বউ হঠাৎ করে বললো, আপনার সাথে আর সংসার করতে ভাল লাগছেনা… ডিভোর্স দিবো…
আমি শুনে হাসলাম, জবাব দিলাম না…
বউ কয়দিন যাবৎ এই একই কথা বলতেসে… শেষে বিরক্ত হয়ে জিজ্ঞেস করলাম কেন?
বউ বলে, “আমার একটা এক্স বিদেশ থেকে চলে আসতেসে, তার সাথে পালিয়ে যাবো…
আমি বললাম আচ্ছা যাও…
– আমাকে কিছু টাকা দিতে পারবেন?
– কেন?
– পালিয়ে যেতে টাকা লাগবেনা? সেজন্য…
– আচ্ছা নিয়ো…
একদিন হুট করে বাসায় এসে দেখি বউ বাসায় নেই… নরমালি মন মেজাজ খারাপ হবার কথা… আমার কিছুই হচ্ছেনা…
সন্ধ্যা হয়ে গেছে, বউয়ের খোঁজখবর নেই… এবার ভয় লাগার কথা… তাও লাগছেনা… কারণ আমেরিকা বাংলাদেশের উপর পারমানবিক বোমা ফেললে সবাই মরে যাওয়ার পর যে একটা মানুষ বেঁচে থাকবে সেটা হল আমার বউ…
সে নিজেকে এতটাই সেইভ করতে জানে…
রাতে দশটার দিকে বউ ক্লান্ত হয়ে ব্যাগ ট্যাগ নিয়ে বাসায় ফিরেছে… আমি তাকিয়ে শুধু একবার দেখলাম, কিছু বললাম না…
বউ এসে আমার হাতে কিছু টাকা ধরিয়ে দিয়ে বললো, সবটা টাকা খরচ হয়নি, কি এক হারামীর সাথে পালাবো ভাবলাম, সারাদিন অপেক্ষা করিয়ে, শেষে রাতেও এলোনা…
অযথাই কিছু টাকা পয়সা নষ্ট করলাম…
আমি কিছুই বললাম না… বউ নিজের মত বলে নিজেই চলে গেল…
আমার এসবে তেমন কিছু যায় আসেনা, তারপরও অকারণে সারাটাদিন নষ্ট হল আমার… সারাদিন কোন কাজ করতে পারলাম না…
হুট করে খুব মন খারাপ হলো… অভিমানে পৃথিবী মাথার উপর ভেঙ্গে পড়ার অবস্থা…
পড়ার ঘরে টেবিলের উপর হাত ঘড়িটা খুলে রেখে, ঘুরতে থাকা চেয়ারটার উপর গাঁ এলিয়ে দিলাম…
জাগতিক কিছু ভাবতে ইচ্ছা করছিলো না… কারো সাথে কথা বলতেও ইচ্ছা করছিলোনা… শুধু ঝিম ধরে পড়ে থাকতে ভাল লাগছিলো…
আমি ফোন বন্ধ করে দিয়েছি, ভিতর থেকে দড়জায় খিল দিয়ে দিয়েছি… খাবারের জন্য বউ বাহির থেকে অনেকবার ডেকেছে, কিন্তু আমার খেতে ইচ্ছা করছেনা… তাই ভিতর থেকে কোন জবাব আমি দেইনি…
সারারাত ঝিম ধরে থেকে ভোরে একটা বই পড়তে শুরু করেছি… বইয়ের নাম হচ্ছে “সুখ” এটা মুলত একটা ইংরেজী বইয়ের বাংলা অনুবাদ…
ব্রাটাণ্ড রাসেলের বিখ্যাত বই “কনকুয়েস্ট অব হেপিনেস” কে মোতাহার হোসেন চৌধুরী “সুখ” নামে অনুবাদ করেছেন…
লেখক বইটাকে দুইটা অংশে ভাগ করেছেন একবার প্রমাণ করার চেষ্টা করছে আমরা আসলে মানবজীবনে অনেক সুখী, আবার প্রমাণ করার চেষ্টা করছে, আসলে সুখী না, আমাদের মানব জীবন শুধু দুঃখের… এখানে দুঃখ ছাড়া কিছুই নেই…
খুবই ইন্টারেস্টিং একটা বই… আমি সারাদিন ধরে এটাই পড়ে যাচ্ছি…
এরমধ্যে বউ কয়েকবার এসে ডেকেছে… আমি কোন জবাব দেইনি… বউ ব্যর্থ হয়ে ডাকা বন্ধ করে দিয়েছে…
সারারাত সারাদিন না খেয়ে একটা রুমে পড়ে থাকায় শরীরটা একটু দুর্বল হয়ে আসছিলো… চোখের পাতা ভারি হয়ে এলো… আমি বইটা বুকের উপর রেখে একটু চোখটা বন্ধ করলাম…
এরমধ্যে বউ নানান কাণ্ড ঘটিয়েছে… আত্মীয় স্বজন সবাইকে ফোন দিয়ে বলেছে আমি আত্মহত্যা করেছি…
আত্মীয় স্বজনরা বাসায় এসে কান্নাকাটির ধুম লাগিয়েছে… বাসার কাজের মেয়েটাও প্রচুর কান্না করছে… আমার বউ কান্নাকাটি তেমন করছেনা, সে ঘুরে ঘুরে সবার কান্না দেখছে…
একটুপর কাজের মেয়েকে এসে জোড়ে একটা ধমক দিলো, ধমক দিয়ে বললো, জামাই মরেছে আমার, তর এত দুঃখ কেন? তুই হাউমাউ করে কাঁদতেছিস কেন?
ধমক শুনেই কাজের মেয়ে চুপ, এবার সে কান্নাকাটি রেখে চুপ করে বসে আছে…
এরমধ্যে অতি উৎসাহী কিছু সাংবাদিক বাসায় ডুকার চেষ্টা করছে, বাহিরে ভীড় লেগে গেছে… কোর্ট শেষে আমার কলিগরাও প্রায় সবাই চলে এসেছে…
এলাকার মানুষ নানান কানাঘুষা শুরু করেছে… তারা ইতিমধ্যে অপরাধী খুঁজে বের করে তার শাস্তিও দাবি করছে… আমার আত্মহত্যার পিছনে তারা প্রধান আসামী বানিয়েছে আমার বউকে, তারপর যথারীতি কাজের মেয়ে এবং বউয়ের বন্ধুদেরকে…
আমার মৃত্যুর চেয়ে এখন তাদের কাছে এখন আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়েছে, স্বামী মরেছে কিন্তু বউ কেন কান্না করতেসে না?
বিষয়টা বউয়ের কান পর্যন্ত এসেছে, কিন্তু বউ এসবে পাত্তা দিচ্ছেনা… সে দুপুর থেকে সবকিছু ম্যানেজ করে চলেছে…
কেউ ভয়ে দড়জা ভাঙছেনা, সবাই পুলিশের জন্য অপেক্ষা করতেসে… এসব সেন্সিটিব ব্যাপারে পুলিশ ছাড়া কারো হাত দেয়াও উচিৎ না…
পুলিশ এখনো আসতে পারছেনা কারণ রাস্তায় প্রচুর জ্যাম… আর আমি খুব বেশি বিশেষ ব্যক্তি নই যে পুলিশ হেলিকপ্টারে চড়ে চলে আসবে…
পুলিশ আসলো আরো আধা ঘণ্টা পর… পুলিশ এসে ভীড় কমাতে সাংবাদিকদের বাসার ভিতর ডুকতে দিলো…
পুলিশের ওসি সাহেবের মধ্যে আমার মৃত্যু নিয়ে তেমন ভাবোধয় হতে কিছু দেখলাম না… উনি বাসার দাড়োয়ান কে ধমক দিয়ে বললো চায়ের ব্যবস্থা করতে…
দাড়োয়ান চা নিয়ে আসেনি, সে কোন ঝামেলায় জড়াতে চায়না তাই এখন পর্যন্ত সে পলাতক…
পুলিশ এসে একবার পড়ার ঘরের দড়জায় উকি দিয়ে গেছে কিন্তু দড়জা ভাঙ্গার ব্যাপারে কোন আদেশ নির্দেশ দেয়নি…
সোফার রুমে পুলিশ এবং সাংবাদিকদের বসার ব্যবস্থা করা হয়েছে…
পুলিশ সাংবাদিকদের ইন্টার্ভিউ দিয়ে যাচ্ছেন, অনেকটা প্রেস ব্রিফিং টাইপও বলা যায়…
পুলিশ আমার মৃত্যুর জন্য অনেকদিনের পারিবারিক কলহ, ব্যাংক ভর্তি অবৈধ টাকার ব্যাপারে দুদকের চাপ, বিবাহিত অবস্থায় পুরোনো প্রেমিকার বিরহে মানুষিক যন্ত্রণা এসব তথ্য সাংবাদিকদের দিয়ে যাচ্ছেন…
এরপর সাংবাদিকরা বউকে নানান কোশ্চেন করছেন, বউ খুব সিরিয়াস হয়ে সাংবাদিকদের খোঁচা মারা টাইপ প্রশ্নের কঠিন জবাব দিচ্ছে…
সাংবাদিক: এই যে আপনার স্বামী কোটি কোটি অবৈধ টাকা ব্যাংকে এবং বিভিন্ন জায়গায় লুকিয়ে রেখেছে, এসব কি আপনি জানতেন?
বউ: জানতাম না মানে? অবশ্যই জানতাম… সেই টাকা দিয়েই তো মঙ্গল গ্রহে ডুপ্লেক্স বাড়ি বানানোর প্ল্যান করছি…
সাংবাদিক২: আপনার স্বামীর পুরোনো প্রেমিকার জন্য মনে যে এত হতাশা এসব কি আপনি বুঝতেন? অথবা এসব নিয়ে আপনাদের মধ্যে রোজ ঝগড়াঝাঁটি হতো?
বউ: আমার স্বামীর তো পুরোনো প্রেমিকা একটা না, একাধিক… কার জন্য ঝগড়া করবো সেটাই বুঝতে পারতাম না… সেজন্য প্রায় প্রতিদিনই দুজন মারামারি করতাম, এক একদিন এক প্রেমিকা নিয়ে মারামারি করতাম…
সাংবাদিক৩: আপনি কি বুঝতে পারছেন, উকিল সাহেবের এই মৃত্যুর জন্য পুলিশের আঙুল প্রথমে আপনার দিকেই উঠবে?
বউ: অবশ্যই বুঝতে পারছি.. স্বামী মারা যাওয়ার সময় বাসায় একমাত্র আমিই ছিলাম, এবং আমার এর সাথে যুক্ত থাকার একটা বিশাল সম্ভাবনাও রয়েছে… কিন্তু স্বামীকে মেরে ভিতর থেকে দড়জা লক করে আমি কিভাবে বাহিরে এলাম সেটা আমার মাথাতেই আসছেনা… তবে পুলিশ অবশ্যই এই রহস্যটা উদঘাটন করবে… স্বামীকে মেরে তো কোন না কোনভাবে আমি বের হয়েছিই…
সাংবাদিকরা বউকে প্রশ্ন করে তেমন মজা পাচ্ছেনা… কিন্তু মনে হল বউ সাংবাদিকদের উত্তর দিয়ে মজা পাচ্ছিলো, অনেকটা সেলিব্রেটি টকশো টাইপ…
পুলিশ দুই ঘন্টা রেস্ট নিয়ে পড়ার ঘরের দড়জা ভাঙার চেষ্টা করছে… দড়জায় ধুরুম ধুরুম শব্দ হচ্ছে… দড়জার শব্দ শুনে আমার ঘুম ভেঙ্গে গেল…
বাহিরে এসে এমন হুলুস্থুলু কান্ড আমি কিছুটা ভয় পেয়ে গেলাম…
কেউ কেউ ভয়ে ভুত বলে দৌড়েও পালালো…
পুলিশ প্রচণ্ড বিরক্তি নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে, আর সাংবাদিকরা আমার ঘুম ভাঙা চেহারার ছবি তুলছে…
এদিকে বউ এগিয়ে এসে আমাকে দিলো ঝাড়ি, মরার মত ঘুমাচ্ছেন যেহেতু, আরেকটু ঘুমাতে পারলেন না? মজাই তো হচ্ছিলো…
সাংবাদিকরা ছবি তোলা রেখে আমার বউয়ের দিকে তাকিয়ে আছে, আর আমিও অবাক হয়ে বউয়ের কাণ্ড দেখে যাচ্ছি…