অভিনয়

অভিনয়

সারারাত অফিসের কাজ কমপ্লিট করে ফজরের নামাজ পড়ে ঘুমোতে গেলাম। ইচ্ছে বেলা ১১ টা নাগাদ ঘুমোবো। কিন্তু মোবাইল বেচারার অহেতুক চিল্লানিতে সকাল আটতাতেই ঘুম ভেঙ্গে গেলো। ফোন হাতে নিয়ে দেখি অথৈর আম্মু ইতিমধ্যে বারো তেরোটা ফোন দিয়ে দিয়েছেন। তেরো নম্বর ফোনটা আলস্যের জন্যে ইচ্ছে করেই পিক করিনি। চৌদ্দ নাম্বার ফোনটা আসতেই পিক করলাম। ফোন পিক করতেই ওপাশ থেকে আন্টি বললেন,
‘হ্যালো শাহীন?’
‘জ্বী আন্টি বলেন।’
‘বাবা তুমি কি ঘুমোচ্ছিলে?’
‘ঐ আরকি। অফিসের কাজ জমা পরে ছিলো। ওগুলো কমপ্লিট করতে কর
‍তেই রাত শেষ তাই ফজরের নামাজ পড়েই ঘুমোতে আসলাম একটু।’
‘ওহ আচ্ছা বাবা আমি দুঃখিত। আসলে আমি বুঝতে পারিনি। তোমার ঘুমের ডিস্টার্ব করলাম।’
‘আরে আন্টি কি যে বলেন না। আচ্ছা কেনো ফোন দিয়েছেন সেটা বলেন? অথৈ কি আবারো সমস্যা করতেছে?’
‘হ্যা বাবা। তুমি ঠিক ধরেছো। অথৈ আজকে একটু বেশিই পাগলামো করতেছে। কাল সারাদিন তো কিছু মুখে দেয়ই নি। রাতেও না খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলো। এখন রাত পেরিয়ে সকাল তাও কিছু খাবেনা বলে জেদ ধরেছে। তুমি না আসা অবধি কিছুই খাবেনা হয়তো। সময় থাকলে একটু আসতে পারবা বাজান?’
‘আচ্ছা আন্টি আমি আসতেছি। আপনি কোনো টেনশন নিয়েন না।’
এরপর আমি ফোনটা রেখে ঘুম ঘুম চোখেই গেলাম ফ্রেশ হতে। ফ্রেশ হয়ে এসে নাস্তাটা সেরেই বেড়িয়ে পড়লাম অথৈদের বাসার উদ্দেশ্যে। একটা রিক্সা ডেকে চেপে বসলাম ওটায়। আর ভাবতে থাকলাম সেদিনের কথাগুলো….

অথৈ আমার গার্লফ্রেন্ড। অথৈ নামটা আমারই দেওয়া। ওর ভালো নাম নাদিয়া রহমান। আমি অথৈ নামেই ডাকি। আমার দেখাদেখি এখন প্রায় সকলেই ওকে অথৈ বলে ডাকে। অবশ্য আমার দেখাদেখি না। ওরে অথৈ বলে না ডাকলে ও সাড়া দেয়না বলেই সবাই বাধ্য হয়েই ডাকে হয়তো। ওর আর আমার রিলেশনের মাঝখানে কিন্তু কম বাধা ছিলোনা। এই যে আন্টি এখন চুন থেকে পান কষতেই ফোন দেয়। সেই আন্টিই আমাদের রিলেশনের ঘোর বিরোধী ছিলেন। কিভাবে যে সবকিছু এতো সহজেই বদলে গেলো। আমিও ওদের ফ্যামিলির একজন হয়ে গেলাম।

সবকিছু বদলেছে মানে সবকিছুই বদলে গেছে। অথৈ ও বদলে গেছে। হুটহাট ওর কি যে হলো! ও আর আগের মতো স্বাভাবিক নয়। মানুষিকভাবে অসুস্থ। ওর চালচলন বাচ্চাদের মতো হয়ে গেছে। বাচ্চাদের মতো জেদ ধরে এটা ওটার জন্যে। মাঝেমাঝে তো অযথাই একা একা হাসে, একা একা কথা বলে।

ওর এই সমস্যাটা হয়েছে মাসদুয়েক আগে থেকে। ফ্যামিলি থেকে ওকে বিয়ের জন্যে প্রেশার দিচ্ছিলো। আর আমি জবের জন্যে ট্রাই করতে করতে ক্লান্ত। ও চেয়েছিলো যাতে আমরা পালিয়ে যাই কিন্তু আমি পারছিলাম না। বলছিলাম কয়েকদিনের জন্যে অপেক্ষা করতে কিন্তু সেটা ওর পক্ষে সম্ভব ছিলোনা। শেষমেশ একটা ছেলে দেখে বিয়ের দিনক্ষন ঠিক করে নিলো ওর ফ্যামিলি। আমিও বড় ছেলে নাটকের মতো ওকে শেষ বিদায় দিয়ে দিলাম। ও আমার কাছ থেকে ফেরার সময় মোটেও কান্না করেনি। ভাবলাম হয়তো খুব সহজেই সে ব্যাপারটা মেনে নিয়েছে। কিন্তু আমি পারছিলাম না। ওখান থেকে ফিরে এসে আবার জবের জন্যে উঠেপড়ে লেগে যাই। অবশ্য একটা ভালো জবও জুটিয়ে ফেলেছিলাম। কিন্তু ততোক্ষণে সব শেষ। আমার ধারণা এতোদিনে ওর বিয়ে হয়ে যাওয়ার কথা। তাই ওকে হারানোর বেদনায় এ যুগের দেবদাসের মতো দিনকাল কাটাতে হচ্ছিলো।

কিন্তু হটাৎ এক বিকেলে আন্টির ফোন পেয়ে খুব অবাক হই। তারচেয়ে আরো দিগুণ অবাক হই অথৈর অসুস্থতার খবর শুনে। এক দৌড়ে সেদিন অথৈইদের বাসায় যাই। গিয়ে দেখি অথৈ আর আগের মতো স্বাভাবিক নয়। খুব কান্না পাচ্ছিলো। অথৈ অবশ্য আমাকে দেখে চিনতে ভুল করেনি। আমি যে সোফাটায় বসি ও ওটার পাশে বসে। তারপর বাচ্চাদের মতো আমার সাথে দুষ্টুমি শুরু করে দেয়। একবার আমার মাথার চুল ধরে টানে তো আরেকবার আমায় সোফা থেকে টেনে ফ্লোরে বসায়। যদিও ওর এই অবস্থা দেখে খুব মর্মাহত ছিলাম, তবুও ওর বাচ্চামিগুলো ভেতর থেকে উপভোগ করছিলাম। মনেমনে খোদাকে ধন্যবাদ দিয়েছিলাম এই জন্যে যে, এটলিস্ট অথৈ আমার জীবন থেকে এখনো হারিয়ে যায়নি বলে।

রিক্সায় বসে অথৈর কথা ভাবতে ভাবতে ইতিমধ্যে অথৈদের বাসায় পৌঁছে গেলাম। অথৈদের বাসার গেট পেরিয়ে ওদের ড্রয়িংরুমে ডুকতেই অথৈ দৌড়ে এসে বললো,
‘তুমি এতো লেইট করলে কেনো আসলে? আজ কতোদিন ধরে কেউ আমার সাথে পুতুল খেলেনা। পুতুলের বিয়ে দেয়না।’
‘আচ্ছা এখন আমি আসছি তো। এবার তোমার পুতুলের বিয়েটা হবেই।’ আমি একটু আহ্লাদী গলায় বললাম।
কিন্তু ও কিছুতেই গললো না। আমার সাথে উল্টো আড়ি দিয়ে বসে আছে। অনেক কষ্টে ওর আড়ি ভেঙ্গেছিলাম। তাও প্রতিদিন একবার আসার প্রমিস করে। তারপর আসলো বাসায় ফেরার পালা। ওর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ফেরার সময় আন্টি আমায় ডেকে নিয়ে বললেন,
‘দেখো শাহীন তোমার কাছে আমি খুব লজ্জিত। আজ তুমি অথৈর এই অবস্থায় পাশে না দাঁড়ালে যে কি হতো আল্লাহ জানে। যাইহোক আমি চাচ্ছিলাম ওকে দেশের বাইরে পাঠাতে কিন্তু ও ওখানে তোমায় ছাড়া আরো বেশি অসুস্থ হয়ে না যায় সেই ভয়ে আর বাইরে পাঠানোর সাহস পাচ্ছিনা। তাছাড়া আগের ছেলেপক্ষ ওকে এই অবস্থাতেই বিয়ে করতে রাজি। কিন্তু আমি কোনো ভরসা পাচ্ছিনা। কি যে করি বাবা…’

আন্টির কথায় কি বলবো বুঝতেছিনা। তবুও মনে অনেকটা সাহস যুগিয়ে বললাম,
‘দেখেন আন্টি যা হওয়ার হয়েছে। তবুও আমি অথৈ কে খুব ভালোবাসি এটা আপনিও জানেন। আপনি রাজি থাকলে আমি ওকে এই অবস্থাতেই বিয়ে করতে রাজি। যেহেতু অথৈ আমায় ছাড়া কিছু বুঝেনা সেহেতু মনে হয়না আমি ভুল কিছু বলছি। যদিও এই কথাগুলো আমার মা বাবার বলা উচিত ছিলো। কিন্তু আমাকেই বলতে হলো যেহেতু আপনি বিয়ের টপিক তুলেছেন।’
আন্টি অনেকক্ষণ ভেবেচিন্তে আমার হাত ধরে বললেন,
‘বাবা আমিও এটাই চাই। চক্ষুলজ্জায় বলতে পারছিলাম না। তোমার ফ্যামিলি রাজি থাকলে আমার কোনো আপত্তি নেই।’
‘আচ্ছা আন্টি আমি আগামী শুক্রবারেই আমার আম্মু-আব্বুকে নিয়ে আসবো। আপনি কোনো চিন্তা কইরেন না। এবার আসি…’
এইবলে আমি অথৈদের বাসা থেকে বেড়িয়ে পড়লাম। মনেমনে খুব খুশি আমি। অবশেষে আমার অথৈকে আমিই বউ হিসেবে পাচ্ছি। নিজেকে পৃথিবীর সবচাইতে সু-ভাগ্যবান একজন পুরুষ মনে হচ্ছিলো।

আজ সেই শুক্রবার। সকাল সকাল ওদের বাসায় এসে পড়লাম আমি সঙ্গে আমার আম্মু আব্বু। আমার আব্বু এই মুহূর্তে অথৈর আম্মুর সাথে আমার আর অথৈর ব্যাপারে কথা বলছেন। আর আমি অথৈর রুম থেকে শুনার চেষ্টা করতেছি তারা কি বলে। তারপর অনেক্ষণ কথা বলে, বাবা কি ভেবে একজন কাজী ডেকে নিয়ে আসেন। কাজী এনে আর দেড়ি না করে আমার সাথে অথৈর বিয়ে পড়িয়ে দেন।

কি আজব আসলাম বিয়ের দিন তারিখ ঠিক করতে অথচ ফিরবো বিয়ে করা বউ নিয়ে। ব্যাপারটা কেমন গোলমেলে হয়ে গেলো।
তারপর কি আর করা বিয়ে যেহেতু করবোই তাহলে নাহয় একটু আগেই করে নিলাম। সারাদিন অথৈদের বাসায় থেকে দুপুরের খাবার খেয়ে, বিকেলে অথৈকে সাথে নিয়ে বাসায় ফিরলাম। বাসায় ফিরে দেখি, বাবার ফোন পেয়ে ছোট বোন আশেপাশের ছোটবড় ছেলেমেয়েদের নিয়ে পুরো বাড়ি সহ বাসর ঘরটাও সাজিয়ে রেখেছে। অথৈ তো বাসার আলোকসজ্জা দেখে অনেক খুশি।
এখন রাত বারোটা বাজে প্রায়। অথৈ বাসরঘরে আমার জন্যে অপেক্ষা করতে করতে অধৈর্য হয়ে হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছে। জেগে থাকলেই বা কি আসে যায়, দেখা যাবে পুতুলের বিয়ে দিতে দিতেই রাত পার করতে হবে। তবুও আমি ব্যাপক খুশি এই ভেবে যে, অথৈ আমার ছিলো; আমারি থাকবে। আমি দরজা খোলে রুমে ডুকতেই দেখি অথৈ এখনো সজাগ। আমি শেরওয়ানি খোলে টিশার্ট পড়ে বেলকনিতে আসলাম। আমার পিছুপিছু অথৈও আসলো। এসে আমার পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে বললো,
‘শাহীন।’
‘হ্যা অথৈ বলো।’
সে তখন শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বললো,
‘একদিন ভার্সিটিতে থাকতে মঞ্চ নাটকে অভিনয়ের সময় তুমি বলেছিলে, আমি নাকি অভিনয়ে দক্ষ নই। অথচ আজ আমি অভিনয়ে দশে দশই পাবো।’

আমি কিছুটা অবাক হয়ে ওকে টেনে আমার সামনে এনে ওর চোখে চোখ রেখে জিজ্ঞেস করলাম,
‘অভিনয়?’ আমার চোখেমুখে আনন্দের ছাপ স্পষ্ট। আমার বুঝতে বাকি রইলোনা কিছুই। অথৈ তখন একগাল মুচকি হেসে বললো,
‘হ্যা অভিনয়। আমাকে নিঃস্বার্থভাবে ভালোবাসার পরিক্ষায় তো তুমি অনেকবার পাশ করেছো। এবার আমি মানষিক অসুস্থার অভিনয়ে পাশ করে আমার সেরা পুরষ্কার টা পেলে দোষ কোথায়?’

আমি তখন অথৈকে আমার বুকের সাথে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে, এই রাতের বিশাল আকাশের তারার পানে তাকিয়ে ভাবি, এমন অভিনয় সবার জীবনে অন্তত একবার হলে মন্দ কি?

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত