এ যেন লজ্জা অশ্রু!

এ যেন লজ্জা অশ্রু!

মারিয়ার সাথে আমার বিয়ে হয়েছে আজ তিনদিন হলো। গোলগাল মুখের সাথে গোল দুটো চোখ। নাকটা একটু বসা। একটু না অনেকখানিই বসা। গ্রামের মানুষ বলে ছেপানাকি। আমার কেন জানি মনে হয় ওর নাক বসা হওয়াতেই বেশি মানিয়েছে। লম্বা নাক হলে হয়ত এত সুন্দর লাগতো না। ধবধবে ফর্সা। দুধে আলতা বললে কম বলা হবে না। বরং না বললেই কম বলা হবে।

বয়স মাত্র সতেরো । বিয়ের আসরে পুলিশি ঝামেলা হবে ভেবে শশুর আব্বা এক বছর বয়স বাড়িয়ে জন্মসনদ জোগাড় করে ফেলেছেন। সতেরো বছরের একটা ধবধবে সাদা মেয়ের গোলগাল চোখ অনেক টা পুতুলের মত মনে হচ্ছে। হাতের মেহেদি এখনো মুছে যায়নি।সাদা হাতের উপর রক্তের দাগ ফুটে আছে যেন।

আমি বারবার ঘুরেফিরে দেখিছি। আমার কপালে যে এমন একটা ফুটফুটে বৌ লেখা আছে আগে কল্পনাও করতে পারিনি।

দেখাদেখির বিয়ে যার নাম এরেঞ্জ ম্যারেজ। বিয়ের আগে আমি অবশ্য দেখিনি। দুলাভাই সম্পর্কের দুইজন আনুষ্ঠানিক দেখে এসে আমাকে টিপ্পনী কেটে বলেছিল আয় তোর কপালে কপাল ঘষে দে। এমন পরির মত মেয়ে তর কপালে আসবে জেনে হিংসে হচ্ছে রে।
আমি লাজুক স্বভাবের হাসি দিয়ে মাথা নিচু করে থেকেছি শুধু।

বিয়ের দিন সন্ধেবেলা মারিয়ার দাদি আমার হাতে মারিয়ার হাত তুলে দিয়ে কি সব বললো আমার কানে কিছুই প্রবেশ করলো না।হাতের ভিতর শুধু এক দলা মাখন নিয়ে বসে আছি এটাই মনে হয়েছে।গাড়িতে ওঠার আগে বৌ ঝরঝর করে কেঁদে কেটে একাকার করলো। আমি অভয় বা সান্তনা কিছুই দিতে পারলাম না। মুখে রুমাল এটে বসে থাকার নিয়ম আছে আমি সে নিয়ম কিছুই মানিনি বলে মারিয়ার ভাবি ও বান্ধবীরা চোখ টেপাটিপি করেছে কয়েকবার আবার এখন বৌ কাঁদছে বলে অভয় দিয়ে গেলে হেসে কুটিকুটি হবে।

বিয়ের দিন মেয়ে মানুষের কান্নার অধিকার আছে। বাকি জীবন স্বামী বেচারাকে কাঁদাতে হলে অবশ্যই কান্নার মহড়া দিয়ে নিতে হবে।

আমি পাঞ্জাবীরর পকেটে হাত দিয়ে আকাশের দিকে তাকাচ্ছি। কোন এক দিকে তাকাতে তো হবে। বৌয়ের দিকে এখন তাকিয়ে থাকা ঠিক না। বাকি সবাই বৌ দেখছে তাদের দিকেও তাকিয়ে থাকা বোকামি।
কে যেন পাঞ্জাবীর পকেট ধরে টান দিল। আমি চোখ ফেরাতেই খিলখিল করে হেসে মারিয়ার বান্ধবী পালিয়ে গেল।

আমাকে ঠকানো এত সহজ নয়। এই ভিড়ের ভিতরে পকেটমার হবে আমি বোকার মত দাঁড়িয়ে থাকব এটা হবে না। আগে থেকেই পকেটে হাত দিয়ে রেখেছি।
তবে বৌ নিয়ে গাড়িতে ওঠার আগ মূহুর্তে কে যেন জোর করেই পকেটে কি ঢুকিয়ে দিল।

বাড়ি ফিরে সবার সামনে আমার পকেটমার না হওয়ার গল্প বন্ধুদের শোনাচ্ছি গর্বের সহিত। হঠাৎ পকেটে হাত দিয়ে বের করলাম জোর করে দেওয়া সেই অমুল্য ধন।
পেকেট খুলতেই চোখ ছানাবড়া। সবাই হো হো করে হেসে উঠলো। আমি লজ্জায় মরে যাচ্ছি…..
কি লজ্জা! কি লজ্জা!

বাসর ঘরে ঢুকলাম রাত বারোটার পর। বৌ আগেই ঢুকে বসে আছে নিয়ম অনুযায়ী মাথায় এক হাত ঘোমটা দিয়ে। সারাদিনের ক্লান্তি লজ্জা সব মিলিয়ে ঘুমে চোখ বুজে আসছে। আমি জানি দরজা জানালার চারিধার কয়েক জোড়া চোখ কান আমাকে ফলো করছে। আমার বা বৌয়ের সামান্য এদিক ওদিক হলেই খিলখিল করে হাসির আওয়াজ পাওয়া যাবে। সাবধান থাকতে হবে দু একদিন। পাঞ্জাবী খুলে আলনায় রাখতে যাব এমন সময় আলনা থেকে একটা তেলাপোকা ফুড়ুৎ করে খাটে এসে বসলো।
আর যাই কোথায়!

বৌ হাউমাউ করে চিৎকার করে পাড়া গরম করে ফেললো। ও মাগোওওওওও….!

যা ভেবেছিলাম তাই। দরজার ও পাশে খিলখিল হাসি আর খিলখিল রইল না। রীতিমত অট্টহাসি!
আমি কি করে বোঝাবো ওদের ওরে এই মাগো সেই মাগো না….
কি লজ্জা! কি লজ্জা!

বিয়ে বাড়ি বলে কথা। চারিদিকে আত্নীয় স্বজন হৈ-হুল্লোড় করে বেড়াচ্ছে। নতুন বৌ পেয়ে ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা ভিড় করে বসে আছে। গাঁয়ের লোকও কম আসছে না।নতুন বৌ এ বাড়ি ও বাড়ি ঘুরিয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে ভাবির দল। আমি দিনের আলোয় সে একটু ভাল করে দেখবো সে সুযোগ হচ্ছেই না। রাতের আলোয় ঝলমলে বিয়ের পোশাকে দেখেছিলাম। ভোর হতে না হতেই বৌ পাশে নেই। লোকে মন্দ বলবে বলে মারিয়া নিজেই সকাল সকাল উঠে গেছে। নতুন বৌ সকাল আটটা নয়টা পর্যন্ত ঘুমাইলে ছিঃ ছিঃ পড়ে যাবে তাই ভোরেই বুদ্ধি করে মারিয়া উঠে গেছে।

আমার ঘুম ভাংলো আটটার পরে। ঘরে মারিয়া নেই। এ ঘর ও ঘর উকি দিচ্ছি একবার দেখব বলে। না কোথাও নেই। বাইরে বন্ধুরা আগে থেকেই অপেক্ষা করছিল আমি বাইরে আসতেই হাত ধরে টানতে টানতে আমাদের আড্ডার আসরে নিয়ে গেল।

টিপ্পনী কেটে জিজ্ঞাসা করলো কিরে তোর বৌ কাল রাতে ও মাগো করে চিৎকার করলো কেন?
আমি কিছুতেই বোঝাতে পারছি না তেলাপোকার কাহিনী।

গ্রামের বাড়ির নিয়মই উঠানের এক পাশে বা কোনায় গোসলখানা/ পায়খানা.
আমাদেরও তাই। পাকা গোসলখানা। টিউবওয়েল এর চতুর্দিক পাকা ওয়াল দিয়ে ঘেরা। দরজা বলতে কাপড়ের পর্দা ঝুলানো। এই হল ভদ্র লোকের বাসা।
আমি বাইরে থেকে এসে হাত মুখ ধুতে যাব কিন্তু আমার আগেই নতুন বৌ টিউবওয়েল টিপে ফ্রেশ হচ্ছে।

পর কেউ না। কবুল বলে বিয়ে করেছি এখন টিউবওয়েল পাড়ে গিয়ে হাত মুখ ধুতেই পারি। তবু কেন জানি আড়ষ্টতা ঘিরে ধরেছে আমাকে।
আবার যেতেও মন চাইছে।
সদ্য ধোয়া মুখটা দেখতে ইচ্ছে করছে খুব। কাচা মুখের ফোটা ফোটা কাচা পানি কেমন দেখতে কে জানে?
লোকে বৌয়ের আঁচল ধরে বেড়াচ্ছি বা বৌ পাগল বলবে বলে ভিতরে ঢুকতে পারছি না। বাইরে চেয়ার পেতে দুলাভাই টাইপ লোক ও ভাবিরা আড্ডার আসর বসিয়েছে।

এমন সময় জীবনে বারবার আসে না। আজ যখন সবাই বিয়ে উপলক্ষ্যে এক জায়গায় একত্রিত হয়েছে, আজকের দিনে আড্ডা কম হলে হবে না।
এ সময় আমাকে বৌয়ের সাথে দেখলে চোখ টেপাটেপি শুরু করে দেবে। ওরা হাসি তামাশার কিছু পেলে ছেড়ে দেবে না। হো হো করে হেসে দুনিয়া কাঁপিয়ে দেবে।

মারিয়া বের হলে আমি ঢুকব কিন্তু ভাবি এসে হাতে জগ ধরিয়ে দিয়ে বললো যা তো এক জগ পানি নিয়ে এসো।
এই সুযোগ। ভাবিকে মনে মনে ধন্যবাদ দিয়ে আমি পর্দা সরিয়ে ভিতরে ঢুকলাম। মারিয়া লজ্জা পেয়ে এক পাশে সরে গেল। আমি মারিয়ার দিকে তাকালাম!
নিষ্পাপ শুভ্র একটা মুখ। আমাকে হা করে তাকিয়ে থাকতে দেখে মারিয়া মুচকি হাসলো। আমি কিছুই বলতে পারলাম না। মুখে হাসি ধরে রাখার চেষ্টা করছি কিন্তু একি? টিউবওয়েল এর পাশে কেঁচো কেন?
বাসায় এত আত্মীয় স্বজন নতুন বৌ। এর মাঝে টিউবওয়েল এর পাশে কেঁচো থাকা মানে রীতিমত নোংরামি। আমি সাহস করে কেঁচোর এক পাশে ধরে ফেলে দেব এমন সময় বৌ ভেবেছে আমি কেঁচো তুলে ওর গায়ে দিয়ে দুষ্টুমি করে ভয় দেখাবো।
ও বেচারা নতুন বৌ ভুলে চিৎকার শুরু করে দিয়েছে —-ছাড়ো ছাড়ো ছাড়ো ছাড়োওওও…!

উঠানের ভাবি দুলাভাই দাত কেলিয়ে হাসি শুরু করে দিয়েছে। কি করে বোঝাব মারিয়া কেঁচো ছেড়ে দিতে বলছে?

কি লজ্জা! কি লজ্জা!

নতুন বউ মারিয়া ঘরময় আলো করে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এ ঘর ও ঘর যেখানেই যাচ্ছে সবাই ভিড় করে দেখছে। আমি নানা অজুহাতে আশেপাশে ঘুরঘুর করছি। চুরি করে দেখছি এক ফালি চাঁদ একখানি তাঁরা এক এক আকাশ মহোবিষ্ট দেহ পল্লব। হৃদয় মোচড়ানো ঠোট টিপে ভুবোন ভুলানো হাসি। চোখে চোখ লজ্জায় রাঙা মুখ। আহা এত সুখ এত হাসি এত ভালোবাসা কোথায় থেকে উড়ে এলো? আমি দেখছি আমি হাসছি আমি ভাসছি আমি হাওয়ায় দুলছি।
আমি আহ্লাদে গলে পড়ছি।

দু দুবার বড় রকমের লজ্জায় নিমজ্জিত হয়েছি।
কি জানি প্রথম প্রথম এমনই হয় কিনা। ভয় লজ্জা ভালোলাগা মিলিয়ে জীবন টা মন্দ না।

দুপুরবেলা ভাবি এসে চোখে মুখে জ্বলজ্বলে হাসি ধরে রেখে আমাকে বললো যাও গো মুখচোরা লাজুকলতা। তোমার কষ্টে আমার বুক ফেটে যাচ্ছে।
ঘরে বৌ সাজিয়ে রেখে আসলাম।। এক পলক দেখে আসো। আর কোন সিন ক্রিয়েট করো না এবার।

ঘরে এসে বসলাম। মারিয়া অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে এসেছে এই দুদিনে। বললো পায়ের জুতা খুব টাইট হয়েছে। আমার পা ছিলে যাচ্ছে। এক জোড়া নরমাল জুতা যেন কিনে আনি।

বুঝলাম শুরু হল আমার সার্ভিস।

সন্ধ্যা হতে না হতেই ঘুটঘুটে অন্ধকার নেমে এলো। আসুক। যার ঘরে এমন ফুটফুটে চাঁদের মত বউ তার বাড়ি পুর্ণিমা অমাবস্যা দুটোই সমান।

দুই দিনের হৈ চৈ আর আড্ডায় ভাটা পড়েছে আজ অনেকটা। ক্লান্তিতে চোখ বুজে আসছে সবার। দশটা বাজতে না বাজতে যে যার মত শুয়ে পড়লো। জেগে আছে ভাবি দুলাভাইরা। সবার খাওয়া শোবার ব্যাবস্থা করে অনেক হিসাব নিকাশ করে তারপর শোবে ওরা। আমি ঘরে চলে গেলাম। ভাবি মারিয়াকে বললো যাও গো বৌ ঘরে যাও আমার দেবরের তর সইছে না!

মারিয়া এলে ঘরের দরজা বন্ধ করে মনের দরজা খুলে দিলাম টুকটাক কথা বলবো বলে। কিন্তু কোন কথায় খুঁজে পাচ্ছি না। মারিয়া একবার হাসলো। কেন হাসলো বুঝতে না পেরে আমিও হ্যাংলার মত হাসলাম। হাসিতে হাসিতে কাটাকাটি। এমনই হয় হয়ত।

আমি বললাম কেঁচো তেলাপোকা নিয়ে যে কান্ড করেছ জানিনা আজ কোন লজ্জায় ফেলবা। মারিয়া লজ্জায় মাথা নিচু করলো। আমি বললাম আজ চুপিচুপি কথা বলবা। মারিয়া ঘাড় নেড়ে সায় দিল।

আমি দক্ষিণের জানালাটা খুলে দিলাম। ঘুটঘুটে আধাঁরে ফুটফুটে জোনাকি থাকে। বললাম মারিয়া এদিকে এসো কি সুন্দর জ্যোৎস্না জ্বলছে।

সময়টা ভাল লাগার। বয়সটা ভালোবাসার। জানালা গলে দু তিনটা জ্যোৎস্না ঘরে ঢুকে পড়লো। আমি ছেলেমানুষের মত জোনাকি পোকা ধরছি। মারিয়াও যেন ছেলেবেলা ফিরে পেয়েছে। ওর ছেলেমানুষি দেখে আমার ভাল লাগছ। আমি লাফিয়ে লাফিয়ে জোনাকি পোকা ধরছি।

হাতের আংগুল গলে জোনাকিপোকা পালিয়ে যাচ্ছে মারিয়া ভুলে গেছে ও নতুন বউ। ফিসফিস করে চাপা স্বরে বলতে বলতে কখন যে সে জোরে বলা শুরু করেছে আরেকটা ধরেন চেপে ধরেন আরেকেটা ধরেন।

দরজার ও পাশ থেকে ভাবি বলে উঠলো ধর রে গাধা চেপে ধর! খিলখিল করে হাসি দিয়ে চলে গেল।
মারিয়া লজ্জাবতী লতার মত চুপসে গেল। বেচারা লজ্জায় আমাকে আঁকড়ে ধরে কেঁদে ফেললো। এই প্রথম আমাকে সে এত শক্ত করে ধরেছে। আমি মিটিমিটি হাসতে হাসতে ওর চুলে হাত বুলাচ্ছি। আমার বুক বেয়ে স্রোত নেমে যাচ্ছে মারিয়ার চোখের জলে…

এ যেন লজ্জা অশ্রু!…
জীবন টা মন্দ না!

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত