তস্কর

তস্কর

আনিসের বিয়ের পরদিনই ওর চাকরিটা চলে যায়। মিলির সাথে ওর শুধু কাবিন হয়েছে, বাসর বা ওই জাতীয় কিছুই হয়নি। আর তাই মিলির বাবা মা চাচ্ছে এই বিয়ে ভেঙ্গে দিতে। তাদের কথা হচ্ছে, বিয়ে হয়েছে শুধু কাগজে কলমে, এই বদ ছেলের কাছে তাদের মেয়েকে তারা দিবেন না।

ওদের বিয়েটা দুজনের বাবা মায়ের পছন্দেই হয়েছিল। আনিসের বিয়ে করার তেমন কোন ইচ্ছে ছিল না এবং সে মানা করে দেয়ার সিদ্ধান্তেই মনস্থির করেছিল। একদিন গল্পের বই খুলে আনিস মিলির ছবি পায়। ছবি দেখে তার চক্ষু শীতল হয় এবং সে বিয়েতে মত দেয়।

আনিসের চাকরি চলে যাবার খবর মিলির বাবা জামান সাহেব তার এক কলিগের মাধ্যমে পেয়ে আনিসদের বাসায় চলে এসেছেন।
“আমি আমার মেয়েকে কোন বদের হাড্ডির হাতে তুলে দিতে পারি না,” আনিসের বাবা-মায়ের সাথে কথার একপর্যায়ে তিনি বলেন।
“কি আমার ছেলে বদ?”, আনিসের বাবা আসগর সাহেব রেগে গিয়ে উত্তর দেন।
“বদ নাতো কি? খালি বদ? ও তো একটা চোর। মনে করেছেন আমি কিছু জানি না? আমি সব খবর পেয়ে গেছি।”
“মুখ সামলে কথা বলেন। আপনি কাকে কি বলছেন?” আসগর সাহেব রাগে কাঁপতে কাঁপতে বলেন।
“চোরকে চোর বলছি। আমি আজই আমার মেয়ের তালাক চাই।” জামান সাহেব বলে।
“তালাক তো মামার বাড়ির আবদার, যে চাইলেই হবে।” আনিসের মা রেশমা বলেন।
“মহিলা মানুষ কথা বলবেন না।” জামান সাহেব চোখ গরম করে বলেন।
“চোখ গরম করবেন না। বুঝেছেন? নিজের ওজন বুঝে কথা বলেন।” রেশমা বলেন।
“তো কি করবেন?” জামান সাহেব উত্তেজিত হয়ে সোফা থেকে উঠে দাড়ান। যেকোন মুহুর্তে পরিস্থিতি খুব বিশ্রী পর্যায়ে চলে যাবার মত অবস্থা। জামান সাহেব পারলে আসগর সাহেবের ওপর ঝাপিয়ে পরেন, আবার আসগর সাহেব পারলে জামান সাহেবকে ঘুষি মারেন।
“আমি তালাক দিতে রাজি আছি।” হটাৎ রুমে প্রবেশ করে আনিস বলে।
“তুই এগুলো কি বলছিস, বাবা?” রেশমা চোখ বড় বড় করে বলেন।
“আমি ঠিকই বলছি, মা।” আনিস বলে। “বিয়ে হয়ে যাবার পর বাসর না হয়ে তালাক হলে দেন মোহরের অর্ধেক দেয়া লাগে। সেটা এই মুহুর্তে আমার পক্ষে দেয়া সম্বব না।”
“তোমার চুরির টাকা নেয়ার জন্যে কি আমি হা করে আছি? আমাকে দেখে মনে হচ্ছে মরা কাতল মাছের মত হা করে আছি?” জামান সাহেব ফুসতে ফুসতে বলেন।
“আচ্ছা,” আনিস বলে। “আপনারা তাহলে তালাকের ব্যাবস্থা নিন। আমি রাজি আছি।”
“মনে থাকে যেন।” বলেই জামান সাহেব গটগট করে দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেলেন।
“এখানে বস,” আনিসকে সামনের সোফার দিকে ইশারা করে আজগর সাহেব বললেন। আনিস বসলে তিনি বললেন, “জামান সাহেব যা বলে গেলেন তা কি সত্যি?”
“কোনটা বাবা?” আনিস নির্লিপ্ত গলায় বলে। এতো সব ঝামেলা এখনো তাকে স্পর্শ করতে পারে নি।
“চুরির কথা বললেন যে উনি,” আসগর সাহেব লজ্জিত গলায় বলেন। তিনি তার ছেলেকে চেনেন। আনিসের মত ছেলেকে এরকম প্রশ্ন করাটাও লজ্জার। প্রশ্ন করেই তার মনে হয়, কি দরকার ছিল ওকে জিজ্ঞেস করার। উনি তো জানেনই আনিস এরকমের কোন কাজ করতে পারে না।
“হ্যা, বাবা। সত্যি। চুরির সাথে আমি জড়িত।” আনিস আবারো নির্লিপ্ত গলায় বলে।
আনিসের প্রতি বিশ্বাস আকাশচুম্বি ছিল বলেই হয়তো তার এই সহজ স্বীকারত্তিতে তার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ে। তিনি হার্টের রোগী। এই কথা শুনে তার বুকে ব্যাথা শুরু হয়ে গেল। তিনি বুকে হাত দিয়ে হাপাতে লাগলেন আর রেশমা তার পাঞ্জাবির বোতাম খুলে দিতে শুরু করেন তাড়াহুড়ো করে।
“ওকে আমার সামনে থেকে চলে যেতে বলো রেশমা,” আসগর সাহেব চিঁ-চিঁ গলায় বলেন। তার গলা দিয়ে শব্দ বের হচ্ছে না।
“তুমি একটু শান্ত হও, প্লিজ।” রেশমা বলেন।
“না। এক ওকে আমার সহ্য হচ্ছে না। ওকে এক্ষুনি এখান থেকে বেরিয়ে যেতে বলো। আর যেন জীবনেও এখানে না আসে। আমি ওর চেহারা আর দেখেতে চাই না।”
“বাবা, আমার কথা—”
“হারামজাদা, তোর কোন কথা শোনার দরকার নেই আমার। তুই বের হ! এক্ষুনি বের হ!” তিনি রাগে কাপতে কাপতে বলেন। তার অবস্থা দেখে রেশমাও কাঁদতে শুরু করেছেন।

আনিস আর কথা না বলে বাসা থেকে বেরিয়ে আসে। তাদের বাড়ি গাজীপুর। আর সে থাকে ঢাকার মতিঝিলের একটা মেসে। বিয়ে উপলক্ষে গাজীপুর নিজেদের বাসায় এসে থাকছিল সে।
পরদিন আনিসের মেসে লোক আসে তাকে মিলিদের বাড়িতে নিয়ে যাবার জন্যে। কিছু কাগজপত্রে তার সাইন লাগবে। আনিস জেতে রাজি হয়।

মিলিদের বাসায় যাবার পর তাকে ড্রইং রুমে বসতে দেয়া হয় এবং বসার সাথে সাথেই তার জন্যে এক গ্লাস বরফশীতল শরবত এনে দেয়া হয়। আজ আনিস চোর না হলে কি শরবতের সাথে টরবতও থাকতো না?
কিছুক্ষনের মধ্যেই মিলির এক মামা এসে তার সামনে বসে। তিনি একজন আইনজীবী। নানা ভাবে ইনিয়ে বিনিয়ে তিনি বললেন যে আনিস তালাক দিতে রাজি হওয়ায় সে এবং তার চোদ্দ গুষ্টি বেচে গেছে, নাইলে সব কয়টাকে জেলের ভাত খায়িয়ে ছাড়তেন তিনি।

