জং ধরা লোহার গেটটা বাঁহাতে ঠেলে ভেতরে পা রাখতেই যার সঙ্গে দৃষ্টি বিনিময় হল সে একটা আধময়লা ধুতি কোনওরকম কোমরে জড়িয়ে আদুল গায়ে ছোট্ট একটুকরো জমিতে উবু হয়ে বসে কী করছিল। জমিটার চারদিক কোমর সমান নীল রঙের মাছধরার জাল দিয়ে ঘেরা। তিনদিকে তিনটে পাকা দেওয়ালের ওপর টিনের ছাউনির লম্বা লম্বা ঘর। ঘাড় ঘুরিয়ে চোখে চোখ রেখেই ভ্রূ যুগল ছেড়ে দিয়ে হাতের খুরপিটা ঝটপট ফেলে সামনে এসে দাঁড়াল মানুষটা। দৃশ্য-অদৃশ্য সব খয়ের নিষিক্ত দাঁত অনাবৃত করে বলল, “রাধেকৃষ্ণ। হুজুর কি আমাদের হস্টেল দেখতে এসেছেন? আসুন আসুন, ঘরে আসুন। রাধেকৃষ্ণ। আমি আবছামতো একটা খবর পেয়েছিলাম বটে।”
নিরুত্তর আমি একটা মাঝারি মাপের চৌবাচ্চার পাশ কাটিয়ে তার এক কামরার অফিস-কাম-ঘরে গিয়ে বসলাম। লোকটা ত্রস্ত হাতে খাটিয়ার পাশের দড়ি থেকে একটা মলিন জামা টেনে নিতে নিতে বলল, “ওই দুটো বেগুনের চারা গুঁজে রাখছিলাম। সময়ে অসময়ে ছেলেপিলেগুলো দুটো ভাজাপোড়া মুখে দিতে পায়।”
গম্ভীর মুখে জিজ্ঞেস করলাম, “সুপার কে?”
লোকটা জামা পরে সামনে এসে দাঁড়িয়ে উত্তর দিল, “আমিই, হুজুর।”
একটু অবাক হয়ে এবারে ভালো করে লক্ষ করলাম। আমার চেয়ে ছোটোই হবে খানিক, বয়স অনুমান বছর পঞ্চাশেক, রং বেশ ফর্সা, মাথার সাদাকালো কোঁকড়ানো চুল কাঁধের ওপর দোল খাচ্ছে। নাদুসনুদুস গড়ন, যেন পাকা আমটি। শরীরের দিকে তাকালে গলার তুলসীর কণ্ঠিখানায় নজর পড়ে সবচাইতে আগে। বললাম, “বসুন। কী নাম আপনার?”
“আজ্ঞে হুজুর, বলরাম গোস্বামী। রাধেকৃষ্ণ।”
“হুম। গত ডিসেম্বর মাসের বাজার খরচের হিসেবটা একবার বের করুন দেখি। চোখ বুলিয়ে নিই।”
বলরাম কাঁচুমাচু মুখে সামান্য ভেবে নিয়ে জিজ্ঞেস করল, “মাপ করবেন। হুজুর কি অঘ্রান-পৌষের কথা বলছেন?”
প্রথমে খানিকটা অবাক হয়ে বিরক্ত কণ্ঠে বললাম, “হ্যাঁ, অঘ্রানের পনেরো হতে পৌষের পনেরো পর্যন্ত হিসেবটা দেখান।”
বলরাম চার-পাঁচটা জাবদা খাতা ঘাঁটতে ঘাঁটতে মুখ ব্যাজার করে কীসব বিড়বিড় করতে লাগল। হঠাৎ খেয়াল হল, ইতিমধ্যে এই ঘরের চারপাশে কখন ঈষৎ চাপা হাসি আর গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়েছে। মুখ তুলে ইতিউতি ঘাড় ঘোরাতেই মনে হল কয়েক জোড়া চোখ যেগুলো এতক্ষণ আমাদের নিরীক্ষণ করছিল, সরে পড়ছে সন্তর্পণে।
খাতা একটা বেছে নিয়ে বলরাম নির্দিষ্ট পাতা খুলে আমার সামনে মেলেই হাঁক পাড়ল, “ওরে অগ্নি, হুজুরের জন্যে এট্টুখানি চা বসা, বাবা। রাধেকৃষ্ণ। আর মধু ময়রার দোকানে পিলুটাকে একবার…”
আমি ব্যস্ত হয়ে বললাম, “ওসবের দরকার নেই, সুপারবাবু। আমি কিছু খাব না। কিন্তু আপনি আমায় এ কী ধরিয়ে দিলেন? এদিকে আসুন।”
বলরাম টেবিলে ঝুঁকে সেই আকর্ণবিস্তৃত দাঁত মেলে বলল, “এ-বছরেরটা এই ধরেছি মাত্র হুজুর। আষাঢ়-শ্রাবণ অবধি এগিয়েছি। এই হতচ্ছাড়া বাঁদরগুলোর জ্বালায় কি আর মাথা ঠিক থাকে, হুজুর! তবে বচ্ছরের সব মাসেরই প্রায় একই হিসাব। খুব একটা হেরফের হয় না। রাধেকৃষ্ণ,” বলেই রান্নাঘরের দরজায় চোখ রেখে দাঁত খিঁচিয়ে উঠল, “বলি, কী রে হতভাগা অগ্নি, গেলি?”
আমি একটু রাগত সুরেই গলা চড়ালাম, “তাই বলে আপনি আমাকে গতবছরের খাতা দেখাচ্ছেন? আপনার দেখছি কিচ্ছুর ঠিক নেই। উঠোন জুড়ে ক্ষেত করে রেখেছেন। গেটের কোনায় আবর্জনার স্তূপ, চৌবাচ্চায় এক হাঁটু শ্যাওলা জমেছে। রান্নাঘরের কী অবস্থা দেখাবেন চলুন। হাইজিন শব্দটার সঙ্গে আপনার পরিচয় আছে কি না সন্দেহ হচ্ছে আমার।”
হস্টেল সুপার থতমত খেয়ে শেষে আহত স্বরে জবাবদিহি করল, “কী করব, হুজুর? অভাবের সংসার। বেতনের এই সামান্য ক’টা টাকায়… তাই কলাটা মুলোটা যদি জোগাড় করে বাড়ি পাঠাতে পারি, ধানি জমি আছে, কষ্টেসৃষ্টে চলে যায়।”
এই সময় একখানা এনামেলের কলাই-চটা থালায় এক কাপ চা আর জলের গ্লাস নিয়ে বছর কুড়ির একটা ছেলে এসে দাঁড়াতে চোটপাট আর গড়াল না। ছেলেটার চোখে চোখ রাখামাত্র ভেতরে ভেতরে চমকিত হলাম। হ্যাঁ, এই সেই ছেলেই বটে। ভাতের ফ্যানের ছিটে সেদিন সে-ই দিয়েছিল। এ-মুখ আমি ভুলব না। থালাটা টেবিলে নামিয়ে রাখতে লক্ষ করলাম, তার বাঁহাতের কড়ে আঙুলটা অস্বাভাবিকরকম ফাঁক হয়ে আছে। নিচের দিকের মাংসপেশি যেন সজোরে টেনে রেখেছে আঙুলটাকে। জিজ্ঞেস করলাম, “তোর নাম অগ্নি?”
ছেলেটার চোখমুখ অত্যন্ত শীতল। তদাপেক্ষা শীতল কণ্ঠস্বরে পাথরের মূর্তির মতো জবাব দিল, “হ্যাঁ।”
“অগ্নি কী? পুরো নাম বল।”
“অগ্নি মুড়াসিং।”
জবাব দিয়ে সে আর কোনও প্রশ্নের অপেক্ষা না করেই ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। মনটা আরও ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল সহসা। চায়ের কাপ ছুঁয়েও দেখলাম না। ভদ্রতাবশে শুধু এক ঢোঁক জল গিলে উঠে দাঁড়ালাম। বলরাম গোস্বামী হাঁ হাঁ করে উঠল। চাটুকু খেয়ে যেতে উপর্যুপরি অনুরোধ উপরোধ করতে লাগল। আমি অটল বুঝে শেষে একদৌড়ে কোত্থেকে এক থলি কাঁচা আনাজপাতি এনে হাজির করে জোড়হাতে বলল, “হুজুর, আমার পেটের ভাত আপনার হাতে। সদরে রিপোর্ট করে দেবেন না যেন। বাগানের সবজি ক’টা বাড়ি নিয়ে যান দয়া করে।”
আমি সোজা গেটের দিকে পা বাড়িয়ে হুকুম করলাম, “অগ্নিকে একবার গেটের বাইরে আসতে বলুন। আর ও-ক’টা গরিব ছেলের মুখের গ্রাস আমাকে ঘুষ দিতে আপনার বিবেকে বাধল না? আমি আগামী মাসে আসব আবার। তখন সবকিছু নিয়মমাফিক চাই আমার। একটা চান্স দিচ্ছি। তখন যদি কিছু গড়বড় পাই… যান, অগ্নিকে পাঠিয়ে দিন।”
বলরাম গোস্বামীর যেন ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল। করজোড় কপাল ঠুকেই রান্নাঘরের দিকে পালিয়ে গেল।
গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে একটা সিগারেট ধরাতে না ধরাতেই অগ্নি এসে সামনে দাঁড়াল। চোখের দৃষ্টি চার হাত দূরের পুকুরপাড়ে। জিজ্ঞেস করলাম, “সেদিন গায়ে ফ্যান ফেলেছিলি কেন রে?”
কথাটা কানে যেতেই খানিক শিউরে উঠল যেন ছেলেটা। মুহূর্তে সামলে নিয়ে ঘাড় শক্ত করে বলল, “ইচ্ছে করে ফেলিনি। আস্তাকুঁড়ে ফেলতে গিয়ে ছিটে লেগে থাকবে।”
ছেলের এই অহেতুক তেজ দেখে এবারে হাসি পাচ্ছিল মনে মনে। জিজ্ঞেস করলাম, “তুইই হোস্টেল কুক? মানে রান্নাবান্না…”
“সরকারি কুক নই। গোঁসাইবাবা দয়া করে আশ্রয় দিয়েছেন।”
“আশ্রয় কেন? তোর বাড়িঘর, মা, বাবা…”
“সবই আছে। আমি বাড়িছাড়া।” অগ্নির চোখে এবারে যেন আগুনের ফুলকি দেখা দিল। দৃষ্টি পুকুরপাড়ের গাছপালায় নিবদ্ধ।
সন্ধ্যা ঘনাতে আর দেরি নেই। মাইল দশেক উজিয়ে গেলে তবে কোয়ার্টারে ফিরব। বললাম, “যা, ভেতরে যা। অমন আর করিস না কখনও।”
*****
এখানে উক্ত ঘটনার ইতিবৃত্তটুকু বলে রাখা প্রয়োজন।
বছর তিরিশেক পূর্বে গভর্নমেন্টের খাতায় সহকারী শিক্ষক হিসাবে যোগ দিয়ে ক্রমে প্রধান শিক্ষক ও বর্তমানে বিদ্যালয় পরিদর্শকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছি। সঙ্গে যে ক’টি স্কুলে হস্টেল বর্তমান রয়েছে তাদের নিয়মমাফিক পরিদর্শনের ভারও কাঁধে এসে পড়েছে।
এই হস্টেলটাতে আরও মাস ছয়েক অবধি আমার পা পড়ত কি না সন্দেহ। কিন্তু বাধ্য করল অগ্নি নামের ওই ছেলেটা।
হস্টেলটার ঠিক পেছনের অংশেই আমার এক দাদার বাড়ি। দশ-বারোদিন আগে ভাইপোর বিয়ে উপলক্ষে একফালি খালি জায়গায় দাঁড়িয়ে আতসবাজির কেরামতি দেখছিলাম। ছেলেছোকরার দল ভিড় করে উল্লাস করছে। জায়গাটার ঠিক পাশেই এই হস্টেলের রসুইঘর। সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হয়েছে অনেকক্ষণ। হঠাৎ বাতাসে বয়ে কী এক তরল পদার্থের ছিটে এসে নাকে মুখে লাগতেই পেছন ফিরে দেখি হস্টেলের রান্নাঘরের দাওয়ায় দাঁড়িয়ে সদ্য কৈশোরত্তীর্ণ এক ছেলে দুই চোখে অগ্নিবর্ষণ করছে। হাতে তার বড়োসড়ো এক গামলা ঝুলছে। চোখাচোখি হওয়ামাত্র সে ভেতরে চলে গেল।
এদিকে আতসবাজির কেরামতি বন্ধ হয়ে গিয়ে হইচই পড়ে গেছে। যারা আমার অপেক্ষাও হস্টেলের দেওয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে ছিলেন, তাদের গায়ে কীসের হালকা ছ্যাঁকা লেগেছে। পরীক্ষা করে জানা গেল, ছেলেটা ভাতের গরম ফ্যান ছুড়ে মেরেছে। এ-পক্ষের ছেলেরা গরম হয়ে উঠল এবারে। আজ হস্টেলের ওই গুণ্ডাগুলোর একটা হেস্তনেস্ত করেই ছাড়বে। হস্টেলেও ছেলেপিলের সংখ্যা কম নয়, প্রায় ডজন দুয়েক। গায়ে হাত পড়লে নিশ্চয়ই ছেড়ে দেবে না। শেষে বিয়ের অনুষ্ঠানে এক শোচনীয় ব্যাঘাত সৃষ্টির আশঙ্কা মাথায় রেখে এ-পক্ষের ছেলেদের বাবা বাছা করে কোনওরকমে ঠাণ্ডা করা হল। বলা হল, পরদিন হস্টেল সুপারের কাছে অবশ্যই নালিশ যাবে। বাজি পোড়ানোও সেদিনকার মতো বন্ধ হল।
আমার কেমন সন্দেহ হল। বিনা কারণে, বিনা প্ররোচনায় একটা ছেলে মানুষের গায়ে ভাতের গরম ফ্যান ফেলবে কেন? নিতান্ত পাগল না হলে তো… খুঁজে পেতে একটু নির্বিবাদী ধরনের একটা ছেলেকে বেছে আড়ালে টেনে আনলাম। জিজ্ঞেস করলাম, “হ্যাঁ রে, হোস্টেলের ছেলেটা ওরকম ফ্যান মারল কেন?”
ছেলেটা উত্তর দিল, “আর বলবেন না, কাকাবাবু। ও হিসেব করতে গেলে আমাদেরই দোষ। বিকেলে যখন দুয়েকটা বাজির মহড়া চলছিল তখন অগ্নি ডেকে বলেছিল, বাজি-টাজি যেন আরও দূরে গিয়ে পোড়ানো হয়। এদের নাকি দু-তিনটে নিচু ক্লাসের ছেলে ভীষণ ভয় পাচ্ছে, কান্নাকাটি করছে। আমিও বলেছিলাম, থাক না, ওরা যখন ভয় পাচ্ছে তখন বাজিগুলো নয় ওই মাঠের ওধারে গিয়ে পোড়াও। তিনুদা আমাকে বুকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিল।”
“তুই ছেলেটিকে চিনিস? পরিচয় আছে?”
“না, কাকাবাবু। ও হোস্টেল থেকে বেরোয় না বিশেষ। ইশকুলেও পড়ে না। তবে শুনেছি, বড্ড তেজ নাকি।”
সেদিনই আমার হস্টেলটার দিকে পূর্ণ নজর গেল। পরদিন অফিসে পৌঁছে লিস্ট ঘেঁটে এর যাবতীয় রিপোর্ট খুলে বসলাম।
*****
এর মধ্যে মাস চারেক অতিক্রান্ত হয়েছে। আমি সেদিনের পর কারণে অকারণে অন্তত বার পাঁচেক হস্টেল ঘুরে এসেছি। বলরাম গোস্বামী দ্বিতীয় মাস হতেই কাজকর্ম মোটামুটি পরিপাটি করে রাখছে। গেটের পাশের জমা ময়লা আবর্জনা, চৌবাচ্চার শ্যাওলা অন্তর্হিত হয়েছে। রান্নাঘর, জমা খরচের হিসেব যথাবিহিত চলছে। উঠোনের সব্জিবাগানটা বলরাম বুক দিয়ে আগলে রাখত। আমারও ওটা নষ্ট করতে প্রবৃত্তি হল না। বাগানখানা রয়ে গেল। অগ্নিও ক্রমশ শীতল হতে শুরু করেছে। প্রায়ই হস্টেলের গেটের বাইরের পুকুরপাড়ের সেগুনগাছের নিচে বসে দু’জনে গল্পগুজব করি। মাঝেমাঝে ভাবি, কিছুদিন আগেও না আমি অগ্নিকে চিনতাম, না অগ্নি আমাকে। ক’মাসে এই অজ্ঞাতকুলশীল একগুঁয়ে তেজি ভূমিপুত্রটির প্রতি আমার এমন মায়া পড়ে গেল কেমন করে?
একদিন কথায় কথায় অগ্নির বাড়িঘরের কথা পাড়লাম। আগে জানা থাকলে এমন ভুল তখনই করতাম না। বাড়ির কথা কানে যেতেই যেন স্তিমিত যজ্ঞে ঘৃতাহুতি পড়ল। অগ্নি আমার দিকে শক্ত মুখে একবার তাকিয়েই ধুপধাপ পা ফেলে হস্টেলে ঢুকে গেল। হতবাক আমি কিছুক্ষণ বসে থেকে নিজের পথ ধরলাম। পরের কয়েকদিন আমি নিরন্তর ভেবেও অগ্নির এই ব্যবহারের অর্থ খুঁজে পেলাম না। বলরামকে জিজ্ঞাসা করেও বিশেষ ফল পাওয়া গেল না। সে ভাসা ভাসা উত্তর দেয়।
শেষে এক সিদ্ধান্ত নিলাম।
দিনতিনেক পর সকাল সকাল বলরামের কাছ থেকে অগ্নির বাড়ির ঠিকানা নিয়ে গাড়িতে উঠলাম। গন্তব্য তাপ্রাধুম। ঘন বন আর উপজাতি অধ্যুষিত এলাকা। পৌঁছব কীভাবে তা জানা নেই।
বাস-রাস্তা হতে মাইলটাক হেঁটে ঘন জঙ্গলের সুঁড়িপথে যখন ঢুকলাম তখনই বেলা বারোটা প্রায়। চারদিকে উঁচুনিচু ঘন জঙ্গলপূর্ণ টিলা-টঙ্কর ছাড়া আর কিছুই দৃষ্টিগোচর হয় না। পাকা রাস্তায় এক দোকানির কাছে খোঁজ নিয়েছি যে পবন মুড়াসিংয়ের বাড়ি পৌঁছতে হলে আমাকে তিনখানা টিলা অতিক্রম করতে হবে। ইতিমধ্যে একটার চড়াই ভেঙে পুনরায় নিচে নেমেছি। চেনা অচেনা ঘন গাছগাছালির নিচ দিয়ে পায়ে হাঁটা অসমতল পথ। যতই বনের গহিনে প্রবেশ করছি ততই চারপাশ যেন ঝিম মেরে আসছে। দুয়েকটা পাখির রব ছাড়া আর কোনও শব্দ নেই। রাস্তাও সম্পূর্ণ অপরিচিত। শিয়ালকাঁটা না কীসে ধুতির কাপড় বারংবার আটকে যাচ্ছে। কাছাকাছি কোথায় টুইকুক টুইকুক শব্দে কী এক অজানা পাখি সুর তুলেছে। যতই এগোচ্ছি, গাছাপালা ঘন হয়ে ধীরে ধীরে শরীর কেমন ভার করে তুলছে। অথচ দোকানির পথনির্দেশ অনুসারে প্রাচীন এক অশ্বথগাছ ও তার ছায়ায় ভাঙা এক স্কুলবাড়ির দেখা পেতে আরও কতখানি হাঁটতে হবে কে জানে। স্কুলবাড়িকে বাঁয়ে রেখে অল্প হেঁটে গেলেই নাকি পবনের ঘর।
আরও একটা টিলা পার হলাম। নিচে নেমে ডানদিকে একটা পথও খুঁজে পেলাম। অল্প পরেই জঙ্গল পাতলা হয়ে এল। চোখ মেলে দেখলাম, কীসের এক বাগানে এসে উপস্থিত হয়েছি কখন। বুক সমান এক জাতের ঝাড় ঝাড় গাছ চারদিকে সেজে রয়েছে। একটা গাছ আরেকটা থেকে নির্দিষ্ট দূরত্বে। বুঝতে ভুল হয় না যে গাছগুলো মনুষ্য দ্বারা রোপিত। কী রূপের বাহার একেকটার! চিরল চিরল পাতা মৃদুমন্দ বাতাসে কেঁপে উঠছে থেকে থেকে। আগায় আগায় মঞ্জরী ধরেছে। দূর হতে গাঁদাফুলের ঝাড় বলে ভ্রম হয়। আমি মরুভূমির লোক নই। অজস্র গাছপালা আমার শহরেও রয়েছে। কিন্তু এই বন্য সৌন্দর্য আলাদা। বিক্ষিপ্ত মনকে ঝিম ধরিয়ে এনে শেষে সম্পূর্ণ নেশাগ্রস্ত করে রাখে। ইচ্ছা জাগছিল, দুই দণ্ড গাছের গুঁড়িতে বসে নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকি নয়নাভিরাম তরুশ্রেণির দিকে। অজগরের দৃষ্টি-সম্মোহনের চেয়ে এর আকর্ষণ কোনও অংশে কম নয়।
ধ্যান ভাঙল কার এক গলার শব্দে। ডানে বাঁয়ে তাকিয়ে দেখি, জনাচারেক মঙ্গোলীয় চেহারার মানুষ কখন আমাকে ঘিরে দাঁড়িয়েছে। প্রত্যেকের হাতে একটা করে টাক্কাল (দা বিশেষ), পরনে হাঁটুর ওপর লেংটি দিয়ে আধময়লা মার্কিন থান কাপড়। বয়স আন্দাজ চল্লিশ-বিয়াল্লিশ। চোখে রোষকষায়িত জিজ্ঞাসা। চারদিকে আর কোনও জনমনিষ্যির চিহ্ন নেই। থতমত খেয়ে কোনওরকমে বললাম, “প-পবনের বাড়ি যাব। পবন মুড়াসিং। রাস্তাটা ঠিক…”
একজন বলল, “কী কাম? বাড়ি কই তুর?”
“বাড়ি শহরে। কাজ বলতে…”
অগ্নি-বৃত্তান্ত খুলে বললাম। ভেতরে ভেতরে বেশ টের পাচ্ছিলাম যে এদের কাছে মিথ্যে বললে বা সন্দেহজনক কিছু ঘটলে প্রাণ নিয়ে আজ ফিরতে নাও পারি।
মাতব্বর গোছের একজন চোখমুখ শক্ত করে বলল, “কামডা থিক করছে না তুই, মাস্তর। ইখানো আমরা কেউরে ধুকতো দেয় না। কোনও জাগাত ইডা লইয়া কোনও কথা কইস না। তুর বিপদ হইব।” তারপর কাকে উদ্দেশ্য করে বলল, “ধনু, মাস্তররে পবনের বাড়িত দিয়া আয়।”
একটা গাছের সরু ডাল ভেঙে নিয়ে ধনু আগে আগে চলল। কোনাচ রাস্তা ধরে হাতের লাঠির বাড়ি মেরে আগাছা ভেঙে পথ দেখিয়ে নিয়ে চলল। ধনু বোবা-কালা। কোনও প্রশ্নের জবাব পেলাম না। দাঁত বের করে শুধু মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।
*****
হাতঘড়িতে সওয়া দুটো, পবনের বাড়ি গিয়ে উঠলাম। টিলার ওপর মস্ত টংঘর। উঠোনের একপাশে ছোটোখাটো গোয়াল। অন্যপাশে খানিকটা কালো থিকথিকে পচা কাদা। গোটা পাঁচেক নধরকান্তি শূকর তাতে গড়াগড়ি দিচ্ছে আর থেকে থেকে এক অশ্রুতপূর্ব শব্দে গোঙাচ্ছে। ঝাঁকে ঝাঁকে ছানা বগলদাবা করে ইতস্তত চরে বেড়াচ্ছে গোটাকতক মোরগ।
আগন্তুক দেখে টংঘরের দাওয়া থেকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টি নিয়ে নেমে এল পবন। ছোটোখাটো মানুষটি। মুখে মঙ্গোলীয় দাড়ি। বললাম, “আমি অগ্নির কাছ থেকে আসছি, পবন। একটু জল খাওয়াতে পার?”
পবন কী বুঝল কে জানে। টংঘরের বাতায় ঝোলানো একটা হাতে বোনা মাদুর পেড়ে এনে উঠোনের কচি উষ্ণ দূর্বায় বিছিয়ে দিয়ে বলল, “ব মাস্তরবাবু, অগ্নি ক্যামুন আছে? কিছু গণ্ডগোল হইছে নাকি?”
রঙবেরঙের রিয়া-পাছড়া পরা বছর পঁয়তাল্লিশের এক উপজাতি রমণী এসে জলের ঘটি আর একগ্লাস শরবত নামিয়ে রাখল। বলল, “অগ্নি তুরে আইতে কইছে, মাস্তরবাবু? হে আইল না? কত বছর হইয়া গেল পোলাডা আমার…” পাছড়ার খুঁট দিয়ে চোখ মুছল সে।
পবন চোখ ঠেরে বলল, “অগ্নির মা। আইজ কত বচ্ছর হইছে পোলাডা দ্যাশছাড়া।”
এক ঢোঁক জল খেয়ে শরবতের গ্লাসটা তুলে নিলাম। কিন্তু মুখের কাছে আনতেই কেমন বোঁটকা গন্ধে শরীর গুলিয়ে উঠল। নামিয়ে রেখে ঘটির বাকি জলটুকু গলায় ঢেলে দিলাম। মুখ মুছে জিজ্ঞেস করলাম, “অগ্নি পালাল কেন?”
“পালাইছে না, মাস্তর। আমি খেদাইয়া দিসে। নাইলে পরের তিনডা অমানুষ হইয়া পড়ত আমার।”
“সে কী! কেন?”
পবন আমাকে এটুকু সময়ের মধ্যে এত বিশ্বাস কী করে করল জানি না। চারদিকে সন্ত্রস্ত দৃষ্টি ফেলে পরিস্থিতি মেপে নিয়ে সে যে বৃত্তান্ত শোনাল, আমি স্তম্ভিত হয়ে গেলাম।
তাপ্রাধুম এলাকায় মোড়ল অনন্ত চৌধুরীই শেষকথা। অনন্ত নিজেও মুড়াসিং সম্প্রদায়ের। গাঁয়ের মাথা হওয়ার সুবাদে রীতি অনুসারে তার উপাধি চৌধুরী হয়েছে। তাদের মোড়লকে ভগবানের পরেই স্থান দেয় গ্রামবাসী। অনন্ত কিন্তু লোক সুবিধের ছিল না। নানা অপকর্ম আর বেআইনি ব্যাবসায় পসার এবং প্রতিপত্তি দুইই বৃদ্ধি করে নিয়েছিল। তার গোয়ালে গরু-শূকরের ইয়ত্তা নেই। তবে আসল ব্যাবসা ছিল দাদন দেওয়া। দরিদ্র জুমিয়ারা অনন্তর কাছ থেকে দাদন নিয়ে নিজের টিলায় জুমচাষ করত। বছর শেষে তিল পরিমাণ দাদনের হিসাব তাল পরিমাণ জমে গেলে চাষির তলব হত। নিজের ইচ্ছায় আসতে না চাইলে বেঁধে আনা হত। তারপর ঋণ পরিশোধ করতে না পারলে জমি ক্রোক হত। আর এই জমিতে তখন শুরু হত অবৈধ গাঁজার চাষ। এই করে করে অনন্তর আঙুল ফুলে দিন দিন কলাগাছ হয়ে উঠতে শুরু করল। অগ্নি যখন গাঁ ছাড়ে, ততদিনে এদের ভিটেটুকু বাদ দিয়ে প্রায় সব জমিই অনন্তর পেটে ঢুকেছে। এক সীমানার বাড়ি হলেও অনন্ত পবনকে বিন্দুমাত্র রেহাই দেয়নি।
ফাল্গুনের শেষাশেষি এক গভীর রাতে পবনের গোয়ালে আগুন লাগল। আদিবাসীরা কখনওই সমতলের বস্তি অঞ্চলের মতো বসবাস করে না। কোনও কোনও টিলায় মাইল-আধা মাইল জুড়ে মাত্র দুই কি তিনটে বাড়ি। অনন্ত চৌধুরী সর্বাগ্রে পৌঁছে দেখল, পবন মাথায় হাত দিয়ে উঠোনে বসে রয়েছে। গোয়াল জ্বলছে। গরুগুলোর কে দড়ি কেটে দিয়েছে আগেই। গরু-বাছুর ঊর্ধ্বশ্বাসে কোথায় পালিয়েছে তার সন্ধান নেই। অনন্তর গরজ বেশি, অনতিদূরেই তার বিন্নিধানের মস্ত গোলা। হাঁকডাক করে দুই ছেলেকে নিয়ে আগুন নেভাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। স্বভাবে চরিত্রে অনন্তর দুই ছেলে বাপের ঠিক বিপরীত।
আগুনের আভা লক্ষ করে অপরাপর টিলা-টঙ্কর থেকে মানুষজন ছুটে আসার আগেই এবারে অনন্তর ঘর জ্বলে উঠল। সর্বপ্রথমে তার কাছারি ঘর ভস্মীভূত হল। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই বসত ঘর দাউ দাউ করে উঠল। অনতিদূরে অনন্তর লোকজন উপস্থিত থেকেও সে আগুন নেভাতে পারল না। সুতোটা অবধি বের করা গেল না। হতবুদ্ধি অনন্ত মাথা ঘুরে পড়ে রইল। এই ঘটনার পর সে অবশ্য বেশিদিন বাঁচল না।
আগুন যেমন আকস্মিক লেগেছিল, মিটতেও সময় বেশি লাগল না। এই গাঁয়ে বাড়িঘর সব পাকা শুকনো বাঁশের, শেষ ফাল্গুনে একেবারে ভাজা ভাজা হয়ে আছে। একটা স্ফুলিঙ্গই যথেষ্ট।
শেষরাত্রে কোত্থেকে অগ্নি মই বেয়ে ঘরে এসে ঢুকল। সব গরু-বাছুরের সন্ধান মেলেনি।
পবন চুপ করতে জিজ্ঞেস করলাম, “তারপর? অগ্নি শহরে গেল কী করে? স্কুল-টুলে ভর্তি করাওনি?”
পবন লম্বা একটা শ্বাস ফেলে বলল, “অগ্নিডার মাথা খুব ভালা আছিল, জানস মাস্তর। ফেইল তো দূরের কথা, কোনও বার সেকেন হইসে না। আত কেলাস পড়সে। ওই ঘতনার পরে সংসারে তানাতানি পইড়া গেছিল। চৌধরীর জমিত কাম করত আমি, কাম গেল। শুধু গরুর দুধ বেইচ্যা কি আর সংসার চলে? আপনেই ক। ইখানো দুধ কিনবো কেডা? বড়ো রাস্তাত গিয়া বেইচ্যা আইত। এর মইধ্যে একদিন সইন্দার আগে গোঁসাই আইল মা গোঁসাইরে লইয়া। কইল অগ্নিরে লগে লইয়া…”
কথা কেটে বললাম, “দাঁড়াও, দাঁড়াও। গোঁসাই মানে? কে, বলরাম গোস্বামী? সেই হস্টেল সুপার?”
“হ্যাঁ। তাইনে হইলে আমরার দীক্ষাগুরু। আমার বাপে দীক্ষা নিছিল তার বাপের থেইক্যা। বলরাম গোঁসাইর থেইক্যা আমি আর অগ্নির মা নিছে। ইখানো অনেক শিষ্য আছে তো তার। বচ্ছরে একবার হইলে ফিরায় আইয়ে। আমরা যে যেমুন পারি ধানচাল দিয়া দেই।”
“আচ্ছা! তারপর?”
“তারপর গোঁসাই সব শুইন্যা কইল, অগ্নিরে লইয়া যামু হুস্তেল। আমার কাছে ভালা থাকব। রাজি হইয়া গেলাম, পোলাও অমত করসে না।”
পবনের চোখ ছলছল দেখে কথা ঘোরালাম। বললাম, “ওই কোণে পলিথিনের ওপর চিতল পিঠে ছড়িয়ে রেখেছ কেন অমন? পিঠেপুলি ওভাবেই রাখো নাকি তোমরা? মাছি-মশা বসবে যে! তাছাড়া পিঠেপুলির সময়ও তো এখন নয়। এই ভর বোশেখে…”
পবন চকিতে আমার অঙ্গুলিনির্দেশে দৃষ্টি ফেলে হেসে উঠল। তাড়াতাড়ি বলল, “ইতা পিথা না। মুলি। চুয়াক বানাইতে কাম লাগে।” বলে আরেকটুকু সলজ্জ হাসল।
চুয়াক শব্দটার সঙ্গে পরিচিত ছিলাম। কিন্তু স্বচক্ষে দেখিনি। চমকিত হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “চুয়াক! তার মানে একটু আগে শরবতের গ্লাসে তোমার বউ…”
“হ, মাস্তর। আমরার বাড়িত কেউ আইলে চুয়াক দেওন লাগে আগে। নাইলে মান যায়।”
উৎসাহিত হয়ে বললাম, “কোথায় বানাও? দেখাবে?”
পবন একটু হেসে আমাকে পেছনদিকের একচালামতো একটা ঘরে নিয়ে গিয়ে তুলল। পরিপাটি করে নিকানো মেঝে। দেখলাম, উনুনের ওপর কালিমাখা ডেকচি বসিয়ে রেখেছে। এর ওপর বিশেষ কৌশলে তৈরি একখানা মুখ চাপা মাটির হাঁড়ি। ওপর থেকে তিনটে আলাদা চোঙ তিনদিকে মুখ করে আছে। একটা মুখের নিচে একটা পরিষ্কার পাত্র বসানো।
পবন বলল, “একদম নিচের সিলভারের দ্যাগে জল থাকে। মইধ্যে মাতির দ্যাগে থাকে ভাত-পচা, তিন-চাইরদিন ধইরা পচাইতে হয়। তারপর চুলায় জ্বাল দিলে ওই চোঙা দিয়া ফোঁতা ফোঁতা চুয়াক পড়ে। অইন্য দুইতা দিয়া হইলে গরম বাতাস বাইর হইয়া যায়। আপনে যে পিথার কথা কইসে, ওই মুলি ভাত-পচার লগে মিশাইতে হয়।”
আমি অবাক হয়ে বললাম, “আচ্ছা! তাহলে লাঙ্গি যে শুনি, সেটাও…”
“হ, একইভাবে বানায় আমরা। তবে লাঙ্গির লেইগ্যা বিন্নিচাল লাগে।”
বেলা পড়ে আসছে। পবন তার বাড়িতে রাত্রিবাস করতে অনেক পীড়াপীড়ি করল। আমি রাজি হলাম না। বৈশাখের বিকেল, ঝুপ করে সন্ধে নামবে না। ফেরার অবকাশ পাব।
শেষে পবন বলল, “মাস্তরবাবু, যাওনের হইলে দেরি করিস না। সূর্য লাল হইয়া গেছে। চল, তুরে পাক্কা রাস্তাত দিয়া আই।”
ব্যস্ত হয়ে বললাম, “আরে না না, পবন। আমি চলে যেতে পারব। তোমায় আর টিলা ভাঙতে হবে না।”
পবন মুচকি হেসে চোখ নাচিয়ে বলল, “বনে হাতি নামলে কী করবি? সামনে পইড়া গেলে? চল। কিছুই ত খাইলি না।”
রওনা হওয়া গেল। পথে জঙ্গল ভাঙতে ভাঙতে কিন্তু কিন্তু করেও শেষে পবনকে জিজ্ঞেস করেই ফেললাম, “আচ্ছা পবন, আসার পথে আমি রাস্তা ভুল করে সুন্দর একটা বাগানে ঢুকে পড়েছিলাম। ঘন বনের মধ্যে জায়গা পরিষ্কার করে কীসের এক বাগান তৈরি হয়েছে দেখলাম। বাইরে থেকে বোঝার উপায় নেই। গাছগুলো অনেকটা গাঁদা ফুলগাছের মতো।”
পবন চমকে ওঠে বলল, “খাইসে! ইতা ত গাঁজার বাগান। লাখ লাখ তেকার মামলা। ও আইচ্ছা, ধনু তারার বাগান তাইলে। কপাল ভালা তোর, বাইচ্যা গেসে। ইতা হইলে দাকাইত পোলাপান।”
পবন কোন রাস্তায় নিয়ে এল ঠাহর পেলাম না। পাকা রাস্তায় উঠতে বেশি সময় লাগল না। চায়ের দোকানের বেঞ্চিতে বসেছি বাসের অপেক্ষায়। পবন ফিরতি রাস্তা ধরবে। হঠাৎ আমার দু’হাত খপ করে ধরে বলল, “আবার আইস, মাস্তর। অগ্নিরে বুঝাইয়া একবার বাড়িত আনিস।” বলেই আমার জবাবের অপেক্ষা না করে গামছায় চোখ মুছতে মুছতে জঙ্গলে মিলিয়ে গেল।
বাসে বসে নিরন্তর ভেবে চলেছি – আচ্ছা, আমি যদি এখানেই এই জনপদে জন্মাতাম তবে কেমন ধারা হত আমার জীবনযাপন। আমিও নিশ্চয়ই পবনের চেয়ে বিশেষ কিছু হতাম না। অন্ধকারে চোখ মেলতাম, অন্ধকারেই বুজে ফেলতাম।
এ-জীবনে আমি আর তাপ্রাধুমে পবনের বাড়ি যাইনি। কিন্তু সেদিনকার এই অমলিন স্মৃতি আজও আমাকে সমান শিহরিত করে তোলে।
*****
দু-চারদিন পরে একদিন সন্ধের মুখমুখ দু’জনে হস্টেলের গেটের বাইরে পুকুরপাড়ে বসেছি। মাথার ওপরে গোটাকতক সেগুনগাছ হাতির কানের মতো বড়ো বড়ো পাতা মেলে ছায়ান্ধকার করে রেখেছে। অগ্নির বাঁহাতটা সস্নেহে আমার কোলে টেনে এনে জিজ্ঞেস করলাম, “হ্যাঁ রে অগ্নি, অনন্ত চৌধুরীর ঘরে আগুন দিয়ে কী লাভ হল তোর, বল তো।”
অগ্নি চমকে উঠেই হাতের দিকে দৃষ্টি ফেলে এক ঝটকায় হাতটা টেনে নিল। ঘাড় বেঁকিয়ে গম্ভীর মুখে বলল, “ক-কে বলেছে? কোনও প্রমাণ আছে?”
