল। এই অপয়া স্টেশনটাই তাে পয়, এখানেই তাকে অদ্ভুত ইন্দ্রজালটা শিখিয়ে দিলেন হামিদ আলি। স্টেশন মাস্টারের ঘরে আলাে জ্বলছে। ঘরে একটি মাত্র লােক। ভীষণ উত্তেজিত মুখে লােকটা একমনে কথা বলছে টেলিফোনে। কালচে নীল উর্দিপরা একজন আধবুড়াে মানুষ কানে মাফলার জড়াতে জড়াতে ঢুকল অফিসঘরে। হাঁপাতে হাঁপাতে কী যেন খবর দিল। প্রায় ছুটে বেরিয়ে গেল আবার।

বিনায়ক সিমেন্টের জাফরি কাটা জানলায় মুখ আনলেন,“দাদা, কলকাতার নেক্সট ট্রেন কখন ?

লােকটা উত্তরই দিল না। কথায় ব্যস্ত।

বিনায়ক গলা চড়ালেন,—-ও দাদা, শুনছেন? কলকাতা যাওয়ার গাড়ি কখন পাওয়া যাবে?

রিসিভার কান থেকে সরিয়ে খ্যাক খ্যাক করে উঠল লােকটা,ষাঁড়ের মতাে চেল্লাচ্ছেন কেন? কী হয়েছে?

জিজ্ঞেস করছিলাম কলকাতা ফেরার ট্রেন…

ধ্যার মশাই, কোনও ট্রেন ফেন এখন পাবেন না। কলকাতা বর্ধমান, কোনও লাইনে ট্রেন নেই।
বিনায়ক আকাশ থেকে পড়লেন,–কেন?

একটু আগে ডাউন লাইনে অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে। পােড়াগ্রামে। বর্ধমান লােকাল ডিরেলড হয়ে সােজা আপের ট্র্যাকে। ক’জন মরল, ক’জন আহত, ভগবান জানেন। রিলিফ এসে গেল বলে…ওফ, আজ সারাটা রাত যে আমার কী যাবে।

বিনায়কের শিরদাঁড়া বেয়ে একটা ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল। ভাগ্যিস তাকে জোর করে নামিয়েছিলেন হামিদ আলি!
কিন্তু এখন এত রাতে বিনায়কই বা থাকবেন কোথায় ? হামিদ আলির বাড়ি? হামিদ আলিই বা কোথায় গেলেন?

অন্ধকারে এদিক-ওদিক, একটুক্ষণ হামিদ আলিকে খুঁজলেন বিনায়ক। তারপর হতাশ মুখে ফিরেছেন কাউন্টারে। জিজ্ঞেস করলেন,–আচ্ছা দাদা, এই খানিক আগে…ওই যে আপনার ঘরে এসেছিল…লােকটা কোন দিকে গেল বলতে পারেন?

কে লােক?
এই বেলমুণ্ডিতেই থাকে। একটু আগে আমার সঙ্গে প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে কথা বলছিল.. কই, ঘণ্টাখানেকের মধ্যে তাে আমার কাছে কেউ আসেনি! লােকটার চোখে বিস্ময়— এক আপনি ছাড়া।

আসেনি? আমাকে যে বলল…। বিনায়ক সরে আসছিলেন কাউন্টার থেকে। আবার কী ভেবে মুখ ফেরালেন,–আপনি কি এখানেই থাকেন দাদা?

হ্যা। লােকটা ফোন রেখে এখন খানিকটা স্থির হয়েছে। বলল,—কেন বলুন তাে?

হামিদ আলিকে চেনেন? তার বাড়িটা কোথায় বলতে পারেন? কে হামিদ আলি ?

সুবেদার হামিদ আলি। মিলিটারিতে ছিল এক সময়ে। ম্যাজিক দেখত। আপনি কি সেই পাগলা ম্যাজিশিয়ানটার কথা বলছেন? হ্যা, হা, ম্যাজিশিয়ান।

সে তো কবে মরে হেজে গেছে। এই কর্ড লাইনেই কাটা পড়েছিল।..খুব স্যাড লাইফ। মিলিটারিতে থাকতে অনেক টাকা জমিয়েছিল। সব কেড়ে কুড়ে নিয়ে অমানুষ ছেলেগুলাে বাবাকে বের করে দিয়েছিল বাড়ি থেকে। শেষে ট্রেনে ট্রেনে ম্যাজিক দেখিয়ে বেড়াত লােকটা। মাখাটাও কেমন যেন হয়ে গিয়েছিল। একদিন ট্রেন থেকে ঝাপ দেওয়ার খেলা দেখাতে গিয়ে।…

আবার টেলিফোন বেজে উঠেছে। লােকটা ঝাপিয়ে পড়ে রিসিভার তুলল। বিনায়ক হতবাক দাঁড়িয়ে। সর্বাঙ্গ অসাড়। পা-টাও নড়াতে পারছেন না। গায়ে কাঁটা দিচ্ছে। বিচিত্র এক শিরশিরানি বুকের ভেতর।

হঠাৎই ঝাকুনি খেয়ে চেতনায় ফিরলেন। এক হাতে এখনও ধরা আছে হামিদ আলির গ্লাভস, অন্য হাতে রংভরা বেলুন! হামিদ আলিকে কর্ড লাইনে আর দেখা যায়নি কোনওদিন।

বিনায়ক দলুইয়ের নতুন খেলাটা ধরে গেছে খুব। বিনা অস্ত্রে পেট কাটার ম্যাজিক দেখে দর্শকরা দারুণ রােমাঞ্চিত হয়। ওস্তাদজির মান রেখেছেন বিনায়ক! খেলাটার নাম দিয়েছেন হামিদ আলির শেষ ভেলকি।

তবে বিনায়কের নিজের মনের ধন্দ এখনও কাটেনি। কোনটা যে হামিদ আলির শেষ ভেলকি, এখনও বুঝে উঠতে পারেননি বিনায়ক।

বিনায়ককে ট্রেন থেকে নামিয়ে তার প্রাণ রক্ষা করা ? না কি তাকে খেলাটা শেখানাে? নিজের গ্লাভস তার ভরা বেলুন শিষ্যের হাতে তুলে দিয়ে যাওয়া?

(সমাপ্ত)

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত