খণ্ডিত কিছু অন্ধকার

খণ্ডিত কিছু অন্ধকার

আবজাদিন

তখন আলো-আঁধারিতে আকাশে মধ্যরাত। হিম হিম হাওয়ার আলতো ঘেঁষে যাওয়াতেই গা হিড়হিড়ি, কে যেন শীৎকার করে ওঠে রোমকূপের প্রতিটি তলায়। বাতাসের শীতল দাঁত পাঁজড়ার হাড় ভেদ করে বসে যায় কলিজায়, এই শীতরাতের মুমূর্ষু ঠান্ডায়, হলুদ জ্যোৎস্নায়।

১৫৬/১, পশ্চিম মালিবাগের এই দোতলা পুরনো বাড়ির বিশাল ছাদ, যেন ফুটবল খেলার মাঠের চেয়েও বিশাল। এখানে ওখানে তার এবড়োখেবড়ো, ছেঁড়াখোঁড়া নয়, সবখানে মেঝের আস্তর নতুনের মতোই। মজবুত পুরানা বাড়ি। সময়ের ছাপ যদিও লেগেছে তার গায়ে, ধূসর কোথাও, রঙ-চুন উঠে সাদাকালো টিভি স্ক্রিনের ঝিঁঝি রং হয়েছে কোথাও।

পুরানা আমলের বাগানঘেরা বাড়ি; ইট কাঠ জঞ্জালকণার শহরের মধ্যে কী একখণ্ড স্নিগ্ধতা!

আমি থাকি এই বাড়িতে। ভাড়া থাকি নাকি স্থানীয় বাসিন্দা আমি, জানি না। অনেকদিন বাসা ভাড়া না দিয়েও বাড়িওয়ালি খালাম্মার প্রশ্রয়ে যে বসবাস করে, তাকে কী বলে? ভাগ্যি আমার চেহারা। যেখানেই যাই; কারো না কারো ছেলের মতো দেখতে, এর মরা ভাইপোর নিষ্পাপ মুখটির মতো, ওর ছোটভাইয়ের কথা মনে হয়… জগতের সকল মা-ধরনের মহিলারা সুখী হোক।

দোতলার সিঁড়ি ভেঙে তেতলায়, মস্ত ছাদের একপাশে—চিলেকোঠায়। ছাদের বাউন্ডারি দেয়াল ধরে সার সার ছোট-বড় টব, সেগুলোর মধ্যে দাঁড়ানো বিভিন্নরকম ফুলের গাছ।

নয়নতারা ফুলের গাছে যেন সাদা-গোলাপির মিছিল পড়ে গিয়েছিল, এই বিগত বসন্তে। ক্যাকটাসেও ফুল এসেছে লাল লাল।

শীতের ক্ষুধার কাছে খাদ্য হয় গাছের সবুজ, ফুলের বেগুনি হলদে গোলাপি সাদা লালচে নীলচে রং। জাড় এসে গাছেদের সম্পদ নিঃস্ব করে খায়।

আমার জিন্দেগির পঁচিশটি বসন্ত সেদিন বিদায় নিয়ে গেছে, আমার কাছ থেকে।

আমার মাঝারি চিলেকোঠার দক্ষিণে, দেয়ালের বাইরে পেরেক দিয়ে সাঁটানো ছোট ছোট খোপভর্তি একটি কাঠের বাসা।

পায়রার বাসা। দেখতে লাগে, ওইটুক খোপ যেন একেকটি এপার্টমেন্ট বিল্ডিং, সেখানে তলায় তলায় ফ্ল্যাট। মাপাজোকা এক বিঘত বাই এক বিঘত গহ্বর।

বাড়ির ছোটমেয়েটির পায়রা পোষা শখ। আটটা পাখি। চার জোড়া পায়রা বাস করে এখানে। পাখিরা আমার মতো নিঃসঙ্গ থাকে না।

এখন, বলেছিলাম, মধ্যরাত।

সমগ্র আকাশে যেন দই-সাদা আগুন ধরে গেছে—আজকের এই প্রবল ধবল জ্যোৎস্নায়।

গায়ে মোটা শাল-চাদর জড়িয়ে বসেছি ছাদে। এক কোণায় ছোট গ্যাসস্টোভ বসানো। একখণ্ড ছেঁড়া টিনের আড়াল।

জ্বরের নিবিড় আবেশে, হৃদয়ের পাটাতনে কান পেতে রাখলে শুনতে পাই অবিরাম কাঠচেরাইয়ের শব্দ।
একটা কেটলি। গড়গড় করে ফুটছে তপ্ত জল। সেই নির্বাক নির্জন বরফশীতল সময়ে গরম পানির ভাপ আর আগুনের ধোঁয়ার উষ্ণতায় কেমন জ্বর নয়, জ্বরের মতো ঘোর ভর করে সমস্ত গায়ে। পিঠে, বুকে, ওম আরামের সুড়সুড়িটা মগজ অব্ধি যায়।

ছাদের ওইপাশের দেয়ালের ওপর উঁকি; এক জোড়া জ্বলজ্বলন্ত চোখ।

নিঃশব্দে লাফ দিয়ে উঠে এল, লাফ দিয়ে নামল একটা বেড়াল। ধূর্ত শিকারির পায়ে সে মার্বেল-চোখওয়ালা এগুচ্ছ পায়রার খোপের টার্গেটে।

আড়াআড়ি উঁচু করে রাখা বাঁশ বেয়ে উঠতে উঠতে মিনি বাঘের মৃদু হুঙ্কার বেরিয়ে গেল, ম্যাও…

অন্ধকারে ঝটপট ঝটপট শব্দ হয়।

ডানা ঝাপটাতে ঝাপটাতে পায়রাগুলো উড়ে যায়। সদলে ভাসতে থাকে উড়তে থাকে শূন্যে।

বেড়ালটা অক্ষমতার আক্রোশে আকাশের দিকে মুখ তোলে, কার দিকে যেন তাকায়।

ডানাহীনতার অভিযোগ পৌঁছায় কি সে আল্লার আরশে?

শিকার শিকার খেলা আমার ভালো লাগতে থাকে।

জ্যোৎস্নার দুধে ভেজা আকাশে একদল পায়রা ঘুরে ঘুরে উড়ছে, ভাসছে বাতাসে, সশব্দে নিঃশব্দে—মনে হয় যেন স্বর্গের একঝাঁক অপ্সরী নৃত্য করছে চন্দ্রের উঠানে।

এ কী অলৌকিক মায়ার ভ্রম আমার!

তারপর একসময় হুড়মুড় করে বৃষ্টি নামল। এক বিক্রমশালী জ্বরও আকাশ থেকে নেমে এল সেই টিপটাপ বর্ষার পানির সাথে।

হুতিয়া
আমার মনটা কাঠ। অনেক পুরনো গাছের কাঠ। কোন নারী, কোন কাঠুরিয়া, নির্ণয় করে উঠতে পারি না, আমার মনের বনে লোহার কুঠারে কাঠ কাটে দিনরাত, সন্ধ্যা-সকাল।

এই জ্বরের নিবিড় আবেশে, হৃদয়ের পাটাতনে কান পেতে রাখলে শুনতে পাই অবিরাম কাঠচেরাইয়ের শব্দ।

চোখের ওপর, কপালে তরল এক ফোঁটা জলজ কিছু পড়ায় ঘুমটা বা ঘোরটা ভাঙে। রুমটায়, আধো অন্ধকার ভাব, অল্প অল্প আঁধার।

খাটের ওপরে জং ধরেছে, লোহার স্ট্যান্ডে কে জানি না ঝুলিয়ে গেছে এক ব্যাগ পানি।

কপালের ঠিক মাপমতো ওপরে কে সাজিয়ে গেল এখানে, এই ভালোবাসা?

ফোঁটায় ফোঁটায় ঝরে পড়ছে আরাম।

একটা জলপট্টিও বেঁধে দিয়ে গেছে কপালে। কে? কখন? জানি না!

এরকম যত্ন করে রাখার মতো কেউ তো নেই আমার। তবে?

একাকী থাকি। কোথাও ফেরার একটি জায়গা নেই। ছাদে, চিলেকোঠার ঘরে কবিতার সঙ্গে আমার সংসার। কবিতার সতীন গদ্য, গল্প, তার সঙ্গেও আমার ঘর।

আমি পড়াশোনায় বোর্ডস্ট্যান্ড করা ছাত্র ছিলাম। তারপর হয়ে গেলাম পাশ না করতে চাওয়া মানুষ। আমাকে চাকরি দেবার মতো যোগ্যতাসম্পন্ন লোকও এই পৃথিবীতে কাউকে দেখি না। ফলত আমি একা বা এক ঘরে, আর সঙ্গী এইসব উদ্ভট চিন্তারা।

আচ্ছা আমার যদি একটা বউ থাকত? কেমন হতো; তাহলে কেমন হতো? একটা লাল টুকটুক বউ।

এমনই এক রাতে জ্যোৎস্নার ফুল ফোটার শব্দে আমার জ্বর আসত। আজকের মতো এমন করেই কি সে জলপট্টি দিয়ে বসে থাকত মাথায়? গালের ওপর যদি উষ্ণ ফোঁটার টুপ টুপ দোলায় চোখ খুলে দেখতাম, মুখের ওপর আমার, নিঃশ্বাস দূরত্বে মুখ তার, সে কাঁদছে?

ঘোমটা পরা লাল মেয়ে আমার বউ হয়ে ঘরে ঢুকত। ইশ, হতো! যদি হতো! যদি… যদি… ভাবনাটা ঝড়ের মতো ছুটতে থাকে। বুকের ভেতর কি মাথার মধ্যে, একটা কিছু দুমড়েমুচড়ে যাচ্ছে সেখানে, যেনবা দানবট্রাক এক, ছুটছে মধ্যরাতের অন্ধকার হাইওয়েতে।

সবকিছুকে আমার বউ বউ মনে হতে থাকে।

একটা পুটিমাছকে আমার মনে হতে থাকে বউ।

একটা মুনিয়া পাখিকে মনে চায় বউ বলে ডাক দেই।

বসন্ত বাতাসে গাছে একটা ফুল হলুদ, দুলতে দেখলে মনে হয়—আমার লাল বউটির খোঁপায় হলুদ ফুলটি কী দারুণ মোহনিয়াই না দেখাত!

একটা তবে আছে। স্মৃতিকে আমার সত্যিকার বউ মনে হয়। স্মৃতির মধ্যেই থেমে আছে আমার রক্তমাংসের বউয়ের বয়স!

পশ্চিম মালিবাগ, ঢাকার এই গলি থেকে আমি এখন চলে যাচ্ছি অনেক দূরে, পাঠক, যাবে আমার সাথে?

আমার পাখিমন আমাকে নামিয়ে দেয় সেই মধুডাঙার পাড়ে।

যেখানে দাঁড়িয়ে থাকে সে।

যেখানে দাঁড়িয়ে থাকে আমি।

লজ্জাবতী লতার মতো সে কিশোরী। আমি ছুঁতে গেলেই আশরীর নুয়ে পড়ে সলাজে, সম্ভ্রমে। তবু সে বারবার কেন আসে আমার কাছে? আমরা কিভাবে কখন দু’জন দু’জনার মোহনায় পড়ে দিকহারা হই কূলহারা হই, সেসবও আমরা ভুলে গিয়েছিলাম। স্পষ্ট কিছুই মনে নেই, এত স্বাভাবিক ছন্দে ব্যাপারগুলো একের পর এক ঘটে গিয়েছিল। আমরাও কি আর জনমে হংসমিথুন ছিলাম?

কালমান
পড়াশোনা কবে ছেড়ে দিয়েছি! মাদ্রাসা-পালানো ছেলে একদিন ঘর পালানো বালক হলো। এখানে ওখানে ঠেকে, শত ঘাটে গঞ্জে শিখে, ঘুরেফিরে এক অচেনা গ্রামে এসে থেমেছি। থেমেছি বলতে, থামতে হলো। এক ভবঘুরে যেন হঠাৎ ঠিকানা তার, ফিরে পেয়ে গেল, তার অনিশ্চিত সব পথ ফুরোল।

এই আমার নতুন ঠিকানা—নাম তার আয়না।

কিশোরীর রূপ ধরে যেন এই মর্ত্যে জন্মেছে সেই আয়নায়ে হুর।

আচ্ছা আয়নায়ে হুর কী? আয়নায়ে হুর এমন এক বেহেশতি নারী, একদলা থু-থু যদি ফেলে সে এই ধুলার পৃথিবীতে, দুনিয়ার সব সমুদ্র মিঠাপানির হয়ে যাবে। সে একবার মুখের পর্দা নেকাব সরালে লজ্জায় চাঁদ আর কোনোদিন জ্যোৎস্না ঝরাতে আসবে না। যার অসম্ভব রূপ, দেহের সত্তর তবক কাপড় উজিয়ে ফুটতে থাকবে।

মধুডাঙার ইমাম সাহেব আমাকে শোনান গল্প। আরো অনেক গল্প।

মধুডাঙা আমার ঠিকানা। আসলে মক্তবের মেয়ে চুলের বেণি দোলানো আয়না আক্তার আমার ঠিকানা।

শুরুটা অন্যরকম। শুরু থেকেই শুরুর গল্প শুরু করার পরিবেশ কি এখন আর এই গল্পে আছে, পাঠক?

এক মসজিদে এসে জুটেছি। এখানেই থাকি পড়ি। ইমাম সাহেব লোক ভালো, মওলানা মানুষ। আপাদমস্তক ভেতরবাহির। তাই জায়গা দিয়েছেন; দয়া।

নদীর তীরে, কিছুক্ষণ আমাদের ভেতর দিয়ে, অন্ধকার ও স্তব্ধতা হামাগুড়ি দিয়ে বেড়াতে লাগল।
গণ্ডগ্রামের ওয়াক্তিয়া মসজিদ। খুব কম লোকই; বুড়ো লোকই, আসে মসজিদে। নামাজে। আমি আনাড়ি ভঙ্গিতে মাঝেমধ্যে আজান দেই। ইমাম সাহেবই কিছু শিখিয়ে পড়িয়ে দিয়েছেন। মসজিদে হুজুরের কোনো বেতন নাই। এবাড়ি ওবাড়ি থেকে আসে তার খানা। প্রথম কদিন আমাকে কেউ চিনত না। আমাকে তার খাবার থেকে ভাগ দিতেন। কোনো কোনো বেলায় ‘খাদ্যগ্রহণ’ তিনি করেন না। বলেন, আগের বেলায় খাওয়া বেশি হয়ে গেছে। স্বল্প আহার অল্প নিদ্রা স্বাস্থ্য’র জন্য ভালো, হাদিসে পাকে আছে।

আমি তখন গোগ্রাসে গেলা শুরু করেছি। আমার তৃপ্তি দেখে তার চোখ ঝকঝক করে, ভেতরের একটা অনির্বচনীয় খুশিতে।

নামাজে দাঁড়ালে কখনো তার পা কাঁপত, ক্ষুধায়। ক্ষুধা লেপা থাকত তার চেহারায়। তখন এতকিছু বুঝতাম না। শুধু জানতাম হুজুর মানুষ কি আর মিথ্যা কথা কয়!

মাথায় টুপি। লুঙ্গি আর কুর্তা পরি। মিলাদে যাই গ্রামের বিভিন্ন ভিটায়। যস্মিন দেশে যদাচার। যেই পরিবেশ ও যেই চরিত্রে যেরকম পোশাক দরকার, তাই। যাত্রাদলে থাকতে সময় মেয়েদের জামাকাপড় পরে বহু তো পার্ট করেছি।

আমার ছিল তৈরি কণ্ঠ। মিলাদ পড়তে গিয়ে চোখ বন্ধ করে সুর সাধি, বালাগাল উলা বি-কামালিহি…

একদিনের ঘটনা। হয় কী, আমি চোখ নিমীলিত করে উদাত্ত কণ্ঠে পড়ছি সুর করে—গলার পেশিগুলো ফুলে ফুলে উঠছে, জলসায় নামিয়ে আনছে বর্ষিত করছে আসমানি আবেগ, বালাগাল উলা বি-কামালিহি, কাশাফাদ দুজা… হঠাৎ মজমার কোথাও ডুকরে কেঁদে ওঠার শব্দ। তারপর হাউ মাউ। চমকে চুপ করে দেখি, একজন ফর্সা মতো বয়স্ক লোক কান্না করছে, তার পিঠ বারবার ঝাঁকুনি খাচ্ছে কান্নার গমকে। যতক্ষণ গজল গাইলাম, লোকটিকে মনে হলো খুব কষ্ট হচ্ছে কারো জন্য। বালাগাল উলার অর্থ তখন জানি না, নতুন এক বিস্ময়ে ভাবি, সশরীরে কেউ তো নেই, তবে কার জন্য এই বেদনা তার, প্রেম তার? এও কি হয়?

মিলাদ শেষে সেদিন আমি এক হাজার টাকা নজরানা পাই। তখন অনেক টাকা আমার কাছে!

সাফাদ
এভাবেই দিন কাটে। যেদিন কোনো কাজ থাকে না, ম্রিয়মাণ দুপুরের হলুদ রোদে বসে থাকি মসজিদের চাতালে। বিকেল পড়ে এলে যাই নদীর ওদিকটায়। মধুডাঙা নদীর তীর। মধুর তীর। বাংলাদেশের সবচেয়ে মধুভরা অঞ্চল। যেখানে আকাশে মধু। বাতাসে মধু। ঘাসের ডগায় মধুর বিন্দু। বালুর কণায় মধুর ফোঁটা। জিয়লমাছের ঘাইতে উঠে আসা ঢেউয়ের ঘাঁ তে মধু। হাঁটি, সেই তীরে আমি। গান গাই।

মানুষদের মধ্যে আমার কোনো বন্ধু থাকে না।

একটা কোকিল পাখি এসে প্রতিদিন আমাকে গান শিখিয়ে যায়।

একটা ডাহুক পাখি এসে প্রতিদিন আমার গলায় কেমন এক রক্ত উঠানো করুণ ডাক রেখে যায়।

একটা চাতক পাখি প্রতিদিন কোত্থেকে যেন একটু একটু তৃষ্ণা একটু একটু প্রতীক্ষা আমার বুকে জমা করে যায়।

চলে যেতে থাকে দিনরাত্রি, বাউণ্ডুলে জিন্দেগি।

এক বিকেলের বাঁকে কে যেন আমায় ডাকে। আমার নাম ধরে নয়।

ডাকে; অ্যাই বালাগল উলা সাহেব!

আমি চমকে উঠে দাঁড়াই। পেছন ফিরে তাকাই। এদিকে, এ অসময়ে কারো থাকার কথা না। কিন্তু এ যে পাখির নয়, মানুষেরই কণ্ঠস্বর। নাকি পাখিরই?

কিশোরীগণ যে পাখিই। বড়ো খাঁটি, সে পাখি। একটা মেয়ে। একটা ছেলের চোখে।

আগে কখনো একে দেখেছি বলে আমার মনে পড়ে না।

রিনরিনে চপল কণ্ঠে, সরলতার গাঢ় ঝোল ছড়িয়ে আছে সমস্ত তার মুখপাতে—বলে সে, আপনার গানের গায়কী এত সুন্দর! ঠিক মুখটার মতোই।

আমি বিহ্বলতা ততক্ষণে কাটিয়ে ফেলেছি। আশ্চর্য হয়ে নিজের ভেতর লক্ষ করি, আমার স্বভাবজাত : জড়তাবোধের শক্তি আর কাজ করছে না। সম্পূর্ণ সহজ হয়ে গেছি এক প্রস্ফুটমান কিশোরীর সামনে।

—বাহ, ধন্যবাদ।

—আজকেই শুধু ধন্যবাদ দিলেন। প্রতিদিনই যে শুনি আপনার গান, সেগুলোর ধন্যবাদও জমে আছে, কে দেবে?

সপ্রতিভ উজ্জ্বল মুখ রচনা করে কিছুক্ষণ চেয়ে রইল আমার দিকে।

বলে কী? প্রতিদিনই? আমি কেন দেখি না? তাহলে কি আড়াল থেকে আমায় সে লক্ষ করে? দারুণ পুলক উপলব্ধি করি। তবে ননীর মতো সুস্বাদু রেশটা তুলে নেয় সে-ই আবার।

গ্রামীণ উচ্চারণভঙ্গি, আবারো তার প্রগলভতা, হুটহাট মন্তব্য; চুলটা এমন বান্দরের মতন রাখছেন ক্যান?

বলেই ফিক ফিক করে হাসতে থাকে। বান্দর হুজুর বান্দর… হি হি হি হি হি হি…

আকাশ থেকে যেন আচমকা বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে। হি হি হি-র বৃষ্টি। অনবরত হি হি ঝরছে আমার চারপাশে, ঝিম ঝিম ঝিম ঝিম মুষলধারায় ঝরছে তার হি হি-র বর্ষাধারা।

আমার মন, ধীশক্তি ভিজে যেতে থাকে, মস্তিষ্ক আবিষ্ট হতে থাকে তার হাসির আলোড়ন ঝংকারে, প্লাবনে ভেসে যায় আমার বুকের উঠান।

কুরিসাত

আমার একটা বই হবে, জানিস? আমি আলতো করে ওর হাতটা ধরি। আমি ওকে গল্পটা বলি। আমার স্বপ্নের গল্পটা। দুটো বাচ্চাবয়সী—নদীর কিনারে বসে নিরিবিলি—ওদের ব্যক্তিগত স্বপ্ন অথবা স্পর্ধার আলাপ করে।

জানিস, আমরা একদিন বিয়ে করব যে?

আগে তোর বইয়ের গল্প কর।

বইয়ের নাম ঠিক করেছি; আকাশে অনেক ঘুড়ি। (আহা, সেই সময়কার মধুরতম কাঁচা চিন্তা আমার!)

আমার দিকে চোখ গোলগোল করে সে জানায় তার দুর্বোধ্যতা।

আকাশ মানে জীবন, বুঝলি? আকাশের যেমন কোনো ব্যাখ্যা নাই জীবনও তো তাই। গল্পগুলো ধর; ঘুড়ি। লাল নীল নানান রঙের ঘুড়ি। নানান তার ধরন, অবয়ব। গল্পও তো তেমনই। আকাশে অনেক ঘুড়ি, মানে জীবনে অনেক গল্প। প্রচ্ছদে একটা ছবি থাকবে আমার, বুঝলি না! সন্ধ্যার আকাশ। অন্ধকার দেখাবে আমার ছবি। আবছায়া মুখ। অর্ধেক শরীর। আকাশে অনেক ঘুড়ি। অনেকের ঘুড়ি। আমার হাতে একটা নাটাই। ওড়াচ্ছি নিজের ঘুড়ি। নিজের গল্প। স্বপ্নগ্রস্তের মতন বলে যাচ্ছি, হঠাৎ সে বাগড়া দেয়।

এহ থাম! কোত্থেকে আসছে এক কবি! ধাক্কা দিয়ে নদীতে ফেলে দিবো। আচার খাবি?

দে, কই? সে ফিচ করে হাসে। আঙুল তুলে মাথার ওপর দেখায়, ওই যে আচার ঝুলে, গাছে। তারপর কোমরে আঁচল বেঁধে সড়সড় করে উঠে পড়ে, বাইতে থাকে তেঁতুল গাছ; একটি ক্রমপ্রস্ফুটমান কিশোরী।

সাহুদ
“ডাকলেই তো এসে পড়ি, ডাকো তো না,
একবার আড়াল হলে আমি, আর তো পাবে না।
চোখের ভাষায় ডেকে তো ফেলেছি মেয়ে; এসেই পড়ো না,
তুমি আসবে জেনে, শূন্য পড়ে থাকে আমার জাদুর বিছানা। “

আকাশের মুখ চেয়ে থেকে লাইনকটা আবৃত্তি করে নিজেই অতিশয় চমকে গেলাম। নিজের গলায় অমন, উদাসী আর গাঢ় স্বর আগে কখনও আবিষ্কার করি নি। নিজের ভেতর অমন, ভাবের তোলপাড় এবং ছন্দ স্পর্শিয়া বাক্যের আনা-গোনা আগে তো কখনো লক্ষ করি নি!

মেয়েটা আশ্চর্য হয়ে আমার কাছ থেকে সরে বসে, যেন তড়িতাহত সে। পলকহীন পলকে আমার দিকে দেখতে থাকে। এতক্ষণ আমার ঘাড়ে মাথা রেখে একটা পাতার ঘ্রাণ শুঁকতে শুঁকতে সে শুনছিল আবৃত্তি আমার। এখন যেন এক অব্যক্ত বিশাল আনন্দ ওর ছোট্ট বুকের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসার কোনো অবলম্বন পাচ্ছে না।

নিজের কাছেই অনেক অনেক অচেনা লাগে নিজেকে।

সেই লাল টুকটুকি কবরটিকে স্মৃতির মলাটে মুড়িয়ে রেখে কোথায় যে চলে আসি! তারপর তো কেবল ভাসছি, আর ভাসছিই।
প্রথম কবিত্বশক্তির ক্ষরণ—তার ঝলকানির রেশে বুক ঝিমঝিম করতে থাকে। মনে হয়, আমার কিছু মুহূর্ত আগের পৃথিবী ঝাঁ করে আমার চারপাশ থেকে সরে গেল, অন্যকোনো পৃথিবীর ভেতর পড়ে গেলাম আমি। এ সম্পূর্ণ নতুন, অপরিচিত এক জগৎ।

নদীর তীরে, কিছুক্ষণ আমাদের ভেতর দিয়ে, অন্ধকার ও স্তব্ধতা হামাগুড়ি দিয়ে বেড়াতে লাগল।

একসময় সে-ই ভাঙে নীরবতা, সম্পূর্ণ অন্যপ্রসঙ্গে ধরে বলে, গতরাতে ঘুম আসে নি তোর, তাই না? আমি সেই প্রথমবার তাকে বলি, মাথার ভেতর তুই কিলবিল করিস, ঘুম আসে না।

তারপর দুজনের এক দীর্ঘশ্বাস বাতাসে ভারি করে তোলে।

এইভাবে জমে যায়। আমাদের অনেক গল্প। দিনরাত। রাতদিন।

একদিন সে আমাকে বলে, জানিস, তোর বয়স পঁচিশ বছর যেদিন হবে, সে রাতে তোকে বিয়ে করব আমি।

যাগুশ
তারপর অনেকদিন কেটে যায়।

(হঠাৎ কী হয়) আমাদের আর দেখা হয় না। নদীর বাঁধের ঢালে বসে থাকি একা। বরই কুল আঁচলে ধরে আর কেউ আসে না এখানে। তার বাড়ির নামও আমি জানি না।

বনের ভেতর থেকে ছায়া একটা মানুষ এসে আবার সেই বনেই মিলিয়ে গেল?

কিচ্ছু ভাল্লাগে না। প্রাণ আইঢাই করে শুধু। আয়নারে ভালো না বাসলে সবকিছু সন্ধ্যার একাকিত্ব আর বিষণ্ণতার মতো লাগে।

অনেক অনেক দিন পর, একদিন আমরা; আমি আর পাঞ্জেগানা মসজিদের ইমাম সাহেব—এক বাড়িতে জরুরি তলব আসে।

জালালি খতম পড়তে হবে। কে নাকি একজন ভীষণ অসুখ তার। ডাক্তার মোক্তার সবাই ফেল মেরে গেছে।

জালালি খতমের অনেক শক্তি। কঠিন কঠিন মুশকিল আসানের উসিলা।

ভাগ্যের কী ফের!

সেই বাড়িতে গিয়ে আমি পেয়ে যাই সেই মেয়েটিকে। কিন্তু এমন পাওয়া কি আমি চেয়েছি?

চমকে উঠি। সুন্দরে কোমলে গড়া সেই নিটোল হাত পা তার, পাটের দড়ির মতো শুকনা, সরু আর লিকলিকে হয়ে আছে।

চোখের জ্যোতি কবে তার নিভে গেছে প্রভূত অসুখের অন্ধকারে। সাদা পরিষ্কার বিছানার ওপর যেন শুধু পড়ে আছে একপ্রস্ত কাপড়ের কুণ্ডলী।

মুখ হলুদ, পাণ্ডুর। ঝরাপাতার মতো জীর্ণ। বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারলাম না। থাকা কি যায়?

সমস্ত মন এক যন্ত্রণাকর বিস্বাদে কুঁকড়ে উঠল।

আমি ওপাশে গিয়ে তার শিয়রে কেবল বসতে পারি। যেন ভেঙে বসে পড়ি ওর মাথার কাছটিতে। ইমাম সাহেব দোয়া পড়ছেন।

বিড়বিড় ঠোঁট নড়ে ওঠে ওর, আমাকে সে ইশারা করে—ওর মুখের কাছে কান নেই, অস্ফুট কণ্ঠে যেন দূরাগত বাতাসের ধ্বনি, বলে, তোর পঁচিশ বসন্তে বন্ধু তুই আর আমি… তুই আর আমি…

কথা আর শেষ হয় না আয়নার।

মেয়েটা একদিন চলে যায়। মরে যায়। মধুডাঙার এক শান্ত সমাহিত তীরে, তার সমাধি হয়।

আমার

শেকড় তারপর সেই মাটির কামড় ছেড়ে দেয় একদিন। আয়নার কবরধরা জমিনের ওপর আমি আর পা ফেলতে পারি না।

সেই লাল টুকটুকি কবরটিকে স্মৃতির মলাটে মুড়িয়ে রেখে কোথায় যে চলে আসি! তারপর তো কেবল ভাসছি, আর ভাসছিই।

বিগত রাতটিতে, আমার দারুণ এক জ্বর করে যে, আমার বসন্ত চলে যায়। সেই বৃষ্টিতে। পঁচিশতম বসন্তের শেষরাত। বর্ষার প্রথম বৃষ্টি।

একটা সংসার নেই আমার। ছিল না, তবুও এখন মনে হচ্ছে, ঘর আমারও একটা হয়েছে । অদৃশ্যের কেউ ছায়াসঙ্গিণী আমার, পরম যত্নে রাখছে আগলে আমাকে। কখনো দেখি না তাকে, কখনো আবার দেখি, আমার শিয়রে সে বসে আছে। স্পষ্ট, ধরা যায়, ছোঁয়া যায়… নির্ভরতার ছায়ায়।

সেই রাতে আমি, বহুবছর বাদে সেই প্রায় বিস্মৃত মুখটি আবার দেখি স্বপ্নে, বা আধো ঘুমে আধো জাগরণে, নাকি বাস্তবেই; দেখি, আমি আর সেই মেয়ে, কবিতার মেয়ে চুলখোলা আয়না আক্তার, সে-ই মেয়েটি এত বড় হয়ে গেছে! ঠিক তো বউ বউ লাগছে; আমাদের বিয়ের জলসা বসেছে সানাই বাজছে সেই মধুডাঙার তীরে।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত