“আজকে যাবেন না। এখানে সোজা দাড়িয়ে থাকেন।
বিকেলের দিকে পরিবেশটা একটু শান্ত শিষ্ট থাকে। কোন রোদ থাকে না। আমি যে বাড়িটাতে থাকি তার ছাদ থেকে চট্টগ্রামের এই ছোট্টশহর একটু ভালভাবেই দেখা যায়। চোখ যত টুকু যায় ততটুকু দেখা যায়। চট্টগ্রাম অনেকটা পাহাড়ি এলাকা। আর আমি যে বাড়িটাতে থাকি সেটাও বলতে গেলে একটা ছোট খাটো পাহাড়ের মধ্যে বাড়িটা নিমার্ণ করা হয়েছে। বলতে গেলে পাহাড় আর পাহাড় নেই সব কেটে ঘর বাড়ি নিমার্ণ করে একাকার। ছাদে দাড়িয়ে যখন পরিবেশটা উপলব্দি করতে লাগলাম কিছুক্ষন পর বাড়িওয়ালার মেয়ে ছাদে উঠে। আর যেই আমি মেয়েটার উপস্হিতি টের পেয়ে নিচে নামার প্রশ্তুতি নিলাম ঠিক তখনি আমায় বলল আমি যেন নিচে না নামি। সোজা যেন দাড়িয়ে থাকি। আমি একটু চুপ করে থেকে ইতস্তত করে বললাম…
“আমার কাজ আছে আমাকে এখন যেতে হবে।
আমার কথাটা শুনে মেয়েটা হাত দুটো কোমড়ে রেখে একটু ভ্র কুচকে থাকিয়ে থেকে বলল…
“দেখুন আপনার কোন কাজ নেই সেটা আমি ভাল করেই জানি। আপনি আমার সাথে এমন করছেন কেন? আমাকে দেখলেই আপনি এড়িয়ে চলছেন। কেন করছেন এটা?
সত্য কথা আমার কোন কাজ নেই। আসলে আমরা যখন এই বাড়িটাতে ভাড়ায় উঠি তখন বাড়িওয়ালা, আব্বা আম্মাকে বলছিল “দেখুন বাসা ভাড়া নিবেন ঠিক আছে। সবার ছেলে মেয়ে আছে। আমারো মেয়ে আছে দুটো তবে ছেলে নেই। আমার একটা শর্ত আছে।”
আব্বা তখন মাথা নাড়াতে নাড়াতে বলল…
“হ্যাঁ বলুন আপনার কি শর্ত।
আমি তখন আব্বার পাশে বসে ছিলাম। মূলত ঘর নেওয়া আমার উপর ডিপেন্ড করছিল। আমার যদি রুম গুলো পছন্দ না হয় তাহলে ঘর ভাড়া নেওয়া হবে না। অনেক বিল্ডিং এ আব্বা ঘর খুজেছে কিন্তু আমার পছন্দ হইনি বলে নেওয়া হয়নি। ঘর পছন্দ হলে ছাদ পছন্দ হয় না। আবার ছাদ একটু ভাল মনে হলে ঘরের রুম পছন্দ হয় না। কোন ঘর যদি ভাড়া নিতে হয় তাহলে আমি প্রথমে একদম সোজা ছাদটা দেখি যে ছাদের অবস্হাটা কেমন। যে বাড়িতে থাকব সে বাড়ির ছাদে যদি সময় কাটাতে না পারি তাহলে সেই ঘর ভাড়া নেওয়া দরকার কি? সেই সুবাধে এই বাড়ির ঘর দেখতে আব্বা আম্মা আমায় নিয়ে আসে। আমি যখন রুম গুলো দেখলাম মোটামোটি ভাল তবে তেমন একটা পছন্দ হয়নি। রুম গুলো তেমন একটা বড় না। রুম গুলো দেখে যখন আমি ছাদ দেখতে গেলাম আমি পুরো অবাক হয়ে গেলাম। এই ছাদ থেকে চারপাশটা ভাল করে দেখা যায়। আর ছাদটা মনের মত হওয়াতে আব্বাকে বললাম এইখানে ঘর ভাড়া নিতে পারো আমার ভাল্লাগছে।
আর আগের যে বাড়িটাতে থাকতাম ঐখানের ছাদটাও অনেক জোস ছিল। বিশেষ করে রাতের বেলায় ঐ ছাদেই আমার বেশ সময় কেটে যেত। ঐ বাড়ির খচ্চর মোটা হাবলা মার্কা বাড়িওয়ালা করল কি বাড়ির ছাদে ছোট খাটো রুম তৈরি করে দিল। কি করব আর না করব কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। ছাদে আসা যাওয়া একদম বন্ধ হয়ে গেল। অবশ্য কিছু করার নেই। কে না চায় দুই চার পাঁচ টাকা পকেটে না আনতে? আগের বাড়িওয়ালাও ঠিক তাই করলো। আর এই কারনে অন্য ঘর খোঁজার চেষ্টা। আব্বার পাশে যখন আমি চুপ করে বসে ছিলাম এমন সময় নতুন বাড়ির বাড়িওয়ালা যে কথাটা বলল আমি সেটার জন্য মোটেও প্রশ্তুত ছিলাম না…
“আমার শর্তটা হলো আপনার ছেলে মেয়ে ছাদে উঠতে পারবে না। একি বাড়িতে থাকলে এমনি কথাবার্তা হবে আমি জানি। আজকালের ছেলে মেয়েরা অনেক এগিয়ে কিন্তু আমার মেয়েদের সাথে কথা বলতে পারবে না। এখন ভেবে দেখুন আপনারা।
লোকটির কথা শুনে আমি অনেকক্ষন চুপ করে তাকিয়ে ছিলাম। ব্যাটায় কি বলল এইটা? তাহলে ঘর ভাড়া দেওয়ার দরকার কি? আম্মা আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল…
“জাহেদ কি বলছে শুনেছিস বাবা?
আমি কিছুই বললাম না। আব্বা আম্মা আমার উওর শোনার অপেক্ষায় ছিল। ঐযে বললাম আমার উপর ডিপেন্ড করছিল সব কিছু। আমি একটু সময় নিয়ে আব্বাকে মাথা দিয়ে না শূচক ইশারা দিলাম। আব্বা বাড়িওয়ালাকে বলল…
“আমরা আপনাকে ভেবে পরে বলব।
“আচ্ছা ঠিক আছে। তবে দু একদিনের ভিতরে বলবেন জানেন তো ঘর সব সময় খালি থাকে না।
আমি বুঝলাম না ভেবে দেখার কি আছে? ছাদে যখন উঠতে পারব না। তখন ঘর ভাড়া নিয়ে লাভ কি? ছাদটাকে বেশি প্রাধান্য দেই এই জন্য যে আমি ছাদে উঠে গিটার নিয়ে মাঝে মাঝে গান করি। যদিও তেমন পারি না। সবার যার যার একটা নেশা থাকে। কারো গল্পের বই পড়ার নেশা। কারো খেলাধুলার নেশা। আর আমার গিটার বাজানোর সাথে গান গাওয়ার নেশা।
“কি হলো চুপ করে আছেন কেন? আমার প্রশ্নের উওর আমি এখনো পাইনি।
মেয়েটির কথায় বাস্তবে ফিরলাম। ঐদিন কথাবার্তা বলে আসার পর আব্বাকে বলেছিলাম… ভেবে দেখার কিছু নেই। আব্বা আমায় একটু ধমকের সুরে বলেছিল… দেখ জাহেদ যথেষ্ট হয়েছে। আমি চাকরি করি। চাকরির ফাকে ফাকে ঘর খুঁজেছি কার জন্য তোর জন্য। ছাদে কিছু যায় আসে না। হয় এই বাড়িতে থাক আর না হয় ঐ নতুন বাড়িতে।” আমি কিছু বললাম না। রাতে ভাবলাম এই বাড়িতে তো এখন ছাদেই উঠা যায় না। তাছাড়া নতুন বাড়ির ছাদটা অবাক করার মত। তাছাড়া আব্বা হয়রান হয়ে গেছে ঘর খুজঁতে খুজতে। আর ছাদে গেলে তো বাড়িওয়ালা আমায় পাহারা দিচ্ছে না যে আমি কখন ছাদে উঠব। তবে উনার মেয়েদের সাথে কথা না বললেই তো হলো। আর এই বাড়িতে উঠলাম আজ চার মাস হয়ে গেছে। আমি ওকে বললাম…
“দেখুন আমি আপনাকে এড়িয়ে যাব কেন?
“আমার চোখের দিকে তাকান। আমার চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলুন। আপনি আমাকে মিথ্যে বলছেন।
মানুষ কখন মিথ্যে বলে জানেন? যখন চোখে চোখ রেখে কথা বলার সাহস থাকে না।
এই মেয়ে দেখি একটু বেশি বুঝে। আসলে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে আমি কথা বলিনি। বাড়িওয়ালার দুটো মেয়ে বড়টার নাম উম্মে ইবনাত আর ছোটটার নাম উম্মে মালিহা। আর বাড়িওয়ালার ছোট রাজকন্যাই আমার সামনে দাড়িয়ে কথা বলছে। একটা কথা কি আমি যখন ছাদে এসে চুপি চুপি গিটার বাজাতাম ওরা দুইবোন মিলে দাড়িয়ে শুনত। যেটা আমি দেখতাম না। পিছন থেকে দাড়িয়ে শুনত তো তাই। আর যখন টের পেতাম তখন কিছু না বলে চুপচাপ ছাদ থেকে নেমে যেতাম। এই চার মাসে আমি অনেক দুরে দুরে থেকেছি এদের কাছ থেকে। তবে একটা বিষয় লক্ষ্য করেছি মালিহার বড় বোনকে তেমন দেখতে পেতাম না। কিন্তু প্রতিদিন মালিহাকে ছাদে নজরে পড়ত। তবে কেউ কারো সাথে কথা বলতাম না। বাড়ির গেটের সামনে দেখা হলে নিচে তাকিয়ে, না দেখার ভান করে চলে আসতাম। আমি এবার সরাসরি মালিহার চোখের দিকে তাকিয়ে বললাম..
“আপনার আর কিছু বলার আছে?
আমার কথাটা শুনেই মালিহা আর কিছু বলল না। কথাটা এমন ভাবে বললাম যেন আমি কোন পাত্তাই দিচ্ছি না। আর আমিও ওর চুপ থাকা দেখে ছাদ থেকে চলে আসললাম। অবশ্য ও মনে মনে কি ভেবেছে আমি জানি না। আসলে সত্য কথা বলতে কি সাধারণত একটা মেয়ে যখন এলাকায় বেড়ে ওঠে তখন এলাকার অনেক ছেলেই ঐ মেয়েটার মন পাওয়ার জন্য পিছে লেগে পড়ে। কথা বলার চেষ্টা করে অপেক্ষায় থাকে ইশ মেয়েটার সাথে যদি কথা বলতে পারতাম। আর সেদিক দিয়ে আমি অনেক পিছে। তবে একটা কথা মানতে হবে মালিহা দেখতে ভালই। মেয়েটার ঠোটের কোনে ছোট্ট একটা তিল আছে যেটা ওকে ফুটিয়ে তুলেছে। আমি যখন মালিহাকে ছাদে দেখতে পেলেই চলে আসি বা ওকে দেখেও না দেখার ভান করে এড়িয়ে যাই তখন ঠিকি মালিহার মনে প্রশ্ন জেগেছে আমি ওকে ইগনোর করছি বা মালিহাকে আমার ভাল লাগে না। এটা ভাবা স্বাভাবিক। এক দিন দু দিন এসব বিষয় মাথায় বিরাজ করে না। কিন্তু আজ চার মাস ধরে এই কাজ গুলো আমি করে আসছি। আমার সাথে এর আগে কথা বলার অনেক চেষ্টা করছে কিন্তু তার আগেই আমি কেটে পড়ি। কি করব কিছু করার নেই বাড়িওয়ালার শর্ত বলে কথা।
ছাদে কথার বলার ঠিক দু দিন পর ভার্সিটি থেকে এসে সিড়ি দিয়ে উঠে বাসায় যাবার জন্য উঠতে লাগলাম তখন দেখলাম ও দাঁড়িয়ে আছে। আমি যথারিতি না দেখার ভান করে চলে যেত যাব অমনি আমার সামনে এসে পথ আগলে রেখে বললো “আমিও দেখে নিব আপনি কি করে আমাকে এড়িয়ে চলেন। অনেক ভাব আপনার তাই না? এখনো এড়িয়ে চলে যেতে চাচ্ছিলেন।” আমি কিছুই বুঝলাম না এই কথার মানে কি? আমি কিছু বলতে যাব মালিহা ঠিক তখন আবার বলল….
“ঐ যে কথায় আছে না সোজা আঙ্গুলে ঘি না আসলে বাকা আঙ্গুল দিয়ে ঘি আনতে হয়।
আমি ইতস্তত করে বললাম ” এই কথার মানে কি?
“মানে কিছুই না। আমাকে ইগনোর করা এতটা সহজ?
আমিও দেখে নিব।”
আমি এই কথার জবাব না দিয়ে বললাম “ঠিকাছে এখন যেতে দেন।”
যখন কথাটা বলে একটু থামলাম ও শুধু আমার দিকে তাকিয়ে রইল। ওর তাকানোর ভঙ্গিমা আমার কাছে কেমন জানি লাগল। ও আস্তে আস্তে এক পা দু পা করে আমার কাছে আসতে লাগল আর আমিও একটু ভয় পেয়ে এক পা দু পা করে পিছনে একটু একটু তাকিয়ে এক সিড়ি দু সিড়ি পিছনে নামতে লাগলাম। মনে মনে বলতে লাগলাম আরে কেউ থাকলে এই মেয়ের হাত থেকে আমায় বাঁচাও। একবার ভাবলাম একটা চিল্লানি দেই বাড়িওয়ালা বলে। কিন্তু দিলাম না কারন বাড়িওয়ালা এইসব কথা বিশ্বাস করবে না। মালিহা আমার আরো এক পা সামনে আসল আর আমি আরো এক পা পিছনে গেলাম।
ও একটু হেসে বললো..
“হি হি হি এখনি ভয় পাচ্ছেন?
আমি কিছুই বললাম না। দেখলাম মালিহা আমার সামনে থেকে সরে গিয়ে দেয়ালে পিঠ লাগিয়ে দাড়াল। আমিও দ্রুত সিড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেলাম।
বিকেলে আর ছাদে গেলাম না। এই মেয়ে কি করে আর না করে তার ঠিক নেই। এশার নামাযের পর ছাদে গেলাম। এটা নিশ্চিত এখন মালিহা আসবে না। আমি গিটার টুং টাং করে আর গাইতে থাকলাম। ঠান্ডাও পড়ছে। কিন্তু এখন তো ঠান্ডা পড়ার কথা না। বেশ কিছুক্ষন বাজানোর পর যখন একটু থামলাম তখন পিছন থেকে শুনতে পেলাম….
“কি ঠান্ডা পড়তেছে? আর বাজাবেন না।
আমি একটু অবাক হলাম এই মেয়ে এখন এখানে কি করে? আমি বসা থেকে দাড়িয়ে বললাম…
“আপনি কি চান বলুন তো? আপনি চান আপনার বাবা আমাদের এই বাসা ছেড়ে দিতে বলুক? এসব কেন করছেন আমার সাথে?
মালিহা একটু চুপ করে রইল। আজকের চাঁদটার আলো বেশ ভাল। আমার কথাটা শুনে ওর চেহারা কেমন একটা ফ্যাকাশে হয়ে গেল। যেন খুব কাছের মানুষ তাকে বকা দিয়েছে। চাঁদের আলোতে অনেকটা বুঝা যাচ্ছে। মালিহা আরো একটু সময় নিয়ে বললো…
“কোথায় যাবেন শুনি? আপনাকে আমি যেতে দিলে তো এই বাসা থেকে?
আমি আবারো একটু অবাক হলাম। এই মেয়ে বলে কি? আমি যখন চুপ করে দাড়িয়ে রইলাম কিছু বুঝে উঠার আগেই মালিহা যট করে আমার কাছে এসে আমার ঠোটে ওর ঠোটের উষ্ণতা দিয়ে দিল। প্রায় ৩০ সেকেন্ডের মত ও আমাকে জড়িয়ে ধরে এই কাজটা করল। আমি নিজেকে এখনো বিশ্বাস করতে পারছিনা এটা কি হলো। তারপর আমাকে ছেড়ে দিয়ে মালিহা বলল…
“দেখি এবার এই বাড়ি থেকে কিভাবে যান আপনি। এবার দেখব কেমন করে আপনি আমায় ইগনোর করেন। আমার এই স্পর্শটা আপনাকে আমার কাছে টেনে আনবেই। আমার এই স্পর্শকে অবহেলা করার শক্তি টুকু আপনার নেই। আর বাবা আপনাদের তাড়াবে কেন আমি থাকতে? তাড়াতে দিলে তো?
আমি এখনো চুপ করে রইলাম। কি বলব কিছুই বুঝতে পারছি না। পুরো শরীরটা হঠাৎ করে কেপে উঠলো। আমি অনুভব করলাম শরীরটা কেমন ঠান্ডা হয়ে গিয়েছে। আর এই কথা গুলো বলেই মালিহা একটা হাসি দিয়ে চলে যায়। যাওয়ার সময় একটু থেমে পিছনে ফিরে একটা চোখ টিপা মেরে দৌড় দিল। আমি অনুধাবন করলাম এই স্পর্শের কি এমন শক্তি যা একটা মানুষকে এমন করে মুহুর্তের মধ্যে নাড়িয়ে দিতে পারে? আমি ভেবে পাই না। কিন্তু আমার মনে হঠাৎ করে গান বাজছে “আমি তো প্রেমে পড়ি নি, প্রেম আমার উপর পড়েছে” এই স্পর্শ আমাকে এমন করে টানছে কেন? এই স্পর্শটা আবার দরকার তখন ভালো করে বুঝতে নিতে হবে এর এতো ক্ষমতা কেন যা একটা মানুষকে নাড়িয়ে দেয়…