‘বিয়ে তোমাকে এই মেয়েকেই করতে হবে। আমি কথা দিয়েছি তাদের।’
কথা শেষ হতেই আশরাফ সাহেব সোফা ছেড়ে উঠলেন, শরীর জুড়েই অনিয়ন্ত্রণতা লক্ষণীয়। চা’র কাপটা বেশ শব্দ করেই টেবিলে রাখলেন, যেন আদেশ জারির শব্দ।
কিছুক্ষণ আগের স্বাভাবিকতায় ভাঁটা পড়েছে প্রিয়ম’র। গুটিয়ে যাওয়া নিজেকে ঘন ঘন নিঃশ্বাস নিয়ে পরিস্থিতির সাথে ভারসাম্য রক্ষায় ব্যস্ত সে। নিঃসৃত প্রতিটি শ্বাস রাগ, ক্ষোপ, হতাশায় পূর্ণ।
‘মা, তুমি অন্ততঃ বাবাকে বুঝাও। আমি এই মেয়েকে বিয়ে করতে পারবো না।’
মায়ের দিকে না তাকিয়েই আকুতি জানায় প্রিয়ম।
‘মেয়েটা কিন্তু অনেক ভালো। আর তাছাড়া তোর বাবাকে বলে কোন ফল হবে না।’
নিজের অসহায়ত্ব উপস্থাপন শেষেই উঠে নিজের কাজে চলে যায় সাজেদা বেগম।
পেন্ডুলামের মতো দুলতেই কেটেছে সারাটা দিন। সন্ধ্যার চা আসরেও যেতে ইচ্ছে হলো না প্রিয়মের। ভেতর থেকেই দরজা লাগিয়ে আপাত বুঝানোর চেষ্টা ‘এটা আমার ওপর অন্যায়’।
প্রিয়মের হাজারো প্রচেষ্টার ফল যে শূন্য, তা সে নিজেও জানে এবং জেনেই চলেছে। মাঝে মাঝেই পাশের ঘর থেকে আশরাফ সাহেবের কণ্ঠ ভেসে আসছে। বয়স কখনোও কখনোও রক্তের সাথে মিশে অদম্যতা সৃষ্টি করে, অবাধ্য হতে শেখায়; তেমনটাই ঘটে চলেছে প্রিয়মের মাঝে। একটা দেয়ালের পার্থক্য দূরত্বে বাবার আদেশ ও ইচ্ছাগুলোকে যেন জানি ‘মাত্রাতিরিক্ত’ মনে হচ্ছে ওর।
রাতের খাবার টেবিলে কথা বাড়াতে ইচ্ছে হলো না কারোই। খাবার পর্ব সেড়ে সবার আগেই আশরাফ সাহেব উঠলেন, হয়তো এমনটাই চেয়েছিলো প্রিয়ম। উঠলেন সাজেদা বেগমও।
অনেকটা সময় পর আশরাফ সাহেব নিজেই আসলেন ছেলের ঘরে।
‘এই হলো ছবি আর মোবাইল নম্বর, কথা বললে বলে নিতে পারো। কালকের মাঝেই আমি সিদ্ধান্ত চাই।’ টেবিলের ওপর ছবি ও নম্বর লিখা কাগজ রেখে বেড়ুলেন আশরাফ সাহেব।
কোন কথা বলতে মন সায় দিলো না প্রিয়মের, বাবা বেড়ুনোর পর দরজাটা লাগিয়ে বিছানায় উঠে বসলো সে।
নিজের ওপরই নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছে বারবার; একবার ল্যাপটপ ওপেন আবার সাটডাউন, মোবাইলে ডাটা অন-অফ, ঘরের এপ্রান্ত-ওপ্রান্ত হাটাহাটি, মোবাইল নম্বর লিখা কাগজটা হাতে নিয়ে আবার রেখে দেওয়া। ছাদে গিয়েও দু’বার সিগারেটের ওপর রাগ ঝেড়েছে।
মধ্যরাতের কিছুটা আগে নম্বরটায় ডায়াল করলো প্রিয়ম; বেজেই চললো। আবার ডায়াল করলো।
‘হ্যালো’-ঘুম জড়ানো কণ্ঠ।
কি ভেবে ফোন দিয়েছিলো তা ভুলে গেছে প্রিয়ম। ওপাশ থেকে ‘হ্যালো, হ্যালো’ চললোই।
‘আমি প্রিয়ম’ এটুকু বলেই যেন হাঁপিয়ে উঠলো সে।
‘জি বলুন। আপনার নম্বর আমাকে বাড়ি থেকেই দিয়েছে। কিছু বলবেন?’ ঘুমাচ্ছন্নতায় আবৃত কণ্ঠ তখনোও।
‘শুনুন, আমি বিয়েটা করতে পারবো না। আর অনুগ্রহ করে আমার বাবাকে বিষয়টা বলে দয়া নিবেন না।’
কথা ফেরত আসলো না ঠিকই, কিন্তু ফোনটাও কাটলো না। ভয়-অভয়ের মিশ্রণে কিছুটা সময় পর প্রিয়মই ফোন কেটে দিলো।
অস্থিরতা নিজের মাঝে অনুভব করছে না প্রিয়ম। যেজন্য এতটা অস্থিরতা তা ভালোভাবে মেটাতে পেরে নিজের ওপরও একটা ভালোলাগা কাজ করছে। ভাবনাগুলো ছুটেই চললো প্রিয়মের; একাধিক ভাবনা।
‘তুর্বা কি ফিরতি কল দিবে?’ ‘বাবাকে যদি বলে দেয় ও’, ‘এভাবে বলাই কী সমাধান?’
সময়ের অনুকূলেই ভাবনাগুলো এগুতে থাকলো। তুর্বাকে সরাসরি বলতে পারার আনন্দই ধীরে ধীরে আধার হয়ে ঘিরে ধরলো প্রিয়মকে।
মা’র অনবরত ডাকে ঘুম ভাঙলো, ঘড়িটায় সকাল নয়টা বাইশ।
খাবার টেবিলটায় বাবার চিন্তিত মুখায়ব প্রিয়মকে নতুনভাবে ভাবাতে শুরু করলো। কথা তুললো না কেউই, এমন প্রত্যাশাই ছিল।
দুপুরের ক্ষুধাও সহ্য করলো প্রিয়ম, তবুও যেন বাবার প্রশ্নের সম্মুখীন হতে না হয়। এলোমেলো সময় কাটিয়েই সন্ধ্যার আভাটায় পৌঁছলো সে। সম্পূর্ণই এলোমেলো; বন্ধুদের সময়দানকে অপ্রয়োজনীয় লাগলো, নাস্তার টাকায় নিকোটিনের চাহিদাই তৃপ্তিকর মনে হলো তার।
সময় দেখতে মোবাইল হাতে নিয়েই চমকে উঠলো প্রিয়ম; একত্রিশ টি মিসড্ কল!! বিদ্যুতগতিতেই ফিরতি কল দিলো সে, বেজেই চললো। হালকা বাতাসেও শরীর ঘামতে শুরু করলো তার।
‘হ্যালো’
রিসিভ হয়েও কথা আসছে না ওপাশ থেকে, মায়ের কণ্ঠে কান্না।
‘হ্যালো! কি হয়েছে মা?’ উৎকণ্ঠায় উগ্রতা প্রিয়মের শরীর ও ভাষায়।
‘তোর বাবা হাসপাতালে……’
কথার পরিশিষ্টতা আয়ত্তে নিতে সময় লাগলো না প্রিয়মের।
মধ্যরাতেও জ্ঞান ফিরলো না আশরাফ সাহেবের, আইসিইউ’তেই নিথর দেহখানা জীবনের আশায় পরে আছে। সাজেদা বেগমের উৎকণ্ঠা কাঁচের দেয়াল ভেদ করে স্বামীর কাছে পৌঁছায় নি এখনোও। ঘুমের সাথে তন্দ্রাযুদ্ধকে উপেক্ষা করার প্রাণবন্ত চেষ্টায় তিনি। কতক সময় পর পর চেয়ার ছেড়ে কাঁচের দেয়ালটার কাছে ফিরছেন, হাজার প্রার্থনার পার্থক্য হয়ে যেন কাঁচের দেয়ালটাই। মুখে আঁচল টেনে কান্না লুকানোর চেষ্টায় আবার চেয়ারটায় ফেরেন।
মা’কে শান্তনা দেবার ভাষাটুকু প্রিয়মের জানা নেই। চতুর্থ তলার মুল ফটকের সিড়ির পাশটায় দাঁড়িয়ে মাঝে মাঝে উঁকিটাই যেন তার শান্তনা। এসেছিলো তুর্বার পরিবারও, চলেও গেছে; রয়ে গেছে তুর্বা।
রাত তিনটা দশ। সাজেদা বেগম চেয়ারে হেলান দিয়েই ঘুমিয়ে পড়েছেন, পাশের চেয়ারটায় তুর্বা; তখনোও জেগেই আছে। সিড়ির পাশটায় এদিক-ওদিক পায়চারী করতেই ঘড়ির কাটা এগিয়ে নেওয়ার চেষ্টায় প্রিয়ম।
জীবনের দামগুলো মানুষ বুঝতে পারে অন্তিম সময়গুলোতেই, যখন করণীয় শূন্য। জেগে থাকা অস্থির মানুষগুলোর স্বজনের সুস্থতা প্রার্থনা প্রতিটি সময়ই জেগে জেগে উঠে হাসপাতালে। কারো স্বজন হারানোর আত্মচিৎকার, কারোবা হারানোর আগের সেবাময় অস্থিরতা; এগুলো দেখতে দেখতেই রাত প্রায় ভোর। ক্লান্তি যেন সবার অস্থিরতা কমিয়ে দিয়েছে রাতের শেষ ভাগটায়।
‘একটু ঘুমিয়ে নিন।’
হঠাৎ কারো কণ্ঠে নিজেকে ফিরে পায় প্রিয়ম। তুর্বা!! ঠিক পাশেই দাঁড়িয়ে।
‘আপনি একটু ঘুমিয়ে নিন, আমার ঘুম আসবে না।’
ঠায় দাঁড়িয়ে তুর্বা। খোলা চুল, সাধারণ পোশাকের সমাহার, খালি পা।
‘বিরক্ত নিবেন না, কিছু কথা বলতাম।’ সাবলিল ও নিচু কণ্ঠ তুর্বার।
কথা সামলে নেওয়ার মতো মানসিক ও শারীরিক অবস্থায় নেই প্রিয়ম। দায়সাড়া উত্তর ‘জি বলুন’।
‘পছন্দের কেউ আছে আপনার?’ তুর্বার কথায় অপ্রস্তুত প্রিয়ম।
‘না। আর আপনার কাছে এমন কথা আশাও করিনি আমি।’ চোখে-মুখে বিরক্তি প্রিয়মের।
‘তাহলে আমি দেখতে কালো বলে বিয়ে করবেন না?’
প্রশ্নটায় মেজাজ হারিয়েও স্থির রইলো প্রিয়ম, মুখোমুখি দাঁড়িয়েই প্রশ্ন করেছিলো তুর্বা।
‘আপনি কী ভেবেছেন আমার বাবা তাঁর কালো মেয়েকে পাত্রস্থ করার জন্য আপনাকে ফাঁসাচ্ছে? আমি আপনার ক্যারিয়ারের লোভে আসক্ত? এগুলো কিছুই নয়। আপনার বাবা কেন আমাকে পছন্দ করেছেন তা উনিই জানেন, আমি শুধু আপনার বাবার পছন্দকে শ্রদ্ধা জানিয়েছি। আর আপনি আমায় কি বলেছেন তা কাউকে বলিনি কোন সুবিধা নেওয়ার জন্য।’
শুনেই যাচ্ছিল প্রিয়ম ইচ্ছা-অনিচ্ছায়। উত্তর দেওয়ার মতো কোন প্রশ্নই তার সামনে নেই।
‘আপনার কথার কোন উত্তর আমার জানা নেই। আরোও কিছু বলার আছে?’ যতটা মুখোমুখি দাঁড়িয়েই জানতে চাইলো প্রিয়ম।
এই প্রথম প্রিয়মের দিকে দৃষ্টি রাখলো তুর্বা।
‘আচ্ছা ভাবুন, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ রূপবতীকে আপনি বিয়ে করলেন। বিয়ের পর কোন কারণে অন্ধ হলেন, তখনোও কি আপনার স্ত্রীকে ফর্সাই দেখতে পাবেন?’
‘প্লিজ থামুন এবার’-প্রিয়মের নিচু কণ্ঠের বার্তা।
আশরাফ সাহেবের মৃত্যুর চতুর্থ দিন আজ। আইসিইউ-এর ঘুম আর ভাঙ্গেনি তাঁর। শেষ কথাটাও বলা হয়ে উঠেনি স্ত্রী সাজেদা বেগম ও প্রিয়মের সাথে। বাড়ির পূর্ব পাশটায় জলপাই গাছটার নীচেই কবর দেয়া হয়েছে।
বাড়ির শোকটা এখনোও শক্তি হয়ে উঠেনি, কথা হারিয়ে ফেলেছে প্রিয়ম, সত্ত্বা হারিয়েছে সাজেদা বেগম, অনবরত স্বাভাবিকতা ফেরাবার ব্যর্থ চেষ্টায় তুর্বা। প্রচলিত সামাজিকতা উপেক্ষা করে একজন মেয়ে যেভাবে বাড়িটায় অবস্থান নিয়েছে, তাতে আপত্তি উঠেনি তুর্বার বাবার কাছেও; মনে হয়েছে এটাই স্বাভাবিক।
হাতের সিগারেটটা পুড়েই চলেছে, মুখে নেওয়া হয়ে উঠছে না প্রিয়মের। ছাদ থেকে কবরটা বেশ স্পষ্ট, এই রাতেও। সিগারেটের শেষ অংশের তাপটা হাতে লাগায় স্বাভাবিকতায় ফিরে সে।
‘চলুন, খেয়ে নিবেন’ কাছাকাছি কোথাও তুর্বার কণ্ঠ।
চমকায় না, শুধু হাতের ঘড়িটায় চোখ বুলায়; রাত দশটা পেরিয়ে।
‘মা খেয়েছে?’
‘জি। উনি ঘুমিয়েছেন। চলুন।’
‘আপনি খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ুন, আমি পরে খাবো।’
চারপাশের হালকা আলোতেই ছাদটা সামান্য আলোকিত। এগিয়ে হাতটা ধরে তুর্বা।
‘সকালে আমি চলে যাব। যাওয়ার পর যত ইচ্ছা না খেয়ে থাকবেন, এখন চলুন’-কথার সাথে সাথে হাতের টানটা বেশি হতে থাকে।
‘আপনি খেয়ে নিন প্লিজ, আমি একটু একা থাকি।’
কথা বাড়ায় না তুর্বা। যতটা সাহস নিয়ে হাতটা ধরেছিলো ততটাই সংকোচে হাতটা ছাড়লো।
কথা হয়নি সে রাতে, দেখাটুকু মিললো না দু’জনের। প্রচন্ড ক্ষুধায় শোকের মিশ্রণে খাওয়া হয়ে উঠলো না প্রিয়মের।
বসার ঘরটায় পারিবারিক ফটোটাও সড়িয়ে ফেলেছেন সাজেদা বেগম, তবুও কেন জানি ওদিকটায় চোখ পড়ে যায় প্রিয়মের; বাবাকে খুঁজতে।
রাতটা রাতের নিয়মেই কাটলো, সকালের আশায়। ঘরের বাহিরের কথাবার্তায় প্রিয়মের বুঝতে অসুবিধা হলো না যে, তুর্বার মা-বাবা এসেছেন।
বিদায় নিতে নিজেই ঘরে আসলো তুর্বা। টেবিলের ওপর এখনোও পড়ে থাকা নিজের ফটো আর মোবাইল নম্বর লেখা কাগজ দেখে অবাক হলো না মোটেই।
‘বসুন’ বিছানার একপাশটা দেখিয়ে প্রিয়ম।
‘ছবিটা আশা করি আর প্রয়োজন হবে না, নিয়ে যাব?’ বিছানায় বসতে বসতেই জানতে চাওয়া।
অপ্রস্তুত প্রিয়ম।
‘আর কয়েকটা দিন থেকে যেতেন।’
‘প্রয়োজনগুলো খুব কম সময়ের হওয়াই ভালো, প্রয়োজনটা বেশি সময়ের হলে সেই প্রয়োজনের অনুভূতি কমে যায়’-বিছানার চাঁদরটায় হাত বুলিয়ে অজানা আল্পনা আঁকতে আঁকতেই বললো তুর্বা।
‘জানি না এত কিছু’-বলেই বিছানায় শরীর এলিয়ে দেয় প্রিয়ম, অভদ্রতা প্রশ্নের তোয়াক্কা না করে।
আবার বলতে শুরু করে-‘আর প্রথম দিনের জন্য দুঃখিত।’
কথা এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলো তুর্বা-‘ভালো থাকবেন, নিজের প্রতি যত্ন রাখবেন; সাথে মায়ের প্রতিও।’
কথা হয়ে উঠেনি কারোও। ঠায় বসেই ছিল তুর্বা, হয়তো কিছু শুনবার আশায়। বসে-শুয়েই ছিল প্রিয়ম, হয়তো কিছু বলার জন্যই। উঠবার সময়টায় টেবিলে রাখা ফটোটায় হাত রেখে প্রিয়মের দিকে তাকিয়েছিলো তুর্বা; হয়তো ফটোটা নিয়ে যাওয়ার নিবেদন। মিলেনি অনুমতি, তাই ফটোটা রেখেই বিদায় নিয়েছে তুর্বা। স্বাভাবিক ভদ্রতা দেখানোর জন্য এগিয়ে দিতেও ঘর থেকে বেড়ুতে মন সায় দেয় নি প্রিয়মের।
মৃত্যুর দেড় মাস পূরণ আজ। স্বামী শোক কাটিয়ে কিছুটা স্বাভাবিক সাজেদা বেগম, কাজের সহায়তার জন্য বুয়া রাখা হয়েছে। অস্বাভাবিকতায় আজও প্রিয়ম। চাকুরীতে যোগদানের চিঠি আসাতেও যোগদান করেনি, ঘর থেকে বেড়ুনো বলতে সিগারেটের সম্ভার বৃদ্ধি আর মায়ের ওষুধ। দিন-রাত কেটে যায় ছাদে, কবরটায় তাকিয়ে। বাবার মৃত্যুর পর থেকেই একটা প্রশ্নই ওকে হাঁপিয়ে তুলেছে-‘আমার জন্যই কী বাবা মারা গেলেন?’
এ সময়কালে তুর্বা এসেছিল কয়েকদিন, এড়িয়ে চলেছে প্রিয়ম; নিজেকে লুকিয়ে রাখতেই। বিরক্ত করতেও চায়নি তুর্বা।
ফোনও দিয়েছিলো প্রায় প্রতিটি দিন, রিসিভ করেনি প্রিয়ম। একা থাকাতেই ভালোলাগাতে শিখে গেছে ও। আজকাল তুর্বার সামনেও সিগারেট খাওয়াটায় বাঁধেনা তার।
‘দেখা করবেন প্লিজ’ এমন ভাষায় ক্ষুদেবার্তাটা প্রিয়মের ফোনে আসলো দুপুর গড়িয়ে। ইচ্ছা-অনিচ্ছার সহস্র খেলায় দেখা করবে বলেই ঠিক করলো পরিশেষ।
তুর্বাকে বাসা থেকেই নিতে হলো প্রিয়মের। পোশাকের শালীনতায় বরাবরই প্রশংসা কুড়ায় সে, এবারোও ব্যতিক্রম নয়।
বাড়ি থেকে অনেকটা পথ, প্রিয়মের অচেনা; তবে সুন্দর বলতে যা বোঝায় তাই। বাবাকে নিয়েও মাঝেমাঝেই বিকেলের ভালোলাগাগুলো রাঙাতে এখানে আসে তুর্বা। স্বচ্ছ পানিতে বাধানো পুকুরপাড়ের গুটিকতক গাছের সমাবেশ বিকেলটাকে মুগ্ধতা দিতে পারে বেশ। কোলাহল নেই বললেই চলে।
‘সিগারেটটা ছাড়তে পারেন না?’
তুর্বার আকস্মিক এমন প্রশ্নে থমকে দাঁড়ালো প্রিয়ম। মুখোমুখি দাঁড়িয়েই আবার জানতে চায়-‘পারবেন?’
‘না’ সরাসরি উত্তর।
হাসলো তুর্বা।
‘আমি জানতাম আপনি পারবেন না। আর এটাও জানি, নিজের প্রতি নিয়ন্ত্রণ যাদের নেই তারাই সিগারেট খায়।’
কথা বাড়ায় না প্রিয়ম। কিছুটা পথ এগিয়ে ঘাসের ওপরেই আসন নেয় তারা।
‘কেন দেখা করতে চেয়েছেন?’
‘খারাপ লাগলে চলে যেতে পারেন।’
তুর্বার কথায় অবাক হয় প্রিয়ম। পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেটটা বাহির করে নিজের কাজটুকু সেরে নেয় সে। বাধা দেয় না তুর্বা।
‘আপনি কি আমায় ভালোবাসেন?’
প্রিয়মের কথায় হেসে উঠে তুর্বা। হাসতে হাসতেই-‘ভালোবাসলে আমার সামনে সিগারেট খেতে দিতাম?’
‘তাহলে আমার ওপর অধিকার দেখাতে আসেন কেন সব সময়?’-দৃষ্টি সামনে রেখেই প্রিয়মের প্রশ্ন।
আবারোও চাপা হাসিটা বেড়িয়ে আসে তুর্বার।
‘আপনি তো নিজেকেই ভালোবাসতে শিখেন নি, তাহলে মানুষ আপনাকে ভালোবাসবে কেন?’
মুখের ধোঁয়ায় বিরক্তির ছাপ স্পষ্ট।
তুর্বার দিকে মুখোমুখি প্রিয়ম।
‘মা কয়েকদিন থেকেই আবারোও বিয়ের কথাটা তুলছে, সেটা নিষেধ করে দিবো কী?’
‘দেখুন, আপনি আগেও নিষেধ করেছেন, প্রয়োজনে আবারোও করেন। ইচ্ছাগুলো আপনার হাতে। আর আমার কথা জানতে চাইলে বলবো, নিষেধ করে দিন। আপনাকে ভালোবাসি কি না তা জানিনা, কারণ আপনি নিজেই নিজেকে ভালোবাসেন না। যতটুকু আপনার পাশে ছিলাম, তা দায়িত্ববোধ থেকে। আপনার বিপদের সুযোগ নিয়ে আপনাকে বিয়ে করা অসম্ভব।’
কথাগুলোয় হাঁপিয়ে উঠে তুর্বা, ভাষা হারায় প্রিয়ম। এই ‘সুযোগ’ কথাটা প্রিয়মেরই সৃষ্টি, তা সে ভালোই জানে।
সন্ধ্যার অনেকটা পর ফিরলো তারা। বাসার ভেতরে যাওয়ার সামান্য ইচ্ছেটুকু নেই, সিগারেটের গন্ধে ভরা শরীর নিয়ে।
‘আসবো এবার, ভালো থাকবেন’-বাহিরে দাঁড়িয়েই প্রিয়ম।
‘ক্ষমা করবেন। আর কখনোও ডাকবো না।’
‘সেটাই ভালো। কল বা ম্যাসেজ না দিলে আরোও ভালোলাগবে।’
‘দেখতে অসুন্দর তাই?’-নীচু স্বরে জড়িয়ে যাওয়া কণ্ঠে।
‘হয়তো তাই। আর একটা কথা বলি?’ প্রিয়ম বলতে বলতেই তুর্বার দৃষ্টি আকর্ষণ করে।
মাথা তুলে দাঁড়ানোর শক্তি নেই তুর্বার।
‘জি বলুন।’
‘মাকে বিয়ের মত দিয়েছি, কাল তোমার বাড়িতে আসবে আংটি পড়াতে। আশা করি ফেরাবে না।’
‘আপনি’ ‘তুমি’র পর্যায়ক্রমটা বুঝতে সময় লাগেনি তুর্বার। প্রিয়মের মুখপানে একবার তাকিয়ে উঁচু স্বরে হাসতে গিয়েও থেমে গেলো, থামলো না দু’কদম এগিয়ে যাওয়া। তুর্বার আকস্মিক জড়িয়ে ধরায় রোধ সাজতে মন চাইলো না প্রিয়মের। বয়সের দীপ্ততায় নিজেকে পুরুষ ভাবতে পারলো না তুর্বাকে বুকে নিয়েও।
‘না, আমি পুরুষ নই; আমি বিশ্বাস’ এমন কথাগুলোই প্রিয়মের মনে খেলা করলো তুর্বাকে জড়িয়ে।