আরশিনগরের মেয়ে

আরশিনগরের মেয়ে

প্রায় পাঁচ বছর পরে সোহম আবার চিলেকোঠার ঘরে পা রাখল। মাঝের ক’টা বছর আর দেউলপুরে আসা হয়নি কয়েকবছরের জন্য বাবা ব্যাংককে ট্রান্সফার হয়ে চলে যাবার কারণে। একটা সময় দেউলপুরের এই পুরনো বাড়িটাতে দিম্মার সঙ্গে বেশ কিছুদিন কাটিয়েছে সে। ভাই এর জন্মের আগের মুহূর্তে মায়ের শরীর খুব খারাপ হওয়ায় দিম্মাই তাকে এখানে নিয়ে চলে এসেছিল। এত বড় বাড়িটাতে শুধু সে আর দিম্মা। কাজের লোক দু তিনজন অবশ্য তখনও ছিল। সকালে আর সন্ধ্যেতে কুর্চিমাসি আসত পড়াতে। বাকি সময়টুকু দেদার খেলো। আমবাগানে ছোটাছুটি করো অথবা ড্রয়িং খাতা আর রঙ পেন্সিল নিয়ে বসে পড়ো। কেউ কিচ্ছুটি বলবে না। মা’কে ছেড়ে এসে সোহমের তাই খুব একটা কষ্ট হয়নি।

তবে একেকসময় খেলার বন্ধুদের কথা মনে পড়লে খুব কষ্ট হত। স্কুলে তার কত বন্ধু ছিল! এমনকি বিকেলে আয়ামাসির হাত ধরে তাদের ফ্ল্যাটের হ্যাঙ্গিং গার্ডেনে যখন সবাই মিলে জড়ো হত।, কতরকম খেলাই না খেলত সন্ধে অবধি! দেউলপুরে সেইসব কিছু বড্ড মিস করত সে। যখন কিচ্ছু ভালো লাগত না তখন এই চিলেকঠার ঘরে সোহম চলে আসত।

তেমনই এক দুপুরে ঘুমন্ত দিম্মার পাশ থেকে উঠে সে চলে এসেছিল এই ঘরে। চিলেকোঠা বলতে যা বোঝায় এই ঘরটা মোটেও সেরকম ছিল না। বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। দেওয়াল আলমারি জুড়ে কিছু পুরনো খাতা আর পেপার কাটিং। একটা ছোট্ট খাট, কাঠের টেবিল চেয়ার আর একটা আয়না। দিম্মার কাছে শুনেছিল সোহমের দাদু লেখক ছিলেন, এই ঘরে বসে বসে নিরিবিলিতে তিনি লেখালিখি করতেন। মাত্র ছয় বছর বয়সে এতকিছু বোঝার ক্ষমতা সোহমের হয়নি তবে মাঝেমাঝে ড্রয়িং খাতা নিয়ে এই ঘরে বসে থাকতে ওর ভালোই লাগত।

একদিন দুপুরে চুপচাপ বসেছিল। মায়ের কথা খুব মনে পড়ছিল। দিম্মা বলেছে মা একটু ভালো হলেই সোহম কলকাতা চলে যাবে আর নাহলে এক্সামের সময় তো যাবেই। সেদিন ড্রয়িং করতেও ভালো লাগছিল না। খাতা গুটিয়ে খাটের উপর বাবু হয়ে বসে ছিল উদাস হয়ে। হঠাৎ আয়নায় চোখ পড়তেই চমকে উঠল। আরে এই মেয়েটা কে? তারই বয়সী হবে। মাথা ভর্তি কোঁকড়ানো চুল, টানা টানা নীল চোখ, গায়ের রঙ গোলাপি ফর্সা। সোহমের চোখে চোখ পড়তেই মিষ্টি করে হাসল মেয়েটি। সোহম তাড়াতাড়ি ওর পিছনে ঘুরে তাকাল, মেয়েটা কখন তার পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে সে টেরই পায়নি। কিন্তু ওর পিছনে তো কেউ নেই! থাকবেই বা কী করে? পিছনে তো দেয়াল!

সোহম অবাক হয়ে আবার আয়নার দিকে তাকাল। মেয়েটার চোখের পাতা তিরতির করে কাঁপছে। হাতে একটা টেডি বিয়ার।

“বন্ধু হবে?” মেয়েটা হ্যান্ডশেক করার ভঙ্গিতে হাতটা বাড়িয়ে দিল। মেয়েটার বলার মধ্যে কিছু একটা ছিল। সোহম খাট ছেড়ে মন্ত্রমুগ্ধের মত আয়নার দিকে এগিয়ে গেল। তারপর নিজের হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “আমি সোহম।”

মেয়েটা হাসতে হাসতে বলল, “আমি ডোনা।” তারপরেই শশব্যস্ত হয়ে বলল, “আমি এখন আসি, কাল এইসময় আবার আসব।”

সোহম জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিল মেয়েটা কোথায় থাকে? শুধু আয়নাতেই তাকে দেখা যাচ্ছে কেন? ডোনা সে সুযোগ না দিয়ে চোখের পলকে উধাও হয়ে গেল।

সন্ধ্যেবেলায় তরুমাসি চিলেকোঠার ঘরে সোহমকে ঘুমিয়ে থাকতে দেখে ডেকে তুলে নিচে নিয়ে যায়। সোহম যখন হাতেমুখে জল দিচ্ছিল তখন তরু মাসি চাপা গলায় দিম্মাকে বলছিল, “কত্তামা, সোহম বাবার মনটা ভালো নেই। চোখের কোণে শুকিয়ে যাওয়া জলের দাগ দেখলাম। মনে হয় আপনাকে লুকিয়ে লুকিয়ে মায়ের জন্য কাঁদে।”

সেই থেকে দিম্মার মুখ গম্ভীর। সোহম বই নিয়ে পড়তে বসে গিয়েছিল। দিম্মাকে আর ডোনার কথা জিজ্ঞেস করার সাহস হয়নি।

পরেরদিন দিম্মার চোখ লেগে যেতেই এক ছুট্টে চিলেকোঠার ঘরে। ডোনা তার জন্য অপেক্ষা করছিল। নিজে থেকেই সোহমের ড্রয়িং খাতা দেখতে চাইল। সোহম খাতার পাতা খুলে একে একে ওর আঁকা ছবিগুলো দেখাচ্ছিল। দেখতে দেখতে ডোনার চোখ মুখ উজ্জ্বল হয়ে যাচ্ছিল। ছবি দেখা শেষ হলে, বিষণ্ণ গলায় বলে উঠল, “জানো সোহম আমিও না ছবি আঁকতে খুব ভালোবাসি। আমার একটা ইয়া মোটা ড্রয়িং খাতা আছে। তবে পাতাগুলো সব শেষ হয়ে গেছে। তুলিগুলোও ভেঙে গেছে, আমি চাইলেও আর আঁকতে পারব না।”

“আমি তোমাকে ড্রয়িং খাতা আর রং তুলি দেব, আমরা এক সঙ্গে আঁকব ডোনা।” সোহমের কথায় ডোনার দীঘল চোখ দুটি আরো বিষণ্ণ হল। সোহম বুঝতে পারেনা খুশি হবার বদলে ডোনা এত দুঃখ পেল কেন? সে আর কথা না বাড়িয়ে অন্য কথায় চলে গেল। “তুমি না বললে, তোমার একটা মোটা খাতা আছে, দেখাও না সেটা!”

ডোনা জানাল সেটাও তার কাছে নেই। সে তো আর জানত না এতকাল তাকে এখানেই থেকে যেতে হবে! তাহলে তো তার প্রয়োজনীয় সব জিনিস গুছিয়ে নিয়ে আসত। এই প্রথম সোহম লক্ষ করল, দু’দিনই ডোনা এক ফ্রক পরে আছে। এমনকি ওর ফ্রকটা বেশ নোংরা। আহা রে! মেয়েটা মনে হয় তার মতই হঠাৎ করে এখানে এসে পড়েছে, তাই সব কিছু গুছিয়ে আনতে পারেনি। তার দিম্মা অবশ্য তার জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়ে এসেছে। শুধু আর এক সেট ব্যাট বল উইকেট আর বার্থ ডে’তে পাওয়া গিফট থেকে যদি কয়েকটা রং পেন্সিল নিয়ে আসত!

“কোথায় থাক তুমি?”

“আরশিনগর”

“সেটা কোথায় ডোনা?’

ডোনা ঠোঁটে আঙুল ঠেকায়, “শশশশ, চুপ কেউ আসছে। পায়ের আওয়াজ পাচ্ছ?”

সোহম ঘাড় নাড়ে। ডোনা ফিসফিস করে বলে, “খবরদার আমার কথা কারুকে বলবেনা কিন্তু যদি বলে দাও আমি আর আসব না।”

পায়ের আওয়াজটা বাড়ছে। সোহম এক ঝলক সিঁড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে নেয় কে আসছে। তারপর ডোনার দিকে তাকিয়ে বলে, “তোমার কথা কাউকে বলব না। এখানে আমার এই একটা মাত্র বন্ধুকে আমি হারাতে চাইনা।”

“প্রমিস?”

“প্রমিস।”

ডোনা চকিতে মিলিয়ে যায়।

দিম্মা ঘরে ঢোকে তারপর ওকে জড়িয়ে ধরে খুশির খবরটা শোনায়, “সোহমবাবু তোমার দায়িত্ব অনেক বেড়ে গেল। তোমার একটা ভাই হয়েছে। আমরা খুব তাড়াতাড়ি কলকাতা যাব।”

ভাই! ছোট্ট একটা ভাই? সোহমের খুব আনন্দ হল। ও দিম্মাকে জড়িয়ে ধরে অনেক ক’টা হামি খেল। একটা দিম্মার জন্য, একটা ঠাম্মির জন্য, একটা দাদাই, একটা বাপি, একটা মা আর গুনে গুনে পাঁচটা নতুন ভাইটার জন্য।

পরের দিন সোহম ডোনাকে জানাল সে কিছুদিনের মধ্যে কলকাতা ফিরে যাবে। তার একটা ভাই হয়েছে। ডোনা অবাক হয়ে চোখ বড়োবড়ো করে বলল, “তুমি তাহলে আর আসবে না? আর আমাদের দেখা হবে না?”

“আবার আসব আমি, এটা তো আমার দিম্মার বাড়ি! যখন খুশি আসা যায় এখানে। আর এত মনখারাপ করছ কেন? এখনো তো কয়েকদিন আছি আমি। রোজ দুপুরে গল্প করব তোমার সঙ্গে।”

“কলকাতায় ফিরে গিয়ে খুব খেলবে তাই না? ওখানে কত ফ্রেন্ডস তোমার! আমার তুমি ছাড়া একটাও ফ্রেন্ড নেই। ইচ্ছে করলেও খেলার উপায় নেই।”

“আমি খেলব তোমার সঙ্গে।”

“সত্যি খেলবে?”

“হ্যাঁ।”

“আমার সঙ্গে খেলতে হলে কিন্তু এখানে আসতে হবে, কারণ আমি তোমার ওখানে যেতে পারব না।”

এবার একটু ঘাবড়ে যায় সোহম। আয়নার মধ্যে সে যাবে কী করে? আর যদিও বা যায় যদি ডোনার মতই আটকে যায়? তখন কী হবে?

“কী হল? ভয় পেলে নাকি? তুমি কিন্তু প্রমিস করেছ!”

তরুমাসি ডাকছে, কুর্চিমাসি পড়াতে এসে গেছে। সোহম হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। দরজার দিকে পা বাড়ায়।

“তুমি কিন্তু প্রমিস করেছ সোহম।” এবার গলা দিকে কান্না ঝরে পড়ে ডোনার। সোহম কথা দেয়, বেশ আসবে সে।

(দুই)

দরজায় হাত ছোঁয়াতেই ক্যাঁচ করে একটা আওয়াজ হয়। বোঝাই যায় এই ঘরে অনেকদিন কেউ আসেনি। সোহম ভেবেছিল, ঘরে ধুলোর পুরু আস্তরণ থাকবে। কিন্তু ঘরে পা দিয়েই ভুল ভাঙল। ঠিক আগের মতই সবকিছু নিখুঁত গুছিয়ে রাখা। দিম্মার বয়স বেড়েছে, শরীরও ভালো না। তবুও সবদিকেই নিখুঁত দৃষ্টি।

সোহম ঝট করে জানলার পাল্লা দুটো খুলে দিল। বিকেলের মরা আলোর সঙ্গে ঠান্ডা বাতাস ঝাঁপিয়ে ঢুকে পড়ল ঘরে। একটু আগেই এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে তাই বাতাসে একটা ঠাণ্ডা আমেজ। সোহম তাকিয়ে দেখল খাটের উপর পরিষ্কার চাদর পাতা। সে আর দ্বিধা না করে বিছানায় শুয়ে পড়ল। শুয়ে শুয়ে চারপাশটা চোখ বোলাচ্ছিল। নাহ! এই পাঁচ বছরে ঘরটার বিশেষ রদবদল হয়নি। একই আছে।

ঠিক তখনই চোখ পড়ল সেই আয়নাটার উপর। একটা কুরুশের কাজ করা ঢাকা দিয়ে চাপা দেওয়া হয়েছে আয়নাটা। আয়নাটার দিকে তাকাতেই ডোনার অভিমানী মুখ আর বিষণ্ণ নীল চোখ দুটোর কথা মনে পড়ে গেল। কে জানে মেয়েটা তার নিজের ঘরে ফিরে যেতে পেরেছে কিনা? তার খেলার সঙ্গী আদৌ পেয়েছে কিনা? ডোনার কথা মনে পড়তেই একে একে সেই সময়কার সমস্ত কথাই মনে পড়ে গেল আর সেই সঙ্গে বুঝতে পারল এসে থেকে এই চিলেকোঠার ঘরটা তাকে এত টানছিল কেন!

মায়ের সঙ্গে তারা দু’ভাই আগেই কলকাতা চলে এসেছিল। বাবা ব্যাংকক থেকে আসবেন পঞ্চমীর রাত্রে। সপ্তমীর দিন তাদের একসঙ্গে দেউলপুরের পুজো দেখতে আসার কথা ছিল। তারা আসার খবর পেয়েই দিম্মা ছুটে গিয়েছিল। মা’কে সঙ্গে নিয়ে দু’দিন ধরে ওদের পুজোর মার্কেটিং করে দিয়ে, ফেরার দিন সোহমকে একবার বলতেই, “কী রে আমার সঙ্গে যাবি?” সোহম ঢক করে ঘাড় নেড়ে দিয়েছিল। রোহণ এর মাথায় হাত দিয়ে দিম্মা বলেছিল, “ছোট দাদুভাই, তুমিও যাবে নাকি?” রোহণ এক ছুটে মায়ের পিছনে লুকিয়েছিল। বুঝিয়ে দিয়েছিল মা’কে ছেড়ে ও কোথাও যাবে না।

রোহণ এলে ওকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখাবে আমবাগান, নাটমন্দির, এই চিলেকোঠার ঘর। বড়রা যদি কেউ নদীর ধারে নিয়ে যায় তাহলে তিরতিরে বয়ে যাওয়া নদীটাও ভাইকে দেখিয়ে আনবে। নদীর ধার ঘেঁষে সেই বুড়ো বটগাছটা এখনো আছে তো? আর সেই ভাঙা শিব মন্দিরটা? এইসব জায়গাগুলো সোহমের নিজস্ব সম্পদ। এগুলোর কথা চোখ বন্ধ করে ভাবলেই মনটা কেমন ভালো হয়ে যায়।

“সোহম এই সোহম কোথায় গেলি? ঠাকুর গড়া দেখতে যাবি বললি যে!”

দিম্মার গলা পেতেই তড়াক করে উঠে দাঁড়াল সোহম। তাদের কয়েক ঘর শরিক মিলে পুজোটা হয়। দিম্মা তেমন কিছু করতে পারে না, টাকা দিয়ে দেয়। অন্য মামা মামীমারাই সব করে। তাদের দুর্গা-দালানটা একটু দূরে। দিম্মার বাড়ি থেকে কয়েকটা বাড়ি পরে। কাঁচা রাস্তা ধরে একটু এগিয়ে যেতে হয়। প্রতিবারের মত ঠাকুর গড়ার কারিগররা কিছুদিন আগে থেকেই এখানে চলে এসেছে। নিজেরাই কাজের অবসরে রেঁধেবেড়ে রাখে। অন্দরমহল থেকে চা বা ভালো কিছু রান্না হলে তাদের জন্য চলে আসে। বেশ একটা পিকনিক পিকনিক ভাব।

মায়ের কাছে কত গল্প যে শুনেছে। একতাল মাটি কারিগরদের হাতের যাদুতে একটু একটু করে প্রাণ পায়। পুজোর মাত্র আর ক’দিন বাকি। কাজ এখন শেষ পর্যায়ে। তরুমাসি বলছিল, এখন রঙের কাজ হচ্ছে। আর তখনই সোহম বায়না ধরেছিল, সে ঠাকুর গড়া দেখতে যাবে। শুনে দিম্মা বলেছিল, “বেশ তো আমার ও বাড়িতে একটু দরকার আছে। দাদুভাইকে নিয়ে আজকেই একবার ঘুরে আসি।”

“ও সোহম বাবা ঘুমিয়ে পড়লে নাকি?” এবার তরু মাসির গলা। জানলাটা বন্ধ করে সোহম ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসে। দরজা বন্ধ করার মুহূর্তে আয়নার দিকে চোখ চলে যায়। কুরুশের ঢাকার ওপ্রান্ত থেকে এক জোড়া দীঘল চোখ তাকে যেন উঁকি মেরে দেখছে। সোহম আর দাঁড়ায় না। দরজাটা বন্ধ করে ধীরে ধীরে সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসে।

রাত্রে ঘুমের মধ্যে ছটফট করে সোহম। বড় হয়েছে বলে আর দিম্মার সঙ্গে শোয় না। দিম্মার বড় ঘরের লাগোয়া ছোট একটা ঘরে ওর শোওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। মাঝের দরজাটা খোলাই আছে। দিম্মার ঘরের মেঝেতে তরুমাসি শুয়ে আছে। তার নাক ডাকার মৃদু আওয়াজ এ ঘরেও ভেসে আসছে। ঘুম ভেঙে যাবার পর সোহম দেখে চাপ চাপ অন্ধকার। লোডশেডিং হয়ে ফ্যানটাও বন্ধ হয়ে গেছে। ঘামে ভিজে গেছে সোহম।

তবে তার জন্য অস্বস্তি হচ্ছে না, ঘুমের মধ্যে ও একটা স্বপ্ন দেখেছেঃ

ছোট্ট সোহম সেদিন দিম্মার সঙ্গে চলে যাচ্ছে কলকাতা। নিচে ড্রাইভারদাদা গাড়ি নিয়ে রেডি। দিম্মা কাজের লোকদের নিয়ে গাছের ফলমূল গাড়িতে তুলছে। সেই ফাঁকে সোহম চলে আসে তার চিলেকোঠার ঘরে। ডোনার কাছ থেকে বিদায় নিতে হবে। নাহলে তার এই বন্ধুটি রোজ এইসময় তার জন্য অপেক্ষায় থাকবে। এমনিতেই মাঝের ক’টা দিন অজানা এক আতঙ্কে সোহম আর এই ঘরে আসেনি।

বিদায় নেবার মুহূর্তে ডোনার চোখে জল, “তুমি কিন্তু প্রমিস রাখলেনা! আমার সঙ্গে একদিনও খেললে না।”

সেই মুহূর্তে নিচে থেকে ডাক এসেছিল। সোহম হাত নেড়ে বিদায় নিয়েছিল। অভিমানে গোলাপি মুখটা নীল হয়ে গিয়েছিল। সেই মুখটাই একটু আগে স্বপ্নে বীভৎস হয়ে তাড়া করে বেড়াচ্ছিল। অন্ধকারে চোখটা সয়ে যেতেই সোহম পা টিপে টিপে পাশের ঘরে গিয়ে দিম্মার পাশে শুয়ে পড়ে। বাকি রাতটুকু নিশ্চিন্তে ঘুমোয়।

আবার সেই নিঝুম দুপুর। দিম্মার পাশে শুয়ে শুয়ে গল্পের বই পড়তে পড়তে জিজ্ঞেস করে ফেলে আরশীনগর মানে কী? নগর মানে সিটি বাট আরশি? দিম্মার চোখ বড় বড় হয়। “এ নাম তুমি কোথায় শুনলে দাদুভাই? আরশি মানে আয়না, এটা তুমি জানতে না?”

“নাহ, আমি তো মিরর আর আয়না জানি শুধু।”

দিম্মা কিছুটা নস্টালজিক হয়ে ওঠে, “তোমার দাদু, ‘আরশীনগরের মেয়ে’ নামে একটা ভৌতিক উপন্যাস লিখতে লিখতে মারা যান। প্রকাশক বারবার বাড়িতে এসে তাগাদা দেন, অসম্পূর্ণ পান্ডুলিপিটা ওঁদের হাতে তুলে দিতে। অন্য রাইটার দিয়ে শেষাংশটা লিখিয়ে নেবেন। খুঁজে পাইনি বলে প্রকাশকদের আমি এড়িয়ে গেছি।” তারপরেই তাঁর খেয়ার হল এত কঠিন বাংলা সোহম বুঝবে কিনা?

“দাদুভাই বুঝেছ তো? “ইনকমপ্লিট ম্যানুস্ক্রিপ্ট।”

এইরকম কিছুই আন্দাজ করেছিল সোহম। সে শুধু জিজ্ঞেস করে, “ওটা যত্ন করে রেখেছ তো?” দিম্মা জানায়, দাদুর অন্যান্য জিনিসের মত এটাও বুকে করে আগলে রেখেছে সে।

দিম্মার চোখ লেগে যেতেই সোহম উঠে পড়ে। চিলেকোঠার আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে এক টানে ঢাকনাটা সরিয়ে দেয়। দুই হাঁটুর মাঝে মাথা গুঁজে বসে আছে ডোনা। পরনের ফ্রকটা একই রয়ে গেছে আর আরো নোংরা হয়ে গেছে। সোহমের উপস্থিতি টের পেতেই ধীরে ধীরে মাথা তুলল সে। সোহম দেখল পাঁচ বছরেও একটু বয়স বাড়েনি তার। এক রয়ে গেছে। সোহমকে দেখেই ছুটে এল কিন্তু আয়নার দেওয়াল ওকে আটকে দিল।

দু’হাতে সেই অদৃশ্য দেওয়ালে আঁচড়াতে আঁচড়াতে ডোনা বলে উঠল, “কতদিন পরে এলে ফ্রেন্ড, এবার খেলবে তো আমার সঙ্গে?”

সোহম আয়নায় হাত রাখে। নরম সুরে বোঝায়, সে বড় হয়ে গেছে। পালটে গেছে তার খেলার ধরণ। ডোনার সঙ্গে পুতুল খেলেছে জানলে সবাই হাসাহাসি করবে।

“তাহলে উপায়? আমার তো কয়েকটা ভাঙা পুতুল আর এই রঙচটা টেডিটা ছাড়া কিছুই নেই।” তারপর দ্বিগুণ উৎসাহে বলে ওঠে, “তুমি বরং তোমার খেলনা নিয়ে কাল চলে এসো, আমাকে একটু শিখিয়ে দিও, আমি ঠিক পারব।”

সোহমের কেমন দমবন্ধ লাগে। ও ঘর ছেড়ে চলে আসে। পায়ে পায়ে পৌঁছে যায় ঠাকুর দালানে। মগ্ন হয়ে বসে দেখে রঙের কারুকাজ। ঠিক করে নেয় ঐ অভিশপ্ত আয়নার সামনে আর কক্ষনো দাঁড়াবে না।

কিন্তু পরের দিন আবার এক অমোঘ আকর্ষণে চিলেকোঠায় পৌঁছে যায়। ওকে দেখেই ডোনা ছুটে আসে। আয়নার সামনে মুখোমুখি বসে ওরা। পুরনো দিনের মত অনেক গল্প করে। সঙ্গে আনা দাবার বোর্ডটা পেতে সোহম খেলার নিয়মকানুন বুঝিয়ে দেয়। ডোনা বেশ কুইক লার্নার। খুব দ্রুত শিখে নেয়। বারবার কাকুতি জানায়, আয়নার ভেতরে এসে ওর সঙ্গে খেলতে।

সোহম ডোনাকে ভয় পায় না, কিন্তু সে জানে আয়নার ভিতরে গেলে সে আর ফিরে আসবে না কোনোদিন। হয়ত চিরকালীন আরশিনগরের বাসিন্দা হয়ে যাবে। কিছুতেই রাজি হয় না সে। বরং ভেবেচিন্তে একটা প্রস্তাব দেয়। আয়নাটা ভেঙে ফেললে কেমন হয়? ডোনা মুক্তি পাবে।

শুনেই রেগে যায় ডোনা। আয়না না থাকলে তার অস্তিত্বই যে মুছে যাবে! হিংস্র কণ্ঠে শেষ বারের মত সে বলে, “তুমি তাহলে আমার সঙ্গে খেলবে না তো? বেশ আর কোনোদিন তোমায় আমি ডাকব না। তোমার মত, হ্যাঁ একদম তোমার মত কাউকে আমি খুঁজে নেব।”

সোহম আর যায় না ঐ ঘরে। দিম্মার কাছে দারুণ দারুণ সব বই আছে। জাতকের কাহিনী, পৌরাণিক কাহিনী, এসব নিয়েই ক’টা দিন কাটিয়ে দেয়।

আস্তে আস্তে বাপি, মা আর রোহণের আসার দিন এগিয়ে আসে। রওনা দিয়েই মা ফোন করে জানিয়ে দেয়, এখন শুধু অপেক্ষার প্রহর গোনা।

ঠিক সন্ধেবেলায় অজানা নাম্বার থেকে ফোনটা আসে। একটা অয়েল ট্যাঙ্কারকে ওভারটেক করতে গিয়ে জিটি রোডে ভয়াবহ একটা এক্সিডেন্ট হয়েছে। ড্রাইভারের আসনে বাপি ছিল। বাপি-মা গুরুতর আহত। আর রোহণ ওখানেই মারা গেছে। এক নিমেষে পুরো গ্রামটা শোকের চাদরে ঢাকা পড়ে গেল। বুক চাপড়ে চাপড়ে তরুমাসি কাঁদছে।

দিম্মার মাথা খুব ঠান্ডা। মামাদের সঙ্গে কথা বলে গাড়ির ব্যবস্থা করছে। সোহম প্রায় টলতে টলতে চিলেকোঠার ঘরে পোঁছে যায়। যা ভেবেছে তাই। রোহণ আর ডোনা একমনে ভাঙা পুতুলগুলো নিয়ে খেলছে। সোহমকে দেখে একটা তাচ্ছিল্যের হাসি হাসল ডোনা। আর রোহণ তাকে দেখতেই পেল না। ওর কোঁকড়া চুলে চাপ চাপ রক্ত।

বুকের মধ্যে তীব্র একটা কষ্ট টের পাচ্ছে সোহম। এক ছুটে বাইরে এসে হড়হড় করে বমি করে ফেলল ও।

সব কাজ মিটে যাবার পরে দিম্মার কাছে সেই অসমাপ্ত পান্ডুলিপিটা চেয়ে নেয় সোহম। শেষ অংশটা নিজের মত করে লিখতে বসে। দিম্মা তন্ময় হয়ে দেখে ওকে। ফিসফিস করে বলে, “দেখ তরু হুবহু সেই মানুষটার মত। ঘাড় গুঁজে লিখে যাচ্ছে। মানুষটাও নাওয়া খাওয়া ভুলে এভাবে লিখে যেত।”

তিনদিনের দিন পান্ডুলিপিটা দিম্মার হাতে ফেরত দিয়ে সোহম বলে, এবার এটা প্রকাশককে দিয়ে দাও আর চিলেকোঠার আয়নাটা পুড়িয়ে ফেলার ব্যবস্থা করো। দিম্মার অবাক দৃষ্টির সামনেই মা’কে ফোন করে, “আমার কাজ শেষ, আমি আসছি মা। দিনুমামা আমাকে দিয়ে আসবে।”

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত