রিয়ার ঈদ

রিয়ার ঈদ

‘এবার আমি বাবার বাড়ি ঈদ করবো৷ বিয়ের পর একবারও বাবার বাড়ি ঈদ করি নাই৷’
‘তুমি পাগল হলে নাকি? আমি সবাইকে বলে দিয়েছি আমরা ঈদ করতে বাড়ি আসছি৷ তাছাড়া জামাই’রা কি শশুরবাড়িতে ঈদ করে? মানুষ কি বলবে? আব্বা-আম্মা কিন্তু রাগ করবে৷’
‘তোমার আব্বা-আম্মা আছে, আমার আব্বা আম্মা নাই? তাদেরও কিন্তু ইচ্ছা করে আমাকে নিয়ে ঈদ করতে৷’
‘দেখো, মেয়েরা বিয়ের পর শশুরবাড়িতে ঈদ করে৷ এটাই নিয়ম৷’
‘এই নিয়ম কোথায় লেখা আছে?’
‘জানি না৷ তোমার সাথে তর্ক করতে পারবো না৷’

রিয়া তার স্বামী মুমিনুলের সাথে ঈদ নিয়ে তর্ক করছে৷ স্বামীর কথায় তার মন খারাপ হয়৷ মন খারাপ হওয়ারই কথা। সে বাবার বাড়িতে একবারের জন্য ঈদ করতে চেয়েছে৷ তাও মুমিনুল জানিয়ে দিলো, সম্ভব না৷ সে ভাবে, ‘তাহলে মেয়েদের বিয়ে হয় পরাধীনতার জন্য, অদৃশ্য শিকলে হাত-পা বন্দী হওয়ার জন্য৷ যার কোন নিজস্বতা থাকবে না৷ সব কিছুতেই অন্যের অধীনস্থ হয়ে থাকতে হবে৷ স্বামী কথা মেনে চলতে হবে, না’হয় সংসারে অশান্তি৷ রিয়া চায় না সামান্য বিষয় নিয়ে সংসারের সুখ নষ্ট করতে৷
তার বিয়ে হয়েছে প্রায় আট বছর হলো৷ দুটি মেয়ে বাচ্চাও আছে৷ বড় মেয়ের নাম প্রিয়া, তার বয়স পাঁচ বছর৷ ছোট মেয়ের নাম হিয়া, তার বয়স দেড় বছর৷ দুই মেয়েকে নিয়ে সংসারের কাজ করতে করতে সে খুব ক্লান্ত হয়ে পড়েছে৷ তার উপর এই বছর বড় মেয়েকে স্কুলে ভর্তি করা হয়েছে৷ স্কুলে আনা-নেওয়ার কাজও তাকে-ই করতে হয়৷ একটুও রিলাক্স করার উপায় নেই৷ তাই কয়েকদিনের জন্য বাবার বাড়িতে গিয়ে মনটাকে একটু চাঙা করতে চায়৷ কিন্তু মুমিনুল রাজি হচ্ছে না৷ সে একটি বেসরকারি ব্যাংকে চাকরি করে৷ সকালে অফিসে যায় রাত দশটায় বাসায় আসে৷ মানুষ হিসেবে তার যথেষ্ট সুনাম আছে৷

পরেরদিন মুমিনুল অফিস থেকে এসে রিয়াকে বলল, ‘অনেক কষ্টে বাড়ি যাওয়ার তিনটা টিকেট পেয়েছি৷ ঈদে বাড়ি যাওয়া নিশ্চিত হলো৷’

কথাটি বলে মুমিনুল যতটা আনন্দ পেয়েছে, রিয়া ততটা নয়৷ রিয়া বুঝে গেল, তার আর বাবার বাড়ি ঈদ করা হচ্ছে না৷ কেন যে পুরানো বান্ধবীদের সাথে ঈদ করার ইচ্ছা হয়েছিলো? এখন নিজের উপর প্রচন্ড রাগ হচ্ছে৷ সে ভুলে-ই গেছে সে একজন নারী, তার কোন ইচ্ছা থাকতে নেই, সে একজন পরাধীন৷ তার মাঝে মাঝে ইচ্ছা হয় পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙে ছুটে যেতে। কিন্তু তার সেই শক্তি ও সামর্থ্য নেই। ইদানিং সে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছে৷

রিয়ার বড় মেয়ে প্রিয়া গত ঈদে দাদু বাড়ির পুকুরে গোসল করতে গিয়ে পানিতে ডুবতে বসেছিল। তার এক চাচা দেখেছিল বলে রক্ষা পেয়েছিল।

প্রিয়াকে উদ্দেশ্য করে মুমিনুল বলল, ‘গত ঈদে পুকুরে গোসল করতে গেছো, মনে আছে তোমার? তোমাকে এবার দাদু বাড়ি নেয়া হবে না৷’
‘বাবা, আমি আর পুকুরে যাবো না৷ আমি দাদু বাড়ি যাবো৷’
‘ঠিক আছে৷ কথা দাও, পুকুরে আর যাবে না৷’
‘প্রমিজ, বাবা৷ আর যাবো না৷’
মুমিনুল হাসতে হাসতে বলল, ‘প্রিয়া, তুমি নানা বাড়ি যেতে চাও?’
‘হ্যাঁ৷ আমরা কি এবার নানা বাড়ি ঈদ করবো, বাবা?
‘না৷ আগামী বছর ঈদ করবো সেখানে৷’
রিয়ার ছোট বেলার কথা মনে পড়ে৷ সে তার সব বান্ধবী মিলে হৈ হুল্লোড় করে বেড়াতো৷ ঈদের আগের রাতে এক সাথে আলপনা আঁকতো, চাঁদ-তারা এঁকে লিখতো-‘ঈদ মুবারক’৷ আরো কত কত স্মৃতি তাদের সাথে আছে৷ অথচ আজ অনেক বছর কারো সাথে দেখা হয় না৷

রিয়া’র বাবার বাড়ির পূর্ব পাশে একটি অশ্বত্থ গাছ আছে৷ তার পাশে একটি কদম গাছ৷ কদম ফুল দিয়ে গাড়ি বানিয়ে সবাই খেলতো৷ আহা, রিয়ার সেই দিনগুলো আজ শুধু-ই স্মৃতি৷ তার আজো ইচ্ছা হয় অশ্বত্থ গাছের নিচে বসে থাকতে৷ দক্ষিণের প্রাণ জুড়ানো বাতাসে কোকিলের কুহুতান শুনতে৷

রিয়া’রা দুই বোন৷ দুই বোনের বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর গ্রামের বাড়িতে তার মা-বাবা একা থাকেন৷ তারা সব সময় পথের দিকে তাকিয়ে থাকেন কখন মেয়েরা আসবে? কখন নাতি-নাতনী আসবে? তারা একা একা গ্রামের বাড়িতে ঈদ করেন৷ প্রতি ঈদে রিয়া তার মা-বাবার কথা মনে করে কষ্ট পায়৷

শশুর বাড়িতে ঈদ মানে তার উপর বাড়তি চাপ৷ প্রচুর মেহমান আসে৷ সবকিছু তাকে-ই সামলাতে হয়৷
গত ঈদে সে সারাদিন রান্না করেছিল৷ তবুও তার শাশুড়ি মুমিনুলকে বললেন, ‘তোর বউ কোন কাজের না৷’
মমিনুল উত্তর দিলো, ‘কি বলো মা? আমি তো তাকে সারাদিন কাজ করতে দেখেছি৷’
‘সারাদিন কাজ করলে হয় না৷ কাজের ধরন বুঝতে হয়৷’

আসলে আজকাল মানুষের মধ্যে কৃতজ্ঞতা বোধ উঠে গেছে৷ সবাই ব্যস্ত আছে পরনিন্দা ও পরচর্চায়৷ রিয়ার ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে৷ সে কাজে কর্মে পটু৷ কারো সঙ্গে উচ্চবাচ্য করে না। তবু শাশুড়ি তাকে কটাক্ষ করেন। ঈদের দিন তার ননদ কোন কাজ-ই করে না, তবু কেউ তাকে কিছু বলে না৷ বিষয়টি মুমিনুলও জানে, কিন্তু সে এতো তুচ্ছ বিষয়ে কথা বলতে রাজি নয়৷ সে রিয়াকে বলল, ‘অল্প কয়দিনের জন্য গ্রামের বাড়ি এসেছো, একটু মানিয়ে চলো৷’

রিয়া মুমিনুলকে বলছে, ‘তুমি একবারের জন্য আমাকে বাবার বাড়িতে ঈদ করতে দিলে না৷ আসলে তোমার মধ্যে মানবতা নাই৷’
মুমিনুল বলল, ‘তুমি বুঝার চেষ্টা করো৷ আমার মা-বাবা অপেক্ষা করে আছে আমার জন্য৷’
‘আমার মা-বাবাতো গত আট বছর ধরে অপেক্ষা করে আছে৷’
‘শোন, এবার-তো টিকেট কেটে ফেলেছি৷ আগামী বছর তোমার বাবার বাড়ি যাবো৷’
‘আমি এবার যেতে চেয়েছি, আগামীতে হয়তো ইচ্ছা করবে না৷’
‘এবার সম্ভব নয়৷’

কয়েকদিন পরে রিয়া তার দুই বাচ্চা ও মুমিনুল রওনা হলেন তার শশুর বাড়ি৷ সবাই একটি সিএনজিতে করে গাবতলী বাস স্ট্যান্ডে গেলো৷ রিয়া তাকিয়ে দেখলো তাদের গাড়িতে লেখা ‘ঢাকা টু সাতক্ষীরা’। রিয়ার বাবার বাড়ি সাতক্ষীরা। মুমিনুলের বাড়ি খুলনা৷ সাতক্ষীরার বেশিরভাগ গাড়ি খুলনা সিটি বাইপাস দিয়ে যায়৷ খুলনার গাড়ির টিকেট না পাওয়া গেলে অনেক সময় সাতক্ষীরার গাড়ির টিকেট কাটতে হয়৷ মুমিনুল আগেও অনেকবার সাতক্ষীরার গাড়িতে করে খুলনা গেছে৷ রিয়া ভাবে, ‘ইস, এই গাড়িতে যদি সাতক্ষীরা যাওয়া যেত!’

তারা সবাই গাড়ির সিটে বসলো৷ কিছুক্ষণ পর গাড়ির সুপারভাইজার টিকেট চেক করতে এসে মুমিনুলকে জিজ্ঞেস করলো, ‘কোথায় নামবেন স্যার?’
মুমিনুল উত্তর দিলো, ‘সাতক্ষীরা।’
রিয়া মুমিনুলের চোখের দিকে তাকিয়ে রইলো৷ মুমিনুল হাসি দিয়ে বলল, ‘চলো, তোমার বাবার বাড়ি৷’
কথাটি শুনে রিয়া চমৎকৃত হলো৷ সে ভাবতেও পারেনি মুমিনুল তাকে বাবার বাড়ি নিয়ে যাবে৷ তার চোখে পানি এসে গেলো৷ মুমিনুল একটি টিস্যু দিয়ে রিয়ার চোখের পানি মুছতে মুছতে বলল, ‘তোমার খুশি ই-তো আমার খুশি।’
সাতক্ষীরা বাসস্ট্যান্ডে নেমে রিয়া তার বাবাকে দেখতে পেলো। সে অবাক হয়ে তার বাবাকে বলল, ‘তুমি এখানে?’
‘তোদের বাড়ি নিতে এলাম৷’
‘তুমি কিভাবে জানলে আমরা আসছি?’
‘কেন? জামাই বাবাজি বলেছে৷ তবে তোকে জানাতে নিষেধ করেছে৷’
রিয়া আরেকবার সারপ্রাইজড হলো৷ মুমিনুলের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তুমি আমাকে আগে বললে কতো খুশি হতাম৷’
মুমিনুল বলল, ‘কেন, এখন খুশি হওনি? তাহলে খুলনা ফিরে যাই৷’
রিয়া বলে উঠলো, ‘তুমি খুব ভাল স্বামী’৷

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত