আজ ভার্সিটির প্রথম ক্লাস।সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে ফ্রেস হলাম। ভার্সিটি যাবার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি এমন সময় আব্বুর ফোন।আমি ফোনটা রিসিভ করলাম।
আব্বু:কেমন আছো খোকা?
আমি: আলহামদুলিল্লাহ আব্বু ভালো আছি।তুমি কেমন আছো আব্বু?
আব্বু: হ্যা রে খোকা।আমিও ভালো আছি আল্লাহর রহমতে।হ্যা রে আজ তো তোর ভার্সিটির প্রথম দিন।
আমি: হ্যা আব্বু,কেন?
আব্বু:খোকা শোন সাবধানে যাস কেমন,আর হ্যা ভার্সিটির সিনিয়রদের সম্মান করবি,স্যার-ম্যাডাম উনাদের সাথে বেয়াদবি করবি না খোকা।
আমি:আচ্ছা আব্বু, মা কোথায়?
আব্বু:তোর মায়ের শরীরটা ভালো নেইরে খোকা,রাতে ঘুমের ঔষুধ খেয়েছে তো তাই ঘুমাচ্ছে।
আমি:আচ্ছা তাহলে ডেকো না,মা উঠলে বলো তোমার খোকা ফোন দিতে বলেছে কেমন।
আব্বু:আচ্ছা খোকা বলবো,আর হ্যা রাস্তা পারাপারে সময় দেখে পার হবে।খবারটা নিয়মিত খেয়ে নিবে,কোন প্রকার অনিয়ম করবে না কেমন। মনে রাখবে সব কিছুর পিছে একটা সুস্থ শরীরের প্রয়োজন,সুস্থতা সব কিছুর অনুপ্রেরণা যোগায় খোকা।
আমি: হ্যা সূচক বার্তা প্রকাশ করে,বাবর অনুমতি নিয়ে ফোনটা কেটে দিলাম।টুট টুট টুট জানেন আব্বুর উপদেশ গুলো মেনে এসেছি সেই ছোট বেলা থেকে।তার এই উপদেশ গুলো আমাকে বেশ অনুপ্রেরিত করে।যখনই কোন সমস্যায় পড়ি আব্বুর সাথে শেয়ার করি,ঠিক সমাধানটা করে দেন তিনি এবং অনুপ্রেরণা যোগায়।এই ভাবতে ভাবতে আল্লাহর নাম নিয়ে ভার্সিটির উদ্দেশ্যে বের হলাম।
ও হ্যা আমি শাওন।আমরা দুই ভাইবোন।আমি ও বড় বোন।বাবা পেশায় স্কুল শিক্ষক। বড় বোনের পড়া শেষ তাই অবসর সময় কাটাচ্ছে। আমি ভার্সিটিতে চান্স পেয়েছি সেজন্য ঢাকায় এসে একটা মেসে উঠেছি।ভর্সিটির থেকে কিছুটা দূরে।মেসের নিচ তলায় কর্ণারে একটা রুমে আমি ও একটা বড় ভাই থাকি। উনার নাম শফিক ভাই,উনি একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন।বেশ মিশুক প্রথম দিনেই ভালো একটা সম্পর্ক হয়ে ওঠে।অবশেষে একটা রিক্সা ডাক দেই এবং ভার্সিটির গেটের সামনে এসে পৌছাই।রিক্সা ওয়ালা মামাকে ২০ টাকা দিয়ে, গেটের দিকে পা বাড়াই।গেটটা দিয়ে প্রবেশ করতেই বুকে ভিতর কেমন জানি করছে,একটু নার্ভাসনেস ফিল করছি।
হাত-পা কেমন জানি কাপছে,কাপা কাপা পা নিয়ে বুকের ভিতর সাহস যুগিয়ে সামনের দিকে অগ্রসর হলাম।পরিচিত কোন মুখ নেই ভার্সিটির আঙ্গিনায় (শুধু আমার ক্ষেত্রে)। একটু সমনে গিয়ে দেখি সিনিয়ররা বসে আছে,আমি তাদের কথোপকথন শুনে বুঝতে পেরেছিলাম যে উনারা সিনিয়র।উনারা ৫ জন এক সাথে বসে আড্ডা দিচ্ছে।আমি উনাদের সালাম দিয়ে জিজ্ঞাসা করি,ভাইয়া রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগটা কোন দিকে একটু বলবেন।উনারা আমার দিকে কিছু ক্ষণ তাকিয়ে রইলেন। আমাকে দেখে একটা ছেলে দৌড়ে আসে এবং ওখান থেকে সরিয়ে নিয়ে যায়।আমি কিছু বুঝতে পারি নি বিষয়টা।ঐ ভাইয়াদের দেখে কেমন জানি মনে হচ্ছিলো।মনে মনে ভাবছি ভার্সিটির নেতা নয় তো?যারা র্যাগ দেয় জুনিয়রদের।
এই ছেলে তুমি কী ভার্সিটিতে নতুন(যে আমাকে ওখান থেকে সরিয়ে নিয়ে এলো)
আমি:হ্যা নতুন,কেন ভাইয়া কোন সমস্যা।
ভাইয়া:সমস্যা তো আছেই,ওরা ভালো নয়।সবাই কে র্যাগ দেয়,অপমান করে আরো অনেক কিছু করে, ওদের থেকে দূরে থাকবে।
কথা গুলো বলেই চলে গেলো।নাম, পরিচয় জানতে চাইলাম কিছু না বলে চলে গেল।যাবার সময় বলে গেলো দেখা হচ্ছে তোমার তোমার সাথে এই বলে দূরত চলে গেল।আমি নির্বাক দৃষ্টিতে চেয়ে রইলাম।ভাবছি আব্বুকে জানাই,হটাৎ দেখি ফোনটা বেজে উঠলো দেখি আব্বুর ফোন।আসলে এমনই হয় আমার সাথে যখন আব্বুর কথা ভাবি ঠিক তখন তার নাম্বার থেকে ফোন আসে।হয়তো কোন যোগ সূত্র আছে সেজন্যই হয়তো বা। ফোন রিসিভ করতেই মায়ের কন্ঠ শুনতে পেলাম, ওপাশ থেকে মা ঘুম জড়িত কন্ঠে বলছে,
মা:কেমন আছিস বাজান?মায়রে খুব মনে পড়ে বাজান?আয়না চইলে আয় বাপ মায়ের কাছে।তর ল্যাইগা পরানডা ক্যামোন জানি করে রে বাজান।
আমি:চোখে পানি চলে এলো মায়ের কথাগুলো শুনে।নিজেকে সামলে নিয়ে কাপা কন্ঠে বললাম মা আমি ভালো আছি,তুমি এমন করে কইও না পরানডা ক্যামোন জানি করে।বুকটা ফাইটে যায় মা। ও মা, মা, মা গো আমি সামনে মাসেই বাড়ি আইবো মা।তুমি দোয়া কইরো।তোমার বাজানের লাইগা।(আসলে মায়ের সাথে গ্রামরে ভাষায় কথা বললে মায়ের মনটা ভরে যায়)
মা:আইচ্ছা বাজান।বাজান তুমি কি বিয়ান(সকাল) ব্যালা খাইছো কিছু?
আমি:না মা খাতি পারি নাই।খুব জলদি জদলি চইলে আইছি ভর্সিটিতে।প্রথ্থোম দিন তো সেই জন্যি।
মা:বাজান এইরম আর করবা না,কয়ডা খাইয়ে ন্যাও এ্যাহোন।
আমি:আইচ্ছা মা। আব্বু কই??
মা:এইযে পাশেই রইছে, কথা কবি তোর বাপের লগে বাজান।
আমি: হ মা,কবো দ্যাওদি আব্বুর কাছে।আর মা তুমি চিন্তা কইরো না ক্যামোন।আমি সামনে মাসেই আসবানি বাড়ি।তুমি আব্বুর কাছে ফোনডা দ্যাও।
মা:আইচ্ছা বাজান,এই নে কথা ক তোর বাপের লগে।
আমি:আব্বু…
আব্বু:হ্যা রে খোকা বল, তোকে এমন চিন্তিত লাগছে যে,তোর কিছু হয়েছে নাকি।
আমি:আব্বুকে ঘটনাটা বলি।
আব্বু: শোন খোকা এটা নিয়ে চিন্তা করিস না।এমন একটু হবেই নতুন তো সেইজন্য।সব সময় মনে সাহস নিয়ে চলবি।হতাশ হবি না কেমন খোকা। চিন্তা করিস না খোকা। কিছু দিন গেলে সব ঠিক হয়ে যাবে..
আমি: আব্বু তোমার কথাগুলোই আমার সাহস সঞ্চয় করার জন্য বড় অবদান। আচ্ছা আব্বু রাখছি কেমন।রাতে ফোন দিবো তোমায়।(আব্বু একটু স্পষ্টভাষী, শুদ্ধ ভাবে কথা বলে)
আব্বু:আচ্ছা খোকা রাখো,রাতে কথা হবে।আমি তোমার মা’কে ঔষুধ দিব, পরে স্কুলে যাব।
আমি:আচ্ছা আব্বু রাখি।এই বলে রেখে দিলাম আর ভাবছি এই আব্বু নামক খুটিটি আছে বিদায় প্রতিটি পদক্ষেপে শক্তি ও সাহস সঞ্চয় করতে পারি।যা আমার পথ চলতে সহায়তা করে। আল্লার কাছে মানুষটার দীর্ঘ আয়ু কমনা করে।
আমি ক্যাম্পাসের খোজে সামনের দিকে অগ্রসর হলাম।হাটতে থাকি আর চারি পাশের সৌন্দর্য আবিষ্কার করি।কিন্তু আমার ক্যাম্পাস অর্থাৎ ভবনটা খুজে পাই নি এখনও।সামনে অনেক গুলো ভবন দেখতে পাই ইংরেজী,বাংলা,সমাজবিজ্ঞান, অর্থনীতি কিন্তু রাষ্ট্রবিজ্ঞান ভবনটা আর খুজে পাই না।আর একটু সামনে যেতেই সামনে ৬ তলা বিশিষ্ট একটা ভবন দেখতে পাই।অমনি মনের ভিতর আশার প্রদীপ জ্বলে।অনেক খুজা-খুজির পর মিলবে হয়তো কাঙ্ক্ষিত ক্যাম্পাসটি।আমি এই ভাবনা আর কৌতূহল নিয়ে এগোতে থাকলাম।কিন্তু সেখানে গিয়ে যে এতটা অপমান ও বোকামির পরিচয দিতে হবে তা বুঝতে পারি নি।
তাহলে শুনুন বোকামির পরিচয়, আমি ঐ ভবনের সামনে গিয়ে সোজা উপরে চলে যাই গিয়ে দেখি এটা রাষ্ট্রবিজ্ঞান ভবন নয়, এটি হলো ছাত্রী নিবাস।আমি তো লজ্জায় শেষ। পিছনে তাকিয়ে দেখি দুজন বয়স্ক মহলি আমার দিকে হন হন করে হেটে চলে আসলো আর বললো এই ছেলে এখানে কী? জানো না এটা ছাত্রী নিবাস।এখানে ছেলেদের প্রবেশ নিষেধ।মিনট পেরোতেই অনেক ছাত্রীরা এসে জড় হলো এখানটায়।আমি লজ্জায় মাথা নামিয়ে নেই এবং বলি আন্তরিক ভাবে দুঃখিত।দুজন বয়স্ক মহিলার মধ্যে একজন বলছে একে অধ্যক্ষের কাছে নিয়ে যাই চলেন আপা।আমার নিরবতা দেখে অপরজন বলে
=>এই ছেলে তুমি কোন ডিপার্টমেন্টের??
=> ভয়ার্ত কন্ঠে বলি পলিটিক্যাল সায়েন্স।
=> ভার্সিটিতে নতুন নাকি??
=>হ্যা নতুন।
পাশে ছাত্রীদের হাসা-হাসি আমি ঠিকই আমর কান অবদি পৌছালো, আমি অনুমান করলাম আমাকেই হাসাহাসি করছে।তখন একটু অপপান বোধ হলো।অনেকে বলছে কোথা থেকে যে আসে এগুলো।আমি লজ্জায় কারো দিকে তাকাতে পারি নি।কিন্তু হটাৎ এক মিষ্টি কোকিল কন্ঠের এক মেয়ে বললো ম্যাম ছেলেটি না জেনে বুঝে এখানে এসে পড়েছে। তাকে অধ্যক্ষের কাছে না নিয়ে তাকে ক্ষমা করে দিন ম্যাম।ছেলিটিকে দেখে খারপা মনে হচ্ছে না ম্যাম।শুধু শুধু ঝামেলা করাটা ঠিক হবে না ম্যাম।
আমি তার কথা শুনে আমি কিছুটা সাহস পাই।তখন ম্যাম বলে তুমি ঠিক বলেছো মাইশি।আচ্ছা রহিম কে ডেকে আনোতো রাবেয়া। [রহিম ভার্সিটির দপ্তরি,এবং রাবেয়া হলো ছাত্রী নিবাসের আয়া] কিছুক্ষণ পরে রহিম নামের লোক আসলো এবং বযস্ক মহিলা অর্থাৎ ম্যাম বললো ছেলেটিকে ওর ডিপার্টমেন্টে পৌছে দিয়ে আসো।আমি লজ্জায় তখনও কারো দিকে তাকাতে পারি নি।কিন্তু যাবার সময় ঐ মাইশি মেয়েটিকে খুজার ব্যার্থ চেষ্ট করলাম কিন্তু এত মেয়ের মাঝে কেমনে খুজি বলুন।তার পর রহিম মামার সাথে চলে আসি।রহিম মামা খুবি মিশুক টাইপের।খুবি ভালো এবং নম্র।রহিম মামা আমার নাম, কোথায় থাকি জানতে চাইলেন।আমি উত্তরে বললাম
=>আমি শাওন,গ্রাম থেকে এসেছি, এখানে একটা মেসে উঠেছি।
=> আচ্ছা মামা চলেন আপনারে পৌছে দেই।আমার আবার অনেক কাজ রয়েছে সেগুলো করতে হবে।
=>আচ্ছা মামা চলেন।
উনি আমাকে বলেন মামা ঐ যে ভবনটা দেখছেন ওটা আপনাদের ভবন।একটু তাড়া থাকার জন্য যেতে পারছি না মামা কিছু মনে করবেন না। আমি বললাম আচ্ছা সমস্যা নেই আমি এখন যেতে পারবো।এই বলে রহিম মামা কে ১০০ টাকা দিতে গেলে উনি বলেন মামা আমার এটা লাগবে না।আল্লাহ আমাকে খুব ভালো রেখেছেন বরং আপনার কাছেই রাখুন।আমি এখানে থেকে যে বেতনটা পাই তাতেই খুব ভালো ভাবে চলতে পারি।
আমি তার কথায় মুগ্ধ হয়ে তাকে নিজের বুকে জড়িয়ে নেই।তাকে জড়িয়ে ধরে কেমন জানি একটা শান্তি পেলাম।হয়তো নীতিবান ব্যক্তি বলে তাই। আবার তার এই কথাতে যে আব্বুর উপদেশটা মনে পড়ে গেল। আব্বু বলতো খোকা কখনো কারো থেকে কোন উপকার করে টাকা নিবে না।কখনো নিজের পারিশ্রমিকের বেশি কারো থেকে নিবে না।রহিম মামাকে জড়িয়ে ধরাতে মামার দুচোখে পানি চলে আসে এবং আমার কাধে দুফোটা পরাতেই বুঝতর পারি। আমাকে বলে মামা আপনি খুব ভালো মনের মানুষ।আমি নিচু শ্রেনির কর্মচারী বলে সবাই আমাকে হেয় করে দেখে।অনেক অপমান করে,আপনার মত করে কেউ এভাবে বুকে জড়িয়ে নেই নি মামা। রহিম মামার চোখের পানি মুছে দিয়ে বলি মামা কষ্ট পাবেন না ওদের ব্যবহারে।
রহিম মামা বলে আচ্ছা শাওন মামা আমি এখন যাই চোখের পানি মুছতে মুছতে।আমি বলি আচ্ছা মামা যান তাহলে।সময় পেলে আপনার কাছে আসবো।এই বলে দুজন দু দিকে হটা শুরু করি। রহিম মামা হয়তো এখনো চোখরর জলে নিজের মুখটা ভিজিয়ে নিচ্ছে।এই ভাবতে ভাবতে ক্যাম্পাসের সাসনে অর্থাৎ রাষ্ট্রবিজ্ঞান ভবনের সামনে এসে পৌছাই। ভবনটি চারি পাশটা কৌতূহল নিয়ে দেখতে থাকি।কতই না সুন্দর এখানকার পরিবেশ।একদম নিরব নিথর। কোন কোলাহল নেই এখানে যেন একটা সুচ পড়লেও শব্দটা শোনা যাবে।এমন সময় এক মেয়ের সাথে ধাক্কা লাগে, মেয়েটি মিষ্টি সুরে সরি বলে চলে যেতে থাকে,আমার ভিতরে কেমন জানি মনে হলো মাইশির মত কন্ঠ।তাকিয়ে দেখি মেয়েটা আমাদের ভবনেই গিয়েছে।আমি তাকে খুজার জন্য দূরত উপরে আসি কিন্তু তাকে পাই নি।কিছুটা মন খারাপ হলো আমার এবং মন খারাপ করেই রুমটা খুজতে থাকি যেখানর আমাদের ক্লাস হবে। অবশেষে আমি খুজে নিলাম আমাদের রুমটা।
আমি অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকি,এটা কি করে সম্ভব। এ যে দেখি ঐ ভাইয়াটা। যিনি নাম না বলে চলে এসেছিলো।আসার সময় বললো দেখা হচ্ছে।তখন আমি বিষয়টা বুঝতে পারিনি কিন্তু এখন ঠিকই বিষয়টা পরিষ্কার।কিন্তু উনি কি করে বুঝলো যে উনার সাথে দেখা হচ্ছে। হয়তো যখন ঐ ৫ সিনিয়র ভাইয়া দের কাছে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের কথা জানতে চেয়ে ছিলাম, দূর হতে হয়তো শুনে নিয়েছে।এই ভাবতে ভাবতে ভাইয়াটা অর্থাৎ স্যার বললো কি ওখানেই দাড়িয়ে থাকবে নাকি রুমে প্রবেশ করবে।জি হ্যা আসছি, ক্লাস রুমে প্রবেশ করতেই কেমন জানি মনটায় শান্তি শান্তি লাগছে।আমি স্যারের দিকে ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে রয়েছি, আমি কিছু বলতে চাচ্ছি হয়তো স্যার বুঝতে পারেছ এবং স্যার বলে যাও ওখানে গিয়ে বসো।ক্লাস শেষে তোমার সাথে আড্ডা দিবো আস্তে আস্তে বলে যাতে অন্যদের কান অব্দি না পৌছায়।আমি সিটে বসার জন্য পিছন মুখি হলাম এবং হটা দিলাম।কিন্তু মুহূর্তের মধ্যেই আমি পা পিছলে পড়ে গেলাম এক মেয়ের গায়ের উপর।
মেয়েটা আমাকে না দেখেই ঠাসসস্ করে চড় মেরে দিলো, কিন্তু যখন নিচে তাকিয়ে দেখলো ফ্লোরে পানি থাকার জন্য স্লিপ করেছি,ঠিক তখনই মিষ্টি কন্ঠে একটা আধো আওয়াজ স… বলেই থেমে গেলো।হয়তো সরি বলতে চেয়েছিলো,কিন্তু না বলে থেমে গেল। এর পর আমার দিকে কেমন করে জানি মেয়েটি তাকিয়ে আছে।আমি কিছু বুঝতে পারছি না,এভাবে কেন তাকিয়ে আছে।সে আমাকে দেখে কিছুটা চমকে গিয়েছে হয়তো আমাকে সে আশা করেনি কিন্তু কেন? নিজেকে প্রশ্ন করি উত্তর পাই না।আমি তাকে সরি বলেই সিটে বসে পড়ি।আর ভাবি মেয়েটা কেনই বা আমার দিকে এভাবে তাকিয়ে আছে কিছুতেই উত্তর খুজে পাচ্ছি না।এই ভাবতে ভাবতে অন্যমনস্ক হয়ে যাই, স্যারে ডাকে বাস্তবে ফিরি।স্যার বলে তোমাকে দিয়েই পরিচয় পর্বটা শুরু করি।ও হ্যা উনি এরি মাঝে পরিচয়টা দিয়ে দিছেন।উনার নাম হলো অয়ন। এ ভার্সিটিরই ছাত্র ছিলেন।তিনি এবছরই বিসিএস সম্মানন পেয়ে এখানে জয়েন করেন।
=>স্যার আমাকে বলেন তোমার নামি কী? কোথায় থাকি সব জানতে চাইলো
=>আমি আমার পরিচয় টা দিলাম।
স্যার বললো বসো।একে একে সবার পরিচয় পর্ব শেষ শুধু ঐ মেয়েটার বাদে।স্যার মেয়েটিকে বললো তোমার নাম কি? মেয়েটা বললো মাইশি।আমি নাম শুনেই কারেন্টের মত সক খাই।সে বলে আমি গ্রাম থেকে এসেছি,পাশের গ্রামের এক বড় ভাইয়ের কল্যানে ছাত্রী নিবাসের সিট মেলে।এটা বলাতেই আমি পুরো নিশ্চিত হয়ে যাই এই সেই মাইশি যে আমার পক্ষ নিয়ে কথা বলেছিলো।অবশেষে বুঝতে পেলাম (ঐ যে মিষ্টি কন্ঠ) নিচে যার সাথে ধাক্কা খেয়েছি সে আর কেউ নয় এই মাইশিই,ভাবতে কেমন জানি অবাক হয়ে যাচ্ছি।অবশেষে খুজে পেলাম আমার দিকে ওভাবে তাকিয়ে থাকার কারণ।মেয়েটিও বুজতে পারলো আমি তাকে চিনতে পেরেছি, কারণ আমি তাকে ছোট করে বললাম ধন্যবাদ।এতেই সে বুঝে নিয়েছে।কিন্তু আমার কথার কোর প্রতি উত্তর দিলো না মেয়েটা।
হটাৎ পাশের সিটের একটা ছেলে আমার দিকে হাত বাড়িয়ে বলে আমি ফারদিন।আমিও তার দিকে হাত বাড়িয়ে দেই এবং পরিচয পর্ব সেরে ফেলি।সে তার বড়লোক বাবার এক মাত্র সন্তান সেটা তার পোশাক পরিচ্ছেদেই বুঝতে পেরেছি।কিন্তু তার মধ্যে বিন্দু মাত্র কোন হিংসা-বিদ্বেষ নেই।তাই তার সাথে প্রথম দিনেই বন্ধুত্বটা বেশ জমে ওঠে।কেননা আব্বু বলেছিল “বন্ধু তুমি তাকেই বানাও যার ভিতর কোন হিংসা নেই”।আমিও তাই করলাম কারণ প্রতিটি পদক্ষেপে আব্বুর উপদেশ ও তার কথা মেনে চলি।
সেজন্য আব্বুর সাথে আমার বন্ধুর মত সম্পর্ক গড়ে ওঠে।এরই মাঝে কন্টাক্ট নাম্বার আদান-প্রদান হয়ে যায় আমাদের।স্যার বললো এটেনশন প্লিজ,আমরা সবাই স্যারে দিকে তকাই, স্যার আমাদের উদ্দেশ্যে কিছু শুভেচ্ছা বানী শুনালেন এবং বললেন আজকের মতে তোমাদের ক্লাস এ পর্যন্তই আগামীকাল দেখা হবে এই বলে স্যার চলে যান। যাবার সময় আমার দিকে ইশারা দিয়ে বলে দেখা করতে।আমি স্যারকে ইশারায় উত্তর দিয়ে দিলাম। ফারদিন বলে চল দোস্ত বের হই।আমি তখন মেয়েটার দিকে তাকিয়ে রয়েছি।কেন তাকিয়ে থাকবো না বলেন।এত সুন্দর, মায়াবী রূপের অধিকারী যে মেয়েটি তার দিকে তাকিয়ে থাকতে সমস্যা কই।তার সৌন্দর্য দেখে আমি মুগ্ধ হয়ে যাই।ফারদিন আমাকে ধাক্কা দিয়ে বলে এই শাওন চল মেয়েটার সাথে কথা বলি।
ও বুজলো কী করে আমি মেয়েটাকে নিয়ে ভাবছি,ওর দিকে তাকিয়ে আছি।আসলে কি জানেন তো বন্ধু গুলো এমনই সব বুঝে যায়। ফারদিন বলে চলনা দোস্ত মেয়েটে যে চলে যাচ্ছে।ও হ্যা তাই তো চল চল কথা বলতে হবে তো।ফারদিন মাইশি বলে ডাক দেয় কিন্তু মাইশি ডাক না শুনে হাটতে থাকে।ফারদিন বলে দোস্ত আয় এই বলে দৌড় দেয় কিন্তু মেয়েটি ছাত্রী নিবাসের গেট অতিক্রম করে ফেলায় আমরা আর এগোতে পারি নি। কেননা ছাত্রী নিবাসে ছেলেদের প্রবেশ নিষেধ।তখন আমরা আবার ফিরে আসি এবং আমি মনে মনে ভাবছি মাইশির পিছে আমরা কেন দৌড়াচ্ছি।আমি প্রেমে পড়ে যাই নি তো ওর।এই যাহহ কি ভাবছি এগুলো,প্রেমে পড়তে যাব কেন। এই ভাবনার মাঝে ফারদিন বললো দোস্ত মন খারাপ করিস না,আগামী কাল আবার শাইশির সাথে কথা বলার চেষ্টা করবো,দেখি কততে কথা না বলে থাকতে পার । আজ পারি নাই কথা বলতে,কিন্তু আগামীকাল পারবো ইনশা-আল্লাহ।ফারদিনের কথা শুনে আমি মনে মনে চিন্তা করি আসলে কোন ভুল মানুষের সাথে আমি বন্ধুত্ব করি নি।তার ব্যবহারে মনে হচ্ছে সে আমার বাল্য কালের বন্ধু। এরি মাঝে দেখি ফোনটা বেজে ওঠে,হয়তো আব্বুর ফোন, ভাবনাটা মিথ্যে হয় নি। ফোন রিসিভ করতেই আব্বু বললো
=>কিরে খোকা কেমন কাটলো ভার্সিটির প্রথম দিন।
=>অনেক ভালো বাবা, তবে জানো আব্বু কী হয়েছে।
আব্বু কে সম্পূর্ণ ঘটনাটা বলি আব্বু হাসছে। আমি বলি তুমি হাসছো কেন?আব্বু বলে ছাত্রী নিবাস বলেই হেসে দেয়।আমিও হেসে দেই।তারপর বাকি ঘটনা বলি। ফারদিনের কথাও বলি।ঠিক তখনি ফারদিন আমার থেকে ফোনটা কেড়ে নিয়ে আব্বুকে সালাম দেয় এবং বলে অাংকেল চিন্তা করবেন না।আমি আছি ওর পাশে।একদম চিন্তা করবেন না।ফারদিনের ব্যবহার আমাকে রীতমতো আমাকে মুগ্ধ করে তুলছে।আব্বুর সাথে কথা বলা শেষ করে ফারদিন ফোনটা রেখে দেয়।আমরা সামনের দিকে হাটতে থাকি গল্প করতে করতে।ঠিক গেটেইর সামনে দেখি একটা দামি গড়ি ফারদিনের।
ফারদিন বলে দোস্ত আয় তোকে নামিয়ে দেই,আমি না দোস্ত থাক একটু সামনেই আমার মেস যেতে কোন সমস্যা হবে না।কিন্তু ফারদিন ও নাছোড় বান্দা যা বলেছে তাই, তার জোরাজুরিতে আর না গিয়ে পালাম না।আমি গাড়ির দিকে এগুতেই ফারদিন গাড়ির দরজা টা খুলে দেয়।আমি ভিতরে ঢুকতেই গাড়ির এসির ঠান্ডা বাতাস সারাদিনের ক্লান্তি দূর করে দেয়।গাড়ি চলা শুরু হলো কিছুক্ষণ পর মেসের সামনে আসতেই বলি দোস্ত এখানেই রাখ।ঐযে তিন তলা বিশিষ্ট বিল্ডিং দেখছিস ওখানের নিচ তলার কর্ণারের একটা রুমি আমি থাকি।এই বলা শেষ হতে না হতেই ফারদিন গাড়িটি থামিয়ে দিলো।আমি ফারদিন কে বিদায় বলে মেসের দিকে রওনা হলাম।
ঠিক তখনই পিছন থেকে একজন ডাক দেয়, বলে শাওন ভইয়য়া বেশ জোরেই। আমি পিছনে ফিরতেই দেখি সাকিব। আমি পিছন ফিরতেই ও আমার কাছে চলে আসে।বলে ভাইয়া তুমি এখানে।সাকিব সম্পর্কে আমার মামাতো ভাই হয়,যদিও আপন নয় তবুও খুব কাছের।গ্রামে এক সাথে ক্রিকেট খেলতাম। আমি বলি কিরে তুই এখানে, ও বলে ভাইয়া এখানে এক আত্নীয়র বাসায় এসেছি।আসলে পরীক্ষা শেষ তাই একটু ঢাকার পরিবেশে ঘূরতে এলাম। বেশ ভালো, ভিতরে চল পরে ঘূরতে বের হবো।ভার্সিটি থেকে ফিরলাম তো তাই ক্লান্ত লাগছে। সাকিব বলে না ভাই তুমি যাও,ফ্রেস হয়ে ফোন দিও আমি আসবানি। আচ্ছা ছোট ঠিক আছে, ঐযে কর্ণারের রুমটায় থাকি, মন চাইলে চলে আসবি কেমন।এই বলে আমি চলে আসি।রুমে ঢুকে দেখি শফিক ভাই ল্যাপটপে অফিসের কাজ করছে।রুমে প্রবেশ করতেই শফিক ভাই বলে
কিরে কেমন গেল প্রথম দিন,কেমন অভিজ্ঞতা হলো ভার্সিটি সম্পর্কে। আমি উত্তরে বলি হুম খুব ভালো তবে মজার একটা ঘটনা ঘটেছে আজ। শফিক ভাইকে ঘটনাটা বলি তিনি হাসতে হাসতে বেহুঁশ হবার উপক্রম। আমি তার সাথে সঙ্গ দেই।দুজনেই হাসতে থাকি একাধারে।শফিক ভাই বলে যাও ফ্রেস হয়ে আসো,তোমাকে নিয়ে একটু ঘূরতে বের হবো।আচ্ছা ভাইয়া এই বলে ফ্রেস হতে যাই এসে একটু রেষ্ট নিয়ে সন্ধার সময় বের হই, সাকিবকে ফোন করে আসতে বলি,আমরা তিন জনে ব্যস্ত শহরটা ঘূরে দেখতে থাকি।নানান ধরনের মানুষ এখানে এসে ভিড় জমিছে। স্বপ্ন পূরণের তাগিদে।কত মানুষের আনাগোনা চারিপাশে। রাতের আলোয় ঢাকার শহর যেন অন্য রকম হয়ে ওঠে। লাল নীল রঙের বাহার চারিদিকে।হটাৎ শফিক ভাইর জরুরি ফোন আসায়
১০ টা দিকে বাসার উদ্দেশ্যে রওনা হই,বাসায় ফিরতে ফিরতে ১১ টা বেজে যায়।আমরা বাহিরে থেকে খেয়ে এসেছি তাই রাতে, মেসে খাই নি। সব কাজ সেরে ১.৩০ এর দিকে ঘুমোতে যাই। ভাবলাম আব্বুকে ফোন দেই কিন্তু আবার মনে হলো ঘুমিয়েছেন হয়তো, এই ভেবে ফোন না দিয়ে ঘুমিয়ে পরি,সকাল ৭ টায় আব্বু ফোন দেয়।অনেক সময় কথা বলি।পরে রেখে দেই, ভার্সিটির জন্য প্রস্তুত হতে থাকি। ফোনটা বেজে উঠে, দেখি ফারদিনের ফোন।রিসিভ করতেই বলে তাড়াতাড়ি আয় আমি বাহিরে অপেক্ষা করছি।আমি শফিক ভাইকে বলে চলে আসি।ভার্সিটিতে পৌছে যাই আমরা,আজ আর প্রথম দিনের মত ক্যাম্পাসে যেতে খুব একটা বেগ পেতে হয়নি।স্যার ক্লাস রুমে ঢুকেই সবাই কে নিয়ম কানুন সম্পর্কে অবগত করছে। আমি তাকিয়ে আছি মাইশির দিকে।মেয়েটার চুল গুলো ফ্যানের বাতাসে দুলছে।দেখতে বেশ ভালোই লাগছে।আমি হারিয়ে যাই মাইশির মাঝে।ক্লাস শেষ হতেই মইশির দিকে এগিয়ে যাই, কথা বলার জন্য কিন্তু সে আমাদের কোন পাত্তা দিলো না।হেটেই চলছে, ফারদিন তার সামনে গিয়ে পথ আটকানোর চেষ্টা করে কিন্তু বেচারার যে বিনিময়ে মুখটা লাল হয়ে গেল বুঝতেই পারছেন কেন।ঠাসসসসসসসসসসস বাকিটা বুঝে নিন।
আজকেও হলো না কথা বলা।মন খারাপ করে ফিরে আসছি তখন অয়ন স্যারের সাথে দেখা। উনি আমাদের সাথে কিছু সময় আড্ডা দিলেন।তার সফলতার গল্প শুনালেন আমাদের।তার কথা গুলো শুনে আমাদের চোখে পানি চলে আসে। তিনিও চোখ মুছে বলে চলো আজ উঠি।আসলে অয়ন স্যার বহু ত্যাগের মাধ্যমে আজ এই সফলতা পেয়েছে।
শুনবেন স্যারের জীবন কাহিনী। তাহলে বলি শুনুন উনি খুব গরিব ঘরের সন্তান ছিলেন। এস.এস.সি’র সময় তার বাবা মা বাস এক্সিডেন্টে মারা যায়।সেই থেকে উনি খু্ব একা হয়ে যায়।অয়ন স্যার ঢাকায় আসে একটা থাকার জাগা খুজতে কিন্তু বহু অপমান,লাঞ্ছনা সইতে হয় উনার।কোন অাত্মীয়র বাসায় তিনি স্থান পায় নি।পরে বাধ্য হয়ে একটা লোকাল বাসে হেল্পারি করতেন। এবং রাতের বেলায় রাস্তার ল্যাম্পের আলোয় পড়তেন।অনেক কষ্ট করে পড়াশুনা করেছেন।উনি ভার্সিটিতে চান্স পেয়ে হলে উঠে তখন একটা টিউশনি করে যা পেত তা দিয়ে কোন মতে রাতগুলো পার করতো।টিউশনি করে বেশ ভালোই যাচ্ছিলো,টিউশনির সুবাদে নিলা নামের মেয়ের সাথে সম্পর্ক গড়ে ওঠে। নিলা ছিলো অয়ন স্যারের ছাত্রী সুমনার বড় বোন।অয়ন স্যার আর নিলা ম্যাডামের সম্পর্ক বেশ ভালোই জমে উঠেছিলো।এই সম্পর্কের কথা নিলা ম্যাডামের বাবা-মা জানতে পরে এবং হারাতে হয় টিউশনিটা।
অয়ন স্যার টিউশনি হারিয়ে বেশ বড় একটা ধাক্কা খায় কেননা সেখান থেকে যে টাকাটা পেত তাই দিয়ে তার খরচ চালাতো।কিন্তু টিউশনি টা হারিয়ে অয়ন স্যার খুব বিপাকে পরে।তবে নিলা ম্যাডামের অনুপ্রেরণায় অয়ন স্যার কিছুটা শক্তি সঞ্চয় করতে পারে।এবং নিলা ম্যাডামেই তাকে দুইটা টিউশনির ব্যবস্থা করে দেয়।এভাবে তিনি বিসিএস দেয় এবং বিসিএস পেয়েও যায়।কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস যে মেনে নিতেই হবে।
অয়ন স্যার আর নিলা ম্যাডাম পালিয়ে বিয়ে করে নেন। ভালোই কটছিলো তাদের সংসারিক জীবন।নিলা ম্যাডাম ছিলেন নয় মাসের অন্তঃসত্ত্বা। হটাৎ একদিন নিলা ম্যাডাম খুব অসুস্থ হয়ে পরেন। অয়ন স্যার ফোন পেয়েই হসপিটালে চলে যায়।সেখানে নিলা ম্যাডামের পরিবারের সবাই ছিলো।উনাদের বিয়ের কিছুদিন পর পরিবার থেকে মেনে নেয়।নিলা ম্যাডাম ওটি তে আছেন। অয়ন স্যার বাহিরে পায়চারি করছে।এমন সময় ভিতর থেকে বাচ্চার কান্নার আওয়াজে সবাই একটু স্বস্তির নিশ্বাস নিলো।কিন্তু ডাক্টার এসে যা বললো সেটার জন্য কেউ প্রস্তুত ছিলো না। সরি, বাচ্চার মা কে আমরা বাঁচাতে পারি নি।এটা শুনে অয়ন স্যার দৌড়ে ভিতরে গিয়ে দেখে সাদা কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছে নিলা ম্যাডামকে।নিলা ম্যাডাকে জড়িয়ে ধরে চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে কাঁদতে থাকে।কান্নার কোন প্রতিশব্দ নেই তাই হয়তো সেদিনের কান্না শুনতে পাইনি নিলা ম্যাডাম।শুনতে পাইনি অয়ন স্যারে আর্তনাদ।
অয়ন স্যারের চোখ দিয়ে পানি বের হচ্ছে।আমাদেরও চোখে পানি চলে আসে।প্রিয় মানুষকে হারিয়ে ফেলার বেদনা কতটা বেদনাময় সেটা ভাষায় প্রকাশ করার মত নয়। আব্বু আব্বু তুমি কাঁদছো কেন?? আম্মুর কথা মনে পড়ছে বুঝি? ও হ্যা এটা হচ্ছে অয়ন স্যারের মেয়ে অনি।আসলে মেয়েটাকে বড্ড বেশি ভালোবাসে তাই সব সময় চোখে চোখে রাখে। অনির বয়স ৫ বছর।খুব মিষ্টি মেয়েটা। অনির সাথে কিছু সময় আড্ডা দিয়ে আবার ফিরে এলাম মেসে।বাসায় এসে রাতের খাবার শেষ করে ঘুমাতে যাই। সকালে উঠে ভার্সিটি যেতে হবে। মাইশির সাথে কথা বলতেই হবে এই ভাবছি।ভাবলাম এ বিষয়টা আব্বুকে বলি, কিন্তু সাহস হলো না আসলে এর আগে কখনও এরকমটা হয় নি। সকাল হতেই ঘুম ভেঙে গেল ব্যস্ত শহরে হরেক রকম শব্দে। তার মধ্যে গাড়ির হর্ণ ছিলো খুব বিরক্তি কর।বিছানা ছেড়ে ভার্সিটির জন্য তৈরি হচ্ছি।আব্বুকে একটু ফোন দিয়ে খোজ খবর নিলাম।।
ভার্সিটির গেটে ফারদিনের সাথে দেখা ওকে নিয়ে আমাদের ক্যাম্পাসের দিকে যাই।ক্যাম্পাসে যেতেই মাইশির সাথে দেখা হয়ে যায়।আমরা একটু দৌড়ে যাই মাইশির কাছে,গিয়ে কেমন আছো জানতে চাইলাম কিন্তু আমাদের উপেক্ষা করে সে চলে গেল।বিষয়টা একটু গায়ে লাগলো।খুব অপমান বোধ হলো,কেমন বেহাইয়া বেহাইয়া মনে হচ্ছে নিজেকে।তাতে কি প্রিয় মানুষের জন্যই তো। এভাবে অনেক দিন গেল কিন্তু আমাদের কোন পাত্তাই দিলো না। আমাদের দিনের পর দিন ব্যর্থ হতেই হচ্ছে।
আমি এটা নিয়ে খুব চিন্তিত হয়ে যাই। মাইশির প্রতি অনেকটা দূর্বল হয়ে যাই।মাইশিকে নিজের করে পাবার বেগ পেয়ে বসলো আমায়,এজন্যই বারে বারে তার কাছে ফিরে যাই।মাইশিকে দেখে বুঝতাম ও বেশ উপভোগ করতো এটা।।ওর চোখের দিকে তাকালে মনে হতো আমাকে ভালোবাসে মাইশি,কিন্তু আমাকে এভাবে ফিরিয়ে দিচ্ছে কেন।আমি এর কোন উত্তর খুজে পাচ্ছি না।তাই আমি নিজের লজ্জাকে দূরে ঠেলে দিয়ে বিষয়টা আব্বুর কাছে বলি।আব্বু একটু হেসে মা কে ডাক দিয়ে বললো শোনো আমাদের খোকা প্রেমে পড়েছে।।এই বলে হেসেই যাচ্ছে,আমার কেমন জানি নিজেকে অসহয় অসহায় মনে হচ্ছে। কিছুটা অভিমানের সুরে বলি আব্বু থামবে মজা নিও না, একটু বলো না কি করবো আব্বু প্লিজজজজ।।
বলে শোন খোকা মেয়েটা তোকে ভালোবাসে,কিন্তু মেয়ে মানুষ তো তাই বলছে না। শোন তুই কিছু দিন মেয়েটার থেকে দূরে থাক, ওর সাথে আগের মত কথা বলিস না দেখবি ও তখন নিজেই তোকে খুজবে। নিজেকে একটু লুকিয়ে রাখবি। আর হ্যা আব্বু কিন্তু এ বিষয় খুব পটু, কেননা আব্বু আর মা দুজনেই দুজনকে ভালোবেসে বিয়ে করেন।
আমি আব্বুর কথা মত কিছু দিন নিজেকে মাইশির থেকে দূরে রাখি।দেখি বেশ কাজ হচ্ছে, আগের মত মাইশির পিছে যাই না।মাইশি কে আগের মত বিরক্ত করি না।এর মধ্যে কয়েক জন বান্ধবীও হয়ে গেল।তাদেরকে বেশি সময় দিতাম এটা দেখে মাইশি একটু কেমন যেন করতো, মুখটা লাল হয়ে যেত, সম্ভবত রাগে।আমার দিকে কেমন রাগান্বিত দৃষ্টিতে তাকাতো।আমি একদিন আমার এক বান্ধবীর সাথে ফারদিনের বাসায় যাচ্ছিলাম রিক্সায় করে।হটাৎ রাস্তায় মাইশির সাথে দেখা।
ও তো আমাদের এক সাথে রিক্সায় দেখেই মুখটা লাল করে ফেললো।বুঝতে বাকি রইলো না কিছুই।মাঝে বেশ কয়েকদিন আমি ভার্সিটিতে যেতে পারি নি।অসুস্থ থাকার জন্য, প্রায় ১৫ দিন ভার্সিটি যেতে পারি নি।সুস্থ হতেই ঈদুল ফিতরের জন্য ভার্সিটি বন্ধ হয়ে যায়।মাইশি কে অনেক দিন দেখি না।খুব মন চাচ্ছে দেখতে, কি করবো বুঝতে পারছি না।খুব খারাপ লাগছিলো নিজের ভিতর।পরের দিন সকালে মাইশির খোজ নিতেই জানতে পারি গ্রামে চলে গেছে।এখন কি আর করার আমিও চলে যাই গ্রামে। সবার সাথে সুন্দর ভাবে ঈদের আনন্দটা ভাগ করে নেই।আসলে পরিবারের সাথে ঈদের মজাটাও আলাদা।কিছু দিন পর আবার ঢাকায় চলে আসি। ভার্সিটি যেতেই বন্ধু বান্ধবীদের সাথে দেখা। সবাই বসে আড্ডা দিচ্ছে।আমার অনুপস্থিতিতে মাইশিও আমাদের গ্রুপে জয়েন করেছে।আমি গিয়ে ওদের সাথে আড্ডা দিতে থাকি আর মাইশ কে দেখতে থাকি তবে লুকিয়ে যাতে মাইশি বুঝতে না পারে।
কিন্তু মাইশির চোখে ধরা পরে গেলাম।কেননা এত দিন পরে মাইশির সাথে দেখা,মাইশি ও যে বার বার তাকাচ্ছিল আমার দিকে।মাইশির চোখে চোখ পড়তেই কেমন একটা অনুভূতি হলো।এ যেন কোন স্বর্গীয় সুখ ভর করেছে।আমরা সবাই মিলে বেশ খানিক গল্প করি। গল্প শেষ হতেই সবাই যার যার বাসায় ফিরে গেল। আমি ফারদিনকে বিদায় দিয়ে একা একা রাস্তা দিয়ে হাটছি আর মনের ভিতরে কথার ঝুড়ি তৈরি করছি।মাইশি কে এটা বলবো, ওটা বলবো আরও কত কি।আমি মেসে পৌছে যাই।ফ্রেস হয়ে রাতের খাবার খেয়ে সুয়ে পড়ি।আব্বুকে ফোন দেই বিষয়টা জানানোর জন্য।আব্বু ফোন ধরেতেই কেমন আছে, এদিক সেদিক জেনে নিলাম। মায়ের সাথে একটু কথা বললাম।
মাও বেশ উৎসাহ দিলো মাইশির ব্যাপারে।আব্বু আমাকে বললো খোকা আগামীকাল তুই মাইশিকে তোর মনের কথা বলে দে। শোন খোকা ৫০ টা গোলাপ দিয়ে একটা তোড়া বানাবি। খুব সুন্দর করে বানিয়ে নিয়ে যাবি যেটা দেখে তোকে ফিরাতে না পারে। আরে শোন তাহলে,আমি তোর মা’কে যেদিন প্রথম দেখি সেদিন ই তোর মায়ের প্রেমে পড়ে যাই।তোর মায়ের বান্ধবী বলেছিলো তোর মা’কে যদি ৫০ টা গোলাপ দিয়ে প্রেম নিবেদন না করি তাহলে আমার প্রেম নিবেদন গ্রহণ করবে না।আসলে তোর মা ও আমাকে বেশ পছন্দ করতো এটা নাকি তোর মা ই বলেছে আমাকে বলার জন্য, সেই জন্য ৫০ টা গোলাপ দিয়েই তোর মা’কে প্রেম নিবেদন করি,তাই আমাকে আর ফিরিয়ে দিতে পারে নি।তুই তো আমারই ছেলে বাপের মত ৫০ টা গোলাপ দিয়ে প্রেম নিবেদন করবি।
আর পাশে থেকে মা বলছে বুড়ো বয়সে বুদ্ধি কি একে বারে গেছে তোমার কি সব বলছো।আব্বু আমাকে আরো অনেক উপদেশ দিলো।আমি আব্বুর উপদেশ গুলো শুনে মনের সাহস আরও বেড়ে গেল। পরের দিন সকালে খুব তাড়াতাড়ি উঠি। ফজরের নামাজ পড়ে নেই।সকাল হতে একটা অন্য রকম অনুভূতি মনের ভিতর।আমি ফারদিন কে ফোন দিয়ে আসতে বলি। আমি আর ফারদিন ফুলের দোকানে গিয়ে ৫০ টা গোলাপ দিয়ে একটা তোড়া বানাতে বললাম ফুলের দোকানিকে।আমরা ফুলের তোড়া নিয়ে ভার্সিটি পৌছে যাই।ক্যাম্পাসে বন্ধু বান্ধবী সবার সাথে দেখা।কিন্তু মাইশি নেই,মাইশর খোজ নিতেই জানতে পারি ও ক্লাসে।আমরা সাবাই ক্লাসে যাই মাইশি কে আজ সবার সামনেই প্রেম নিবেদন করবো মনে মনে স্থির করে নিলাম।
অয়ন স্যারও এসে গেলেন সেই মুহূর্তে আমি মাইশিকে ডেকে সামনে আনি এবং সবার সামনে একটু হিরোদের মত হাটু গেড়ে দিয়ে প্রেম নিবেদন করি। মাইশি এটার জন্য প্রস্তুত ছিলো না।কিছু না ভেবেই গ্রহণ করে নিলো।ফুলের তোড়া নিতেই চোখের কোণে পানি এসে গেল।জড়িয়ে নিলো আমাকে। সবাই হাতে ক্লাব দিচ্ছে এইটাতে আরো বেশি লজ্জা পেল মাইশি।নিজেকে লুকিয়ে নিতে চাইলো আমার বুকের মাঝে। আমি লজ্জা না করে জড়িয়ে নিলাম। সবাই আমাদের অভিনন্দন জানালো।অয়ন স্যার ও অভিনন্দন জানালো। কিন্তু অয়ন স্যারে চোখে পানি দেখে বুঝতে বাকি নেই কিছুই,হয়তো নিলা ম্যাডামের কথা মনে করেই।।
এভাবে কিছু দিন যাবার পর। আমাদের ভার্সিটি জীবন শেষ হয়ে যায়। সবাই কর্ম জীবনে ব্যস্ত হয়ে যায়।আমি ভালো একটা চাকরি পেয়ে যাই।দুই পরিবারে সম্মতিতেই বিয়ের দিন-তারিখ পাকাপোক্ত হয় আমার আর মাইশির। বন্ধু- বান্ধবী,শফিক ভাই, অয়ন স্যারও আমাদের বিয়ের অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।আজ আব্বুর জন্যই মাইশিকে নিজের করে পেয়েছি।আব্বুর উপদেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছি সেজন্য আমার এই প্রাপ্তি।আমরা এখন বেশ সুখে শান্তিতে সংসার করছি।কিছুদিন বাদে আমাদের কলিজার টুকরা আসছে আমাদের ঘর আলো করে। এভাবেই কেটে যাচ্ছে আমাদের জীবন। পরিবারের সবাই কে নিয়ে সুখে-শান্তিতে কাটাচ্ছি সময়গুলো।অতিবাহিত হচ্ছে আমাদের সুখের দিন গুলি।