অতনু আর কল্যানীর বিয়ের বয়স কুড়ি। এত বছরে কোন ব্যাপারেই স্ত্রীর কাছে নীচু হয়ে আকুতি জানাতে হয়নি অতনুকে। ঘরকন্নার কাজে সদা ব্যস্ত কল্যানীও কখনও স্বামীর কোন ব্যাপারে নাক গলায় নি।
কিন্তু আজ দায় পড়ে অতনুকে স্ত্রীর কাছে বারংবার অনুরোধ জানাতে হচ্ছে। আলমারিতে চাবি দিয়ে সেটা ড্রেসিং টেবিলে রাখল কল্যানী। মুখ ঘুরিয়ে অতনুর দিকে সরাসরি চেয়ে বলল,
“আমে দুধে মিলে যাবে আর আঁটি পড়ে গড়াগড়ি খাবে। বাবা, আমি খুব ভাল করেই চিনি তোমাদের। আজ কুড়ি বছর হয়ে গেল এ বাড়িতে এসেছি। হাড়ে মজ্জায় চিনেছি একেবারে। শেষে দেখব ভাই বোনে গলাগলি, আর আমি হব এলি থেলি।”
অতনু তবু কল্যানীকে আপ্রাণ বোঝানোর চেষ্টা করে,
” প্লিজ, তুমি অনিতাকে নিজের মত করে বুঝিও। যতই হোক মায়ের রোজকার জীবনে তুমিই তো ছিলে সবসময়ের সঙ্গী। তোমার কথার একটা আলাদা দাম আছে। ”
চোখের কঠিন দৃষ্টি নিয়ে, ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি ছড়িয়ে বলে ওঠে কল্যানী,
” আমার কথার কোনো দাম আছে নাকি তোমাদের কাছে! মায়ের শেষ ইচ্ছের কথা আমি বলতে রেখেছিলে বুঝি ? ”
” অযৌক্তিক কথা ও ভাবে রাখা যায় নাকি!”
কল্যানী চোখে আঁচল চাপা দেয়।
” উনি ছিলেন দেবী। বুঝলে দেবী। তোমরা গাদা গাদা বই পড়ে খালি টাকা রোজগার করা আর স্ট্যাটাস শিখেছ। আর মা খাতা বইকে প্রাণের জিনিস করে নিয়েছিলেন। আমাকে তোমাদের ভাই বোনের ব্যাপারে একদম জড়াবে না বলে দিচ্ছি।”
কল্যানী ছিটকে বেরিয়ে গিয়ে ঢুকল শাশুড়ি সুতারা দেবীর ঘরে। সেখানে টেবিলের ওপর কল্যানীর গাঁথা জুঁই ফুলের মালা গলায় পরে ছবিতে হাসছেন তিনি।
নিতান্ত ছাপোষা মানুষ ছিলেন সুতারা দেবী। স্বামী অপরেশ মজুমদার কাজের সূত্রে সারা ভারত ঘুরে বেরাতেন কিন্তু সুতারা দেবী ছেলে অতনু ও মেয়ে অনিতাকে নিয়ে উত্তর কলকাতার শ্বশুর বাড়িতে একান্নবর্তী পরিবারে দিনযাপন করতেন। হাসিমুখে পরিবারের সকলের আবদার যতটা পারতেন মেটাতেন। আর ছেলে মেয়ের শিক্ষার জন্য যৎপরনাস্তি চেষ্টা চালাতেন। অপরেশবাবু বলতেন,
” তোমার মতো গৃহিনী পেয়েছি বলেই না সংসার চিন্তা মাথায় তুলে খুদকুঁড়োর আশায় দেশ ভ্রমণ করে বেড়াই।”
ছেলে মেয়ে কিছু বড় হতে অপরেশবাবু আলাদা বাড়ি করেন এবং স্ত্রী সন্তান সমেত সে বাড়িতে চলে আসেন।
সুতারা দেবী খুব কিছু শিক্ষিত মহিলা না হলেও লেখার হাত ছিল অসামান্য। সংসার সামলে এক অন্দরের মহিলা যে কি ভাবে লেখার জগতে প্রথম দিকে স্থান করে নিতে পারে, তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ বোধহয় উনি।
দুপুরে ভাত ঘুম না দিয়ে বিছানায় নিজেকে এলিয়ে দিতেন। তারপর আশ্রয় করতেন খাতা আর কলম। পাতার পর পাতা লিখে যেতেন। রাতে সমস্ত কাজ কর্ম সেরে মাঝে মাঝেই টেনে নিতেন লেখার খাতা। বিনিদ্র এক একটি রাতে সৃষ্টি হতো মণিমুক্তোর মতো সব কাহিনী। আকাশ ফরসা হওয়ার সময় যখন ডেকে উঠতো ভোরের প্রথম কাক, দূরে শোনা যেত নিঃঝুম রাস্তায় পথচারীর সাইকেলের ঘণ্টি, তখন সুতারা দেবী কোন উপন্যাসের শেষ অংশ লিখে মনে প্রশান্তি অনুভব করতেন।
ছেলে মেয়েরা উচ্চশিক্ষিত হল দুজনেই। ভাল পদে চাকরি পেল। জামাইও হল প্রতিষ্ঠিত। অপরেশবাবু মারা যান এর মাঝে। লেখা কখনও থামেনি সুতারা দেবীর। অনেকগুলো বই প্রকাশিত হয়েছে ওনার। বেশ কিছু শুভাকাঙ্ক্ষীর সাহায্যে মাঝে মধ্যেই সাহিত্যের আসরেও হাজির হন। সাহিত্য জগতে লেখিকা সুতারা দেবী এক উজ্জ্বল নাম।
মেয়ে অনিতা বিয়ে করেছে নিজের পছন্দে। ছেলে অতনুর জন্য বউ পছন্দ করলেন সুতারা দেবী নিজে। হাওড়ায় এক সাহিত্য সভায় পুরনো বান্ধবী প্রতিমার সাথে দেখা। আর বান্ধবী কন্যা কল্যানীকে প্রথম দেখাতেই পছন্দ করা। কল্যানী তখন কলেজে। পিতৃহীন মধ্যমেধার কল্যানীর জন্য তার মা প্রতিমা দেবী পাত্রের সন্ধানে ছিলেন। সুতারা দেবী পুত্রবধূ রূপে পছন্দ করায় তিনি এক কথায় রাজি। কল্যানী দেখতে এক কথায় অপরূপ সুন্দরী। অতনু তাই এক দেখাতেই পছন্দ করে। অপরেশবাবু ছেলের বিয়ে দেখে মারা গেছেন। কল্যানীর মুখখানা লক্ষ্মী প্রতিমার মতো। কাজে কর্মে পটু এবং ব্যবহার অমায়িক। ছেলের বউ নিয়ে খুব খুশি ছিলেন অপরেশবাবু। সুতারা দেবীর পছন্দের প্রশংসা করতেন। তবে নিয়তি এমন যে, বেশিদিন সেই ভরা সংসারের সুখ পাননি তিনি।
অনিতা তার বউদিকে নিয়ে প্রথম থেকেই খুশি ছিল না। যদি-ও অতনুর আগেই তার বিয়ে হয়ে যায়।কিন্তু অল্পশিক্ষিতা কল্যানীকে, অনিতা পরিবারে মিস ম্যাচ মনে করত। এই অপছন্দের কথা দাদার বিয়ের আগেই মাকে জানিয়েছিল সে। সুতারা দেবী বলেছিলেন,
” আমিও তো এমন কিছু লেখা পড়া জানিনা, তাহলে আমিও তো যোগ্য নই পরিবারে।”
অনিতা চমকে উঠে বলেছিল,
” কি যে বল মা! কোথায় তুমি আর কোথায় ‘ ও’। তোমার মতো গুণী মানুষের ধারে কাছে যাবে? ”
” সবার তো সব গুণ থাকে না। কল্যানী কি সুন্দর গুছুনি মেয়ে আর হাতের রান্নাও কত চমৎকার। সম্পর্কে তোর বউদি হবে। সম্পর্কটা ভাল করে বজায় রাখবি এই আশা করব।”
কল্যানী আর অতনুর এক ছেলে সুপ্রতীপ, বর্তমানে ডাক্তারীর ছাত্র। অতনু কর্মজগতে প্রায়ই এদিক ওদিক করে বেরায়। গত বিশ বছরে সুতারা দেবীর খুব কাছের জন কল্যানীই ছিল। পাশাপাশি থাকতে থাকতে একে অপরের সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু হয়ে উঠেছিল। ছেলে মেয়ে নিজেদের ব্যক্তিজীবনে ব্যস্ত থেকেছে। মায়ের শারীরিক খুবই মাঝে মধ্যে নেওয়া ছাড়া আর বেশি আগ্রহ দেখায় নি।
তিনদিন হল সুতারা দেবী বয়সজনিত কারণে মারা গেছেন। তাঁর মৃতদেহ নিয়ে বিশাল শোভাযাত্রার আয়োজন হয়েছিল। মৃত্যুর পর সারা বাড়ি কত জ্ঞানী গুণী, শিল্পী মানুষে ভরে গেছিল। চারিদিকে শুধু ফুল আর ফুল। সমবেদনার বন্যা বয়ে গেছে।
কল্যানী অনেক বার বলার চেষ্টা করেছিল, সুতারা দেবী তাঁর মৃতদেহ নিয়ে এত ধুমধাম হোক চাননি কখনও। তিনি বলতেন, মৃত্যু একটা স্বাভাবিক ঘটনা। জন্ম যখন হয়েছে, মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা তো করতেই হবে।শোক, একটা ব্যক্তিগত অনুভূতি। তাই তাঁর ক্ষেত্রেও যেন শেষকৃত্যের অনুষ্ঠান বাহুল্যবর্জিত হয় এবং শুধুমাত্র আত্মীয় পরিজনের মধ্যেই তা সীমাবদ্ধ থাকে। এটাই শেষে আশা করেছিলেন তিনি। কিন্তু নিজের সন্তানেরাই যে শেষ কথা!
অত নাম যশ খ্যাতি যে মহিলার, তার মৃত্যুর খবর সকলকে না জানালে হয় নাকি! বিভিন্ন সংস্কৃতির পীঠস্থানে তাঁর মরদেহ শায়িত থাকবে না, এ কেমন কথা।
অতনু এবং অনিতা এ ব্যাপারে একমত। মায়ের মৃত্যুটা একটা ঘটনা। কত শত মানুষের সান্ত্বনা বাক্য গ্রহণ করল দুজনে। কিন্তু মতভেদ হচ্ছে মায়ের শ্রাদ্ধের অনুষ্ঠানের ব্যাপারে। অতনু চায়, বিরাট বাড়ি তাদের। সেখানেই শ্রাদ্ধ শান্তি হোক। আর সমস্ত প্রথিতযশা মানুষের আগমন ঘটুক। কিন্তু অনিতা চায়, অন্য কোথাও বিরাট জায়গা ভাড়া করে সেখানে শ্রাদ্ধের অনুষ্ঠান আয়োজন করা হোক। অনিতাকে এ ব্যাপারে বোঝানোর জন্য অতনু কল্যানীকে তাই অনুরোধ করেছিল।
শেষ পর্যন্ত অতনু আর অনিতা দুজনেরই মতামত রইল। শ্রাদ্ধানুষ্ঠান বাড়িতে হল ও শোকজ্ঞাপন বাইরে করা হল। সুতারা দেবী কি যে সে মানুষ! বিয়ে হয়ে ছেলে মেয়ে মানুষ করে যেমন দায়িত্ব পালন করেছেন, তেমনই কলমের জোরে হয়ে উঠেছেন বড় লেখিকা। পেয়েছেন নামীদামী পুরস্কার, মান-সম্মান। মৃত্যুর আগে পর্যন্ত ডাক পেয়েছেন বিভিন্ন সাহিত্য সভায়।
পরেও যে রেখে গেছেন ছেলে মেয়ের জন্য অনেক কিছু। তাঁর এক একখানা বই এখনো বেস্ট সেলার। টাকা পয়সার প্রতি সুতারা দেবীর তেমন কোন মোহ না থাকলেও ছেলে মেয়ের জন্য সেটা তো আসতেই থাকবে। অতনু অনিতাও নয় ভাল টাকাই ইনকাম করে। কিন্তু তারা অমন একজন মায়ের সন্তান। সমাজে মুখ দেখাতে এ যে বিরাট এক পরিচয়। তাই এমন মায়ের মৃত্যু কি সহজে হেলাফেলা করার।
কল্যানী শ্রাদ্ধের দিন তিনতলার এক ঘরে নিজেকে বন্দী করে রাখল। সেই ঘরে খুব একটা কারোর যাতায়াত ছিল না। একতলার বিরাট হলঘর লোকে পূর্ণ। বিয়ের পর থেকে কল্যানী তার বিখ্যাত শাশুড়ির সাথে বহু সাহিত্য সভাতেই গেছে। বিশেষ করে শেষ পাঁচ বছর সুতারা দেবী অসুস্থ হওয়ার পর থেকে কোথাও একা ছাড়ত না।এছাড়া বাড়িতেও বহু নামী মানুষ আসতেন দেখা করতে। সবসময় পাশে পাশে থাকার কারনে বহু মানুষই কল্যানীকে চিনত।
সেইসব মানুষেরা কল্যানীর খোঁজ করতে লাগল।অতনু জানাল
” ও আসলে একটু অসুস্থ হয়ে পড়েছে। তাই ডাক্তার বিশ্রাম নিতে বলেছে।”
অনিতাকে কেউ জিজ্ঞেস করলে সে বিরক্ত বোধ করতে লাগলো।
সুপ্রতীপ ভীড় এড়িয়ে মায়ের কাছে চলে এল। কল্যানী ছেলেকে বলে,
” তোর ঠাকুমার আত্মার শান্তি কামনায় যে মানুষগুলো শ্রদ্ধা জানাতে এসেছেন, তাদের সামনে থাকাটা তোরও কর্তব্যের মধ্যে পড়ে। আমি নয় মনের সায় পাচ্ছি না বলে ঘরে আছি। তুই নীচে যা।”
বাইরে যেদিন শোকজ্ঞাপন অনুষ্ঠান হল, সেদিনও কল্যানী অনুপস্থিত। সেদিন সে সকাল সকাল চলে গেল এক বৃদ্ধাশ্রমে। সারাটা দিন নিঃসঙ্গ মানুষগুলোর সাথে কাটিয়ে সন্ধ্যের পর বাড়ি এল। সুতারা দেবীর ছবির সামনে এক গোছা চন্দন ধূপ জ্বালিয়ে দাঁড়াল চুপ করে। সুতারা দেবী বলতেন,
“বউমা, আমি কত ভাল আছি। তোমার মত একজন সাথী পেয়েছি শেষ জীবনে। কিন্তু অনেকেই এই সময়টা বড্ড খারাপ কাটায়। একা একা বৃদ্ধাশ্রমে কি ভাবে কাটায় মানুষগুলো। কেউ যদি সামান্য সহানুভূতি দেখায়।”
মৃত্যুর কুড়ি দিন পর বাড়ি পুরো ফাঁকা। অতনুও কর্মসূত্রে মুম্বাই গেছে। শুধু দারোয়ান, মালি আর রাতদিনের দুজন কাজের লোক রয়েছে। সারা বাড়ি খাঁ খাঁ করছে। সকালে স্নান সেরে, একমুঠো বেলফুল গাছ থেকে তুলে শাশুড়ির ছবির সামনে রাখে কল্যানী। সাদা ফুল সুতারা দেবীর পছন্দ ছিল। হাপুস নয়নে কেঁদে চলে তাঁর প্রিয় পাত্রী।
” মা গো, কি অটুট বন্ধনে জড়িয়ে ছিলে আমায়। তোমার সুখ দুঃখ, আমার সুখ দুঃখ কি ভাবে আমরা পরস্পর ভাগ করে নিয়েছি এত গুলো বছরে। তোমার ছেলে মেয়েরা তার ভাগীদার তো কখনো হল না। তোমার পাঠকেরা তোমার লেখার সাথী হয়েছে, আর মনের সাথী হয়েছি যে আমি। এখন এই খালি বাড়িতে আমি কি নিয়ে থাকব বল। বাড়ির প্রতিটি কোণে যে তোমার স্পর্শ লেগে। ”
কাঁদতে কাঁদতে হাঁপিয়ে উঠে একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে কল্যানী। ছবিটা দু’হাতে জড়িয়ে বলতে থাকে,
” তোমায় দেওয়া কথাও আমি রাখতে পারি নি মা।মৃত্যুর পরে শান্তি দিল না তোমায়। তোমার প্রাণহীন দেহটা নিয়ে টানাটানি করল।”
অলক্ষ্যে বসে সুতারা দেবীর সমস্ত আশীর্বাদ ঝরে পড়ল কল্যানীর ওপর। আপনজন, পরিচিত অপরিচিত মহলে সুতারা দেবী বেঁচে রইলেন এক অসামান্যা লেখিকা হিসাবে। আর ব্যক্তি সুতারা দেবী বেঁচে রইলেন পুত্রবধূ কল্যানীর মনে। এই অসমবয়স্ক বন্ধুত্বের সূচনা হয়েছিল কোন এক বৈবাহিক সূত্রে। মৃত্যুদূত তার পরোয়ানা এনে বিচ্ছেদ ঘটালেও এক নারী মনে রাখল অন্য নারীর সাথে বন্ধুত্বের গভীরতা। যেখানে নেই কোন দেনা পাওনার হিসেব নিকেশ।
সমাপ্ত