সে আকাঙ্ক্ষায় জড়ানো প্রেমিকা

সে আকাঙ্ক্ষায় জড়ানো প্রেমিকা

বাসায় ঢুকতেই এক ধরনের নীরবতা আমাকে ছুঁয়ে গেল। শাড়ির আচলে মুখ ঢুকিয়ে মা নিজেকে লুকিয়ে বাঁচলো মনেহয়,ছোটভাই রাতুল-এর ফোন কেটে দেওয়ার তীব্র প্রচেষ্টা, ছোট বোন নিশা’র নতজানু অবস্থা আর বাবার কুচকানো কপালের স্তরীভূত ঘাম।
মিষ্টির প্যাকেটটা টেবিলে রেখে বাবার পাশে বসলাম।
‘কি হয়েছে বাবা?’
নিশা আর রাতুল চলে গেল। বেশ খানিকটা সময় নিয়ে আমার বাম হাতটা ধরলো, দৃষ্টি তখনোও অন্য দিকে। উনার হাতের মাঝে নিজের হাতের নিষ্পেষণ আর কপালে ঘামের মাত্রাতিরিক্তকা আমাকে বেশি ভাবাচ্ছে।

‘পূর্বা’র বাড়ি থেকে ফোন দিয়ে জানালো পূর্বা খুব অসুস্থ, আপাতত বিয়ে দিবে না তারা।’
বুঝতে পারলাম বাবার নিজের ভিতরের চাপ কমে গেছে, হাতের চাপটাই বুঝিয়ে দিল। হাতটা ছাড়িয়ে নিজের রুমের দিকে হাটলাম। রুমে গিয়েও ভেতর থেকে দরজা আটকালাম না, তাতে সবার কষ্টটা বাড়বে।
সন্ধ্যার অনেক পর নিশা চা রেখে গেলো টেবিলে। হয়তো কিছু বলতো, বললো না পরিশেষ।

ফোনটা হাতে নিয়ে কল দিলাম পূর্বাকে। রিসিভ হলো না। রিসিভ না হওয়াটাই স্বাভাবিক, এটা মানতে একটু কষ্টই হলো।
পূর্বা; নিশা বা রাতুল কারো সামনে ওকে পরিচয় করিয়ে দিলে বলবে-‘ভাবী’, আমার কাছে ওর পরিচয়ের কোনো অভাব নেই।
একই বিষয়, একই বিশ্ববিদ্যালয়, একই শিক্ষাবর্ষ, একই ধরনের ‘প্রথম’ হওয়ার উম্মাদনা। দ্বিতীয়বর্ষে একবার ওকে ডিঙ্গিয়ে প্রথম হয়েছিলাম, সেদিনই অপ্রত্যাশিতভাবে আমাকে নিজের করে চাইলো। অনেকটা সময় মন্ত্রমুগ্ধের মতো ওর দিকে তাকিয়ে ছিলাম, ওর বলা প্রতিটা কথাই সফল শ্রোতার মতো শুনেছিলাম, কিন্তু ওর বলা শেষে বলতে হয়েছিলো-‘আর একবার বলোতো কথাগুলো, আমি কিছুই শুনিনি’।

ওখান থেকেই শুরু। প্রথম দিকে মাঝেমাঝেই মনেহতো আমাকে প্রথম না হতে দেওয়াটাই সম্পর্কের শুরু। ভুল ভেঙ্গে দিয়েছে ও নিজেই বহুবার বহুভাবে।

আজ প্রায় ৩ মাস থেকে সে অসুস্থ। সিজোফ্রেনিয়ায় ডুবে আছে। অনেক চিকিৎসার পর ডাক্তার প্রায় সুস্থ দাবি করেছে। আর আজ শুনলাম অন্য কথা।

রাত ৯ টায় বেড়ুলাম পূর্বাদের বাসার উদ্দেশ্যে, রিকশা না পেলে হাটাপথে ২৫ মিনিট।
পূর্বা অসুস্থ হওয়ার পর থেকে আজ ৫৭ তম শার্ট বিসর্জন দিতে যাচ্ছি। ওর একটা বিষয় আমার এমন সময়েও ভালো লাগে, আজ পর্যন্ত পুরাতন শার্ট ছিড়েনি ও, সব নতুন।
রিকশা পাইনি।

কলিংবেল তৃতীয়বার শব্দ করাতে ওর মা দরজা খুললো। দেখেই ক্লান্তির পরিমাপ করা গেলো। মেঝেতে নির্ভার হয়েই বসে আছে পূর্বা। সামনের বেশ কিছুটা জায়গা জুড়ে কাঠগোলাপের টুকরো অংশ। সুস্থ অবস্থায় যতকিছু প্রিয় ছিলো, সেগুলোই এখন নষ্ট করার তালিকায় পরেছে।

ভার্সিটিতে যতবারই দেখা হইছে প্রায় প্রতিবারই কাঠগোলাপ সে আমাকে দিতই। জুবেরী মাঠের শেষ প্রান্তে যেখান থেকে প্যারিস রোড শুরু ঠিক ওখানেই কাঠগোলাপের গাছ। ভাগ্যিস ফুলটা সারাবছরই ফোটে। বছরের কিছু সময় কম ফোটে, কিন্তু পূর্বার যতটা দরকার ততটা ফুল দানের ক্ষমতা সৃষ্টিকর্তা ঐ গাছটাকে দিয়েছেন।

বসলাম ওর পাশেই। ও ওর মতো করেই বসে আছে। সামনে থেকে কিছু ফুল হাতে নিয়ে আমিও ছিড়তে শুরু করলাম। জানতাম আমি শুরু করলেই ও থেমে যাবে।
মাথায় হাত দিতেই আমিও ওর মাথায় বিলি কাটতে শুরু করলাম, ও হাত সরিয়ে নিলো।
অনেকক্ষণ মাথায় হাত বুলিয়ে চললাম।
‘চুড়িগুলো কোথায়?’
প্রশ্নটা করা মাত্রই অন্যঘর থেকে চুড়িগুলো নিয়ে এসে আমার সামনে রাখলো। আমার দেওয়া এই একটি জিনিসই এখন বাকী আছে ভাঙ্গার। চুড়িগুলো হাতে নিয়ে ভাঙতে শুরু করতেই পূর্বা কেড়ে নিয়ে রেখে আসলো।

আমি জানি আজ যা সিজোফ্রেনিয়া কাল তা অটোফেজিয়া হবেই। আজ ভাঙছে বা কাটছে প্রিয় জিনিসগুলো, আর কাল কাটবে নিজের শরীর। হয়তো কোনো সময় নিজের মাংসই সে খাবে।
হঠাৎ আমার পায়ে মাথা রেখেই শুয়ে পরলো। বাঁধা দিলাম না। মাথায় হাত রেখে বিলি কাটলাম।
প্রায় ১১ টা। উঠতে যাবো এমন সময় আমার হাতটি ধরে-‘আমার মাথায় তেল দিয়ে দিবে?’
‘হুম, উঠে বসো’। সহস্র ভালোলাগা থেকে উত্তর দিলাম।
‘আজ না তো, কাল সকালে’।
‘হ্যা, দিব।’
পূর্বার কথায় কোনো অসামঞ্জস্যতা নেই, এটাই শুধু সিজোফ্রেনিয়ার মাঝে পরে না। কিন্তু কোন কথাই স্থায়ী হয় না এখন।
সম্পর্ক শুরুর কয়েকদিন পর থেকেই ওর একটাই দাবী মাথায় তেল দিয়ে, বিলি কেটে, বেনী করে দাও। প্রতিবারই না না না, আজ প্রথম হ্যা।

এখন পর্যন্ত এই একটা কথাই ওর মনে আছে বেশ, আর প্রায় সবকিছুই ভুলে শেষ। মাঝে মাঝে আমারই নতুনভাবে পরিচয় হতে হয়, এমন কি ওর মা-বাবাকেও।

বাসায় ফিরলাম ১২.৩৫ এ। ঘুমাতে যাওয়ার পূর্বমূহুর্তে খুলে রাখা শার্টের দিকে দৃষ্টি পরলো, নিজেরই হাসি পাচ্ছে। ৫৭ তম শার্ট আজ জীবন নিয়ে ফিরতে পারলো।

পূর্বার মা আমাদের বিয়ের বিষয়ে আলোচনার এক পর্যায়ে জিজ্ঞাসা করেছিলো-‘শুধু আমার কাছে তুমি কি নিবে এ বিয়েতে?’
বাড়ির সকলেই মন খারাপ করেছিলো এ কথাতে।
‘আমি কিছু নিবই’-কথাটা বলা শেষ না হতেই সকলের অগ্নিমূর্তি রূপ।
হাসতে হাসতেই বললাম-‘আমার ৫৬ টা শার্ট কিনে দিতে হবে’।
ঘরজুড়ে হাসির শব্দে আর কিছুই বলা হয় নি।
সকালে দরজা ভেঙ্গে ফেলবার মতো শব্দে ঘুম ভাঙলো। দরজা খুলতেই নিশা’র ভাঙ্গা কণ্ঠে-‘তোর ফোন বন্ধ, সেই কখন থেকে ডাকছি, পূর্বা আপু খুব অসুস্থ। আঙ্কেল বারবার ফোন দিচ্ছে।’

মুখে পানি ছিটিয়ে শার্টের বোতাম লাগাতে লাগাতেই বেড়ুলাম। পূর্বাদের বাসায় গিয়ে জুতা খোলার সময় দেখলাম জুতার ভিন্নতা।
পূর্বার বাবা ডাক্তার আনতে গেছে, মা বিছানায় বসে আছে। উনার কান্না কণ্ঠ আর চোখের অশ্রুই বলে দিচ্ছে কী অবস্থা।
পূর্বার ঘরের দরজা খোলা, বিছানার চাদর মেঝেতে পড়ে, কর্ণার স্ট্যান্ড ভেঙ্গে পড়ে আছে। আর এলোচুলে ঘরের এককোণে হাটু গেড়ে বসে আছে পূর্বা। হাতের ইশারা না বুঝেও দরজা লাগিয়ে দিলাম, নতুন কোন ইশারা না করায় বুঝলাম ইশারা ওটাই ছিল।
বসলাম ওর পাশেই, দেওয়ালে হেলান দিয়ে ওর মাথায় হাত রাখলাম। আমার কাঁধে মাথা রাখলো সে, কাঁধটাকে আজ খুব বিশ্বস্থ মনে করলো।

ডাক্তার এসে জানালার পর্দা সরিয়ে মৃদু হেসে চলে গেলো। এ হাসি ডাক্তারী ভাগীদারিত্বের তাচ্ছিল্য হাসি নয়, এ হাসি সমর্থনের, এ হাসি ‘তুমিই ঠিক’ বুঝানোর।
‘মাথায় তেল দিয়ে দিবে না?’ কাধে মাথা রেখেই।
‘হুমম’
উঠে দাঁড়ালো।
আমার হাত ধরে বিছানায় বসালো।
তেল, চিরুনী, চুড়িগুলো বিছানায় আমার পাশে রেখে মেঝেতে বসলো। ছোট্ট একটা বক্স হাতে ওর।
বিছানায় ঝুলে থাকা দু’পায়ের মাঝে ওর মাথাটা রেখে তেলহাতে বিলি কাটলাম নিরন্তর। বেনী গাথলাম, জানি এ বেনী পার্লারে গাথলে উল্টো জরিমানা দিতে হতো।

বক্সটা বিছানায় রেখে দাঁড়িয়ে হাত দু’টো এগিয়ে দিল। দিলাম চুড়ি।
কিছু না বলেই জড়িয়ে ধরলো, ছাড়ানোর চেষ্টা করলাম না। মুখটা বুকে গুজিয়েই বললো-‘ওই বক্সটাতে সব ঔষধ আছে, খাইনি।’
চমকে উঠলাম, ছাড়াতে চেষ্টা করলাম।
আরো জোরে জড়িয়ে আবার বললো-‘মাথায় তেল দিয়ে দিবে না বলেছিলে, আজ দিয়েই নিলাম। আজ বলো, ভালোবাসবে আমাকে এমন করেই?’
একমূহুর্তেই বুঝে গেলাম সে রোগী নয়, সে আকাঙ্ক্ষায় জড়ানো প্রেমিকা।
এবারোও ছাড়ানোর চেষ্টা ব্যর্থ। জড়িয়ে ধরলাম নিজেও। বললাম-‘৫৬ টা শার্ট দাও, ভালোবাসবো তাহলে।’

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত