ক’টা বাজে এখন? তিনটা হবে – আনমনে কথা বলে প্রমা। পাহারাদারের বাঁশীর শব্দ এখন তার সময় মাপার সঙ্কেত। পাশের ঘরে শুয়ে অনন্ত, অচেতন গভীর ঘুমে। “একটু কি দেখে আসবো ওকে? ভয় দেখানোও যেতে পারে” – দুষ্টুমি ঝিলিক দিয়ে ওঠে প্রমার চোখে। আস্তে করে নেমে আসে খাট থেকে, নিঃশব্দে হেটে যায় দরজা পর্যন্ত, “আহারে … বেচারা টেবিল ল্যাম্প বন্ধ না করেই ঘুমিয়েছে” – অস্ফুট উচ্চারণ প্রমার। টেবিল ল্যাম্পের আলোতে ঘুমন্ত অনন্তকে বড় সুন্দর, বড় আপন মনে হয় ওর। অজান্তেই হাত চলে যায় পেটের ওপর, ওখানে একতিল একতিল করে বেড়ে উঠছে অনন্তর সন্তান।
প্রথম দু’মাসে তেমন কিছু টের পায়নি প্রমা। ঘরের কাজ, বাইরে ঘোরা – কোন কিছুই বাদ থাকেনি, অথচ এখন মনে করতেই ভয় ভয় লাগে। কত কিছুই যে হয়ে যেতে পারতো। এখন প্রমা প্রতিটা পদক্ষেপ মেপে চলে। সাবধানে বিছানায় এসে ওঠে সে। খুবই অবাক লাগে তার, অনন্ত – তার অনন্তর গায়ের গন্ধে এখন বমি পায় তার। কি বিব্রতকর অবস্থা। প্রথম দিকে লজ্জায় কুঁকড়ে থাকতো সে, বলতে পারতোনা অনন্তকে, আবার মানতেও পারতোনা। কিন্তু এটা তো সবারই হয়, যে মানুষটার সন্তান তার স্বত্বার গভীরে বড় হচ্ছে প্রতি মুহূর্তে, সেই মানুষটাকেই তার গন্ধ লাগে। অনন্ত নিজে থেকেই বুঝে নিয়েছিলো, মনে হয় তার কুঁচকে যাওয়া চোখ মুখ দেখেই, তার পর থেকে আলাদা খাটে ঘুমায় তারা। প্রমা জানেনা আর কতদিন এমন চলবে, ভাল লাগেনা ওর, অনন্তর বুকের মধ্যে বিড়ালছানার মত গুটিসুটি মেরে ঘুমাতে ইচ্ছে করে।
টুপ টুপ করে পানি পড়ার শব্দ হচ্ছে, ঘুম ভেঙ্গেই বুঝতে পারে প্রমা। এত মৃদু শব্দে কারও ঘুম ভাঙ্গার কথা না, অথচ তার ভাঙ্গল। এখন এমনি হচ্ছে, শব্দ আর গন্ধের ব্যাপারে সেনসিটিভিটি বেড়ে গেছে অনেক। অনন্ত বলে – বায়োনিক উয়োম্যান হয়ে গেছে প্রমা। মনে হতেই হাসি ছড়িয়ে যায় প্রমার মুখে। দেয়াল ঘড়িতে সময় তখন সকাল ৯টা পেরিয়েছে। তার মানে অনন্ত চলে গেছে অফিসে। যাবার আগে এই ঝুড়ি ফলমূল, গ্লাসে পানি, স্প্রাইটের ক্যান আর পাতলা করে বানান ছোট্ট কয়েকটা আটার রুটি আর এক টুকরা গুড় রেখে গেছে টেবিলে। রুটিগুলোর দিকে তাকিয়ে শব্দ করে হেসে ওঠে প্রমা, নিখুঁত গোল রুটি, দেখেই বোঝা যায় বানাবার পর গুড়ো দুধের খালি কৌটো চাপা দিয়ে কেটে নেয়া। এটাও কি ভালবাসা? প্রিয়তমাকে নিখুঁত গোল রুটি উপহার দেবার চেষ্টা? হাসতে থাকে প্রমা।
সাবধানে বিছানা ছাড়ে প্রমা। শরীর সামলে নিতে একটু দাঁড়াতে হয় ওর। মর্নিং সিকনেসটা অনেক কমে গেছে এখন, কমে এসেছে অন্য অনেক উপসর্গ। পেট’টা বেলুনের আকৃতি পেয়েছে। মমতায় হাত বোলায় প্রমা পেটের ওপর। ভেতর থেকে সাড়া দেয় প্রমার অন্তঃস্থিত প্রাণ, নড়ে ওঠে, যেন ঘুম ভেঙ্গে আড়মোড়া ভাংছে জানের টুকরোটা।
মুখ ধোয়া দরকার, বেসিনের দিকে এগিয়ে যায় প্রমা। সকালে ট্যাঙ্কে পানি ছিলোনা বলে পানির কল পুরোটা বন্ধ করেনি অনন্ত। পানি আসার পর ফোটা ফোটা পানি গড়িয়ে পড়ে ছড়িয়ে গিয়েছে মেঝের অনেকটা যায়গায়। শোবার ঘরের পর্দা টানা থাকায় আলো আসছে না বেশী ওদিকটায়, ফলে পানির ধারাটা থেকে গেল প্রমার চোখের আড়ালেই।
দরজা খোলার আওয়াজে চমকে যায় প্রমা, একহাতে বাজারের ব্যাগ অন্য হাতে দু’টো মুরগী নিয়ে ঘরে ঢোকে রনির মা, গৃহ পরিচারিকা। “আফায় উঠছেন নি, আইজকা শইলডা কিমুন?” বলতে বলতে এগিয়ে যায় রান্নাঘরের দিকে। “লাউ আর মুরগী কিনা দিছে বাইজান, পাতলা কইরা মু……… আল্লা গো ……” – মেঝেতে জমে থাকা পানিতে পিছলে পড়তে পড়তে সামলে নেয় সে। হাসতে হাসতে কুটিকুটি হয় প্রমা, হি হি করতে করতে পানিটা মুছে ফেলে রান্না ঘরে গিয়ে ঢোকে রনির মা। প্রমা ফ্রেস হয়ে এসে দাঁড়ায় এক চিলতে বারান্দাটায়।
ইজি চেয়ারের উপর ৩টা ছোট্ট বালিশ, লাল নীল সবুজ মখমলে মোড়ানো, দেখলে মনে হয় হাত দিয়ে ছুঁয়ে দিলে গলে যাবে। অনন্তর কাজ – কই থেকে যে পায় এইসব জিনিস। প্রমার গত জন্মদিনে এমনি করেই সে এনে দিয়েছিল ছোট্ট ছোট্ট ৩টা পুতুল। মেয়েরা বড় হয়ে গেলে কেউ আর পুতুল গিফট করেনা, কিন্তু ওই পুতুলগুলো পেয়ে প্রমা যে কি পরিমাণ খুশী হয়েছিল, তা কেবল সে নিজেই বলতে পারবে। পরে একসাথে খেতে বসে অনন্ত বলেছিল “আল্লাহ আমাকে ক্ষমতা দিলে আমি তোমাকে হীরের আংটি কিনে দিতাম” – তখন কেন যেন চোখে পানি এসে গিয়েছিল প্রমার। ছেলেরা জানে না যে একটা মেয়ের কাছে হীরের আংটির চাইতে ভালবাসার মানুষটির অল্প একটু এটেনশন অনেক বেশী প্রিয়। আর অনন্ত এতটাই বেশী মনোযোগী যে, মাঝে মাঝে প্রমার খিধে পাবার আগেই সে খাবার এনে রেডি করে রাখে যাতে প্রমা খিধে পাবার সাথে সাথেই খেতে পারে।
খাবারের কথা মনে হতেই হু হু করে রাজ্যের খিধে পেয়ে যায় প্রমার। বাবুও নড়েচড়ে জানান দেয় যে সে ক্ষুধার্ত। পেটের ওপর হাত বুলিয়ে আদর করে প্রমা, তারপর দ্রুত ফিরে আসে ঘরে। যাকে বলে গোগ্রাসে খাওয়া – প্রমা মনে হয় সেভাবেই খেয়ে ফেলে রুটিগুলো। এমন হুলুস্থুল ধরনের খিধে স্বাভাবিক সময়ে লাগেনা কারোই। খেতে খেতে আনমনে হাসে প্রমা।
খাবার পরে বাবু অনেকক্ষন নড়াচড়া করেনা। সে সময় তার সাথে রাজ্যের গল্প করে প্রমা। আশ্চর্যের বিষয় – বাবু মাঝে মাঝে উত্তরও দেয়। এ কথা প্রমাণ করবার শক্তি কারো নেই বলেই ভাবতো সে, কিন্তু অনন্ত তার কথা শুনে তাকে জানিয়েছে আরেক আজব তথ্য। পৃথিবীতে মা এবং তার সন্তানের টেলিপ্যাথিক যোগাযোগের ব্যাপারটা প্রায় স্বীকৃত। তখন থেকেই বাবুর কথাগুলো মন দিয়ে শোনার চেষ্টা করে প্রমা। আজ যেমন হঠাৎই প্রমা শুনল বাবু বলছে “মা, ঘুরে শোও, আমি নড়তে পাচ্ছিনা তো”, সাথে সাথে ওপাশ ফিরে শুলো প্রমা, সাথে সাথেই বুঝতে পারলো বাচ্চাটার নড়াচড়ার জায়গা কমে গেছিলো। সোনামণিটা বড় হচ্ছেনা দিনে দিনে? তার তো আরও জায়গা লাগবেই খেলবার জন্যে।
প্রমার শোবার ঘরে মোট ১২টা বাবুর ছবি আছে, কেনা ছবি না, অনন্তর নিজে হাতে তোলা। ছবিগুলো কার প্রমা সেটা জানেনা, কিন্তু বাচ্চাটার সাথে অনন্তর চেহারার মিল আছে। ও জানতে চাইলে অনন্ত বারবার এড়িয়ে গেছে, পরে প্রমাও আর জোর করেনি অনন্তকে। প্রত্যেকেরই কিছু কিছু একান্ত ব্যক্তিগত বিষয় থাকে যা কাউকেই বলা যায়না। যেমন সে শুভ্রর ব্যাপারে কিছুই জানায়নি অনন্তকে। অনন্ত অবশ্য জানতেও চায়নি তার অতীত। বিয়ের দিন আয়নায় প্রথম অনন্তকে দেখতে পায় প্রমা, এক পলকের দেখা, আয়নার নিজের বরের দিকে তাকাতে লজ্জা লাগেনা? হয়তো অনন্ত কোনদিনও জানবেনা যে সে অনেকটাই শুভ্রর মত দেখতে।
শুভ্রর কথা আজ হঠাৎ এতদিন পর মনে এলো কেন? অনন্ত কি তাকে তার চাওয়ার থেকেও হাজার গুন বেশী ভালবাসা দিয়ে ভরিয়ে দেয়নি? তার অস্তিত্বের মাঝে বেড়ে উঠছে অনন্তর সন্তান, তার কি পুরনো দিনের কথা ভাবা উচিৎ?
রনির মা এসে জানিয়ে যায় যে তার কাজ প্রায় শেষ, প্রমা গোসল করে নিলে ভেজা কাপড় ধুয়ে দিয়ে চলে যাবে সে। দ্রুত হাতে জামা কাপড় গুছিয়ে ওয়াস রুমে ঢোকে প্রমা, মেঝেতে পা ফেলে খুব সাবধানে। এক সেকেন্ডের অসতর্কতা অপূরণীয় ক্ষতি করে ফেলতে পারে। অবশ্য ভয়ের তেমন কিছু নেই। ওয়াস রুমের মেঝেটা শুকনো রাখাটাও অনন্ত তার দায়িত্বের মধ্যে নিয়ে ফেলেছে। সকালে গোসল করে মেঝেটা পর্যন্ত মুছে দিয়ে গেছে সে। চেয়ারে বসে এ পর্যন্ত কাউকে গোসল করতে দেখেনি প্রমা, কিন্তু অনন্তর ইচ্ছেতেই প্রথম দিন প্লাস্টিকের নীল চেয়ারটাতে বসে গোসল করার সময় প্রমা বুঝতে পেরেছে যে এই অবস্থায় এর চাইতে ভাল আর কিছু হতেই পারেনা।
গোসল করে শরীরের সাথে সাথে মনটাও ফ্রেস হয়ে যায় প্রমার। ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে হঠাৎ করেই কেন যেন অনন্তকে খুব জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করে ওর। কতদিন অনন্তকে কাছে আসতেও দেয়না সে। ছেলেদের কি কষ্ট হয়? অনন্ত অবশ্য কোনদিন জোর করেনি ওকে, স্বামিত্বের দাবীতে প্রকাশ করতে চায়নি অবাধ্য পৌরুষ। আদর করেছে একটা পুতুলের মত করে, সে সময়েও যেন নিজের চাহিদা গুলোর চাইতে প্রমার দিকেই মনোযোগ বেশী থাকে তার। মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে প্রমা – আজ সে অনন্তকে জড়িয়ে ধরে ঘুমবেই ঘুমবে।
অফিস তেকে একটু আগেভাগেই বেড়িয়ে পরে অনন্ত, আজ দীপ্তর জন্মদিন, ওর জন্য গিফট কিনতে হবে, ওকে নিয়ে খেতে হবে কোন চাইনিজ রেস্টুরেন্টে। দীপ্তর চার বছর পূর্ণ হলো আজ। খেলনার দোকান থেকে বড় রিমোট কন্ট্রোল ওয়ালা গাড়ী আর আগেই অর্ডার দেয়া কেকটা নিয়ে খুব দ্রুত পৌঁছে গেল সে উত্তরায়। দরজায় কলিং বেল বাজানোর সাথে সাথে দীপ্তর চিৎকার শুনিতে পেল অনন্ত – “পাপা এসেছে- আমার পাপা এসেছে”।
অনন্তর এক হাতে কেকের প্যাকেট অন্য হাতে গাড়ীটা, এ অবস্থায় তার কোলে ঝাঁপিয়ে পরা দীপ্তকে কিভাবে কোলে নেয়া যায়? কাজেই সোজা মেঝেতেই বসে পরে অনন্ত, ছোট্ট দু’টি হাতে তার গলা জড়িয়ে ধরে জিজ্ঞেস করে দীপ্ত – “আমার জন্য কি আনছো”? এক মুহূর্তের জন্য থমকে যায় অনন্ত, সামলে নিয়ে বলে – বাবা, কেক আর তোমার বার্থডে গিফট এনেছি, আর আজ আমরা খেতে যাবো চাইনিজে, তুমি না চাইনিজ পছন্দ কর? ততক্ষণে অনন্তকে ছেড়ে গাড়ীটার ওপর ঝাঁপিয়ে পরেছে দীপ্ত।
চুল শুকিয়ে পরনের নীল শাড়ীর সাথে মিলিয়ে কপালে নীল একটা টিপ পড়লো প্রমা। হালকা করে কাজল দিলো চোখে তারপর তার সবচাইতে প্রিয় জিনিস – তার চুরি রাখার স্ট্যান্ডটা নিয়ে গিয়ে বসলো খাটের উপর। বেঁছে বেঁছে আকাশী নীল চুড়ি ম্যাচ করলো। আঁচলে মুছে মুছে দুহাত ভর্তি করে চুড়ি পড়লো প্রমা। তারপর বাচ্চাদের মত করে আনন্দে হাত নাড়াতে লাগলো। চুড়ির রিনরিন শব্দটা শুনতে এত ভাল লাগে !! সেই সময়েই পেটের মধ্যে জোড়ে ঝাঁকি দিয়ে উঠলো প্রমার সন্তান, ব্যথায় আর্তনাদ করে উঠলো প্রমা, তারপর আবার সব চুপ।
কপট রাগে সরু হয়ে যায় প্রমার চোখ – “অ্যাই বাবু, মা’র ব্যথা লাগেনা? এত জোড়ে কেউ খেলে? ওটা কি ফুটবল খেলার মাঠ? এখনও তার জন্মই হয়নি, কিন্তু খেলাধুলা শুরু হয়ে গেছে”। ভালবাসা গলে পরে মা’র চোখ থেকে। পেটের ওপর থেকে আচল সরিয়ে হাত বুলিয়ে আদর করে তার সন্তানকে। পেটের চামড়ায় ফাটা ফাটা দাগ সামান্য হলেও বোঝা যায়। লোশন আনতে হবে, অনন্তর দাদী অবশ্য সরিষার তেলের সাথে কি কি যেন মিশিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছেন, মনে পরে প্রমার। বেড সাইড টেবিলের ড্রয়ার থেকে শিশিটা বের করে অল্প তেল তালুতে নিয়ে মাখাতে থাকে পেটের ওপর, চকচকে পেটের ওপর আড়াআড়ি করে কাটা দাগটায় চোখ আটকে যায়। দিনে দিনে স্পষ্ট হয়ে উঠছে দাগটা।
দীপ্তকে নিয়ে চাইনিজ রেস্টুরেন্টে চলে আসে অনন্ত। দরজার কাছেই দেখা হয়ে যায় সোমা, তানিম আর তমার সাথে, খালামনিদের পেলে দীপ্ত আর তার পাপাকেও চেনেনা। ওরা সবাই মিলে ঢুকে যায় রেস্টুরেন্টে। বড় একটা টেবিল নিয়ে বসে ওরা, কেক কেটে পালন করে জন্মদিন। খেতে খেতে সোমা জানতে চায় প্রমার কথা। প্রমার জন্য কিনে আনা নতুন শাড়ী আর গিফট গুলো দেখায়। খাওয়া দাওয়া শেষে তানিমের সাথে দীপ্তকে পাঠিয়ে দিয়ে সোমা, তমা আর অনন্ত চলে আসে ওদের বাসায়।
আঙ্গুল দিয়ে পেটের কাটা দাগটা ছুঁয়ে যায় প্রমা, কবে কখন কিভাবে ওর পেটে এই অপারেশন হয়েছিলো ওর মনে আসেনা। কিন্তু এটা যে খুব বেশীদিন আগের নয় তা বোঝা যায়। পুরনো অনেক কথাই কেন যেন মনে করতে পারেনা প্রমা। কবে যেন তার একটা এক্সিডেন্ট হয়েছিল। সেই এক্সিডেন্টের আগের অনেক কিছু মুছে গেছে প্রমার স্মৃতিপট থেকে। তবে সেই সময়টা নিয়ে প্রমা নিজেও আর বেশী কৌতূহলী নয় এখন। অনেক চেষ্টার পর সে মেনেই নিয়েছে সমস্যাটা। এখন সে নিজের মতই থাকতে ভালবাসে। অনন্তর ভালবাসাটাও ওকে খাঁচায় আটকে রাখা পাখীর অনুভূতি দেয়নি, বরং মাঝে মাঝে ওর মনে হয়েছে ওর গণ্ডির চাইতে অনন্তর ভালবাসার আকাশের বিস্তৃতি অনেক বেশী। ও যেন কোন ভাবেই সেই অসীমতাকে ছুঁতে পারেনা, ছাড়িয়ে যাওয়া তো দুরের কথা।
বিকেলের দিকে খিধের কারণেই ঘুম ভেঙ্গে যায় প্রমার। মনে পরে ভাত না খেয়েই ঘুমিয়ে গিয়েছিলো। আহা রে, সে কারণেই বাবুটার বুঝি খিধে পেয়ে গ্যাছে। দ্রুত উঠে খাবার টেবিলে বসে প্রমা, খুব পাতলা করে রাঁধা অল্প একটু তেল মশলা দেয়া তরকারির গন্ধটা আজকে আর তেমন বেশী ঝাঁঝালো মনে হয়না। কিন্তু তরকারির চাইতে কালি জিরে ভর্তা আর শুকনো মরিচ পোড়ানো আলু ভর্তার আকর্ষণটা ওর কাছে অনেক বেশী। খাওয়ার সময় আর তার পরে বেশ কিছুক্ষণ বাবু কেন যেন নড়েচড়ে না, মনে হয় খুব অবাক হয়ে লক্ষ্য করে খিধে নামক আজব অনুভূতিটা মিলিয়ে যাচ্ছে। আপন মনেই হেসে ওঠে প্রমা। এই সময় দরজা খুলে ঘরে ঢোকে অনন্ত, সাথে সোমা আর তমা, প্রমার দুই বোন।
তমা দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরে প্রমাকে, তারপর বলে – “তুমি এসব রাখো তো, চাইনিজ এনেছি তোমার জন্য, ওগুলো খাও, ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে”। তোরা সবাই আমাকে রেখে চাইনিজে গিয়েছিলি? – অভিমান প্রমার গলায়। ঝট করে অনন্তর দিকে তাকায় তমা – সাথে সাথেই সামলে দেয় অনন্ত, বলে – “অনেক দিন থেকেই ওরা খেতে চাচ্ছিলো, আজ অফিসেও কাজ ছিলনা তেমন, তাই ওদের আসতে বলেছি, আর তুমি চাইনিজে গিয়ে যদি সিক হয়ে যাও, সে জন্যে তোমাকে বলিনি। আমরা খেয়ে তোমার জন্যে নিয়ে এসেছি”। অকাট্য যুক্তি। প্রমা জানে ওরা অনেক দিন থেকেই ওদের বাবু আসা উপলক্ষে খেতে চাইছিল। তাই অভিমানটা মিলিয়ে যায় সাথে সাথেই। ততক্ষণে সোমা এসে ওর হাত থেকে প্লেট নিয়ে নিয়েছে, মুখে তুলে খাইয়ে দিচ্ছে ওকে একটা ছোট বাচ্চার মত।
“আপি, তোর কি কোন প্লান ছিল আজকে? যাবি কোথাও” খাইয়ে দিতে দিতে সোমার প্রশ্ন। “কেনরে – না তো” – প্রমা একটু অবাক। “তাহলে নীল পরী হয়ে বসে আছিস কেন ফাকা বাড়ীতে?” – লজ্জা পেয়ে যায় প্রমা। “এমনই, নীল আমার ভাল্লাগে, জানিসনা?” হি হি করে হেসে ওঠে তিন বোন।
খাওয়া দাওয়া করে ওরা গিয়ে বসে প্রমার খাটের ওপর। মোড়ক খুলে বের করে আনে নতুন শাড়ী, প্রমা অবাক হয় কিন্তু কিছু বলেনা। তখনই অনন্ত এসে যোগ দেয় আড্ডায়, আর অনন্ত থাকলে মহাকাশ থেকে শুরু করে ব্যাকটেরিয়া পর্যন্ত যে কোন কিছুই হয়ে উঠতে পারে উপভোগ্য আড্ডার বিষয়বস্তু। কথার ফাঁকে ফাঁকে অনন্ত ড্রয়ার খুলে প্রমাকে ট্যাবলেট গুলো এগিয়ে দেয়, এমন কি পানির গ্লাসটাও প্রমার হাতে তুলে দেয় যেটা ছিল প্রমার নাগালের মধ্যেই। সোমা আর তমা এই নিয়ে খুনসুটিতে মেতে ওঠে অনন্তর সাথে। সেই সময় তল পেটে চিনচিনে ব্যথাটা টের পায় প্রমা, যা মুহূর্তে তার উজ্জ্বল মুখে কষ্টের ছায়া ফেলে।
“আপা … এই আপা, কি হইছে?” সোমার গলা আর্তনাদের মত শোনায়। তমা এক লাফে উঠে এসে জড়িয়ে ধরে প্রমাকে, শুধু অনন্ত নির্বিকার – ডান হাতটা রাখে সোমার হাতের ওপর, আত্মবিশ্বাসী কণ্ঠে বলে – “সেরে যাবে”। প্রমা নিজেও জানে সেরে যাবে, ডাক্তার বলেই দিয়েছেন যে হঠাৎ হঠাৎ এমন ব্যথা হতেই পারে, কিন্তু যদি সেটা খুব বেশী হয় আর অনেকক্ষন থাকে তাহলে খুব দ্রুত চলে যেতে হবে তার ক্লিনিকে। তার পরেও অনন্তর আত্মবিশ্বাসী কণ্ঠের মাঝে ভরসা খুঁজে পায় প্রমা।
গল্পে গল্পে বেলা গড়িয়ে যায়। সন্ধ্যে নেমে এলে সোমা বিদায় চায় – “আপা আজ যাই রে, কাল সকালে ক্লাস আছে, পড়তে হবে”। “আমি কিন্তু যাবনা আপু, আজ থেকে একমাস আমি তোমার সাথে থাকবো, আমার পরীক্ষা শেষ” – গলায় আহ্লাদ আর খুশী ঝরে পরে তমার। প্রমা মৃদু হেসে অনন্তর দিকে তাকায়, অনন্তর চোখে কি ভালবাসা খেলা করে? পুরু কাঁচের চশমায় ঢাকা চোখ দুটি যে কি সুন্দর, তা বলে বোঝানো যাবে না। এই চোখে প্রমা তার প্রতিবিম্ব দেখতে পায় যেন।
গাড়িতে বসে কথা বলে সোমা – “ভাইয়া, আপুকে কবে বলা যাবে দীপ্ত’র কথা? ডাক্তার কি বলেছে?” “বাবু হবার আগে তো অবশ্যই না, এমন কিছুই করা যাবেনা ওর সাথে যাতে ওর পুরনো স্মৃতি মনে পরে যায়। নতুন বাবু একটু বড় হলে আস্তে আস্তে ওকে জানাতে হবে সব”।
সোমাকে ড্রপ করে দিয়ে দীপ্তর কিছু জামা কাপড় আর খাবার জিনিস নিয়ে উত্তরাতে যায় অনন্ত, এবার দরজা খুলে দেন শুভ্রর মা, জানান দীপ্ত এই মাত্র ঘুমিয়ে গেছে। অনন্তর হাত থেকে প্যাকেট গুলো নিয়ে আঁচলে চোখ মোছেন মমতাময়ী। “আমার শুভ্র বেঁচে থাকলেও এমনই আদর করতো দীপ্তকে – প্রমা কেমন আছে এখন?” “ও ভাল আছে খালাম্মা, নেক্সট উইকে আবার চেকআপে নিয়ে যাব, ডাক্তার বলেছেন এখন পর্যন্ত কোন সমস্যা নেই, দোয়া করবেন প্লিজ”। – “তা কি আর বলতে হয় বাবা। প্রমা কি আমার মেয়ে না? আফসোস, মেয়েটাকে দেখতে যেতে পারিনা আমি”।
অনন্ত বিদায় নিয়ে চলে গেলে ধীর পদক্ষেপে শুভ্রর বাঁধানো ছবিটার সামনে এসে দাঁড়ান মা, আঁচল দিয়ে ধুলো মুছে দেন। শুভ্রর শেষ আর্তনাদ তার কানে আজও বাজে। ড্রাইভ করতে করতে তার সাথেই কথা বলছিল শুভ্র, পাশে প্রমা, ডেলিভারির জন্য ক্লিনিকে ভর্তি হবার আগে শেষবার চেকআপে যাচ্ছিলো তারা। তখনই ঘটে যায় মারাত্মক সেই দুর্ঘটনা, শুভ্রকে চোখের সামনে চলে যেতে দেখে মানসিক ভারসাম্য হারায় প্রমা। দেড় বছর চিকিৎসা করার পর অনেকটা সুস্থ হলেও পুরনো অনেক স্মৃতি হারিয়ে ফেলে সে। ডাক্তারের বারণ থাকায় দীপ্তকে আলাদা করে রাখা হয় তার মা’র কাছ থেকে। কোনক্রমে প্রমার যদি মনে পড়ে যায় সেই এক্সিডেন্টের কথা, তবে সর্বনাশ হতে পারে।
সাবধানে ড্রাইভ করে বাড়ীর পথে রওনা হয় অনন্ত ..