নক আউট

নক আউট

পুজো আসছে। বাগবাজার গঙ্গার ঘাটে চা-জলখাবারের দোকান ‘শ্রীমা কাফে’তেও ভিড় বাড়তে শুরু করেছে। অনাথের কাজও তাই বেড়েছে। একেই সকালে চান সারতে সময় একটু বেশিই লাগে ওর। সামান্য রোদ উঠলে সারা গায়ে তেল মেখে টানটান হয়ে পড়ে থাকে সিঁড়ির উপর। তারপর জলে নেমে বার দুয়েক গঙ্গা এপার ওপার। ত্রিবেণীর ওদিকে গঙ্গার ধারেই একসময় থাকত ওরা। মা বলতেন, শরীর ভালো রাখতে ওর চাইতে ভালো কিছু হয় না। তেলটা নিজেই মেখে নিত আগে। এখন রামনাথ করে দেয়। ঘাটে তেল মালিশের কাজ করে লোকটা। অত ভোরের দিকে খদ্দের থাকে না তেমন। ওকে একা তেল মাখতে দেখে নিজেই এগিয়ে এসেছিল একদিন। তখন মাঝেমধ্যে সামান্য কিছু দিলেই হত। ইদানীং কিছুই নেয় না। টাকাপয়সার কথা তুললেই জিব কাটে শুধু, “ও-বাত না বুলবেন, খোকাবাবু। আপনার লড়াই তো হামি দেখিয়েছি। দেখবেন, একদিন খুব নাম হোবে আপনার। কাগজে ছবি বাহির হোবে। হাওয়াই জাহাজ মে বিদেশ ভি যাবেন। সেদিন এই রামনাথের ঠেকে লাইন পড়িয়ে যাবে। রেট বাড়িয়ে দিব হামিও।”

কলকাতা শহরটাকে একেক সময় তাই ভগবান বলে মনে হয় অনাথের। নইলে এক রাত্তিরের ধুম জ্বরে যেদিন মা চোখ বুজল, তারপর এতদিনে কোথায় ভেসে যেত সে। কুমারটুলির মাটি কাটার এক নৌকায় এসে পড়েছিল এই বাগবাজারের ঘাটে। দুই রাত্তির ঘাটের চাতালে শুয়ে কাটাবার পর একদিন চোখে পড়ে গিয়েছিল শ্রীমা কাফের মালিক মহাদেবচাচার। ডেকে এনে কাজে লাগিয়ে দিয়েছিলেন দোকানে। প্রাণে বেঁচে গিয়েছিল ও। তার বছর পাঁচেকের মধ্যেই পরিচয় স্যার গদাই মিত্তিরের সঙ্গে। ততদিনে মহাদেবচাচার কাফেতে থিতু হয়েছে। সামান্য মাইনেও মেলে। দুপুরের দিকে কাজ তেমন না থাকলে ঘুরে বেড়ায় এদিক ওদিক। সেই সময়ই একদিন চোখে পড়ল কাছেই জয়হিন্দ বক্সিং ক্লাবটা। মাঝারি মানের অ্যাসবেস্টসের শেডের ভিতর এই দুপুরে ডাম্বেল, বারবেল নিয়ে ব্যায়াম করছে নানা বয়সের কয়েকজন। ওর মতো তের-চৌদ্দ বছরের ছেলেও রয়েছে। ওদিকে কড়িকাঠ থেকে ঝুলছে রবারের গোটা কয়েক ভারী ব্যাগ। হাতে ঢাউস গ্লাভস বেঁধে তারই একটায় ঢপ ঢপ শব্দে ক্রমাগত ঘুসি মেরে চলেছে একজন। পাশেই আরেক কাণ্ড। উপরে নিচে জোরালো স্প্রিং দিয়ে টানা ওই একই জাতের আরেকটা ব্যাগ। কাছে দাঁড়িয়ে ঘুসি মারছে একজন। ছিটকে গিয়ে ব্যাগটা পলকে ফিরে আসছে আবার। মুহূর্তে আবার ঘুসি। একদিকে দেয়ালে সাঁটা মস্ত এক আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নেচে নেচে ঘুসি প্র্যাকটিস করছে আরেকজন। সামান্য দূরে হালকা প্যান্ট-শার্ট পরা মাঝবয়সি একটি মানুষ তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে তার দিকে। হাত আর পায়ের কাজে সামান্য ভুল হলেই ধরিয়ে দিচ্ছেন বার বার। বেশ মজা লাগছিল ওর। তারপর থেকে সময় পেলেই চলে আসত ওখানে। তাকিয়ে থাকত হাঁ করে। ওই সময়ই একদিন তাকিয়ে আছে জানালা দিয়ে, হঠাৎ বাইরে বেরিয়ে এলেন সেই মানুষটি। তীক্ষ্ণ চোখে তাকালেন ওর দিকে। মানুষটিকে এই প্রথম সামনাসামনি দেখল অনাথ। পঞ্চাশের কাছে বয়স হলেও প্রায় বেতের মতো শরীর। ভোঁতা চাপা নাকে বিশ্রী একটা ক্ষতচিহ্ন। সারা মুখে অসংখ্য কাটাছড়ার দাগ। মানুষটাকে ওইভাবে তাকাতে দেখে ভয়ে গোড়ায় কুঁকড়ে গিয়েছিল অনাথ। কিন্তু রীতিমতো মোলায়েম গলায় মানুষটি হঠাৎ বললেন, “কী হে ছেলে, বক্সিং শিখবে?”

আদতে বিহারের মানুষ হলেও বাবার মৃত্যুর পরে মা ওকে কোলে নিয়ে সেই যে একদিন ত্রিবেণীতে এসে ঠাঁই নিয়েছিল, অনাথের সবকিছু সেখানেই। খেলার সঙ্গীসাথী সবাই ছিল বাঙালি। পড়তও এক বাংলা স্কুলে। বাংলাটা তাই ও বলতে পারে আর পাঁচটা বাঙালির মতোই। মানুষটির কথায় আকাশ থেকে পড়ে কোনওমতে বলেছিল, “আ-আমি কি পারব, সার?”

“পারবে।” এগিয়ে এসে ওর পিঠ চাপড়ে দিয়ে বলেছিলেন মানুষটা। “তোমার চোখদুটোই বলছে সেকথা। গদাই মিত্তিরের ভুল হয় না এ-ব্যপারে। শরীরটা রোগা একটু। তবে দিন কয়েক ব্যায়াম আর ঠিকমতো খাওয়াদাওয়া করলেই ঠিক হয়ে যাবে।”

ততক্ষণে ভয়টা কেটে গেছে ওর। হেসে ফেলে বলল, “সে হবার নয়, সার। চায়ের দোকানের বয়। ঠিকমতো খাওয়াদাওয়া পাব কোথায়?”

শুনে একটু থতমত খেয়ে গিয়েছিলেন মানুষটা। তারপর বলেছিলেন, “কোন চায়ের দোকান? নাম কী তোমার?”

একে একে এরপর ওর সবকথাই জেনে নিয়েছিলেন তিনি।

সেই বিকেলেই জয়হিন্দ বক্সিং ক্লাবের কোচ গদাই মিত্তির এসে হাজির হয়েছিলেন ওদের চায়ের দোকানে। মালিক মহাদেবচাচার সঙ্গে কথা বলেছিলেন অনেকক্ষণ। আর তার পরদিন থেকেই দুপুরে দোকানের ঝাঁপ পড়লে অনাথ হাজির হতে লাগল সেই বক্সিং ক্লাবে। মাইনে কমিয়ে মহাদেবচাচা ওর খাবারের বরাদ্দ বাড়িয়ে দিলেন কিছু। সকালে জলখাবারের সঙ্গে দুটো ডিমসিদ্ধ। বিকেলে প্র্যাকটিসের পর টিফিনের খরচাটা স্যার নিজেই দিতেন। শুরু হয়ে গেল তার আরেক জীবন। তা এসব সেই পাঁচ বছর আগের কথা। এর মধ্যে গঙ্গা দিয়ে গড়িয়ে গেছে অনেক জল। জয়হিন্দ বক্সিং ক্লাবে এখন সেরা বক্সার সে। গোটা কয়েক পদক, ট্রফি এখন তার সংগ্রহে। সেগুলোর কিছু শ্রীমা কাফের শেলফে আর কতক ক্লাবের শো-কেসে শোভা পায়। সামান্য লেখাপড়াও শুরু করেছে আবার। স্যারই বলেছেন, “যেকোনও ব্যাপারে উন্নতি করতে গেলে লেখাপড়াটাও জানা দরকার। ওটা ছাড়া হয় না কিছু।”

স্যারের কথায় সেদিন চোখ ফেটে জল এসে গিয়েছিল ওর। মা-ও ওই একই কথা বলত সবসময়। মাটি কাটার কাজ করত এক ইটখোলায়। সারাদিন হাড়ভাঙা খাটুনি। তবুও পড়াশুনায় ব্যাঘাত হবে বলে কোনওদিন ঘরের সামান্য কাজটুকুও করতে দেয়নি। অনাথের তখন মন লাগত না মোটেও। মা সারাদিন বাইরে। সুযোগটা ভালোই নিত। প্রায়ই স্কুল ফাঁকি দিয়ে সমবয়সী এক দঙ্গল ছেলেদের সঙ্গে দিনভর হইহই করে বেড়াত। মা জানতেও পারত না। স্যার উৎসাহ জোগাতে এবার আর তাই ফাঁকি দেয়নি। সময়ের অভাবে স্কুলে ভর্তি হওয়া সম্ভব হয়নি। বেশি রাতে ঘরে বসেই তাই চলেছে কাজটা। স্যারও সাহায্য করেন। আশা দিয়েছেন, কিছু উন্নতি হলেই পরীক্ষায় বসার ব্যবস্থা করে দেবেন। মহাদেবচাচাও দোকানের কাজ হালকা করে দিয়েছেন কিছু। সকালে অনেকটা সময় এখন শরীরচর্চার জন্য ছুটি মেলে অনাথের। মহাদেবচাচা নিজেই সামলে নেয় ওই সময়টা। তবে অনাথ ওর মধ্যেই যথাসাধ্য করে দিয়ে যায়। খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠেই দোকান ঝাড়পোঁছের কাজটা করে ফেলে। তারপর উনুনে আঁচ দিয়ে বের হয়ে পড়ে তেলের শিশি নিয়ে। ততক্ষণে কাঠের মস্ত পাটা নিয়ে তৈরি হয়ে গেছে রামনাথ। শিশিটা সামনে নামিয়ে দিয়ে পাটার উপর টানটান হয়ে শুয়ে পড়ে। পুজোর মুখে এই ভোরেও রামনাথের খদ্দের জুটে যায় কখনও। কিন্তু পরোয়া করে না ও। বসিয়ে রাখে তাদের। বড়ো অদ্ভুত এই মানুষটা। কিন্তু আজ মহালয়া। গঙ্গার ঘাটে এই দিনে ভিড় মাত্রা ছাড়িয়ে যায় বরাবর। অনাথ নিজেই তাই তাগাদা দিয়ে উঠে পড়ল খানিক আগেই। চানটাও সেরে নিল একটু তাড়াতাড়ি। দ্রুত দোকানে ফিরে দেখে ভিড় জমে উঠেছে ভালোই। ভিজে প্যান্টটা বাইরে মেলে দিয়ে লেগে পড়ল কাজে।

ভিড় কমতে কমতে দুপুর গড়িয়ে গেল আজ। সব গুছিয়ে ঝাঁপ বন্ধ করেই অনাথ ছুটল বক্সিং ক্লাবের দিকে। পোশাক পালটে তৈরি হচ্ছে, হঠাৎ বাইরে জুতোর মসমস শব্দ। তারপরেই চিৎকার, “তোর এত আস্পর্ধা গদাই! আমায় না জানিয়ে ন্যাশনালে নাম পাঠিয়েছিস?”

উপস্থিত সবাই প্রায় সিঁটিয়ে উঠেছে ততক্ষণে। লোকটা বাঘা বোস। কাছেই জুবিলি জিমনাসিয়ামের দাপুটে বক্সার। অনাথ শুনেছে, জুবিলি জিবনাসিয়ামের তাবৎ কর্মকর্তা নাকি ওর কথাতেই ওঠে-বসে। রাজ্য বক্সিং অ্যাসোসিয়েশনেও নাকি লোকটার হাত অনেক লম্বা। তাই শুধু জুবিলি কেন, ওদের বক্সিং ক্লাবেরও কেউই ঘাঁটায় না। দুর্বিনীত লোকটা সেই সুযোগটাই নেয় সবসময়। কারণে অকারণে অপমান করে স্যার গদাই মিত্তিরকে। সেই কবে লোকটা রিংয়ে এক লড়াইতে নক আউট করেছিল তাঁকে। চোয়াল ভেঙে ছ’মাস পড়ে থাকতে হয়েছিল। শেষ হয়ে গিয়েছিল বক্সিং জীবনও। সামান্য সুযোগ পেলেই সে কথা বলে খোঁটা দেয়। অনাথ বরাবর দেখে আসছে লোকটার সামনে কেমন যেন কুঁকড়ে যান স্যার। একটি কথাও বলেন না কখনও। ব্যাপারটা কোনওদিনই ভালো লাগেনি ওর। কিন্তু ব্যতিক্রম দেখল আজই। গদাই মিত্তির ততক্ষণে বেরিয়ে এসেছেন বাইরে। ধীর গলায় বললেন, “হ্যাঁ, পাঠিয়েছি নাম। ন্যাশনাল কম্পিটিশনে এবার লড়বে আমার ছেলেরা।”

“লড়বে তোর ছেলেরা!” ভেংচে উঠলেন বাঘা বোস। “কেউ জানল না। আমি জানলাম না। কত বড়ো বক্সার তৈরি করেছিস তুই?”

“সে তো রিংয়েই প্রমাণ হবে রে, বাঘা। দেখতেই পাবি তখন।” ঠাণ্ডা গলাতেই বললেন গদাই মিত্তির।

সেই উত্তরে যেন আরও খেপে গেল বাঘা বোস। “যত বড়ো মুখ নয় তত বড়ো কথা কইছিস, গদাই। বাংলার নাম ডোবাতে চাইছিস?”

“ওটা তো তোদেরই একচেটিয়া রে। বছর বছর তো তোদের জুবিলির ছেলেরাই যায়। আর তার ফল অজানা নেই কারও।”

কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে পড়ল যেন। প্রায় তেড়ে এল বাঘা বোস। হিংস্রভাবে ডানহাতের মুঠি গদাই মিত্তিরের নাকের সামনে নাড়তে নাড়তে বলল, “হঠাৎ দেখছি বড্ড বাড় বেড়েছে তোর, গদাই। সাপের পাঁচ পা দেখেছিস নাকি? সেবার চোয়াল ভেঙেছিলুম। এবার মুণ্ডুটাই গুঁড়িয়ে দিয়ে যাব।”

আর সহ্য হল না অনাথের। ন্যাশনাল চ্যাম্পিয়নশিপে ওদের ক্লাব নাম দিয়েছে এই প্রথম শুনল ও। কারা যাবে জানে না তাও। মাত্র এই কয়েক বছরে বাংলার খেলাধুলার জগতের হোমরাচোমরাদের নানা নোংরামির কথা জেনে ফেলেছে অনাথ। ভালোই জানে, ইচ্ছে করলেই বাঘা বোস ওই নামগুলো বাতিল করে দিতে পারে। কিন্তু স্যারের মুখের উপর ওইভাবে হাত নাড়ানো আর বরদাস্ত করতে পারল না। ছুটে এসে দাঁড়িয়ে পড়ল দু’জনের মাঝখানে। শান্ত গলায় বলল, “হাত নামান শীগগির। স্যারের সঙ্গে ওভাবে কথা বলবেন না।”

এমন অভিজ্ঞতা জয়হিন্দ বক্সিং ক্লাবে এই প্রথম বাঘা বোসের। গোড়ায় একটু থতমত খেয়ে গেলেও মুহূর্তে সামলে নিয়ে হুঙ্কার দিয়ে উঠল, “তুই কে রে ছোঁড়া? এত বড়ো সাহস! জানিস, এক ঘুসিতে তোর মাথা এক্ষুনি গুঁড়িয়ে দিতে পারি?”

“না, পারেন না।” হঠাৎ ফুঁসে উঠল অনাথ। ফস করে বলল, “তাহলে রিংয়েই হয়ে যাক পরীক্ষাটা। আপনাকে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছি আমি।”

আচমকা বাজ পড়লেও বুঝি এতটা অবাক হত না কেউ। বছর আঠারো বয়সের এক কিশোর, মাত্রই বছর পাঁচেক হল শুরু করেছে বক্সিং, চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে বাঘা বোসকে! লোকটা শুধু লাইট হেভি ওয়েটে প্রাক্তন বেঙ্গল চ্যাম্পিয়নই নয়, রিংয়ে রীতিমতো দাপিয়ে বেড়াচ্ছে এখনও। শুধু গদাই মিত্তিরই নয়, এ-পর্যন্ত কত জনের বক্সিং জীবন যে শেষ করে দিয়েছে, তার হিসেব নেই। রিংয়ে উঠে লোকটা নিয়মনীতির ধারও ধারে না সবসময়। আর অদ্ভুত ব্যাপার, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে রেফারি সেগুলো দেখেও দেখে না।

ব্যাপারটা হজম করতে যেটুকু সময়। তারপরই হাঁ হাঁ করে উঠল গদাই মিত্তির। “ছেড়ে দে, বাঘা। অনাথ ছেলেমানুষ। ঝোঁকের মাথায় বলে ফেলেছে। ধরিসনে ওসব।”

অনাথের হঠাৎ ওই কথায় খানিকটা থতমত খেয়ে গিয়েছিল বাঘা বোসও। খ্যাক খ্যাক করে হাসল এবার। “ছেড়ে দেব কী রে! ক্ষমতা থাকে তো ছাত্তরকে পাঠিয়ে দিস সপ্তমীর সন্ধেয় জুবিলির পুজো প্যাণ্ডেলে। ওই দিন বক্সিং কম্পিটিশনের প্রোগ্রাম রয়েছে। সবশেষে আমি লড়ব তোর ছাত্তরের সঙ্গে। দেখি এলেম কত। আজই পোস্টার ছাপাতে দিয়ে দিচ্ছি। মনে রাখিস, সামনের সপ্তমীর সন্ধে।”

কাউকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে গটমট করে চলে গেল বাঘা বোস।

কয়েক মুহূর্ত কারও মুখেই কথা নেই কোনও। সামলে উঠতে গদাই মিত্তিরেরই সময় লাগল সবচেয়ে বেশি। ধুপ করে বসে পড়লেন পাশে এক বেঞ্চে। “এ তুই কী করলি, অনাথ! বাঘা বোসকে চিনিস তুই? কত উঠতি বক্সারের বক্সিং লাইফ শেষ করে দিয়েছে ও? তোকে নিয়ে যে অনেক আশা ছিল রে আমার!” প্রায় হায় হায় করে উঠলেন তিনি।

অনাথ বাঘা বোসকে চেনে না, এমন নয়। খানিকটা ঝোঁকের মাথায় হয়ে গিয়েছে ব্যাপারটা। তবুও ধীরস্থির গলায় বলল, “ভাববেন না, স্যার। সব জেনেই চ্যালেঞ্জটা নিচ্ছি আমি।”

সপ্তমীর সন্ধে। ভিড়ে উপচে পড়ছে জুবিলির পুজো প্যাণ্ডেলে। জুবিলির বড়োসড়ো মাঠে এ-সময় ছোটো মেলাও বসে একটা। রকমারি স্টল, ভেলপুরি আর ফুচকাওয়ালাদের চারপাশে ভিড় জমে ওঠে। আজ কিন্তু মাঠে বড়ো ভিড়টা জমে উঠেছে বক্সিং রিংয়ের চারপাশ ঘিরে। মাঠ জুড়ে একাধিক বড়ো আকারের পোস্টার আর ব্যানারে লেখা – ‘আজকের বক্সিং প্রতিযোগিতার মূল আকর্ষণ, প্রাক্তন বেঙ্গল চ্যাম্পিয়ন জুবিলির বাঘা বোস লড়বেন তাঁর পুরনো প্রতিদ্বন্ধী জয়হিন্দ বক্সিং ক্লাবের কোচ গদাই মিত্তিরের ছাত্র চ্যালেঞ্জার অনাথ প্রসাদের সঙ্গে। নক আউট লড়াই।’

বাঘা বোসের কাজের ধরনটাই এইরকম। প্রচারের ব্যাপারটা বোঝে ভালোই। দিন কয়েক আগে থেকেই বড়ো বড়ো পোস্টারে ছেয়ে ফেলেছে সারা পাড়া। মাঝে নিজের বড়ো একটা ছবি। সুতরাং সাড়া পড়েছে ভালোই। ছবি না থাকলেও অখ্যাত অনাথের নামটাও ছড়িয়ে পড়েছে মুখে মুখে। সেই সাথে নানা রকমারি গুজব। সন্দেহ নেই, বাঘা বোসই কৌশলে ছড়িয়েছে সেগুলো। ডেঁপো ছেলেটা নাকি রীতিমতো অপমানজনক কথা বলে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছে বাঘা বোসকে। এ-লড়াই জুবিলির বাঘা বোসের কাছে তাই প্রেস্টিজ ইস্যু।

লোকটার মতলব সেই প্রথমদিনই বুঝতে বাকি থাকেনি গদাই মিত্তিরের। তবুও এতটা ভাবেননি। প্রথমদিন পোস্টারটা নজরে পড়তেই তাই ছুটেছিলেন বাঘা বোসের কাছে। কোনওরকম ভণিতা না করেই বলেছিলেন, “এটা কী হল, বাঘা! নক আউট লড়াই মানে?”

জুবিলির ক্লাবঘরের একপাশে ছোটো তক্তপোশে খালি গায়ে হাত-পা ছড়িয়ে টানটান হয়ে শুয়ে ছিল বাঘা বোস। দু’জন ম্যাসাজ করে দিচ্ছিল শরীর। চল্লিশ পার করে দিয়েও শরীরটা ভালোই তৈরি রেখেছে লোকটা। তবে বয়সের দরুন অতিরিক্ত চর্বির আভাসটা টের পাওয়া যায় কিছু। বিশেষ করে কোমরের চারপাশে। লড়াইয়ের আগে সেটাই ঝরিয়ে ফেলতে চাইছে। এই সময় বাঘা বোস কথা বলে না বড়ো একটা। তবুও গদাই মিত্তিরের কথায় খিক করে হেসে উঠল একটু। “কেন রে? বক্সিং-কোচ হয়েছিস আর নক আউট মানে জানিস না!”

হুলটা গায়ে না মেখে গদাই মিত্তির নরম গলায় বললেন, “সে কথা নয় রে, বাঘা। তিন রাউন্ডের অ্যামেচার লড়াই, এর মধ্যে কেউ যদি নক আউট হয় তো আলাদা কথা, কিন্তু পোস্টার ওভাবে কেন?”

“তোর কাছে আমায় বাংলা শিখতে হবে রে হতভাগা!” হঠাৎ প্রায় খেঁকিয়ে উঠল বাঘা বোস। “তিন রাউন্ডের লড়াই কে বললে?”

“তবে?” থতমত খেয়ে বলল গদাই মিত্তির।

“নক আউট লড়াই যখন, তখন চলবে সেই পর্যন্তই।” চিবিয়ে চিবিয়ে বেশ সময় নিয়ে বলল বাঘা বোস।

“বলছিস কী! তুই কি নিয়মকানুনটাও মানবি না?”

“মানব না কেন?” এই প্রথম গলাটা একটু মোলায়েম করল বাঘা বোস। “ভেবে দ্যাখ, পুজোয় দর্শকরা একটু আনন্দ করতেই তো আসবে। তাদের কথা ভেবেই করতে হল ব্যাপারটা। তবে ভাবিসনি। পাঁচ রাউন্ডের বেশি গড়াবে না বলতে পারি। আইনের ভিতরেই থাকবে সব। মনে রাখিস, চ্যালেঞ্জটা তোর ছাত্রের। আশা করি পিছিয়ে যাবে না এরপর। তোর তো আবার এসব স্বভাব আছে। তা তেমন ব্যাপার হলে আগেভাগে জানিয়ে দিস একটু। গজুদাকে দিয়ে নতুন পোস্টার ছাপাতে হবে আবার।” কথা শেষ করে খিক করে ফের হাসল বাঘা বোস।

ব্যাপারটা বেশ কয়েক বছর আগের। স্টেট চ্যাম্পিয়নশিপে সেবার লড়াই পড়েছিল বাঘা বোসের সঙ্গে। তার আগের রাতেই হঠাৎই ফুড পয়জনিং। পরের দিন রিংয়ে নামার মতো অবস্থা ছিল না আর। ব্যাপারটা নিয়ে আজও সুযোগ পেলেই খোঁটা দিতে ছাড়ে না বাঘা বোস। তবে সেদিনের ব্যাপারটায় পরে রহস্যের গন্ধ পেয়েছিলেন তিনি। আগের দিন সন্ধেয় প্র্যাকটিস শেষ করে ক্লাব থেকে বের হয়েছেন, পথে নামতেই দেখা গজেন বরাট ওরফে গজুদার সঙ্গে। জয়হিন্দের ট্রেজারার ছিলেন একসময়। হিসেবে নানা গোলমালের পর জরুরি সভা ডেকে শোকজ করা হয়েছিল বছর কয়েক আগে। সেই থেকে ক্লাবের সঙ্গে আর সম্পর্ক নেই। অনেকদিন পরে দেখা। লোকটাকে তেমন পছন্দ না করলেও সৌজন্যের খাতিরে বলতেই হল দু-চার কথা। গজুদা কিন্তু ছাড়লেন না। প্র্যাকটিসের পরে এই সময় কাছেই এক ঠেকে খেতে যেতেন। গজুদা বললেন, “অনেকদিন পরে তোর সঙ্গে দেখা। সহজে ছাড়ছি না। চল নতুন এক জায়গার খোঁজ দেব তোকে, দারুণ স্টু বানায় ওরা। আমিই খাওয়াব আজ।”

গজুদার পয়সায় খাওয়ার ইচ্ছে একটুও ছিল না। কিন্তু মুখের উপর না-ও করতে পারেননি। তা খাবারটা সেদিন ভালোই খাইয়েছিলেন গজুদা। রেস্তরাঁটা ছোটো হলেও খাতির করেছিল খুব। তারপর সেই রাতেই হয়েছিল বিপত্তিটা। মাঝরাত থেকেই হঠাৎ ভয়ানক দাস্তবমি। সেমিফাইনালে ওয়াক-ওভার পেয়ে লাইট হেভি ওয়েটে সেবারই প্রথম ফাইনালে উঠেছিল বাঘা বোস। তারপর ফাইনালে জিতে বেঙ্গল চ্যাম্পিয়ন। সন্দেহটা তখনও মনে দানা বাঁধেনি তাঁর। কিন্তু এর কিছুদিন বাদেই যখন গজেন বরাট জুবিলিতে যোগ দিলেন তখন আর ঝেড়ে ফেলতে পারেননি ব্যাপারটা। কিন্তু কাউকে জানাতেও প্রবৃত্তি হয়নি। তাতে লাভও হত না কিছু। তাই চেপেই গেছেন সব। আজ গজুদা ওরফে গজেন বরাট জুবিলির প্রেসিডেন্ট। দু’জনে মিলে ভালোই কবজা করেছে ক্লাবটাকে।

জলজ্যান্ত মিথ্যে কথাটা তাই বেমালুম হজম করেই সেদিন ফিরে এসেছিলেন গদাই মিত্তির। উত্তর দেননি কোনও। আসলে বাঘা বোসের উদ্দেশ্য সেই প্রথমদিনই টের পেতে বাকি থাকেনি তাঁর। আজকের পর আর সন্দেহ নেই কিছুমাত্র। ন্যাশনালে অনেকদিন পরে এবার নাম পাঠিয়েছিলেন অনাথের কথা ভেবেই। আগুন আছে ছেলেটার ভিতরে। ঠিকমতো গড়েপিটে নিতে পারলে অনেকদূর যাবে। প্রায় হারিয়ে যেতে বসা জয়হিন্দ বক্সিং ক্লাবটা ফের দাঁড়াতে পারবে আবার। গজেন বরাট আর বাঘা বোসের দল চায় না সেটাই। একবার ভেবেছিলেন, অনাথকে বাঁচাবার জন্য সেদিনের গজেন বরাটের মতোই কিছু একটা করবেন। সন্দেহ নেই, ব্যাপারটা নিয়ে ভালোই ঘোঁট পাকাবে ওরা। তবে তাতে যায় আসে না কিছু। অনাথকে অনেকদূর এগোতে হবে আরও।

কিন্তু শেষপর্যন্ত তেমন কিছু আর করা হয়ে ওঠেনি। আসলে গদাই মিত্তিররা সেই জাতের মানুষ, যাদের কাছে বিবেকের মর্যাদা সবার উপরে। অনাথকে না জানিয়ে কিছু করতে মন সায় দেয়নি তাঁর। আর তাতে ফল হয়েছে উলটো। মতলবটা জানাতেই ছেলেটা নির্বাক হয়ে তাকিয়ে ছিল শুধু। ছলছল করে উঠেছিল চোখদুটো। ছেলেটার সেই মুখের দিকে তাকিয়ে কিছু আর বলতে পারেননি গদাই মিত্তির। মতলবটা তাই ঝেড়ে ফেলে অনাথের প্র্যাকটিস বাড়িয়ে দিয়েছেন আরও। কয়েকটা দিন পাখিপড়া করে বুঝিয়েছেন প্রতিদ্বন্দ্বীর প্লাস পয়েন্টগুলো। দুর্বলতাই বা কোথায়।

তা সেই লড়াইটাই হতে চলেছে আজ। সপ্তমীর রাত যত বাড়ছে, জুবিলির পুজো প্যাণ্ডেলের ভিড়টা ক্রমশ সরে আসছে উলটোদিকে বক্সিং রিংয়ের চারপাশে। চেয়ার যা পাতা হয়েছিল দখল হয়ে গেছে অনেক আগেই। পিছনে তার দ্বিগুণ মানুষ দাঁড়িয়ে রয়েছে অধীর আগ্রহে। মাইকে থেকে থেকেই ঘোষণা হচ্ছে। বেশিরভাগটা জুড়েই বাঘা বোসের গুণগান।

অনুষ্ঠানের গোড়ায় জুবিলির জুনিয়র ছেলেদের কয়েকটা প্রদর্শনী লড়াইয়ের ব্যবস্থা ছিল। শুরুও হয়েছিল যথাসময়ে। কিন্তু ততক্ষণে অস্থির হয়ে উঠেছে অপেক্ষমাণ দর্শকের দল। জুনিয়র ছেলেদের সেই লড়াই খানিক গড়াতেই আওয়াজ শুরু হল চারধারে। আসল লড়াই দেখতে চায় সবাই। ব্যাপার বুঝে জুনিয়র ছেলেদের লড়াই শেষ করে দেওয়া হল অল্প সময়ের মধ্যেই। সামান্য কয়েক মিনিট বিরতির পর রিংয়ে ঢুকলেন নতুন এক রেফারি। তারপরেই ঘোষণা হতে দু’হাত তুলে বাঘা বোস রিংয়ে ঢুকতেই চাপা গুঞ্জন উঠল চারপাশে। এই বয়সেও বুক আর হাত-পায়ের পেশি তাকিয়ে দেখার মতো। ততক্ষণে গায়ের তোয়ালেটা ছুড়ে দিয়ে ছোটো ছোটো লাফে ওয়ার্ম আপ শুরু করে দিয়েছে বাঘা বোস। দামি স্পোর্টস প্যান্ট আর স্যান্ডো গেঞ্জি হাজার ওয়াটের আলোয় ঝলসে উঠছে। দেখতে দেখতে চাপা গুঞ্জন গর্জনে পরিণত হতে দেরি হল না। কিন্তু প্রতিদ্বন্দ্বী মানুষটি কোথায়? দর্শকের চোখ যখন রিংয়ের চারপাশে পাক খাচ্ছে তখনই দেখা গেল, গায়ে হালকা গেঞ্জি, পরনে হলুদ বর্ডার দেওয়া আঁটোসাঁটো প্যান্ট পরা সবে কৈশোর পেরোনো বছর আঠারো বয়সের এক ছোকরা দড়ির ফাঁক গলে ভিতরে ঢুকছে। বেতের মতো ছিপছিপে শরীর। নাকের নিচে গোঁফের রেখা তেমন ঘন হয়নি এখনও। টেনেটুনে ব্যান্টম ওয়েট গ্রুপে ফেলা যায়। শক্তপোক্ত চেহারার বাঘা বোস সেখানে হেসে খেলে ঢুকে পড়বে তিন ধাপ উপরে লাইট হেভি ওয়েট গ্রুপে।

দুই প্রতিদ্বন্দ্বীকে দেখে দর্শকদের মধ্যে তখন মিশ্র প্রতিক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে। পোস্টার দেখে যারা জবরদস্ত একটা লড়াই আশা করেছিল তাদের অনেকেই হতাশ। আবার বাঘা বোসের কট্টর সমর্থক যারা, তারা ভিতরের আনন্দ গোপন না করে চিৎকার জুড়ে দিয়েছে বিপুল উৎসাহে। “থ্রি চিয়ার্স ফর বাঘা বোস, হিপ-হিপ-হুররে।”

গদাই মিত্তির সকাল থেকে প্রচণ্ড টেনশনে রয়েছেন আজ। এমন ভয়ানক চাপের মুখে নিজের বক্সিং জীবনেও পড়েননি কখনও। কিন্তু চেপে রেখেছেন আপ্রাণ চেষ্টায়। অনাথের ইচ্ছে আর মনের জোর দেখে এই কয়দিন অনেক সময়ই তাঁর মনে হয়েছে হারবে না ছেলেটা। কিন্তু ভাবতে গিয়ে পরের মুহূর্তেই চমকে উঠেছেন, এও কি সম্ভব! আজ বিকেল থেকেই চোখে চোখে রেখেছেন।এক মুহূর্তের জন্যও কাছছাড়া করেননি। নিজে অনাথের হাতে ব্যান্ডেজ বেঁধে গ্লাভস পরিয়ে দিয়েছেন। মুখে মাউথপিস ঢুকিয়ে এগিয়ে দিয়েছেন রিংয়ে। স্যারের পিঠ চাপড়ানোর স্নেহের পরশ গায়ে মেখে অনাথ যখন রিংয়ে উঠে দাঁড়িয়েছে, বুঝতেও পারেনি রেফারির দিকে তাকিয়ে গদাই মিত্তিরের মুখ কালো হয়ে গেছে ততক্ষণে। লোকটা জুবিলির স্যাটা চৌধুরী। বাঘা বোসের অতি কাছের মানুষ। সুতরাং রেফারি কেমন হবে বুঝতে বাকি থাকেনি তাঁর। চোরাগোপ্তা বেআইনি মারে বাঘা বোস বরাবরই ওস্তাদ। স্যাটা চৌধুরী সেগুলো দেখেও দেখবে না। রিংয়ে অনাথের অবশ্য এসব জানার কথা নয়। মাসলগুলো আলগা করার জন্য হালকা পায়ে ও তখন লাফিয়ে চলেছে উৎসাহে। হঠাৎ দর্শকদের মাঝে একটা মানুষ দাঁড়িয়ে উঠল চেয়ার ছেড়ে। মাথায় প্যাঁচানো গামছাটা খুলে উৎসাহে ঘোরাতে ঘোরাতে চেঁচিয়ে উঠল, “জিতেগা জিতেগা, হামারা অনাথবাবু জিতেগা।”

মানুষটা আর কেউ নয়, গঙ্গার ঘাটের মালিশওয়ালা রামনাথ। প্রায় সাথে সাথেই দূরে দূরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বেশ কিছু মানুষও লাফিয়ে উঠে গলা মেলাল তার সঙ্গে। “জিতেগা জিতেগা। অনাথবাবু জিতেগা। জয় বজরংবলী।”

হঠাৎ সেই চিৎকারে বাঘা বোসের ভুরু কুঞ্চিত হল অনেকটাই। অনাথ ছেলেটার সমর্থনে জুবিলির মাঠে গলা ফাটাবে কেউ, ভাবতে পারেনি সে। কোনওদিন হয়নি এমন আসলে বাঘা বোসের জানার কথা নয়, লড়াইয়ের খবরটা কানে আসতে রামনাথ ঠিকই করে ফেলেছিল হাজির থাকবে আসরে। অনাথবাবুর সমর্থনে গলা ফাটাতে দু-চারজন সঙ্গীসাথীও জুটিয়ে নেবে। কিন্তু এই সপ্তমীর রাতে তেমন কাউকেই পায়নি সে। একাই হাজির হয়েছিল তাই। কিন্তু ইতিমধ্যে ব্যাপার হয়ে গেছে একটা। বড়বাজারে হুঁকোপট্টির জনাকয়েক জুয়াড়ি পুজোর বাজারে মওকা বুঝে টু-পাইস কামাতে লেগে পড়েছিল কাজে। প্রায় অচেনা বক্সার অনাথের দর উঠে গিয়েছিল পাঁচ টাকায় পঞ্চাশ টাকা। এদিকে রামনাথের দৌলতে তার পরিচিত মহলে বক্সিংয়ে অনাথের দক্ষতার কথা ছড়িয়েছিল ভালোই। তাই এই মওকায় পাঁচ টাকার টিকিট কেটে পঞ্চাশ টাকা পাবার লোভ সামলাতে পারেনি অনেকেই। তাদেরই একটা বড়ো অংশ লড়াই দেখতে শেষমুহূর্তে হাজির হয়েছে মাঠে। তবে রিংয়ে অনাথকে দেখে তেমন ভরসা করতে পারেনি কেউ। কিন্তু রামনাথ চিৎকার করে উঠতে আর চুপ করে থাকেনি কেউ। এরপর শুধু রামনাথরাই নয়, জয়হিন্দ বক্সিং ক্লাবের যারা হাজির ছিল মাঠে উৎসাহে চেঁচিয়ে উঠল তারাও। রিংয়ের পাশে গদাই মিত্তির এই প্রথম নড়েচড়ে বসলেন একটু।

কিন্তু যাকে নিয়ে এত হইচই তার তখন হুঁশ নেই কোনওদিকে। অসম্ভব ঠান্ডা মাথায় হালকা পায়ে রিংয়ের উপর লাফিয়ে চলেছে সমানে। মাথায় শুধু পাক খেয়ে চলেছে গত কয়েকদিন স্যারের কাছে শেখা টিপগুলো। বড়ো মুখ করে কথা দিয়েছে মানুষটাকে। অন্যথা করা চলবে না কিছুতেই।

ঢং করে ঘন্টা বাজল। রেফারি দু’জনকে ডাকলেন রিংয়ের মাঝখানে। রেফারির প্রথাগত দু-চার কথার পর গ্লাভসবদ্ধ হাতে হাত ঠেকাল দু’জন। এরপর ফাইট বলে রেফারি সরে যেতেই তড়িৎগতিতে বাঁহাতে প্রতিদ্বন্দ্বীর মুখের উপর দুটো চমৎকার জ্যাব করে নিজের কোণে ছিটকে গেল অনাথ। গ্লাভসজোড়া মুখের সামনে রেখে লঘু পায়ে প্রায় নাচের ভঙ্গিতে এগোতে পিছোতে লাগল।

রিংয়ের মাঝে দাঁড়িয়ে তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে অনাথকে লক্ষ করছিল বাঘা বোস। অপেক্ষা করছিল ফের কখন তেড়ে আসবে ছেলেটা। এই বয়সের ধর্মই এই। শুরুতেই ঝাঁপিয়ে পড়ে পেড়ে ফেলতে চায় প্রতিপক্ষকে। অভিজ্ঞ বক্সার কাজের কাজটি সেরে ফেলে তার মধ্যেই, অনেক কম শক্তি খরচ করে। কিন্তু কয়েক সেকেন্ড পার হয়ে গেল, ফের তেড়ে এল না ছেলেটা। ওদিকে দর্শকদের মধ্যে আওয়াজ উঠতে শুরু করেছে। ছোকরা প্রতিপক্ষের দু-দুটো দারুণ জ্যাবের পরেও চুপ করে আছে বাঘা বোস। টিপ্পনিগুলো সহ্য করা সহজ হল না তার। প্রায় বুনো শুয়োরের মতো লাফাতে লাফাতে এগিয়ে গিয়ে গোটা কয়েক জ্যাবের পরে আচমকা প্রতিপক্ষের চোয়াল লক্ষ্য করে সপাটে হুক করল একটা। কেতাবি মার। মাথা পুরো সরাবার সময় পেল না অনাথ। পিস্টনের মতো আঘাতটা দুই হাতের গ্লাভসে কোনওক্রমে ব্লক করতে পারলেও বেসামাল হয়ে রিংয়ে ছিটকে পড়ল। অবশ্য উঠে দাঁড়াল মুহূর্তেই। বাঘা বোসের সমর্থকদের গর্জন তুঙ্গে উঠে নেমে এল আবার। তবে কারও বুঝতেও বাকি রইল না, ছেলেটার গতি কী হতে চলেছে এরপর। উৎসাহে বাঘা বোস এরপর আক্রমণ শানিয়ে চলল একের পর এক। দারুণ ফুটওয়ার্ক আর ক্ষিপ্রগতির সাহায্যে অনাথ ঠেকা দিয়ে গেল সারাটা সময়। লড়াইটা প্রথম রাউন্ড থেকেই জমে গেল বেশ।

রাউন্ড শেষের ঘন্টা পড়তে অনাথ নিজের কর্নারে টুলে এসে বসতেই ছুটে এলেন গদাই মিত্তির। মুখে জল ছিটিয়ে তোয়ালে দিয়ে যত্ন করে হাতমুখ মুছিয়ে মুখের মাউথপিসটা খুলতেই অনাথ বলল, “মাফ করবেন, স্যার। শুরুতেই পিছিয়ে গেলাম অনেক পয়েন্ট। তবে মেকআপ করে নেব ঠিক। ভাববেন না।”

দু’হাতে তোয়ালে নেড়ে হাওয়া দিতে শুরু করেছিলেন গদাই মিত্তির। ছেলেটাকে এমন নিশ্চিন্তে কথা বলতে দেখে অনেকটাই যেন স্বস্তি পেলেন। বাঘা বোসের ওই ভয়ানক হুকেই বারো বছর আগে একদিন ঠিকমতো মাথা সরাতে না পারায় চোয়াল ভেঙেছিলেন। অনাথ বেসামাল হয়ে পড়লেও দারুণ ব্লক করেছে। তবুও আতঙ্কে নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে গিয়েছিল তাঁর। বাঘা বোসের কম্বিনেশন পাঞ্চটা বরাবরই দুর্দান্ত। ওই মুহূর্তে ওয়ান-টু-থ্রি চালাতেই পারত। সেই সময়ও পেয়েছিল। তাহলে তখনই নক আউট হয়ে যায় অনাথ। কিন্তু পেরে ওঠেনি। আসলে সেই ক্ষিপ্রতা, সেই শক্তি আর নেই মানুষটার। বারোটা বছর বাঘা বোসের অনেক কিছুই নিংড়ে নিয়ে গেছে। কিছুটা ভরসা পেয়েছেন তারপরেই। বিশেষ করে পরবর্তী সময় অনাথের লড়াইটা দেখে। নেচে নেচে ছেলেটা সামনে চক্কর কেটে গেছে বাঘা বোসের চারপাশে। কদাচিৎ ভিতরে ঢুকে এক-আধটা জ্যাব, নয়তো চমৎকার কম্বিনেশন পাঞ্চ চালিয়ে সরে গেছে মুহূর্তে। দর্শকরা টিটকিরি দিয়েছে। কিন্তু নিজের পথ থেকে সরেনি একটুও। ওদিকে বাঘা বোস সামনে হাত চালিয়ে গেছে শুধু। ঠিক এই জিনিসটিই চাইছিলেন তিনি। অনাথের পিঠ চাপড়ে তাই বললেন, “কীসের পয়েন্ট! নক আউট লড়াই যখন, ওসব নিয়ে ভাবিসনে একদম। আর গোটা দুই রাউন্ড শুধু চালিয়ে যা এভাবে। টায়ার্ড করে দে বাঘা বোসকে। মনে রাখিস, লড়াইটা কিন্তু দারুণ শুরু করেছিস। ঠিক এই জিনিসটাই চাইছিলাম আমি।”

দ্বিতীয় রাউন্ডে বাঘা বোস কিন্তু অনেকটাই সংযত করল নিজেকে। অযথা অনেকটা শক্তি শুরুতেই ক্ষয় করে ফেলেছে। অথচ পাঁকালমাছের মতো শুধুই পিছলে গেছে ছেলেটা। পাখির মতো হালকা পায়ে যেভাবে রিং জুড়ে নেচে বেড়াচ্ছে, তাতে আরও পাঁচ-সাত রাউন্ড চালিয়ে যেতে পারবে দিব্যি। গদাই ভালোই তৈরি করেছে ছেলেটাকে। এই প্রথম বাঘা বোসের প্রত্যয় হল, ঝোঁকের মাথায় এভাবে লড়াইয়ে নামা ঠিক হয়নি মোটেই। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব লড়াইটা এবার শেষ করা দরকার। সুতরাং সতর্ক হল ও। সুযোগ মিলেও গেল।

দ্বিতীয় রাউন্ডের অন্তিম পর্ব তখন। বিদ্যুৎগতিতে এগিয়ে এসে অনাথ পাঁজরে দুটো ওয়ান-টু কম্বিনেশন পাঞ্চ চালিয়ে পিছিয়ে যাবার মুখে বাঘা বোস ক্লিনচিং করল ওকে। ডানহাতে গলা, বাঁহাতে কোমর জড়িয়ে ধরল হঠাৎ। এ-অবস্থায় জোরালো ঘুসি মারা যায় না। তবুও বাঘা বোসের বুকে আর পেটে দ্রুত কয়েকটা ঘুসি মেরে ছাড়িয়ে নেবার চেষ্টা করল। পারল না। এমন বেশিক্ষণ হলে ব্রেক কল করে দু’জনকে ছাড়িয়ে দেওয়াই নিয়ম। কিন্তু রেফারিও দেখেও দেখল না। অগত্যা আরও গোটা কয়েক এলোপাথাড়ি ঘুসি চালাল অনাথ। এই প্রথম সামান্য অধৈর্য হয়ে উঠল। আর ঠিক সেই মুহূর্তেই বাঘা বোস ছেড়ে দিল ওকে। রিংয়ে অধৈর্য হয়ে ওঠা, সামান্য ভুলচুকও সর্বনাশ ডেকে আনতে পারে। এক্ষেত্রেও তাই হল। মুহূর্তের জন্য ও অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল একটু। চোখ সরে গিয়েছিল প্রতিদ্বন্দ্বীর উপর থেকে। সঙ্গে সঙ্গে বাঘা বোসের দুর্দান্ত একটা লেফট হুক আছড়ে এসে পড়ল চোয়ালের উপর। সঙ্গে ডানহাতে জোরালো একটা পাঞ্চ।

মুহূর্তে দু’চোখ অন্ধকার হয়ে এল অনাথের। কাটা কলাগাছের মতোই ছিটকে পড়ল রিংয়ের উপর।

আঘাতের তীব্রতায় মুহূর্তের জন্য জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিল। যখন ফিরে এল শুনল রেফারি চার পর্যন্ত গুনে ফেলেছে। ঝিমঝিম করছে মাথা। কানের ভিতর ঝিঁঝি পোকার ডাক। গালের পাশে নোনতা চটচটে ধারা। চেষ্টা করেও চোয়াল নাড়াতে পারল না একটুও। ‘লক জ’ হয়ে আটকে রয়েছে। গোড়ায় মনে হয়েছিল পারবে না আর। কিন্তু চারপাশে তুমুল হট্টগোলের মধ্যে ‘নক আউট, নক আউট’ রবটা কানে আসতেই শরীরে যেন জ্বালা ধরে গেল ওর। মাথাটা ঝাঁকিয়ে নিয়ে মুখের ভিতর জিবটা নাড়ল অল্প। না, ঠিকই আছে সব। রেফারি স্যাটা চৌধুরী দ্রুত গুনে চলেছে তখন। একটু বেশিরকম তাড়াতাড়ি। উদ্দেশ্য পরিষ্কার। দেরি করা যায় না আর। মাথাটা আরেকবার ঝাঁকিয়ে নিল অনাথ। যখন উঠে দাঁড়াল, রেফারি তখন নয়ে পৌঁছে গেছে।

ওই মারের পরে ছেলেটা যে শেষপর্যন্ত উঠে দাঁড়াতে পারবে ভাবতে পারেননি স্যাটা চৌধুরী। গোনা থামিয়ে এগিয়ে এসে জিজ্ঞাসা করল, ফের লড়তে চায় কি না।

আড়ষ্ট চোয়ালে সামান্য হলেও সাড় ফিরেছে তখন। ঘাড় তুলে অনাথ অতিকষ্টে উচ্চারণ করল, “ফাইট।”

ফের লড়াই শুরু করার নির্দেশ দিয়ে রেফারি সরে যেতে বাঘা বোস এগিয়ে এসে দুটো মামুলি জ্যাব করেই ডানহাতে আপার কাট চালাল একটা। চোখ এবার আর সরেনি অনাথের। শরীর বইছিল না তেমন। রক্তে চোখের অনেকটাই ঢেকে গেছে। ভালো দেখতেও পাচ্ছিল না। তবুও চমৎকারভাবেই মাথা সরিয়ে নিতে পারল। নিখুঁত ফুটওয়ার্কে পিছিয়ে গেল কয়েক পা। রাউন্ড শেষ হবার ঘন্টা পড়ল ওই সময়।

গতবছর বহরমপুরে এক টুর্নামেন্টে লড়তে গিয়েছিল অনাথ। সেমিফাইনালে প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল বাংলাদেশের এক দুর্দান্ত বক্সার। লাগাতার আক্রমণ চালিয়ে প্রথম রাউন্ডেই অনাথকে প্রায় পাট করে ফেলেছিল। এগিয়ে গিয়েছিল অনেক পয়েন্ট। অবস্থা দেখে ইন্টারভ্যালে ওকে বসে যেতেই পরামর্শ দিয়েছিলেন গদাই মিত্তির। উত্তরে সেই প্রথম স্যারের মুখের উপর ফুঁসে উঠেছিল ছেলেটা, “কী বলছেন, স্যার! আমার বাবা খাদানে পাথর ভাঙত। দিনভর মাটি কাটার কাজ করত মা। এই সামান্য আঘাতে কিছু হয় না আমার।”

“কিন্তু অপোনেন্ট যে অনেক পয়েন্টে এগিয়ে গেছে রে। জিততে হলে নক আউট করা ছাড়া পথ নেই। পারবি?” কিন্তু কিন্তু করে বলেছিলেন গদাই মিত্তির।

“সেই চেষ্টাই তো করছি, স্যার। সুযোগ ঠিক পেয়ে যাব দেখবেন।” দাঁতে দাঁত চেপে বলেছিল অনাথ।

তো সেই লড়াইতে থার্ড রাউন্ডেই বাজিমাত করে ফেলেছিল ও। পছন্দের মার ডানহাতের দুর্দান্ত এক সুইংয়ে। নিঁখুত সুইংটা নিমেষে আছড়ে পড়েছিল প্রতিদ্বন্দ্বীর সোলার প্লেক্সাসের উপর। উঠে দাঁড়াতে পারেনি আর। ছাত্রটিকে সেদিন বিলক্ষণ চিনেছিলেন গদাই মিত্তির। ইন্টারভ্যালে অনাথের ক্ষতস্থানের পরিচর্যা করতে করতে শুধু বললেন, “তোকে বলা হয়নি অনাথ, রেফারি স্যাটা চৌধুরী বাঘা বোসের কাছের মানুষ। পক্ষপাতিত্ব কিছু হবেই। অযথা মাথা গরম না করে নিজের লড়াইটা লড়ে যা।”

অ্যান্টিসেপটিকে ভেজানো তুলোয় ক্ষতস্থান জ্বালা করছিল বেশ। রক্ত বন্ধ করার জন্য লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে স্টিকিং প্লাস্টার। লড়াইয়ের মাঝে এই ব্যাপারগুলোই একদম সহ্য করতে পারে না অনাথ। কতবার আপত্তি জানিয়ে বলেছে, “ওসবের কোনও দরকার নেই, স্যার।” কিন্তু কান দেয়নি কেউ। কথা না বলে নীরবে ঘাড় নাড়াল শুধু। তৃতীয় রাউন্ড শুরু হবার ঘন্টা পড়ল ওই সময়। স্যার মুখে মাউথপিসটা লাগিয়ে দিতেই উঠে পড়ল।

ওই প্রচন্ড মার খেয়ে ছেলেটা উঠে দাঁড়াতে পারবে ভাবতে পারেনি বাঘা বোস। তবুও ভিতরে একটা আশা ছিল, বিরতির পরে লড়াই থেকে নিজেই সরে দাঁড়াবে। টেকনিক্যাল নক আউটে জিতে যাবে ও। কিন্তু তা যখন হল না, স্বাভাবিক ছন্দেই ছেলেটা ফের এগিয়ে এল রিংয়ের মাঝে, প্রমাদ গোনতেই হল বাঘা বোসকে। বহুদিনের অভিজ্ঞ মানুষটির বুঝতে বাকি রইল না এ জয় তারুণ্যের। বারো বছর আগে এই জোরেই সে হারিয়ে দিয়েছিল গদাই মিত্তিরকে। গদাই রিংয়ে ফিরে আসতে পারেনি আর। আজ তেমন কিছু হয়ে গেলে মুখ দেখাবার জায়গা থাকবে না। বড়ো মুখ করে চ্যালেঞ্জটা নিয়েছিল। তলিয়ে ভাবেনি। ফুটওয়ার্ক অসম্ভব ভালো ছেলেটার। পাঞ্চ করে অসম্ভব ফাস্ট। জ্যাবের সঙ্গে সঙ্গে দুর্দান্ত ওয়ান-টু কম্বিনেশন। শরীর থেকে ঘুসি ঝেড়ে ফেলার কায়দাটাও জানে। যা বয়স, আরও পাঁচ-ছয় রাউন্ড একই গতিতে চালিয়ে নিতে পারবে অনায়াসেই। কিন্তু তার পক্ষে এখন আর সম্ভব নয় একেবারেই।

পরের দুই রাউন্ডে তেমন কিছু আর না ঘটলেও ব্যাপারটা কোনদিকে গড়াচ্ছে বেশ বুঝতে পারছিল বাঘা বোস। বুঝতে পারছিলেন রিংয়ের বাইরে বসে গদাই মিত্তিরও। ফোর্থ রাউন্ডের শেষে ইন্টারভ্যালে ছাত্রকে সেই পরামর্শই দিলেন তিনি। “ক্লান্ত হয়ে আসছে তোর প্রতিদ্বিন্দ্বী। আগের গতি নেই। তোর ডানহাতের জমাট একটা সুইংয়েই শেষ করে দেওয়া যায় এখন। তৈরি থাক, সুযোগ এই রাউন্ডেই পেয়ে যাবি মনে হয়।”

রাউন্ড শুরু হতে লড়াইটা জমে গেল আবার। প্রথমদিকের দাপুটে বাঘা বোস তখন হারিয়ে গেছে অনেকটাই। খানিক আগে দর্শকদের একতরফা প্রতিক্রিয়া তখন স্পষ্টতই দুটো ভাগ হয়ে গেছে। অচেনা রোগা-পাতলা ছেলেটাও এবার পালটা মার দিতে শুরু করেছে। দেখে আরও অনেকেই গলা ফাটাতে শুরু করেছে তার হয়ে। ওদিকে রামনাথ আর তার দলবল তো শুরু থেকেই উৎসাহ দিয়ে চলেছে সমানে।

বক্সিংয়ের প্রথম পাঠ হল, প্রতিপক্ষকে একবার বাগে পেলে আর থিতু হতে দিও না। নতুন রাউন্ড অনাথ শুরুও করেছিল সেইভাবেই। বিদ্যুৎগতিতে প্রতিপক্ষের চোয়াল নয়তো পাঁজরে ঘন ঘন জ্যাব করে যাচ্ছিল। সঙ্গে ওয়ান-টু কম্বিনেশন। এত দ্রুত জায়গা বদলাচ্ছিল যে, বাঘা বোস কোনও হদিশই পাচ্ছিল না। শরীরের শক্তি তখন অনেকটাই হারিয়ে ফেলেছে মানুষটা। কোনওক্রমে ঠেকা দিয়ে চলেছে শুধু। খানিক আগের সেই উদ্ধত চোখের দৃষ্টি একেবারেই ম্রিয়মাণ।

চারদিকে বিপুল চিৎকারের মাঝে দারুণ উৎসাহে লড়াই শুরু করলেও কিছুক্ষণের মধ্যেই সেই বিধ্বস্ত মানুষটির দিকে তাকিয়ে হঠাৎ যেন সব কেমন গোলমাল হয়ে গেল অনাথের। সব উৎসাহ হারিয়ে ফেলল ক্রমশ। আজ থেকে বারো বছর আগে তরতাজা তরুণ বাঘা বোস এমনই এক দিনে স্যারের বক্সিং জীবন শেষ করে দিয়েছিল। পালটা দান আজ তার হাতে। চারপাশে উন্মত্ত দর্শকরাও তাই চাইছে। চোয়াল ভাঙার দরকার নেই। বেশ বুঝতে পারছে, আজ এই লড়াইতে হেরে গেলে স্যারের মতো শেষ হয়ে যাবে বাঘা বোসের বক্সিং জীবনও। মাথা তুলে আর কথা বলতে পারবে না কোনওদিন। সুযোগটা এসে গেল ওই সময়েই। হঠাৎ একটা হাফ চান্স পেয়ে ডানহাতে তড়িঘড়ি একটা সুইং চালাল বাঘা বোস।

বক্সিংয়ে ঠিকমতো একটা সুইং মারের জবাব নেই। কিন্তু অসুবিধেও আছে। মারতে সময় লাগে একটু। হাত অনেকটা পিছনে টানতে হয়। শরীরও বাঁকাতে হয় কিছু। সতর্ক প্রতিপক্ষ আত্মরক্ষার সময় পেয়ে যায় সহজেই। অথচ আক্রমণকারীর মুখের গার্ড সামান্য হলেও আলগা হয়ে যায় কিছু। অভিজ্ঞ বক্সার তাই তেমন সুযোগ না পেলে ঝুলি থেকে এ অস্ত্র বিশেষ বের করে না। আজ সেই ভুলটাই হঠাৎ করে ফেলল বাঘা বোস। আসলে লড়াইটা তখন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব শেষ করতে চাইছিল ও। সর্তক অনাথ ঘুসিটা এড়াল সহজেই। প্রতিপক্ষের মুখের সামনে গার্ড সরে গেছে দেখে মুহূর্তে বাঁহাতটা রামধনুর মতো ছিটকে গেল থুতনি লক্ষ্য করে। চমৎকার আপার কাটটা জমে গেল যথাস্থানে। সামলাতে না পেরে টলে গেল বাঘা বোসের বিরাট শরীরটা।

“মার, অনাথ।” পিছনে রিংয়ের বাইরে চাপা গলায় চেঁচিয়ে উঠলেন গদাই মিত্তির।

স্যার কী বলতে চাইছে বুঝতে ভুল হবার কথা নয়। টাল সামলাতে গিয়ে বাঘা বোসের মুখের বাঁদিকটা সম্পূর্ণ অরক্ষিত হয়ে গেছে। ওর সেরা অস্ত্র ডানহাতের একটা সুইংয়েই গুঁড়িয়ে দেওয়া যায় বাঘা বোসের চোয়াল। কিন্তু হাত তুলতে গিয়েও থেমে গেল ও। ততক্ষণে টাল সামলে বাঘা বোস দ্রুত একটা হুক চালিয়েছে ওকে লক্ষ্য করে। কানের পাশে এসে সেটা জমে যেতেই রিংয়ের উপর পড়ে গেল অনাথ।

রিংয়ের বাইরে প্রবল উত্তেজনায় দাঁড়িয়ে পড়েছিল গদাই মিত্তির। কপাল চাপড়ে বসে পড়ল আবার। এমন দারুণ লড়েও চমৎকার সুযোগটা কাজে লাগাতে পারল না অনাথ। হায় হায়! অনাথের হয়ে চারপাশের তুমুল গর্জনও মুহূর্তে থেমে গেছে তখন। এমনকি বাঘা বোসের কট্টর কিছু সমর্থকও বিশ্বাস করতে পারছে না ব্যাপারটা। ছেলেটা কী সত্যিই নক আউট হয়ে গেল, না আগের বারের মতোই দারুণভাবে উঠে দাঁড়াবে আবার। হাঁ করে তারা তাকিয়ে রইল শুধু। মুখে শব্দ নেই কারও। রেফারি স্যাটা চৌধুরী ততক্ষণে ছুটে এসে গুনতে শুরু করেছেন দ্রুত।

মারে জোর ছিল না এমন কিছু। সামলে নেওয়াই যেত। কিন্তু সেই ইচ্ছেটাই যেন হারিয়ে ফেলেছে অনাথ। কানের কাছে দ্রুত গুনে চলেছে রেফারি। সহজেই উঠে পড়া যায়। কিন্তু পড়ে রইল সেইভাবেই। ওর সারা মগজ জুড়ে তখন পাক খেয়ে চলেছে অন্য এক ব্যাপার। আজ ও নক আউট হয়ে গেলে রামনাথেরা নিরাশ হবে ঠিকই। নিরাশ হবেন স্যারও। বড়ো মুখ করে ও কথা দিয়েছিল মানুষটাকে। তবে তার বেশি কিছু নয়। রিংয়ে নামার ঢের ঢের সুযোগ আবার পাওয়া যাবে। কিন্তু আজ হেরে গেলে শেষ হয়ে যাবে বাঘা বোস মানুষটা। তাঁর সম্মান। যেভাবে এমনই এক দিনে শেষ হয়ে গেছেন স্যার গদাই মিত্তির। না, ঠিক হবে না সেটা। হাজার হোক, রিংয়ের উপর লড়াইটা ভালোই বোঝে মানুষটা।

অনাথ তাই পড়েই রইল সেইভাবে। স্যাটা চৌধুরী দশ গুনে শেষ করলেন একসময়। বাঘা বোসের সমর্থকরা উল্লাসে চিৎকার জুড়ল চারপাশে। অতি উৎসাহী কয়েকজন রিংয়ে ছুটে এসে জড়িয়ে ধরল তাকে। অদ্ভুত ব্যাপারটা ঘটল ওই সময়। কোনওমতে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে গ্লাভস খুলে দু’হাতে মুখ ঢেকে হঠাৎ হাউহাউ করে কেঁদে উঠল বাঘা বোস। ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরল অনাথকে। তুলে দাঁড় করিয়ে দিল তাকে। তারপর আছড়ে পড়ল গদাই মিত্তিরের পায়ের কাছে।

উপস্থিত কয়েক হাজার মানুষ অবাক হয়ে দেখল এক অদ্ভুত দৃশ্য। চিরকালের উদ্ধত মানুষ বাঘা বোস পাগলের মতো মাথা ঠুকছে গদাই মিত্তিরের পায়ে। “আমি হেরে গেছি রে, গদাই। হেরে গাছি তোর কাছে। তোর ছাত্রর কাছে। অনেক অন্যায় করেছি তোর উপর। অনেক অপমান। ক্ষমাভিক্ষা চাইছি আজ।”

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত