আজ শুক্রবার। ভার্সিটি বন্ধ তাই ঘুমাচ্ছি।ঘুমন্ত অবস্থায় মেঘলার কন্ঠ শুনতে পেয়ে ঘুমটা ভেঙে যায়। ভাইয়া! ও ভাইয়া! আজকে আমাকে একটু ঘুরতে নিয়ে যাবি।অনেক দিন তুই ঘুরতে নিয়ে যাস না।ফুসকা,চটপটি,আইসক্রিম ও খাওয়াস না।আজকে চলনা একটু ঘূরে আসি। ভাইয়া ও ভাইয়া যাবি, চলনা চচচলনা ভাইয়া। আমি বলি আচ্ছা নিবো এখন যা ঘুমোতে দে। বিকালে নিয়ে যাবো, এই বলতে পাগলী বোনটা আমাকে জড়িয়ে ধরে একটা পাপ্পিয়া দিয়ে আমার জড়িয়ে শুয়ে থাকে।
ও হ্যা ও হচ্ছে মেঘলা, আমার ছোট বোন। বয়স মাত্র ৫ বছর। খুব ভালোবাসি মেঘলাকে। অনেক দিন মেঘলাকে নিয়ে কোথাও ঘুরতে যাই না। আসলে ভার্সিটির ব্যস্ততার জন্য হয়ে ওঠে না। মেঘলা আমার গলা তার দু হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে যায়। খুব মহনীয় লাগছে মেঘলাকে। আমি মেঘলার কপালে একটা চুমি দিয়ে বলি পাগলী বোনটা আমার।এই বলে ভাই বোন মিলে কিছু সময় ঘুমিয়ে নেই। মায়ের ডাকে আমার আর মেঘলার ঘুম ভাঙে।আমি মেঘলাকে বলি যা সুন্দর একটা জামা পরে নে।আমি ফ্রেস হয়ে আসছি।
মেঘলাকে নিয়ে বিকালে ঘুরতে বের হই।আমরা রাস্তার পাশ দিয়ে হাটতে হাটতে যাচ্ছি আর একটু দুষ্টামি করছি।মেঘলা আমাকে ডাক দিয়ে বলে ভাইয়া আইসক্রিম খাবো।আমি বলি আচ্ছা দাড়া আনছি। রাস্তার ঐ পাশে একটা দোকান দেখতে পাই, গিয়ে বোনটার জন্য আইসক্রিম নিয়ে আসি।আমরা হাটতে থাকি, মেঘলা আমাকে ডেকে বলে ভাইয়া কোলে নে হাটতে পারছিনা। আমি মেঘলা কে কোলে নিয়ে হাটতে থাকি। মেঘলাকে নিয়ে শিশু পার্কে যাই। সেখানে মেঘলা আর আমি অনেক মজা,দুষ্টামি করি।
সন্ধার দিকে একটা রিক্সা করে বসার দিকে ফিরছিলাম। হটাৎ পিছন থেকে একটা বাস নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে এবং খুব জোরে রিক্সায় ধাক্কা দিতেই মেঘলা ছিটকে পড়ে রাস্তায়।আমিও পড়ে যাই,হটাৎ মেঘলার আওয়াজটা কানে আসতেই বুকটা কেপে ওঠে। মেঘলা অজ্ঞান হয়ে গিয়েছে।মাথা ফেটে গেছে, ঘিলু কিছুটা বেরিয়ে গেছে। সেটা দেখে কি করবো বুঝতে পারছি না। অনেক রক্ত বের হচ্ছে। আমি আমার শার্ট খুলে মেঘলার মাথাটা বাঁধি কিন্তু রক্ত বের হও থামছে না।আমি মেঘলাকে কোলে নিয়ে হাসপাতালের দিকে দৌড়াতে থাকি। হাসপাতালে পৌছাতেই মেঘলাকে ওটি তে নিয়ে যায়। মেঘলার অবস্থা খুব খারাপ। কান্নায় বুকটা ফেটে যাচ্ছে কি করবো বুঝতে পারছি না। আম্মু-আব্বু খবর পেয়ে পাগলের মত ছুটে আসে। আমার মাথা দিয়ে রক্ত বের হচ্ছে সেদিকে আমার কোন খেয়াল নেই। চোখের পানি একের পর এক বের হচ্ছেই। আর আল্লাহর কাছে বলি আল্লাহ মেঘলার যেন কিছু না হয়।এর মধ্যে ডাক্তার বেরিয়ে এসে বলে দূরত “এ পজেটিভ” রক্তের ব্যবস্থা করুন।আমাদের এখানে “এ পজেটিভ” রক্ত নেই।
কয়েক জাইগায় খোজ নিয়েছি কিন্তু পাওয়া যায় নি।রক্ত না পেলে রোগিকে বাঁচানো সম্ভব নয়।যত তাড়াতাড়ি পারেন রক্তের যোগাড় করুন সময় খুবি কম।কথা শুনে আমি কাকুতি মিনতি করে বলি ডাক্তার আমার বোনকে বাঁচান ডাক্তার যত টাকা লাগে দিবো, প্লিজ ডাক্তার প্লিজ কিছু একটা করুন।আমি এই বলে কাঁদতে কাঁদতে হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে যাই। কোথাও রক্তের সন্ধান পাচ্ছি না। অনেকের কাছে সাহায্য চাইলাম কিন্তু কেউ করলো না। ফেসবুকে পোষ্ট দিলাম সেখানেও কেউ কোন প্রত্যুত্তর করে নি।তাদের মধ্যে কি কেউ ছিলো না “এ পজেটিভ ” রক্ত বহনকারী। কিন্তু না সবাই এটা দেখেও কেউ এগিয়ে আসে নি। খুব কষ্ট পেয়েছিলাম,মানুষগুলো কতটা স্বার্থপর। বিভিন্ন গ্রুপেও খোজ নিলাম কিন্তু কোন সাড়া পাই নি। আমি কাঁদছি আর হাটছি,এখনও রক্তের যোগাড় করতে পারি নি। ওদিকে মেঘলা বোন আমার মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছে। আমার মাথায় রক্ত, আমার কান্না দেখে টং দোকানে বসে থাকা এক ভাইয়া আমার দিকে আসেন।
তিনি আমার সকল কথা শুনেন এবং বলেন আমার রক্তের গ্রুপ “এ পজেটিভ” চলো আমি তোমার বোন কে রক্ত দিবো।আমি তাকে নিয়ে হাসপালে যাই কিন্তু বুকের ভিতর ছ্যাত করে উঠলো।আম্মু আব্বু একদম নিশ্চুপ হয়ে সামনের সাদা কাপড়ে ঢেকে রাখা বেডে দিকে তাকিয়ে আছে।আমি এক দৌড় দিয়ে বেডের কাছে যাই।আব্বু আব্বু বলে চিৎকার দিয়ে বলছি আমার বোনের কি হয়েছে যে ঢেকে রেখেছে বলো আব্বু বলো, বোন! বোন আমার ওঠ কথা বল ভাইয়ার সাথে ওঠ বোন ওঠ ওঠ। আব্বু আমাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দেয়, কাঁদো গলায় বলে মেঘলা আমাদের ছেড়ে চলে গেছে না ফেরার দেশে।আমি আর নিজেকে সামলাতে পারি নাই।আমি বোনকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকি। আর বলি ও বোন বোনরে আমায় ছেড়ে চলি গেলি। আমায় কে বলবে ভাইয়া আমাকে ঘূরতে নিয়ে যাও, কে বলবে ভাইয়া আইক্রিম খাবো কে বলবে ভাইয়া আমার জন্য খেলনা নিয়ে আসবি। কে আমাকে এখন জড়িয়ে ধরে ঘুুমাবে। কে আমায় ভাইয়া বলে চুমু দিবে।
এই বলছি আর কেঁদেই চলছি।আমার কান্নায় সবাই কেঁদে দেয়।আমার সাথে আসা ভাইয়াটি ও কেঁদে দেয়। আমাকে এসে সান্তনা দিচ্ছে কিন্তু নিতে পারছি না।যেই বোন একটু আগেও আমার সাথে ঘুরেছে,কথা বলেছে,ভাইয়া বলে ডেকে সে যে একদম চিরতরে চুপ হয়ে গিয়েছে।সে যে আমায় আর ভাইয়া বলে ডাকবে না।কান্না যে আমার থামতে চাইলো না। আমি অজ্ঞান হয়ে যাই। আমার শরীর থেকেও অনেক রক্ত বের হয়েছে। তাই হটাৎ অজ্ঞান হয়ে যাই পরে কিছু সময় পর আমার জ্ঞান ফিরে আসে। আমি মেঘলা মেঘলা বলে চিৎকার করি, ছুটে যাই মেঘলার কাছে। মেঘলাকে পবিত্র গোসল দিচ্ছে। গোসল,জানাজা শেষে রেখে আসি বোন কে অন্ধকার ঘরে আর প্রতিজ্ঞা করে আসি আর কোন ভাইয়ের থেকে রক্তের অভাবে হারিয়ে যেতে দিবো না। কাঁদতে কাঁদতে বাসায় আসি,ঐ ভাইয়া আমার সাথেই ছিলো।আমার অবস্থাও খারাপ ছিলো। সব সব সময় ভাইয়াটা আমার পাশে ছিলেন।
ও হ্যা ভাইায়ার পরিচয় দেই ভাইয়ার নাম সাখাওয়াত হোসেন।গ্রামের বাড়ি রাজশাহী।খুব কোমল মনের মানুষ, জন দরদীও বটে।ভাইয়া কে বলি ভাই আমার ছোট বোন কে রক্তের অভাবে বাঁচাতে পারি নি।এমন অনেকে আছে যারা রক্তের অভাবে প্রিয়জন ছেড়ে চলে যায়।আমরা যদি একটা “রক্তদান” নামে একটা সংগঠন করি এবং এই সংগঠনটি এদের সেবায় নিয়জিত থাকবে। প্রতিটি হাসপাতালে আমাদের সংগঠনের নাম্বার থাকবে, আমাদের ফোন করতেই আমারা ছুটে যাব তাদের সেবা দিতে।তাদের রক্ত দিতে।এভাবে রক্তের জন্য হারাতে দিবো না পরিবারে প্রিয়জনকে।সাখাওয়াত ভাই আমাকে অনুপ্রেরণা দেয়,তার মতামত সাপেক্ষে কাজ করতে থাকি। আমরা একটা “রক্তদান” নামে ফেইসবুকে গ্রুপ খুলি।
স্বপ্নীল ভাই,সেতুদা ভাই, নাহিদ ভাই, মামুন ভাই, জেসুস আপু এদের নিয়ে আমাদের “রক্তদান” সংগঠনের যাত্রা শুরু করি। সেতুদা একটা মত প্রকাশ করেন যে, আমরা একটা তালিকা তৈরি করি, সেখানে সবার নাম, ঠিকানা, ফোন নাম্বার ও রক্তের গ্রুপ থাকবে। তিনার এই মতে সবাই সহমত পোষণ করে।আমরা একটা তালিকা তৈরি করি এবং সবখানে আমাদের সংগঠনের নাম্বার ছড়িয়ে দেই বিভিন্ন ভাবে। প্রতিদিন আমাদের কাছে ফোন আসে আর আমারা সেই নিকটবর্তী সদস্যকে মেসেজ করে যেতে বলি “রক্তদান” কমিটিও পৌছিয়ে যাই।কিছু দিনের মধ্যেই আমাদের সংগঠনটি পরিচিতি ও সদস্য বাড়তে থাকে। বিভিন্ন জেলায় আমারা সংগঠন করে তুলি। সেখানে দায়িত্ব থাকে আমাদের সংগঠনের সদস্য। স্বপ্নীল ভাই ফরিদপুরে রক্তদান সংগঠনে, সেতুদা চট্টগ্রামে,নাহিদ ভাই বগুড়ায় এভাবে বিভিন্ন জেলায় আমাদের সংগঠন পরিচিতি লাভ করে এবং মানুষের সেবায় অটল থাকে।
আজকের দিনে আমার বোন মেঘলা ছেড়ে যায় আমাদের।প্রতিবছর মেঘলার কবরের পাশে যাই বোনের সাথে একটু কথা বলতে।সে কোন উত্তর দেয় না শুধু শুনেই যায়। আমি বোনের কবরের পাশে গিয়ে বলি মেঘলা বোন আমার, আজ কোন ভাইয়ের থেকে রক্তের জন্য হারিয়ে যেতে হয় না তার কোন বোনকে আল্লাহর রহমতে।আমরা খোজ পেতেই পৌছে যাই সেখানে।জানিস বোন সেদিন কেউ আমাকে সাহায্য করতে পাশে দাড়য় নি, জানিস বোন সেদিন সাখাওয়াত ভাই আমার পাশে এসে দাড়িয়ে ছিলো কিন্তু খুব দেরি করে ফেলেছিরে বোন আসতে।ক্ষমা করে দিস ভাইটারে। ক্ষমা করিস বোন আমার এই বলে চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে কাঁদতে থাকি। পিছন থেকে সাখাওয়াত ভাই,স্বপ্নীল ভাই,মামুন ভাই, সেতুদা আমাকে এসে জড়িয়ে নেয়। সবাই আমাকে খুব আদর করে, তাই হয়তো আমার কষ্টটা নিজেরা ভাগ করে নিচ্ছে।আমাকে সাহস যোগাচ্ছে। এভাবে উনারা আমাকে বিগত ৫ বছর ধরে সাহস যুগিয়ে চলেছে। ভালোবাসি ভাইগুলোকে, আমাদের “রক্তদান” সংগঠন আজও মানুষের সেবাই ছুটে যায় তাদের কাছে। আল্লাহর রহমতে আমাদের এই “রক্তদান” সংগঠনের রক্তের বিনিমেয় ফিরে পায় নতুন জীবন।।
আসুন আমরা সকলে এগিয়ে আসি, রক্তদানের মাধ্যেমে বাঁচিয়ে দেই মানুষের প্রাণ।ফিরিয়ে দেই তাদের নতুন জীবন । তবে কোন স্বর্থ ছাড়াই “রক্তদান” সংগঠনের পক্ষে কাজ করে যাই।গড়ে তুলি “রক্তদান” সংগঠন।মানুষের সেবায় নিয়জিত থাকি সব সময়। আপনার রক্তে হয়তো ফিরে পেতে পারে নতুন জীবন। রক্তের আভাবে যেন হরাতে না হয় আমার মত কারো প্রিয় বোনকে। চলে যেতে না হয় না ফেরার দেশে। আসুন রক্তদিয়ে বাঁচিয়ে রখি এমন বোন,মা-বাবা,ভাইয়ের মত মানুষদের।ফিরিয়ে দেই তাদের ভালোবাসার মানুষের কাছে।আল্লাহ হয়তো আমাদের রক্তের জন্য বাঁচিয়ে দিতে পারে কিছু মানুষের জীবন।আমাদের স্লোগান হোক রক্ত দেই,জীবন বাঁচাই।এগিয়ে আসুন মানবতার সেবাই।নিয়জিত থাকি সব সময়…..
সমাপ্ত