একটু আগে আমার এক্স গার্লফ্রেন্ড আমাকে ফোন করেছিল। আর এই ব্যাপারটা ইবনাত নিজেই আমাকে বলেছে। যখন ফোন করেছিল আমি তখন ওয়াশরুমে ছিলাম। দু মাস হলো ইবনাতকে আমি বিয়ে করেছি। সে যখন আমাকে ফোন করার ব্যাপারটা বলেছিল আমি কোন প্রত্যুত্তর দেইনি। ও তখন শাড়ির আচলের কোনা আঙ্গুলের মাঝে প্যাচাতে প্যাচাতে খাটের দক্ষিন দিকে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে ছিল। আমি বেশ খানিক পর ইতস্তত হয়ে বললাম “তোমার তো এখন মন খারাপ হওয়ার কথা। এই বিষয়টা নিয়ে আমার সাথে তোমার ঝগড়া করা উচিৎ। কি উচিৎ না? ঝগড়া করতে পারো?” সে এই কথার ঠিকঠাক উত্তর না দিয়ে বললো “উনি খুব সুন্দর ছিলেন তাই না? উনি মনে হয় আপনাকে মিস করছে।” এই প্রশ্নের উত্তর আমার কাছে নেই। আসলে ওকে আমি সুন্দর বলবো না। পৃথিবীর মধ্যে আল্লাহর সৃষ্টি করা সব কিছুই সুন্দর। তবে ওকে আমি অন্য কিছু ভাবতাম। ভাবতাম ও একটা কদম ফুল। আমার পছন্দের ফুলের মাঝে হলো কদম। মাঝে মাঝে ওকে আমি কদম বলেও ডাকতাম। ও তখন হাসতো শুধু হাসতো। যখন হাসি দিত আমার শহর জুড়ে একটা আলোড়ন বয়ে যেত। সে আলো দিয়ে আমি রাতের আকাশকে স্পষ্ট ভাবে দেখতে পারতাম। মাঝে মাঝে ওর চোখ দুটোর মাঝে আমি হারিয়ে যেতাম। আমার এক্স গার্লফ্রেন্ড বা প্রাক্তনের নাম ছিল আরিয়া। বিয়ের আগে ইবনাতকে আমার ব্যাপারে সব কিছু বলা হয়েছে এই যে আমি বেকার ছেলে। কিছুই করি না। যদিও আমার বাবার ব্যবসা আছে। এসব ব্যবসা আর চাকরির প্রতি আমার কোন ইন্টারেস্ট নেই। ঘুরি আর খাই। তবে এই যে আমি এভাবে চলাফেরা করি এটাকে জীবন বলে না। এটাকে জাস্ট ফাজলামো বলে। এসব শোনার পরও যদি আপনি আমার গলায় ঝুলে পড়তে চান তাহলে আমার কিছু করার নেই। ঝুলে পড়ে হাত পা ভাঙ্গলে আপনাকে একাই ডাক্তারের কছে যেতে হবে। বুঝতে পেরেছেন?” সে তখন মাথা নিচু করে শুধু বলেছিল “আচ্ছা। আর কিছু বলবেন?” এতো স্বাভাবিক ভাবে উত্তর শোনার পর সত্যি বলতে কি আমার আর কিছু বলা হয়নি। এটাও বলা হয়নি আমার একজন ভালোবাসার মানুষ ছিল। আসলে আমি বলতে চাইনি। প্রত্যেকটা দিন শুরু হওয়ার আগে যার সাথে কথা বলে শুরু হতো, যে কথায় মনে হতো সারাটা দিন আমার ভালো কাটবে। সে ভালো লাগাটা যখন আমার মাঝ থেকে হারিয়ে গেলো তখন আমার একবারো মনে হয়নি ইবনাতকে এই ভালো লাগার কথাটা জানানো দরকার। তবে বিয়ের ঠিক চারদিনের মাথায় আমাকে এমন একটা কথা জিজ্ঞেস করলো যেটার জন্য আমি প্রশ্তুত ছিলাম না। আমাকে বললো ”আরিয়া আপনার অনেক পছন্দের নাম তাই না?” আমি বেশ ঘাবড়ে গিয়েছিলাম ওর মুখে এই নামটা শুনে। আমি বললাম “কেন বলো তো? আর এই নামটাই বা তুমি আমাকে কেন আস্ক করলে? ” সে বললো “তেমন কিছু না। রুম গোছানোর সময় বেশ পুরানো একটা খাতা পেয়েছি। সেখানে বড় বড় অক্ষরে অনেক বার লেখা আছে “আরিয়া, আরিয়া, আরিয়া তুমি কই গেলা হারিয়া।” আমি কি প্রশ্নটা করে ভুল করেছি?” আমি মাথা নেড়ে না সুচক ইশারা দিয়ে সেদিনই আরিয়ার ব্যাপারে বলি। যখন আরিয়ার ব্যাপারে বললাম ঠিক তখনো ওর মুখটা স্বাভাবিক ভাবে দেখেছিলাম। আমাকে একটা বারও জিজ্ঞেস করেনি এই যে আপনি আমাকে বিয়ের আগে এই ব্যাপারটা বলেন নি কেন? আপনি খুব খারাপ কাজ করেছেন।”
ইবনাত আমার চুপ থাকা দেখে আবার বললো “উত্তর দিলেন না যে? উনি কি খুব সুন্দর ছিল?” আমি এই কথার প্রত্যুত্তর না দিয়ে বললাম “সুন্দরে কি আসে যায়? তোমার তো এখন প্রশ্ন করা উচিৎ বিয়ের পরও আপনার এক্স গার্লফ্রেন্ড আপনাকে ফোন করে কেন? আর এসব প্রশ্ন না করে তুমি কিসব সুন্দর নিয়ে কথা বলছো। এসব আর বলবে না ঠিকাছে? ঠিকঠাক প্রশ্ন করো। ঝগড়া করতে শিখো। বাঙ্গালি মেয়েদের এই একটা অভ্যাস থাকা জরুরি। যে মেয়ে স্বামীর সাথে ঝগড়া করতে পারে তাকে খাঁটি বাঙ্গালি মেয়ে বলে।” আমার কথা শুনে সে আমার দিকে তাকিয়ে বলে “আপনাকে এসব উদ্ভট কথা কে বলেছে?” আমি আর কিছু বলি না। বলতে ইচ্ছে করে না। নিজের মাঝেও কেমন জানি লাগে।আমি ভাবি আমার মত হারামজাদাটাকে ও বিয়ে করলো কেন? প্রায় ভাবি ওকে এই কথাটা জিজ্ঞেস করবো কিন্তু কখনো জিজ্ঞেস করা হয়নি। আচ্ছা একদিন সময় করে জিজ্ঞেস করবো।
রাত হলেই শহরটা অদ্ভুত রুপে সাজে। রাস্তার দুপাশে কমলা হলুদ রং এর বাতি মাথার উপর জ্বলতে থাকে।চারপাশ কেমন যেন নিশ্চুপ হয়ে যায়। মাঝে মাঝে আমার মনে হয় মানুষ গুলোও এমন করে একটা সময় নিরব হয়ে যায়। রাতের অন্ধকারে তারা হারিয়ে যায়।চোখ মেললেও এই কমলা হলুদ রং এর চলন্ত জীবনের মাঝে খুজে পাওয়া যায় না। আমি আমার জীবনকে নিয়ে ভাবি। এই শহরে রাতের বেলা কমলা হলুদ রং এর আলো দেখা গেলেও আমার জীবনে এখন কমলা হলুদ রং এর আলো নেই। একটুও নেই। আমার যখন সাত বছর ঠিক তখন আমার বাবা আর মায়ের ডিভোর্স হয়। আমি জানতাম না এই ডিভোর্স জিনিসটা কি? এটা কি কোন খাওয়ার জিনিস? ঐটুকু বয়সে আমার বুঝার উপায় ছিল না। ডিভোর্স হওয়ার পর মা আমাকে তার সাথে করে নিয়ে যায়। যখন দিন গুলো অতিক্রম হতে লাগলো আমার মনে হতো আমার জীবন থেকে কিছু একটা হারিয়ে যাচ্ছে। মাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম “আমরা নিজেদের বাসায় কখন যাবো আম্মু?” মা কিছু বলতো না এই ব্যাপারে। শুধু আমাকে বুঝাতো “জীবনে বাঁচতে হলে বা বেঁচে থাকার জন্য একা একা লড়াই করা শিখো বাবা। একটা সময় তোমারটা তোমাকে নিয়ে ভাবতে হবে। তোমাকে কেউ তখন নিজের হাতে খাইয়ে দিবে না। দেখিয়ে দিবে না এই পথে যাও ও পথে যেও না। নিজের যুদ্ধটা নিজে করতে হবে। কারো উপর ভরসা করতে নেই। কারো উপর ভরসা করার চেয়ে তুমি নিজেই করতে পারো কিনা চেষ্টা করবে। বার বার করবে।” আমি কিছুই বুঝতাম না মা কেন আমাকে এমন করে বুঝাতো। কথা গুলো আমার এই কান দিয়ে ঢূকে ঐ কান দিয়ে বের হয়ে আকাশে উড়ে যেত। কিন্তু আকাশে কথা উড়ানো আমার ভালো লাগতো না। আমার ভালো লাগতো আকাশে যখন ঘুরি উড়তো কিংবা সাত রঙ্গা রঙ ধনু তার জাদুকরি স্নিগ্ধতা মেলে ধরে তার ছায়ায় আবদ্ধ করতো তখন। এর কয়েকদিন পরই বাবা আমাকে নিয়ে আসে তার কাছে। যদিও এই ব্যাপারটা মা প্রথমে বুঝতে পারতো না। চুপি চুপি শুধু আমার সাথে দেখা করে আমাকে বাবা নিয়ে যেত।পরে মা আবার আমাকে তার কাছে নিয়ে যেত। আর এই বিষয়টা আমার সিলেবাসে জায়গা করে নিতে লাগলো। একবার এখানে আর একবার ওখানে। যদিও বাবা একদিন এর বেশি তার কাছে আমাকে রাখতে পারেনি। দেখা গেছে উনার ব্যবসার কারনে উনি নিজেই আমাকে মায়ের কাছে দিয়ে যেত। এই সিলেবাসের পড়া পড়তে পড়তে আমি শিখে গিয়েছিলাম বা বুঝে গিয়েছিলাম ডিভোর্স কোন খাওয়ার জিনিস না। প্রায় আমি কেঁদে কেঁদে বলতাম “আমরা আবার একসাথে থাকি আম্মু? আব্বু কি তোমাকে বকেছে? আমি বাবাকে বলে দিব আর যেন তোমাকে না বকে? আমরা আবার একসাথে থাকি?” আমার মা শুধু আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতো। আমি চুপ করে মায়ের চোখে পানি মুছে দিতাম। চোখের পানি মুছতে পারলেও তাদের মাঝে যে দেয়ালটা তৈরি হয়েছিল সেটা আমি মুছতে বা ভাঙতে পারিনি। এভাবেই আমি বড় হয়েছি। ডিভোর্স হওয়ার মাস খানেক আগে তাদের মধ্যে আমি অনেক ঝগড়া হতে দেখেছিলাম। পর্দার আড়ালে চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিলাম। ওরা দুজনেই আমাকে দেখতে পেয়ে চুপ হয়ে গিয়েছিল। আমি আস্তে আস্তে হেটে বাবার কাছে গিয়ে বলেছিলাম “আম্মুকে বকো কেন?” বাবা কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলেছিল “বকিনি তো। কথা বলছিলাম।তুমি ঘুমাও নি কেন বাবা?” আম্মু কাঁদতে কাঁদতে ভিতরের রুমে চলে গিয়েছিল। আমার মা ছিল স্কুল টিচার। অবশ্য এখন আর শিক্ষকতা করে না। আর আমার বাবা একজন ব্যবসায়ী।মুলত আমার বাবা সারাদিন ব্যবসার জন্য বাহিরে বাহিরে থাকতো। তাদের মাঝে দুরত্বের বিষয়টা নিয়েই এই ডিভোর্স। আচ্ছা তারা কি আমার কথা একবারো চিন্তা করেছিল তখন? পরে অবশ্য আমি নিজের মত করে চলতে শিখেছি। মায়ের কাছেই থেকে গিয়েছি।
এসব ভাবতে ভাবতে আমি রাস্তার ফুটপাথ ধরে হাটতে থাকি। আর আমার পিছনে হাটতে থাকে মিরাজ। মিরাজ আমাকে বলতে লাগলো “ভাই বিয়ে সাধি তো করলেন, এমন কইরাই জীবন কাটাইবেন?” আমি হাটা বন্ধ করে ওর দিকে তাকিয়ে ইশারা করে বুঝাই কাছে আয়। সে কাছে আসতেই তার কাধে হাত রেখে হাটতে হাটতে বললাম “জীবনে কয়টা রং থাকে জানোস?” সে একটু ভেবে বললো “বহুত হিসেব নেই।তয় আমার লাল রং পছ্ন্দ।” আমি ওর গালে আস্তে করে থাপ্পড় মেরে বলি “হারামজাদা তোর লাল রঙ কেন পছ্ন্দ সেইটা আমি জানি।তোমার গার্লফ্রেন্ড কি যেন নাম তাশফিয়া না? তারও লাল রঙ পছ্ন্দ ঠিক? মিল তাই না মিল, সব মিলে যায়। শুইনা রাখ জীবনের রং হলো দুইটা। একটা সাদা, আর একটা কালো। এই দুইটার মাঝেই আমাদের চলাফেরা। এই দুইটার মাঝে আমরা গুলিয়ে ফেলি। মনে করি জীবনের বহুত রং। আসলেই কিছু না। এই শহরটা কিছুক্ষন পর ঘুমাই যাবে। শুধু আকাশের চাঁদটা জেগে থাকবে। আর কারা জেগে থাকবে জানোস? আমার মত মানুষেরা।তারা আকাশের চাঁদের সাথে ভাব জমাবে। তারপর রুমে গিয়ে বালিশ ভিজাবে। অবশ্য বালিশ ভিজায় মেয়েরা। ছেলেরা বালিশ ভিজায় না। ওরা মুখ দিয়ে সিগারেটের ধোয়া দিয়ে সাদা মেঘ তৈরি করে আকাশে ছেড়ে দেয়। এটার মাঝে একটা আলাদা অনুভূতি আছে বুঝবি না তুই।”
তিনটা দিন পার হয়ে যাওয়ার পর আমি একবারো ব্যাক করিনি কেন আরিয়া আমাকে ফোন করেছে।ওর সাথে আমার কোন যোগাযোগ নেই।ওর নাম্বারটা এখনো আমার ফোনে রয়ে গেছে। যেটা আরও অনেক আগে মুছে ফেলার উচিৎ ছিল আমার কিংবা আমার এই সিমটাই বদলানো দরকার ছিল। নিজের গালেই একটা চড় লাগাতে ইচ্ছা করছে। আমি চেয়ারে হেলান দিয়ে পিসিতে লিখতে থাকি…
এই অদৃশ্য পথ চলায় পৃথিবীর জনপদের ভীড়ে
নীল সাগড় পাড়ে তোমায় নিমন্ত্রণ
আজ এতো বছর পর মিছে শুধু কেন মনে পড়ে…?
আমি ভাবি মানুষ গুলো এমন কেন? চিনা যায় না, বুঝা যায় না। তাদের চেহারায় একটা মুখোশ লুকিয়ে থাকে। অন্তরালে যে মানুষটাকে নিয়ে ভাবি একরকম সে মানুষটা তেমন না ও হতে পারে। একটা ভুল ছায়াকে ঘিরে মানুষকে চেনা যায় না। এসব ভাবতে আর লিখতে লিখতে হঠাৎ ইবনাত কাছে এসে বললো “আপনি এতো রাত জেগে জেগে কি লিখেন? কবিতা? খাবেন কখন? আর ঘুমাবেনই বা কখন? এই অভ্যাসটা ছাড়া যায় না।?” আমি ওর কথার উত্তর না দিয়ে বললাম “তুমি খেয়েছো?” সে মাথা নেড়ে না সূচক ইশারা দিয়ে বুঝায় “না।” তারপর বললো “আপনার কবিতা আমি অনেক পড়েছি। কবিতা লিখা ভালো।জানেন আপনার সাথে বিয়ে হওয়ার আগেও আপনার কবিতা পড়েছি। আপনার মা আমাকে দিত।আচ্ছা সব কবিতা ছ্যাকা টাইপের কেন?” আমি কিছু বললাম না। ও নিশ্চয় বুঝতে পেরেছে এ ব্যাপারে আমি আর কথা বলতে চাই না। কিন্তু আম্মা ইবনাতকে কেন আমার কবিতা দিত? এটা অবশ্য আমি পরে জেনেছি ইবনাত, আমার মায়ের একসময় ছাত্রী ছিল।আমার চুপ থাকা দেখে সে বললো “আচ্ছা খেতে চলেন।” আমি বললাম “তুমি খেয়ে শুয়ে পড়ো।” ও চুপ করে আমার সামনে কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে থেকে হঠাৎ একটু জোড়ে শব্দ করেই বললো “কথা কানে যায় না? মগের মুল্লুক পেয়েছেন নাকি? আপনি জীবনটাকে যেমন ভাবেন জীবনটা আসলে এমন না। আপনার জীবনটা শুধু মাত্র আপনার একার না। আপনার জীবনটা বিয়ের পর থেকে আমারও হয়ে গেছে। আমার জীবন এমন না খেয়ে থাকবে। এমন করে চলবে তা তো আমি হতে দিব না। উঠেন বলছি।” আমি বেশ অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে থাকলাম। কি বলছে ও? যে মেয়ে জ্বি, আচ্ছা, হ্যাঁ, ঠিকাছে, এই টাইপের কথা বলে এসেছে সে মেয়েই কি করে আমাকে এমন কঠিন করে কথা বলতে পারে? হঠাৎ ওর কি হলো?” আমি আস্তে আস্তেই বললাম “কি বলেছো আবার বলবে?” সে নিচের দিকে তাকিয়ে থেকে ইতস্তত হয়ে বললো “আপনি তো প্রায় বলেন আমি ঝগড়া করতে পারি কিনা। আপনাকে যেন কথায় চেপে ধরি।তাই আমি শিখছি একটু একটু। আমার এই রকম কথায় চেপে ধরা বা রেগে গিয়ে কথা বলা এটা কি যথাযথ ভাবে হচ্ছে? না হলে একটু বলে দিবেন যেখানে ভুল হবে কেমন? আমি ঠিক করে নিব।” এর প্রত্যুত্তর কি দিব আমার জানা নেই। আমি শুধু নিরব চোখে তাকিয়ে থেকে খেতে চলে গেলাম। আর যাওয়ার সময় বেশ বুঝতে পেরেছি ও মনে মনে হাসছে।
হাসপাতালে যখন পৌছালাম আমার বন্ধু আদনান আমাকে দেখে হাত ধরে কেঁদে বললো “শোভন, আমাদের বন্ধুটার এমন কেন হলো? আমি এটা মানতে পারছি না।” আমি স্থির হয়ে কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে থাকলাম। বুকটা কেমন যেন ধড়ফড় করছে।ওর অফিসের কয়েকজনকে দেখলাম। আমার বান্ধবী নাদিয়া একজন রিপোর্টার। ও একটু সাহসী টাইপের মেয়ে।ভার্সিটি জীবনে ও যা কিছু বলতো সোজা সাপ্টা বলে ফেলতো। এমনকি এখনো বলে। ও মাঝে মাঝে আমায় বলতো জানিস দোস্ত এই শহরটার জন্য আমার মায়া হয়।এই শহরটার চারপাশে যখন তাকাই তখন বুকের গভীরে নদীর স্রোতের মত কিছু একটা বয়ে যায়।শহরটা অনেক আগে পচে গেছেরে। আমরা শুধু মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করছি। ভয়ানক মৃত্যু। ও দেশ নিয়ে ভাবতো। দেশের মানুষের জন্য ভাবতো।আমি আদনানকে বললাম “কিচ্ছু হবে না আমার বন্ধুটার।
ভিতরে গিয়ে নাদিয়াকে যখন দেখলাম আমার ভিতরটা কেমন যেন মোচড় দিয়ে উঠলো। ওর মাকে দেখলাম ওর পাশে বসে বসে নিরবে চোখের পানি ঝড়াচ্ছে। ঘটনাটা ঘটেছে গতকাল রাতে।গতকাল রাতে সে অফিস থেকে ফিরার পথে তাকে ট্রাক দিয়ে ধাক্কা দেয়। ও যে বেঁচে আছে সেটাই তো অনেক। আমার এখানে আসতে অনেকটা লেইট হয়ে গিয়েছে। ও আমাকে দেখে মুখটা অন্যদিকে করে কাঁদতে লাগলো। ওর অবস্থা তেমন একটা ভালো না। আমার কি বলা উচিৎ আমি বুঝতে পারলাম না। ভার্সিটিতে পড়ার সময় আরিয়া যে আমার সাথে এমন কিছু একটা করবে আমি একদমই বিশ্বাস করতাম না। নাদিয়া আমাকে প্রায় বলতো “তুই আসলে একটা গাধা। আরিয়া যে তোরে একদিন ছ্যাকা দিবে এটা কি তুই বুঝোস না? তুই এমন কেনরে শোভন? তোর জন্য অনেক মায়া হয়রে। যখন একটা বিশাল ছ্যাকা খাবি তখন তোর এই মুখটা কেমন দেখাবে আল্লাহ জানে। আচ্ছা ছ্যাকা খাওয়ার পর আমার সাথে দেখা করিস। তোর জন্য আমার দরজা সব সময় খোলা। তখন আরিয়াকে দেখিয়ে দেখিয়ে দুজন প্রেম করবো ঠিকাছে?” মূলত আমিই আরিয়াকে পছন্দ করতাম। কিন্তু আরিয়া পছন্দ করতো ইংরেজি ডিপার্টমেন্টের ফারাবী ভাইকে। উনি আমাদের সিনিয়র ছিলেন। আমি প্রায় উনার সাথে আমাকে তুলনা করতাম আর প্রতিবারই ব্যার্থ হতাম এই যে উনার সাথে আমার যায় না। উনি একটা অন্য লেভেলের মানুষ। উনাকে অপছ্ন্দ করার মত কিছু নেই। আমি যেমনটা আরিয়ার কাছ থেকে অবহেলা পেয়ে ভিতরে ভিতরে জ্বলতাম ঠিক তেমনি আরিয়াও জ্বলতো ফারাবীর ভাই এর অবহেলায়। একটা সময় আরিয়ার সাথে ঠিকি আমার সম্পর্কটা হয়। কিন্তু এই সম্পর্কটা চার মাসের মত ঠিকেছিল। সে আমাকে জানিয়েছিল ফারাবী ভাই তার জীবনে আসতে চায়। আমাকে ইতস্তত করে বলেছিল “আমি উনার হাতটা ধরলে তুমি কি কষ্ট পাবে? বিশ্বাস করো আমার সব কিছুতে উনাকে অনুভব করি। এই আমি উনাকে ভুলে গিয়ে তোমাকে ভালোবাসতে চেয়েছি কিন্তু ঠিক ততবার আমি ব্যার্থ হয়েছি। একটা সময় মনে হয়েছিল ঠিকি তোমায় ভালোবাসতে পারবো। কিন্তু আমি পারিনি। বিশ্বাস করো পারিনি। ভালোবাসাটা এমন কেন? আমি কি করবো?” আমি একটা কথাও বলিনি। আমি বুঝে গিয়েছিলাম এই ভালোবাসাটা আমার না। আমার হতে পারে না। আমি নিজেই যন্ত্রণার মাঝে একা একা কাঁদতাম। আরিয়াকে কখনো এই ব্যাপারে আমি দোষ দেইনি। দোষ দেওয়াটা যায় না। ভালোবাসা মন থেকে আসে। মনের ভিতর যে ভালোবাসা তৈরি হয় তাকেই ভালোবাসা উচিৎ। তাকেই আগলে রাখা উচিৎ। তার কাছেই যাওয়া উচিৎ। আমার যখনি মন খারাপ থাকতো, বা কোন কিছু নিয়ে চিন্তা হতো, হতাশায় থাকতাম আমার এই বন্ধু নাদিয়াই আমায় সাহস দিত। আমার পাশে থাকতো। মাঝে মাঝে মজা করে বলতো “মাইয়া মাইনষের মত এতো কাঁদস ক্যান? কাঁদেনা আমার বাবুটা। চল রহিম চাচার হোটেল থেকে গরম গরম সিঙ্গারা খাওয়াবো।” আর এখন আমার সব চাইতে ভালো এই বন্ধুটাকেই আমি কি বলবো? আমি ওর কাছে গিয়ে বসে বললাম “এমনটা তো হওয়ার কথা ছিল না তাইনারে?” ও আমার দিকে বেশ খানিকক্ষন তাকিয়ে থেকে কাঁদতে কাঁদতে হেসে দিয়ে আস্তে আস্তে বললো “জীবনটা অনেক কঠিন। আমরা নারীরা হচ্ছি তোদের মত পুরুষের মধ্যে কিছু কিছু বহুরুপি জানোয়ার আছে না তাদের কাছে একটা পন্য। জানিস এই পরিস্থিতির জন্য আমার একটুও কষ্ট হচ্ছে না। কষ্ট হচ্ছে মেয়েটার জন্য। মেয়েটার জন্য আমি কিছু করতে পারলাম নারে। কিছু করার আগেই ওরা আমাকে এমন করে দিল। প্রচন্ড জোড়ে ওরা আমার স্কুটিতে ধাক্কা দিয়েছে।” এটা বলেই ও একটু থামলো। আমি বুঝতে পারছি ওর কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু তারপরও আর একটু সময় নিয়ে আবার বললো “আমি তো চেয়েছি মেয়েটা যেন একটা ন্যায় বিচার পাক। ওর উপর যে মিথ্যা কথা রটিয়ে দিয়েছে তার সত্যটা যেন সামনে আসে। মেয়েটার উপর অনেক অত্যাচার হয়েছিল।ওরা অনেক গরীব তো ভয় পেয়েছিল। একে তো মেয়েটার উপর অত্যাচার করেছিল পরে যখন বিষয়টা জানাজানি হয়ে গেলো তখন একটা মিথ্যা কাহিনী দিয়ে ছড়িয়ে দিল। আফিয়ার সাথে শেষ কথা হয়েছিল আমার। মেয়েটা আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলেছিল “ওরা আমাকে খুব মারছে আপু। অনেক কষ্ট আপু অনেক।” আমি তার চোখের কান্নার জল গুলোকে অনুভব করতে পেরেছিলাম। যেদিন আফিয়ার সাথে আমার শেষ কথা হয় তারপরের দিনই মেয়েটাকে আর পাওয়া যায়নি।ওরা এটা নিয়ে কি বলেছে জানিস? বলেছে আফিয়া অবাধে চলাফেরা করতো। এই নষ্টা মেয়ের ঘটনা যখন সবাই যখন জেনে গেছে অন্য ছেলের সাথে পালিয়ে গেছে। কিন্তু বিশ্বাস কর আমি বুঝতে পেরেছি ওরা মেয়েটাকে মেরে ফেলেছে। সত্যি মেরে ফেলেছে।” ও কি করে এতো কষ্ট সহ্য করে এতো কথা বলতে পারছে? আমি ঠিকি বুঝতে পারছি ওর ভিতরে এখনো একটা আগুন জ্বলছে। আমি কিছুদিন আগে নাদিয়ার একটা আর্টিকেল পড়েছিলাম। ও খুব ভালো লেখে। ওর লেখার মাঝে একটা বিদ্রোহী ভাব আছে। পনেরো বছরের একটা মেয়ে আফিয়াকে নিয়ে রিপোর্ট করেছিল। মেয়েটা ধর্ষিত হয়েছিল তারই স্কুলের সভাপতির কাছে। বিষয়টা ধামাচাপা পড়ে গেলেও কেমন করে যেন এটা চারপাশে ছড়িয়ে যায়। তারপর থেকেই নাদিয়া এই বিষয়টা নিয়ে লিখতে শুরু করে। কিন্তু এটা নিয়ে যে এতোদুর পর্যন্ত একটা কান্ড ঘটে যাবে কে জানতো। নাদিয়া আমাকে বললো “আব্বু নেই ভালো হয়েছে। আমার ভালো বাবাটা কখনো আমার গায়ে হাত তুলেনি। মা যখন শাষন করতো আমি বাবার কাছে চলে যেতাম। আজকে যদি বাবা বেঁচে থাকতো আর আমার এই অবস্থা যখন আমার ভালো বাবাটা দেখতো তখন কি ঠিক থাকতে পারতো? ও মা, বাবা কি ঠিক থাকতে পারতো বলো না?” ওর কথা শুনে আমার চোখ দুটো কেমন যেন করতে লাগলো। আমি চুপ করে থাকলাম। ওর মা একটা জোড়ে কান্নার শব্দ করলো। কাঁদতে কাঁদতেই বললো “একটু চুপ থাক না মা। আল্লাগো আমার কলিজাটার সাথে এমন কেন হলো?” আমি আর একটুও থাকতে পারছিলাম না।
বের হয়ে ওর অফিসের লোকজনের সামনে এসে বললাম “আপনারা কি চুপ করে বসে থাকবেন ভাই? কিছু করবেন না?” ওরা আমাকে স্ট্রেট জানিয়ে দিল “আমাদের কি করার আছে? পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা লিখতে পারবো কিন্তু কিছু কি হবে? হবে না।দুদিন তিন দিন এটা নিয়ে কার্য্যক্রম চলবে কিন্তু এরপর? এই দেশ এখন তাদের হাতে, জোর যার মূল্লুক তার। কিছু করতে পেরেছে নাদিয়া? আমরা বলেছিলামও বিষয়টা নিয়ে চুপ হয়ে যেতে। মেয়েটা উধাও হয়ে গেছে। কয়েকদিন পর এই ইস্যুটা এমনিতেই হারিয়ে যেত। ও তো শুনলো না। আর এখন দেখেন এই অবস্থা। তাছাড়া সেই লোকটাই যে গাড়ি চাপা দিয়েছে তার কোন প্রমান নেই ভাই।” আমার মেজাজটা খুব খারাপ হয়ে গেলো ওদের কথা শুনে। কেমন কলিগ ওর। আমি রেগে গিয়ে বললাম “ভাইজান আমার এখন কি করতে ইচ্ছে করতেছে জানেন? আপনাদের পাছায় দুইটা লাথি দিয়ে তাড়ায় দিতে। আজ আপনার পরিবারের কারো সাথে এমন কিছু হোক তখন আপনি আপনারাই এর প্রতিবাদ জানাতেন। কি জানাতেন না? একটা সুষ্ঠু বিচারের আশা করতেন। তখন মনে করেন আমি যদি বা আমার মত লোকজন সবাই যদি বলতো চুপ যা ভাই হুদাই চিল্লাচিল্লি করতেছিস। কিচ্ছু লাভ হইবো না। আপনার কেমন লাগতো? আপনাদের মত মানুষেরা সংখ্যাটা এই দেশটাতে ছড়িয়ে গেছে। সবাই নিজ নিজ জীবন নিয়ে ব্যস্ত। আল্লাহর ওয়াস্তে আপনারা বিধায় হন।
চোখ দুটো যখন মেললাম তখন আমার পায়ে ব্যাথা অনুভব করতে লাগলাম। আমার কষ্ট হয়। বুকের ভিতর যখন কষ্ট নামক জিনিসটা চেপে ধরে তখন ভাবি বেঁচে থাকার অর্থ কি? তবু আমরা বেঁচে থাকি। বাঁচতে হয়। প্রতিদিন এই শহরের সকালের সাদা রোদের সাথে দেখা হয়। কিন্তু এই সাদা রোদের মাঝেও অনেক মানুষের চেহারায় একটা মুখোশ লুকায়িত থাকে। কালো মুখোশ। যার ভিতরটা চেনা যায় না। শুধু বাহিরের রুপটা দেখা যায়। আমি দীর্ঘশ্বাস নিয়ে সামনের বসা লোকটাকে ইতস্তত করে বললাম “আপনারা আমাকে বেধেছেন কেন? কেন ধরে এনে আমাকে কিছু বলতে না দিয়ে এমন করে মারলেন? ” আমার ডান পাশের কালো মোটা করে লোকটা একটা হাসি দিল। তার নাম আজগর যা আমি এখানে এসে বুঝতে পারলাম যখন অন্য কেউ তার নাম ধরে ডাক দিয়েছিল। সে বললো “ধইরা আনবো না তো তোরে কি আদর করবো হারামজাদা। মামলা চু*ইতে গেছিলা? মরনের সখ হইছে না? তোর বান্ধবীরেও বহুত বুঝাইছিলাম। হারামজাদী তো শুনে নাই।” আমার মুখ দিয়ে আর একটা কথাও বের হয়নি। শুধু চুপ করে তাকিয়ে থাকলাম। গতকাল আমি আর আদনান থানায় গিয়েছিলাম। ওসি হারুন উর রশিদ মামলাটা নিতে চায়নি। যখন উনাকে বললাম “আপনি কেন মামলাটা নিতে চাচ্ছেন না। এতে কি বুঝা যায় না আমার বন্ধুটার সাথে যা কিছু হয়েছে তার জন্য ওরাই দায়ি?” উনি পেপার ওয়েট টা ঘুরাতে ঘুরাতে বললো “দেখুন এটা জাস্ট একটা দুর্ঘটনা। ওরাই যে আপানার বান্ধবীর এই অবস্থা করেছে কি করে আপনি এতো নিশ্চিত ভাবে বলতে পারেন? যার নামে মামলা করতে বলছেন আপনি তাকে চিনেন? উনি একজন সম্মানিত লোক। শুধু শুধু আপনাদের সময় নষ্ট করছেন আর আমাদেরও সময় নষ্ট করছেন। যান তো ভাই।” আমার মাথাটা ঝিমঝিম করতে লাগলো। আমি কিছু বলার আগেই আদনান আমার পাশ থেকে উঠে একটু জোড়েই বললো “উনার টাকা পয়সা আছে বলেই উনি মানুষ আমরা মানুষ না? কিভাবে এমন হলো সব কিছুর তদন্ত করা আপনাদের দায়িত্ব। কত টাকার দালালি করতেছেন?” ওসি হারুন উর রশিদ বেশ কিছুক্ষন আমাদের দিকে তাকিয়ে থাকলেন। তারপর বললেন “আমি বুঝতে পারছি আপনাদের অবস্থাটা। মামলা অবশ্যই নিতে পারি কিন্তু কিচ্ছু হবে না। বিশ্বাস করেন। আমি এই চেয়ারটায় বসি তো আমি জানি। আপনারা যে এখানে আসছেন দেখেন এই খবর ওদের কাছে পৌছে গেছে। ওদের লোকজন দেয়ালের চারপাশে ঘুরে বেড়ায়। ঠিকাছে কনস্টেবল আজহার এর কাছে মামলা দায়ের করেন। তবে একবার ভেবে দেখেন।” আমি কিছু বলিনি। চুপ করেই থেকেছিলাম। আদনান স্পষ্ট ভাবেই জানিয়ে দিয়েছিল ভাবাভাবির কাজ নেই। আমি ওর কথায় কোন প্রত্যুত্তর দেই নি। বেশ কিছুক্ষন ভেবে মামলা না করে আদনানকে নিয়ে বের হয়ে গিয়েছিলাম। যখন বের হয়ে গিয়েছিলাম তখন আদনান আমার দিকে অবাক তাকিয়েছিল। আমি দুইটা কাশি দেই। আজগর আমাকে আবার বললো “শুনলাম ঘরে তোর একটা বউ আছে অনেক সুন্দরী এটার জন্য মায়া হয় না? জানের যদি মায়া থাকে তাইলে ভালো ভালো কইতাছি নিজেও ভালো থাক আমাদেরকেও আমাদের মত থাকতে দে। এসব মামলা টামলার ধারে কাছেও যাইস না। আর তোর বন্ধুরেও সাবধান কইরা দিস।” আমি কিচ্ছু বলতে পারি না ওদের। বলার এই শক্তিটা এই মুহুর্তে আছে আমার? আমি শুধু চুপ করে হ্যাঁ সম্মতি দিলাম আর নিজেকে অসহায় ভেবে শান্তনা দিতে লাগলাম।
তার দুদিন পরই আমি নাদিয়ার সাথে আবার দেখা করতে গেলাম। আমি ভাবি ওর বাবা ওকে কতটা ভালোবাসতো। বাবার এই প্রিয় মেয়েটার আজ এই অবস্থা। সত্যি কি ওর বাবা ঠিক থাকতে পারতো? গতকালকেই যখন বাসায় গেলাম মা আমার অবস্থা দেখে কান্না করে দিয়েছিল। আমি নিজেকে স্বাভাবিক রেখে বলেছিলাম “কিছু হয়নি।” মা আমাকে বললো “লুকাচ্ছো কেন? আমি মা, আমার চোখকে লুকানো যায় না বুঝো না? কে করেছে এমন তোমার? কে করেছে?” আমি আর কিছু বলিনি। পরে ইবনাত থেকে শুনেছিলাম বাবা এসেছিলেন আমার সাথে দেখা করতে। অবশ্য বাবা আমাকে একটা টেক্সট করেছে যাতে লিখা ছিল “তোমাদের অনেক মিস করছি।” এই একটা লাইনেই আমি সব কিছু বুঝতে পেরেছি উনি ভালো নেই। এটাও বুঝতে পেরেছি ব্যবসা ব্যবসা করে উনি আমাদের হারিয়েছেন। কাছে থেকেও আমরা উনার কাছ থেকে দুরে। যদিও বাবার সাথে মাঝে মাঝে আমার কথা হয় দেখা হয় কিন্তু ছোট বেলায় যে ভালোবাসাটা অনুভব করা যেত সে ভালোবাসাটা আমি খুঁজে পাই না।
আমি নাদিয়ার পাশে গিয়ে বসেই বললাম “আমি তোর জন্য কিছু করতে পারিনি আমার খুব লজ্জা লাগছে। তুই ঠিকি বলতি শহরটা নষ্ট হয়ে গেছে অনেক আগেই। শহরটা এখন কিছু কিছু মানুষের হাতে। তারা যেভাবে চালায় শহরটা সেভাবেই চলে।” সে আমার দিকে চুপ করে তাকিয়ে থাকলো। আমি তার চোখে পানি দেখি। আমাকে আস্তে আস্তে বললো “শহরটা না, শহরের পোকামাকড় গুলোই নষ্ট।” আমি আর কিছু বলি না। বলতে ইচ্ছে করে না।
ঠিক একবছর পর আমি রাতের জোৎস্না আলোয় ছাদের মাঝখানটায় বসে একা চাঁদটাকে দেখতে থাকি। রাতের বাধ ভাঙ্গা জোৎস্না আলোটা এই শহরটাকে যখন ঘিরে ধরে তখন মনে হয় শহরে নতুন ফুল ফুটেছে। আমার পছন্দের কদম ফুল। কিন্তু এই কদম ফুল এখন আর ভালো লাগে না। যে শহরটায় মানুষ ঠিক মত নিশ্বাস নিতে পারে না, আকাশ ছোয়ার স্বপ্ন দেখতে পারে না সে শহরে কদম ফুলের দরকার আছে বলে আমার মনে হয় না। আমার বন্ধু নাদিয়া মারা গেছে। ওর কথা যখনি মনে পড়ে তখন নিজের ভিতরই একটা ঘৃনাবোধ তৈরি হয়। লজ্জা লাগে খুব লজ্জা। হাত পা খোলা থেকেও আমাদের মত মানুষের হাত পা বন্ধি থাকে। আমি ভিতরে ভিতরে কাঁদি, আমার বন্ধুটার জন্য কাঁদি। একটা বিষণ্নতা ছুয়ে দিয়ে যায় দক্ষিনের বয়ে আসা বাতাসের সাথে। ইবনাত আমার পাশে বসে চুল ছেড়ে দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। আমি তাকে বলি “আমাকে না দেখে শহরটা দেখো।” সে আমাকে বলে “শহরটার মাঝে মায়া নেই। কেমন যেন একটা কালো ছায়া জমাট বাধে। আপনাকে দেখলে মায়া হয়, ভালো লাগে। আপনার দিকে তাকিয়ে থাকি?” এর একটু পরই মিরাজের ফোন আসে আমার কাছে। আমি রিসিভ করতেই বললো “ভাই শুয়রের বাচ্চা সভাপতিরে বাইধা রাখছি।” আমি শুধু হুম করে একটা শব্দ করলাম। একটু পর আমাকে যেতে হবে। সভাপতির সাথে পুরানো হিসেবের খাতাটা নিয়ে বসতে হবে। আমি কাউকে ছাড়িনি। সেই আজগরকেও একমাস আগে আমি খাইয়া ফেলছি। নাদিয়া মারা যাবার পর আমার ভিতরে কি যেন একটা হয়েছিল। আমি ঠিক মত ঘুমাতে পারতাম না। ছোট বেলার মায়ের কথাটা বার বার আমাকে তাড়া করে বেড়তো। “জীবনে বাঁচতে হলে বা বেঁচে থাকার জন্য একা একা লড়াই করা শিখো বাবা। একটা সময় তোমারটা তোমাকে নিয়ে ভাবতে হবে। তোমাকে কেউ তখন নিজের হাতে খাইয়ে দিবে না। দেখিয়ে দিবে না এই পথে যাও ও পথে যেও না। নিজের যুদ্ধটা নিজে করতে হবে। কারো উপর ভরসা করতে নেই। কারো উপর ভরসা করার চেয়ে তুমি নিজেই করতে পারো কিনা চেষ্টা করবে। বার বার করবে।” আমি শোভন কারোর উপরই এখন ভরসা করি না। আমি ইবনাতকে ইতস্তত হয়ে বললাম “একটা কথা ছিল। তোমাকে বলবো বলবো বলে কখনো বলা হয়নি। উত্তরটা আমার জানা দরকার। এই কয়েক মাস হলো আমি চাকরি করছি। বাবা বার বার বলেছে তার ব্যবসায় বসতে। কিন্তু আমি ব্যবসায় জিনিসটায় জড়াতে চাইনি। তুমি আমার সাথে কেন সংসার করতে রাজি হয়েছিলে?” সে আমার দিকে বেশ কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকলো। তারপর বললো “হঠাৎ এই কথা?” এটা বলেই ও একটু ঝিম মেরে থাকলো তারপর আবার বলতে লাগলো “আপনাকে আমি আগে থেকেই চিনতাম। ছোট বেলা থেকেই আপনার প্রতি একটা ভালো লাগা কাজ করতো। তবে এটাকে ভালোবাসা বলাটা ঠিক হবে না। এইটুকু বয়সে ভালোবাসাটাকে আমি অনুভব করতে পারতাম না। মাঝে মাঝে আপনার কথা বলতো আম্মা। উনি আপনাকে নিয়ে চিন্তা করতো। উনার কাছে পড়ার সময় হঠাৎ করে কেঁদে দিতেন। আমি জানতে চাইতাম। উনি বলতে চাইতো না। কিন্তু আমি নিজেই জানলাম। স্কুল শেষ করে যখন কলেজে ভর্তি হলাম তখন আপনি ভার্সিটির প্রথম বর্ষের শেষের দিকে। প্রায় আপনাদের বাসায় আসতাম। কখনো কখনো আপনি বাসায় থাকতেন না। আমি আপনার কবিতা পড়তাম। কি আজেবাজে লিখা লিখতেন আপনি। এগুলো পড়ে আমি হাসতাম। এরপর যখনি আপনাদের বাসায় আসতাম আপনার কবিতা খুঁজে খুঁজে পড়তাম। না পেলে আম্মা নিজেই আমাকে খুঁজে বের করে দিত। আপনার সাথে আমার তেমন একটা দেখাই হতো না। তবে বেশ কয়েকবার দেখা হয়েছিল। আপনি আমার দিকে খেয়ালই করতেন না। এরপর অনেক বছর কেটে গেছে। অনার্সটা শেষ করলাম। তারপর হঠাৎ করেই আম্মা আমাকে আপনার জন্য চাইলো। আমি কি করে না করতে পারি বলেন? ততদিনে আপনাকে নিয়ে ভাবাটা আমার অনেক বেড়ে গিয়েছে। অবশ্য আমার বাবা মায়ের মত ছিল না প্রথমে। আমি বলেছিলাম আমি যাকে নিয়ে ভাবতে শুরু করেছি তাকে আমার মত গুছিয়ে নিব সুযোগটা দাও। ঠিক করেছি না বলেন? আমার মত মেয়ে আপনি আর পেতেন?” আমার কি বলা উচিৎ আমি জানি না। শুধু আকাশের দিকে তাকিয়ে অনুভব করলাম এই বাধ ভাঙ্গা জোৎস্না আলোয় আকাশ থেকে কেউ একজন নেমে এসে আমাকে স্পর্শ করে গেলো। আমি ভাবি এই স্পর্শটা কি ইবনাতের? এই স্পর্শে আমি ভুলেই গিয়েছিলাম আমার ভিতরের জমা থাকা কান্নার কথা। আমাকে উঠতে হবে। পুরানো হিসেবটা বন্ধ করতে হবে। কিন্তু আমি জানি এই শহরের আনাচে কানাচে অনেক হিসেব জমা হয়ে আছে। সেই হিসেব আমাদের অনেকের কাছে অজানা। প্রিয় ইবনাত কথা দিচ্ছি আমি সব সময়ের জন্য এই স্পর্শটা নিজের শরীরে মাখিয়ে অনুভব করবো। এই স্পর্শটা আমার দরকার, ভীষন যে দরকার…