আমি স্মিত হেসে তার হাতের দিকে ইশারা করে বললাম, “বলেনি কেউই সরাসরি। আমি ক’দিন আগে তোদের বাড়ি গেছিলাম রে হতভাগা। আচ্ছা, তোর একবারও মা, বাবা, ভাইবোনদের কথা মনে পড়ে না! পবন বলল, তোকে অনেক সাধ্যসাধনা করেছে বাড়ি নিয়ে যাওয়ার, তুই নাকি গোঁ ধরে রয়েছিস! ওদের মনে কি কষ্ট দিতে আছে, বল।”
অগ্নি মাটিতে চোখ রেখে কেটে কেটে বলল, “এক ঘরের আগুন যদি দশ ঘরকে মুক্তি দেয়, ক্ষতি কী। দাদনের কাগজপত্র কিচ্ছু বের করা যায়নি। সব পুড়ে খাক হয়ে গেছে। অন্যায়ভাবে ছিনিয়ে নেওয়া জমি সব যার যার হাতে ফিরে গেছে।”
দু’জনেই চুপ করে বসে আছি। খানিক পরে মাথায় হাত বুলিয়ে নরম গলায় শুধালাম, “বাড়ি যাবি না, বাবা? পড়াশোনাটা এভাবে এক্কেবারে ছেড়ে দিবি! কী রে?”
অগ্নি ফুঁপিয়ে উঠল। তারপর আমার কোলে মুখ গুঁজে ছেলের সে কী কান্না!
*****
অগ্নি পরের বছর এক্সটারনাল পরীক্ষার্থী হিসেবে মাধ্যমিক পরীক্ষা দেবে। যা যা ব্যবস্থা করবার সব করেছি। বলরামও সমান উৎসাহী। ইতিমধ্যে অগ্নি বার দুই বাড়ি ঘুরে এসেছে। পবন নাকি বারংবার আমাকে একবার যেতে অনুরোধ করে।
মাধ্যমিকে আশাতীত ফল করেছে ছেলেটা। প্রায় মাস তিনেকের চাপা উৎকণ্ঠার অবসান ঘটল। অগ্নি একাদশ শ্রেণীতে ভর্তি হল।
হস্টেলে যখনই গেছি অগ্নিকে বই হাতেই দেখেছি। ছেলেটার অধ্যবসায় দেখে অবাক হয়ে যেতাম। ক্রমে দ্বাদশ শ্রেণীর বোর্ডের পরীক্ষা ঘনিয়ে এল। পরীক্ষা শেষে অগ্নি বাড়ি গেল। দিন সাতেক থাকবে। মাস দুই আড়াই এখন অখণ্ড অবসর।
*****
অগ্নি কিন্তু এবারে আর ফিরল না। দু’মাস অতিক্রান্ত হয়ে গেল। প্রথম প্রথম ঘন ঘন বলরামের কাছে খবর নিতাম। ধীরে ধীরে কেমন এক অভিমান এসে ঘিরে ধরল। অগ্নি প্রতিদিন আমার জীবন থেকে অল্প অল্প করে মুছে যেতে লাগল।
কিছুদিন পরেই ঘোরতর বুকের অসুখ বাধালাম। চাকরিরও আর বেশিদিন বাকি নেই। দেখাশোনা করবে তেমন লোক কই এখানে? স্ত্রী গত হয়েছেন বছর দশেক হল। একমাত্র কন্যা জামাইয়ের চাকরিসূত্রে দিল্লিবাসী। শেষে ভিআরএস নিয়ে মেয়ের কাছে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত হল। যাওয়ার মুখে একদিন বলরাম দেখা করতে এলে খবর পেলাম, অগ্নি গাঁয়ে পৌঁছেই দল পাকিয়েছে। অনন্ত চৌধুরীর দুই ছেলেকে সামনে রেখে এক সমবায় সমিতি গড়েছে। মাসে মাসে সামান্য পরিমাণ নির্দিষ্ট চাঁদা তহবিলে জমা হয়। কেউ বিপাকে পড়লে তা থেকে বিনা সুদে ঋণ করে। পরিশোধ না করলে অন্য সদস্যরা মিলে ভাঙা তহবিল জোড়া দেয়। সেক্ষেত্রে ঋণী সদস্য আর কোনওদিন ঋণ পায় না। দল থেকে বহিষ্কৃত হয়। এছাড়া পানীয় জল, সাধারণ চিকিৎসা, স্বাবলম্বন এসব দিকেও অগ্নি মাথা দিয়েছে। একখানা গাছ কাটা পড়লে পাঁচখানা লাগায়। শুনে আনন্দ হলেও স্বস্তি পেলাম না। হতাশ হয়ে বললাম, “তবে সে কি আর লেখাপড়াটা করবে না? গ্র্যাজুয়েশনটা অন্তত…”
বলরাম ইতস্তত করে বলল, “হুজুর, অগ্নি নিজে কিন্তু এলাকায় নেই। তাপ্রাধুম থেকে আরও অনেকদূরে, আরও গভীর জঙ্গলে ক্যাম্প ওদের। ওই জঙ্গলে সাধারণ মানুষের পা রাখার হুকুম নেই।”
“ক্যাম্প! সে কীসের আবার?”
“হুজুর, আপনার শরীর গতিক ভালো নয়, এসব কথা বলা উচিত নয় বুঝি। কিন্তু সত্য থেকে আপনাকে অন্ধকারে রাখিই বা কী করে? অগ্নি এলএফটি দলে গিয়ে ঢুকেছে। এরা নাকি বন্দুকের মুখে বাঙালি খেদিয়ে স্বাধীন দেশ গড়বে।”
হাত-পা অবশ হয়ে এল শুনে। অগ্নি এমন কাজ করতে পারে বিশ্বাস করতে কষ্ট হল। বলরাম যোগ করল, “তবে ছেলেটা নাকি কিছুতেই রাজি ছিল না এসবে। কিন্তু দিনের পর দিন বাড়ি চড়াও হয়ে বেরেন ওয়াশ করতে করতে একদিন… জানেনই তো ছেলেটাকে। এসবই ওর বাপ পবনের মুখে শোনা। গত হপ্তায় গেছিলাম তো আমি।”
ত্রিপুরাকে জন্মের মতো বিদায় জানিয়ে দিল্লি চলে এলাম। সঙ্গে আনলাম দশমনি ভারের এক মন।
*****
বেশ কয়েক বছর কেটে গিয়েছে। আমি দীর্ঘায়ু মানুষ। দুই নাতনি আজ মহানন্দে অশীতিপর দাদুর জন্মদিন উদযাপনের আয়োজন করেছে। সন্ধেয় আশেপাশের ফ্ল্যাটের প্রতিবেশীদেরও নেমন্তন্ন করা হয়েছে।
অলস দুপুরে নিজের ঘরে শুয়ে ছিলাম। দীর্ঘদিন বাদে হঠাৎ কী কারণে জানি না অগ্নির কথা ভীষণ মনে পড়ল। ছেলেটা কত বড়ো হয়েছে কে জানে। কোথায় আছে, কী করছে – এসব ভাবতে ভাবতে কখন চোখ লেগে গেছিল টের পাইনি। ঘুম ভাঙল ছোটো গিন্নির ধাক্কায়। “এই যে বার্থ ডে বয়, সামওয়ান ইজ ওয়েটিং ফর ইউ।”
উঠে বসতে বসতে জিজ্ঞেস করলাম, “কে রে? এখনও তো সন্ধের অনেক বাকি!”
“ড্যানি ডেনজংপা গো। লিভিং রুমে বসে আছে, দ্যাখো গে।” বলেই খিলখিল শব্দে হেসে ছোটো গিন্নি পালিয়ে গেল।
ত্রস্ত পায়ে সামনের ঘরে এসে দেখি বেশ স্বাস্থ্যবান এক উপজাতি যুবক সোফায় বসে ম্যাগাজিনের পাতায় মুখ গুঁজে রেখেছে। আমার সাড়া পেয়েই পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করল। জিজ্ঞাসা করল, “কেমন আছেন, স্যার? কতদিন পর দেখলাম।”
থতমত খেয়ে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতেই সে নিজের বাঁহাতের তালুটা মেলে হাসতে হাসতে বলল, “অগ্নি স্যার, অগ্নি।”
আশ্চর্য! একেই কি টেলিপ্যাথি বলে? চোখের দৃষ্টি সম্পূর্ণ ঝাপসা হয়ে গেল। বুকে জড়িয়ে ধরতে ভাঙা গলায় কীসব বের হয়ে এল অনর্গল কে জানে। শুধু নিজের গলার এটুকু কথা স্পষ্ট হল, “অগ্নি! এসেছিস, বাবা?”
পাশে বসে জিজ্ঞেস করলাম, “কোথায় চলে গেছিলি রে? এভাবে কেউ কাউকে কষ্ট দেয়, হতভাগা?”
অগ্নি কৌতুক করে বলল, “আমি কোথায় যাব, স্যার? যাইনি তো কোথাও। আপনিই তো চলে এলেন ছেড়ে।”
“তাহলে ওই লিবারেশন ফ্রন্ট অফ ত্রিপুরা…”
“তুলে নিয়ে গেছিল, স্যার। তারপর মিথ্যা রটনা ছড়িয়ে দিয়ে দলে আটকে রাখতে চাইছিল। সুযোগ পেয়েই পালিয়ে এসেছিলাম। কিন্তু ততদিনে আপনি দিল্লি চলে এসেছেন।”
মনের সব কালো মেঘ অন্তর্হিত হয়ে গেল এক লহমায়। খুশি হয়ে জানতে চাইলাম, “তারপর? কেমন ছিলি? কী করিস এখন?”
“কিছুই করিনি, স্যার। তবে এখন হয়তো করার সুযোগ হয়েছে। পোস্ট গ্রাজুয়েশনের পর সিভিল সার্ভিসের পরীক্ষায় বসেছিলাম। উতরে গেলাম। আজ আটদিন হল দিল্লিতে ট্রেনিং চলছে। ফিরেই জয়েন করব। আপনার আশীর্বাদ না থাকলে…”
এ আনন্দ রাখি কোথায়? বাচ্চা ছেলের মতো হেঁকে ডেকে সারাবাড়ি জড়ো করে ফেললাম সেকেন্ডে। মেয়েকে বললাম, “শিগগিরই মিষ্টি নিয়ে আয়, পিউ। অগ্নি মস্ত অফিসার হয়েছে রে!”
তারপর আচমকা সন্দেহ হতেই জিজ্ঞেস করলাম, “তা হ্যাঁ রে, আমার ঠিকানা খুঁজে পেলি কোথায় এখানে?”
অগ্নি দেখলাম প্রশ্নের জবাব না দিয়ে আমার মেয়ের দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে। মেয়েও তদ্রূপ। শেষে অগ্নিই খোলসা করল, “পিউদির কারণে, বা বলা যায় ফেসবুকের কল্যাণে। মাস দুয়েক আগেই যোগাযোগ হয় আমাদের। ভাগ্যিস, পিউদিদের সবকথা আমার আগে থাকতেই জানা ছিল আপনার মুখে। তাই চিনে নিতে দেরি হয়নি। সারপ্রাইজ দেব বলে আমিই বারণ করেছিলাম আপনাকে জানাতে।”
ব্যতিব্যস্ত হয়ে বললাম, “দাঁড়া দাঁড়া, ওই ফেসবুক জিনিসটা কী বল দেখি।”
বড়োগিন্নি এসে দু’হাতে গলা জড়িয়ে বললে, “সে আমি শিখিয়ে দেব তোমায়, ডার্লিং। ভেবো না। দু-চারটে নতুন গার্লফ্রেন্ড খুঁজে পাও কি না দ্যাখো।”
উচ্ছ্বসিত হাসির দমকে ঘরখানা যেন কেঁপে উঠল। এবারে বোধহয় মরে শান্তি পাব।