পরের ট্রেনে যাবি নাকি আগের মত শেষ ট্রেনেই যাবি বলে ঠিক করেছিস রাজশাহী স্টেশনে বসে আছি। একের পর এক ট্রেন ছুটে চলেছে। আমি বরাবরের মত শেষ ট্রেনেই যাব বলে প্লাটফর্মে বসে আছি। মনে মনে ভাবছি আজ তবে গল্পের শেষ হল। স্টেশনে ভাললাগার সবকিছুই আছে। ওভারব্রীজ সাথে সোডিয়াম আলোর নিচে টং দোকান। হ্যা, সাখাওয়াত আর আমার তো স্টেশনের এই দুটো জিনিস অনেক বেশি পছন্দের ছিল। এসব যখন ভাবছি তখনি পাশে থেকেই একটা মেয়েলি আওয়াজ এলো, ভাইয়া, আপনি এখানে? পাশে তাকিয়ে দেখি নিহা দাড়িয়ে আছে।
ওকে এখানে এতোদিন পরে দেখব এটা আমি কখনই ভাবতে পারছি না। সময় পাল্টালেও আগের মতই আমার একটা অভ্যাস রয়েই গেছে। তাই তাকে বললাম, এইতো ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করছি বলেই ভাবতে লাগলাম তার সমন্ধে যে, ও এখানে কি করছে? তারপর মনে হল ওর বাসা রাজশাহীতেই তাই ও এখানে থাকতেই পারে কিন্তু একা কেন? ওর স্বামী কোথায়? তাছাড়া আজকেই বা কেন দেখা হতে হবে? সাখাওয়াত কি ওকে দাওয়াত করেছিল? আর যদি করেই থাকে তবে বিয়ে তো কাল শেষ হয়েছে তবে আজ এসময়ে এখানে কি করছে? এসব যখন মনে মনে ভাবছি তখনি নিহা বলল, জিজ্ঞেস করবেন না আমি এখানে কিভাবে এলাম? আমি কিছু বলতে যাব তখনি ও আবার বলল, আপনি অবশ্য কখনও কিছু জিজ্ঞেস করেন না।
নিজের মনকেই সব প্রশ্ন করে তারপর নিজে থেকেই উত্তর খুজে নেন। আগের মতই রহস্য নিয়ে থাকতে ভালবাসেন আপনি। আমি বললাম, অনেক কিছুই জানো দেখছি আমার ব্যপারে। ও বলল, জানতে হয় আমাদের। কেউ তো আর এতকিছু চিন্তা করে না। আমি বললাম, তোমার স্বামী কোথায়? ও বলল, আছে আশে পাশে। তো আপনি জানতে চাইবেন না আমি এখন এখানে কি করছি? আমি বললাম, তোমার বাসা রাজশাহীতেই, তাই এখানে তুমি থাকতেই পারো, এটা জানার কি আছে? ও একটু চুপ থেকে বলল, আমি কি আপনার পাশে বসতে পারি? আজকে কি আমি যা জিজ্ঞেস করব তা দয়া করে বলবেন আমায়? আমি একটু চিন্তা করে বললাম, হুম বস।
আর ভাবছি, কি এমন জিজ্ঞেস করবে? সব কিছু তো আর বলা যায় না তাই বললাম, সময় হবে কিনা সবকিছুর উত্তরের তা বলতে পারছি না। তাছাড়া তুমি নিশ্চয়ই এখানে তোমার স্বামীর সাথে কোন কাজে এসেছো। সেও নিশ্চয়ই আমার সাথে এভাবে বসে কথা বলাটা ভালভাবে নিবে না, তাই না? নিহা একদৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, আমার ব্যপারটা আমার উপরেই ছেড়ে দিন প্লিজ। আমি হাসলাম এটা শুনে। বললাম, পরের ট্রেন আর কিছুক্ষনের মধ্যেই আসবে। ও বলল, কেনই বা ইগনোর করছেন আমায়। আপনি নিশ্চয়ই পরের ট্রেনে যাবেন না। আপনি তো শেষ ট্রেন ছাড়া যান না তবে আজ কি নতুন কিছু হতে চলল? আমি সামনে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লাম। নিহাকে বললাম, তো বল কি জানতে চাও তুমি? নিহা বলল, যতদুর আমি জানি ভার্সিটিতে আপনাদের একটা ভাল ফ্রেন্ড সার্কেল ছিল।
ভার্সিটির এই বন্ধুগুলোকে নিয়েই সাখাওয়াত ভাই আর আপনি একটা গল্প লিখা শুরু করেছিলেন। দুজনে অফিস শেষে অনেক কষ্ট করে হলেও একটু একটু করে গল্পটা লিখছিলেন। আমাকে সেই গল্পটির ব্যপারে একটু বলুন। আমি একটু অবাক হয়ে বললাম, তোমাকে গল্পটির ব্যপারে কে বলেছে? এটা তো সাখাওয়াত আর আমি ছাড়া কেউ জানে না। ও বলল, যেহেতু আপনি আর সাখাওয়াত ভাই ছাড়া কেউ জানে না তাহলে ভেবেই দেখুন কে বলেছে? আমি আর কিছু না বলে শুধু একটা কথাই বললাম, সব বলব, তার আগে একটা কথার উত্তর দাও? ভার্সিটি শেষ করার তিন বছর হয়ে গেল। তোমার কি তবে সাখাওয়াতের সাথে কথা হত? ও বলল, হুম, আমার দরকার হত তার সাথে কথা বলার।এরপর একটু চুপ থেকে বলতে শুরু করলাম,
আমাদের ফ্রেন্ড সার্কেলটা অন্য সব সার্কেলের মত ছিল না। সবাই সবার মত ছিল তবে একে অপরের প্রতি ছিল গভীর টান। তার মধ্যে অন্যতম ছিলাম সাখাওয়াত আর আমি। তাই ভার্সিটি শেষ করে যখন সবাই চাকরীর জন্য বিভিন্ন জায়গায় চলে গেল, আমরা তখনও এক জায়গায় ছিলাম। এরপরই সিদ্ধান্ত নেই গল্প লিখার। যেটা একটা বই বানিয়ে আমাদের সবাইকে দেওয়ার কথা ছিল। তো দুজনে শুরু করলাম গল্প লিখা। দুজনে চিন্তা করে, পরামর্শ করে গল্পের প্লটগুলো সাজিয়ে লিখছিলাম। কিন্তু তখনি মাথায় এলো গল্পে আমরা সবাই মুল চরিত্রে। তবে এসব চরিত্রে তো শুধুই আড্ডা, মাস্তি, বিভিন্ন ভাল কাজ, একে অপরের প্রতি ভালবাসা, রাগ অভিমান দেখালেই হবে না, সাথে কিছু বিপরীতধর্মী ভালবাসা থাকতে হবে।
যদিও সবার বয়ফ্রেন্ড, গার্লফ্রেন্ড সমন্ধে জানতাম অল্প করে, তবুও ওই অল্পর ওপর ভিত্তি করেই মোটামোটি সবার ভালবাসার গল্পগুলো সাজালাম। সত্যি বলতে অনেক মজা হচ্ছিল এসব লিখতে। কিন্তু সমস্যায় পরে গেলাম আমরা দুজন। যদিও আমি জানতাম যে সাখাওয়াত আমাদের ক্লাসমেট মুনিয়াকে পছন্দ করত তবুও ওর জন্য সেটা প্রকাশ করতে ইচ্ছে হল না। দুজনে এই পর্যায়ে এসে যখন আর সামনে এগোতে পারছিলাম না তখন আমি ওকে আলাদা আলাদা লিখার কথা বলি। বলি যে, ওর গল্পটা আমি লিখব আর আমার গল্পটি ও লিখবে। ও রাজি হল এতে। আমি সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলেছি যে সত্যিটাই লিখব। ওর গল্পে আমি মুনিয়াকেই ওর বিপরীতে সাজাবো। তেমনিভাবেই দুজনেরই গল্প লিখা শেষ হলে কিছুদিন পর আমরা একে অপরের গল্পটা পরস্পর পড়ে দেখলাম। গল্পটা পড়ে এরকমি এক স্টেশনে ওভারব্রীজের রেলিংয়ে উঠে সামনে তাকিয়ে ছিলাম।
একসময় আমি ওকে বলি, তোর লিখা আমার গল্পটা কিন্তু অহেতুক একটা বস্তুকে নিয়ে। সাখাওয়াত তখন বলেছিল, আসলেই কি অহেতুক কিছু? আমি মুনিয়ার ব্যপারে অনেক কিছুই বলেছি তোকে তাই ওটাই লিখেছিস তুই। কিন্তু তুই না বললে যে আমি কিছুই জানতে পারব না, এটা কি করে ভাবলি তুই? আমি তোর বন্ধু, তোকে একটু হলেও চিনি আমি। তুই যেটাকে অহেতুক বলছিস সেটাই এই পৃথিবীর এক অপ্রকাশ্য সত্যি। আমি ওকে বলি, আমি কি তোকে কখনও এ ব্যপারে জানিয়েছি? ও বলল, না জানালেও কি তুই বুকে হাত রেখে বলতে পারবি যে লিখাগুলো মিথ্যে? আমি এবার ওর দিকে তাকিয়ে বলি, সবার গল্পে নায়িকা থাকে না রে দোস্ত। এবার একটু চুপ থেকে সাখাওয়াত আমাকে বলল, তাহলে আর কিছুই প্রকাশ হবে না। আমার গল্পটাও না। এই গল্প আমি আর লিখছি না। এরপর এটা নিয়ে আমাদের দুজনের মধ্যে অনেক কথা হয়েছে, খানিকটা তর্কও হয়েছে।
এই তর্কের জন্যই আমরাও দুজন থেকে আলাদা হয়ে যাই। ভেবেছিলাম ভার্সিটি থেকে বের হওয়ার পর প্রথম নতুন বছরে সবাইকে গিফ্ট করব বইটা। আজ তিন বছর হতে চলল কিন্তু সেই গিফ্ট আর কাউকে দেওয়া হল না। এখানেই শেষ হয়ে যায় আমাদের গল্প লিখা। এরপর আমাদের দুজনের মধ্যে সম্পর্ক স্বাভাবিক হলে আমি আবারও চেষ্টা করি গল্পটি শেষ করার। কিন্তু কোনরকমে পেরে উটছিলাম না। তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, আমার লিখা সাখাওয়াতের গল্পটিকে সত্যি করে তবেই তা প্রকাশ করব। আর তাই আজ এখানে। নিহা বলল, কিভাবে সত্যি করলেন সাখাওয়াত ভাইয়ের গল্পটাকে? আর কিই বা ছিল আপনার লিখা তার গল্পতে? আমি বললাম, ওই যে বললাম না সব কিছু সবার পেছনে থেকে দেখে আমি একটা পৈশাচিক মজা পাই। তেমনি ভার্সিটিতে একদিন দেখি সাখাওয়াত মুনিয়ার সাথে কথা বলছে।
ও অনেক মেয়ের সাথেই টুকটাক ফ্রি তাই কথা বলতেই পারে। কিন্তু এর দুদিন পরেই ক্যান্টিন থেকে দুজনকে একসাথে হাসতে হাসতে বের হতে দেখলাম। ব্যপারটা কেমন যেন লাগলো তাই রাতে তাকে এই ব্যপারে অনেকটা চেপে ধরি। ও তখন বন্ধু বলে কাটিয়ে দিতে চাইলে আমি আরও চেপে ধরি। তখন ও বলে, সাখাওয়াত নাকি পছন্দ করে মুনিয়াকে কিন্তু তা কখনও মুনিয়াকে জানায়নি। আর অন্যদিকে মুনিয়া ওকে শুধুই বন্ধু ভাবে। এর মাঝে আরও অনেক কিছুই হয়েছে যেটা তোমাকে বলা যাবে কিনা বুঝতে পারছি না। তাই আমি ভার্সিটির পরের কথাই বলছি। সাখাওয়াত আমি গল্প লিখার সময় আলাদা হয়ে গেলে আমি মুনিয়ার খোজ নিতে থাকি। সত্যি বলতে মুনিয়ার বাসা আমার জেলাতেই আবার একই থানায়। কিন্তু আমি শুধু জানতাম একই জেলায়। তাই ভাল ভাবে খোজ নিয়ে জানতে পারি একই থানাতেই। তাই তার সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করি। মুনিয়ার বন্ধুদের দারা তার নাম্বারটা পেয়ে রাতে তাকে ফোন দিয়ে নিজের পরিচয় বলি।
ও আমাকে সেদিন ডিরেক্ট বলে যে আমি কেন তাকে ফোন দিয়েছি? আমি তখন ওকে একটা রেষ্টুরেন্টে দেখা করার কথা বলি। আশ্চর্যজনক ভাবে ও রাজী হয়। ওর সাথে দেখা করার পর আমি সাখাওয়াতের সব কথা তাকে খুলে বলি। ও আমাকে তখন অবাক করা কিছু কথা বলে। সাখাওয়াত ওকে তৃতীয় বর্ষে থাকাকালীন একবার প্রপোজ করেছিল। সে রাজিও হয়েছিল। তবে সাখাওয়াত আমাদেরকে তার থেকে বেশি সময় দিত এটা মুনিয়া মেনে নিতে পারে নি। তাই সাখাওয়াতকে সে বলেছিল, আমাদের সাথে কম মিশতে। সাখাওয়াত সেদিন মুনিয়াকে বলেছিল, একদিন আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলে যে এই ভার্সিটি শেষে আমার ফিরে আসার মত কোন পিছুটান থাকবে কি না? আমি সেদিন হেসেছিলাম। আজ বলছি, মনের মত কিছু বন্ধু আছে আমার যাদের জন্য সবকিছু করতে ইচ্ছে হয় আমার।
এই বন্ধুরাই আমার পিছুটান। আর তুমি এদেরকেই ছেড়ে দিতে বলছ। তখন মুনিয়া তাকে বলে, তোমার কাছে আমি বেশি না তোমার বন্ধুরা বেশি? সাখাওয়াত বলে, তুমি আমার জিবনে আলাদা কেউ। আর তারা আলাদা। তাদের সাথে আমি তোমার তুলনা করতে পারছি না। তবে এখন নাহয় তাদের একটু বেশি সময় দিচ্ছি কিন্তু একসময় তো শুধু তোমারই থাকব আমি। মুনিয়া সাখাওয়াতকে বলেছিল, তার মানে এখন আমার থেকে তারা বেশি গুরুত্বপুর্ন? সাখাওয়াত বলেছিল, মুনিয়া, তুমি ভুল ভাবছো। কিন্তু বিভিন্ন কথা কাটাকাটির মাঝে সেদিন তাদের সম্পর্কটা ভেঙ্গে গিয়েছিল। কিন্তু মুনিয়া আমার সাথে দেখা করার পর বুঝতে পেরেছিল যে সাখাওয়াতের বন্ধুরা খারাপ ছিল না। মুনিয়া তার ভুলটা বুঝতে পেরেছিল। আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম মুনিয়াকে, সাখাওয়াতকে সে এখনোও ভালবাসে কি না? সে চুপ থেকে মৃদু শব্দে বলেছিল, সাখাওয়াত কি আমাকে ক্ষমা করবে? আমি হেসেছিলাম সেদিন। আসলে ভার্সিটির পর সাখাওয়াত কোন মেয়ের সাথে ভালভাবে কথাও বলত না।
সারাদিন কর্মরত দিনের শেষে যখন সোডিয়াম নিয়নের আলোতে দাড়িয়ে দুজনে দুই কাপ চায়ের সাথে নিজের ভেতরে জমানো কষ্টগুলো সামনে অন্ধকার আকাশে ছড়িয়ে দিতাম তখন মনে হত এখনোও সাখাওয়াতের ভেতরে কেউ একজন আছে। মুনিয়াকে এখনও ভালবাসে কিনা এটা নিয়ে সন্দেহ হলেও আমি নিশ্চিত ছিলাম না। তবে মুনিয়ার থেকে এসব শোনার পর আমি অনেকটা নিশ্চিত হয়েই যাই যে সাখাওয়াত এখনোও মুনিয়াকে ভালবাসে। আর এজন্যই আমার লেখা গল্প প্রকাশ করতে তার সমস্যা মনে হয়েছিল। আমি মুনিয়াকে সব কিছু বলার পর বলি, সে এখনোও তোমার অপেক্ষায় আছে। যাও তার কাছে। আর কতই বা একটা ছেলে সহ্য করতে পারে বল। মুনিয়া কেঁদেছিল সেদিন অনেক। বলেছিল, আমাকে সাখাওয়াতের কাছে নিয়ে যাও প্লিজ। আমিও যে আর পারছিনা তাকে ছাড়া চলতে। আমিও তো তাকে ছাড়া কাউকে ভালবাসতে পারিনি। আমি তখন তাকে তৈরী হতে বলি ঢাকায় আসার জন্য সেদিনই আমরা এই ব্যস্ত শহরে চলে আসি।
সেদিনও সাখাওয়াত সোডিয়ামের আলোতে এক কাপ চায়ের সাথে নিজের কষ্টগুলো হাওয়ায় মিশাবে বলে ঠিক করেছে। তাই সে টং থেকে এক কাপ চা অর্ডার করল। প্লানমত আমি সেখানে গিয়ে বললাম, মামা লাল চা টা সহ আরও দুটো মালাই চা দিন। অর্ডার দিয়েই যখন বিলটা আমি সাথে সাথেই দিয়ে দিলাম তখনিই সাখাওয়াত বলল, দুদিন কই ছিলি। বাসায়ও নেই, ফোনেও পাওয়া যাচ্ছে না। আর দুটো মালাই চা কেন, আর একট চা টা কে খাবে? আমি একটু হেসে বললাম, লাল চা টা আমি খাব আর মালাই চা টা তোদের লাগবে। বলেই লাল চা টা নিয়েই যখন আমি অন্যদিকে চলে গেলাম তখনি মুনিয়া তার সামনে আসল।
সাখাওয়াতকে দেখলাম একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মুনিয়ার দিকে। দুজনের তাকিয়ে থাকাতে কি হচ্ছে জানি না। তবে সাখাওয়াত বলল, জানো এখন আমার হাতে অনেক সময় কিন্তু সেই তুমিই নেই যাকে সময় দেওয়ার ছিল। মুনিয়া ক্রন্দন মুখে বলল, আমিতো এসে গেছি। এখন সেই সময়গুলো কি তবে আমায় দিবে? সাখাওয়াত বলল, কি করে দিব? তুমি কি এখনোও আমার আছো? আমার কি সেই অধিকার আছে? মুনিয়া বলল, ছিলাম, আছি, আর যদি একবার আমাকে আমার ভুলের জন্য ক্ষমা করে দাও তবে সারাজিবন থাকবো। মুনিয়ার ক্রন্দনমুখে এ কথা শুনে সাখাওয়াত নিজেকে আর সামলাতে পারলো না। কেঁদে ফেলে মুনিয়াকে সে নিজ বাহুডোরে আবদ্ধ করে নিল। বলল, কিভাবে ছিলে এতদিন ছেড়ে আমায়? মুনিয়া কিছু না বলে শুধু কেঁদেই চলেছে। দৃশ্যটা দেখে সুখের কান্নাটা আটকাতে পারলাম না। তখন শুধু নিজেই কষ্টের ওপারে একটা জাদুর অপেক্ষায় ছিলাম……
তারপর তো সাখাওয়াতের বিয়ে হল। গতকাল তারা আমার প্রিয় রাঙ্গামাটি গেছে হানিমুনে। আর আজ আমি আবারও ব্যস্ত শহরে যাচ্ছি। হ্যা, আমাদের বন্ধুত্বের গল্পটার শেষটা আমি পেয়ে গেছি।
নিহা তখন বলল, আর সাখাওয়াত ভাই আপনার গল্পটা কি লিখেছিল? একটু হেসে বললাম, তেমন কিছু না, ওই যে অহেতুক। তখনি পেছন থেকে শোনা গেল সবার ওপরের কথাটা,
তুই কি পরের ট্রেনে যাবি নাকি আগের মত শেষ ট্রেনেই যাবি বলে ঠিক করেছিস? পেছনে ঘুরে দেখি সাখাওয়াত দাড়িয়ে আছে। আমি চট করে উঠে দাড়িয়ে বললাম, তুই এখানে? তোর তো আজ রাঙ্গামাটি থাকার কথা। ও বলল, আমাদের বন্ধুত্বের গল্প লিখাটা আমরা দুজনে শুরু করেছিলাম আর তাই শেষটাও দুজনি করব। এখন বস বাকি গল্পটুকু আমি বলি। অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে ওকে বললাম, কি বলবি তুই? বাদ দে না সব। ভাল আছি তো আমরা। সাখাওয়াত বলল, তুই তোর লিখা গল্পটা সত্যি করেছিস আর এখন আমি আমার লিখাটা সত্যি করব। এখন বস, আমি শুরু করি। আমি ওকে বললাম, চল আলাদাভাবে শুনছি। ও বলল, আমার পুরো গল্পটা তুই নিহাকে বললি আর তোরটা আলাদাভাবে শুনবি, এটা হবে না। এখানেই শুনতে হবে। আমি চুপ করে বসেই থাকলাম কিছু করার নাই আর। সাখাওয়াত শুরু করল….
আমরা যখন তৃতীয় বর্ষে তখন নতুনদের নবীন বরনে কোন এক রুপসীকে দেখে একজন প্রেমে পরে গিয়েছিল। কিন্তু সেই একজনের একটা সমস্যা ছিল। সে নিজের ভেতরের কথা মুখ ফুটে কাউকে বলত না। নিজের সব শেষ হয়ে গেলেও ছেলেটা হাসিমুখে না থাকলেও দুঃখটা বুঝতে দিত না। যদিও অন্য কিছু অনেক সময় বলে তবে প্রেম ঘটিত কোন কথা কখনই বলবে না। তাই ব্যপারটা আড়ালেই থেকে যায়। কিন্তু জিনিসটা ধরা পরে যায় সেদিন, যেদিন নিহা নামের সেই রুপসী মেয়েটার হারিয়ে ফেলা ফর্ম পুরনের টাকাটা নিশ্চুপে সেই একজন দিয়ে দেয়। নিহাকে দেখলাম মুচকি মুচকি হাসছে।
সাখাওয়াত আবারো বলা শুরু করল, ভার্সিটির শেষের দিনগুলোতে সেই রুপসী মেয়ে নিহাকে সেই একজনের হয়ে যখন সবকিছু জানালাম, তাকে সেই একজনের হয়ে ভালবাসার কথাটা বললাম তখন সেই মেয়েটিও তার প্রেমে পরে যায়। মেয়েটি যখন আরও অনেক কিছুতেই সাহায্য পেতে থাকল নিজের অজান্তে, তখন অনেকেই এসে এর সুযোগ নিচ্ছিল। অনেকেই এসবের সুযোগ নিয়ে মেয়েটাকে প্রেমেরও প্রস্তাব দেয়। তখন মেয়েটিকে আমি আবারও সব সত্যিটা জানিয়ে দেই। একদিন মেয়েটি সরাসরিই সেই একজন কে জিজ্ঞেস করেছিল যে সাহায্য করার পরও সামনে বলেন না কেন? কেন নিশ্চুপ থাকেন? অন্য কেউ এসে এটার সুযোগ নিচ্ছিল তবে আপনি কেন এসে বললেন না? সেই একজনের উত্তর ছিল, উদ্দেশ্য ছিল সাহায্য করা। সেটা আমি করেছি। কে এর সুযোগ নিল বা নিল না এটা আমার দেখার ব্যপার না।
আর সাহায্যটা যে আমিই করেছি এটা জানাটা এতোটা জরুরী না। আমার খুব ভাল লেগেছিল সেই একজনের কথাটা। কিন্তু সেই একজন যে মেয়েটাকে অনেক বেশি ভালবাসে এটা ভার্সিটির শেষ দিনে খুব ভালভাবে বুঝেছিলাম। বিদায় দিনে মেয়েটিকে না দেখতে পেরে সেই একজনের দুটি চোখ এদিকে ওদিকে খুজছিল। কিন্তু না দেখতে পেয়ে মাথা নিচু করে মনে হয় একটু কেঁদেছিল সবার অগোচরে। তবে যখন একসময় মেয়েটি তার সামনে এলো তখন সে কিছু বলতে পারলো না। কিছু না বলেই দ্বিধায় পরে একসময় চলে গেল। যদিও মেয়েটি সেদিন অনেক আশা করে এসেছিল। ভার্সিটি শেষ করেও সেই একজন তার মনের ভেতরের সত্ত্বাকে বের করতে পারল না। মেয়েটি অনেক চেষ্টা করেও পারে নি। তাই সেই মেয়েটি আমার সাথে যোগাযোগ রেখে তার খোঁজ নিত।
হঠাত একদিন সেই একজনকে বললাম, নিহার বিয়ে পরশু থেকে। ও কিছু না বলে চলে গেল। নিজে যেন এক আত্মদাতা হয়ে গেছে। বুঝেছিলাম, মিথ্যে বিয়ের কথা বলে কতটা কষ্ট দিয়েছিলাম তাকে। কয়েকটাদিন ঠিকমত অফিসে আসা কাজ করা সবই হল। তবে ভেতরে যে তার আগুন জলছে এটা তার বাইরের শীতলতা কাউকে বুঝতে দিল না। কষ্ট নিয়েই সে তার বন্ধুর কষ্ট দুর করার চেষ্টা করছে আর সেটা মুখে হাসি রেখেই। এটা শোনার পর আমি নিহার দিকে তাকালাম। তার মানে ওর বিয়ে হয়নি। হঠাত একটা ভাললাগা কাজ করল নিজের মনে। সাখাওয়াত আবারও বলল, বুঝেছিলাম সেই একজনের ধৈর্য প্রচুর। তার ভেতরের সত্ত্বা কখনই বের হবে না তবে সেই রুপসী মেয়েটিই যদি একবার তার সামনে এগিয়ে আসে তবে সেও তাকে ফিরিয়ে নিতে পারবে না। আর মহান সেই একজন আমার সামনে বসে আছে। আমার সবচেয়ে ভাল বন্ধু, মামুন।
এসব বলে সাখাওয়াত তাকিয়ে আছে আমার দিকে। আমি তার দিকে তাকিয়ে আছি। পাশে বসে নিহা তার ব্যাগ থেকে কাগজ বের করে সাখাওয়াতের লিখা আমার গল্পটি দেখালো আমায়। আমি একটু দেখে মাথাটা নিচু করে রাখলাম। নিহা পাশে থেকে বলল, এতো ভালবাসা মনের মাঝে জমিয়ে রেখে কষ্ট ছাড়া কি পেয়েছেন বলুন তো? এবার কি তবে আপনাদের বন্ধুত্বের গল্পটা শেষ করা যাবে? আমি কিছু না বলে হেসে চলেছি। চোখে কিছুটা নোনাপানি গড়িয়ে পড়ল। একটু পরেই মুনিয়া টং থেকে চা নিয়ে এসে আমাকে এগিয়ে দিয়ে বলল, তোমাদের বন্ধুদের গল্পের বইটা কবে পাচ্ছি। আমি বলার আগেই সাখাওয়াত বলল, এইতো সামনের নতুন বছরে। গল্পের শেষটা অনেক আগেই লিখা হয়েছিল তবে সেটা সত্যি প্রমানিত করতে একটু সময় লাগলো আরকি। আমি শুধুই শুনছি সবকিছু। সাখাওয়াত এবার আমার ডানপাশে বসল। আর মুনিয়া বসল নিহার বাম পাশে।
মানে মাঝখানে আমি আর নিহা। হঠাত সাখাওয়াত বলল, নিহা তোমাকে বলেছিলাম যা করার তোমাকেই করতে হবে। এর দারা কিছু হচ্ছে না। তখন নিহা একটু কাছে এসে আমার হাতটা ধরল। এর মাঝে পরপর দুটি ট্রেন চলে গেছে। কিন্তু আমার মনে হল কিছুক্ষন হল। আমি এখনোও কোন কথা বলছি না তাই মুনিয়া এবার নিহাকে একটু ধাক্কা দিল যার ফলে নিহা আমার উপরে এসে পরল। আমি বললাম, এই কোন সমস্যা হল নাকি? সাখাওয়াত তখনি হেসে উটলো। সাখাওয়াত এবার আমাকে নিয়ে একটু সাইডে গেল। বলল, নিহা মেয়েটা সত্যি অনেক ভালবাসে তোকে। আর তুইও তো ভালবাসিস তাহলে কিছু বলছিস বা কেন? আমি বললাম, হ্যা, ভাল তো আমিও বাসি কিন্তু কিভাবে কি করি বলতো? মানে আমি তো এসবের জন্য তৈরী ছিলাম না। সাখাওয়াত বলল, বোঝা ওকে যে তুই এখনোও ওকে ভালবাসিস।
আমি বললাম, কেন ও কি বোঝে না। প্রতিটা বারই আমি শেষ ট্রেনে কেন যাই এটা ও বোঝে না? আমিও তো প্রতিটা বারই ভেবেছি এই বুঝি সে এলো। এসে আমার হাতটা ধরে বলল, এবার কি আমাকে সঙ্গে নেবে? কিন্তু না, উল্টো তার স্বামীর কথা জিজ্ঞেস করলে সে বলল যে আশেপাশেই আছে। আমার কি কষ্ট হয়নি তখন? সাখাওয়াত বলল, ভাই ও তোকে ভালবাসে তাই বলে অন্তর্যামী নয়। কি দেখে বুঝবে যে তোর এটা ভাল লাগেনি। আর ওর তো বিয়েই হয় নি। ওকে যখন স্বামীর কথা বলেছিলি ওর কি খারাপ লাগেনি। তুই যখন ওর বিয়ের কথা শুনেছিলি তখনও হাসিমুখে ছিলি। কি করে বুঝবে ও এসব। সাখাওয়াত যখন এসব বলছিল তখনি নিহা এসে আমার হাতটি ধরে বলল, এবার কি তবে নেবে আমাকে সঙ্গী করে? আমি শুধু তোমার সাথেই এই জিবনে তোমার হাতটি ধরে অনন্ত পথ ভ্রমন করতে চাই। আমি এবার নিহার দিকে তাকালাম।
দেখলাম তার চোখ বহু প্রতিক্ষিত আমার ভালবাসার জন্য অপেক্ষা করে আছে। তাই এবার পেছনে ঘুরে সাখাওয়াতকে বললাম, এই তোর জুনিয়র কোন মেয়েকে ভাবি ডাকতে সমস্যা হবে নাতো। এটা শুনে মুনিয়া আর সাখাওয়াত হাসলো। আমি আবারও বললাম, আচ্ছা তোরা তো এখন চলে যাবি তাই না? মুনিয়া বল, না, আমরা তোমাদের সাথে ঢাকায় যাচ্ছি। আর ঢাকা থেকে রাঙ্গামাটি। আমি বললাম, তাহলে হবে কিভাবে? সাখাওয়াত মুখ ভেঙ্গে বলল, কি হবে? আমি বললাম, ইয়ে, মানে ভালবাসা হবে কিভাবে? কিভাবে ইয়ে করব আরকি? তোরা থাকলে তো লজ্জা লাগে। এটা শুনে মুনিয়া আর সাখাওয়াত হাসতে শুরু করল। পাশে তাকিয়ে দেখি নিহাও মাথা নিচু করে হাসছে। আমি তখন নিহাকে আমার ডান পাশে বাহুতে জড়িয়ে নিলাম।
তারপর সাখাওয়াত আর মুনিয়াকে জিজ্ঞেস করলাম, সবকিছু কিভাবে করলি? সাখাওয়াত বলল, মুনিয়াকে সাথে নিয়ে প্লানটা করেছিলাম। গল্পের শেষটা তো আর তুই একাই করলে হবে না, আমাকেও লাগবে। তাই আরকি। তখনি দিনের শেষ ট্রেনটি প্লাটফর্মে ঢুকলো। আমি তখন তাড়াহুড়ো করে বললাম, কথা বলতে বলতে তো টিকিট টাই কাটা হয়নি। মুনিয়া তখন একটি কেবিনের টিকিট ধরিয়ে দিয়ে বলল, এখন আর ইয়ে মানে ইয়ে করতে মানে ভালবাসতে আর সমস্যা হবে না। বলেই ওরা সবাই হেসে উঠলো। সাখাওয়াত বলল, আমার শশুরবাড়ি তোর জেলায় হল তবে তোরটাও আমার জেলাতেই হচ্ছে।নতুন বছরে তোদের বিয়ে হবে। সব বন্ধুদের দাওয়াত করব।
ওই দিনেই আমরা আমাদের গল্পের বইটা সবাইকে দিব। তাই কষ্ট করে একটু ফ্রি থাকিস, লিখাটা শেষ করে কাভার সম্পুর্ন করতে হবে। আমি মৃদু হেসে বললাম, তুই ঘুরে আয়, আমি ফ্রি থাকব। অবশেষে ট্রেনে উঠলাম। ট্রেন ছেড়েও দিল। নিহাকে পাশে জড়িয়ে নিয়ে আছি। কানে কানে বললাম, ভালবাসি। ও ফিক করে হেসে বলল, ভাগ্যিস এখন বললেন নাহলে তো আমি জানতেই পারতাম না বলে হাসতে শুরু করল। আমিও হেসে মনে মনে বলছি অবশেষে তোমাকে পেলাম। আর হ্যা, আমাদের বন্ধুত্বের গল্পটাও তবে শেষ হল…