“কাজগ পত্র আনুন, সাইন করে দিচ্ছি।” আনি বলে।
“এদেশের সব কিছুতে আঠারো মাসে বছর ইয়াং ম্যান। তালাক একটা লেন্দি প্রসেস। তো আজ শুধু তার ইনিশিয়াল কয়েকটা সাইন। এর পর আরো অনেক কাঠখড় পোড়ানোর পর তালাক হবে।”
আনিস সাইন করে দেয়। দিয়েই আনিস সেখান থেকে চলে যাবার জন্যে উঠে আসছিল। কিন্তু মিলির মামা বললেন, “তুমি আরেকটু বসো। মিলি তোমার সাথে একটু কথা বলতে চায়।”

আনিস বসে। সে বাসার ভেতর থেকে রাগান্বিত স্বরের কথা কাটাকাটি শুনতে পায়। মিলির মা বলছেন, “ওই ছেলের সামনে যাওয়ার আগে তোর শাড়ি চেঞ্জ করা লাগবে কেন? ফাযলামি করিস আমার সাথে?” মিলিও হয়তো জবাবে কিছু বলে, কিন্তু সেটা আনিসের কান পর্যন্ত আসে না।

তার পরপরই মিলি রুমে এসে ঢুকে। তাকে শাড়ি চেঞ্জ করতে দেয়া হয়নি। ও রুমে এসে আনিসের একদম মুখোমুখি সোফায় বসে পড়লো।
আনিস মিলির চোখের দিকে তাকায় না, হাতের দিকে তাকায়। হাতের মেহেদি এখনো সতেজ।
“আপনার চাকরি চলে গেছে?” মিলি তাকে জিজ্ঞেস করে।
“হ্যা, এখন আমি বেকার।”
“আপনার কি একদমই কান্ডজ্ঞান নেই?” মিলি বিরক্তি ভরা কন্ঠে বলে। “উফফফ!”
আনিস কিছু না বলে চুপ করে থাকে। “আপনার নামে যা শুনছি তা কি সত্যি?”
“হ্যা, সত্যি।”
“আপনি চুরি করেছেন?” কঠিন গলায় মিলি জিজ্ঞেস করে।
“হুম। চুরি করেছি, কিন্তু ধরা খেয়ে গেছি আর কি। বলে না? চুরি বিদ্যা মহা বিদ্যা, যদি না পড় ধরা?”
“মানে?” মিলি কিছু না বুঝতে পেরে বলে।
“মানে আমি অফিসের হিসেবে একটা গরমিল করে দিয়েছিলাম।”
“এটা তো চুরিই।”
“অবশ্যই চুরি।”
“চুরি করে স্বীকার করছেন কেন? অন্য কারো ওপর দোষ চাপালেন না কেন?”
“কারন চুরিটা আমিই করেছি।”
“যারা চুরি করে, তারাই অন্যের ওপর দোষ দিয়ে পারে। চুরি না করে কেউ চুরির দায় আরেকজনের ঘাড়ে চাপাবে কিভাবে?”
“ঠিক বলেছেন।”
“কত টাকা চুরি করেছেন?”
“৫ লাখ।”
“মাত্র? আপনাদের কোম্পানির কাছে তো এটা কোন টাকাই না।”
“হ্যা”
“এর বেশি চুরি করতে পারতেন না?”
“হ্যা, পারতাম।”
“তো করেন নি কেন?”
“প্রয়োজন ছিল না।”
“ওরা কেস করে নি?”
“না। আমার বাবা টাকাটা দিয়ে দিতে রাজি হয়েছেন। টাকা পেয়ে গেলে ওরা আর কেস করবে না।”
“কেন? আপনি টাকা কি করেছেন? এর মধ্যেই খরচ করে ফেলেছেন?”
“হ্যা।”
“কি খরচ করলেন?”
“সেটা বলা যাবে না।”
“আচ্চা। আপনি এখন যান। আমার প্রচণ্ড মাথা ধরেছে।”
আনিস চলে আসে।

পরদিন বাইরে প্রচন্ড বৃষ্টিপাত হচ্ছে। মেসের সবাই অফিসে গেছে। আনিস শুয়ে শুয়ে হুমায়ূন আহমেদের কোথাও কেউ নেই উপন্যাসটা পড়ছে। এমন সময় দরজায় আঘাত।

এরকম সময় কে এলো? আনিস ভাবে। দরজা খুলে দেখে মিলি দাড়িয়ে আছে। তার সাড়া শরীর ভিজে চপচপ করছে। হাত মুখের সামনে মুঠো করে একবার খুকখুক করে কাশলো সে।

আনিসকে একরকম ধাক্কা দিয়ে মিলি রুমের ভেতর ঢুকে পড়ে। তার হাতে ছোটখাট একটা ব্যাগ।
“এই বৃষ্টির মধ্যে আপনি এখানে কি করছেন?”
“বৃষ্টির মধ্যে এসেছি এটা দেখলেন। আর বাবা মাকে ফাকি দিয়ে পালিয়ে এসেছি এটা দেখলেন না?”
“না, মা-মা-মানে… ”
“তোতলানোর অনেক সময় পাবেন। আমাকে আগে একটা টাওয়েল দিন। আর বাথরুমটা কোথায়?”
“আপনি কি বলছেন?… বাসায় কেউ নেই।” আনিস কথা খুজে না পেয়ে বলে।
“বাসার সবাই বাইরে গেলে বাথরুম তালা মেরে যায় নাকি? আপনি বদনা চুরি করবেন এই ভয়ে?”
“না মা-মানে…” আনিস মিলিকে বাথরুমটা দেখিয়ে দিয়ে টাওয়েল আনতে যায়।
সে টাওয়েল এনে বাথরুমে নক করলে মিলি দরজা ফাক করে তার মেহেদি রাঙ্গা হাত বাড়ায়। আনিস লজ্জায় অন্যদিকে তাকিয়ে থাকে।
“অন্য দিকে তাকিয়ে আছেন কেন? চুরি করতে পারেন আর মেয়েদের দিকে তাকাতে পারেন না?
“না মানে…”
“আপনি রাবেয়াকে চিনেন? আপনাদের অফিসের এসেস্টেন্ট একাউন্টেন্ট। ও আমার বান্ধবি।” মিলি বাথরুমের ভেতর থেকেই বলে।
“হ্যা, চিনি তো। কেন?”
“ও আমাকে অনেক কথা বলেছে। ওর ধারনা আপনি আপনার অফিসের টাকাটা নিয়ে আপনার কলিগ রমজান সাহেবকে দিয়েছেন। কথাটা কি সত্যি?”
“সত্য। কিন্তু সেটা তো তার জানার কথা না। এটা আমি আর রমজান সাহেব আর আমি ছাড়া কেউ জানে না।”
“রমজান সাহেবের ক্যান্সারে আক্রান্ত মেয়েটা কি এখন ভালো আছে?”
“হ্যা। অনেকটা ভালো।” আনিস ধরা পড়ে যাওয়া কন্ঠে বলে।
“মেয়েটাকে দেখতে নিয়ে যাবেন আমাকে একদিন?” মিলি বলে।
“যাব,”
“আচ্ছা, এখন ঝটপট করে রেডি হয়ে নিন। আমি বাসা থেকে পালিয়ে এসেছি। তাদের সব বলার পরও তারা আমাকে আপনার সাথে আসতে দিতে রাজি হচ্ছিল না। আমি বান্ধবীর বাসায় যাবো বলে পালিয়ে এসেছি। হাতে একদমি সময় নেই। কয়দিনের জন্যে পালিয়ে থাকতে হবে আমাদের।”
“কি!!! ”
“জ্বী!!!” বাথরুমের দরজা খুলে মিলি বলে। সে দুলে দুলে হাসছে।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত