মেঘ অথবা রোদ্দুরের গল্প

মেঘ অথবা রোদ্দুরের গল্প

ষোল সালের মাঝামাঝিতে আমার এক প্রেমিক ছিলো। ঠিক যেন এপোলোর অষ্টম ভার্সন। প্রায় ছফিট লম্বা, মাথাভর্তি ঝাঁকড়া চুল, ঠোঁটের নীচে তিলটা জ্বলজ্বল করতো। শার্টের বোতাম খুলে রাখতো উপরের দুটো। ফর্সা বুকে পশমগুলো লালচে দেখাতো। হঠাৎ দেখলে বুকে ধাক্কার মত লাগে। এতটা অসহ্যকর সুন্দর ছিল। ছেলেমানুষের এত সুন্দর হতে নেই।

ওর সাথে আমার পরিচয়টা এডওয়ার্ডের বাংলা ডিপার্টমেন্টের পুকুর পাড়ে। সেদিন ছিল কাঠফাটা রোদ্দুর। আমি পড়া শেষ করে একা একাই এসে বসতাম জায়গাটায়। সেদিনও বসেছি। কিছুক্ষন পর বিরক্ত হলাম ফোনের শব্দে। তিথি, আমাদের মিস বাংলাদেশ বান্ধবী ফোন দিয়েছে।
-হ্যালো তিতির
-বল শুনতেছি
-কই রে তুই?
-এডওয়ার্ড এ।
-আচ্ছা শোন।তুই একটু বস। আমি আসতেছি। শহরে যাব।
-রাবুরে নিয়া যা না
-রাবুও বের হইতেছে
-আচ্ছা আয়।
ফোন রাখতেই পাশ থেকে কেউ বললো,
-আপনার কন্ঠটা তো ভয়াবহ টাইপের সুন্দর।
বিরক্ত হলাম। দুটি কারণে। এক মন খারাপ হলে আমি একা থাকতে ভালোবাসি। দ্বিতীয়ত ফ্লার্ট করা ব্যক্তি আমার একটুও পছন্দ না।কোনো উত্তর দিলাম না। চুপচাপ ডায়েরী লিখতে লাগলাম। কিছুক্ষন পর আবার বললো,
-হ্যালো কিন্নরী। আছেন আপনি?
-আমি রাফি।আপনি?
-আমি জানি আপনি আছেন এখানে।
আমি উত্তর না দিয়ে নিঃশব্দে উঠে চলে এলাম।

রাফির সাথে আমার দ্বিতীয়বার দেখা হয় আমাদের কলেজের সামনে। আমি সবেই টেস্টের মার্কশীট নিয়ে বেরিয়েছি। তখনই দেখি একটা ছেলে মাঝরাস্তায় অন্ধের মত হাতড়াচ্ছে শূন্যে। ওটা ঢাকা কুষ্টিয়া বিশ্বরোড। গাড়ি যাচ্ছে আসছে। ছেলেটাকে রাস্তা থেকে টেনে সরিয়ে কষে এক থাপ্পড় লাগালাম।
-মরার ইচ্ছা হইছে?সমস্যা কি?
ছেলেটি হেসে ফেললো।
-হাই মিস কিন্নরী।
আমি ভেজা বারুদের মত চুপসে গেলাম।
-আপনি কি আছেন?
বিড়বিড় করে বললাম
-আছি। বলুন।
-আমাকে একটু বাসা অব্দি পৌঁছে দেবেন প্লিজ? প্লিইইজ।
-বাঁচালেন যখন। আর একটু উপকার তো করতেই পারেন।
-বাসা কোথায়?
-নারায়ণপুর জামে মসজিদের কাছে।
-আচ্ছা চলুন।
-হাতটা ধরুন
-কেন?একা হাঁটতে পারেন না?
-পারলে নিশ্চয়ই আপনি থাপ্পড়টা মারতেন না।
রাফিকে নিয়ে রিকশায় উঠলাম। নারায়ণপুর মসজিদের কাছে আসতেই এক পিচ্চি চিৎকার করে উঠলো,
-বড় ফুপুউউউউউ। রাফি ভাইরে পাওয়া গেছে।

মুহূর্তে কি থেকে কি হয়ে গেলো বুঝলাম না । চারিদিকে জনা ত্রিশেক লোক জড়ো হয়ে গেলো। আমাকে প্রায় শূণ্যে তুলে নামালো।আমি ভয়ে চোখ বন্ধ করে ফেললাম।চোখ খুলে দেখলাম আমি সুন্দর একটা রুমে বসে আছি। আমার সামনে প্রায় এক পল্টন লোক চুপকরে বসে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে । প্রায় ত্রিশ জোড়া চোখ ওভাবে তাকিয়ে থাকলে অস্বস্তি হওয়াটা স্বাভাবিক।আমি একটু নড়েচড়ে বসলাম।সবাই স্থির। এবার বললাম পানি খাবো।একজন উঠে পানি এনে দিলো নিঃশব্দে।
আবার সব চুপচাপ। আচমকা এবার প্রত্যেকেই হাউমাউ করে কথা বলা শুরু করলো। তারপর বৃদ্ধা একজন লাঠিতে ভর দিয়ে ঠুক ঠুক শব্দ করতে করতে এগিয়ে আসলো। তাকে দেখে সবাই আবার চুপ করে গেলো।
-তুমিই রাফিকে নিয়ে এসেছো?
-জ্বি
-নাম কি?
-তিতির রশিদ
-তুমি পিপি রশিদের মেয়ে নও তো?
-জ্বি
বৃদ্ধার মুখ উজ্জ্বল হলো।
-আছে কেমন বেকুবটা?
আমি হতভম্ভ হয়ে গেলাম।আমার বাবার মত জাঁদরেল উকিলকে কি না বেকুব বলছে।
-জ্বি?
-আরে মেয়ে। তোর বাবা আমার বড় ছেলের সাথে পড়তো। আমার বড় গাধাটা তো লন্ডনে আছে। লন্ডনী গাধা হয়েছে।
-অ
আমি বিরস মুখে বসে রইলাম।

-তুমি যে কি বাঁচানো বাঁচালে মা
বম্বের নায়িকা শর্মিলা ঠাকুরের মত এক মহিলা এগিয়ে এসে কথা গুলো বললো।
আমি বরাবরই অনেক লোকের মধ্যে হেজিটেট ফিল করি।মহিলার কথায় বললাম,
-না না। এই আরকি।তেমন কিছু না।
-তেমন কিছু না বলছো?ছেলেটা আমার অন্ধ। তারপর কাউকে কিছু না বলে বেরিয়ে গেছে।
আমি প্রচন্ড শক পেলাম। রাফির দিকে তাকালাম। কি সুন্দর জলভরা চোখ। এত সুন্দর চোখের ছেলেটা কি না অন্ধ?

এরপর প্রায়ই আমার আর রাফির দেখা হতো।বিকেলের দিকে ও ওর ছোটবোনকে নিয়ে আমাদের বাসায় চলে আসতো।আমি ছাদের রেলিং এ পা ঝুলিয়ে গিটার বাজাতাম। ও চুপচাপ শুনতো। কোনো কোনো দিন ওকে নিয়ে হাঁটতে বের হতাম।
ধীরে ধীরে আমি ওর চোখ হয়ে গেলাম। আমি প্রত্যেকটা জিনিসকে বর্ণনা করে দিতাম ওর কাছে। জন্মান্ধ ছেলেটির ওপর আমার ভীষণই মায়া পড়ে যায়।

এর মধ্যে আমার ইন্টার শেষ হয়ে গেলো।আমি কোচিং নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেলাম। ব্যস্ততার মধ্যেও ঠিক সময় বের করে নিতাম ওর জন্য। ও যেন ঠিক এই সময়টুকুর জন্যই অপেক্ষা করতো। ওকে আমি গল্প শোনাতাম। শীর্ষেন্দুর দূরবীন পুরোটা পড়ে শুনিয়েছিলাম। ও খুব কবিতা ভালোবাসতো। বিদেশে থাকার জন্য ওর পড়াশোনা আটকায় নি। স্পেশাল চাইল্ড কেয়ার হোমে পড়েছে। রাফির প্রিয় কবি ছিল জীবনানন্দ। ‘অঘ্রাণ প্রান্তরে ‘ কবিতাটা আমি বোধহয় ওর কাছ থেকে কয়েক হাজার বার শুনেছি।

এরমধ্যে আমাকে ঢাকায় চলে আসতে হলো। চারুকলায় হয়ে গেলো আমার। ভর্তি, হল সব মিলিয়ে আমি কয়েকটা দিন ভীষণই ব্যস্ত পার করলাম। সেদিন সবেই খানিকটা অবসর পেয়ে হাঁটছিলাম। তখনই আননোন নম্বর থেকে ফোনটা এলো।দোনোমনা করে ফোনটা রিসিভ করলাম।
-তিতির?
-বলছি
-রাফি
-হ্যা রাফি বলো।
-অবাক হওনি?
-উঁহু
-কেন?
-স্বর্ণা নিশ্চয়ই তোমাকে ফোন দিয়ে দিয়েছে।
রাফি শব্দ করে হেসে ফেললো। আমি মুগ্ধ হলাম। এই ছেলে যতবার হাসে আমি মুগ্ধ হই। আমার ইচ্ছে করে ওকে বলি ‘ফিরে ফিরে নিতি তব চরণে আসিবো।’
-শোনো
-বলো
-তোমাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে। তুমি কই আছো এখন?
-এইতো রামপুরা ব্রিজের এখানে
-তোমার ভার্সিটি থেকে দূরে না?
-তা দূর আছে
-ওখানে কেন?
-এমনি ঘুরতে ঘুরতে চলে এসেছি।
-আচ্ছা।
কিছুক্ষণ পর আমার সামনে একটা পাজেরো থামলো। রাফিকে হাত ধরে নামালো স্বর্ণা। আমার সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়ে বললো,
-এই নাও তিতির আপু। তোমার জিনিস বুঝাইয়া দেয়া হইলো।
হেসে ফেললাম।

অনেকক্ষণের নিরবতা ভাঙলো রাফি।
-তোমাকে আমার কেন দরকার হয় জানো?তুমি সব সিচুয়েশনে আমাকে বুঝতে পারো।
-আচ্ছা।
-তিতির
-হু
-কাজটা না করলে হোতো না?
আমি উত্তর দিলাম না।
-আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করতাম তো।
খানিকক্ষণ চুপচাপ থেকে বললাম,
-রাফি। ভালোবাসাটা কি জানো? শেয়ারিং। আমি যখন খুব ভালো কোনো দৃশ্য দেখি।মনেহয় তোমাকে এইটা বর্নণা করি। তুমি যখন খুব ভালো কোনো মিউজিক শোনো। সেটা আমাকে শোনাও।
-হ্যা
-তাহলে তুমি যখনই দেখবা যে তোমার ভালোবাসার মানুষটা তুমি ছাড়া অন্য কোনো একজনের সাথে ভালো আছে। তুমি কি সরে যাবে না?
-হ্যা
-কেন যাবে?
-কারণ সে অন্য মানুষটার সাথে ভালো আছে।
-গ্রেট। এটাই ব্যাপার। ভালোবাসার মানুষ গুলার জন্য জায়গা ছেড়ে দেয়াটাও একরকম শেয়ারিং। কারণ তুমি জানছো তাতে সে ভালো আছে।
-কিন্তু তিতির। অন্য কেউ তোমার প্রিয় মানুষটাকে ভালোবাসে বলে তুমি জায়গা ছেড়ে দিচ্ছ। কিন্তু এটা কি জানতে চেয়েছো তোমার প্রিয় মানুষটা তাকে চাচ্ছে কি না?
-আমি হলে ফিরবো রাফি।চলো তোমাকে স্বর্ণার কাছে পৌঁছে দিই।
-তিতির, আমি রাজি হবো তোমার জন্য। কিন্তু আমার বাকী জীবনটা হবে আ লঙ জার্নি অব লোনলিনেস।
আমি রাফিকে স্বর্ণা কাছে পৌঁছে ফিরে চললাম।

আমার কিইবা করার ছিল। মৌরি আপু যখন বাবাকে বললো ওর রাফিকে পছন্দ,রাফিকে ভালোবাসে। বাবা প্রস্তাব তুলতে ওদের ফ্যামিলিতেও মেনে নেয়। তখন আমার দূরে আসা ছাড়া উপায় তো ছিল না। একজীবনে সকল ব্যথা উপেক্ষা করা যায় না যে।
হাতিরঝিল পার হয়ে আসতেই মসজিদের নগরীর অলিগলি থেকে মাগরিবের আজান ভেসে এলো। আমার দীর্ঘশ্বাসেরা হাওয়ার সাথে মিশে গেলো।।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত