আমাদের ক্লাবের প্রেসিডেন্ট সনাতনকাকুর ছেলে সৈনিক টলিউডের নবাগত হিরো। তবে ফিল্মস্টারদের অনেকের যেমন হামবড়া ভাব থাকে, শুনি সৈনিকদার স্বভাব তার উলটো। কখনও জলপাইগুড়ি এলে সৈনিকদা আমাদের ডেকে নেয়। একসঙ্গে আড্ডা, খাওয়াদাওয়া আর হৈ-হুল্লোড় হয়।
সৈনিকদার দিদি সেবন্তীদি বিয়ে করে থিতু হয়েছে লন্ডনে। ছেলেবেলায় মা চোখ বোজায় দুই ভাইবোনের কাছে বাবাই সব। সেবন্তীদি বহুদিন বাদে সনাতনকাকুর কাছে এসেছে কিছুদিনের ছুটি কাটাতে। সৈনিকদারও আসার কথা ছিল, কিন্তু শুটিংয়ের ডেট পড়ে যাওয়ায় শেষমুহূর্তে ফ্লাইটের টিকিট বাতিল করেছে।
সেবন্তীদির বর অনপম ঘোষাল বিখ্যাত কোম্পানির হোমড়াচোমড়া। ছুটি পায়নি বলে অনুপমদা আসতে পারেননি। তবে জামাইবাবু না এলেও সেবন্তীদির সঙ্গে এসেছে ওদের দুই ফুটফুটে মেয়ে শ্রেয়া আর খেয়া। শ্রেয়া নার্সারিতে পড়ে। কলকল করে কথা বলে আর বেসুরে গান গায়। সেবন্তীদি আর অনুপমদার কড়া নির্দেশ হল, সবাইকে বাড়িতে বাংলা বলতে হবে। সেই হুকুম মেনে শ্রেয়া আমাদের সঙ্গে যতটা সম্ভব বাংলাতেই কথা বলার চেষ্টা করছে। তবে তার মধ্যেও দুয়েকটা ইংরেজি বুলি যে ঢুকে পড়ছে না তা নয়। তখন শ্রেয়া জিভ কেটে সরি বলছে। ওদিকে খেয়া আবার শ্রেয়ার থেকেও ছোটো, সবে টলমল করে হাঁটতে শিখেছে, কথা বলে আধো আধো। খেয়ার এখনও স্কুলে ভর্তির বয়স হয়নি। মজার মেয়েদুটোকে নিয়ে দারুণ সময় কাটছে আমাদের।
কলকাতা থেকে আমাদের জন্য হরেকরকম ঘুড়ি নিয়ে এসেছিল সেবন্তীদি। দু’দিন ধরে কাচের গুঁড়ো দিয়ে মাঞ্জা দেওয়া হয়েছিল সুতোতে। আজ ছিল বিশ্বকর্মাপুজো, ঘুড়ি ওড়াবার দিন। বিকেলে সনাতনকাকুর বাড়ির ছাদ থেকে সকলে মনের সুখে ঘুড়ি উড়িয়েছি। শ্রেয়া আর খেয়াও আমাদের সঙ্গে হুটোপুটি করেছে সারাক্ষণ। দিনের আলো ফুরিয়ে যাবার পর সকলে গোল হয়ে বসেছি আড্ডায়। আমাদের জন্য মাংসের শিঙাড়া এসেছে। সেবন্তীদির নিজের হাতে তৈরি সেই অমৃতসম শিঙাড়া খাচ্ছি তারিয়ে তারিয়ে। সনাতনকাকুর দুই বাঘের মতো জার্মান শেফার্ড নন্দী আর ভৃঙ্গী থাবা মেরে বসে আমাদের জুলজুল করে দেখছে। কুকুরদুটোর শরীরে হাত বুলিয়ে আদর করছে শ্রেয়া আর খেয়া। নন্দী আর ভৃঙ্গী তাতে মোটেই বিরক্ত হচ্ছে না। বরং আরামে কুঁই কুঁই করছে।
মাংসের শিঙাড়া খেতে খেতে প্ল্যান ভাঁজা হচ্ছিল। দুর্গাপুজো চলে এল বলে। আমাদের পাশের পাড়ার লোকজন আড়মোড়া ভাঙতে শুরু করেছে। আসলে ওদের যে খুব আহামরি দুর্গাপুজো হয় তা নয়, কিন্তু পুজোর চাইতেও বড়ো আকর্ষণ হল ওদের বিজয়া সম্মিলনীর অনুষ্ঠান। ডুয়ার্সের বিশিষ্ট শিল্পীরা আসেন সেই বিচিত্রানুষ্ঠানে গানবাজনা করতে। পুজোর দু’মাস আগে থেকে শুরু হয় চাঁদা তোলা। ওদের লোকবল অনেক। দুর্গাপুজোর ঝক্কি সামলায় একটা দল। অন্য দল লেগে পড়ে বিজয়া সম্মিলনী নিয়ে। শিল্পীদের সঙ্গে যোগাযোগ করা, তাঁদের যাতায়াতের ব্যবস্থা করা তো চাট্টিখানি কথা নয়। এমন একটা অনুষ্ঠান করার বাজেটও অনেক। একমাত্র বড়োরাই পারেন সেই হাতির খরচ তুলতে।
গরম শিঙাড়াটা মুখে ঢুকিয়ে উহ্ আহ্ করছিল রাসেল। সেটা কোঁৎ করে গিলে নিয়ে বলল, “দুর্গাপুজো করার না হয় অনেক হাঙ্গামা। কিন্তু নিদেনপক্ষে একটা বিজয়া সম্মিলনীও কি আমরা করতে পারি না?”
পিন্টু নিজের ঊরু চাপড়ে জোর গলায় বলল, “আলবাত করতে পারি। জমিয়ে একটা গানবাজনার আসর করা যেতেই পারে।”
শ্রেয়া আমার দিকে তাকিয়ে আবদার করল, “আমিও গান জানি। আমার গোল্ডেন কালারের টিউনিকটা পরে একটা গান গাইব স্টেজে। মেক ইট হ্যাপেন, চ্যাপেলমামা।”
আমার নাম চপল। সেটা বদলে চ্যাপেল করে দিয়েছে শ্রেয়া। মিষ্টি শিশুটার জিভে সেটা শুনতে ভারি মিষ্টি লাগছে বলে আর শুধরে দিচ্ছি না। একটু হেসে শ্রেয়ার চুল ঘেঁটে দিয়ে বললাম, “আচ্ছা বেশ। কিন্তু কী গান গাইবি তুই?”
শ্রেয়া মহা উৎসাহের সঙ্গে বলল, “মেরি হ্যাড আ লিটল ল্যাম্ব করব। বাংলা গানও করতে পারি। আই ক্যান সিং বেঙ্গলি সংগস টু। ‘পুরানো সেই দিনের কথা’ গানটা জানি। শোনাব এখন?”
আমি আঁতকে ওঠার ভঙ্গি করে বললাম, “ওরে বাবা থাক থাক, এখন গান-টান থাক।”
শ্রেয়া খিলখিল করে হেসে উঠল। খেয়া কী বুঝল কে জানে, হাততালি দিয়ে হেসে কুটিপাটি হল ছোট্ট খেয়াও।
ভুলু বলল, “বুঝলি চপ্পল, আমারও বহুদিনের স্বপ্ন বড়ো করে একটা বিজয়া সম্মিলনী করব। বড়ো গাইয়েরা এসে গানবাজনা করবে। আমরাও ভলান্টিয়ার ব্যাজ পরে ঘোরাঘুরি করব। পাড়াতে প্রেস্টিজ বেড়ে যাবে আমাদের।”
আমার নাম চপল, কিন্তু হতচ্ছাড়া ভুলু কিছুতেই সে নামে ডাকবে না আমাকে। গলায় বিরক্তি মিশিয়ে বললাম, “এমন একটা প্রোগ্রাম করতে কত টাকা দরকার তোর ধারণা আছে? ছেঁড়া কাঁথায় শুয়ে রাজপ্রাসাদের স্বপ্ন দেখিস না।”
ভুলু বলল, “তুই কথায় কথায় এত রেগে যাস কেন রে?”
একটা তেতো হাসি হেসে বললাম, “রাগার কারণ আছে বলেই রাগি। এমন একটা প্রোগ্রাম নামাতে হলে হাজার পঁচিশেক টাকা দরকার। কে দেবে সেই টাকা? তোর কি কোনও গৌরী সেনের সঙ্গে আলাপ আছে?”
ভুলু উদাস গলায় বলল, “মোটে তো পঁচিশ হাজার। রসিদ বই সরস্বতী আর্ট প্রেসে ছাপতে দিয়ে দে। ছাপা হয়ে এলে একটা বই আমাকে দিস। গৌরী সেন-টেন লাগবে না, টাকার ব্যবস্থা হয়ে যাবে।”
আমি স্তম্ভিত হয়ে ভুলুকে জরিপ করছি। পিন্টু, রাসেল, বাপ্পা, টিঙ্কু হাঁ করে দেখছে ভুলুকে। ভুলু একটা অলস হাই তুলে বলল, “ওয়ার্ড ইজ ওয়ার্ড। পুরো পঁচিশ হাজারই তুলে দেব। আজ থেকেই তোরা অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি শুরু করে দে।”
ভুলু গদাইলস্করি চালে বেরিয়ে গেল। আমরা বেশ কিছুক্ষণ স্পিকটি নট হয়ে থাকলাম। বাপ্পা কপালে ভাঁজ ফেলে বলল, “ভুলু কি ফাজলামি করছে?”
পিন্টু বলল, “এত জোর দিয়ে যখন কথাটা বলছে তখন পুরো না হলেও কিছু টাকার অন্তত ব্যবস্থা করে ফেলবে। আমরাও বসে না থেকে একটা স্পেশাল ড্রাইভ দিয়ে দেখিই না কতটা কী করতে পারি।”
টিঙ্কু বলল, “সবাইকেই অ্যাক্টিভ হতে হবে। পাড়ায় যার যত সোর্স আছে সবগুলি জায়গায় হানা দিতে হবে। সকলে মিলে চাঁদা সংগ্রহ অভিযানে নেমে দেখাই যাক না কতটা ফান্ড তুলতে পারি।”
২
প্রেস থেকে রসিদ বই হাতে চলে এসেছে। পঁচিশ পাতার একটা করে বইয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে সকলকে। কুখ্যাত তোলাবাজরা যেমন করে হপ্তা ওঠানোর জন্য নিজের নিজের শিকারক্ষেত্র বেছে নেয়, তেমনি করে পাড়ার পুরো এলাকা আমরা নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নিলাম। পাড়ার একমাথায় পাশাপাশি কিছু অ্যাপার্টমেন্ট হয়েছে। মূলত অবাঙালি লোকজনেরই বসবাস সেখানে। দুর্গাপুজোর ঐতিহ্য বা তাৎপর্য কোনওটাই তারা জানে বলে মনে হয় না। ভুলুকে দেওয়া হল ওদিক থেকে চাঁদা তোলার দায়িত্ব। ভুলু আপত্তি তো করলই না বরং একগাল হেসে বলল, “তথাস্তু।”
সাতদিন ধরে চাঁদার রসিদ নিয়ে দৌড়ঝাঁপ করার পর এক রবিবার বিকেলে ক্লাবঘরে একজোট হয়েছি সকলে। এই এক সপ্তাহ ধরে জুতোর শুকতলা খইয়ে খইয়ে যা চাঁদা উঠেছে তা জড়ো করে গোনা হল। দশ, কুড়ি, পঞ্চাশ আর একশো টাকার নোটগুলো গুনে দেখলাম, বাজেটের সিকিভাগও তুলতে পারিনি। পাড়ার লোকজন যে এত কিপ্পুস সেটা অ্যাদ্দিন জানা ছিল না। আমি ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম, “বিজয়া সম্মিলনী নামানো তো দূরের কথা, এই ক’টা টাকা দিয়ে তো হলই ভাড়া করা যাবে না।”
ভুলু হাসিহাসি মুখে আমাদের কার্যকলাপ লক্ষ করছিল। এবার একটা উঁচুদরের হাসি হাসল। সাদা বাংলায় যাকে বলে হাই-ক্লাস। তারপর পকেট থেকে একতাড়া পাঁচশো টাকার নোট বের করে বলল, “এই নে চপ্পল, পঁচিশ হাজার আছে। গুনে দ্যাখ।”
আমি থতমত খেয়ে টাকাগুলো গুনে ফেললাম। সত্যিই পঁচিশ হাজার আছে। ভুলুর দিকে তাকিয়ে ঘাবড়ে গিয়ে বললাম, “এত টাকা কোথায় পেলি তুই? ব্যাঙ্ক লুঠ করিসনি তো?”
ভুলু তাচ্ছিল্যের একটা ভঙ্গি করে বলল, “রসিদ বইতে সকলের নাম লেখা আছে। দেখে নে চোখ বুলিয়ে।”
রসিদ বইটা হাতে নিয়ে দেখি কাউন্টার পার্টে মিসেস রেড্ডি, মিস কৃষ্ণমূর্তি, মিস টায়ারওয়ালা, মিস্টার সুখানিদের নাম রয়েছে। এঁরা পঁচিশ জন প্রত্যেকে একহাজার টাকা করে চাঁদা দিয়েছেন। আমতা আমতা করে বললাম, “আমার সত্যিই হজম হচ্ছে না ঘটনাটা। এঁদের কপালে বন্দুকের নল ঠেকিয়ে টাকা আনিসনি তো?”
ভুলু মুখ ভেটকে বলল, “তাহলে এতক্ষণে থানাপুলিশ হয়ে যেত। তুই সাইকিয়াট্রিস্ট দেখিয়ে নে, চপ্পল। তোর মাথাটা গেছে।”
৩
আমাদের প্রস্তুতি শুরু হয়ে গেল জোরকদমে। অনুষ্ঠানের জন্য হল বুক করা হল। শহরের বিশিষ্ট শিল্পীরা কথা দিলেন, তাঁরা ঠিক সময়ে চলে আসবেন। গলির মোড়ে একটা ফ্লেক্স টাঙিয়ে দেওয়া হল যাতে লেখা, ‘সবুজ সংঘের ব্যবস্থাপনায় বিরাট বিচিত্রানুষ্ঠান।’
ফ্লেক্সটা লাগানোর পর বেশ একটা আলোড়ন পড়ে গেল। এমন জিনিস আগে কখনও হয়নি। পাড়ার মাসিমা-কাকিমাদের কয়েকজন এসে ধরলেন আমাদের। তাঁরা বিয়ের আগে গানবাজনা করতেন, এখন হাঁড়ি ঠেলতে গিয়ে সেসব ভুলেছেন, এই আসরে মঞ্চে ওঠার সুযোগ চান। কেউ এলেন তাঁর ছেলের বা মেয়ের গান গাইবার সুযোগের সুপারিশ নিয়ে। মোট কথা, পাড়ায় আমাদের প্রেস্টিজ এক লাফে চারগুণ বেড়ে গেল।
অনুষ্ঠানের আগের দিন সনাতনকাকুর বাড়ির ছাদে আমরা জড়ো হলাম। কাকে কী দায়িত্ব নিতে হবে সেটা নিয়ে আলোচনা চলছিল। ছাদের একদিকে নন্দী আর ভৃঙ্গী হুটোপুটি করছে। কুকুরদুটোর সঙ্গে সঙ্গে হাততালি দিতে দিতে দৌড়াদৌড়ি করছে শ্রেয়া আর খেয়া। সেবন্তীদির তৈরি চিকেন ফ্রাই এসেছে আমাদের জন্য। ভুলু চিকেন ফ্রাইতে বড়োসড়ো একটা কামড় বসিয়ে বলল, “কাল আমি থাকতে পারছি না। তোরা বিচিত্রানুষ্ঠানটা চালিয়ে নিস।”
আমি বিস্মিত হয়ে বললাম, “তুই থাকবি না মানে? কী হয়েছে?”
ভুলু বলল, “কাল সকালের ট্রেন ধরে একটু কলকাতা যেতে হবে। আমার এক মাসি থাকেন ভবানীপুরে। মাসি স্কুলে পড়ান, মেসো হাইকোর্টে প্র্যাকটিস করেন। মেসোর শরীরটা ক’দিন হল ঠিক যাচ্ছে না। তাই মা বলল একবার যা, দেখা করে আয় ওঁর সঙ্গে।”
পিন্টু বলল, “সে ঠিক আছে। তোকে যেতে বারণ করা হচ্ছে না। কিন্তু একদিন পরে যা।”
ভুলু মাথা নেড়ে বলল, “উঁহু, কালকেই যেতে হবে।”
ভুলু বেরিয়ে গেল। আমার মনটা কেন যেন খুঁতখুঁত করছিল। বলেই ফেললাম, “তোরা যা-ই বল, একটা গোলমাল আছে এর মধ্যে। কিছু একটা যেন লুকোচ্ছে ভুলু।”
পিন্টু চিন্তিত গলায় বলল, “আমার মনটাও কু ডাকছে। কাল মনে হচ্ছে কিছু একটা গড়বড় হতে যাচ্ছে। ভুলু নির্ঘাত কিছু একটা গোল পাকিয়ে এসেছে। কিন্তু সেটা যে কী সেটা ঠাহর করতে পারছি না।”
৪
ডুয়ার্সের বিভিন্ন জায়গা থেকে আজ গান শোনাতে আসবেন লোকগানের বেশ কিছু শিল্পী। আসবেন রবীন্দ্রসংগীত, নজরুলগীতি, ধ্রুপদী সংগীতের নামী গায়ক। টিভি-রেডিওতে প্রোগ্রাম করেন দু-চারজন আর্টিস্ট আসবেন গান গাইতে। এত বড়ো অনুষ্ঠানের আয়োজক হিসেবে টেনশন তো হবারই কথা। অনুষ্ঠান শুরুর একঘন্টা আগে থেকে দাঁড়িয়ে আছি গেটের বাইরে। স্থানীয় শিল্পীরা আসতে শুরু করেছেন এক এক করে। এমন সময় একটা নীল গাড়ি এসে দাঁড়াল আমাদের সামনে। থপথপে চেহারার এক বয়স্ক ভদ্রমহিলা নামলেন গাড়িটা থেকে। রাসেল আমার কানে কানে বলল, “উনি মিসেস রেড্ডি। ওঁর স্বামী একসময় কোর্টের জাজ ছিলেন। স্বামী চাকরি থেকে অবসর নিয়েছেন, এখন ওঁরা এই শহরে থাকেন।”
মিসেস রেড্ডির বয়স সত্তরের কাছাকাছি হবে। ওজন কম করে একশো কেজি, পরনে লাল ঝলমলে শাড়ি। গা-ভর্তি গয়না, চুলে বেলফুলের গজরা গোঁজা। মিসেস রেড্ডি এসেই ভুলুর খোঁজ করলেন। আমি বললাম, “জরুরি কাজে ভুলু শহরের বাইরে গেছে। আপনি আসুন, একদম ফ্রন্ট সিট আপনার জন্য রাখা আছে।”
মিসেস রেড্ডি দৃশ্যতই হতাশ হলেন। তারপর চুলে গোঁজা বেলফুল ঠিক করতে করতে জিজ্ঞেস করলেন, “ইটস ওকে। বাই দ্য ওয়ে, শ্রেয়া কি চলে এসেছেন?”
কথাটা শুনে একটু খটকা লাগল। রাসেল হাঁদার মতো মুখ করে বলল, “শ্রেয়া মানে? কোন শ্রেয়া?”
মিসেস রেড্ডি বিরক্তি প্রকাশ করে বললেন, “হোয়াট ননসেন্স! আমি শ্রেয়া ঘোষালের কথা বলছি। স্টেজে তাঁর সঙ্গে গান গাইবার সুযোগ করে দেবে বলেই তো ওই ভুলু একহাজার টাকা চাঁদা নিয়েছে আমার কাছ থেকে।”
কানের কাছে কেউ একটা বোমা ফাটালেও এতটা অবাক হতাম না। মিসেস রেড্ডির কথায় আকাশ থেকে পড়লাম। প্রত্যেকের মুখের রক্ত শুকিয়ে গেল। উটের মতো মুখ করে তাকাতাকি করতে লাগলাম নিজেদের মধ্যে। বাপ্পা ফ্যাসফ্যাসে গলায় বলল, “কী সর্বনাশ!”
মিসেস রেড্ডি হাতে ধরা মোবাইল ফোনটা দেখিয়ে লাজুক গলায় বললেন, “প্লিজ গেট মি টু শ্রেয়া। প্রোগ্রামের আগেই একটা সেলফি নিয়ে নিই ওর সঙ্গে।”
রাসেল তোতলাতে শুরু করে দিল, “শ-শ-শয়তান ভুলু কী ফাঁসান ফ-ফাঁসিয়ে গেল আমাদের!”
ততক্ষণে লাল, নীল, হলুদ, সবুজ ঝাঁ-চকচকে গাড়িতে চেপে হলের সামনে আসতে শুরু করেছেন মিসেস পালকিওয়ালা, মিস টায়ারওয়ালা, মিস্টার সুখানিরা। সকলেই এসে খোঁজ করছেন ভুলুকে। জানা গেল ভুলু ওঁদের সকলের কাছ থেকেই একহাজার টাকা করে নিয়েছে স্টেজে শ্রেয়া ঘোষালের সঙ্গে একসঙ্গে গান গাইবার সুযোগ দেবার কথা বলে।
আমরা অডিটোরিয়ামের সিঁড়িটায় সার দিয়ে বসে পড়েছি। গণপিটুনি খাবার আগেই পালিয়ে যাব নাকি পুলিশের কাছে সারেন্ডার করব ভাবছি। এমন সময় সেবন্তীদি এল দুই মেয়ের হাত ধরে। শ্রেয়া আর খেয়া ছুটে এল আমাদের দিকে। শ্রেয়া এসে আমার গলা জড়িয়ে ধরে বলল, “চ্যাপেলমামা, আমি ঠিক করেছি আজ মেরি হ্যাড আ লিটল ল্যাম্ব গাইব না। সেই যে – পুরানো সেই দিনের কথা, ওটা গাইব।”
শ্রেয়ার কথায় হাসব না কাঁদব ভেবে পাচ্ছি না। এমন সময় সেবন্তীদির হাতে ধরা মোবাইলটা বেজে উঠল। ফোনটা আমার দিকে এগিয়ে দিল সেবন্তীদি। বলল, “ভুলু ফোন করেছে। নাও, কথা বলে নাও।”
কাঁপা কাঁপা হাতে ফোনটা ধরতেই ভুলু বলল, “হ্যাঁ রে চপ্পল, সব ঠিক আছে তো?”
রাগে উত্তেজনায় ফেটে পড়তে পড়তে বললাম, “হতচ্ছাড়া! তুই জলপাইগুড়ি ফিরলে তোর ফাজলামি আমি ঘুচিয়ে দেব। কী কান্ড করে রেখে গিয়েছিস তুই! নিজে তো পালিয়ে গিয়েছিস। আমাদের তো এবার জেল যেতে হবে।”
ভুলু বলল, “অত ঘাবড়াস না। শ্রেয়াকে স্টেজে তুলে দে। তারপর মিসেস পালকিওয়ালা, মিস টায়ারওয়ালা, মিস্টার সুখানি, মিসেস রেড্ডিদের মঞ্চে ডেকে নে। এক কাজ কর, শ্রেয়াকে জনগণমন গাইতে বল। সবাই এমনিতেই দাঁড়িয়ে পড়ে গলা মেলাবে।”
আমি চিবিয়ে চিবিয়ে বললাম, “জানি না গণপিটুনি খাওয়ার পর বেঁচে থাকব কি না। কিন্তু যদি বেঁচে থাকি তাহলে তুই বাঁচবি না। তোকে কুচি কুচি করে কেটে করলা নদীতে ভাসিয়ে দেব।”
ভুলু বলল, “চপ্পল, ঠান্ডা মাথায় ভেবে দ্যাখ একবার, সেবন্তী ঘোষাল আর অনুপম ঘোষালের মেয়ে শ্রেয়ার পদবিও তো ঘোষাল। আমি সকলের কাছ থেকে চাঁদা নিয়েছি শ্রেয়া ঘোষালের সঙ্গে গান গাইবার সুযোগ করে দেওয়া হবে বলে। বিখ্যাত প্লে ব্যাক সিঙ্গার শ্রেয়া ঘোষালের কথা তো বলিনি কখনও। ওঁরা ভুল বুঝলে আমার কী দোষ?”
গায়ের জ্বালা মেটানোর জন্য জুতসই বিশেষণ খুঁজছিলাম। কিন্তু এমন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গিয়েছি যে, কোনও কিছুই মাথায় এল না। খেঁকিয়ে উঠে বললাম, “কিন্তু এটা তো চিটিংবাজি। এর নাটের গুরু হলি তুই। আমরা জেলে গেলে তোকেও জেলে যেতে হবে।”
ফোনের ওপার থেকে ভুলু বলল, “চাঁদা তোলার সময় অত তলিয়ে ভাবিনি রে চপ্পল। আইনের মারপ্যাঁচ জানি না বলেই তো চলে এসেছি মাসির বাড়িতে। মেসোমশাই কলকাতা হাইকোর্টে প্র্যাকটিস করেন। থানাপুলিশ হলে জামিনের ব্যবস্থা করেই আমি জলপাইগুড়ি ফিরব। টেনশন নিস না।”
ডুবে যাওয়া মানুষ খড়কুটো পেলে আঁকড়ে ধরে। আকুল ভঙ্গিতে ভুলুকে বললাম, “তোর মেসোমশাই কী বললেন? এটা কি ফোরটুয়েন্টি কেসের মধ্যে পড়বে?”
ভুলু খটখটে গলায় বলল, “জানি না। তবে আমার মুখে গোটা ঘটনা শুনে ওঁর আক্কেলগুড়ুম হয়ে গেছে। সেই যে থমথমে মুখে চেম্বারে গিয়ে বসেছেন আর বেরোচ্ছেন না। আমি বাইরে দিয়ে উঁকিঝুঁকি মারছি। ভেতরে ঢোকার সাহস পাচ্ছি না। কিছু একটা সিগনাল পেলেই তোকে ফোন করে জানাচ্ছি। তোরা ততক্ষণ বিচিত্রানুষ্ঠানটা চালিয়ে যেতে থাক।”
ফোনটা রেখে হতবুদ্ধির মতো স্টেজের দিকে তাকালাম। আমাদের বিচিত্র অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গেছে। সোনালি টিউনিক পরা ছোট্ট শ্রেয়াকে আজ দেখতে পরির মতো লাগছে। মঞ্চে দাঁড়িয়ে ‘পুরানো সেই দিনের কথা’ গাইছে শ্রেয়া। কী আশ্চর্য, দর্শকরা দেখি হাসিহাসি মুখে তার বেসুরো বেতালা গান শুনছে আর তাল দিচ্ছে। যদিও গান শেষ হবার পর যে কী ঘটবে সেটা আমরা কেউই এখনও জানি না!