আমার চাচাতো ভাইকে মনে মনে খুব ভালোবাসতাম। কিন্তু তিনি বুঝতে চাইতেন না। বুঝানোর চেষ্টা করলেও কোনো প্রকারের পাত্তা দিতেন না। মাঝে মাঝে কষ্ট হতো এই ভেবে, কি নেই আমার মাঝে? রুপ, গুন, সুন্দর চেহারা, টোল পড়া হাসি। এরপরেও কেনো আমাকে পছন্দ করেন না। প্রেম নিবেদন করেছি কিন্তু তাতেও কোন কাজ হয়নি।
আমি তামান্না। ইন্টার ফাস্ট ইয়ারে পড়ি। আমি বাবা মায়ের আদরের একমাত্র সন্তান। অনেক আগে থেকেই আমার বাবা ব্যাবসা করেন। ঢাকায় আমাদের ৫ তালা একটি বাড়ি আছে। ২ তলায় আমরা থাকি আর বাকি ফ্ল্যাটগুলো ভাড়া দেওয়া আছে। আমাদের দেশের বাড়ি কুমিল্লা।
আজ ২ মাস হলো আমার ক্রাশ হাসান ভাই পড়াশোনা করার জন্যে ঢাকা এসেছেন। প্রথম কয়েকদিন মেসে থেকে কলেজ যেতেন। বাবার অনুরোধে ওনি এখন আমাদের বাসা থেকে ক্লাস করেন।
মাঝে মাঝে কোনো কারণ ছাড়াই ওনার রুমে যাই। এটা ওটা জিজ্ঞেস করি। তেমন কোনো উত্তর দেয়না।
একদিন ওনার জন্যে গরম চা বানিয়ে অনুমতি ছাড়াই ওনার রুমে গেলাম।
‘ভাইয়া আপনার জন্যে চা এনেছি’।
‘টেবিলে রাখো। অন্যদিকে তাকিয়ে আস্তে করে বললো হাসান ভাই।’
‘চলে যাচ্ছি।’
‘আচ্ছা।’ দৃষ্টি নিচের দিকে রেখেই উত্তর দিলো।
ভাবলাম ওনি মানুষ নাকি এলিয়েন। ওনার মন বলে কিছুই নেই। আমার মত একটা মেয়ে যার জন্যে কিনা কলেজের কত ছেলে পাগল তাকে হাসান ভাই এভাবে এভয়েড করে। কারণটা ঠিক মত মাথায় ডুকলোনা।
হাসান ভাই আমার থেকে তিন’বছরের বড়। ছোটবেলা থেকে গ্রামেই লেখাপড়া করেছেন। মাথায় কোনো সমস্যা ছিলো বা হয়েছে নাকি সেটাও জানিনা। শুনলাম ছোট থেকেই ওনি তাবলীগ জামা’আতের সাথে সময় দিতেন। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তেন। এখনো পড়েন। কিন্তু ইসলামে কি নিষেধ আছে তোমরা চাচাতো বোনের সাথে চোখে চোখ রেখে কথা বলিও না?
আমার জানা নেই। কেননা ঢাকার আলো-বাতাসে বড় হয়েছি। আল্ট্রামর্ডান পরিবেশে বেড়ে ওঠা। ধর্মীয় শিক্ষা তেমন একটা পাইনি বললেই চলে।
আজ কলেজ বন্ধ। বাসায় বসে বেকার সময় কাটছে। তাছাড়া আজ ভোর থেকেই গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি ঝরছে। আকাশটা কেমন ভার হয়ে আছে! যেনো অভিমানী মানুষের গাল ফুলানো মুখ। আমার মনটাও ভালো নেই। শুধু এলোমেলো নানা কথা মাথায় এসে ঘুরপাক খাচ্ছে। হাসান ভাইয়ের কথা সারাক্ষণ মনে পড়ে।
যাই হাসান ভাইয়ের রুমে যাই। দেখি ওনি করেন?
-“ভাইয়া আসবো?”
-“কোনো দরকারী কাজ আছে?”
মাথা নিচু করে উত্তর দিলেন
-“কেনো দরকারী কাজ ছাড়া রুমে আসা মানা আছে নাকি?”
-“বই পড়তেছি। রুমে ডুকে মনোযোগের ক্ষতি না করলে খুশী হবো।”
ধুর ওনি আছে ওনার ভাব নিয়ে। মনে মনে ভাবলাম, ওনি আবার অন্য কারো সাথে প্রেম করে নাতো?
আর ওনার মত ছেলের প্রেমে পড়বে এমন মেয়ের এখনো জন্মও হয়নি। পুরাই আন-রোমান্টিক।
রুমে গেলাম। টিভি চালু করে কিছু সিরিয়াল দেখতে লাগলাম।
আচ্ছা হাসান ভাইকে যখনই কিছু জিজ্ঞেস করি তখনই তিনি মাথা নিচু করে উত্তর দেন। কিন্তু কেনো? এর কারণটা আমাকে জানতেই হবে। মাধ্যম হিসেবে একটা চিঠি লিখলাম-
-“হাসান ভাই একটা জিনিস লক্ষ্য করলাম, আপনাকে যখন কিছু বলি তখনই আপনি মাথা নিচু করে উত্তর দেন। আজ অবধি এর কারণটা জানতে পারিনি। আমার উপস্থিতি কি আপনি বিরক্ত হন? যদি হন তাহলে বলবেন।
৬ দিন পর চিঠির উত্তর পেলাম।
-“তামান্না এখন আমার পরিক্ষা চলে। সময়মত তোমাকে আমি সব প্রশ্নের উত্তর দিবো। শুধু তুমি একটু ধৈর্য ধরো।”
এতটুকুতেই উত্তর শেষ করে দিলেন ওনি।
ইদানীং আমার মা আমাকে হাসান ভাইয়ের রুমে অতিরিক্ত না যাওয়ার জন্যে বারন করতেছেন। হাসান ভাই, মাকে কিছু বলেনিতো?
নাকি মা ব্যপারটা আচ করতে পেরেছে? খুব চিন্তা হয়।
কিছুদিন পর আবারো হাসান ভাইকে একটা চিঠি দেই। সেই চিঠিতে লেখা ছিলো- “হাসান ভাই আমি আপনাকে মনে-প্রাণে ভালোবাসি। জানি এটা ভালেবাসা নাকি ভালোলাগা। ভাইয়া আপনাকে ছাড়া কোনো কিছুই আমার মাথায় আসেনা। আমার ভাবনা জুড়ে শুধু আপনি আর আপনিই থাকেন। ভাইয়া আপনাকে ছাড়া আমি বাঁচবো না।”
খুব টেনশনে হচ্ছে! চিঠিটা ওনি পড়বেতো নাকি আবার ওয়েস্টেজ পেজ ভেবে ডাষ্টবিনে ছুড়ে ফেলবেন।
দু’দিন পর আমার অপেক্ষার প্রহর শেষ হলো। আমার দেয়া চিঠির উত্তর দিলো।
উত্তরে হাসান ভাই লিখলো- “দেখো তামান্না পাশ্চাত্য মন-মানসিকতার এই সমাজে বেড়ে ওঠা তোমার কাছে এমন চিঠি পেয়ে আমি মোটেও অবাক হইনি। আমাকে তুমি ভালোবাসো। এটাতো ভালো কথা। বোন ভাইকে ভালেবাসবেই। তবে তোমায় জীবনের আসল বাস্তবতা নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করতে অনুরোধ করছি। আর হ্যাঁ, তোমাকে কয়েকটি বই আর কিছু পত্রিকা দিচ্ছি। যদি আমাকে তুমি সত্যিকার অর্থেই ভালোবেসে থাকো, তাহলে আশা করি তুমি সেগুলো আদ্যোপান্ত পর্যন্ত পড়বে।”
কিছু ধর্মীয় ও ইসলামী গঠনমূলক পত্রিকা পড়ার পর থেকে আমার ভিতর ধীরে ধীরে পরিবর্তন হয়েছে। এখন আর আগের মত কারনে-অকারনে বিনা অনুমতিতে হাসান ভাইয়ের রুমে যাইনা। কিংবা প্রয়োজন হলেও অযথা তেমন কোনো কথা বলিনা।বললেও পর্দা করে সমস্ত শরীর ডেকে যাই। কলেজে বোরকা পরে হাতমোজা পামোজা পরিধান করে যাই। এখন আর কোনো ছেলে আমাকে কিউট আটা ময়দা সুন্দরী বলেনা। বলবেইবা কি করে আমার চেহারাতো সবসময় ডাকা থাকে। আমার হঠাৎ এমন পরিবর্তন দেখে বান্ধবীরা অবাক হয়। সবকথা খুলে বলি। তাদেরকেও দ্বীনের পথে দাওয়াত দেই।
হাসান ভাইকে আমার জন্যে আল্লাহর কাছে দোয়া করতে বলি। আল্লাহ আমাকে যেনো সঠিকভাবে দ্বীনের পথে চলার তৌফিক দেন।
সত্যিই আমার জীবনে এখন আমূল পরিবর্তন ঘটলো। পুরোপুরি দ্বীন মেনে চলার চেষ্টা করি। শরয়ী পর্দার সাথে থাকি এবং বুঝতে পারছি যে, আল্লাহর হুকুম ও নবীজীর তরিকার মধ্যে একমাত্র কামিয়াবি। অন্যকোন মত ও পথে কোন কামিয়াবি নেই।
শুকরিয়া স্বরুপ হাসান ভাইকে একটা কাগজে চিঠি লিখি-
“হাসান ভাই সত্যিই আপনি আমার জীবনকে শুধরে দিয়েছেন। আপনি আমার নাজাতের রাস্তা খুলে দিয়েছেন। এতোদিন আমি নিকষ কালো অমানিশার ভেতরে হাবুডুবু খাচ্ছিলাম।আপনার উসিলায় আমার জীবনধারা বদলে গেছে। আমার জন্যে দোয়া করবেন মহান প্রভুর দরবারে। আর আমার পথচলা এখন আল্লাহর পথে। আলহামদুলিল্লাহ।
আজ দু’বছর হলো আমাদের বিয়ে হয়েছে। অবাক হচ্ছেন তাইনা?
আমার এমন পরিবর্তনে আমার বাবা-মা খুব খুশী হন। ওনাদেরকে আমি সবকথা খুলে বলি। সাথে আমার ভালেবাসার কথাও। বাবা শুধু আমাকে ধৈর্য ধরতে বলেছেন। হাসান ভাই মানে আমার জামাই যখন মাস্টার্স কমপ্লিট করে তখন আমার বাবা ওনাকে আমাদের অফিসে ম্যানেজার পদে চাকুরী দেন। আমার শশুর-শাশুড়ী কে খবর দিয়ে ঢাকায় আনেন। ওনাদেরকে আমার বাবা সব কথা খুলে বলেন। আমার জন্যে আমার শশুরের কাছে আমার বাবা তার ছেলেকে ভিক্ষা চান। শশুরের উত্তর ছিলো, হাসানতো তোরই ছেলে। তোর কাছে থেকে পড়াশোনা শেষ করেছে। তুই তোর অফিসে চাকুরি দিলি। তুই এখন হাসানের অভিভাবক। তোর উচিত ছিলো বিয়ের ডেট ঠিক করে আমাকে খবর দেয়া। কথাগুলো বলেই ওনারা কোলাকুলি করতে লাগলো। ওইদিন রাতেই ইসলামের ধর্মীয় মোতাবেক আইন মেনে আমাদের বিয়ে হয়। শশুর শাশুড়ীর পা ছুয়ে সালাম করে পরবর্তী জীবনের পথ চলা শুরু করলাম। আমাদের জন্য সবাই দোয়া করবেন। আল্লাহ হাফেজ।