রোজার দিনের গল্প ৩

রোজার দিনের গল্প ৩

শফিক সাহেবের কথায় আমি এবারও মুচকি হাসলাম।তবে তার মুখের ভাব সেই আগের মতই রয়ে গেলো। আমার হাসি দেখে ওনার মনের অবস্থা আমি বুঝতে পারলাম না। আমার চুপ থাকা দেখে শফিক সাহেব আবারও বললেন,
-আপনি কি কোন ভাবে আজকেও এড়িয়ে যেতে চাইছেন?
শফিক সাহেবের কথায় আমি এবার চুপ করেই রইলাম।হাত ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে দেখি ইফতারের আর ঘন্টাখানেক বাকি।এদিকে শফিক সাহেবকেও আজ কেন যেন ফিরিয়ে দিতে ইচ্ছে করছে না।আমি শফিক সাহেবের দিকে তাকিয়ে বলুন,
-আচ্ছা চলুন।
আমার কথায় শফিক সাহেবের মলিন মুখে হুট করেই হাসি ফুটে উঠলো। প্রশান্তিত হাসি।

আমি যেদিন এই অফিসে জয়েন করি সেদিন শফিক সাহেব আমার কেবিনে মলিন মুখেই এসেছিলেন।সবাই যেখানে হাসিমাখা মুখে এসে পরিচিত হচ্ছিলো তখন ওনার মলিন মুখ দেখে আমি একটু অবাকই হয়েছিলাম।
শফিক সাহেব এসে কিছু বললেন না।দাঁড়িয়ে রইলেন। আমি বসতে বললেও উনি ঠিক আগের মতই রইলেন। ওনাকে দেখে মনে হচ্ছে বেশ ঝামেলায় আছেন,মনটা প্রচন্ড রকমের খারাপ।

আমি কিছু বলার আগেই শফিক সাহেব চেয়ার টেনে বসতে বসতে বললেন,
-কেমন আছেন স্যার?
আমি ওনার কথার কোন উত্তর দিলাম না। একটু চুপ থেকে বললাম,
-কোন সমস্যা,কোন বিষয়ে টেনশনে আছেন? আপনি চাইলে সবকিছু বলতে পারেন।
আমার কথায় শফিক সাহেব আমার দিকে শান্ত চোখেই তাকালেন। হয়তো ভাবছেন আমাকে কথাগুলা বলা যাবে কি না।এমনিতেই নতুন মানুষ, তারউপর আবার উপরের পোষ্টে।কিন্তু উনি এসব ভাবলেও আমাকে হয়তো বিশ্বাস করতে সময় লাগাননি।একটু চুপ থেকে বললেন,
-আসলে স্যার বিয়ে করেছি মাস খানেক হবে।তখন ছুটি পাইনি। এখন সবাই বলছে একটু বাইরে থেকে ঘুরে আসতে।কিন্তু….
শফিক সাহেবের কিন্তুটা আমি জানি। উনি ছুটি চেয়েছিলেন কিন্তু পাননি। আমি শফিক সাহেবের দিকে তাকিয়ে বললাম,
-আচ্ছা,যদি ছুটি পান তাহলে খুশি হবেন?

আমার কথায় উনি কিছু বললেন না।তবে ওনার মুখের মলিন ভাবটা আর দেখতে পেলাম না।এখন সেখানে আশ্চর্যের ভাব ফুটে উঠেছে।আমি শফিক সাহেবকে বললাম,
-আপনি যান আমি স্যারের সাথে কথা বলে আপনার ছুটির ব্যবস্থা করছি।
আমার কথায় শফিক সাহেব মুচকি হেসে বললেন,ধন্যবাদ স্যার,অনেক অনেক ধন্যবাদ।
সেদিনের পর থেকে উনি আমাকে প্রায় প্রতিদিনই বলেন ওনার সাথে ওনার বাসায় যেতে।ওনার স্ত্রী নাকি খুব ভাল রান্না করেন।আর ওনার স্ত্রী ও নাকি অনেকবার বলেছেন আমাকে নিয়ে যেতে।কিন্তু আমি যাইনি।প্রতিবারই কোন না কোন ভাবে এড়িয়ে গেছি।কিন্তু আজ শফিক সাহেবের মলিন মুখ দেখে আর না করতে পারিনি।

আমি যখন শফিক সাহেবের সাথে ওনার বাসায় আসলাম তখন ইফতারের আর মিনিট দশেক বাকি।শফিক সাহেবের স্ত্রী হয়তো রান্না ঘরে।আমাকে বসিয়ে রেখে শফিক সাহেবও রান্না ঘরের দিকে গেলেন।আমি এদিক ওদিক চোখ বুলালাম কিছুক্ষন।বেশ ভালভাবেই গুছানো সব।এরমধ্যে বেশ কয়েকবার শফিক সাহেব খাবার টেবিলে কি কি যেন রেখে গেলেন আর আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলেন।ওনার এই হাসিটাই বলে দিচ্ছে আর একটু অপেক্ষা করুন, একটু।

শফিক সাহেব যখন ওনার স্ত্রীর সাথে আমার পরিচয় করিয়ে দিলেন তখন আমি চেয়ার টেনে খাবার টেবিলে বসেছি মাত্র।আজানের সময় হয়ে গেছে।আমি চোখ তুলে শফিক সাহেবের স্ত্রীর দিকে তাকালাম। ততক্ষনে আজান প্রায় দিয়ে দিয়েছে।শফিক সাহেবের স্ত্রী আমার দিক থেকে এতক্ষনে চোখ সরিয়ে নিয়েছে কিন্তু আমি তাকিয়েই আছি ওনার দিকে।বেশ সুন্দর দেখতে,নামটাও বেশ সুন্দর। ইথিকা।

শফিক সাহেব আজ বেশ খুশি।অবশ্য কারনটা আমি জানি।উনি ফ্রিজ থেকে সদ্য বের করা ঠান্ডা পানি গ্লাসে ঢেলে আমার দিকে এগিয়ে দিতেই ইথিকা বললেন,
-ওনার তো ঠান্ডা পানি খেলে সমস্যা হয়,ঠান্ডা লেগে যায়।নরমাল পানি দাও।

শফিক সাহেবের স্ত্রীর কথায় আমার থেকে শফিক সাহেব ই মনে হয় একটু বেশি অবাক হলেন।এটা তো ইথিকার জানার কথা নয়।পরিবেশটা স্বাভাবিক করতে শফিক সাহেব হেসে বললেন,
-দেখেছেন আপনাকে দেখেই সবকিছু বুঝতে পেরে গেছে। আসলে মেয়েটা কিভাবে যেন সবকিছু বুঝে যায়।
আমি শফিক সাহেবের কথায় মুচকি হেসে সম্মতি জানালাম।

ইফতারে অবশ্য আমি এতকিছু খাই না,যতটা আজ খাচ্ছি। অবশ্য আজ আমার জন্যে দু একটা আইটেম বেশিও করতে পারে।কিন্তু আজ এতকিছুতেও কেমন যেন তৃপ্তি পাচ্ছি না। অস্থির লাগছে।উপরে ফ্যান ঘুরলেও কেমন যেন ঘামছি আমি।আমি দ্রুত খাওয়া শেষ করে সোফায় এসে বসলাম। কেমন যেন ইথিকা নামের মেয়েটার সামনে বসে আমি খেতে পারছিলাম না।টেনশন হচ্ছিলো,প্রচন্ড ঘামছিলাম। লজ্জা, ঘৃণা সবকিছু যেন একসাথে চেপে ধরেছিল আমাকে।

আমি ফ্যানের নিচে বসেও প্রচন্ড ঘামছিলাম। শফিক সাহেব হয়তো এটা খেয়াল করে আমার পাশে বসতে বসতে বললেন,
-স্যার,কোন সমস্যা?
আমি শফিক সাহেবের কথায় কিছু বলতে পারি না। কিভাবে বলবো এই মেয়েটা আমার চেনা। একদম কাছে থেকে চেনা।চাকরীটা আর কিছুদিন আগে পেলে এই মেয়েটাই আমার ঘরে বউ হয়ে আসতো। হ্যা,এই মেয়েটাই বলেছিল ভালবাসি তোমায়, অনেক বেশিই ভালবাসি।কিন্তু সে এখন অন্যকাউকে ভালবাসি বলে দিব্যি কাটিয়ে দিচ্ছে।
আমি সোফা থেকে উঠতে উঠতে বললাম,
-আজ আসি তাহলে।
-কি বলেন,আপনার ভাবি আপনার জন্যে বিরিয়ানি রান্না করতে গেলো।
শফিক সাহেবের কথায় আমি ওনার কাধে হাত রেখে বললাম,
-ভাবিকে বলবেন আমি আর বিরিয়ানি খাই না।গ্যাসের প্রচুর সমস্যা।

কথাটি বলে আমি আর দাড়ালাম না।বের হলাম। এখানে আর এক মূহুর্ত নয়। চারিদিকে প্রায় অন্ধকার হয়ে এসেছে।কিন্তু আজ আমার মনের অবস্থা এর থেকেও বেশি অন্ধকার। যেখানে টর্চ লাইট জ্বালিয়েও কিছু দেখা যায় না।আমি বের হয়ে দু তলার বেলকুনির দিকে একবার তাকালাম। শফিক সাহেবের রুমটা একদম স্পষ্ট দেখা যায়।আমি এটাও স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি যে বেলকুনিতে কেও একজন অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আছে। আমি জানি কে দাঁড়িয়ে আছে। ইথিকাদের বাসা থেকে আমি যেদিন শেষ বারের মত বের হয়ে আসলাম সেদিনও মেয়েটা বেলকুনির গ্রিল ধরে এভাবেই দাঁড়িয়ে ছিল। আমি আর সেদিকে তাকালাম না।চোখ সরিয়ে নিয়ে সামনের দিকে হাটা দিয়ে পকেট থেকে ফোন বের করে আম্মাকে ফোন দিয়ে বললাম,
বিয়েতে আমি রাজি।

ফোন কাটার আগে আম্মার কন্ঠ শুনে আমি এটুকু বুঝেছিলাম যে উনি আজ অনেক বেশিই খুশি।যে খুশিটা আটকে ছিল আমার জন্যে।হ্যা আমার জন্যে।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত