মুংলি আর বাঘ

মুংলি আর বাঘ

বাঁধের উপর দিয়ে ছোট ছোট পা ফেলে উদ্দেশ্যহীন ভাবে হেঁটে চলেছে মেয়েটা। আসলে ও মাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। দু’গালের উপর জলের দাগ শুকিয়ে গেছে অনেকক্ষণ।

বাঁধের গা লাগোয়া জঙ্গল, জঙ্গল লাগোয়া নদী, হেড়োভাঙা নদী। কোটালে ভরা গাঙের জল বাঁধ ছুঁয়েও কিছুটা উপরে ওঠে- বাঁধের একপারে গ্রাম এক পারে জঙ্গল। গ্রামটা বাঁধের বেশ কিছুটা নীচে অবস্থিত। কোটালে নদীর জল অনেকটা বাড়োলেও বাঁধ থাকার দরুন তা গ্রামে প্রবেশ করতে পারে না। কিন্তু উদ্দাম ঝড়বৃষ্টিতে বাঁধের গা ধ্বসে গেলে নদীর জল ঢুকে পড়ে গ্রামে, প্লাবিত হয় গ্রাম নদীর নোনা জলে। মানুষ তখন ঘরবাড়ি ছেড়ে আশ্রয় নেয় উঁচু বাঁধের অক্ষত অংশে বা রাস্তায়। নোনা জল ভাঁটার টানে আবার সরে গেলেও লবণাক্ত জলের কারণে চাষের জমি আর চাষযোগ্য থাকে না বেশ কয়েক বছর। চাষীদের ঘরে ঘরে তখন দুর্দশার অন্ত থাকে না। ভাঙা ঘরে অনাহারকে সঙ্গী করে কোনরকমে বেঁচে থাকতে হয় তাদের।

এখন ভরা কোটালের ভাঁটা। নদীর জল নেমে গেছে অনেকটা। মায়ের সঙ্গে জলে জঙ্গলে নেমে অভ্যস্ত মেয়েটা এবার পা বাড়ায় জঙ্গল পেরিয়ে নদীর দিকে। ভয় পেতে এখনও শেখেনি ও। কখনও বাঘ দেখেনি, বাঘ যে ভয়ের বস্তু তা ওর জানা নেই। জুজুর ভয়ের মত তাই বাঘের ভয়কেও উপেক্ষা করে।

ঝলমলে একটা সকাল। পাখপাখালির ডাকে এখন মুখরিত এ অরণ্য। নীল আকাশে সাদা কুচো কুচো মেঘের শীতের অকাল আস্তর। গরাণ গেঁওয়া বানী গাছের ফাঁক গলে ঝুরো রোদ্দুর দৌড়ে বেড়াচ্ছে ওর ছোট্ট শরীর ঘিরে। ও জানে এ-সময় মা জঙ্গলে অথবা নদীরে চরের দিকেই আছে জ্বালানী কাঠের সন্ধানে। কিন্তু জানে না, সেটা পুবপাড়ে না উত্তরপাড়ের জঙ্গলে।

চার মেয়ে নিয়ে সংসার শ্রীমন্ত আর মুংলির। গ্রামের স্কুলটা ওদের বাড়ি থেকে অনেক দূরে বলে, পড়াশোনা করার জন্য তিন মেয়েকে ওরা রেখে এসেছে ভিনগাঁয়ে বুড়ো বাপ-মায়ের কাছে শহিদনগরে। ভালো স্কুল আছে ওখানে। বর্দ্ধিষ্ণু গ্রাম। তাই লেখাপড়ার সঙ্গে সঙ্গে ভালো আদবকায়দাও শিখবে। এখানে এই নদী, জঙ্গল লাগোয়া আদিবাসী পাড়ায় শিক্ষার কোন প্রসার ঘটেনি এখনও। নেই কোন দোকানপাট বা বিদ্যুতের ব্যবস্থাও। সন্ধ্যা হলেই তাই দুটো কিছু মুখে দিয়ে কেরোসিনের লম্ফে ফুঁ দিয়ে মাটিতে হেঁতাল পাতার নিজেহাতে বোনা চাটাই বিছিয়ে শুয়ে পড়তে হয়।

শুধু বাদায় খেলাধূলা করে, পুকুরে সাঁতার কেটে, ছাগল গরু হাঁসমুরগী চরিয়ে দিন কাটে বাচ্চাদের। আর একটু বড় হলেই ছেলেরা যায় নদীতে মাছ ধরতে। আর তেরো চোদ্দ বছর বয়সে পা দিতে না দিতে বিয়ে দিয়ে দেয়া হয় মেয়েদের, চলে যায় তারা শ্বশুরঘর করতে।

শ্রীমন্তর কোনো ছেলে নেই, ও চায় না অশিক্ষিত অবস্থায় ওর মেয়েরা তাড়াতাড়ি বিয়ে করুক তাই এই লেখাপড়ার ব্যবস্থা। ছোট মেয়েটা বড্ড ছোট, তাই ওকে নিজের কাছে রেখেছে। যদিও ওরা আজকাল বেশ বুঝতে পারছে, আদরে আদরে খুব জেদি আর অবাধ্য হয়ে যাচ্ছে ওই আড়াই তিন বছরের অসীমা। ওকে এবার ওর দিদিদের কাছে পাঠানো দরকার, কিন্তু গরুবাছুর চাষবাস ঘেরা সংসারে কি বাচ্চা-কাচ্চা ছাড়া আঁটকুড়োর মত দিন কাটান যায়? এই দো-টানায় পড়ে ছোটটাকে তাই পাঠানো হয়নি শহিদনগরে বাবা-মায়ের কাছে।

সুন্দরবন অঞ্চলে বাঁধ লাগোয়া এই গ্রামটার নাম আদিবাসী পাড়া। মাত্র কয়েকঘর আদিবাসী পরিবারের বাস এখানে। খড়ের ঘর ছাড়া কোন পাকাবাড়ি নেই। পিচ বা ইঁটের রাস্তাও নেই। ঝড়ে মাটির ঘরের খড়ের চাল উড়ে যাওয়া আর কাঁচা রাস্তায় হাঁটু সমান কাদা ভাঙা নিত্য অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগই হোক বা অনাহারই হোক খোলা আকাশের নীচে রাত কাটাতে হলেও কারো বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ নেই। সব কিছু মুখ বুজে সহ্য করে ওরা।

সকালে শ্রীমন্ত গেছে মাঠে কাজ করতে। যেমন রোজ যায়। মুংলি একবার ভেবেছিল ভাসা কাঠ আনতে অসীমাকে সঙ্গে নেবে। কিন্তু মেয়েটা খুব পাজি। একটুও হাঁটতে চায় না। কোলে নিতে হবে ওকে। মাথায় কাঠের বোঝা নিয়ে মেয়ে কোলে কি হাঁটা যায়? আর আজ এই ঠান্ডায় ঘুম ভাঙিয়ে তুলে ওকে জঙ্গলে নিয়ে যেতে ইচ্ছে করছিল না।

কাল রাতে পিঠে বানিয়ে তারপর খেয়েদেয়ে শুতে শুতে রাত ভারি হয়ে গেছে। সকাল থেকে পেটটাও কেমন মোচর দিচ্ছে বার বার। এদিকে ঘরে জ্বালানী নেই। কিসে রান্না হবে তার ঠিক নেই। জঙ্গলে গিয়ে নদী থেকে দুটো ভাসা কাঠ কুড়িয়ে এনে দুপাটা জাল ফেলে মাছ ধরে একটু হালকা করে ঝোলভাত বানাতে হবে। কিন্তু মেয়েটাও হয়েছে তেমন! ঘুম ভেঙে ঘরে মাকে দেখতে না পেলে উঠে কাঁদবে। কী করা যায়? দোনোমনা করতে করতে ঘুমন্ত মেয়ে ঘরে রেখে একাই বেরিয়ে যায় মুংলি।

জঙ্গল পেরিয়ে শেষ কান্নার রেশের ফোঁপানিটুকু নিয়ে চরে পৌঁছে যায় অসীমা। মাকে দেখতেও পেয়ে যায়। এক বোঝা ভাসা কাঠ মাথায় উঠে আসছে তার মা নদী থেকে। নতুন করে চিৎকার জুড়ে দেয় সে। মেয়েকে দেখতে পেয়ে আর তার কান্না শুনে মুংলির প্রাণটা আকুল হয়ে ওঠে। মাথার বোঝাটা জঙ্গলে ফেলে দৌড়ে গিয়ে কোলে তুলে নেয় বাচ্চাটাকে।

“সব্বোনাশ! একা একা চলে এইচিস, কি সব্বোনাশ, যতি বাগে ধরত? নদীর থে কুমির উটি ধরি নে যেত? তবে কারে কোলে নে আদর করতুম আমি হ্যাঁ?”

“তুই আমারে একা ঘরে একা একা থুয়ে রেকে কেনে চলে এইচিস? হ্যঁ-হ্যঁ-হ্যঁ-”, মায়ের কোলে উঠে মাকে জড়িয়ে ছোট ছোট হাতে তাকে কিলচড় মেরে মেরে কাঁদতে লাগল মেয়েটা।

ওকে একটু ঠান্ডা করে মাথায় আবার কাঠের বোঝা তুলে কাঁখে মেয়ে নিয়ে ঘরে এল মুংলি। থালায় করে কিছু বাসি পিঠে নিয়ে খেতে বসল মা-মেয়ে। পেটের মোচড়নিটা কমেছে এখন।

***

ধান বাদায় আর আলু বাড়িতে (ক্ষেতে) জল সেচ দিয়ে একটু তাড়াতাড়ি ঘরে ফিরে এসেছে শ্রীমন্ত।

“রান্না করিচিস? মাছ ধরিচিস?

“এট্টো ফলই মাছ শুধু পেইচি, ঝোল ভাত করচি। চ্যান করি ন্যাও ভাত বাড়ি, খিদা লাগছে জোর। তাড়াতাড়ি ন্যাও।”

“আইজ কী হইছে জান? ওরে ঘরে থুয়ে ভাসা আনতি গেসলুম। দেকি না একা একা ঘুমের থে উটি চরে গে দাঁইরে আচে আর আমারে দেখি কানতে লেগিচে।”

শ্রীমন্ত শুনল কিন্তু কোন উত্তর দিল না। একটু তেল চেয়ে নিয়ে কাঁধে গামছা ফেলে ঘাটে চলে গেল।একটা চরবেড় জালের উপর ভরসা করে সংসার চলে তার। নদীর দয়ায় কোনদিন নামিদামি মাছ পেলে আড়তদারের কাছে বেচে আসে সে। মনটা সেদিন খুব খুশি থাকে। যদিও মাছ বিক্রির টাকা সঙ্গে সঙ্গে হাতে পায় না।

আড়তদার সেই মাছ চালানের পর, সেদিনের বাজার দরের অনুপাতে জেলেদের ধরা মাছের দর নির্ধারণ করে। অনেকসময় বাজার মন্দা থাকলে আড়তদার যা টাকা হাতে তুলে দেয় তাই মেনে নিতে হয়। জেলেদের দাম যাচাই করার কোন সুযোগ থাকে না। লেন-দেনের সবটুকুই আড়তদারের ইচ্ছের উপর নির্ভর করে।

মূল মাছের পাইকারি বাজার সোনাধূলি এখান থেকে প্রায় ত্রিশ কিলোমিটার রাস্তা। অতদূরে গিয়ে মাছ বেচে, তারপর আবার গাঁটের পয়সা খরচ করে অতটা রাস্তা ফিরে আসা সম্ভব নয়। এতে অনেকসময় পড়তা পড়ে না। ফলে গ্রামের সব জেলেরই ভরসা পাড়ার মধ্য আড়তদার আর তার মৌখিক হিসাব।

এখানকার সাধারণ লোকেরা কোনদিন গলদা বা বাগদা চিংড়ি প্রাণে ধরে খেতে পারে না। পুকুরে জালে একটা গলদা উঠলে বা নদীতে দুটো বাগদা পেলে তা কখনও কেজি প্রতি আটশ বা হাজার টাকায় বিক্রি হয়, সেক্ষেত্রে একটা চিংড়ি বিক্রি হয় সত্তর বা আশি টাকায়। তাই প্রাণে ধরে এ-সব মাছ নিজেদের হেঁসেলে পৌঁছয় না। এসব ভাবলে মনটা খারাপ হয়ে যায় শ্রীমন্তর। ভাবে না মেয়েটাকে একদিন পুকুরের একটা বড় মোচা(গলদা চিংড়ি) খাওয়াতে হবে।

জালে ঐ মাছ পড়লে অসীমা বলবেই বলবে, আইজ কিন্তুক হেই মোচাটা আমি খাবু বাবা। তারপর অনভ্যস্ত কচি হাতে মাছটা তুলে দেয় বাবার থলিতে আড়তদারের জন্য।

“কৈ গো ভাত যে ঠান্ডা হয়ে গেল, তুমার চ্যান হুলো?”

ভাবনার তাল কেটে যায় শ্রীমন্তর। মুংলির ডাকের জবাব না দিয়ে গামছায় একটু গা-ডলা দিয়ে কোনমতে দুটো ডুব দেয়। তারপর ভিজে অবস্থায় শুকনো লুঙ্গিটা কোমরে জড়িয়ে কাঁপতে কাঁপতে দাওয়ায় উঠে আসে সে।

এখন গণ-এর বাজার। দ্বাদশী থেকে ষষ্টি পর্যন্ত জেলেরা রাতের জোয়ারে জাল তোলে। জাল তোলা ব্যাপারটা এইরকমঃ জাল সবসময় খুঁটিতে বাঁধা অবস্থায় ভাঁটার জলহীন কাদায় ফেলা থাকে। জোয়ারে নদীর জল বেড়ে জাল পেরিয়ে বাঁধ পর্যন্ত চলে আসে। তখন নৌকো নিয়ে গিয়ে জালটা মাটি থেকে তুলে জলের উপর জেগে থাকা খুঁটির সঙ্গে বেঁধে দেওয়া হয়। এতে ভাঁটায় যখন জালের এপারের সব জল বেরিয়ে যায় তখন মাছগুলো আটকা পড়ে জালে। তবে সব প্রক্রিয়াটুকুই হয় রাতে। নতুবা দিনের জোয়ারে জাল তুললে আটকা পড়া সব মাছ চলে যায় ভোঁদড় বা কাক পাখির দখলে।

এই সাত আট দিনে যেটুকু আয় হয় ওদের।

এরপর মরাণী ষষ্টির পর আর জল বাড়ে না তেমন। আবার এ-সময় নদীর জল তেমন কমেও না। তবে জোয়ার জাল পর্যন্ত পৌঁছয় না।

আগে আগে শ্রীমন্ত ভরা জোয়ারে খালের দুপাড়ে খুঁটি পুঁতে দিনের বেলা মাটিতে জাল বিছিয়ে রেখে আসত। তারপর গণ-এর সময় পূর্ণ জোয়ারে, তা সে রাত দশটাই হোক বা দুটোই হোক, নদী যখন কানায় কানায়, তখন বৈঠা দিয়ে নৌকো ঠেলে নিয়ে দিয়ে গভীর জঙ্গলে খালে পেতে রাখা ডূবো জাল উচুঁ করে তুলে বেঁধে দেয় দুপাড়ে খুঁটির সঙ্গে। ভাঁটার জল নেমে যাওয়ার সময় জঙ্গলের ভরা খাড়ির মাছ আটকা পড়ে জালে। ভোর রাতের খাল তখন জলহীন। কখনও মধ্যরাত কখনও ভোর রাতে একটা টর্চ জ্বেলে জালে আটকা পড়া মাছ গা ছম্‌ ছম্‌ ভয় নিয়ে কাদা ঘেঁটে প্রাণ হাতে ঘরে ফিরত।

কি কুক্ষণে সেদিন হাটে এক গ্রাম্য জ্যোতিষীর সামনে দু’হাত পেতে সে বসল কে জানে। জ্যোতিষী হাত দেখে বলে কি না, “তুমার দেখতেছি অপুঘাতে মিত্তু আছে ভাগ্যে। জঙ্গলে সাপধানি ঘুরা ফিরা করবা।”

তখনকার মত পাত্তা দেয়নি শ্রীমন্ত কথাটাকে, কিন্তু রাত দুটো আড়াইটের সময় সেদিনই গভীর জঙ্গলে জালের মাছ কুড়াতে গিয়ে বাঘের আক্রমণের ভয়ে শরীর এমন কাঁপতে লাগল যে সব মাছ না কুড়িয়েই পালিয়ে এল ঘরে। বার বার সে সময় মনে পড়ে যাচ্ছিল হাটে জ্যোতিষীর কথাগুলো।

সেই থেকে একা একা আর রাতবিরেতে মাছ কুড়াতে সে জঙ্গলে যায় না। সত্যিকথা বলতে কী আজকাল মুংলিও ওকে আর রাতে একা ছাড়ে না। ঘুমন্ত মেয়েটাকে একা কাঁথা মুড়ে শুইয়ে ঘরে, ওরা যায় দুজনে একসঙ্গে জঙ্গলে জালে পড়া মাছ কুড়োতে। টর্চ লাইট জ্বেলে মুংলি খেয়াল রাখে বাঘের। এ এক জ্বালা হয়েছে, ঘরে একা ঘুমন্ত মেয়ের চিন্তা, আর বাইরে জঙ্গলে বাঘের চিন্তা। আক্ষেপটা বার-বার ফিরে ফিরে আসে হাটে হাত দেখানোর।

জঙ্গলের গা ঘেঁষে গড়ে ওঠা পাড়াটার নামই আদিবাসী পাড়া। মাত্র বারো চৌদ্দটা পরিবারের বাস। প্রত্যেকেই পঞ্চায়েত থেকে দু-পাঁচ বিঘে বা কারো দু’ভাইকে একসঙ্গে দশ বিঘে জমি দেওয়া হয়েছে। সুতরাং জমির সীমা অনুযায়ী ঘরগুলোও সব একটা থেকে অন্যটা বেশ কিছুটা দূরে দূরে। নিজেদের মধ্যে কথাবার্তাই হোক আর সীমার মধ্যে ছাগল গরু ঢুকে ক্ষেত নষ্ট করার ঝগড়াঝাঁটিই হোক সব সারতে হয় দূরত্বের কারণে চিৎকার করে।

মাঝেমাঝে বড় নদী পেরিয়ে গ্রামে বাঘ ঢুকে পড়লে, গ্রামে পুরুষদের- হাঁকাহাঁকি আর মেয়েদের চিৎকারে শোরগোল পড়ে যায়। এতে বাঘ আক্রমণ করার আগেই আবার বাঁধের ওপারে জঙ্গলে গা ঢাকা দেয়।

*****

আজ শ্রীমন্ত বাড়ি নেই। গাছে এককাঁদি পাকা কলা পড়েছে। বাবাও তলব পাঠিয়েছে। মায়ের শরীরটা ক’দিন খুব খারাপ যাচ্ছে। তিন মেয়ে থাকে বাবার ঘরে। একইসঙ্গে ওদেরকেও একটু দেখে আসা যাবে। টুকিটাকি খাবারদাবার, যেমন মুরগীর ডিম, গরুর দুধ আর পিঠে নাটার পোটলা বেঁধে নিয়ে গেছে সে শহিদনগরে নিজেদের বাড়িতে। এখন গণ-এর সময়। ভালো মাছ পড়ছে নদীতে। আজ জালে যা মাছ বেঁধেছিল, কিছুটা ঘরে ছোট মেয়ে আর বৌ এর জন্য রেখে, থলে ভরে আড়তে না দিয়ে নিয়ে গেছে ওদের জন্য শ্রীমন্ত। মুংলি তার মেয়ে নিয়ে বাড়িতে একা রান্নাবাড়া করে খাবে থাকবে। শ্রীমন্ত ফিরবে কাল দুপুরে খাওয়াদাওয়া সেরে।

মা গরু বাঁধতে বাদায় গেছে অসীমা জানে সে-কথা। তার হাতে এখন কোন কাজ নেই। ঘরে একা একা এখন সে যে কী দুষ্টুমি করবে ভেবেই পাচ্ছে না। মা জেনেবুঝে সবকিছু তার নাগালের বাইরে চালের বাতায় গুঁজে রেখেছে। একটা ছেঁড়া প্লাস্টিক পেপারে পয়সার পুঁটুলিটা বেশ দেখতে পাচ্ছে ও। বরফওয়ালা এক্ষুনি হেঁকে হেঁকে আসবে বাঁধের উপর দিয়ে। কিন্তু ও ঐ চালে গোঁজা পয়সায় হাত পাবে না। ময়লা ছেঁড়া সোয়েটারের বোতামগুলো যে বসে বসে ছিঁড়বে সে উপায়ও নেই, এই কাজটাও ও আগেই সেরে রেখেছে।

ছোট্ট দাওয়াটায় তাই অকারণ দুটো হাত উঁচু করে কিছুটা লাফিয়ে নেচে নিল সে আর সেটা করতে গিয়েই নজরে পড়ল মাছের থলেটা। যাক্‌- আপাতত একটা কাজ পাওয়া গেছে। থলেটা ঝোলানো ছিল ঝাঁপের বেড়ার গায়ে। “ওরেঃ বাবা কত্ত মাচ! তাইলে কি বাবা দিদিদের কাচে মাচ নে যেতি ভুলি গেল? উঠোনে চুপড়িটা পড়ে আচে।”

আর কালবিলম্ব না করে থলের সব মাছগুলো চটপট সে ঢেলে ফেলল চুবড়িতে, তারপর ঘাঁটতে বসল।

ইতিমধ্যে মুংলি গরু বেঁধে ক্লান্ত হয়ে মাঠ থেকে ঘরে ফিরে এসেছে। আজকাল একটু ছোটা-ছুটির কাজ করলেই হাঁপিয়ে পড়ছে সে। আর বাছুরটাও বড় বদমাশ। দড়ি একটু আলগা পেলেই ছুটবে, দিগ্বিদিকজ্ঞানশূন্য হয়ে, ঢুকে পড়বে লোকের খামারে বা সবজিবাগানে। শুনতে হবে গালাগালি। তাই ছুটোছুটি করে অবশেষে ধরে বেঁধে রেখে এসেছে। দুপুরে গরুগুলোকে জল খাওয়াতে গিয়ে দুধ দুইয়ে ওটাকে মায়ের কাছে একটু ছেড়ে রাখা হয়। তখন ওর মন থাকে শুধু মায়ের দুধের বাঁটে। দুধ খায় তাই অন্য কোথাও পালায় না। ওর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ছুটতে গিয়ে একেবারে দম লেগে গেছে আজ ওর।

সেদিন গেরামে একটা সংস্থা থেকে ডাক্তার এসেছিল। গেরামের লোকের শরীল টরীল পরীক্ষে করার জন্যি। ওষুধগুলা আর খাওয়া হয়নিকো। খাবে ক্যামনে, ওষুধের নাম পড়তি না জানলি? কিন্তুক একটা চাকতির উপর ডাইরে ওজন করিছিলো, মেপিছিলো, সিটা খুব মনি আছে। বলিছেলো আমার ওজন খুব কম। ত্রিশ বছর বয়সে মাত্র সাতাশ কেজি! বাড, বাড! ওটা ইংরেজি কতা, হি হি হি কিন্তুক আমি বুঝিচি। আরও বলিচে, ভালমন্দ খেতি হবে, এট্টু জিরোতি হবে। বাবাঃ ওসব শুনলি চলবে? একার সোমসার দেখবে কে? শুধু তো এট্টু মাতা ঘুরায় আর ছুটলি পরে হাঁপ লাগে! তা সে এখানকার সপ মেয়েদেরই লাগে। উঃ বললি হবে?

মুংলির হঠাৎ মনে পড়ে মেয়েটার কথা। চিৎকার করে, “ওরে ও অসীমা কুতায় গেলি রে?”

ঘরে দাওয়ার ভিতর থেকে আওয়াজ আসে, “এই তো তুমার কাজ করতিচি।”

“কাজ করচু মানে?”

মুংলি ছুটে দাওয়ায় উঠে দেখে থলের সব মাছ অসীমার ঢালা হয়ে গেছে, কিছুটা চুপড়িতে, কিছুটা মাটিতে চট্‌কানো।

“সর্ব্বনাশ! তু ওকী করচু?”

“দেখতে পাচ্চিস না? মাচ বাচচি মাচ। বাটিটা দে তো কুটি।”

“হায়-হায়-হায়! এতখন আমি না এসি পড়লি তো এট্টা কান্ড হত। বঁটিতে হাত দিলি পরে তোরে একাবারে ঘেঁটি ধরি ছুঁড়ি মারব উঠানে।”

অসীমা মায়ের চিৎকারে মাছ চট্‌কানো ফেলে সোয়েটার আর জামায় দু’হাত মুছতে মুছতে উঠে দাঁড়ায়। তারপর ঠোঁট ফোলাতে ফোলাতে চিল-চিৎকার জুড়ে মাটিতে শুয়ে পড়ে গড়াগড়ি দিতে শুরু করে। মুংলি আরও রেগে গিয়ে ওর হাতের ডানাটা ধরে উঠনে নিয়ে গিয়ে রোদে ঝপাৎ করে বসিয়ে দিয়ে আসে আর গজগজ করে আপনমনে, “তুকেও আর ঘরে রাখব না্।, দিদিদের কাচে পাইটে দুবো। তেকন বুঝবি। আমার হাড়মাস খেইয়ে ফেলল গো! দূর হয়ি যা আমার সামনথে। বুলে কিনা বটি দে মাচ কাটি! বড় আমার কাজের নোক এয়াচে রে-”

গরগরানী আর আর থামে না মুংলির। এদিকে মেয়ের কান্না শুনে পাশের বাড়ি থেকে ছুটে আসে ওর পাড়া সম্পর্কে কৌশল্যা দিদিমা। কোন কথা না বলে ধুলোমাখা মেয়েটাকে কোলে তুলে নিয়ে আবার হাঁটা দেয় নিজের বাড়ির দিকে। মুংলি দেখে চিৎকার করে ওঠে, “ও দি’মা যেওনি চাড্ডি মাচ নে যাও। তুমার নাতি দেকো আমাদের জন্যি কডা থুয়ে গেচে। আমরা তো মা মেইয়ে দু’লোকে খাপ, তা এড্ডা মাচ কী হবে?”

“কেন রা? শ্রীমন্ত ঘরে নি?” যেতে গিয়ে কৌশল্যা থমকে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে।

“উতো শহিদনগরে গেচে শৌরের সাতি দেকা করতি। ও দিমা মাচগুলো নে যাও না সপ। সেই অসীমা তো তুমার কাচেই খায়! তা আমারে না হয় এট্টু তরকারি দিও। ঘরে পান্তা আচে।”

শুনে মুখ ঝামটা দিয়ে ওঠে কৌশল্যা বুড়ি, “মরণ! দুপুরে পান্তা খাবি ক্যান লা? একন খানটা খেইয়ি পুখরে ঢেলি দে, মাচে খাবে। তোর দাদুওতো ঘরে নি। এড্ডা মাচ-চিংড়ি কখন কুটি? কটা পান্তা খেইয়ে তু-ও আয় আমাদের ঘরে এট্টু হাতে হাত লাগাবি। ওলো আমার সোনা লে! মা কত্তো মেরিচে গো! না নোনো কাঁদে না…” ক্রমশ আদরের আওয়াজটা মিলিয়ে গেল।

আজ দুপুরে খাওয়াটা একটু বেশি হয়ে গেল। একটু সরষের তেলও নিয়ে গিয়েছিল মুংলি দিদিমার ঘরে মাছ ভাজার জন্য। ও মনে মনে একটু রাগই করল শ্রীমন্তর উপর। মাছ চিংড়ি একটু বেশি করে নিয়ে গেলে শহিদনগরে ওদের ঘরে দু’বেলা হয়ে যেত। মেয়েগুলো একটু ভাল করে খেত। শৌরের বাড়িতে তো আর জাল তোলা হয় না, কাছে নদীও নেই। মাছ খায় ওরা তবে কেনা অথবা পুকুর থেকে ধরা।

ঘরে ফিরে মুংলি হোগলার ঝ্যাঁতলা বিছিয়ে মেয়েটাকে কোলের কাছে নিয়ে শুয়ে কখন যে দু’চোখের পাতা এক হয়ে গেছে বুঝতে পারেনি। ঘুম যখন ভাঙল তখন আর বেলা নেই, তবে অন্ধকারও হয়নি। মেয়েটা অকাতরে ঘুমাচ্ছে। তিনবছরের বুড়ো মেয়ে এখনও ওর দুধ না খেলে ঘুমায় না। অসীমার কাছ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে দৌড়ে বেরিয়ে যায় ও মাঠের বাদায় গরু তুলতে।

যেতে যেতে ভাবে মানুষটা যদিও জাল তুলতে একা একা জঙ্গলে যেতে বারণ করেছে, কিন্তু তাতে কী? মাছ বিক্রির দুটো পয়সা হলে সে তো তার নিজেরই থাকবে। ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠল মুংলির। মাথায় দু’হাত ঠেকিয়ে বিড়বিড় করল, “আইজ যেন খুব মাচ লাগে জালে ঠাকুর মা বনবিবি-”

গরু বাছুর গোয়ালে তুলে, ধোঁয়া দিয়ে মশা তাড়িয়ে মশারিটা ঝেড়ে ঝুড়ে টাঙিয়ে দেয় গোয়ালে। তারপর ঘরে ঢুকে দেখে মেয়েটা তখনও ঘুমাচ্ছে। এই অসীমা, বেলা গইড়ে যে আঁধার নামল, উঠপি নে, এ অসীমা। অসীমা বোধহয় মায়ের আওয়াজ পেয়ে জেগে উঠেছিল। পায়ে পায়ে বেরিয়ে এসে বলে, “ল্যাম জ্বালবিনি? কত্ত আন্ধার।”

“আমি একুন সন্ধেবাতি দেইকি খেইয়েদেইয়ে পরে জাল তুলতি যাব। তু এট্টু দিম্মার ঘরে গে থাক।”

এসব শোনার অভ্যাস আছে অসীমার। তবু বায়না ধরল, “আমু যাব তোর সাতি।”

“না। রাত নেমিচে। জঙ্গলে কী আচে জানিস?”

“কী আচে? না কিচ্চু নি। আমু যাব তোর সাতি।”

“এক্কা থাবড়া মারব গালি। বাগে ধরলি কী হবে? যা! যা বলতিচি!”

ডানহাতটা মাথার পিছনে তুলে বেঁকেচুরে ঘ্যান ঘ্যান করতে করতে চলে গেল অসীমা।

জোয়ার পূর্ণ হতে আর একটু দেরি আছে। তাই সময় হাতে পেয়ে আর একটু ঘুমিয়ে নিল মুংলি। ঘড়ির দরকার হয় না সময় জানার জন্য। ঠিক দশটার একটু পরে ঘুম থেকে উঠে পড়ল ও। এবার জাল তোলার সময় হয়েছে।

নদীর জল বেড়ে বাঁধ ছুঁয়েছে। তবে কালকের থেকে একটু কম। দড়ি খুলে নৌকোটাকে ঠেলে দিয়ে তার উপর লাফ দিয়ে উঠে পড়ে লগি ঠেলে সে। একা একা লগি ঠেলে ঠেলে হাঁপিয়ে ওঠে। আপনমনে বিড়বিড় করে, “আমি মেইয়েমানুষ! এ-কাজ কি আমার একার দ্বারা সম্ভব?” কিন্তু পরক্ষণে মাছের কথা ভেবে কাজে মন দেয়।

জঙ্গল পেরিয়ে খালের মুখে এসে পৌঁছোয় সে। অন্ধকার রাত কিন্তু তারার আলোয় দেখা যায় সামনে বড় নদী কানায় কানায় পূর্ণ জোয়ারের জলে। জালের খোঁটায় নৌকোটা বেঁধে নেয় আগে। হাতে টর্চ থাকলেও সবসময় তা জ্বালার সুযোগ পায় না। অভ্যস্ত হাতে অন্ধকারেই কাজ শুরু করার প্রস্তুতি নিতে লাগল মুংলি।

*****

বাচ্চা প্রসব করার সময় হয়ে আসছে। পেটের ভিতর পুরুষ বাঘের ছানা। এখন এ-জঙ্গল তার কাছে মোটেও নিরাপদ নয়। বড় বাঘ যা তার সঙ্গী আবার ছানাদের বাবাও বটে, খেয়ে ফেলবে পুরুষ বাচ্চাগুলো। বাঘ তার নিজের এলাকায় বাঘিনী ছাড়া কোন বাঘকে আশ্রয় দেয় না, সে তার নিজের ছানা হলেও।

বাঘিনী রাতের অন্ধকারে জোয়ার-ভাঁটার সন্ধিক্ষণে নদী পেরিয়ে গ্রামের পাড়ে জঙ্গলে ঢোকে ভালো আশ্রয়ের সন্ধানে। যেখানে সে নির্ভয়ে পুরুষ ছানাদের নিয়ে থাকতে পারবে। এই প্রথম নয়, এর আগেও সে দু একবার ঘুরে গেছে এই জঙ্গলে বাসার সন্ধানে।

ও জানে একটা মানুষ রোজ জাল পাততে আর তুলতে আসে নৌকো ঠেলে এখানে। কিন্তু কোনদিনও সে-ভাবে আক্রমণ করার সুযোগ আসেনি তার কাছে। মানুষটার হাতে একটা বড় ডান্ডা আর আলো থাকে। তাছাড়া মানুষটার চেহারাটাও খুব মজবুত। সবসময় জঙ্গলে সজাগ থেকে কাজ করে ও। তবে কোনদিন সেভাবে সুযোগ পেলে তার সদ্‌ব্যবহার করতে বাঘিনী ছাড়বে না। তক্কে তক্কে থাকে সে। পেটের ভিতরে ছানা থাকায় শরীরও খুব ভারী এখন। তাক্‌ করে লাফ দিলেও যে সফল হবে এমন কোন নিশ্চয়তা নেই।

আজ অনেকক্ষণ এ-পাড়ে এসেছে সে। খিদেও পেয়েছে খুব। হঠাৎ নৌকো ঠেলার আওয়াজ কানে এসে পৌঁছয় তার। আরে এ তো একটা সহজ শিকার সামনে! মনে মনে মঙ্গলাকে দেখে খুশি হয় বাঘিনী। ভাবে একে কোনো অবস্থাতেই ছাড়া যাবে না। নিজেকে প্রস্তুত করে সে শিকার ধরার জন্য।

*****

খোঁটার গায়ে বাঁধা জাল পড়ে আছে জঙ্গলে জলের গভীরে। সেই জাল জল থেকে টেনে তুলে খালের দু’পাড়ে খোঁটায় বাঁধতে গিয়ে একেবারে গলদঘর্ম সে এই শীতেও।

কাজ প্রায় শেষ করে এনেছে, এমন সময় হঠাৎ পা হড়কে মুংলি পড়ে গেল অগাধ জলে। কোনরকমে নৌকোর গালা আঁকড়ে ধরে নিজেকে টেনে তুলল আবার নৌকোয়। ভিজে তো গেলই আবার ডোবা শুলোয় হাত পা কেটে একশা। ভাগ্যি টর্চটা গামছায় বেঁধে আহ্নিকে জড়িয়ে রেখেছিল নতুবা রাত দেড়টা দুটো নাগাদ মাছ কুড়াতে আসাই মুশকিল ছিল টর্চ ছাড়া!

একা একা রাতে জঙ্গলে এসে আজ ওর একটু ভয় করতে লাগল। অন্যদিন শ্রীমন্তর সঙ্গে আসে ওকে আলো জ্বেলে সাহায্য করতে, ভয়ভাবনা সবটাই থাকে শ্রীমন্তর কাঁধে। ভাবল, না এলেই হত। আবার তো রাতে আসতে হবে।

খুট্‌ করে একটা শব্দ হল কোথাও। হৃদপিণ্ড যেন লাফিয়ে উঠল। প্রাণপণ জঙ্গল ঠেলে বৈঠা বাগিয়ে নৌকোখানা পাড়ের দিকে এগিয়ে নিয়ে আসতে লাগল মুংলি। ভয়ে ভয়ে বারবার একবার পিছনে তো একবার ডাইনে বাঁয়ে তাকিয়ে খোঁজার চেষ্টা করল কিছু। কিন্তু গভীর জঙ্গলের ভিতর টর্চের আলোটুকু পড়ার জায়গাটা ছাড়া ঘন গাছ-পালার আড়ালে আর কিছুই ওর নজরে পড়ল না।

দু’হাত দিয়ে গাছপালা ঝোপঝাড় সরিয়ে অবশেষে লগি ঠেলে-টেলে বাঁধের ধারে জঙ্গলের কিনারায় এসে ঠেকল ওর নৌকো।

পেটের ভিতর কেমন মোচড় দিচ্ছে। নৌকো থেকে নেমে জঙ্গলেই তাড়াতাড়ি পেট হালকা করে এল ও। তারপর নৌকোটা ভাল করে বেঁধে বাঁধ টপকাতে যাবে, সেই অপেক্ষাতেই ওকে তাক করে বসেছিল বাঘটা। কী মনে হওয়াতে বৈঠাখানা উঁচু করে হঠাৎ জঙ্গলে নজর করল মুংলি। না কিছু নেই। সবটাই মনের ভুল। মুংলির এই হঠাৎ বৈঠা বাগিয়ে ধরা ও জঙ্গলে প্রখর দৃষ্টি নিক্ষেপ এবারের মত বাঁচিয়ে দিল মুংলিকে। আবার অপেক্ষা। মাছ কুড়াতে দু-চার ঘন্টা বাদে আবার নিশ্চই আসবে মেয়েটা। আর তখন……

*****

দিদিমা ততক্ষণে মেয়েটাকে খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে বিছানা পেতে ল্যাম্প জেলে শুইয়ে রেখে গেছে। একটু কিছু খেতে হবে। বার-বার দাস্ত হওয়ার ফলে পেটটা একেবারে খালি হয়ে গেছে। শীতের রাত বড়, উপোষ থাকা উচিত নয়।

এখন পেটের ভিতর মোচড়ানি ভাবটা একটু কমেছে। রাতে আবার মাছ গুড়াতে (কুড়াতে)একা একা যেতে হবে জঙ্গলে। তখন অবশ্য নৌকোর দরকার নেই। কিন্তু গায়েগতরে তো শক্তি দরকার। না খেলে হবে? শীতের পান্তা এত তাড়াতাড়ি নষ্ট হয় না। আবার মাছ ভাজা দিয়ে খানিকটা পান্তা চটকিয়ে খেয়ে, মেয়ের পাশে তাড়াতাড়ি শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ল মুংলি।

রাত তখন বেশ ভারি। গাঢ় অন্ধকার। মুংলির পেটের ভিতর আবার মোচড় দেওয়া শুরু হল। সঙ্গে বমি বমি ভাব। পর পর বেশ কয়েকবার উঠতে হল ওকে বাইরে যাওয়ার জন্য।

যখন জল সরে গিয়ে ভাঁটার কাদা-জঙ্গলে জালে আটকে পড়া মাছ কুড়াতে যাওয়ার সময় হল, তখন বার বার জলের মত দাস্ত হওয়ার কারণে ও বেশ ক্লান্ত বোধ করছিল। কিন্তু আজকে পাওয়া সব মাছগুলোই ওর একার। ওগুলো বিক্রি করে ও যে টাকা পাবে, তা শ্রীমন্তকে ভাগ দিতে হবে না। মাছক’টা নিয়ে গাঁয়ে একবার ঘুরলেই দু’দশ ঘর লোক নগদ বা বাকিতে কিনে নেবে। শুধু এখন একটু কষ্ট করে এই মাঝরাতে মাছগুলো কুড়িয়ে জালটা খুলে নামিয়ে দিলেই হল।

*****

বাঘের স্বভাব চোরের মত সুযোগ বুঝে হঠাৎ আক্রমণ করা। অসীম ধৈর্য ওদের। কোন শিকার যখন ও নিশানা করে, তখন ঘন্টার পর ঘন্টা অপেক্ষা করতে ও দ্বিধা বা ক্লান্তি বোধ করে না (এক্ষেত্রে আমি বিড়ালের ইঁদুর ধরার সঙ্গে বাঘের আচরণে কোন তুলনা করতে চাই না, আর তা উচিত বলে আমি মনে করি না। আমার কাছে ওর আচরণ রাজকীয় বলে মনে হয়- লেখক)।

অনেকক্ষণ ধরে বাঘ সুযোগের অপেক্ষায় ছিল। প্রথমবার যখন মুংলি এসেছিল নৌকো নিয়ে জাল তুলতে, তখন নদীতে জল থাকায় সামনে দিয়ে আক্রমণ সম্ভব ছিল না। জঙ্গলে একটু উঁচু জায়গায় যেখানে জল প্রায় নেই, চেষ্টা করেছিল সে সেইখান থেকে, কিন্তু না। জালে আড়াল হচ্ছিল মুংলির শরীরটা। তখন বাঘ ঘুরে এসেছিল পিছন দিকে। জাল মুংলি এবার এক লাইনে। সবে চার হাত’পা এক করে লাফ দিতে যাবে, পাকা ফলের মত পা পিছলে হঠাৎ সেই সময় টুপ করে জাল জড়িয়ে নৌকো থেকে জলে পড়ে ডুবে গেল মুংলি। ফস্‌কে গেল বাঘের লক্ষ্যবস্তু সেই সময়ের মত।

হাঁচোড়পাঁচোড় করে আপনমনে গজরাতে গজরাতে নৌকোর গালা আঁকড়ে ধরে কোন রকমে নিজেকে টেনে তুলেছিল মুংলি। ওদিকে শিকার হঠাৎ নৌকো থেকে পিছলে পড়ে যাওয়াতে, বাঘটাও বেশ ভড়কে গেল। যেহেতু শিকারে বাধা এল, মুংলির আবার নৌকোয় ওঠা পর্যন্ত ও অপেক্ষা করেনি। কিছুটা ঘুরে সন্তর্পণে কোন আওয়াজ না করে শিকারের ডান দিকট চোখে চোখে রেখে জলে পা ফেলে নদী বরাবর এগিয়ে এসে দাঁড়িয়েছিল মুখোমুখি। কিন্তু না। মেয়েমানুষটা খুব চালাক। একটুও অসতর্ক হয়নি। আলোটা জ্বেলে বগলদাবায় চেপে নৌকোয় দাঁড়িয়ে এক হাতে জাল বাঁধছিল খোঁটায় আর অন্যদিকে বার বার সতর্ক নজর রাখছিল সামনে-পিছনে, নাকি আমার দিকেই? এইসময় ওকে ধরার জন্য লাফটা যদি দিই তবে ও নির্ঘাত লাফ দেবে আবার জলে। আর আমি এই ভরা ছানা পেটে নিয়ে নৌকোর কাঠের গায়ে আছড়ে পড়ে আঘাত পাব। হতে পারে মেয়েটার চিৎকারে গাঁয়ের লোক সব জড়ো হয়ে ধরে পিটিয়ে মেরে একশা করবে আমায়!

নাঃ এদিক দিয়েও হবে না। অতএব অপেক্ষা।

মানুষরা বলে আমাদের নাকি অসীম ধৈর্য। কথাটা অবশ্য মিথ্যে নয় একটুও। ধৈর্য ধরে যারা কাজ করে তাদের সফলতা পেতে সুবিধা হয় বেশি। আজ যদি আমাদের মনযোগ ও ধৈর্য না থাকত, আমাদের চরিত্র নিয়ে সারা পৃথিবীতে এত আলোচনা হত না। আমরা শিকার ধরার আগে নানা দিক, নানা কোন থেকে শিকারকে পর্যবেক্ষণ করি। তারপর সুযোগ বুঝে যখন শিকারের মন থেকে আমার ভাবনা দূর হয়, নিজেকে বিপদমুক্ত মনে করে অসাবধান হয়, তখনই তো আমার সুযোগ নেওয়ার পালা। এই ভাবেই তো জঙ্গলে খেয়ে ঘুমিয়ে টিকে আছি!

তা, মেয়েটার তো এবার মাছ কুড়োতে আসার সময় হল। এখনও আসছে না কেন? আমি অবশ্য ওর জল সরে যাওয়া জাল থেকে ক’টা মাছ আর নদীর চর থেকে থাবার ঘায়ে কটা কাঁকড়া মেরে মেরে খেয়েছি। এখন তো পেট খালি দিলে আমার চলবে না। আবার অনেকটা সময় হাতে ছিল বলে ছানাদের রাখার জন্য একটা ভালমত জুতসই জায়গাও বেছে ফেলেছি। ওখানেই আমি আমার ছানাদের এনে তুলব। তবে একটা মানুষ মারতে পারলে অনেক দিনের মত নিশ্চিন্ত। মড়িটাকে পিঠে তুলে নিয়ে অক্লেশে নদী পেরিয়ে আবার ওপারে গিয়ে উঠব। শুধু খাব আর ঘুমাব…..

আরেঃ! ঐতো আবার এসেছে মেয়েটা! কিন্তু হাতে আবার এত মোটা ডান্ডা কেন? মারবে নাকি? বাছা আজ তোমার নিস্তার নেই আমার হাত থেকে। তোমাকে ওপারে আমার বাড়িতে নিয়ে গিয়ে তুলবই তুলব।

আরেঃ! চোখের আড়াল হয়ে গেল নাকি মানুষটা?

*****

এদিকে ডান্ডা বাগিয়ে ততক্ষণে মাছগুলো সব খুঁটে নিয়েছে মুংলি। আবার পেটের ভিতরটা ব্যথা ব্যথা করছে! মুংলি থলেসমেত মাছ জালের কাছে রেখে জঙ্গলের আড়ালে ডান্ডা হাতে ধরে গিয়ে বসছে। আর তখনই আড়াল হচ্ছে ও বাঘের চোখের সামনে থেকে।

ফিরে এসে খোটা থেকে জাল খুলে নামিয়ে রেখে ও মাছ সমেত দুদ্দাড় ছুটল থলে হাতে বাঁধের দিকে। ও অনেকবার রাতে শ্রীমন্তকে পাহারা দিতে জঙ্গলে এসেছে। কিন্তু এবারের মত এত ভয় কোনদিন পায়নি। ওর অনেকদিনের অভিজ্ঞতা থেকে বেশ বুঝতে পারছে আজকের এই জঙ্গল পরিবেশ অন্যদিনের মত নয়। পুরো জঙ্গল যেন চুপ করে গেছে কীসের ভয়ে। আজ আমার কিছু হবে না তো?

বাঁধে কাছে পৌঁছতেই আবার পেটে মোচড়। ভাবল আর কিছুতে না হোক এই পেট খারাপেই আজ আমি মরব। নাঃ এতগুলো সিদ্ধ পিঠে খাওয়া ঠিক হয়নি আমার। বাঁধের গায়ে বাঁধা নৌকোর খোলে মাছের থলেটা রেখে আবার জঙ্গলে পেট খালি করি। কিন্তু খুব ভয় করছে, তা করুক গে- আমাদের গাঁয়ে একটা কথা চালু আছে না, হাগারে নেই বাঘার ভয়। তা এখন আর ভয় কী? ঐ তো বাঁধে ওপারে আমাদের পাড়া। শুধুমুধু টর্চের ব্যাটারি পুড়িয়ে লাভ কী?

হলই বা অন্ধকার, বাতি নিভিয়ে মুংলি আবার বাঁধের গা ঘেঁসে জঙ্গলে বসে পেট খালি করে আরাম পেল।

এই সময়টুকুর জন্য আবার বাঘের চোখে হারিয়ে গেল সে। উঠে এসে থলেটা নিল। তারপর নৌকোর খোল থেকে টর্চ জ্বেলে বাঁধের চড়াইয়ে উঠার জন্য পা বাড়াতেই- ওর নড়াচড়ায় আবার বাঘের নজরের আওতায় এসে গেল-

মাছ পেয়ে বিক্রির আনন্দে বেশ খানিকটা খুশি আর অন্যমনস্ক মুংলিকে দেখে বাঘ ভাবল, এখন আর এ সুযোগ হাতছাড়া করলে চলবে না। অতএব-

বাঁধের পাড়টা খুব খাড়া। জঙ্গল আর গ্রামের মাঝে দাঁড়িয়ে এই বাঁধই মানুষকে বাঁচিয়ে রেখেছে। ঝড়, ঝঞ্ঝা, অতিবৃষ্টির আর নোনাজলের প্লাবনের হাত থেকে।

রুগ্ন ক্লান্ত আর দুর্বল মুংলি খাড়া বাঁধে ওঠার জন্য ও খানিক মাথা ঘোরার কারণে হঠাৎ শুয়ে পড়ার মত ঝুঁকে পড়ে চার হাত পা ব্যবহার করল, আর বাঘও ঠিক সেই সময়েই তীব্র এক লাফ দিল ওকে লক্ষ করে।

বাঁধে হঠাৎ ঝুঁকে পড়ার জন্য লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে বাঘের থাবার সামনের পায়ের থাবার নখের আঁচড়ের ধাক্কায় ক্ষত-বিক্ষত হয়ে গেল ওর পিঠ। সটান আছড়ে পড়ল মুংলি বাঁধের ঢালু ঢালে ধাক্কার চোটে সামলাতে না পেরে। নতুবা ততক্ষণে বাঘের হাঁ-মুখের ভিতরে থাকত ওর মট্‌কে যাওয়া ঘাড়, আর দেহটা পিঠে তুলে নদী পেরিয়ে পালিয়ে যেত বাঘ।

আর কিছু মনে নেই আমাদের মুংলির।

রাতে একা বাচ্চা মেয়ের কান্নার আওয়াজ শুনে কৌশল্যা দিদিমা এসে দেখে মুংলি তখনও ফেরেনি জঙ্গল থেকে। লোকজন লাঠিসোঁটা নিয়ে সকলে মিলে জঙ্গলে খুঁজতে বেরিয়েছিল ওকে। রক্তাক্ত অজ্ঞান আধমরা মুংলিকে বাঁধের ঢাল থেকে গড়িয়ে জঙ্গলে কাদামাখা অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে উদ্ধার করে ওরা।

***

আজ মুংলি আবার জঙ্গলে আসে, মাছ ধরতে আসা শ্রীমন্তকে টর্চ জ্বেলে পাহারা দেওয়ার জন্য।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত