সাথীয়া

সাথীয়া

-ঘুমালি?
-না, ঘুম আসে?
-দেরী হলো আজ?
-অনেক কাজ থাকে তো।
-কাল এলিনা?
উত্তর দিল না।বলল,

-তুই খাসনি কেন? আর একি!মুখ দিয়ে লাল ঝরছে!জামায় রক্তের দাগ, শুকনো হয়ে গেছে।খোল এটা!ওই ক্ষমা কর না!

-ধুর আবার এক কথা!
আর কথা বাড়ালাম না, চোখ বুঝলাম।একবার হাতে রাখা “ওর” ছবিটা দেখে চোখ বুজলাম।ও, কেউ না , শ্রীনন্দা, আমার শ্রী।

শ্রী কে যখন প্রথম দেখি, ঠিক মনীন্দ্র কলেজটার পাশে তিনটে ছেলের সাথে বসে, হাতে সিগারেট নিয়ে।একটু করে টানছে, আর কেশে যাচ্ছে।পাশের ছেলেটা একবার ওর মাথায় হাত দিল।এক ঝটকায় হাত সরিয়ে দিলো।দেখেই হেসে ফেললাম। হাসির শব্দে পেছন ফিরে তাকালো ও।একটা গোলাপি রঙের চুড়িদার পরা।সারা মুখে খুব হতাশার চিহ্ন, কিন্তু চোখ দুটো খুব টানা।যেন অনেকটা সারাটা দিন মাঠে কাজ করার পর, গাছের ছায়ায় বসলে যেমন লাগে।এই চোখের মানুষটা কে যেন হৃদয়ের সব কথা উজাড় করে দিতে হয়।

-এই যে তোমায় ডাকলাম

আবার কথাটা কানে আসতেই আকাশ কুসুম চিন্তায় ছেদ পড়ল।সামনে যখন দাঁড়ালাম, পুরো আপাদমস্তক দেখে বলল,

-পাঞ্জাবী পরা বাবু, হাসলেন যে?
বললাম,
-না, আসলে আমি না যেটা পারি না, সেটা লোক দেখাতে চেষ্টাও করি না।
রেগে গিয়ে বলল,
-মানে? কী বলতে চাইছ?
বললাম,

-এই ধরুন আমি দুঃখ পেলে চুপ করে থাকব, কাঁদতে পারি না তাই, কিন্তু লোক দেখিয়ে কাঁদব না।আনন্দে হাসব, প্রাণ খুলে হাসব।তেমনি আপনি…

-শোনো মিস্টার…
মুখের কথা শেষ না হতেই ভেতর থেকে কে যেন ডাকল “শ্রী, ভেতরে আয়”।
চলে গেল “শ্রী”, দিয়ে গেল মুঠোভরা ভালোলাগার শিউলিফুল।

আবার দেখলাম ওকে কাছ থেকে, যেদিন সরস্বতী পুজো ছিল কলেজে। এক কোনে দাঁড়িয়ে।আজ সালওয়ার, তবে কালো, চুলটা কোনোরকমে বাঁধা।কপালে দুটো ভুরুর মাঝে একটা ছোট্ট টিপ।ব্যাস সারা মুখটা যেন সূর্য এসেও ঢাকতে পারবে না তার আলোতে।পাশে গিয়ে বললাম,

-এখানে যে?
বলল,
-তুমি? যাও অঞ্জলি দেবে না?
বলল,
-না, দিই না।
আবার বললাম,
-বাইরে যাবে?
পুরোটা দেখে বলল,
-এর পর কফিতে নাকি?
বললাম,
-আমি চা খাই।

হেসে ফেলল শ্রী।বাইরে বেরিয়ে রাস্তা পেরিয়ে ও পারে গিয়ে বসলাম একটা চায়ের দোকানে।দুটো চা নিয়ে শুরু করলাম কথা।

-তুই বলি?
বলল,
-প্লিস বল, তুমিটা জাস্ট!!!
বললাম,
-আমি রাহুল, রাহুল সেন।তুই?
-শ্রীনন্দা মুখার্জী,বন্ধুরা শ্রী বলে।
আমি বললাম,
-আমিও বলি তাহলে?
বলল,
-না তুই শত্রু নোস আমার।
হেসে ফেললাম।বললাম,
-কলকাতার কোথায় থাকিস?
-মানিকতলা,এমনি বাড়ি আমাদের বোলপুর।
বললাম,
-মা, বাবা এখানে না ওখানে কেউ আছেন?
-বাবা এখানে, মা নেই।
একটু থেমে নিজেই বলল,
-তোর?
-বাগুইহাটি।
বলল আবার,
-কে কে আছে?
-মা আর দাদা, বাবা নেই।সেই দু বছর…
আর শুনল না।বলল,
-মার ফটো দেখাবি?

ফোনে ছিল একটা ফটো।দেখল অনেকক্ষন, একটু হাত বুলিয়ে স্ক্রিনে বলল,

-খুব সুন্দর দেখতে।আচ্ছা আসি।

ছুট্টে পালিয়ে গেল।বড্ড ভালো লাগলো আমার।অনেকদিন পর মনে হলো, মায়ের পর মেজাজ দেখানোর লোক খুঁজে পেলাম।

দেখা হতো শ্রী এর সাথে প্রায়।আর্টস নিয়ে পড়ত, আর আমি কমার্স।সুযোগ পেলেই ক্যান্টিনে বসতাম চা আর সিঙ্গারা নিয়ে।জানলাম ওকে, মায়ের একসিডেন্ট আর বাবার কর্মব্যস্ততার কথা।ওর বাবা একটু বেশী ব্যবসা নিয়ে ব্যস্ত।বাড়িতে নিজের বলতে দাদু আর ঠাকুমা।

আস্তে আস্তে বদভ্যাস হয়ে গেছিল মেয়েটা।আমার বাড়ি যখন আসত, মায়ের সাথে সাথে রান্না ঘরে ঘুরত,গল্প করত,যখন বলতাম,

-বাড়ি যাবি না?
দুজনে একসাথে বলত,
-তুই বেরো বাড়ি থেকে।
একদিন বলেই ফেললাম,
-শ্রী কাল ১৪ তারিখ।
-তো? আজ ১৩, কাল তো ১৪ হবেই!!
বললাম,
-আঃ, ভ্যালেন্টাইন..
শেষ হতে দিল না, বলল,
-কোনো মেয়ে পেলি?

এবার হাতটা ধরলাম ওর।বললাম,

-দেখ ট্রিপিকাল প্রপোজ কাকে বলে জানি না।শুধু জানি তুই ছাড়া কিছু বুঝি না।তোকে ছাড়া চা খেতে ভালো লাগে না।তোর জন্য শুধু আমিই সিগারেট কিনব।পছন্দের সিনেমাতে হাসতে হাসতে কাঁধ জড়িয়ে ধরবি।টিপটা যখন কপালের ঠিক মাঝখান থেকে নীচে নেমে আসবে, শুধু আমি ই তুলে দেব।একসাথে পুকুরের পারে পা ডুবিয়ে বসে থাকব ঘন্টার পর ঘন্টা।তোর চোখে জল আটকাতে পারব কিনা জানি না, শুধু আমি থাকলে তোকে কাঁদতে দেব না আর।তোকে…

মুখে এবার হাত চাপা দিয়ে হাতের ওপর একটা চুম্বন দিয়ে বলল,

-পাগল একটা।

পালিয়ে গেল ঘর থেকে, শুধু অনেকটা বড় হয়ে গেলাম আমি।
এবার আর কি!সবার মত আমার গল্পেও প্রেমপর্ব শুরু হলো।কিন্তু ওই যে কতদিন আর খালি পেটে প্রেম হবে?কলেজ শেষের রেজাল্টটা হাতে নিয়ে ওর সাথে দেখা করতে এলাম।আজ কিন্তু ফ্যাকাশে মুখ পুরো।বলল,

-ছেড়ে যাবি না তো মায়ের মত?

একটু বুকে জড়িয়ে বাড়ি চলে এলাম।খুব চেষ্টা করেছিলাম জানেন, একটা কাজের জন্য।ওর বাড়িতে এবার বাবা চাপ দিতে শুরু করল।রোজ কিছুনা কিছু আমি ইন্টারভিউ দিতাম।এমনই একদিন ময়দানের কাছে যখন নামলাম, মেসেজ করলাম ওকে,

-পৌঁছে গেছি,জানাব বেরিয়ে।

পেয়ে গেলাম চাকরীটা।৯০০০টাকা মাইনে, এসিস্টেন্ট স্টোর কিপার আপাতত।বাড়ি এসে বললাম ওকে। খুশিতে চিৎকার করে,

-রাহুল নিয়ে যা এবার এখান থেকে।
অনেক সাহস নিয়ে মাকে নিয়ে গেছিলাম কথা বলতে।না , মানে নি, ওর বাবা!শ্রী টাও বড্ড জেদী, শেষমেশ বাবাকে মানিয়ে আমার ঘাড়েই ঝুলল।ফুলশয্যার দিন ওকে জড়িয়ে ছিলাম অনেকক্ষন।বললাম,

-তুই সঙ্গে থাকলে দেখিস অনেকটা বড় হবো খুব তাড়াতাড়ি।
বলল,
-এবার জন্মদিনে একটা জিনিস দিবি?
বললাম,
-কী?
বলল,
-তুই?
হেসে বললাম,
-পাগলী, আমিটা তোরই।যেখানেই থাকি জন্মদিনটা শুধু তোর।
সেদিন খুব বৃষ্টি, ছাতা নিতে ভুলে গেছিলাম।মোড়ের মাথায় ছাতা নিয়ে দাঁড়িয়ে আমায় ফোন করে,
-বাবু, বাস স্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে।কোথায় বাস এখন?খুব বাজ পড়ছে।

নেমে দেখলাম, জায়গাটা লোকে লোকারণ্য।পুড়ে গেছে অনেক জায়গা।বাস স্ট্যান্ডটাও ঝলসে গেছে..সঙ্গে…হাতের সোনার আংটিটা কালো হয়ে গেছে।

ওর আর সৎকার করতে পারলাম, কী আর করব।না কাঁদিনি, কাঁদতে বারণ করত তাই।
ঠিক এক মাস পরেই হবে, অফিসের জন্য সিঁড়ি দিয়ে নামতে যাব, আচমকা কেউ খিমচে ধরল যেন!একটু না অনেকটা ভয় পেলাম।জামাটা গুঁজেছিলাম, ধরে টান মারতেই একটা বোতাম খুলে পড়ল।কিছু বোঝার আগেই দেখি আমি মাটিতে।বড্ড বাঁচলাম, কিন্তু কে টানল??কাউকে বলতে পারছিলাম না আসলে!কদিন ধরেই না এটা হচ্ছে। বাথরুম যেতাম, বেরিয়ে দেখি জামা রেডি, ঘড়ি, মোবাইল সব গুছিয়ে রাখা।হয়ত আমিই করেছি মনে হত!কিন্তু রোজ রোজ! খাবার টেবিলে মনে হত কেউ দেখছে আমায়।দুটো রুটি দুধ দিয়ে খেয়ে উঠে যেতাম।কিছু ভালো লাগত না।খুব কাঁদতে ইচ্ছে করত, সিগারেটের প্যাকেট থেকে বার করে যতবার জ্বালাতে যাব, নিভে যেত আপনা আপনি।বুঝতে পারতাম কিছু।নীচে মা আর দাদা, আর ওপরে আমি থাকতাম আর এই অদ্ভুত অনুভুতি গুলো।একদিন কোল বালিশটা ধরে ঘুম আসছে না।উসখুস করছি, হঠাৎ হাতে একটা স্পর্শ পেলাম।ছ‍্যাঁত করে উঠল বুকটা, বললাম সাহস করে,

-শ্রী তুই?
দমকা হাওয়াটা থেমে গেল।একটা কান্নার আওয়াজ পাচ্ছি যেন।বললাম,
-আচ্ছা কাঁদিস না, একবার কাছে আয় বাবু।কতদিন জড়িয়ে শুই না।

কিছু একটা হাওয়া বয়ে গেল শরীরে।তারপর থেকে একটু একটু করে ভালো হতে থাকলাম আমি।বেরোতাম যখন কাজে, টাটা করতাম পেছন ফিরে।মা দেখত শুধু।রাতে খাবার সময় খেতে খেতে কথা বলতাম।টিভি দেখতাম আর গল্প করতাম , হাসতাম।মা আর দাদা কেন জানি না , আর বেশি কথা বলত না।কিছু বললেই, চোখ মুছত শুধু ।
একদিন নিয়ে এল দাদা এই রাজারহাটের কাছে একটা বাড়িতে।একটা ডাক্তারের সাথে একটু কথা বললাম।বলল ওরা,
-কিছুদিন আউটিংয়ে নিয়ে যাব, মন ভালো হয়ে যাবে দেখিস।

সেই মত রোজ তৈরি হয়ে বসি।মাঝে মাঝে যন্ত্রনা হলে ওরা ওষুধ দিয়ে যায় নাহলে “শক “দেয়।বড্ড কষ্ট হয়।মুখ দিয়ে লাল পড়তে থাকে।শ্রী কে দেখি তখন, ও এসে কথা বলে যায়।সেই কলেজ ক্যাম্পাসে যেমন ছিল একদম হুবহু।শুধু দেখি, খুব কষ্টে আছে ওর চোখ দুটো।ক্ষমা চায় রোজ আমার কাছে।একাই করে দিল আমার শ্রী, আমার সাথীয়া…

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত