রাজামশাই, বাঘ আর বুড়ির গল্প

রাজামশাই, বাঘ আর বুড়ির গল্প

বাঘ লাফ দিয়ে নালাটা পার হয়ে গেল। তারপর একটা ঝাপুড়-ঝুপুড় গাছের ছায়ায় বসে হাই তুলল। এই গাছের নিচে বসে দিব্যি একটা ঘুম দেওয়া যেতে পারে এই ভেবে বাঘ তার শরীরটা এলিয়ে দিল মাটিতে। বাঘের একটা কান মাটি স্পর্শ করে থাকল। ঠিক তখনই বাঘ শুনতে পেল একটা ঘোড়ার পায়ের শব্দ। টগবগ, টগবগ। শব্দটা ক্রমশ কাছে আসছে। না, ঘুমটা দিতে পারল না বাঘমশাই। কান খাড়া করল।‍ ‘কে আসে ঘোড়ার পিঠে চেপে?’

রাজামশাই একা একা বন দাপিয়ে ঘোড়া ছুটিয়ে চলেছেন। মাথায় তাঁর সোনার রাজমুকুট শোভা পাচ্ছে। কোমরে ঝুলছে ধারালো তলোয়ার। না, রাজামশাই একা একা আসছেন না। পিছনে রয়েছেন তাঁর মন্ত্রী ও অন্যান্য লোকলস্কর। কিন্তু তাঁরা অনেক আগেই পথ হারিয়ে ফেলেছেন। তাই রাজামশাইয়ের পিছনে কিন্তু কেউ নেই। তিনি একা।

রাজামশাইয়ের ঘোড়াটা তেজি। সবাইকে পিছনে ফেলে আগে ছুটতে চায়। তাতেই যত বিপত্তি বাড়ল। রাজামশাই তাঁর তেজি ঘোড়া থামিয়ে সঙ্গী-সাথীদের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলেন। কিন্তু ঘোড়াটার থেমে থাকার ইচ্ছে নেই একটুও। রাজামশাই ঘোড়া থেকে নেমে যেতেই সেটা টগবগ টগবগ করে চরকি কাটতে লাগল। মনে হচ্ছে তার থেমে যাওয়ার খুব একটা ইচ্ছে নেই।

হঠাৎ হাজির হল বাঘমশাই। তবে সোজা আক্রমণ করতে নয়। কিছুটা খোঁজখবর নিতে, জঙ্গলে হঠা‌ৎ কাদের আগমন ঘটল।

হেলতে দুলতে বাঘ তো এগিয়ে আসছে। রাজামশাই সোজা ঘোড়ার পিঠে চেপে বসলেন। আর ঘোড়াটা ছুটল তিরবেগে। রাজামশাই ঘোড়ার পিঠে সেঁটে রইলেন। এই বুঝি পড়ে যান। সামনে যে নালাটা ছিল, রাজামশাইয়ের ঘোড়া সেটা এক লাফে পেরিয়ে গেল। আর অনর্থটা ঘটল ঠিক তখনই। রাজা টাল সামলাতে না পেরে পড়লেন সেই নালার মধ্যে।

ঘোড়াটাকে আর দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না। কাছাকাছি বাঘটাও নেই। রাজামশাই জল-কাদায় মাখামাখি হয়ে কাঁটাঝোপ মাড়িয়ে উপরে উঠে এলেন। তাঁর গায়ের পোশাক ছিঁড়ে গেছে। পা থেকে মাথা পর্যন্ত কাদামাটি মেখে রাজামশাই পালিয়ে যাওয়া ঘোড়াটার পথের দিকে চেয়ে রইলেন। কই, ঘোড়াটা তো ফিরে আসছে না?

তখন বেলা পড়ে এসেছে। রাজামশাই একা গাছের নীচে বসে ভাবতে লাগলেন, ‘এবার কোথায় যাই?’

সেই বনের একপ্রান্তে এক বুড়ির মেয়েকে বাঘে খেয়েছিল। সে অনেকদিন আগের কথা। বুড়ির আর কেউ ছিল না। মনের দুঃখে বুড়ি এসে অনেক কেঁদেছিল। তারপর বনে একটা পাতায় ছাওয়া কুঁড়েঘর বানিয়ে সেখানেই থাকতে লেগেছিল। বুড়ির মাথার ঠিক নেই। আপন মনে কথা বলে। বাঘটাকে যখন তখন গালমন্দ করে। মাঝরাতে বনের মধ্যে একা একা ঘুরে বেড়ায়। বুড়ির সাহস আর চেঁচামেচি শুনে বাঘ-শেয়াল কেউ ওদিক পানে তাকায় না। বুড়িকে সকলেই ভয় পায়।

তো হয়েছে কী, রাজামশাই গুটি গুটি পায়ে ঐ বুড়ির উঠোনের কাছে এসে পড়েছেন। গভীর বনের মাঝে বুড়িকে দেখে তিনি তো অবাক। বুড়ি তখন উঠোনের একপাশে শাক-পাতা তুলছিল। আর বিড়বিড় করে কাকে গালমন্দ করছিল। রাজামশাইকে দেখতে পেয়ে খ্যানখ্যানে গলায় বলে উঠল, “‍কে রে তুই মিনসে? তোর সাহস তো কম নয়? আমরা বাড়ির সামনে ঘুরঘুর করিস! তোর মতলবটা তো ভালো নয়।”

বুড়ি তো আর রাজামশাইকে চেনে না। তাই আচ্ছা করে দু’কথা শুনিয়ে দিল। তারপর কাছে এসে নাকচাপা দিয়ে বলল, “‍ছেঃ ছেঃ, তোর জামাকাপড় থেকে পচা পাঁকের গন্ধ ছড়াচ্ছে। যা, তাড়াতাড়ি স্নান করে আয়।”

রাজামশাই কিছু একটা বলতে গেলেন। বুড়ি তাকে তুড়ি মেরে স্নান করতে পাঠিয়ে দিল। রাজামশাই দেখলেন, পাশেই একটা ছোট্ট পুকুর রয়েছে। সেই জলে স্নান করে রাজামশাই ঠকঠক করে কাঁপতে লাগলেন। ফিরে এসে বুড়ির একটা কাপড় ধুতির মতো করে পরে নিলেন। তারপর মাটির দাওয়াতে বসে পড়লেন।

তা দেখে বুড়ি একেবারে চিলচিৎকার জুড়ে দিল। “‍বলি, এই সন্ধেবেলায় আয়েস করে বসে পড়লে চলবে? এই তোদের নিয়ে এক জ্বালা। ঘরের কুটোটি নাড়বি না। বলি, ভাত যে রাঁধব তার জল ঘরে আছে এক ফোঁটা? যা, ঐ পুকুর থেকে জল নিয়ে আয়। আমি ততক্ষণে শাকটা বেছে রাখি।”

রাজামশাইয়ের খুব জলতেষ্টা পেয়েছিল। তিনি ভেবেছিলেন, বুড়ি নিশ্চয়ই তাঁকে জল-বাতাসা দেবে। জল-বাতাসা না পেয়ে তিনি একটা মাটির কলসি নিয়ে পুকুরে চললেন। তারপর বেশ করে জল পান করে কলসিতে জল ভরে ফিরে এলেন।

বুড়ি খুশি হয়ে একগাল হেসে বলল, “‍বাহ্‌! তুই দেখছি বেশ কাজের ছেলে। ঘরে গিয়ে পিঁড়িতে বসে পড়। আমি আগুনটা জ্বেলে রান্না শুরু করি।”

বুড়ি শাক-পাতা রান্না করে দুটো পাতায় ঢেলে হাঁক পাড়ল, “‍কই রে, কুঁড়ের হদ্দ। পড়ে পড়ে ঘুমোলেই হবে? ভাত যে ঠাণ্ডা হয়ে যায়।”

সেই বাঁশপাতার মতো মিহি এবং জোরালো ডাক শুনে রাজামশাই ধড়মড় করে উঠে বসলেন। এভাবে তো কেউ তাকে ঘুম থেকে ওঠায় না। রাজামশাইয়ের যখন ইচ্ছে হয় তখন ওঠেন। কার এত সাহস যে তার ঘুম ভাঙায়?

রাজামশাই দেখলেন, বুড়ি ভাত আগলে বসে রয়েছে আর নিজের মনে বিড়বিড় করছে। তাঁর খুব খিদে পেয়েছিল। এরকম খিদে বহুদিন পায়নি। বুড়ির শাক-ভাত যেন অমৃত। শুধু শাক-ভাতের এমন স্বাদ তা তিনি কোনওদিন জানতে পারতেন না। তাই খেয়ে রাজামশাই বড়োই প্রসন্ন হলেন।

কিন্তু ভরপেট খাওয়ার ফলে রাজামশাই আর বসে থাকতে পারলেন না। ঘুমে চোখ বুজে আসতে লাগল। রাজপ্রাসাদের মনোরম শয়নকক্ষে রাজামশাইকে ঘুমের জন্য কত সাধ্যসাধনা করতে হয়। আর এখানে? রাজামশাই একঘটি ঠান্ডা জল ঢক ঢক করে খেয়ে মাটিতে চাদর বিছিয়ে শুয়ে পড়লেন। ঘুম যখন ভাঙল তখন সেখানে ছড়িয়ে পড়েছে মনোরম এক সকাল।

বুড়ি ঘুম থেকে উঠেই কাজে লেগে পড়েছে। সারাদিনে তার কাজের শেষ নেই। সূর্যের আলো গাছের ফাঁকফোঁকর গলে বুড়ির নিকোনো উঠোনে এসে পড়ছে। সেই রোদ গায়ে মেখে শালিক আর চড়ুইরা দানা খুঁটতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। রাজামশাই মগ্ন হয়ে সেই দৃশ্য দেখতে লাগলেন। হঠা‌ৎ তাঁর হারিয়ে যাওয়া ঘোড়াটার কথা মনে পড়ে গেল। তিনি দ্রুত তাঁর হারিয়ে যাওয়া ঘোড়ার সন্ধানে বেরিয়ে পড়লেন।

কিন্তু কোথায় তাঁর ঘোড়া? রাজামশাই খুঁজতে খুঁজতে অনেকদূর চলে এলেন। সামনেই একটা পুকুর। পুকুরে আয়নার মতো স্বচ্ছ জলের মধ্যে লাল-সাদা শাপলার মেলা। এত শাপলার মেলা রাজামশাই আগে কোনওদিন দেখেননি। তিনি অবাক হয়ে সেদিকে চেয়ে রইলেন। মনে হল, তিনি যেন আবার তাঁর কিশোরবেলায় ফিরে এসেছেন। এখন তিনি রাজা নন। পথ হারিয়ে ফেলা এক অচিন কিশোর অথবা এক সদ্য যুবরাজ। যিনি ভালোবাসেন এই সবুজ অরণ্য। গায়ে মেখে নেন রামধনু রং।

রাজামশাই সবুজ ঘাসে শুয়ে পড়বেন কি না ভাবছেন, এমন সময় দেখলেন দূরে তাঁর প্রিয় সাদা ঘোড়া নিশ্চিন্ত মনে ঘাস খাচ্ছে। তিনি ঘোড়ার পিঠে চেপে বসলেন। তবে এখন তিনি একজন সাধারণ মানুষ। তাঁর মাথায় নেই মুকুট। গায়ে নেই রাজপোশাক। পরনে তাঁর বুড়ির পুরনো শাড়ি। তিনি ঘোড়া ছুটিয়ে চলেছেন বনের পথে। শুকনো পাতার খড়খড় শব্দে বাতাস নেচে উঠছে। সোনা-কুচি রোদ ঝরে পড়ছে সবুজ পাতায়। রাজা চলেছেন নিরুদ্দেশে।

এমন সময় গভীর বনে দেখতে পেলেন সেই বাঘটাকে। না, সেই বাঘটা নাও হতে পারে। তাতে অবশ্য কোনও ক্ষতি নেই। রাজামশাইয়ের চোখে সব বাঘের চেহারাই এক। বাঘটা হালুম করল না। লাফাল না, ঝাঁপালও না। শুধু অবাক হয়ে দেখতে লাগল, একটা তেজি ঘোড়ার পিঠে বসে রয়েছেন একজন অত্যন্ত এলেবেলে লোক। এই লোকটাকে কি তার শ্রদ্ধা জানানো উচিত? অর্থাৎ রাজকীয় ভঙ্গীতে অভিবাদন জানাতে উচিত?

বাঘ বসে বসে ভাবতে লাগল। ততক্ষণে শাড়ি পরা রাজামশাই গভীর বনে হারিয়ে গেছেন।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত