পাতালরেলের টানেলটা যেখানে শেষ হয়েছে সেখানে থেকে ফেরু বাইরের আলো দেখতে পায়। দিনের আলোতে ফেরু বাইরে আসতে চায় না। সেদিন রাত্তিরে টানেলের ঘুটঘুটে অন্ধকার থেকে বাইরের আলোয় এসে ফেরু চারদিক দেখল। আশেপাশে কেউ নেই। এদিকে কেউ বড়ো একটা আসে না। শুধু রেল লাইনের মিস্ত্রিরা বছরে দুয়েকবার লাইন সারাতে আসে। দূরে গির্জার ঘড়িতে দশটা ঢং ঢং আওয়াজ হল। রাত দশটা বাজল। গরমকাল। তখনও চারদিকে দিনের আলো ঝলমল করছে।
ফেরুর এই গরমকালটা একটুও ভালো লাগে না। সুয্যিমামা যাব যাব করেও যেতে চায় না। মেঘলা দিনেও আকাশজুড়ে একটা ঘোলাটে আলো থাকে। অন্ধকার না হলে ওর বের হতে ভয় করে। শীতকালটা ফেরুর খুব পছন্দ। শীত বৃষ্টি বরফ লেগেই থাকে। বিকেল চারটে থেকে অন্ধকার নামে। ফেরু টানেলের বাইরে চলে আসে। রাস্তায় বেশি লোকজন থাকে না। থাকলেও তারা শীতে কাবু হয়ে কোট, টুপি, দস্তানা পরে তড়িঘড়ি হেঁটে চলে যায়। তাদের কোনওদিকে তাকানোর সময় নেই। এমনিতে আকাশ যেমন মেঘলা, লোকের মুখও তেমনি গোমড়া। ফেরু ওদের পাশ দিয়ে চলে গেলেও কেউ ওকে খেয়াল করে না।
দূর থেকে অনেকে ওকে কুকুর বলে মনে করে। সামনাসামনি দেখলে ঠিক চিনে ফেলবে। ফেরুর ছুঁচলো মুখ, লম্বা কান, মোটা বাহারি ল্যাজ। গায়ের রঙ লালচে বাদামি। কুকুরদের চেয়ে ও অনেক ভালো দেখতে। স্টেশনের গায়ে খাবারের দোকান ‘গ্রিজি স্পুন’-এর মালিক আদর করে ফেরুকে খেতে দেন। গ্রিজি স্পুন একটা তেল চুকচুকে চামচ। দোকানে দিনরাত অনেকরকমের তেলেভাজা খাবার পাওয়া যায়। লরি, কোচ, ট্যাক্সির ড্রাইভাররা গাড়ি থামিয়ে খাওয়া সেরে নেয়। দোকানের মালিক ফেরুকে দেখলেই ডাক দেন, “অ্যাই ফেরু, অ্যাই ফেরু।” ও থমকে দঁড়ালে ওর দিকে একটা আধখাওয়া ওমলেট কি সসেজ ছুড়ে দেন। ফেরুর এই ডাকটা খুব ভালো লাগে।
গরমকালে সবকিছু বদলে যায়। রাত বারোটা একটা পর্যন্ত রাস্তায় লোকের ভিড়। সবাই হাসে, খেলে, খোশমেজাজে আড্ডা দেয়। চায়ের দোকান, খাবারের দোকান, লাল-সাদা-হলুদ-সবুজ পানীয়ের দোকান থেকে লোক উপচে পড়ে। তারা ফুটপাথে পাতা চেয়ার-টেবিলে বসে ঘন্টার পর ঘন্টা বসে আড্ডা দেয়। বাড়ি যাওয়ার নাম নেই।
ফেরুর খিদেতে পেট চোঁ চোঁ করছিল। সেই কোন সকালে ও একটা বাসি রুটি খেয়েছে, তারপর থেকে পেটে কিছু পড়েনি। বড়ো রাস্তা পেরিয়ে পার্কের ধারে হা হা রোডে অনেক বাগানবাড়ি। সেদিকে পৌঁছতে পারলে আর খাবারের অভাব হবে না। এইসব ভাবতে ভাবতে ফেরু রেল লাইনের ধার দিয়ে হাঁটছিল।
বড়ো রাস্তায় এসে ফেরু একটু ভয় পেল। জুলাই মাস। দু-তিনদিন হল বেশ গরম পড়েছে লন্ডনে। রাস্তায় লোক হাসি হাসি মুখে ঘুরে বেড়াচ্ছে। অচেনা লোককেও হ্যালো হ্যালো করছে। জোরে জোরে কথা বলছে। এত লোকের সামনে ফেরু কী করে রাস্তা পার হয়ে পার্কের দিকে যাবে ভেবে উঠতে পারছিল না।
ফেরু হঠাৎ দেখতে পেল, একদল লোক বড়ো কোচ থেকে নেমে মালপত্তর নিয়ে হুড়মুড় করে রাস্তা পার হচ্ছে। কোনওদিকে তাকাচ্ছে না। একটু দেরি করলেই উলটোদিকের সবুজ আলোটা নিবে যাবে। সবুজ আলোটা বেশিক্ষণ জ্বলে না; রাস্তা পার হওয়ার সময় দেয় না। একটু জ্বলেই লাল হয়ে যায়।
ফেরুর মাথায় অনেক বুদ্ধি। ও দেখে দেখে শিখে ফেলেছে, সবুজ আলোর লোকটা এক পা বাড়ালেই রাস্তা পার হতে হয়। লাল আলোর দাঁড়ানো লোকটা এলেই দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। তখন পার হতে গেলেই গাড়িচাপা পড়ে চিঁড়েচ্যাপ্টা হয়ে যাবে। সেই লোকগুলোর ভিড়ের পিছনে হেঁটে ফেরু রাস্তা পার হয়ে গেল। কোনওদিকে তাকাল না। তরতর করে ও সোজা পার্কের দিকে হাঁটতে লাগল। ফেরুর এ-রাস্তাটা এত চেনা যে ও চোখ বুজে পার্কে চলে যেতে পারে।
পার্কের চারধারে বড়ো বড়ো বাগানঘেরা বাড়ি। সব বাড়িগুলোই একরকম দেখতে। শুধু সদর দরজার রঙ আলাদা। লাল, কালো, নীল, হলুদ, সবুজ যার যা ইচ্ছে রঙ করেছে। দরজার মাঝখানে একটা জায়গায় ফাঁক আছে। সেখান দিয়ে ডাকপিওন চিঠি ফেলে। সামনের ছোটো বাগানে হানিসাকল আর জুঁইফুলের ঝোপ। গরমকালে ঝোপগুলো ফুলে ভরে যায়। আসল বাগানবাড়ির পেছনদিকে। সেখানে গাছে গাছে আপেল, ন্যাসপাতি, চেরি, প্লাম। বড়ো উঁচু গাছের তলায় চেস্টনাট বাদামের ছড়াছড়ি। সব বাড়ির বাগানে ময়লা ফেলার ডাস্টবিন। ফেরু রোজ সেখানেই যায়। ও এই ডাস্টবিনগুলো ঘেঁটে খাবার খোঁজে। ফেরু এতদিনে বুঝে গেছে কোন বড়ির লোক কী খায়।
ফেরুর খাবারের ব্যাপারে কোনও বাছবিচার নেই। তবে ভালোমন্দ খাবার পেলে ও খুব খুশি। এক নম্বরের দরজায় তালা মারা। ডাস্টবিন ফাঁকা। তিন নম্বরের ডাস্টবিনে কলা আর লেবুর খোসা, কিছু শাকপাতা। বাড়ির মালিক রোগা-ঢ্যাঙা লোকটাকে ও পার্কে ডনবৈঠক করতে দেখেছে। মনে হয় রান্না করে খায় না। পাঁচ নম্বর বাড়ির বাইরে ভারা বাঁধা। আট মাস ধরে সারাই হচ্ছে। বোধহয় মিস্তিরিরা কাজে ফাঁকি দিচ্ছে। সাত নম্বরে মনে হয় অনেক হ্যাংলা লোক থাকে। ওরা খোসা, বিচি, কাঁটাকুটি, হাড়গোড় সবকিছু খায়। এক কুচি খাবারও ফেলে না। ওদের ডাস্টাবিনে শুধুই জঞ্জাল। ন’নম্বরে প্ল্যাস্টিক আর কাগজের ঠোঙা, খালি পিৎজার কৌটো, নুডলসের প্যাকেট, চিকেন কোর্মার প্ল্যাস্টিকের প্লেট, কোকাকোলা আর সেভেন-আপের বোতল। ফেরু খেয়াল করেছে যে বাড়িটায় একদল ছেলে থাকে। তারা সাইকেলে কি মোটরবাইকে চেপে হৈ হৈ করে আসে আর চলে যায়। ফেরু ঠোঙা, প্যাকেট চেটে দেখেছে। ওর ভালোই লেগেছে, কিন্তু ছেলেগুলোও একটুও খাবার ফেলে না।
ওর এগারো আর পনেরো নম্বরের বাড়ি দুটোই সবচেয়ে পছন্দ। এগারো নম্বরের বেয়াড়া ছোটো ছেলেটা মনে হয় খাবার নিয়ে খুব ঝামেলা করে। ফেলে ছড়িয়ে খায়। তাই ওদের ডাস্টবিনে আধখাওয়া বার্গার, বানরুটি, মাছভাজা, আলুভাজা, আপেল, কলা খেতে পায়। শনি-রবিবার হলে আধখাওয়া মুরগির ঠ্যাংও ফেরুর কপালে জুটে যায়। তেরো নম্বরের লোকগুলো বছরে ছ’মাস লন্ডনে থাকে না। গরমকালে দল বেঁধে আসে, দুটো বড়ো গাড়ি হাঁকিয়ে ঘুরে বেড়ায়। বাড়ির সামনে দুটো গাড়ি রাখে বলে পাশের বাড়ির লোক গাড়ি রাখতে পারে না। ফেরু দেখেছে, একদিন এই নিয়ে এগারো আর তেরো রাস্তায় নেমে দারুণ ঝগড়া করছে।
তবে তেরো নম্বরে লোক এলে ও অনেক বিদেশি খাবার খেতে পায়। ওদের খাবারগুলো অন্যরকম। ওরা লাউ, বেগুন, টম্যাটোর পেটের মধ্যে মাংসের পুর ভরে রান্না করে। ফেরু বাদাম খেতে ভালোবাসে। চিনির রসে চুবানো পেস্তাবাদামের মিষ্টিগুলোর জন্যে ও অপেক্ষা করে থাকে। সবশেষে কোনার দিকে পনেরো নম্বরে যিনি থাকেন তিনি ছবি আঁকেন। জানালার ধারে বসে ছবি আঁকেন। বাড়িতে একটা ঝাঁকড়াচুলো ছোটো মেয়েও আছে। সেও জানালায় এসে দাঁড়ায়। ওরা হয়তো ফেরুকে ডাস্টবিন থেকে খেতে দেখেছে।
একদিন অন্ধকার বাগানে বোধহয় ওর পায়ের শব্দ শুনে মেয়েটা চেঁচিয়ে উঠল, “বাবা, দেখে যাও, বাগানে একটা নেকড়ে বাঘ এসেছে।”
বাবা দৌড়ে এসে বাইরের জোরালো আলোটা জ্বেলে দিয়েছিলেন। হাঁসের ঠ্যাংটা চিবোতে চিবোতে ফেরু মুখ তুলে তাকাতেই উনি মোবাইলে ওর ছবি তুলে ফেললেন। মেয়েটাকে বললেন, “এমিলি, ওটা নেকড়ে বাঘ না। ওটা ফেরু।”
এমিলি লাফাতে লাফাতে বলল, “বাবা, আমরা ফেরুকে পুষব। আমাদের কুকুর নেই। ফেরুকে রাখব।”
বাবা বললেন, “কেউ ফেরুকে বাড়িতে রাখে না। ফেরু বন্যজন্তু। বনেই ভালো থাকে। ওদের বাড়িতে ধরে রাখা যায় না।”
এমিলি বলল, “কেন? ফেরু আমাদের বাগানে থাকবে!”
বাবা বললেন, “দেখি, ফেরু যদি আমাদের বাগানে থাকতে রাজি হয়।”
অবাক কান্ড! তারপর থেকে মাঝেমাঝেই বাগানে একটা প্লেটে কিছু খাবার রেখে দিচ্ছেন। ভেড়ার মাংস, হাঁস-মুরগির ঠ্যাং কি মাছের মুড়ো। ফেরু অন্য ডাস্টবিনেও মাছের মুড়ো খেয়েছে। এরা মাছ কিনে মুড়োটা ফেলে দেয়। ফেরুর মাছের মুড়ো চিবিয়ে খেতে খুব মজা লাগে। ফেরুকে খেতে দেখলে বাবা আর এমিলি জানালা দিয়ে দেখে। মাঝে মাঝে ওর ছবিও তোলে। ফেরুর ঝাঁটার মতো ল্যাজটা দেখে এমিলি ওর নাম দিয়েছে ফুলঝাড়ু। নামটা ফেরুর খুব পছন্দ। তারপর থেকে ফেরু হয়ে গেল ফুলঝাড়ু।
ফুলঝাড়ু কিছুদিন থেকেই দেখছে, ওর আসতে একটু দেরি হলেই এগারো আর পনেরো নম্বরের খাবার হাওয়া হয়ে যাচ্ছে। তাই আজ একটু তাড়াতাড়ি বেরিয়েছে। খাবার চোরকে ধরতেই হবে। পার্কে ওর দু-চারজন জাতভাই থাকে। তারা ওর চেয়ে বয়সে অনেক ছোটো। তিন মাস আগে বসন্তকালে ওদের কচি ঘাসের ওপর খেলা করতে দেখেছে। ওরা ফুলঝাড়ুকে ভয় পায়। ওদের ফুলঝাড়ুর খাবার চুরি করে খাওয়ার মতো সাহস হবে না। ফুলঝাড়ুর ভীষণ দুশ্চিন্তা কে ওর খাবারে থাবা দিচ্ছে। তাকে ধরতেই হবে।
ফুলঝাড়ু যখন হা হা রোডে পৌঁছল তখন দিনের আলো নিভে এসেছে। কোনও কোনও বাড়ির জানালায় আলো দেখা যাচ্ছে। এগারো নম্বর অন্ধকার, ফাঁকা ডাস্টবিন উল্টানো রয়েছে। বোধহয় বাচ্চা ছেলেটার ইস্কুলে গরমের ছুটি শুরু হল। মা-বাবার সঙ্গে বেড়াতে গেছে। তেরো নম্বরের কাছে এসে ফুলঝাড়ু আর এগোতে পারল না। দেখল, বাগানে আলো জ্বলছে। চারজন ছেলে বাগানে বল খেলছে। আটজন লোক চেয়ারে বসে গল্প করছে। ওদের বাগানের পাশ দিয়ে পনেরো নম্বরে গেলে সবাই ওকে দেখে ফেলবে। ফুলঝাড়ু খালি পেটে টানেলে ফিরে এল। গ্রিজি স্পুনও বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। কেউ ফুলঝাড়ুকে ডেকে খেতে দেয়নি।
পরেরদিনও ফুলঝাড়ু হা হা রোডে গিয়ে হতাশ হল। পনেরো নম্বরের বাগানে সেদিন আলো ঝলমল করছে। গাছের ডালে ডালে বেলুন আর রঙিন কাগজের মালা ঝুলছে। ছোটো, বড়ো অনেক লোক। বড়োরা হাতে গেলাস নিয়ে ঘুরে ঘুরে কথা বলছে। টেবিল থেকে বাদাম, জলপাই, আলুভাজা তুলে খাচ্ছে। ছোটোরা ললিপপ, আইসক্রিম চুষছে।
ফুলঝাড়ু বুনো গোলাপ ঝোপের পেছনে বসে দেখছিল। বাগানের মাঝখানে টেবিলে একটা বড়ো চকলেট কেক। কেকের ওপর একট দু’ইঞ্চি লম্বা চিনির বার্বি ডল। তার মাথায় গোলাপি বুড়ির চুল। পুতুল ঘিরে ছ’টা মোমবাতি। একসময় ঝাঁকড়াচুলো মেয়েটা এসে কেকের মোমবাতিগুলো জ্বেলে দিল। মোমবাতি তারাবাজির মতো চিকচিক করে জ্বলে উঠল। সেই সঙ্গে সবাই মেয়েটাকে ঘিরে বেসুরো গলায় গান গাইতে শুরু করল। গান থামলে মেয়েটা চিনির পুতুলটা তুলে টপ করে মুখে ফেলে দিল। ওর মা হাঁ হাঁ করে উঠলেন, “এমিলি, তুমি মিলিসেন্টকে খেয়ে ফেললে?”
এমিলির বন্ধু রেশমি জিজ্ঞেস করল, “মিলিসেন্ট কে, আন্টি? ও তো বার্বি ডল।”
উনি উত্তর দিলেন, “তুমি জানো না। বার্বির ভাল নাম বারবারা মিলিসেন্ট রবার্টস। বার্বি গল্পের বই থেকে এসেছে।”
তারপর এমিলিকে বকলেন। “বলেছি না সবাইকে দিয়ে খেতে হয়? আর অত মিষ্টি খেও না। দাঁতে পোকা হবে।”
এমিলির মা কেক কাটলেন। টুকরো টুকরো কেক সবাইকে বিলি করলেন। বাগানের একপাশে সাদা টুপি মাথায় একজন লোক ইলেকট্রিক উনুনে মাংসের টুকরো সেঁকে প্লেটে তুলে রাখছিল। মাংসের গন্ধে ফুলঝাড়ুর খিদে বেড়েই যাচ্ছিল। ফুলঝাড়ু বসে বসে সব দেখছিল আর ঠোঁট চাটছিল। তারপর রেকর্ডে গানের সঙ্গে ছোটো বড়ো সবাই লাফালাফি করে নাচতে লাগল। যার যেমন ইচ্ছে নাচছিল। যে লোকটা মাংস সেঁকে রাখছিল, সে-ও উনুন নিভিয়ে নাচতে নামল। ফুলঝাড়ু ভাবল, এই মওকায় যদি একটা মাংসের টুকরো চুরি করতে পারে। ও ঝোপের আড়াল থেকে মাথা উঁচু করে দেখছিল। এমন সময় একটা ছোটো ছেলে ফুলঝাড়ুকে দেখতে পেয়ে কেঁদেকেটে বলে উঠল, “ওলে বাবা, এমিলিদিদিল বালিতে ল্যাজমোটা কুকুল।”
এমিলির বাবা দৌড়ে এসে ছেলেটাকে কোলে তুলে বললেন, “ওটা কুকুর না, খোকা। ও আমাদের ফুলঝাড়ু। ও কিচ্ছু করবে না। ওর খিদে পেয়েছে। একটুকরো কেক পেলেই চলে যাবে।” বলেই একটুকরো কেক ফুলঝাড়ুর দিকে ছুঁড়ে দিলেন।
ততক্ষণে ছেলেটার মা, বাবা, আরও অনেকে নাচগান ফেলে ছুটে এসেছেন। ছেলেটার বাবা বলছেন, “মশাই, আপনি বাগানে শিয়াল পুষেছেন? জানেন, ওরা আপনার কত ক্ষতি করতে পারে?”
অন্য একজন বলল, “খবরে শুনেছিলাম, একটা শিয়াল একতলার খোলা জানালা দিয়ে ছোটো বাচ্চাকে টেনে নিয়ে গিয়েছিল।”
অন্য একজন ফোড়ন কাটল, “কাগজে দেখেছি, লন্ডন শহরে প্রায় দশ হাজার শিয়াল ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।”
বাচ্চা ছেলেটার মা কপালে চোখ তুলে বললেন, “কী কান্ড! এ আমার জানা ছিল না। শিয়ালগুলো থাকে কোথায়?”
আগের লোকটি বললেন, “এরা শহুরে শিয়াল। থাকে পার্কে, বাগানের শেডে, ঝোপেঝাড়ে, রেল লাইনের ধারে, টানেলে, বাড়ির গ্যারাজে।”
বাচ্চা ছেলেটার মা এবার হাউমাউ করে উঠলেন। “ওরে বাবা, বাড়ির গ্যারাজে শিয়াল আসতে পারে!”
এমিলির মা এসে সবাইকে শান্ত করলেন। “ফুলঝাড়ু খুব শান্ত ভদ্র শিয়াল। ও শুধু খেতে আসে। ডাকলেও আমাদের বাড়িতে ঢোকে না।”
একথায় লোক খুব শান্ত হল না। প্লেটভর্তি সেঁকা মাংস, রুটি, স্যালাড, আঙুর, স্ট্রবেরি খেতে খেতে বলল, “কাগজে দেখেছি, এই শহুরে শিয়ালদের মেরে ফেলার কথাও কেউ কেউ বলছেন।”
এমিলির বাবা এগিয়ে এসে বললেন, “এরা বন্যজন্তু। এদের বাঁচিয়ে রাখা দরকার। জানেন তো, সরকার আইন করে ফক্স হান্টিং বন্ধ করে দিয়েছে। রাজামশাইরা আর দলবল নিয়ে শিয়াল শিকার করতে পারবেন না।”
একজন চটে গিয়ে প্রশ্ন করল, “বলুন, শিয়ালরা কার কোন উপকারে লাগে?”
এমিলির বাবা বললেন, “ওরা খরগোস খায়। খরগোস ক্ষেতখামারে গিয়ে ফসল খায়। চাষিদের দারুণ ক্ষতি করে।”
উনি আরও বললেন, “শহরে ওরা বেশিদিন বাঁচতে পারে না। হয় গাড়ি চাপা পড়ে মারা যায়, নয় লোকে মেরে ফেলে।”
ফুলঝাড়ু কান পেতে সব শুনছিল। এসব শুনে মন খারাপ করে টানেলে ফিরে গেল। ঠিক করল, ভোর রাত্তিরে এসে খাবার খুঁজবে। তখন লোকগুলো নাচতে নাচতে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়বে।
ভোর রাত্তিরে ফুলঝাড়ু যখন টানেল থেকে বেরিয়ে এল, দিনের আলো তখনও ভালো করে ফোটেনি। আকাশে আবছা চাঁদ। নির্জন রাস্তায় ফুলঝাড়ু জোর পায়ে হাঁটছিল। রাস্তায় ওর পায়ের শব্দ শুনে কোন একটা বাড়ি থেকে ঘেউ ঘেউ ডাক উঠল। ফুলঝাড়ু এই ডাকটা ভালো করেই চেনে। কিন্তু উত্তর দেয় না। শহরের রাস্তায় ওর ডাক শুনলে লোক মার মার করে তেড়ে আসবে। ও ফিরেও দেখল না কোন বাড়ি থেকে ঘেউ ঘেউ আওয়াজ আসছে।
হা হা রোডে পৌঁছে ফুলঝাড়ু দেখল, সব বাড়ি অন্ধকার। সবাই ঘুমাচ্ছে। কোনও সাড়াশব্দ নেই। পনেরো নম্বরের বাগানে ফাটা বেলুন, কাগজের রুমাল, কেকের গুঁড়ো, বাদাম আর আধখাওয়া স্যান্ডউইচ ছড়িয়ে আছে। তারপর দেখতে পেল ডাস্টবিনের পাশে কলাইকরা থালায় সেঁকা মাংস, রুটি, বাদাম আর চকলেট কেক। একটা প্ল্যাস্টিকের গেলাসে ফলের রস।
খাবার দেখে ফুলঝাড়ুর আনন্দ আর ধরে না। একবার ভাবল, দুটো ডাক দিয়ে এমিলিদের জানায় ফুলঝাড়ু খেতে এসেছে। জানত ও ডাকলে সব বাড়ির জানালা খুলে যাবে। ফুলঝাড়ু আর ভাবতে পারছিল না তারপর ওর কী হেনস্থা হতে পারে।
ভোর রাত্তিরে পেটপুরে খেয়ে ফুলঝাড়ুর ভীষণ ঘুম পেয়ে গেল। টানেলে ফিরে যাওয়ার মতো অবস্থা ছিল না। বাগানে খোলা আকাশের তলায় ওর খুব ঘুমাতে ইচ্ছে করছিল। সেখানে ঘুমালে সকালবেলা আশেপাশের বাড়ির লোকেরা ওকে চিনে ফেলবে। ফুলঝাড়ুর হঠাৎ চোখ পড়ল বাগানের কোনায় বড়ো ডাস্টবিনটার ওপর। ওর মাথায় এক বুদ্ধি খেলল। ও ডাস্টবিনের ডালাটা খুলে লাফ দিয়ে একরাশ নোংরা কাগজের প্লেট, গেলাস আর রুমালের মধ্যে শুয়ে পড়ল।
সবে ঘুম আসছে তখন বাগানে খসখস মসমস শব্দ। ফুলঝাড়ু ডালাটা একটু ফাঁক করে দেখল, তিনটে ছোটো ছোটো ফেরু মাটি থেকে খুঁটে খুঁটে খাচ্ছে। ওরা খাচ্ছে দেখে ফুলঝাড়ুর মনটা খুশিতে ভরে গেল। ফুলঝাড়ু ওর খাবার চোরদের ধরে ফেলেছে। ভাবল, ফেরুগুলো বড়ো হচ্ছে। ওরা এখন ফুলঝাড়ুকে ভয় পায় না। তারপর ও এমিলিদের ডাস্টবিনে নিশ্চন্তে ঘুমিয়ে পড়ল।
ক্যাঁচক্যাঁচ, ঘটাংঘটাং, দুমদাম শব্দে ফুলঝাড়ুর ঘুম ভেঙে গেল। ডাস্টবিনে জবুথবু হয়ে শুয়ে ওর হাত-পায়ে ব্যথা করছিল। ডাস্টবিনের ডালাটা ফাঁক করে দেখতে পেল, তিন-চারজন লোক দুটো বড়ো লরি করে বাড়ির জঞ্জাল নিতে এসেছে। লড়ি থেকে একটা লোহার ডান্ডাওলা বিকট হাত এসে ডাস্টবিন তুলে নিয়ে লরিতে উপুড় করে সব জঞ্জাল ফেলছে। ফুলঝাড়ু উঠে বসার আগেই বিকট হাতটা এসে ওর ডাস্টবিনটা আঁকড়ে ধরে লরির জঞ্জালের ওপর খুলে দিল। সব আবর্জনার সঙ্গে ফুলঝাড়ুও লরিতে গিয়ে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে লরির ঝাঁপ নেমে গেল। লরি চলতে শুরু করল।
এমিলি জানালায় দাঁড়িয়ে দেখছিল। ফুলঝাড়ুকে লরিতে পড়তে দেখে ও কেঁদে উঠল। “বাবা, বাবা, শিগ্গিরি এসো! ফুলঝাড়ু জঞ্জালের লরিতে চলে গেল।” বাবা দৌড়ে এলেন। কিন্তু ততক্ষণে লড়িটা হা হা রোড থেকে বেরিয়ে গেছে।
ফুলঝাড়ু লরির ভেতরে আবর্জনার গাদায় খানিকক্ষণ হাবুডুবু খেল। তারপর লরির ভেতরটা ঘুরে দেখল বের হবার মতো কোনও ফাঁক আছে কি না। ভেবেছিল সবুজ আলো জ্বললে লরিটা যখন থামবে, তখন ও এক লাফে পালিয়ে যাবে। বের হবার মতো কোনও রাস্তাই পেল না। ড্রাইভারের সিটের পেছনে একটা কাচের জানালা। ফুলঝাড়ু সেটা খোলার অনেক চেষ্টা করল, কিন্তু খুলতে পারল না। কখন লরির ঝাঁপ উঠবে সেই আশায় বসে রইল।
লন্ডনের ভিড় ছাড়িয়ে বাইরের ফাঁকা রাস্তায় ড্রাইভার খুব জোরে লরি চালাতে লাগল। পাশের সিটে যে লোকটা বসেছিল তাকে বলল, “প্রায় এসে গেছি ময়লা ফেলার জায়গায়। বেশি দেরি নেই। এই টেমস নদীটার ও-পাড়ে। উত্তর দিকে।” ফুলঝাড়ু ভাবছিল, ময়লা ফেলার জায়গা থেকে কি ও হা হা রোডে ফিরে যেতে পারবে? তারপর পাতালরেলের টানেলে?
আবর্জনাভর্তি লরিটা একটা ঝাঁকুনি দিয়ে থামল। ফুলঝাড়ুও গা ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়াল। ভেবেছিল ঝাঁপ খুললেই পালাবে। ড্রাইভার লরিতে বসে বোতাম টিপে ঝাঁপ খুলল। ঝাঁপটা নিজে নিজেই উঠে গেল আর সেই সঙ্গে লরির সব আবর্জনা হুড়হুড় করে মাটিতে পড়ল। তার সঙ্গে ফুলঝাড়ুও তালগোল পাকিয়ে পড়ে গেল। লরির ঝাঁপটা আবার নিজে নিজেই বন্ধ হল। ঝাঁপ বন্ধ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই লরিটা ঝড়ের বেগে চলে গেল। দূর থেকে ড্রাইভার হাত নেড়ে বলল, “বাই বাই, ফেরু।”
ফুলঝাড়ু ভাবছিল ও কোথায় এসে পড়ছে। নদীর ধারে একটা বিশাল মাঠে রাজ্যের আবর্জনা আর জঞ্জাল পাহাড় হয়ে আছে। একটার পর একটা বড়ো লরি এসে মাঠে আবর্জনা ফেলছে। ফেলছে গাড়ির ফাটা টায়ার, সাইকেলের ভাঙা চাকা, ছেঁড়া লেপ-কম্বল, কাঠকুটো, একগাদা পচা খাবার আর রাশি রাশি প্ল্যাস্টিকের ব্যাগ। প্ল্যাস্টিকের ব্যাগগুলো হাওয়ায় চারদিকে উড়ছে। পচা খাবারের ওপর এক ঝাঁক নীল বোতল মাছি ভন ভন করছে। মাটিতে পোকামাকড় ঘুরে বেড়াচ্ছে। ফুলঝাড়ু দেখল ওর মতো আর কেউ জঞ্জালের সঙ্গে মাঠে এসে পড়ল না। ও একা একা জায়গাটা ঘুরে দেখতে লাগল। ওকে দেখে একপাল ধেড়ে ইঁদুর দৌড়ে পালিয়ে গেল। ফুলঝাড়ু আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখল, সেখানে দু-চারটে বড়ো বড়ো অচেনা পাখি। তাদের ধারালো ঠোঁট। ও শুধু কাক, শালিখ, পায়রা আর চড়ুই দেখেছে। এইসব পাখি আগে কখনও দেখেনি। ফুলঝাড়ু আরও এগিয়ে দেখতে পেল মাঠের মাঝে কিছু কিছু জায়গায় আবর্জনার পাহাড় নেই। সেখানে ঘাস আর বুনো গাছপালা গজিয়েছে। একটা ছাইরঙা খরগোস কাঠবিড়ালিকে তাড়া করছিল। হঠাৎ ফুলঝাড়ুকে দেখে ভয় পেয়ে পালিয়ে গেল।
ফুলঝাড়ু মাঠের আশেপাশে বাড়িঘর, দোকানবাজার, লোকজন কিছুই দেখতে পেল না। ফুলঝাড়ুর পনেরো নম্বর হা হা রোডের জন্যে মনটা হু হু করে উঠল। ঝাঁকড়াচুলো মেয়েটা কি ওকে খুঁজবে? ওর বাবা কি ফুলঝাড়ুর জন্যে বাগানে খাবার রাখবে? যদি রাখে, ছোটো ফেরু তিনটে খেয়ে বাঁচবে। এটা ভেবে ওর আনন্দ হল। খাবারের কথা মনে হতে ফুলঝাড়ুর খিদে পেয়ে গেল। ও তো শহরে লোকের ফেলে দেওয়া খাবার খেয়ে বড়ো হয়েছে। এই মাঠে শুধু ডাস্টবিনের পচাগলা খাবার। তারপর ফুলঝাড়ুর মনে হল, এখানে তো খরগোস আর কাঠবিড়ালি আছে। তাহলে ওর চিন্তা কী? ও টাটকা মাংস খাবে।
দুপুর, বিকেল, সন্ধের পর রাত্তির হল। অন্ধকার নামল। ফাঁকা মাঠে ফুলঝাড়ুর খুব একা লাগছিল আর ভয় করছিল। আগে কোনওদিন ও অন্ধকারকে ভয় করেনি। ওর কান্না পাচ্ছিল, কিন্তু কাঁদল না। ফুলঝাড়ু জানে শিয়ালরা খুব সাহসী হয়। ওরা বিড়ালকুকুরদের মতো মিউ মিউ, কিঁউ কিঁউ করে কেঁদে ভাসায় না। আস্তে আস্তে আকাশে চাঁদ, তারা ফুটে উঠল। জঞ্জালভরা মাঠটা রুপোলী আলোয় ভরে গেল। ফুলঝাড়ু হঠাৎ শুনতে পেল একটা চেনা ডাক। হুক্কা হুয়া, হুক্কা হুয়া। ও পালটা জবাব দিল, ‘হুক্কা হুয়া, হুক্কা হুয়া।’
তারপর সবাই মিলে উল্লাসে ডেকে উঠল, ‘হুক্কা হুয়া, হুক্কা হুয়া। হুক্কা হুয়া, হুক্কা হুয়া।’
ফুলঝাড়ু জীবনে কোনওদিন ভয়ে গলা ছেড়ে ডাকতে পারেনি। এতদিন ও মুখ বুজে ছিল। ফুলঝাড়ুর ভয় ভেঙে গেল। চাঁদের আলোয় ফুলঝাড়ু নতুন বন্ধুদের খুঁজতে চলল।