ডাবলুবাবুর ডুপ্লিকেট

ডাবলুবাবুর ডুপ্লিকেট

দূর থেকে দেখতে পাচ্ছিলাম ভদ্রলোক হাঁপাতে হাঁপাতে আমাদের দিকেই আসছিলেন। আমরা সানসেট পয়েন্টে দাঁড়িয়েছিলাম। আমরা বলতে আমি, বুল্টি, টোটোদা আর অমরবাবু। হি হি করে কাঁপতে কাঁপতে আমরা অপেক্ষা করছিলাম। টোটোদা যেদিকে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যাবে বলছে, সেদিকের আকাশে মেঘ রয়েছে। জানি না সূর্য ওঠার সময় মেঘটা সরে যাবে কি না। আর একটু পরেই কাঞ্চনজঙ্ঘার ওপর সূর্যের আলোটা পড়ে সেই বিখ্যাত গোল্ডেন ক্রাউন দেখা যাবে, ঠিক এমনি সময় ভদ্রলোক উদয় হলেন। বেশ লম্বাচওড়া ঝাঁকড়াচুলো লাল লাল চোখের ভদ্রলোককে দেখে আমার কেন জানি রঘু ডাকাতের কথা মনে পড়ছিল।

“আরে অমরবাবু যে, কবে এলেন? সুহৃদের মুখে শুনলাম আপনি এসেছেন।”

অমরবাবু সোল্লাসে ভদ্রলোককে জাপটে ধরলেন, “আরে ডাবলু যে! কী আনন্দ হচ্ছে যে… ভেবেছিলুম একটু বেলা হলে দেখা করব।”

আমাদের সঙ্গে ছিল রোজেন রাই। আমরা যে হোম-স্টেটাতে আছি উনি তার কেয়ারটেকার। উনি বললেন, “এইবার দেখুন।”

আমি উত্তরদিকেই চেয়েছিলাম। একটা বড়োসড়ো মেঘ দেখা যাচ্ছিল। তার ফাঁক দিয়ে উঁকি মারবে নিশ্চয়ই। সূর্যের আলো সেই মেঘের উপর পড়ে লাল হয়ে আছে।

টোটোদা অস্ফুটে বলল, “ওয়ান্ডারফুল!”

আমি ভালো করে উঁকিঝুঁকি মেরে দেখার চেষ্টা করলাম। কোথায় কাঞ্চনজঙ্ঘা? কিস্যু দেখতে পাচ্ছি না। তাই টোটোদাকে জিজ্ঞেস করলাম, “কোথায়?”

টোটোদা আঙুল উঁচিয়ে বলল, “কেন, ওই তো বিশাল সাদা বরফে ঢাকা পাহাড়ের চুড়ো দেখতে পাচ্ছিস না, লাল হয়ে আছে?”

“ও হরি! তার মানে ওই যেটাকে মেঘ বলে ভাবছিলাম সেটাই কাঞ্চনজঙ্ঘা? এত্ত বড়ো!” আমি লজ্জা লজ্জা মুখে হেসে উঠলাম।

সদ্য পরিচিত ডাবলুবাবু অট্টহাস্য করে বললেন, “কাঞ্চনজঙ্ঘা প্রথম দেখছ, খোকা? প্রথমবার ওইরকম একটু হয়।”

বুল্টি এমন একটা সবজান্তা ভাব করে হাসল যেন ও কত্ত আগে থেকেই ওই মেঘটাকে ও কাঞ্চনজঙ্ঘা বলে চিনতে পেরে গেছিল।

আমরা গতকাল বিকেলে আলগাড়া এসেছি। এই জায়গাটার কথা অনেকেই জানে না। আলগাড়া জায়গাটা কালিম্পং থেকে পনেরো কিলোমিটার দূরে। রাস্তার একদিকে গভীর খাদ আর অন্যদিকে পাহাড়। এখান থেকে একটা রাস্তা চলে গেছে সিকিম সিল্করুট ধরে আর একটা রাস্তা গেছে রিকিসুম হয়ে লাভা, রিশ্যপের দিকে। সমুদ্রতল থেকে প্রায় ছ’হাজার ফুট ওপরে পাহাড়ের বুকে লেপচাদের ছোটো একটা গ্রাম। এমন একটা জায়গায় থাকা মানে বলতে গেলে স্বর্গে থাকা। মনভোলানো পাহাড়ের সৌন্দর্য আর সন্ধে হলেই কনকনে ঠাণ্ডা। অমরবাবুর এক বন্ধু থাকেন এখানে। ব্যাঙ্কে চাকরি করেন। তাঁর নামই সুহৃদবাবু। অমরবাবু মাঝেমধ্যেই নাকি এখানে এসে কাটিয়ে যান। নিউমেরোলজি সংক্রান্ত একটা ঘটনার পর থেকে উনি টোটোদার ভারি ফ্যান হয়ে গেছেন। তাই এবার আলগাড়া যাবার কথা হতেই উনি টোটোদাকে অফার করলেন ওঁর সঙ্গে যাবার জন্য। সেটা শুনে আমি আর বুল্টিও ঝুলে পড়লাম টোটোদার সঙ্গে। আমাদের বাড়ি থেকে কোথাও ঘুরতে যাওয়া মানেই পুরী। দার্জিলিংটুকুও যাওয়া হয়নি। অমরবাবুর কাছে এই জায়গাটার বর্ণনা শুনে আমরাও লোভ সামলাতে পারিনি। টোটোদাই দুই বাড়িতে কথা বলে পারমিশন আদায় করে নিয়েছে। শর্ত টোটোদার কথা যেন শুনে চলি সবসময়, নইলে এটাই আমাদের একলা একলা ঘুরতে যাবার শেষ সুযোগ হবে।

টোটোদা হল সুবোধজেঠুর ছেলে। ভালো নাম, সুবাস চট্টোপাধ্যায়। যাদবপুরে কম্পিউটার সায়েন্স নিয়ে পড়ছে। হাতখরচের জন্য গোটাকতক টিউশনি পড়ায়। আমাকে আর বুল্টিকে অঙ্ক-বিজ্ঞান পড়ায় সপ্তাহে তিনদিন। আর বুল্টি হল তিনুকাকুর মেয়ে। আমাদের বাড়ির ঠিক উলটোদিকে ওদের বাড়ি। আমার সঙ্গে একই ক্লাসে পড়ে।

টোটোদাদের বাড়িটা আমাদের দুটো বাড়ি পরেই। কোন্নগরে এই বিশ্বম্ভর ব্যানার্জী লেনের প্রতিটি বাড়িই প্রত্যেকের আত্মীয়ের মতো। সবাই সবাইকার খুব আপন। টোটোদাকেও কোনওদিন আমার নিজের দাদা ছাড়া আর কিছুই মনে হয়নি।

সূর্য উঠে যাবার খানিক পরে আমরা সানসেট পয়েন্ট থেকে সুহৃদবাবুর বাড়ির দিকে রওনা দিলাম। ঢালু পথে পাহাড়ের গা বেয়ে ঘুরে ঘুরে নিচে নামতে হয়। অমরবাবু আর ডাবলুবাবু কথা বলছিলেন নিজেদের মধ্যে। টোটোদা নিজের এস.এল.আর ক্যামেরার লম্বা লেন্স তাক করে পাহাড়ি ফুল আর নানান সিনারির ছবি তুলছিল এমন ভাব করে যেন ওঁদের কথাবার্তা ওর কানেই ঢুকছে না। কিন্তু আমি খুব ভালো করেই জানি, টোটোদার কান সবসময় খাড়া থাকে।

ওদের কথা থেকে বুঝলাম, ডাবলুবাবু অমরবাবুর পূর্বপরিচিত। উনি একটি নামী প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি করেন। আপাতত আলগাড়াতেই রয়েছেন ভদ্রলোক। অল্পদিন হল এখানে বদলি হয়ে এসেছেন। পাহাড় খুব পছন্দ।

অমরবাবু টোটোদার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিয়ে বললেন, “এই ছেলেটি রীতিমতো জিনিয়াস। বুঝলেন মশাই, দীর্ঘদিন ধরে নিউমেরোলজি নিয়ে আমার একটা ভুল ধারণা ছিল। সেটা ও ভেঙে দিয়েছে।”

ডাবলুবাবুর চোখ গোল গোল করে বললেন, “তাই নাকি? তাহলে তো বলতে হয় তুমি বাপু একটি চৌকস ছেলে! ইয়ে, তুমি বললাম বলে কিছু মনে কোরো না, আমার থেকে অনেক ছোটো তো।”

“নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই। আমি এখন যাদবপুরে কম্পিউটার সায়েন্স নিয়ে গ্র্যাজুয়েশন করছি।” টোটোদা লাজুক লাজুক হেসে বলল, “আমার ধারণা সব ঘটনার পিছনেই একটা লজিক থাকে। লজিকের বাইরে কিছুই হতে পারে না। কিন্তু অমরবাবুর ঘটনাটা ঠিক লজিকে মিলছিল না। তাই আমি একটা ব্যাখ্যা দিতে চেয়েছিলাম। আর সেটা ক্লিক করে গেছে। এই আর কী।”

ডাবলুবাবু টোটোদার দিকে চেয়ে খানিকক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর যেন অনেক কিছু ভেবেচিন্তে বললেন, “তাহলে তোমাকে একটা ঘটনা বলি, শোনো। দ্যাখো তো এর মধ্যে কোনও লজিক খুঁজে পাও কি না।”

সামনে রাস্তাটা একটু বেশিই ঢালু ছিল বলে বুল্টি আমার হাতটা ধরে ছিল নামার সময়। ও আলতো করে আমার হাতে একটা চিমটি কাটল। টোটোদা, অমরবাবু আর ডাবলুবাবু এগিয়েছিলেন। আমি বুল্টির মুখের দিকে চেয়ে দেখি ও ভ্রূ নাচিয়ে যে ইশারাটা করল তার মানে হয়, দ্যাখ আবার একটা কেস এসে গেল বলে!

বুল্টি বরাবরই রহস্য প্রিয়। ওর ইচ্ছে বড়ো হয়ে গোয়েন্দাগিরি করবে। গোয়েন্দা হবার মতো বুদ্ধি নেই আমার। তবে বড়ো হয়ে বুল্টি যে নির্ঘাত একজন কেউকেটা গোছের হবে এটা আমার দৃঢ় বিশ্বাস। আর টোটোদাও সেটা মানে।

হাঁটতে হাঁটতে ডাবলুবাবু বলতে লাগলেন, “ঘটনাটা গেল বছরের। রোজ সকাল আর সন্ধে আমার অভ্যেস হাঁটবার। হাঁটতে হাঁটতে লোকালয় ছাড়িয়ে রাস্তা ধরে এগিয়ে যাই। রাস্তার পাশে জন্মে থাকা পাহাড়ি ফুল, অর্কিড, ঝরনা, দূরের পাহাড়ের গায়ে লেগে থাকা বাড়িগুলো দেখতে দেখতে আবার ফিরে আসি।

“একদিন হল কী, রাস্তায় এক ভদ্রলোকের সঙ্গে দেখা। বাঙালি। উনি আমার উলটোমুখে হেঁটে আসছিলেন। আমাকে দূর থেকেই চোখ কুঁচকে দেখছিলেন। কাছে এসে প্রায় জড়িয়ে ধরেন আর কী! রীতিমতো চিত্কার করে উঠলেন, প্রদ্যুৎ! তুমি ফিরে এসেছ? কবে এলে ভাই? আরে, এইভাবে কেউ কি বাবা-ভাইয়ের ওপর রাগ করে বাড়ি ছেড়ে চলে যায়?

“আমি বিরক্ত হয়ে বললাম, কী বলছেন মশাই? কাকে প্রদ্যুৎ বলছেন? আমার নাম অনির্বাণ।

“ভদ্রলোক ভয়ংকর রেগে গেলেন। দ্যাখো, ইয়ার্কির একটা সীমা থাকা উচিত। তোমার বাবা মৃত্যুশয্যায়, ভাই চিন্তায় পাগল হয়ে যাচ্ছে আর তুমি একবার তাঁদের খবরটুকুও নেবার প্রয়োজন বোধ করলে না? অনেক হয়েছে, যাও বাড়ি যাও। তা কোথায় আছ এখন?

“সক্কাল সক্কাল এইরকম ইয়ার্কিতে আমিও বিরক্ত হয়ে বললাম, দেখুন মশাই, আপনি কে আমি মোটেও জানি না আর জানার ইচ্ছেও নেই। কথা বলার ইচ্ছে থাকলে সকাল দশটার পর অফিসে যাবেন। এই বলে আমি হাঁটা দিলাম। সকাল সকাল এই অদ্ভুত ঘটনাটায় মনটা খিঁচড়ে গেল।

“অফিসে সুহৃদকে বললাম ঘটনাটা। অনেককেই বললাম। সকলেই বলল, হয়তো তোমার মতো দেখতে কাউকে ভেবে ভুল করছে। আমিও সেটাই ভাবলাম। যাক, দিনের শেষে ঘটনাটা মন থেকে মুছে গেল।

“কিন্তু দু’দিন পর আবার দেখা সেই ভদ্রলোকের সঙ্গে। এবার একেবারে ব্যাঙ্কের এ.টি.এম থেকে বেরোবার মুখে, দুপুরবেলায়। ভদ্রলোক বিরক্ত সুরে আমাকে বললেন, কী ব্যাপার, তুমি আলগাড়ায় রয়েছ, অথচ বাড়ি যাওনি যে বড়ো? বিদ্যুৎকে বললাম তোমার কথা। সে তো আকুল হয়ে উঠেছে।

“আমি ভদ্রলোকের দিকে ভালো করে চেয়ে দেখলাম। পাগল বলে তো মনে হল না। জিজ্ঞেস করলাম, আপনি কোনও ভুল করছেন। সেদিনও বলেছিলাম যে আমি প্রদ্যুৎ নই।

“আমার মুখের দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে উনি বললেন, কেন এখনও রাগ পুষে রেখে দিয়েছ? একবার অন্তত বাড়ি যাও। তোমার বাবা সত্যিই মরণাপন্ন। ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করো।

“মানুষটির বলার ধরন দেখে আমার কেন জানি মনে হল কিছু একটা ভুল তো নিশ্চয়ই হচ্ছে। তবে উনি মিথ্যে বলছেন না। তার মানে নিশ্চয়ই অবিকল আমার মতো দেখতে কেউ একজন আছেন, যাঁর নাম প্রদ্যুৎ। যাঁর সঙ্গে আমাকে উনি গুলিয়ে ফেলছেন। তার মানে এতটাই সেই প্রদ্যুতের সঙ্গে আমার মিল যে খুব পরিচিত মানুষরাও ভুল করছেন!

“জানেন, কোথায় যেন পড়েছিলাম এই পৃথিবীতে অবিকল আপনার মতো দেখতে অন্তত সাতজন মানুষ আছেন। এবার আমার মধ্যেও কৌতূহল হতে লাগল সেই মানুষটিকে দেখবার। তবে তিনি তো পলাতক, তাই অন্তত তাঁর বাড়িতে গিয়ে বাবা-ভাইয়ের সঙ্গে আলাপটা তো সেরেই আসা যায়। বাড়িতে নিশ্চয়ই তাঁর ছবি থাকবে। সেটা দেখেই চক্ষু সার্থক করে আসি। আমি ভদ্রলোককে বললাম, আপনি আমাকে প্রদ্যুৎবাবুর বাড়িতে নিয়ে যেতে পারেন?

“ভদ্রলোক রাগত সুরে বললেন, ও, তার মানে বলতে চাও যে তুমি প্রদ্যুৎ নও?

“আমি পকেট থেকে অফিসের আইডি কার্ড বের করে দেখিয়ে বললাম, সত্যিই আমি প্রদ্যুৎ নই, আমার নাম অনির্বাণ সামন্ত। এখানে চাকরি করি। অল্পদিন হল বদলি হয়ে এসেছি।

“কার্ড দেখে আর কথা সরে না। উনি ভীষণ অবাক হয়ে বারে বারে বলতে লাগলেন, এমনও হয়? কী মিল! কে বলবে যে আপনি প্রদ্যুৎ বাগচী নন?

“তা ভদ্রলোককে অনুরোধ করলাম আমাকে একটিবার সেই প্রদ্যুতের বাড়ি নিয়ে যাবার জন্য। ওঁর আর্জেন্ট কোনও কাজ ছিল তখন। উনি বললেন বিকেলে পাঁচটার দিকে আলগাড়া বাজারে দাঁড়াতে, আমাকে নিয়ে যাবেন।

“সেইমতো বিকেল পাঁচটা নাগাদ ওঁর মোটরবাইকে চড়ে রওনা দিলাম। রিকিসুমের দিকে গেলে দেখবে ডানদিকে গভীর খাদ আর বাঁদিকে পাহাড়। অল্প খানিকটা যাবার পর পাহাড়ের ফাঁক দিয়ে ঝরনার পাশ দিয়ে সরু একটা পায়ে চলার মতো পথ চলে গেছে। সেইদিকে মোটরবাইক নিয়ে ঢুকে পড়লেন ভদ্রলোক। ভদ্রলোক ভদ্রলোক বলছি বারবার, উনি নিজের নামটাও বলেছিলেন, ওঙ্কার দাস।

“তা সেই ওঙ্কারবাবু আমাকে নিয়ে সেই পথে সামান্য একটু নিয়ে গিয়ে দাঁড় করালেন একটা কাঠের বাড়ির সামনে। এইখান দিয়ে পাহাড় থেকে বয়ে চলা বৃষ্টির জলের একটা ধারা আছে। ঠিক তার গায়েই অনেকটা লগ-হাউস টাইপের বাড়িটা। পাইনগাছের সারির মাঝে অপূর্ব লাগছিল। বুঝলাম, প্রকৃতির বুকে থাকার জন্য কোনও ধনী ব্যক্তি এই বাড়িটা তৈরি করেছেন। প্রদ্যুৎবাবুর বাবাই নিশ্চয়ই সেই মানুষ। অথবা উনি কারও কাছ থেকে কিনেও থাকতে পারেন।

“আমাকে ইঙ্গিত করে বাড়ির দিকে এগিয়ে গেলেন ওঙ্কারবাবু। কাঠের দোতলা বাড়িটার সামনে কাঠের বারান্দা। সেখানে একটা ঘন্টা ঝুলছে। ওঙ্কারবাবু সেটাকে নাড়িয়ে আওয়াজ করলেন। অল্পক্ষণের মধ্যেই দরজা খুলে বেরিয়ে এলেন প্রায় আমারই বয়সী একজন মানুষ। পাজামা আর সোয়েটার পরা। ওঙ্কারবাবুকে দেখে বললেন, আরে এসো এসো, কতদিন পর… তারপরই ভদ্রলোকের দৃষ্টি পড়ল আমার দিকে। বিস্ফারিত চোখে আমার দিকে চেয়ে তার যেন কথা বন্ধ হয়ে গেল। সাত-আট সেকেন্ড পর মুখ খুলে কোনওমতে বললেন, তুই ফিরে এসেছিস, পল্টু!

“ওঙ্কারবাবু আমাকে ভিতরে নিয়ে গিয়ে পরিচয় করিয়ে দিলেন বিদ্যুৎবাবুর সঙ্গে। সেই পাজামা-সোয়েটার পরা ভদ্রলোকই বিদ্যুৎবাবু। উনিও কিছুতেই মানছিলেন না যে আমি প্রদ্যুৎ নই, অনির্বাণ। তারপর এগিয়ে এসে আমার ডান কানের কাছে জুলপির চুল তুলে হতাশ ভঙ্গিতে বললেন, নাহ, তুই, ইয়ে আপনি প্রদ্যুৎ নন। ওর এইখানে একটা আঁচিল ছিল। সেটা আপনার নেই।

“আমি বললাম, সে তো আমি জানিই। কিন্তু এই প্রদ্যুৎবাবুর ব্যাপারটা একটু খুলে বলবেন কি? আমিও রীতিমতো অবাক হয়ে গেছি।

“প্রদ্যুৎ আমার ভাই। ও পল্টু আর আমি লাল্টু। বিদ্যুৎবাবু বললেন, আমি বড়ো আর ও আমার থেকে দু’বছরের ছোটো। একটু বেশি অভিমানী। আমাদের কাঠের ব্যাবসা। পাহাড়ি জঙ্গলে ইজারা নিয়ে কাঠ কেটে শহরে শহরে পাঠাই। শিলিগুড়িতেও বেশ কয়েকটা বাড়ি আছে। এদিকে কাজের সূত্রে থাকতে হয় বলে এই বাড়িটা বাবা কিনেছিলেন। একটা ঝামেলার সূত্রপাত হয় এই বাড়িটাকে নিয়েই। ভাইয়ের ইচ্ছে ছিল এই বাড়িটা ওকে বাবা লিখে দিক। কিন্তু ভাই এই ব্যাবসায় নেই, চাকরিবাকরিও তেমন কিছু করে না। শুধু ঘুরে ঘুরে বেড়ায়। কবিতা-টবিতাও লেখে। তা বাবা ওকে শিলিগুড়ির একটা বাড়ি লিখে দিয়েছেন আগেই। বেশ বড়োসড়ো বাড়ি। নিচে একটা ব্যাঙ্ক ভাড়া নিয়েছে। এ.টি.এমও আছে। তার রোজগার থেকে ওর ভালোভাবেই চলে যাবার কথা। কিন্তু ওর ইচ্ছে, এই বাড়িটাও ওকে দিয়ে দেওয়া হোক। ওর এইখানকার প্রকৃতি খুব ভালো লাগে। অথচ এই কাঠের ব্যাবসার জন্যই আমার এই বাড়িটা ভীষণ দরকার। মাসখানেক আগে সেই নিয়ে বাবা ওকে কড়া করে শুনিয়ে দিয়েছিলেন একদিন। ব্যস, তার পরদিন থেকেই ও নিপাত্তা। রিকিসুম, আলাগাড়া, শিলিগুড়ি, আত্মীয়স্বজনদের বাড়ি সর্বত্র প্রচুর খোঁজখবর করছি সেই থেকে, কিন্তু কোত্থাও হদিস নেই। বাবা মুখে যাই বলুন না কেন, উনি ওকে খুব ভালোবাসেন। চিন্তায় চিন্তায় উনি রীতিমতো অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। খবরের কাগজে বিজ্ঞাপনও দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু কিচ্ছু হল না। ছেলেটা বেমালুম উধাও!

“ভদ্রলোক মাথা নিচু করে মাটির দিকে চেয়ে বললেন, মাঝে মাঝে নিজেকেই দোষী বলে মনে হয়। আমার জন্যই রাগ করে ও বাড়ি ছেড়ে চলে গেল। তারপর উনি আমার দিকে চেয়ে বললেন, আপনার সঙ্গে আমার ভাইয়ের অদ্ভুত মিল। কে বলবে যে আপনি প্রদ্যুৎ নন! সেই মুখ, সেই নাক, চোখ, সেইরকম কথা বলার স্টাইল! অদ্ভুত! এমনও হয়?

“আমি বললাম, ওঙ্কারবাবুর মুখ থেকে শোনার পর থেকে আমারও ভারি কৌতূহল হচ্ছে। আপনার ভাইয়ের একটা ছবি দেখাতে পারেন?

“হ্যাঁ হ্যাঁ, নিশ্চয়ই। বিদ্যুৎবাবু উঠে গিয়ে ভিতর থেকে একটা ফ্রেমে বাঁধানো ছবি নিয়ে এলেন। তাতে এক বৃদ্ধ ভদ্রলোকের দুইপাশে দু’জন দাঁড়িয়ে। একজন যে বিদ্যুৎবাবু সেটা বলে দেবার অপেক্ষা রাখে না। আর অন্যজন — মশাই, বললে বিশ্বাস করবেন না, আমি—অবিকল আমারই প্রতিরূপ! কোনও ফারাক নেই! দুটো মানুষের যে এতটাই মিল থাকতে পারে যে নিজের ভাই পর্যন্ত চিনতে ভুল করে, এমনটা আগে কক্ষনও শুনিনি! এইরকম অনাত্মীয় দু’জন মানুষের মিল থাকলে ইংরেজিতে তার কী একটা নাম আছে বলে শুনেছি…”

আমরা হাঁটতে হাঁটতে ভিউ পয়েন্টের পাহাড় থেকে নেমে রাস্তায় এসে পড়েছিলাম। সামনেই একটা চায়ের দোকান ছিল। বেঞ্চি পাতা। আমরা সবাই বসে পড়লাম। অমরবাবু চায়ের অর্ডার করলেন। রাস্তার উলটোদিকে খাদের ওপারে আরেকটা পাহাড়। সেটা জঙ্গলে ভরা। ওখানে কেউ নাকি বাস করে না। ওটা সংরক্ষিত অরণ্য। সেইদিকে চেয়ে ক্যামেরা ফোকাস করতে করতে টোটোদা বলল, “ডপেলগ্যাংগার।”

“অ্যাঁ?” অমরবাবু যেন বিষম খেলেন।

টোটোদা বলল, “এটা একটা জার্মান শব্দ। জ্যঁ পল নামের এক লেখক ১৭৯৬ সালে তাঁর উপন্যাস সিনকাস-এ প্রথম ব্যবহার করেছিলেন।”

“অ।” অমরবাবু আর বিশেষ কথা না বাড়িয়ে গরম চায়ে চুমুক দিলেন।

টোটোদা মুচকি হেসে ডাবলুবাবুর দিকে তাকিয়ে বলল, “আপনি ছবিটা হাতে নিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেছেন? কম্পিউটারের কারিকুরি নয় তো?”

“না মশাই, কম্পিউটারের ব্যাপার-স্যাপার আমি অত বুঝি না, আর সেই সময় আমার মাথায় ওসব আসেওনি। আমি তাজ্জব হয়ে বসে রইলাম। যাক, আরও কিছু কথাবার্তা বলে ফিরে আসছিলাম, এমনি সময় বিদ্যুৎবাবু বললেন, ইয়ে, একটা রিকোয়েস্ট করব?

“বলুন না। আমি বললাম।

“আসলে বলতে সংকোচ হচ্ছে, তবুও না বলে পারছি না। ভদ্রলোক দ্বিধা নিয়ে দুটি হাত জোড় করে বললেন, আসলে বাবার যা অবস্থা, ডাক্তার জবাব দিয়ে দিয়েছেন। ছোটো ছেলের শোকেই মানুষটা শেষ হয়ে গেল। যদি আপনি একবার বাবার সামনে দাঁড়াতেন… মানে আমার ভাই সেজে যদি যেতেন একটিবার… মানুষটা অন্তত এইটুকু সান্ত্বনা নিয়ে মরত যে দুই ভাইয়ের মিল হয়ে গেছে। এইটুকু অনুরোধ ছিল আপনার কাছে।

“খুব খারাপ লাগল শুনে। আমারও তো বাবা ছিলেন। বছর দুয়েক আগে মারা গেছেন। এখানে এক পিতা ছোটো ছেলেকে একটিবার চোখের দেখা দেখবার আশায় মৃত্যুর দিন গুনছেন। আমি ওঁর হাতটাকে আমার মুঠিতে ধরে বললাম, চলুন, কোথায় আছেন আপনার বাবা?

“এই বাড়িরই দোতলায় একটি ঘরে খাটের ওপর কম্বল মুড়ি দিয়ে ঘুমাচ্ছিলেন বৃদ্ধ। মৃদু একটা আলো জ্বলছে। বিদ্যুৎবাবু বললেন, বাবার কাছাকাছি মোটেও যাবেন না, দূর থেকেই কথা বলবেন। আপনাকে হাতের কাছে পেলে ছাড়বে না আর আজকের মতো। কাছে বসিয়ে রাখবে। তারপর ডেকে তুললেন তাঁকে। দ্যাখো কে এসেছে…

“বৃদ্ধ বিস্ফারিত চোখে আমাকে দেখে ফ্যাসফ্যাসে সুরে অস্ফুটে বললেন, পল্টু! তুই এয়েচিস? এয়েচিস বাবা? চোখের জল ফেলতে ফেলতে বললেন, তুই যা চাস তাই হবে, বাবা। আর যাস না আমাদের ছেড়ে। জানবি আমরাই তোর সবচেয়ে আপনার।

“বিদ্যুৎবাবু সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, বাবা পল্টু আর যাবে না। তুমি নিশ্চিন্তে ঘুমাও।

“আমার মনটা ভারী হয়ে গিয়েছিল। বিদ্যুৎবাবু বললেন, আপনি তো কাছেই থাকেন। পারলে মাঝে মাঝে চলে আসুন। আমি বাবাকে বলব, পল্টু আজকাল আমাদের ব্যাবসার কাজ করছে। এদিক ওদিক যাতায়াত করছে। মাঝে মাঝে আপনি এলে বাবাও খুশি হয়ে যাবে। ভাববে, পল্টু সত্যিই ফিরে এসেছে।

“আমি কথা দিলাম, আসব।”

চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে টোটোদা বলল, “তারপর?”

বুল্টিও গোল গোল চোখ করে ঘটনাটা যেন গিলছিল। অমরবাবুর অবস্থা দেখে মনে হল ভদ্রলোক এমন আশ্চর্য ঘটনা জীবনে শোনেননি।

ডাবলুবাবু বলতে লাগলেন, “এমনি প্রায় রোজই অফিসের পরে হাঁটতে হাঁটতে যেতাম বৃদ্ধের সঙ্গে দেখা করতে। বেশ মায়া পড়ে গেছিল। মনে মনে বেশ রাগই হত আমার ডুপ্লিকেট প্রদ্যুতের ওপর। এভাবে নিজের বাবাকে কেউ কষ্ট দেয়? তা সপ্তাহখানেক পর একদিন বিদ্যুতবাবু বললেন, একটা কথা ছিল। বুঝতে পারছি না আপনি কীভাবে নেবেন বিষয়টাকে।

“আমি সামান্য অবাক হয়ে বললাম, এত কিন্তু কিন্তু করার কী আছে, বলেই দেখুন না!

“বিদ্যুৎবাবু হাত কচলাতে কচলাতে মাথা নিচু করে বললেন, বাবার বড়ো ইচ্ছে প্রদ্যুৎকে এই বাড়িটা লিখে দিয়ে যান।

“তা বেশ তো, তাতে অসুবিধে কোথায়? আমি ঠিক ধরতে পারি না ওঁর সমস্যাটা।

“সমস্যাটা হল, বাবার কাছে তো আপনিই প্রদ্যুৎ। আপনাকেই উনি উকিলের সামনে দানপত্র-সইসাবুদ করে বাড়িটা লিখে দিতে চাইছেন।

“মনটা খারাপ হয়ে গেল। বেচারি এই মৃত্যুশয্যাতেও নিজের ছেলেকে দেখে যেতে পারছেন না। বললাম, আমাকে কী করতে হবে?

“আপনি যদি আগামীকাল দুপুর নাগাদ আসতে পারেন তবে আমাদের পারিবারিক উকিল এখানে হাজির থাকবেন, বাবা কাগজগুলোয় সাইন করে দেবেন।

“আমি এককথায় রাজি হয়ে গেলাম। ঠিক হল, পরদিন আমাদের লাঞ্চ টাইমে দেড়টা নাগাদ আমি আসব। সেই সময় ওঁর বাবার পছন্দের উকিল ভদ্রলোকও হাজির থাকবেন।

“পরদিন ওখানে যেতে বিদ্যুৎবাবু আমাকে নিচু স্বরে বললেন, উকিল ভদ্রলোক বাবার ঘরে আছেন। ওখানে যাবার আগে একটা দরকারি কথা বলে নিই। কাল বলতে ভুলে গেছিলাম, দলিলে আপনাকেও কয়েকটা সাইন করতে হবে।

“বুঝলাম সেক্ষেত্রে আমাকেই প্রদ্যুৎবাবুর বকলমে সই করতে হবে। একটা সইয়ের মূল্য কী সেটা আমার অজানা নয়! একটু কঠিন সুরেই বললাম, আমি তো প্রদ্যুৎবাবুর সইটা করতে পারি না। এটা অন্যভাবে ম্যানেজ করতে হবে।

“বিদ্যুৎবাবু ইতস্তত করে বললেন, অনির্বাণবাবু, বলছিলাম কী, বাবার সামনে যদি এমনি এমনিই প্রদ্যুৎ বাগচী লিখে সাইন করে দেন… জাস্ট বাবাকে খুশি করার জন্য, আপনি-আমি-উকিলবাবুরা সকলেই তো জানি যে আপনি আমার ভাই নন।

“এবার আমি সত্যিই বিরক্ত হলাম। আমি বললাম, বিদ্যুৎবাবু, আমার পক্ষে অন্য কারও হয়ে সাইন করা অনৈতিক কাজ হয়ে যাবে। এটা পারব না।

“বিদ্যুৎবাবু হাঁ হাঁ করে উঠলেন। এ হে, আপনি ভুল বুঝবেন না, আমি বলছিলাম কী, বাবা তো চোখে দেখেন না, আপনি যা হোক কিছু একটা লিখে দিলেই হয়ে যাবে। বাবাকে খুশি করার জন্য বলছিলাম আর কী। ঠিক আছে, আপনি বরং আপনার নিজের নামটাই লিখে দেবেন। তাহলে তো আর কোনও সমস্যা নেই?

“এরপর আর কী বলা যায়। ওঁদের দলিলে আমার নামের সই থাকলে তার কোনও মূল্যই নেই। উকিলের সামনে বসে কাগজগুলোয় পরপর সাইন করে দিলাম। খুশিতে বৃদ্ধের চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ল। অনেক আশীর্বাদ করে বললেন, তুই যা চাইছিলি তাই হল। এই বাড়ি এখন তোর। কেউ তোকে এখান থেকে উত্খাত করতে পারবে না। তুই কিন্তু আর আমাদের ছেড়ে কোথাও চলে যাসনে।

“আমার খুব খারাপই লাগছিল, কারণ এক হিসেবে এটা বৃদ্ধকে ধোঁকা দেওয়া। কিন্তু এ ছাড়া আর কোনও উপায় ছিল না বৃদ্ধকে শান্তিতে জীবনের শেষদিনগুলো কাটাতে দেবার।

“এরপরই হল তাজ্জব ব্যাপার! এই ঘটনার পরদিন অফিস থেকে ফেরার সময় ওই পথে গিয়ে রীতিমতো চমকে উঠলাম। বাড়িটায় তালা মারা! ভেতরে কেউ নেই! কাছেপিঠে আর কোনও বাড়িও নেই যে কাউকে জিজ্ঞেস করব ওঁরা কোথায় গেলেন। চিন্তা হল। বৃদ্ধের শরীর খারাপ-টারাপ হয়নি তো? কিন্তু সে খবর নেবার কোনও উপায়ও নেই। বিদ্যুৎবাবুর ফোন নম্বরও নিয়ে রাখিনি যে ফোন করে একটা খবর নেব। মাথায় চিন্তা নিয়ে ফিরে এলাম।

“পরদিন আবার গেলাম। একইরকম তালা মারা। তার পরদিন গেলাম। তারও পরদিন। নাহ্‌, তালা খুলল না।

“পরের রবিবার আমার ছুটির দিন বেলা এগারোটা নাগাদ ঘুরতে ঘুরতে একবার গেলাম ওই পথে। দূর থেকে নজরে পড়ল, দরজাটা খোলা। সামনে ইজিচেয়ারে এক ভদ্রলোক শুয়ে রয়েছেন। প্রায় দৌড়তে দৌড়তে গেলাম। নাহ্‌, বিদ্যুৎবাবু বা তাঁর বাবা নন, অপরিচিত মধ্যবয়স্ক এক মানুষ বসে রয়েছেন। জিজ্ঞেস করলাম ওঁদের কথা। ইনি আকাশ থেকে পড়লেন। শুনলাম, এটা নাকি একটা গেস্ট-হাউস। শিলিগুড়ি থেকে বুকিং করতে হয়। দেখাশোনা করার জন্য প্রবীণ বলে একটি কমবয়েসী নেপালি ছেলে আছে। এমনিতে প্রবীণ নিজের গ্রামেই থাকে, লোকজন এলে দরকার হলে ডাকলে তাকে পাওয়া যায়। নইলে প্রতি রবিবার এসে সে সাফসুতরো করে দিয়ে যায়। আজ রবিবার বলে সে এখানে ছিল। জিজ্ঞেস করে জানলাম, এর আগে দুই ভদ্রলোক দিন পনেরোর জন্য ভাড়া নিয়েছিলেন বাড়িটা। কলকাতা থেকেই এসেছিলেন। তাঁদের ঠিকানা আর ফোন নম্বর দুই-ই শিলিগুড়ির অফিসে কথা বললে পাওয়া যেতে পারে।”

“তারপর?” অমরবাবু উত্তেজিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করলেন।

“শিলিগুড়িতে যোগাযোগ করে যে ঠিকানা আর ফোন নম্বর পেয়েছিলাম সবকটাই ভুল।”

“বলেন কী!”

“ভীষণ ঘাবড়ে গেছিলাম। কী উদ্দেশ্যে ওরা এসেছিল, আর কেনই বা চলে গেল কিছুই মাথায় ঢুকল না। অনেকের সঙ্গেই আলোচনা করে দেখেছি, কিস্যু বুঝতে পারিনি। তুমি ভেবে দেখো, কিছু যদি উদ্ধার করতে পার।”

টোটোদা ডান কানের ওপরের চুলে আঙুল ঘষতে ঘষতে মুখে রহস্যময় একটা হাসি নিয়ে বলল, “কিছু মনে করবেন না, অনেকদিন তো চাকরিবাকরি করেছেন, তা আপনার সম্পত্তি-টম্পত্তি কেমন জমেছে?”

“সেইটাই তো রহস্য,” ডাবলুবাবু বললেন, “প্রথমটা আপনার মতো আমারও মনে এসেছিল, যে আমাকে দিয়ে কোনও ভুলভাল ডকুমেন্টে সাইন করিয়ে আমার সম্পত্তি হাতাবার চক্করে আছে। কিন্তু হিসেব করে দেখলাম, সম্পত্তি বলতে ব্যাঙ্কে পড়ে আছে সাড়ে বারো হাজার। আমার আবার বই পড়ার নেশা। এই নেশার চক্করে কোনওদিন অফিস টাইমের বাইরে ওভারটাইম করিনি। প্রমোশনের জন্যে বড়োসাহেবের তাঁবেদারি করিনি। চাকরি আর বই পড়া, এই নিয়েই আছি। রোজগার যা করি তার বেশিরভাগই বই কিনতে খরচ হয়ে যায়। মাস গেলে বড়োজোর দু-তিন হাজার বাঁচে। পুজোর ছুটিতে সেই টাকায় দেশভ্রমণ করে বেড়াই। বিয়ে-থা করিনি। নিজের বাড়িটুকুও করতে পারিনি। পৈতৃক সম্পত্তি হিসেবেও কিস্যু জোটেনি। এমন মানুষের সাইন কোন কম্মে লাগবে ভগবানই জানেন। তিনকুলে কেউ নেই। থাকার মধ্যে আছেন শুধু এক পিসি নৈহাটিতে, তাঁর সঙ্গেও বহুদিন যোগাযোগ নেই। তিনি খুব বড়োলোক। পিসি আমায় ভালোবাসেন খুব, তবে আমার সেখানে যেতে বড়ই সংকোচ হয়। ওঁদের ওই বৈভবের সামনে আমি বড়োই বেমানান।”

বুল্টি ফট করে বলে উঠল, “পিসির ছেলেমেয়ে ক’টি?”

ডাবলুবাবু বললেন, “পিসি নিঃসন্তান। পিসেমশাইও মারা গেছেন বেশ কয়েকবছর আগে।”

টোটোদা বুল্টির দিকে চকচকে চোখে চেয়ে বলে উঠল, “সাবাশ, বুল্টি!” তারপর ডাবলুবাবুর দিকে চেয়ে উত্তেজিত স্বরে বলে উঠল, “আপনার ফোন নম্বর নিশ্চয়ই পিসির বাড়ির মানুষেরা জানেন না?”

“খুব স্বাভাবিক!” ডাবলুবাবু অবাক সুরে বলে উঠলেন, “পিসির সঙ্গে আমি তো সেভাবে যোগাযোগ রাখি না, আর এখানে আসার পর আগের মোবাইল নম্বরটাও বদলেছিলাম। কিন্তু এটা কেন জিজ্ঞেস করছ?”

টোটোদা উত্তেজিত স্বরে বলল, “আর সাইন করার আগে নিশ্চয়ই পুরো দলিলটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়ার প্রয়োজন মনে করেননি?”

“ঠিক তাই!” এবার ডাবলুবাবুও ভয়ানক চমকে গেছেন।

টোটোদা প্রায় চিত্কার করে উঠল, “মশাই, শিগগির একবার পিসির বাড়িতে যোগাযোগ করে দেখুন আপনার সব রহস্যের সমাধান পেয়ে যাবেন।”

“কী বলছ, আমি তো কিছুই…” ডাবলুবাবু ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়া সুরে বললেন।

টোটোদা বলল, “আমার ধারণা, আপনার পিসি ইহজগতে আর নেই। উনি নিশ্চয়ই আপনাকে সমস্ত সম্পত্তি দিয়ে গিয়েছেন, আর কেউ খুব চালাকি করে আপনাকে দিয়ে একটা পাওয়ার অফ অ্যাটর্নি জাতীয় কোনও কাগজে সই করিয়ে নিয়ে গেছে। যার দৌলতে আপনার পিসির উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া সমস্ত সম্পত্তি সে হস্তগত করে ফেলেছে। তাড়াতাড়ি খোঁজ নিয়ে দেখুন সে-সব আর আছে, না বেচেবুচে কেটে পড়েছে তারা।”

অমরবাবু ভ্রূ কুঁচকে বললেন, “আচ্ছা টোটো, আজকাল সম্পত্তি দানপত্র করতে হলেও তো শুনেছি দাতাকে খোদ হাজিরা দিতে হয় কোর্টে!”

টোটোদা হেসে বলল, “সব তালারই চাবি থাকে, মশাই। যারা এত চালাকি করে ডাবলুবাবুকে দিয়ে সাইনটা করিয়ে নিতে পারল, তারা বাকিটুকুও ঠিক সামলে নিতে পারবে, নিশ্চিন্ত থাকুন।”

অমরবাবু মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ে বললেন, “বাপ রে!”

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত