ভোরের রঙ কালো

ভোরের রঙ কালো

এই ব্যাস্ত শহরে আজ প্রথম পা রাখা আমার।ভোরের ঝাপসা আলোতে বেশ ভাল করে একবার দেখে নিলাম শহরটাকে। এখানের নদির পানি তারের উপর বসা কাক কল কারখানার ধোয়া সব কিছুই কেমন কুৎসিত শুনেছি এ শহরের মানুষের বেলায়ও ঠিক তাই।বাবা আমার হাত ধরে সামনের দিকে এগিয়ে গেলেন।প্লাটফর্ম থেকে হাটছিলাম এই শিতের মধ্যেও কিছু কিছু মানুষের শরীরটুকু ঢাকার জন্য এক টুকরো কাপড় নেই খুব ইচ্ছে করছিল ব্যাগ থেকে বের করে মায়ের দেয়া কাথাটা দিয়ে দেই।কিন্তু ক’জন কে দেব।আমার মা খুব যত্ন করে কাথাটা আমাকে শেলাই করে দিয়েছে।এক ধরনের সৃতি হিসেবে।উচ্চমাধ্যমিকে খুব ভালো রেজাল্ট করায় বাবা আমাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করেছেন যদিও এখানে সবথেকে বেশি অবদান আমার কাকার সেই বাবাকে বলেছেন আমাকে যেন ঢাকাতে ভাল কলেজে ভর্তি করায়।টাকা-পয়সা নিয়েও চিন্তা করতে মানা করেছেন।আমরা এখন তাদের বাসায়ই যাব।বাবা একটা রিক্সা পেলেন আমরা উঠলাম রিক্সা চলতে লাগলো।এই শহরের কথা বইতে কত পড়েছি আজ বাস্তবে দেখার সৌভাগ্য হলো তবে আমার কাছে দুর্ভাগ্য মনে হচ্ছে।আমি মাকে ছাড়া বেশিদিন কোথাও থাকিনি আর এখানে পড়তে হলে আমাকে মাসের পর মাস থাকতে হবে।হঠাৎ একটা গাড়ি এসে আমাদের রিক্সাটিকে ধাক্কা দিল।আমি রীতিমতো ভয় পেয়ে গেলাম কিন্তু তারপর আবার রিক্সা চলতে লাগলো।বাবা বুঝতে পেরেছেন আমি ভয় পেয়েছি তাই আমাকে বললেন,ঢাকা শহরে চলাচল করার জন্য যানবাহন অনেক বেশি তো তাই এরকম ধাক্কা লাগে এতে ভয়ের কিছু নেই।আমি বুঝতে পারলাম রাস্তার গাড়ির সংখ্যা দেখে।আমার বাবা খুব গম্ভির মানুষ কিন্তু এই গম্ভিরতার মধ্যেও আমার জন্য সুপ্ত একটা ভালবাসা আছে আমি তা বুঝতে পারি মাধ্যমিকে যখন আমি জিপিএ ফাইভ পেয়েছিলাম বাবা পুরো গ্রাম মিষ্টি বিলিয়েছিলেন।

বাবা ঢাকাতেই একটা ছোট্ট কোম্পানিতে চাকরি করেন তবুও বাবা আমার পড়ালেখার খরচা নিজেই চালান কখনো কারো কাছে হাত পাতেন নি।আমরা কাকার বাসার সামনে পৌছে গেলাম।রিক্সা থেকে নেমে সিড়ি বেয়ে উপরে উঠতে ছিলাম তাদের বাসা চারতলায় পুরো বাড়িটা সাত তলা তাদের নিজেদেরই বাসা।কাকাকে কয়েকবার দেখলেও কাকিকে আর চাচাতো ভাই বোনদের কখনোই দেখিনি।তার দুই মেয়ে এক ছেলে।ছেলে বাহিরে থেকে পড়াশোনা করে।আর দুই মেয়ে এই বাসায়ই থাকে।বড় মেয়েটা আমার সাথেই পড়ে,সেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই ভর্তি হয়েছে এইজন্যই বাবা ভরসা পাচ্ছেন।ওর সাথে একসাথে যেতে পারব।তারা কখনোই গ্রামের বাড়িতে যান নি।বাবা যদিও সবাইকে দেখেছেন সে মাঝেই মাঝেই এই বাড়িতে আসেন।বাবা কলিং বেল বাজাতেই একটা মেয়ে দরজা খুলে দিলো।আমি তাকে সালাম দিলাম মেয়েটি সালামের জবাব দিতেই মধ্যবয়স্ক একজন মহিলা বলে উঠলো ও তো এ বাড়ির কাজের লোক।মেয়েটি চলে গেল।আমি কিছুক্ষন মহিলার দিকে তাকিয়ে রইলাম বাবা আমাকে বললেন ইনি তোমার কাকি।কিছুটা অনিচ্ছায় তাকে সালাম দিলাম। তিনি উত্তর না দিয়ে বসতে বললেন।কাজের মেয়েটিকে দু গ্লাস পানি দিয়ে যেতে বললেন।বাবা কাকিকে বললেন আমার হাতে একদমই সময় নেই আটটায় ডিউটিতে যেতে হবে।কাজের মেয়েটি পানি দিয়ে গেলো।বাবা পানি খেয়েই উঠে বসলেন।কাকি কে বললেন।”আজ উঠি ভাবি আমার মেয়েটাকে একটু দেখে রাখবেন। কাকি বললেন আপনার মেয়ে তো আমাদেরই মেয়ে তাইনা”
বাবা চলে যেতে যেয়েও থেমে গেলেন পিছনে ফিরে বললেন।
-ভাবি!ভাই কি এখনো ঘুম থেকে ওঠেনি?
-সে খুব সকালে উঠেই অফিসে গেছেন।আপনাদের জন্য দেরী করবে ভেবেছিল কিন্তু একটা ফোন পেয়ে চলে গেছে।
তারপর বাবা আমাকে বললেন।জয়া আমি চললাম,ছুটি পেলে আবার আসবো তুই ঠিকমতো পড়াশুনা করিস আর সবার সাথে মিলেমিশে থাকিস।এই বলেই বাবা চলে গেলেন।আমার বুকটা তখন কেমন যেন হাহাকার করে উঠলো।একটা অজানা পরিবেশে যেমনটা লাগার কথা তেমনই লাগছিলো।

কাকি কাজের মেয়েটাকে বললেন আমার রুম দেখিয়ে দিতে।মেয়েটি আমাকে নিয়ে যেতে লাগলো তখন আমার বাড়িটার দিক নজর পড়লো খুব সাজানো গোছানো সুন্দর প্রত্যেকটা রুম।এরপর আমাকে যে রুমটা দেয়া হয়েছে সেখানে নিয়ে যাওয়া হলো।এই রুমটাও বেশ সুন্দর।মেয়েটি আমাকে দিয়েই চলে গেলো।রুমের সাথে একটা বারান্দাও আছে।কিন্তু এসব কিছুর মধ্যেও কেমন যেন সবকিছু শুন্য শুন্য লাগছে এই বিশাল গ্লাস বসানো ড্রেসিংটেবিলের আয়নার থেকে যেন গ্রামের সেই ছোট্ট হাত আয়নাটা বেশি সুন্দর।সেগুন কাঠের এই ডিজাইনার খাটটার থেকে যেন গ্রামের আমার আর ছুটকির সেই ছোট্ট চৌকিটা বেশি আরামদায়ক।ব্যাগ থেকে কাপড় বের করে ঘুছাতে লাগলাম।ব্যাগের মধ্য থেকে বেরিয়ে আসলো ছুটকির দেয়া কাপড়ের পুতুলবউ ছুটকি নিজের হাতে বানিয়ে দিয়েছে আমাকে আর বলেছে যেদিন আমার বিয়ে হবে সেদিন এই পুতুলবউয়ের সাথে একটা বরপুতুল বানিয়ে দেবে আমার বিয়ে খাওয়ার ছুটকির খুব সখ।আসার সময় আমাকে বলে দিয়েছে আমি যেন শহর থেকে জামাই নিয়ে আসি।ইশ ছুটকিটার কথা খুব মনে পড়ছে।জামা কাপড় গুছানো হলে সেই নরম বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম সারারার ঘুমাতে পারিনি। বিছানায় কম্বল থাকলেও মায়ের দেয়া কাথাটাই গায়ে দিলাম।তখনি কাজের মেয়েটি নাস্তা নিয়ে এলো।দিয়েই যেন দৌড়ে পালিয়ে যেতে লাগলো আমি ডাক দিতেই থেমে গেলো। আমি আসতে বললাম।মেয়েটি আমার সামনে দাঁড়িয়ে রইলো।দেখে মনে হচ্ছে বয়স তের চৌদ্দ হবে।আমি জিজ্ঞাস করলাম তোমার নাম কি?
-সুখি
-বাহ খুব সুন্দর নাম তুমি জানো!যার যে নাম থাকে সে সেই নামের অধিকারী হয়।
-কিন্তু আফা আমার জিবনে তো কোনো সুখ নাই।
-কেন সুখ গেছে কোথায় হুম?শোনো নিজেকে কখনো অসুখী মনে করতে হয়না।তুমি তোমার অজান্তেই সুখি।
-হুম(মাথা নিচু করে)আফা আপনার নাম কি?
-জয়া
-আপনি কি জয়ী?
-হা হা,আমার বাবা বলে আমার নামের সাথে আমার কাজেরও মিল আছে।থাকো কোথায় তুমি?
-এই বাড়িতেই থাকি
-আর তোমার মা বাবা ভাই বোন তারা?
-বাপের কথা কইতে পারিনা আর আমি একাই, আমার কোনো ভাই বোন নেই।আর আমার মা কমলাপুর রেলস্টেশনে ভুট্টা বিক্রি করে।
-তোমার মা তোমাকে দেখতে আসেনা?
-না তয় আমি মায়রে প্রতি মাসে একবার দেখতে যাই যা বেতন পাই তা দিয়া আহি।কিন্তু মায়ে সব রাখেনা আমারেও কিছ দেয় তা দিয়া।
–তাহলে তুমি তোমার মায়ের কাছে থাকোনা কেন?
-আমি মায়ের কাছেই থাকতাম দুইজনেই ভূট্টা বেচতাম,বস্তিতে থাকতে মেলা টাকা লাগে তাইলে আমরা দুইবেলা খাইতে পারতাম না তাই আমরা স্টেশনেই থাকতাম তারপর একদিন এই ঘরের খালু আমারে দেইখা মায়ের কাছ দিয়া এই জায়গায় নিয়া আহে।খালু চাইছিলো আমারে স্কুলে ভর্তি করতে কিন্তু খালায় কইছে আমি পড়ালেখা করলে বাড়ির কাজ কে করবে!এইজন্য আমি এই বাসায় কাম করি।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম
-তোমার মায়ের কাছে থাকতে ইচ্ছা করেনা?
-করে কিন্তু মায় আমারে তার কাছে রাখতে চায়না জানেন আফা এই নরম ফোমের বিছানার থেকে স্টেশনের ফ্লোরে মায়ের পাশে ঘুমাইতে অনেক শান্তি লাগে।
মেয়েটির প্রতিটি কথা একেবারে বুকে যেয়ে লাগলো।মেয়েটিকে বললাম।
-তুমি তোমার মাকে তাহলে এখানে এনে তোমার কাছে রেখে দেও।
-খালুও কইছিলেন কিন্তু খালায় কইছে এত মানুষরে ভাত খাওয়াইতে পারবে না।আচ্ছা আফা আমি অহন যাই খালায় মেহমানেগো লগে কতা কইতে মানা করছে।
-আমি মেহমান না আমিও তোমার মতন করেই এ বাড়িতে থাকতে এসেছি।
মেয়েটার সাথে আরো গল্প করতে লাগলাম ঘুম কোথায় যেন চলে গেলো।এভাবে কিছুক্ষন পর ও ফারহা ও ফারিনকে নাস্তা দেয়ার জন্য চলে গেলো।

অনেকদিন কেটে গেলো।আমি আর ফারিন একসাথেই কলেজে যাই। কিন্তু কেন যেন মনে হয় ফারিন আমাকে সহ্য করতে পারেনা।ও সবসময় ড্রাইভারের পাশের সিটে বসে,আর আমি পিছনের সিটে।ও এ যুগের বিভিন্ন স্টাইলের জামা কাপড় পরে আর আমি কত ক্ষেত জামা কাপড় পড়ি তাই আমার সাথে হাটতেও চায়না।কাকিও যেন কেমন ব্যাবহার করে।ফারহা মাঝে মাঝে আমার কাছে এসে বসলে কাকি পড়ার কথা বলে নিয়ে যায়।কিন্তু কাকা একদম আমাকে বাবার মত স্নেহ করে।আমার সারাটাদিন যায় লেখাপড়ায় আর বারন্দায় বসে সুখির এক কাপ চায়ে।মেয়েটা বেশ ভালোই চা বানায়।কাজের ফাকে একটু সুযোগ পেলেই আমার সাথে এসে আড্ডা দেয়।বাবা কয়েকমাস পর পর আসে।কিন্তু মা আর ছুটকিকে দেখিনা প্রায় এক বছর।ফারিনের ফোন থেকে মাঝে মাঝে কথা বলি কিন্তু তাতে মনে হয় ফারিন কিছুটা বিরক্ত হয় বাবাকে টাকার জন্য একটা ফোন কিনে দেবার জন্য বলতেও পারিনা।যদি কয়েকটা টিউশনি করাতে পারতাম তাহলে হয়ত পড়ালেখার খরচাও কিছুটা চালাতে পারতাম।কিন্তু এই শহরের মানুষ সবাই প্রাইভেট কোচিং এর পিছনে ছোটে।

ফার্স্ট সেমিস্টার পরিক্ষা শেষ হয়েছে রেজাল্ট দিতে এখনো অনেক দেরী আছে।আমি ভেবেছিলাম বাবার সাথে বাড়ি যাব।কতদিন মাকে আর ছুটকিকে দেখিনি। কিন্তু কাকি বলেছে যতদিন রেজাল্ট না দেয় ততদিন যেন আমি ফারহাকে পড়াই ওর সামনে পরিক্ষা।এইজন্য আর যাওয়া হলো না।শত হলেও আমি এ বাড়িতে থাকি খাই,এটুকু তো তাদের জন্য করতেই হবে।কিছুদিন পর রেজাল্ট দিলো যা ভেবেছিলাম তার থেকেও অনেক ভাল রেজাল্ট করেছি বাবা কাকা সবাই অনেক খুশি হয়েছে।কিন্তু ফারিনের রেজাল্ট খুব খারাপ হয়েছে ওর দুই সাবজেক্টে ফেল এসেছে।আর এর জন্য কাকি ওকে অনেক কথাও শুনিয়েছে যা আমি পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে শুনেছিলাম।আমার মত গ্রামের একটা লো ক্লাস মেয়ের থেকে ও কিভাবে খারাপ রেজাল্ট করলো।

মাকে আমার রেজাল্টের খবরটা জানাব কিন্তু ফারিন আমার সাথে কথা বলেনা যার জন্য ওর ফোন থেকে মাকে কল দিয়ে জানাতে পারিনি।পরেরদিন শুনলাম ফারিনকে দেখতে আসবে।এতে ফারিনেরও মত আছে ছেলে নাকি অনেক বড়লোক কাকার অফিসের বসের ছেলে।ফারিন নাকি ছেলেটাকে পছন্দ করে।বিকেলে ছেলেপক্ষ আসলো।আমি ফারিনের রুমে ফারিনকে সাজাতে গেলাম।কিন্তু দেখি ফারিন নিজেই শাড়ি পড়ে বসে আছে।আমি ওকে যেয়ে বললাম “বাহ তোমাকে খুব সুন্দর লাগছে ছেলে তো তোমার উপর থেকে চোখই সরাতে পারবেনা।দেখলাম ফারিন হাসি দিয়ে আমাকে থ্যাংক্স দিয়েছে।যাক বাবা ওর রাগ তো ভেঙেছে।সকাল থেকেই ওকে খুব ফুরফুরে দেখাচ্ছে।সুখি এসে বললো ফারিন আপুকে ছেলেপক্ষের সামনে নিয়ে যেতে।ফারিন আমাকে বললো জয়া তুমিও আমার সাথে চলো আমার লজ্জা করছে।তারপর আমি ওকে নিয়ে মেহমানদের সামনে সোফায় বসালাম।আমি পাশে দাঁড়িয়ে রইলাম।তারপর তারা কিছুক্ষন দেখে কথাবার্তা বলে চলে গেলেন।রাতে ফারিন আমাকে বললো।
-জয়া তুমি একটু যেয়ে বাবাকে জিজ্ঞেস করোনা ছেলেদের বাড়ি থেকে কোনো খবর দিয়েছে কিনা?
-হ্যা আমারো খুব জানতে ইচ্ছে করছে তুমি দাড়াও আমি এক্ষুনি জেনে আসছি।
আমি কাকি কাকার রুমে ঢুকতে যাবো তখন শুনলাম কাকি কাকাকে বলছে-
ওই অপয়া মেয়ের জন্য আজ আমার মেয়ের বিয়ে ভেঙে গেলো,ওই মেয়েকে ওদের সামনে কে যেতে বলেছিল,তুমি ওকে আজই এ বাড়ি থেকে বের করে দেবে।ওরা আমাকে ফোন দিয়ে বলেছে মেয়েকে নয় মেয়ের চাচাতো বোনকে পছন্দ হয়েছে ওদের,আমি বলে দিয়েছি যে ও মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে।

কাকির এসব কথা শুনে সত্যি নিজেকে খুব অপয়া মনে হচ্ছে এখন আমি ফারিনকে যেয়ে কি বলবো।আমার মাথায় কোনো কাজ করছিলো না।আমি ফারিনের রুমে যেতেই ফারিন আমাকে ধরে বললে।
-কি হয়েছে কিছু জানতে পারলে?
-না কাকা আর কাকি কথা বলছে তাই আর রুমে ঢুকিনি
-উহ তোমাকে দিয়ে কোনো কাজই হয়না আমিই যাচ্ছি এই বলে ফারিন চলে গেলো আমি খাটের উপর বসে পড়লাম।আমি যেন কিছু ভাবতেই পারছিলাম না।কিছুক্ষন পর ফারিন এসেই আমাকে বললো।
-বেরিয়ে যাও এখান থেকে তুমি আমার চোখের সামনে আর কখনো আসবেনা।
-দেখ ফারিন তুমি আমার থেকে কত সুন্দরী।তাছাড়া আমি কত গরিব ঘরের লো ক্লাস মেয়ে আমার মনে হয় তোমাদের কোনো শত্রু সম্বন্ধটা ভেঙে দিয়েছে আর তারা কারণ হিসেবে আমাকে দেখিয়েছে।
এরমধ্যে কাকি এসে বললো হ্যা তাই হবে কারণ তোমাকে দেখে পছন্দ হবার কথাইনা তুমি যাও আমি কথা বলছি আমার মেয়ের সাথে।

আমি চলে এলাম।রাতে ঘুমাতেও পারলামনা।পরেরদিন সকালে ফারিন আমার রুমে আসলো।ওর হাতে কি যেন একটা বক্সের মত।ও এসেই আমার পাশে বসলো আমি কিছু বলার আগেই ও বললো।

-আসলে ছেলেটাকে অনেক আগ থেকেই ভালবাসতাম মনে মনে সবসময় চাইতাম যেন আমার সাথে ওর বিয়ে হয় এইজন্য কালকে সবকিছু ওভাবে ভেঙে যাওয়ায় বেশিই রেগে গেছিলাম যার জন্য তোমার সাথে ওরকম বাজে ব্যাবহার করেছি সরি।
-আরেহ সরি তো বলা উচিৎ আমার তুমি কেন বলবে।

তারপর ও আমার হাতে ওর হাতের বক্সটা দিয়ে বললো এর মধ্যে একটা ফোন আছে।তুমি তোমার মায়ের সাথে কথা বলার জন্য বারবার আমার কাছে যাও আমি ব্যাস্ত থাকায় হয়ত তোমাকে দিতে পারিনা।আর তাছাড়া তুমি সারাদিন একা একা বাসায় থাকো তাই তোমার টাইম পাস করার জন্য কিনেছি।

তারপর ও আমাকে ফেসবুক,ইন্সটাগ্রাম,হোয়াটসঅ্যাপ আরো কি কি যেন খুলে দিলো।আমার বিভিন্ন স্টাইলে ছবি তুলে তা আপলোড দিয়ে দেয় মাঝে মাঝে।এভাবে কয়েকদিন যায়।একদিন ফারিন আর আমি ঘুরতে যাচ্ছিলাম কিন্তু কোথায় যাচ্ছি তা জানিনা।তাই ফারিনকে জিজ্ঞেস করলাম -আমরা কোথায় যাচ্ছি?
-সারপ্রাইজ,শোনো বাবাকে বলেছি কলেজে সবাই কত স্টাইলিশ জামা কাপড় পড়ে আর জয়া কেমন ক্ষেত জামা কাপড় পড়ে তাই জয়া বলেছে আমার মত জামা কিনবে,তা বলে বাবার কাছ থেকে টাকা নিয়েছি তোমাকে সপিং করে দেব বলে।
-কিন্তু ফারিন কাকা আমাকে কয়দিন আগেও জামা কিনে দিয়েছে আর আমার ওসব পড়ার কোনো ইচ্ছাই নেই।
-আরেহ এখন যুগটাই আপডেট এখন ওসবই পড়ে আমাকে দেখে শেখো।
-যাই বলো আমি ওসব পড়তে পারব না।

-দেখ জয়া বাবাকে বলে আমি টাকাটা নিয়েছি তুমি যদি না পড়ো বাবা আমাকে বকাবকি করবে তুমি কি তা চাও?
ও এমন মায়াবী ভাব নিয়ে বললো আমি না মেনে পারলামনা। মার্কেটে গিয়ে অনেক ধরনের টপজিন্স,সর্টস এসব কিনে দিলো।এরপর শুরু হলো আধুনিকতা। যেই কলেজের কেউ আমাকে চিনত না এখন সবাই আমাকে একনামে চেনে।ফারিনের সাথে ক্লাব,রেস্টুরেন্ট থেকে রাত করে বাড়ি ফেরা,ফেসবুকে যেমন ইচ্ছা তেমন ছবি আপ্লোড দেয়া,রাতভর মেসেঞ্জারে চ্যাটিং,তারপর রকি!রকি হচ্ছে কলেজের সবার ক্রাশ সেই রকি কিনা আমার ক্রাশ হ্যা ওর সাথে হোয়াটসঅ্যাপে ভিডিও কলে কথা বলা চ্যাটিং আরো কত কি।এভাবে চলে গেলো একটা বছর। সেকেন্ড সেমিস্টারের রেজাল্ট খুব খারাপ আসলো।

কিন্ত এ নিয়ে আমার কোনে মাথা ব্যাথা নেই।কিন্তু বাবার কথায় বুঝতে পারলাম বাবা খুব কস্ট পেয়েছে।কিন্তু তাও ভুলে গেলাম।বাবা কালকে বাড়ি যাবে আমাকেও নিয়ে যাবে মা অসুস্থ আমাকে তার দেখতে ইচ্ছে করছে।কিন্তু কালকেই কলেজ থেকে কক্সবাজার এর ট্যুর আছে।তাই বাবাকে বললাম কলেজ থেকে ট্রেনিংয়ে কক্সবাজার নিয়ে যাবে এখন যেতে পারবো না।বাবা রাজি হয়ে গেলেন।আমার একটুও খারাপ লাগছিলো না।আমার তো প্যাকিংয়ে মন ছিলো।সকালে ফারিনের সাথে রওয়ানা হলাম।তারপর কলেজে এসে কলেজ বাসে করে কক্সবাজার।আমার সিটটা রকির পাশেই পড়েছে।তাই জার্নিটা খুব ভালোই লাগছে।পৌছে গেলাম হোটেলে।আমি আর ফারিন এক রুমে ছিলাম।ফারিন একটু কাজে বাইরে গেছিলো আমি একা একা রুমে বসে ছিলাম দরজা খোলাই ছিলো এমনসময় রকি এসে বললো। আমার রুমের বাথরুমে সাবান নেই তোমাদের বাথরুম থেকে আমি কি সাবানটা নিতে পারি?আমি বললাম হ্যা শিউর। তারপর ও বাথরুম থেকে সাবান নিয়ে গেলো।ও সাবান দিয়ে যাওয়ার পর আমি গোসল করে নিলাম।তারপর সবাই মিলে সি-বিচে গেলাম।তিন দিন ঘোরাঘুরির পরে বাসায় ফিরলাম।বাসায় এসে জানতে পারলাম আমি সময় পাইনা দেখে মা নিজেই বাবার সাথে কাল ঢাকা আসবেন।ভালোই হবে কতদিন মা কে দেখিনা এই দুই বছরে ছুটকিও নিশ্চয়ই অনেক বড় হয়ে গেছে যাক বাবাহ কতদিন পর দেখতে পারবো।রাতে শুয়ে শুয়ে ফেসবুকিং করছিলাম।হঠাৎ রকির মেসেজ মনে মনে খুব খুশিই হলাম দেখে,মেসেজে একটা ভিডিও।ভিডিওটা দেখে আমার খুশি নিমিষেই শেষ হয়ে গেলো।সেদিন সাবান নেয়ার বাহানায় ও আমার সাওয়ার নেয়ার ভিডিও করেছে।আবার একটা মেসেজ দিলো।

“যদি এই ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় না দেখতে চাও,তাহলে কাল রাত আটটায় পাচ লক্ষ টাকা নিয়ে মুনলাইট হোটেলে চলে আসবে”

মেসেজটা দেখে সারা শরীর ঘামতে শুরু করলো। কি করব কিচ্ছু বুঝতে পারছিনা।চারদিক যেন অন্ধকার হয়ে আসছে।আমি কিছুই ভাবতে পারছিলাম না কাউকে কিছু বলতেও পারছিলাম না।আমার দম বন্ধ হয়ে আসছিলো।এতগুলো টাকা আমি কোথায় পাবো।বাবাকে ফোন করে কলেজের কথা বলে পাচলক্ষ টাকা চাইলাম।বাবা আমাকে চিন্তা না করতে বললো সকালের মধ্যে ম্যানেজ করে দেবে যেভাবে পারে। সারারাত ঘুমাতে পারিনি।পরেরদিন সকালে বাবা বাসায় আসলেন আমার হাতে পাচলক্ষ টাকা দিয়ে বললেন।মারে এটা আমার সারা জিবনের সঞ্চয় শেষ সম্বল এটা আজ আমি তোর হাতে দিলাম তুই পড়াশোনা করে যেদিন অনেক বড় হবি সেদিন এই পাচ লক্ষ দশ লক্ষ টাকা তোর হাতের ময়লা হয়ে যাবে তুই বুঝবিনা কিভাবে এই পাচ লক্ষ টাকা আমি জমিয়েছি।আমি বাবার মুখের দিকে সব কথা শুনছিলাম কোনো কথা বলতে পারছিলাম না।কিছুক্ষন পর বাবা চলে গেলেন।আমি ঠিক রাত আটটায় হোটেল মুনলাইট পৌছালাম।রকি আমাকে দেখেই বিশ্রি একটা হাসি দিলো।আমি ওকে বললাম আগে ভিডিও ডিলিট দেবো তারপর যা হবার হবে।ও আমাকে ওর ফোন থেকে ভিডিও বের করে দিলো আমি ডিলিট করে দিলাম।আমি দৌড়ে পালাতে যাবো তার আগেই ও রুমের দরজা আটকে দিলো।টাকাটা ছো মেরে নিয়ে নিলো। আমি ওকে অনেক ভাবে অনুনয়-বিনয় করে আমাকে ছেড়ে দিতে বললাম।কিন্তু না এসব করে কোনো লাভ হয়নি।ও ঝাপিয়ে পড়লো আমার উপর। আমাকে আমার সবকিছু হারাতে হয়েছিল।রাত এগারোটা বাজে আমি পাগলের মতো রাস্তা দিয়ে হাটছিলাম।নিজের উপর খুব ঘৃণা হচ্ছিলো।নিজের শরীরের উপর নিজের চরিত্রের উপর সবকিছুর উপর ঘৃণা হচ্ছিলো।আমার পা যেন চলছিলো না।একটা গাড়ি ডাকবো তাও মুখ থেকে কথা বের হচ্ছিলো না।রাত বারোটায় বাসায় পৌছালাম।কলিং বেল বাজাতেই সুখি দরজা খুলে দিলো।সবাই সামনের রুমে বসা ছিলো দেখে মনে হচ্ছে যেন আমার জন্যই অপেক্ষা করছে।কাকি জিজ্ঞেস করলেন।কোথায় গিয়েছিলাম আমি!কিন্তু আমার মুখ থেকে কিছু বের হচ্ছিলো না কাকাও জিজ্ঞেস করলেন তাও কিছু বলতে পারলামনা।আমি নিচের দিক তাকিয়ে রুমে চলে আসলাম।তখন কাকিকে বলতে শুনলাম কাকাকে বলছে।

“দেখ কোথায় গিয়ে নষ্টামি করে আসছে গ্রামের মেয়েদের উপর আমার একদম ভরসা নেই”
আসলেই তো কাকি ঠিক কথা বলেছে নষ্টামি করে এসেছি।এই নষ্ট শরীর নিয়ে থাকতে খুব বিশ্রি লাগছিলো আমি গোসল করে নিলাম।রাত বাজে তখন একটা আমার চোখে ঘুম নেই।তখন একটা নোটিফিকেশন এলো।রকি আমাকে ট্যাগ করে একটা ভিডিও আপ দিয়েছে।ভিডিওটা দেখে আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো।এটা তো আজকের রুমডেটের ভিডিও।তার নিচে ফারিন কমেন্ট করেছে।”রকি তোমাকে যা করতে বলেছিলাম তুমি তো তার থেকে একধাপ বেশি করে ফেলেছো হাহা”
বুঝতে বাকি নেই এসবের পিছনে ফারিনেরও হাত আছে।আমি কি করব বুঝতে পারছিলাম নাহ।এসব যদি বাবা মা কাকি কাকা দেখে আমি তাদের কি জবাব দেবো এই নষ্ট মুখ কিভাবে দেখাবো।

তখন আমার মাথায় আসলো আত্নহত্যা।আমি আর কিছু না ভেবে ছাদে চলে গেলাম।আমার লাগানো গোলাপ গাছটা অযত্নে মরে রয়েছে।তখনি বুঝতে পারলাম এত কিছুর মাঝখানে আমার অবস্থানটা ছিলো কোথায়।নিজের নামটার উপর খুব ঘৃণা হচ্ছে।বাবা সবসময় বলে তার মেয়ের সাথে নামের একদম মিল।কিন্তু বাবার কথা আজ ভুল প্রমান করলাম আমি।ভোর হয়ে আসছে।আর কিছুক্ষন পর মাও চলে আসবে কিন্তু এসে কাকে দেখবে।আমি আর কিছু ভাবতে পারছিনা। এই শহরের পশুগুলোকে দেখতে একদম মানুষের মত।মুখুশের আড়ালে লুকিয়ে রাখে তাদের আসল চরিত্র।আমি আর কিছু না ভেবেই ছাদ থেকে লাফ দিলাম।হাওয়ায় ভাসছিলাম তারপর আমার শরীরটা মাটিতে পড়ার সাথে সাথেই একটা গাড়ির চাকা আমার মুখের উপর দিয়ে পিষে গেলো।এ মুখ যেন আর কেউ না দেখে।এ শহরের মানুষের কাছে আমি নির্জয়া।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত