।।এক।।
অন্যদিনের মতনই আজও বিনা নোটিশে ঝুপ করে সূর্যটা ডুবে গেল। অমনি কালুর বাগানের ঝাঁকড়া ঝাঁকড়া আম, কাঁঠাল আর লিচুগাছগুলোর মাথার ওপর দিয়ে গড়িয়ে এসে সন্ধে নামল মাঠের ওপরে। কাজেই আজও খেলার নিষ্পত্তি হল না। মাত্র দশ ওভার করে খেলা। তবুও সেই ড্র বলেই মেনে নিতে হল ম্যাচটা। বুকানটা চিরকালের কুচুটে। আর পিকাইও কম যায় না কোনওমতেই। দু’জনের বন্ধুত্বও যেমন গলায় গলায়, বিচ্ছুমিতেও এক্কেবারে সমান সমান। টসে জিতে ব্যাটিং নিয়েছিল রিয়ানরা। তাদের মাঠের এটাই রীতি অবশ্য। যারাই টস জেতে তারাই আগে ব্যাটিং করে নেয়। পরে ব্যাটিং নিলে ব্যাপারটা বেশ চাপের। শেষের দিকে জমিয়ে ব্যাট করার মতন সময়ই পাওয়া যায় না। বলা নেই কওয়া নেই, আকাশ আঁধার করে সন্ধে। আলো দ্রুত কমে আসে তখন। আর আলো কমে এলে ম্যাচ বের করাটাও বেশ কঠিন। একটু জোরে বল এলে ভালো করে দেখাই যায় না। আনতাবড়ি ব্যাট চালিয়ে উইকেট ছুড়ে দিয়ে আসতে হয়। এই করে কালই বুকাইদের কাছে হেরে বসেছে তারা।
আজ প্রতিশোধ নেবে ঠিক করে নিয়েই মাঠে নেমেছিল রিয়ান। ইচ্ছে করেই আজ আর টিম পালটানো হয়নি। কপাল ভালো ছিল। টসটায় দিব্যি উতরে গিয়েছিল। প্রথম ব্যাট করে রানটাও খারাপ হয়নি। সে নিজে ন’রানের বেশি করতে না পারলেও টিম একশো পার করে দিয়েছিল দশ ওভারে। পরে ব্যাট করতে নেমে বুকানরা তখন রীতি মতন ধ্যাড়াচ্ছে। সাত ওভারে মাত্র একাত্তর। তিন ওভারে তখনও চৌত্রিশ রান বাকি। হাতে উইকেট বলতে বুকাই নিজে আর দিব্য, ঘোঁতন। তার মধ্যে দিব্যটা তো ভালো করে ব্যাট ধরতেই জানে না। ম্যাচ হাতের মুঠোয়। এমন সময় আম্পায়ার পিকাইয়ের কাছে কম আলো বলে খেলা বন্ধের আবেদন করে বসল বুকাই। পিকাই তো ওরই দলের। নিজে রানও করতে পারেনি। জানে হারবে। ম্যাচ বাঁচানোর এইটাই ভালো মওকা।
রিয়ান চেঁচিয়ে বলল, “মোটেই আলো কম নেই এখন। তিন ওভার দিব্যি চালিয়ে নেওয়া যাবে।”
“তা বললে তো চলবে না,” পিকাই বিচ্ছিরি মুখ করে হেসে ওঠে, “ব্যাটসম্যান আবেদন করেছে যখন আমাকে ব্যাপারটা সরেজমিনে তদন্ত করে দেখতেই হবে।”
“কী তদন্ত করবি তুই এখন? তোর হাতে কি লাইট-মিটার আছে?” ব্যাজার মুখে বলে রিয়ান।
“তা থাকলে তো হয়েই যেত।” পিকাই বলে, “আমি যে আম্পায়ার। আমাকে নিরপেক্ষ হতেই হবে। নইলে খেলার স্পিরিটটাই নষ্ট হয়ে যাবে।”
“তাহলে কী করতে চাইছিস তুই?”
“আমি নিজে ব্যাট করে দেখতে চাই বল কতখানি স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।”
“ক’টা বল?”
“ছ’টা।”
“অ্যাঁ?”
“হ্যাঁ। ছ’টা বল। অন্তত ছ’টা বল না দেখে আমি সিদ্ধান্ত নিতে পারব না।”
“তাতে তো আরও সময় চলে যাবে!”
“গেলে কী করা যাবে। আমাকে তো শিওর হতে হবে ব্যাপারটা।”
ব্যাজার মুখে পাপ্পুর দিকে বলটা ছুড়ে দিল রিয়ান। “নে, বল কর। ছুটে এসে বল করতে হবে না। উইকেটের কাছে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বল কর।”
পাপ্পু ওদের টিমে সবচেয়ে কম জোরে বল করে। ওর বল অন্ধকারেও দেখতে পাওয়া উচিত। তবুও ইচ্ছে করে তার বলগুলো মিস করার জন্যে বল ছেড়ে হাওয়ায় ব্যাট চালাল পিকাই। তারপর ছ-ছ’খানা বল খেলার পরে অসভ্যের মতন মুখ করে বলে উঠল, “না রে, বল দেখতে অসুবিধেই হচ্ছে।”
“কক্ষনও না,” রিয়ান প্রতিবাদ করে ওঠে, “তুই ইচ্ছে করে বলগুলো ব্যাটে কানেক্ট করিসনি।”
ওর কথাতে কানই দিল না পিকাই। ডানহাত দিয়ে পট পট করে মাটি থেকে উইকেটগুলো উপড়ে ফেলে দিয়ে জানিয়ে দিল, “ম্যাচ ড্র। খেলা অমীমাংসিত।”
বাড়ি ফিরে এসেও মনটা বেজায় বিগড়ে ছিল রিয়ানের। খেলায় হার-জিত আছে। একপক্ষ জিতবে আর এক দলের হার, এই তো নিয়ম। কাল তো তার টিমই হেরে গেছে। কিন্তু তাই বলে খেলার মাঠে এমন চোট্টামি করবে কেন বুকানরা? দাওয়ায় মাদুর পেতে পড়তে বসতে বসতেই মনে মনে ঠিক করে ফেলল রিয়ান যে ব্যাপারটা কালই করিমদাদুকে জানাতে হবে।
করিমদাদু তাদের গ্রামে খুব বিখ্যাত মানুষ। সক্কলে ভীষণ ভালোবাসে তাঁকে। করিমদাদু কবিরাজি করেন। সূর্য ভালো করে ঘুম থেকে ওঠার আগেই করিমদাদু উঠে পড়েন রোজ। বাগান থেকে নিমের ডাল ভেঙে দাঁতন করে মুখ-টুখ ধুয়ে নিজের ঘরের কাজকর্ম সেরে রেখে বেরিয়ে পড়েন এ-গঞ্জে সে-গঞ্জে। রান্নাবান্না মাজাঘষা সবই তাঁকে রোজ নিজের হাতেই করতে হয়। উপায় কী? করিমদাদুর নিজের লোক বলতে কেউ নেই যে। গ্রামে কেউ কেউ এমন প্রস্তাব দিয়েছিল যে পালা করে একেক দিন একেক বাড়ি থেকে তাঁর জন্যে খাবার পাঠানো হবে, কিন্তু করিমদাদু রাজি হননি। মিষ্টি করে হেসে বলেছেন, “স্বাবলম্বী হবার জন্যে ঘর ছেড়েছি। সেই কোন ছোট্টবেলা থেকে পথের জীবন বেছে নিয়েছি। শুধু নিজে নিজের কাজ করে নেব এইটুকু তো নয় বাপু, আমি চাই সকলেই স্বনির্ভর হোক। কর্মঠ হোক। দেশকে ভালোবাসুক প্রাণ দিয়ে। আর নিজের দেশ নিজের মাটির গৌরব বৃদ্ধিতে যত্ন করুক মনপ্রাণ ঢেলে দিয়ে।”
করিমদাদু যখন এইসব কথা বলেন, তাঁর দু’চোখ জ্বলজ্বল করে ওঠে। আলো হয়ে ওঠে সারা মুখ। কোনওদিন তিনি বেরোন নানানরকম গাছপালা জড়িবুটির সন্ধানে, কোনও কোনওদিন আবার সেই গাছাপালা দিয়ে তৈরি করা ওষুধ বিক্রি করার জন্যেও বেরোন তিনি। মাঝে মাঝে করিমদাদু দু-তিন মাসের জন্যে বেপাত্তা হয়ে যান। কোথায় যে যান কে জানে! প্রথম প্রথম লোকে নাকি বলাবলি করত করিমদাদু মানুষটার গতিবিধি সন্দেহজনক। লোকটার কোথায় বাড়ি, কী মতলবে এই গ্রামে এসে বাসা বাঁধল কেউ জানে না। দিনকাল তো ভালো নয়, কার যে মনে মনে কী কু-অভিসন্ধি তা বাইরে থেকে তো আর বোঝার জো নেই। কিন্তু যতই দিন কাটতে লাগল ততই এই মানসিকতা ফিকে হতে হতে এক্কেবারে মিলিয়ে গেল। সক্কলে একবাক্যে স্বীকার করে, করিমদাদু এই গঞ্জের সম্পদ। অমন মানুষ আরও আগে যদি এই গ্রামে আসতেন তাহলে গ্রামটা আরও আগেই পালটে যেত অনেকখানি।
ছোটদের সঙ্গে বেজায় ভাব করিমদাদুর। তারাই তাঁর সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু। সুযোগ পেলেই তাদের সঙ্গে গল্পে মেতে ওঠেন মানুষটা। নানান গল্প বলে তাদের বোঝান ন্যায়ের পথে থাকা, সত্যের পথে থাকা কতখানি জরুরি। যখন চোখ বুজিয়ে গাঢ় গলায় তিনি বলতেন, “সত্যভ্রষ্ট হয়ে বেঁচে থাকাটা একটা মস্ত অভিশাপ, জানিস তো ভাই।” তখন রিয়ানদের বুকের মধ্যেটা আবেগে কেঁপে কেঁপে উঠত। মনে মনে শপথ নিয়েছিল প্রত্যেকেই তারা সত্যকে ছেড়ে থাকবে না কোনও সময়েই। তেমনভাবেই তো চলছিল তারা। শুধু তারা নয়, এই গ্রামের বড়োরাও। এখানে কেউ কাউকে হিংসে করে না, কেউ কারও নিন্দে করে না, কারও সাফল্যে অন্যের মুখে আঁধার নামে না এতটুকু। তবে? আজ বুকানরা এমন করে হারিয়ে দিল কেন তাহলে রিয়ায়ানদের? বুকের মধ্যে খুব কষ্ট হচ্ছিল রিয়ানের। যতটা না খেলায় হারার জন্যে, তার থেকেও বেশি বুকান পিকাইদের এই চোট্টামোর জন্যে। ওরা দুম করে শপথ ভুলে গেল কী করে? রাধানগরে গত পাঁচ-ছ’বছরে কেউ তো অন্যায় যুদ্ধে কাউকে হারানোর কথা ভাবেনি! করিমদাদুকে সবকথা বলা দরকার। করিমদাদুর এইসব জানা খুব দরকার, খুবই দরকার।
পড়ার বইতে আজ আর কিছুতেই মন বসছিল না রিয়ানের। একটা চাপা উত্তেজনা টের পাচ্ছিল সে মনের মধ্যে। একটা অদ্ভুত অস্বস্তিও। তবুও বই বন্ধ করে উঠে যাবারও জো নেই। পড়াশোনায় মন না দিলে মা ছেড়ে কথা বলবে না। তাছাড়া কাল স্কুল আছে। ক্লাশে পড়া না পারলে কেলেঙ্কারি ব্যাপার হয়ে যাবে। পড়াশোনায় ভালো বলে রিয়ানের একটা বাড়তি সম্মান আছে ক্লাশে। সেটা একেবারে জোর টাল খেয়ে যাবে। মনটাকে খুব শাসন করতে লাগল রিয়ান।
যে সময় পড়ায় মন বসতে চায় না, রিয়ান সেই সময় লেখার কাজ করে। এখনও সে বাংলা রচনা আর ইংরেজি কমপ্রিহেনসনের হোমওয়ার্কগুলো সেরে ফেলল। তারপরে অঙ্ক বই খুলল সে। ঝটপট কষে ফেলতে লাগল অঙ্কগুলো। অঙ্কগুলো একবারে মিলে গেলে ভারি আনন্দ হয় তার। মনে হয় অঙ্কগুলো যেন তার কাছে গো হারা হেরে গিয়ে মুখ নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে।
ক্রমশ পড়াশোনার মধ্যে ডুবে গিয়ে অঙ্কগুলো দ্রুত মিলিয়ে ফেলছিল আজ রিয়ান। সন্ধেবেলার মনখারাপ ভাবটা কেটে গেছে অনেকখানি। রাত বেড়েছে। বাইরে একটানা ঝিঁঝিঁ ডাকছে। বাঁশবাগানে কঞ্চিতে কঞ্চিতে ঘষা লেগে কট কট করে আওয়াজ ঊঠছে। কোথাও কোনও একটা গাছে বসে চ্যাঁ চ্যাঁ করে পেঁচা ডেকে উঠল। মায়ের রান্না শেষ হয়ে গেছে। সেই সময়েই রিয়ানের ঠাকু্রমা তার মায়ের উদ্দেশ্যে হাঁক পাড়লেন, “বৌমা, তোমার হাতের কাজ শেষ হল?”
মা আঁচলে হাত মুছতে মুছতে এগিয়ে এসে ঘরের হ্যারিকেনের পলতেটা আর একটু উসকে দিয়ে বলে উঠল, “হ্যাঁ, মা। এবার তাহলে আপনাদের খেতে দিয়ে দিই?”
“তা দাও,” ঠাকুরমা মায়ের কথায় মাথা নেড়ে সায় দিয়ে বলে ওঠেন, “কিন্তু নিশিকুটুমের ভোগটা মনে করে দিয়েছ তো? নইলে সে বেচারি রাতে-ভিতে হয়তো এসে কিচ্ছুটি না পেয়ে মন খারাপ করে ফিরে যাবে। তখন তার দীর্ঘশ্বাসে গেরস্থের অকল্যাণ।”
“দিয়েছি, মা।”
“কী দিলে আজ?”
“বিকেলে আপনার ছেলে বাগান থেকে খান কতক লাউ কেটে এনেছিল, তার একখানা। সঙ্গে একছড়া চাঁপা কলা।”
“আচ্ছা, ঠিক আছে।” ঠাকুরমা খুশি হয়ে বলেন।
মা খাবার বাড়ার তোড়জোড় করতে করতেই রিয়ানের দিকে ফিরে স্নেহের সঙ্গে বলে, “আজ উঠে পড়, রিয়ান। আবার কাল ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে পড়তে বসিস।”
।।দুই।।
রাত একটু ঘন হয়ে আসার পরে বিছানা থেকে গা তুলল ঘনশ্যাম। চোখেমুখে জলের ঝাপটা দিল কয়েকবার। রান্না চড়াল। রান্না মানে গরম ভাতের সঙ্গে আলু, ডিম আর কিছু সবজি। এটুকু করতেই অবিশ্যি বেশ সময় লেগে গেল। আজকাল হাত-পায়ের গতি কমে গেছে। জ্যোতি কমে গেছে চোখের। অথচ তার কাজকম্মে চোখের জ্যোতিটা বড়োই দরকারি। রাতের অন্ধকারে দুর্বল চোখে জিনিসপত্তর কি আর ঠাওর করা যায় ঠিক মতন? অথচ উপায়ও নেই তার। দিনের আলোয় তার ফায়দা নেই। ঘনশ্যামের কাজটা চিরকাল রাত্তিরবেলাতেই। নিশুত রাতে গেরস্ত হতক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়লে তবেই তার ব্যাবসাবাণিজ্য শুরু হয় প্রতিদিন। একসময় আশেপাশের দু-দশটা গ্রামগঞ্জ একেবারে চষে ফেলেছে সে। চোর হিসেবে যে নামডাক আর সম্ভ্রম সে-সময় ঘনশ্যাম অর্জন করেছিল অন্যেরা তার ধার পাশ দিয়েই যেতে পারেনি কোনওদিন। তার জন্যে বয়েসকালে অবশ্য বিস্তর পরিশ্রম করতে হয়েছে তাকে। ভালো গুরু ধরে বছরের পর বছর ধরে বিদ্যেটাকে একেবারে নিখুঁত রপ্ত করেছে ঘনশ্যাম। গেরস্ত বাড়িতে ঢুকলাম আর মালপত্তর সাফা করে দিলাম, কাজটা তো সত্যি বলতে এমন মোটা দাগের নয়। এই কাজেও শিক্ষিত হাতের আলাদা কদর আছে। সমঝদার মানুষ দেখলেই বুঝতে পারবে কোন কাজ আনতাবড়ি এলেবেলে হাতের আর কোন কাজে সত্যিকারের গুণী শিল্পীর ছোঁয়া লেগে আছে। ঘনশ্যাম আদপে শিল্পী। অতি উচ্চমানের শিল্পী একজন। চুরিটাকে এমন সুন্দর আর মহিমামণ্ডিত এই এলাকায় আর কোনও চোর এ যাবত করে উঠতে পারেনি।
একসময় পাশের গ্রামে থানার বড়োবাবু হয়ে এসেছিলেন ব্রজেন তালুকদার। বেজায় রাশভারী আর রাগী প্রকৃতির মানুষ। সুন্দরবনের দিকে যখন পোস্টিং ছিল, তাঁর কথায় বাঘে-হরিণে একঘাটে এসে জল খেত। হরিণদের দিকে বাঘেরা চোখ তুলে তাকাতেই সাহস পেত না। গভীর জঙ্গলে মধু সংগ্রহে গিয়ে বাঘের খপ্পরে পড়ে বহু লোক নাকি শুধু ব্রজেন দারোগার নাম শুনিয়ে বাঘ ভাগিয়ে গঞ্জে ফিরে এসেছে অক্ষত শরীরে। ব্রজেন দারোগা নিজে বলে বেড়াতেন, সুধন্যখালির জঙ্গলে একবার একটা বাঘ তাঁর মুখোমুখি পড়ে গিয়েছিল আচম্বিতে। ব্রজেনকে দেখে রয়েল বেঙ্গলটা এমন ঘাবড়ে গিয়েছিল যে দাঁতে দাঁতে খটখটি লেগে যায় তার। এমনকি ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে বেচারা বাঘটার একখানা দাঁতই নাকি খুলে পড়ে যায়। সে দাঁতটা কুড়িয়ে এনে সোনার চেনে বেঁধে নিজের গলায় ঝুলিয়ে নিয়েছিলেন ব্রজেন। এখনও তাঁর গলায় ঝোলে সেই দাঁতটা। এই গল্প শোনানোর সময় প্রত্যেকবার চেনসুদ্ধু দাঁতটা জামার ভেতর থেকে বাইরে এনে সক্কলকে দেখান তিনি আর বলেন, “হুঁ বাবা, আমার সঙ্গে চালাকি নয়। বাঘ আমার প্রতাপ সহ্য করতে পারল না, তোরা তো কোন ছার।”
“ঠিক ঠিক,” সকলেই মাথা নেড়ে সায় দেয় তাঁর কথায়, “আপনি এখানে আসার পর থেকে এলাকায় চুরিচামারি তো প্রায় বন্ধই হয়ে গেছে, বড়োবাবু। কে আর সাধ করে আপনার সঙ্গে টক্কর দিতে যাবে বলুন।”
“তবে হ্যাঁ, আমায় দেখে ভয় পেয়ে ওই যে সেই বাঘটার একখানা কাঁচা দাঁত ফস করে খুলে এল মাড়ি থেকে তাতে আমার একটা মস্ত লাভ হয়ে গেল।” ব্রজেন বলেন খুশি খুশি মুখ করে।
“কীরকম, বড়োবাবু?” আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করে কেউ কেউ।
“সেই ঘটনার পরেই তো সরকারের টনক নড়ল।”
“কেন?”
“টনক নড়বে না, বলিস কী রে?” ব্রজেন চোখ পাকিয়ে বলেন, “সুন্দরবনে মানুষের চেয়েও বাঘের জীবনের দাম ঢের ঢের বেশি বাপু। না খেয়ে যদি মানুষ মরে যায়, কিংবা ধর মানুষের ন্যূনতম চাহিদা হয়তো সরকার মেটাতে পারল না, তাতে কোনও অসুবিধে নেই, কিন্তু বাঘেদের সুবিধে অসুবিধে নিয়ে বনদপ্তর সদা সতর্ক। তাদের স্বাচ্ছন্দ দিতেই হবে। কাজেই আমি ওখানে থাকা মানে তাদের লাইফ রিস্ক। অতএব আমার বদলির অর্ডার হয়ে গেল সাত তাড়াতাড়ি।”
“আপনি বেঁচেই তো গেলেন, বড়োবাবু। ওই জঙ্গুলে জায়গা। আলো নেই, গরমের দিনে রাতে মাথার ওপরে পাখা নেই…”
“সে আর বলতে।” ব্রজেন সায় দেয়, “কিন্তু যাই বলিস, ওখানে সবজিটা বড়ো টাটকা মিলত রে। তাছাড়া নদীর মাছ আর ইয়া বড়ো বড়ো চিংড়ি… কিছুই কিনতে হত না। পুলিশের প্রতি মানুষের ভক্তিভাবটা যাই বলিস বাপু, ওদিকে বরাবরই একটু বেশি।”
ব্রজেন দারোগার সবকথাই যে মানুষে বিশ্বাস করত তা নয়, তবে লোকটার দাপটটাকেও কেউ চট করে অবিশ্বাস করত না। চুরি-ডাকাতি বন্ধ না হলেও তার আমলে কমেছিল খানিক এ-কথা সত্যি।
এ-হেন ব্রজেন তালুকদারের বাড়ি রীতি মতন চ্যালেঞ্জ করে চিঠি দিয়ে আগেভাগে দিনক্ষণ জানিয়ে রেখে চুরি করেছিল ঘনশ্যাম। ব্রজেন দারোগা ঘনশ্যামের টিকিটুকুও ছুঁতে পারেননি। ঘনশ্যামের যে এলেম আছে তা সকলের সামনে স্বীকার করে নিতে বাধ্য হয়েছিলেন ব্রজেন। বুক ফুলিয়ে বলেছিলেন, “গুণী লোকের কদর করতে আমি কোনওদিন পিছ-পা হই না।” তারপর একদিন নিজে লোক পাঠিয়ে ঘনশ্যামকে বাড়িতে ডেকে এনে চর্ব-চোষ্য-লেহ্য-পেয় রান্না করিয়ে পেট পুরে খাইয়েছিলেন ব্রজেন। নিজের হাতে সার্টিফিকেট লিখে উপহার দিয়েছিলেন তাকে। ঘনশ্যামকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলেন, “তুমি সত্যিই গুণী মানুষ হে ঘনশ্যাম।”
ঘনশ্যামও আহ্লাদে আটখানা হয়ে মাটিতে গড়াগড়ি দিয়ে পেন্নাম করেছিল তাঁকে। চুরির সব মাল ফেরত দিয়ে কথা দিয়েছিল তাঁকে, “হুজুরের এলাকায় আর কখনও চুরি করব না এর পর থেকে।”
তা সত্যি বলতে কী, করেওনি ঘনশ্যাম। কাজ-কারবার যা করেছে তা দূরে দূরে। ব্রজেন দারোগার এক্তিয়ারের বাইরের অঞ্চলে।
এমন করিতকর্মা আর শিল্পী মানুষকে নিয়ে এলাকার লোকের গর্ব থাকাই স্বাভাবিক। কাজেই ঘনশ্যামকে নিয়েও ছিল। গ্রামের মানুষ বুক বাজিয়ে ঘনশ্যামের প্রশংসা করত সেই সময়ে। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিস্থিতি পালটাল। ঘনশ্যামের বয়েস বাড়ল। এলাকার মানুষের পাকা বাড়ি, কংক্রিটের ছাদ-মেঝে হল। বাড়ির সামনে কারুকার্য করা গুমগড় লোহার গেট বসল। তাতে ঘনশ্যামের পক্ষে কাজটা অসম্ভব হল না ঠিকই, কিন্তু পরিশ্রমের তো হল। আর পরিশ্রমের ক্ষেত্রে তার বয়েসটা খুব একটা আর সঙ্গ দিতে চাইল না তাকে। ঘনশ্যাম খুব মনমরা হয়ে থাকত সবসময়। তাছাড়া পেট বলে তো একটা বস্তু আছে। তাকে তো সময়ে সময়ে তেল-কয়লা দেওয়া চাই। শেষপর্যন্ত করিমদাদুই গ্রামের আর পাঁচজনের সঙ্গে কথা বলে ঘনশ্যামদাদুকে পাশে বসিয়ে একটা বিলিবন্দোবস্ত করলেন। দু’বার গলাখাঁকারি দিয়ে খুব গম্ভীর ভারিক্কি গলায় বললেন, “শোনো ঘনশ্যামদাদা, তুমি হলে গিয়ে এলাকার একজন মান্যিগন্যি গুণী মানুষ। তোমার দেখভাল করাটা আমাদের দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে।”
বাকিরাও তাঁর কথায় সায় দিয়ে ঘাড় নেড়ে বলে উঠলেন, “ঠিক ঠিক।”
পঞ্চানন পাইক সদ্য নেতা হয়েছেন। পার্টিতে বেশ দহরম মহরম চলছে আর একটু বড়ো নেতাদের সঙ্গে। সামনের ইলেকশনে পঞ্চায়েতের প্রধান হওয়ার দৌড়ে প্রথমেই তাঁর নাম। লোকটা করিতকর্মা সন্দেহ নেই, তবে এলাকার মানুষ আড়ালে বলে কোথায় কী কথা বলা উচিত আর কোন কথা পেটের মধ্যে লুকিয়ে রাখতে হয় এ-বিষয়ে পঞ্চানন নাকি বড়োই কাঁচা। তাছাড়া সভা-টভার সময় প্রতিশ্রুতি দেবার সময় তাঁর নাকি লাগাম থাকে না। পঞ্চানন প্রতিশ্রুতি দেওয়া শুরু করলেই সঠিক সময়ে তাঁকে মোবাইলে মিসড কল দিয়ে সতর্ক করে দেওয়ার জন্যে সবসময় মঞ্চের পাশে লোক ঠিক করে রাখতে হয়। ব্যাপারটা বাড়াবাড়ির পর্যায়ে যাবার আগে তারাই নাকি কায়দাকানুন করে থামিয়ে দেয় পঞ্চাননকে।
পঞ্চানন বলে উঠলেন, “আমি শীর্ষ নেতৃত্বের সঙ্গে কথা বলে দেখব ঘনশ্যামকাকাকে যাতে সরকারের পক্ষ থেকে একটা তস্করশ্রী পুরস্কার পাইয়ে দেওয়া যায়। তাতে এককালীন কিছু টাকা পাওয়া যাবে। তাছাড়া নানা সময় সরকারের বা পার্টির এমন কিছু কাজকর্ম থাকে যেখানে ঘনশ্যামকাকার অভিজ্ঞতাটা কাজে লেগে যেতে পারে। কাজেই দেখি, ওপর-মহলে বলে কয়ে পরে একটা মাসিক ভাতার ব্যবস্থাও যদি করে দেওয়া যায়…”
“এমন পুরস্কার বা ভাতা কি সত্যিই কোনও সভ্য দেশের সরকার দিতে পারে হে সবার সামনে?” করিমদাদু ঠোঁট টিপে হেসে সংশয় প্রকাশ করে বললেন।
“সরকার পারে না এমন কোনও কাজ আছে নাকি?” পঞ্চানন বলে ওঠেন, “আমি এমন কত লোককেই চিনি যাঁরা এমন নিখুঁতভাবে চুরি করেন যে লোকে চ্যালেঞ্জ করেও ধরতে পারেন না তাঁদের। পার্টিতে কী দাপট আর কদর তাঁদের!”
পঞ্চানন আরও কিছু হয়তো বলতেন, কিন্তু এই সময়েই তাঁর জামার বুকপকেটের মধ্যে রাখা মোবাইল ফোনটা খানিক সুর তুলেই থেমে গেল আচম্বিতে। মিসড কল। পঞ্চানন ভারি অপ্রস্তুত হয়ে থেমে গেলেন। লাজুক মুখে বলে উঠলেন, “ঠিকই বলেছেন করিমকাকা। আমি বোধহয় ভুলই বলে ফেললাম কিছু। এমন হয় না। হতেই পারে না। হবে কী করে? আমাদের পার্টি তো চুরির বিরুদ্ধেই চিরকাল। আমাদের অপোনেন্ট ক্ষমতায় থাকলে হয়তো এই ব্যাপারটা করিয়ে দেওয়া যেত। বলতে নেই, ওদের শীর্ষ নেতৃত্বের সঙ্গেও আমার সম্পর্ক ভালোই। আসলে সত্যি কথাটা কী জানেন তো, রাজনীতিতে শত্রু বলে কিছু হয় না। আজ যে শত্রু কাল সেই পরম বন্ধু। এই মনে করুন, পরের ইলেকশনে ওরা যদি ক্ষমতায় আসে, তখন কি পুরনো পার্টি আঁকড়ে ধরে বসে থাকলে চলবে? এও তো একটা ব্যাবসা। দেখেশুনে তবেই না লগ্নি করতে হবে। তা নইলে…” আবার থেমে গেলেন পঞ্চানন। বুকপকেটে ইতিমধ্যে সেল ফোনটা আবার আওয়াজ করে উঠে থেমে গেল। পঞ্চানন আর কথা বলার ঝুঁকি নিলেন না কোনও।
পঞ্চানন থামতে করিমদাদুই প্রস্তাবটা দিলেন, “আমি বলি কী, আমাদের গ্রামের সবাই মিলেই ঘনশ্যামদাদার ভরণপোষণের দায়িত্ব ভাগ করে নিই। ধরা যাক, একেকদিন আমরা একেকজন তাঁকে ভাগাভাগি করে দিনে রাতে খাওয়াদাওয়ার বন্দোবস্ত করে দিলাম। বছরে খান দুই-তিন ধুতি-শার্ট…”
“হ্যাঁ, বেশ। আমরা রাজি। একদিন খাওয়ানোটা কোনও ব্যাপারই নয়। এত লোক আমাদের গ্রামে, তার মানে মাসে একদিনও এই দায়িত্ব নিতে হবে না আমাদের। ব্যাপারটা কারওরই গায়ে লাগবে না তেমন।” হই হই করে বলে উঠল সব্বাই, “আমরা সবাই রাজি।”
“কিন্তু আমি বাপু রাজি নই।” সকলকে অবাক করে দিয়ে বলে উঠল ঘনশ্যামদাদু।
“সে কী! কেন?” করিমদাদু বলে উঠলেন।
“আরে এতে রাজি না হবার কী আছে? একটা সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত এইভাবে নাকচ করে দেওয়া তো অগণতান্ত্রিক হয়ে গেল, কাকা।” পঞ্চানন পাইক বললেন।
“কিন্তু ব্যাপারটায় রাজি হওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়।” আবারও বলে ঘনশ্যামদাদু।
“সে তো বুঝলাম। কিন্তু রাজি হওয়া কেন সম্ভব নয় সেটা তো বলবে!” তার পিঠে হাত রেখে বলেন করিমদাদু।
“গুরুবাক্যি লঙ্ঘন হয়ে যাবে।” ঘনশ্যানদাদু বলে ক্লান্ত গলায়।
“কীরকম?”
“শিক্ষের সময়ে গুরু আমাকে পই পই করে বলে দিয়েছিলেন, হাজার অসুবিধেতেও জীবন থাকতে যেন বিদ্যেছাড়া না হই কখনও। তিনি বলতেন, কথাটা সব্বদা মনে রাখিস বাপ, এই বিদ্যে বড়ো অভিমানী, বড়ো লাজুক। একে যদি অবহেলা করে দূরে সরিয়ে রেখে দিস, তবে এ কিন্তু তোকে ছেড়ে চলে যাবে চিরকালের মতন। তখন কেঁদেকেটে হাতে পায়ে ধরেও আর ফিরিয়ে আনতে পারবি না তাকে। তাঁর সেই কথাকে মাথায় করেই তো বাঁচলাম এতদিন। সেই বিদ্যে ভাঙিয়েই তো আজ এত নাম যশ ভালোবাসা। কাজেই শেষ বয়েসে বিদ্যেছাড়া হয়ে ভিক্ষের দান নেওয়া আমার পক্ষে বড্ড অপমানকর গো। ও আমি পারব না।”
তাহলে উপায়? ঘনশ্যামদাদু খাবে কী তাহলে? এই বয়েসে তো বেপাড়ায় গিয়ে কাজ করা ওর পক্ষে খুবই মুশকিল। ঝুঁকিরও। সকলেই চিন্তায় পড়ে গেল খুব।
সেই করিমদাদুই আবার পথ দেখালেন। একগাল হেসে বললেন ঘনশ্যামদাদুকে, “শোনো দাদা, একটা বুদ্ধি মাথায় এসেছে। প্রস্তাবটায় আর না কোরো না। এতে সাপও মরবে, কিন্তু লাঠিটি থাকবে অটুট।”
“কীরকম, কীরকম?” সাগ্রহে জিজ্ঞেস করে সব্বাই।
“ঘনশ্যামদাদা রাতের ব্যাবসা যেমন চালাচ্ছেন তেমনই চালান। কিন্তু ব্যাবসাটা ছোটো করে ফেলুন।”
“কীরকম?” ঘনশ্যামদাদুই জিজ্ঞেস করে চোখ কুঁচকে।
“আমি বলি কী, তুমি তোমার কাজকম্ম এই গ্রামের মধ্যেই চালিয়ে যাও। গেরস্থ মানুষ বেভুলে এটা ওটা অসাবধানে ফেলে ছড়িয়ে রাখবেই। তুমি তা তুলে নেবে নিজের জন্যে। যা পাবে তা সবই তোমার।”
“হুঁ,” কথাটা বোধহয় মনে ধরল ঘনশ্যামদাদুর। মাথা নেড়ে দাদু বলল, “তা নাহয় হল। কিন্তু কেউ যদি দেখে ফেলে আমায়, তখন সে কি থানাপুলিশ করবে? আমাকে দেখেও যদি একগাল হেসে কেউ ঘরের মধ্যে সেঁধিয়ে যায় তাহলে তো চুরি করার মজাটাই থাকে না আর!”
“কথাটা উড়িয়ে দেবার মতন নয়, যুক্তি আছে।” মাথা নেড়ে সায় দেন করিমদাদু, “সেক্ষত্রে আমরা একটা আইন স্থির করে ফেলি বরং।”
“কী আইন?” জিজ্ঞেস করে পঞ্চানন পাইক।
“ধরো কারওর বাড়ি থেকে কিছু চুরি করার সময়ে ঘনশ্যামদাদার মুখোমুখি হয়ে গেল কেউ, তাহলে সেই জিনিস সেদিন সে-বাড়ি থেকে কিছুতেই নেবে না আর ঘনশ্যামদাদা। শুধু তাই নয়, সেই বাড়ি থেকে তার পরের পনেরোদিন তিনি আর কিছু গ্রহণ করবেন না। বলো, রাজি সবাই?”
“রাজি।” সমস্বরে চিৎকার করে উঠল সক্কলে।
ঘনশ্যামদাদুর মুখে হাসি ফুটে উঠল। খুশি খুশি গলায় তিনি বললেন, “বিদ্যেটা বহাল রইল তাহলে?”
“একশোবার।” বলে উঠলেন করিমদাদু।
“তাহলে কাল থেকেই এই ব্যবস্থা?”
“কাল নয়, আজ থেকেই। ঘনশ্যামদাদা কাজে বেরোবেন রাত বারোটার পরে। তার আগেই সকলকে ঘরে খিল দিতে হবে, মনে থাকে যেন।” গ্রামের বর্ষীয়ান হরুজেঠু বললেন, “আর ঘরে খিল দেবার আগে যে যার সাধ্য মতন নিশিকুটুমের ভোগ বাইরে রেখে দেওয়া চাই।”
সেই থেকে চালু হয়েছে এই প্রথা। ঘনশ্যাম ঘুম থেকে উঠে খেয়েদেয়ে চুরি করতে বেরোয়। গ্রামে ঘুরে বিভিন্ন বাড়ির সিঁড়ি থেকে, গ্রিলের ফাঁকে হাত গলিয়ে, উঠোনের প্রান্ত থেকে নানান জিনিস সংগ্রহ করে রাত্তির ভোর হবার আগে অবধি। তারপর পুব-আকাশ লালচে হবার আগে ফিরে এসে খানিক বিশ্রাম।
এভাবেই চলে আসছিল। অসুবিধে হচ্ছিল না ঘনশ্যামের এতটুকুও। পেট ভরে খেতেও পাচ্ছিল। পরনের কাপড়ও জুটে যাচ্ছিল নিয়ম করে। মাঝেসাঝে গ্রামের লোকেরা বাড়িতে এসে খোঁজ নিয়ে যায় কোনও সমস্যা হচ্ছে কি না তার। ঘনশ্যাম ফোকলা দাঁতে হেসে বলে, “একটুও না।”
ঘনশ্যামদাদু দিব্যি মজায় আছে এখন। করিমদাদুও খুব খুশি। আসলে গ্রামের ভালো কিছু করার নেশায় সবসময় বুঁদ হয়ে থাকে লোকটা। করিমদাদুর এককথা। যাকে পায় তাকেই ধরে বলে, “শোনো হে। মনে রেখো, আমাদের এই গ্রাম আসলে একটা মস্ত পরিবার। একটাই পরিবারে তুমি আমি আমরা সকলে প্রতিপালিত হচ্ছি। কাজেই সকলের সম্পদে বিপদে অন্যদের পাশে থাকা চাই।”
ঘর থেকে বাইরে বেরিয়ে দরজায় তালা দিয়ে চাবিটা গ্যাঁটিতে গুঁজতে গুঁজতে আপন মনে মাথা নাড়ে ঘনশ্যাম। করিম মানুষ বড়ো ভালো। এমন মানুষ যেকোনও সমাজের পক্ষে এক্কেবারে খাঁটি রত্ন। কিন্তু মুশকিল হল, দামি রত্নকে যত্ন করে আগলে রাখতে হয়। নইলে বাইরের লোক সুযোগ পেলেই তা হাতিয়ে নেবার চেষ্টা করে। কে জানে গ্রামের মানুষ কতদিন যত্ন ধরে রাখতে পারবে করিমভাইকে।
আজ আকাশে চাঁদ নেই। মেঘও বিছিয়ে রয়েছে এদিক ওদিক। তারাদের স্পষ্ট করে দেখা যাচ্ছে না মাথা ওপরদিকে করলে। মোটের ওপরে রাতটা বেশ অন্ধকারই বলা চলে। সাধারণ লোকের পক্ষে এই অন্ধকারে পথচলা বেশ কষ্টকর। কিন্তু ঘনশ্যাম তো আর সাধারণ লোকের আওতায় পড়ে না। সে আর পাঁচটা মানুষের চেয়ে আলাদা। তাকে অসাধারণ বললেও বাড়িয়ে বলা হয় না মোটেই। খোদ ব্রজেন দারোগা যাকে নিজের হাতে শংসাপত্র লিখে দিয়েছিলেন একসময়, তাকে তো আর হেলাফেলা করা যায় না। তার এলেম নিয়েও প্রশ্ন তোলা যায় না কোনও।
কাজেই এই অন্ধকারেও পথ চলতে মোটেও অসুবিধে হল না ঘনশ্যামের। তবে দৃষ্টিটা আগের মতন আর তীক্ষ্ণ নেই বলে পথের পাশে শুয়ে থাকা কালো রঙের কুকুরটার গায়ে ঠিক ক’টা মশা বসে আছে ঠিক মতন ঠাওর করতে পারল না ঘনশ্যাম। মনটা একটু খারাপ হয়ে গেল তার। বয়েস কাউকে ছেড়ে কথা কয় না।
একটা বড়ো দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আবার হাঁটা শুরু করল সে। কোমরের কাছে ঝোলানো ছোটো থলিটায় যত্ন করে গুছিয়ে রাখা প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতিগুলোয় খুব মনতার সঙ্গে একবার হাত বুলিয়ে নিল। এগুলো কাজে লাগে না এখন আর। কাজে লাগানোর অবকাশই নেই। তবুও রাতে বেরনোর সময় অভ্যাস-বশে এগুলো সঙ্গে রেখে দেয় সে। বহুদিনের সঙ্গী, এদের ছেড়ে থাকতে মন চায় না। তাছাড়া বহু কষ্টে শেখা বিদ্যে। এদের হাতছাড়া করলে বিদ্যেটাও হাত ফসকে উড়ে যাবে ফুড়ুত করে।
ভাবতে ভাবতেই একটা অদ্ভুত চিন্তা মাথায় আসে আজ ঘনশ্যামের। বিদ্যেগুলো সত্যিই কি এখনও আয়ত্তে আছে তার? কতদিন যাচাই করে দেখা হয়নি কায়দাকানুনগুলো। নিজের মনে মনে বেশ একটা উত্তেজনা অনুভব করে ঘনশ্যাম। একবার পরীক্ষা করে দেখলে কেমন হয়? আজ রাতে সোজা আধমাইলটাক হেঁটে গিয়ে বাঁদিকে বেঁকে মিত্তিরদের বাড়ি থেকে কাজকর্ম শুরু করবে এমনই ইচ্ছে ছিল ঘনশ্যামের।
কিন্তু মত পালটাল সে। আজ ও-পথে যাবে না। বরং মন্ডল পাড়া বেড় দিয়ে মজা খালের ওপাশে হালদারদের যে পরিত্যক্ত ভূতুড়ে বাড়িটা পড়ে রয়েছে দীর্ঘদিন ধরে, ওটার কাছে গিয়েই নিরিবিলিতে আজ বিদ্যেগুলো একবার ঝালিয়ে নেওয়া যাক।
যেমন ভাবা, তেমনই কাজ। ঘনশ্যাম চলার পথের দিক পালটে ফেলল। মিত্তিরদের বাড়ির দিকে না গিয়ে একেবারে উলটোদিকে হাঁটা লাগাল সে হনহন করে।
।।তিন।।
হালদারদের বাড়িটা অন্ধকারের মধ্যে আরও ঘন অন্ধকার হয়ে থম মেরে দাঁড়িয়ে ছিল চুপটি করে। এমনি করেই দাঁড়িয়ে থাকে বাড়িটা প্রতিদিন। একা একা। আলোবিহীন, শব্দবিহীন। দিনে তো দেখা হয়নি বাড়িটা তেমন করে ইদানিং কালে, তবে রাতে কয়েকবার এই বাড়ির আশপাশ দিয়ে যাতায়াতের সময় বাড়িটার চাপা দীর্ঘশ্বাস কানে এসেছে ঘনশ্যামের। সেই ক্ষীণ বাতাসের মতন মৃদু শব্দের ভেতরেও বাড়িটার অনেক কষ্ট, অনেক হাহাকার মিশে ছিল। ঘনশ্যামের বাড়িটার জন্যে বুক ভারী হয়ে উঠেছিল। বাড়িটার প্রায় নিঃশব্দ দীর্ঘশ্বাসের সঙ্গে আরও একটা আক্ষেপের শ্বাস একদিন কানে এসেছিল ঘনশ্যামের। সঙ্গে একটা গন্ধও। এই গন্ধ ঘনশ্যামের খুবই চেনা। শুধু ঘনশ্যামই বা কেন, এই লাইনে যারাই ব্যাবসাবাণিজ্য করে তাদের সকলেরই এই গন্ধটা বিলক্ষণ চেনা। সকলে বললাম বটে, তবে সত্যিই কি আর সকলে? আসলে যারা ওস্তাদ চোর, কথাটা তাদের জন্যে। কেননা গন্ধটা চেনার মতন নাকটাও তো থাকা দরকার। আনাড়ি নাক কি আর এসব সূক্ষ্ম গন্ধ টের পায় কোনওদিন? এও একটা বিদ্যে। মস্ত এলেমের বিদ্যে। দুটো বই পড়লাম দুলে দুলে, আর খাতার পাতায় সেই মুখস্ত করা বিদ্যে ঢেলে দিয়ে এলাম, তেমন হেলাফেলার শিক্ষে এটা নয়। সদগুরুর শিক্ষা আর এলেমদার শিষ্য না হলে এসব বিদ্যে রপ্ত করা চাট্টিখানি কথা নয়।
প্রথম যেদিন কাজে নেমে গন্ধটা নাকে গিয়েছিল, খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিল ঘনশ্যাম। সারা শরীর কাঁটা দিয়ে উঠেছিল। ধড়ফড় করে উঠেছিল বুক। কিন্তু লাইনে টিকে থাকতে গেলে এসব ভয়কে জয় করতেই হয়। কাজেই ঘনশ্যামও সামলে নিয়েছিল নিজেকে।
তার গুরু বার বার করে সাবধান করে দিয়েছিলেন কাজ শেখানোর ফাঁকে ফাঁকে, “বাবা ঘনা, রাতেভিতে এইসব অশরীরী প্রেতাত্মাদের মুখোমুখি পড়ে গেলে ভয় পাবি না কক্ষনও। বরং তাঁদের সঙ্গে ভাব জমাবার চেষ্টা করবি প্রাণপণে। প্রয়োজন হলে ফাইফরমাশ খেটে দিবি তাঁদের। দেখবি বেমক্কা কখনও যদি ঘোর আতান্তরেও পড়ে যাস, সেই দুঃসময়ে এঁরাই স্নেহের বশবর্তী হয়ে উদ্ধার করে দেবেন তোকে।”
কথাটা মাথায় রেখেছিল ঘনশ্যাম। ভয়টা কাটিয়ে নিয়েই দু’হাত জোড় করে আকাশের দিকে চেয়ে একটা পেন্নাম ঠুকে নিল সে। তারপর বিগলিত স্বরে বলল, “আপনি আছেন বুঝতে পারছি কত্তা, কিন্তু পাপ চোখে দেখতে তো পাচ্ছি না আপনাকে। কাজেই দয়া করে এই অধমকে একবারটি যদি দর্শন দেন…”
একটা জোরালো বাতাস পাক খেয়ে গেল অমনি ঘনশ্যামের সারা শরীর ঘিরে। তারপর সেই ঘুরপাক খেতে থাকা বাতাস ক্রমশ ঘন হতে হতে একটা মানুষের রূপ নিল তার চোখের সামনে। মানুষটার বয়েস হয়েছে। মাথার চুল সাদা এবং পাতলা। মুখে একগাল দাড়ি। পরনে ফিনফিনে ধুতি আর ফতুয়া। গলায় মেডেলের মতন কী জানি একটা কী দুলছে জরির ফিতের সঙ্গে। ঘনশ্যাম তাঁর সামনে মাথা ঝুঁকিয়ে আর একবার পেন্নাম সেরে নিল।
মানুষটার মুখ দেখে মনে হল, ঘনশ্যামের এই বিনয়ী ব্যবহারে সে বেশ খুশিই হল। ঘনশ্যামের দিকে নরম চোখে তাকিয়ে লোকটা জিজ্ঞেস করল, “কী নাম?”
“আজ্ঞে ঘনশ্যাম। ঘনশ্যাম দাস।”
“বেশ বেশ। ঘন…” বলেই থেমে গেল লোকটা। শ্যামনাম উচ্চারণে তাঁর বোধহয় সমস্যা হল একটু।
ব্যাপারটা বুঝতে পেরে আবারও ভারি বিনয়ের সঙ্গে বলে ঘনশ্যাম, “আজ্ঞে, আপনি আমাকে ঘনা বলে ডাকতে পারেন। আমার বাবা আমাকে ছোটোবেলায় ঘন্টা বলে ডাকতেন। চাইলে সে নামটাও আমি আপনার পায়ে উচ্ছুগ্যু করে দিতে পারি।”
“তোমাকে যত দেখছি বড়ো ভালো লেগে যাচ্ছে আমার হে। একালে তোমার মতন বিনয়ী ছেলেপুলে আর দেখাই যায় না।”
“আপনাদেরই আশীর্বাদ।”
“তা তোমার থাকা হয় কোথায়?”
“বোষ্টম পাড়ার পশ্চিমে।”
“অ। তা তোমার পিতার নাম?”
“বটকৃষ্ণ দাস।”
“পিতামহ?”
“আজ্ঞে, জীবনকৃষ্ণ।”
“তাই বলো। তুমি তাহলে আমাদের জীবন ইয়ের নাতি। তাই তো বলি, মুখটা কেমন যেন চেনা চেনা লাগছিল তখন থেকে…”
“আপনি আমার দাদুকে চেনেন?”
“চিনি কী হে, জীবন যে আমার একেবারে গলায় গলায় বন্ধু ছিল গো। আহা বড়ো উঁচুদরের চোর ছিল সে। একেবারে শিল্পীর হাত।”
কথাটা কানে যেতেই নিচু হয়ে মানুষটার পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করতে গেল ঘনশ্যাম। কিন্তু হাতটা হাওয়ার মধ্যে দিয়ে ভেসে বেরিয়ে গেল। ঘনশ্যাম থতমত খেয়ে গেল। সেই মানুষটাই বুঝিয়ে বলল তখন, “ওতেই হয়েছে বাছা। শরীর কি আর আছে বাপু যে পায়ের ধুলো নেবে!”
নিজের ভুল বুঝতে পেরে একগাল হাসে ঘনশ্যাম। মনের মধ্যে থেকে ভয়টা একেবারেই ফিকে হয়ে গেছে তখন। লোকটার দিকে চেয়ে সে বলে, “কিন্তু আপনাকে তো ঠিক চিনতে পারলাম না, দাদু।”
“চেনার কথাও নয়। কম দিন তো হল না শরীরটা চলে গেছে। তা বলতে নেই, দু’কুড়ি বছরেরও খানিক বেশিই হবে বোধহয়। আসলে এই যে বাড়িটা দেখছ, এই বাড়িতেই থাকতাম আমি। বাড়িটা নিজে দাঁড়িয়ে থেকেই এমন জৌলুস দিয়েছিলাম বলতে গেলে। আমার নাম হরিশংকর হালদার। হরিদাদু নামটা চেনা লাগছে নিশ্চয়ই?”
“আজ্ঞে, আপনিই হরিদাদু!” অবাক হয়ে বলে ঘনশ্যাম, “বাপ-পিতামহের মুখে খুব নাম শুনেছি আপনার। আপনারই কথা মতন আমার ঠাকুর্দা একবার বোধহয় সপ্তগ্রামের নিশি চৌধুরীর কোঠা বাড়িতে সিঁদ দিয়েছিল।”
“সিঁদ দিয়েছিল মানে!” চোখ গোল গোল করে বলেন হরি হালদার, “আস্ত একটা সিন্দুক সেই সুড়ঙ্গপথে ঘর থেকে বের করে নিয়ে চলে এসেছিল সে। সিন্দুকটা আমার হাতে না এলে আমাদের জমিদারির সব্বোনাশ হয়ে যেত একেবারে। খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু দলিল ছিল ওই সিন্দুকে।” বলে ফোঁস করে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললেন হরি হালদার। “সে জমিদারি টিকল কি শেষপর্যন্ত? আর এই বাড়ি… কত যত্নে বানিয়েছিলাম এই বাড়ি। আজ দেখো, একেবারে শ্মশান। যেন হানাবাড়ি একটা। আমাদের ভূতেদের সমাজে একেবারে হুড়োহুড়ি পড়ে গেছে এই বাড়িটার দখল নিয়ে একটা মস্ত কলোনি বানানোর জন্যে। কত কষ্টে রক্ষে করছি গো বাড়িটা। এই দেখো না, গলায় সর্বক্ষণ কোর্টের ডিক্রি ঝুলিয়ে রেখেছি এ-বাড়ির ব্যক্তি মালিকানা অন্যদের সামনে মেলে ধরার জন্যে।”
“ও।” বলে খানিক হাঁ করে তাঁর দিকে চেয়ে রইল ঘনশ্যাম।
হরি হালদার বলে চললেন, “ক’দিন আগে দেখা হয়েছিল জীবনের সঙ্গে। বলছিল বটে তোমার কথা।”
“আজ্ঞে, আমার দাদুর সঙ্গে?”
“হ্যাঁ।” মাথা নাড়েন হরিশংকর। “বলছিল, মানুষের মতন মানুষ হয়েছ তুমি। বংশের মুখ রেখেছ। বাপ-পিতামহর পেশা দু’হাত দিয়ে আগলে ধরে রেখেছ। অতীতকে জাগিয়ে রাখার এই চেষ্টাটা বড়ো মহৎ বুঝলে হে। আমি সেই জন্যেই এই বাড়ি আগলে বসে আছি। বছরের পর বছর ধরে অপেক্ষায় আছি যদি ফিরে আসে কেউ। আমার বংশধরেরা কেউ যদি এই গ্রামে ফিরে এসে এ-বাড়িটার হিল্লে করে একটা। আবার আলো জ্বালে এখানে, উঠোনে ঝাঁটা পড়ে, তুলসিতলায় প্রদীপ দেখায়…” বলতে বলতেই ক্রমশ ফিকে হয়ে হাওয়ায় মিলিয়ে যান হরিশংকর।
এসব ঘটনার পরেও কত বছর পেরিয়ে গেল। হালদার বাড়িতে কেউই ফিরে এল না আজ পর্যন্ত। মাঝে বার কয়েক কাজে কর্মের পথে হরিদাদুর সঙ্গে দেখা হয়েছে ঘনশ্যামের। তার মুখের দিকে কষ্টে তাকাতে পারেনি আর সে। মাঝে একদিন হতাশ গলায় তিনি বলেছিলেন, “আর কদ্দিন এইভাবে যক্ষের মতন সম্পত্তি আগলে পড়ে থাকা যায় বল দেখি ঘনা? ভাবছি গ্রামের কোনও মঙ্গলের কাজেও যদি লাগাতে পারিস তোরা বাড়িটাকে তো একটু শান্তি পাই অন্তত মনে মনে। তা তেমন কেউ যদি গ্রামে থাকে তো দেখিস বাপ। যার ওপরে সত্যিই ভরসা করা যায়, যে শুধু নিজের না হয়ে অন্য দশজনের হয়ে ওঠার মন-মানসিকতার অধিকারী তেমন কেউ একজন।”
“তেমন কাউকে পেলে বলব’খন দাদু।” বলে পাশ কাটিয়ে গিয়েছিল ঘনশ্যাম। তেমন লোক পাওয়া কি সোজা! সকলেই আজকাল নিজের কথাটুকুই ভাবে খালি। কাজেই হালদারবাড়ি যোগ্য হাতে দেওয়া যায়নি। আজ মনে হল ঘনশ্যামের এতদিনে একটা ঠিকঠাক লোক পাওয়া গেছে বোধহয়। একমাত্র করিমই পারে এ-বাড়িটাকে গ্রামের কাজে ঠিক মতন ব্যবহার করতে।
এই করিম মানুষটি বড়ো সাচ্চা মানুষ। লোভ নেই, গোঁড়ামি নেই। সত্যিকারের সন্ন্যাসী বলতে যা বোঝায় মানুষটা তাই। কোনও কিছুতেই মোহ নেই। সে দেবতা বলতে মানুষকে বোঝে। আর ধর্মাচরণ বলতে মানুষের সেবা আর মানুষকে সৎ পথে টেনে আনার চেষ্টা করা।
আপন মনে মাথা নাড়ে ঘনশ্যাম। আজ একবার হরিদাদুর সঙ্গে দেখা হলে দিব্যি হত। এ-বিষয়ে একটা শলাপরামর্শ করে নেওয়া যেত এইবেলা। বাড়িটার আরও কাছে এগিয়ে আসে ঘনশ্যাম। নাক উঁচু করে শ্বাস টানে। কিন্তু উঁহু, পরিচিত গন্ধটা তো একবারও নাকে এসে লাগছে না তার। বরং অন্যরকমের একটা গন্ধ আসছে নাকে। গন্ধটা ক্ষীণ, তবুও অনুভব করতে পারে ঘনশ্যাম। ঘনশ্যাম বলেই আসলে অনুভব করতে পারে।
স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে সে। চারদিক দেখে নেয় ভালো করে। সতর্ক হয় মনে মনে। তার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় জানান দেয়, এবারে সাবধানে পা ফেলার সময়। গন্ধটা সুবিধের নয়, বেশ ঘোরালো একটা গন্ধ উড়ছে হালদারবাড়ির আনাচে কানাচে। ব্যাপারটা উপেক্ষা করে চলে যাওয়া ঠিক হবে না।
ঘনশ্যাম একটু দাঁড়িয়ে গন্ধের উৎস বোঝার চেষ্টা করল। মনে হল, বাড়ির ভেতর থেকেই আসছে সে গন্ধটা। আজ এত বছর পরে হালদার বাড়ির ভেতরে ঢোকা মনস্থ করল ঘনশ্যাম। বাড়িতে ঢোকার গেট একটা আছে, কিন্তু সে-গেট দিয়ে ঢোকা ঠিক হবে না বলেই মনে হল তার।
কোমরে ঝোলান ছোটো থলেটায় খুব স্নেহের সঙ্গে হাত বুলিয়ে নিল ঘনশ্যাম। যন্ত্রগুলো বের করে আনল সে সন্তর্পণে। তারপর বাড়ির নির্দিষ্ট একটা প্রান্তে গিয়ে কাজ শুরু করল সে। অনেকদিন চর্চা নেই বটে, তবুও যন্ত্র হাতে পড়তেই হাত যেন একেবারে কথা বলে উঠল ঘনশ্যামের। নিজের কেরামতিতে নিজেই নিজেকে নিঃশব্দে সাবাশ বলে উঠল ঘনশ্যাম। কাজের উদ্যম দ্বিগুণ বেড়ে গেল তার। মাটির নিচে দিয়ে অভ্রান্ত নিশানায় পথ তৈরি করে এগোতে লাগল সে।
এগোতে এগোতেই দুয়েকবার মনে হল, পরিচিত গা ছমছমে গন্ধটা উড়ে উড়ে চলে গেল কয়েকবার নাকের পাশ দিয়ে। কিন্তু ওই গন্ধটাকে এখন খুব বেশি আমল দিল না ঘনশ্যাম। এখন লক্ষ্য স্থির রাখার সময়। ওই ঘোরালো গন্ধটা নাক থেকে হারিয়ে যেতে দেওয়া যাবে না কোনওমতেই। ওই গন্ধের পথ ধরেই এখন এগিয়ে যেতে হবে তাকে। মন বলছে একটা খারাপ কিছু যেন ঘটছে এখানে। এই নিঝুম পরিত্যক্ত বাড়িতে। সকলের অগোচরে।
যে করে হোক বড়োসড়ো অঘটন কিছু ঘটার আগে সেটা থামিয়ে দেবার বন্দোবস্ত করা দরকার। কাজটা ঝুঁকির হতে পারে, তবুও ঘনশ্যামের মনে হল এ-কাজটা একমাত্র তার পক্ষেই করা সম্ভব।
যতই এগোতে লাগল, গন্ধটা স্পষ্ট হতে থাকল নাকে। কাজ করতে করতেই মাথাটাকে খাটাতে শুরু করল ঘনশ্যাম। গন্ধটা যেখান থেকে ছড়াচ্ছে তার খানিক তফাতে ঠেলে ওঠাটাই বুদ্ধিমানের কাজ। একটু দূর থেকে পুরো ব্যাপারটা নজর করা দরকার আগে। ঠিক কী ঘটতে চলেছে বিষয়টা বোঝা চাই। তারপরে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপের কথা ভাবা। তেমন যদি দরকার পড়ে এখানেই ঘাঁটি গেড়ে থেকে যেতে হবে কয়েকদিন।
হাতের যন্ত্রের দক্ষ নিয়ন্ত্রণে পথের অভিমুখ সামান্য পরিবর্তন করে ঘনশ্যাম। তারপর আবার এগোতে থাকে।
।।চার।।
স্কুল যাবার পথটা বেশ লম্বা। বাড়ি থেকে বেরিয়ে মিত্তির পাড়া পার হয়ে ডানদিকে বেঁকে গেলে ঘোষেদের মস্ত মাঠ। সেই মাঠটাকে ডানহাতে রেখে চারকোনা দিঘির পাশ দিয়ে সোজা খানিকক্ষণ হাঁটলে রিয়ানদের স্কুল। এই পথটা রোজ হেঁটেই যায় রিয়ান। হেঁটে যেতে দিব্যি লাগে তার। কতজনের সঙ্গে দেখা হয়। তার সমবয়েসী যারা বা তার থেকে একটু ছোটো বা বড়ো তারা তার সঙ্গ নেয়। বড়োরা বাড়ির অন্যদের কথা জিজ্ঞেস করে। খোঁজখবর নেয়।
স্কুল যাবার পথে পড়ে ললিতদাদুর বাড়ি। ললিতদাদুদের মস্ত বাগান। সেখানে বছরভর নানারকম ফল-পাকুড় হয়। স্কুলে যাবার সময় প্রায় প্রতিদিনই দাদু তাদের হাতে হয় ডাঁসা পেয়ারা, তা না হলে পাকা টমেটো – কিছু না কিছু দেবেনই। নিতে না চাইলেও জোর করে দিয়ে বলবেন, “টিফিনে খেও।”
আজও দূর থেকে দেখতে পেল রিয়ান, ললিতদাদু বাড়ির সামনে লোহার নিচু গেটটার ওপরে হাতের ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। রিয়ান কাছে যেতেই দুটো পেয়ারা হাতে দিয়ে বললেন, “তাড়াতাড়ি ব্যাগে ভরে নিয়ে চলে যাও।”
রিয়ান একটু অবাক হল। দাদুর গলাটা আজ এমন অন্যরকম শোনাচ্ছে কেন? ঠিক তখনই বাড়ির ভেতর থেকে দিদা উঁচু গলায় বলে উঠলেন, “আবার বাগানের ফলমূলগুলো বারো হাতে বিলিয়ে দিচ্ছ তুমি? কতবার বলেছি অমন দান খয়রাত করে নিজের পায়ে কুড়ুলটি মেরো না। লোকটা এত দাম দিয়ে গেল পেয়ারাগুলোর… তোমার পাল্লায় পড়ে একটা পয়সাও ঘরে উঠল না আজ অবধি। এবার আর উপায় নেই। দেখো, আমি এবার পেয়ারায় বিষ দিয়ে রাখব।”
ললিতদাদু আবার তাড়া লাগালেন, “যা যা, পালা শিগগিরি এখান থেকে।”
রিয়ান দ্রুতপায়ে দাদুর বাড়ির সামনে থেকে সরে এসে স্কুলের পথে পা বাড়াল, কিন্তু মনটা বড়ো ভারী হয়ে রইল তার। গত কয়েকদিন ধরে কীসব যেন ওলটপালট হয়ে যাচ্ছে। ওপর ওপর বোঝার উপায় নেই কিচ্ছুটি, কিন্তু রিয়ান দিব্যি বুঝতে পারছিল, সবকিছু ঠিকঠাক চলছে না। কোথায় যেন তাল কেটে যাচ্ছে বার বার।
খেলার মাঠে বুকাইরা অসৎ উপায়ে জিততে দিল না তাদের। দিদা পেয়ারায় বিষ মেশানোর কথা ভাবছে পয়সার জন্যে। আজ সকালে বড়োদের মুখে শুনছিল, কয়েকদিন ধরেই নিশিকুটুমের ভোগ গ্রামের সকলে নাকি রাখছে না রাত্তিরে করে। কথাটা শুনে খুব মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল রিয়ানের। গ্রামের মানুষ রাত্তিরবেলা ঘরের বাইরে নিশিকুটুমের ভোগ সাজিয়ে না রাখলে ঘনশ্যামদাদুর যে অসুবিধে হয়ে যাবে খুব। মানুষটা তখন খাবে কী? দাদুর যে বয়েস হয়েছে! আর কি রাতবিরেতে দৌড়ঝাঁপ করার ক্ষমতা আছে মানুষটার?
ঘনশ্যামদাদু কেমন আছে কে জানে! কাল রাতে তারা নিশিকুটুমের জন্যে যা কিছু সাজিয়ে রেখেছিল তা অমনই পড়ে ছিল। ভোরবেলা ঠাকুরমা ঘুম থেকে উঠে ওগুলো ঘরে তুলে এনে আলাদা করে রেখে দিয়েছে। ছোটোকাকাকে বার বার ঠাকুরমা বলছিল জিনিসগুলো ঘনশ্যামদাদুর বাড়ি গিয়ে দিয়ে আসতে, কিন্তু বাবা বলল অমনভাবে দিতে গেলে দাদু নাকি কিছুই নেবে না।
দাদু সকালবেলা হেঁটে এসে বলল, ঘনশ্যামদাদু কাল রাতে কারও বাড়ি থেকেই নাকি কিচ্ছুই নেননি। ব্যাপারটা বেশ গোলমেলে। ব্যাপারটা চিন্তারও। এই যে এতকিছু ঘটে যাচ্ছে, করিমদাদু আদৌ এসব জানে কি না কে জানে! স্কুল ফেরত করিমদাদুকে ব্যাপারগুলো জানানো দরকার ভাবতে ভাবতেই স্কুলে পৌঁছে গেল রিয়ান। পড়াশোনায় আজ আর মন বসল না তার।
বাংলার মানিকবাবু বেশ রাগী মানুষ। গম্ভীর মুখ করে থাকেন সবসময়। ভীষণ সৎ আর এককথার মানুষ উনি। মিথ্যে এক্কেবারে সহ্য করতে পারেন না। স্কুলের ছেলেমেয়েরা সবাই খুব শ্রদ্ধা করে মানিকস্যারকে। আজ ক্লাশে এসেই স্যার বললেন, “শোন, সিলেবাসের পড়া তো রোজ পড়াই। আজ বরং তোদের একটু লিখতে দিই।”
“তাহলে কি খাতা বের করব?” জিজ্ঞেস করে রিয়ান।
“নিশ্চয়ই।” বলে পাঞ্জাবির পকেট থেকে নস্যির কৌটো বের করে ডানহাতের তর্জনী দিয়ে তিনবার ঠুকে নিয়ে নাকে একটিপ নস্যি নেন মানিকস্যার। তারপর রুমালে নাক মুছে বলতে থাকেন, “রচনা লেখ, কাল যদি পৃথিবীটা থেমে যায়।”
এমন অদ্ভুত অদ্ভুত বিষয় নিয়ে প্রায়ই লিখতে দেন তিনি। ছেলেরা খানিক চেষ্টা করার পর নিজেই লিখিয়ে দেন তিনি বিষয়গুলো সুন্দর করে। বেশিরভাগ সময়েই আগে কী লিখিয়েছেন তা তিনি ভুলে যান। আজও গেলেন। এই রচনাটাই দিন চারেক আগে নিজে লিখিয়ে দিয়েছেন তিনি।
কথাটা বলতে যাচ্ছিল রিয়ান। পাশ থেকে শুভায়ু হাত টেনে ধরে বসিয়ে দিল ওকে। চোখের ইশারায় ইঙ্গিত করল চুপ করে বসে থাকতে। রিয়ান কেমন যেন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। এমন তো হবার কথা নয়। এই গ্রামে সকলেই সত্যকে আঁকড়ে বাঁচে। তাহলে হঠাৎ এমন হল কেন? চারদিকে তাকিয়ে দেখতে লাগল রিয়ান।
তাপস পুরনো লেখাটা কপি করছে খাতা দেখে দেখে। অভিষেক আর সোহম খাতায় চিকে গোল্লা খেলছে একমনে। সুনন্দ খাতার আড়াল করে কমিক্স পড়ছে, আর রক্তিম বাংলা খাতা সরিয়ে রেখে পরের পিরিওডের আনন্দস্যারের দেওয়া বাড়ির কাজ করছে সৌগতর খাতা দেখে দেখে।
প্রথমটা অবাক হল রিয়ান। আশ্চর্য হয়ে গেল সে বন্ধুদের এমন অনৈতিক কাণ্ডকারখানা দেখে। তারপরেই গলার কাছটা ব্যথা করে উঠল। ভীষণ কান্না পেয়ে গেল রিয়ানের।
।।পাঁচ।।
বাস-স্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটি যখন দুম করে রাস্তার ওপরে পড়ে গেল, অনেকেই দৌড়ে এসেছিল। পাশের একটা দোকান থেকে জল-টল এনে ভদ্রলোকের চোখেমুখে ছিটিয়ে তাঁর জ্ঞান ফিরিয়ে আনার চেষ্টাও করেছিল কিছুক্ষণ। তারপর যেই তারা দেখল ব্যাপারটা বেশ ঘোরালো, ভিড় পাতলা হতে শুরু করল। করিমদাদু কয়েকজনকে বলেছিলেন এক্ষুনি ভদ্রলোককে কোনও একটা হাসপাতাল বা নার্সিং হোমে ভর্তি করে দেওয়া দরকার, কিন্তু সকলেরই এমন তাড়া আর জরুরি কাজের চাপ যে করিমদাদু কিছুক্ষণের মধ্যেই দেখলেন তাঁর চারপাশ ফাঁকা হয়ে গেছে। তিনি একা কীই বা করতে পারেন এই ভেবে করিমদাদুও দায় এড়িয়ে চলে যেতে পারতেন সেই জায়গা থেকে, কিন্তু তিনি তা গেলেন না। প্রাণপণে নানা মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে তাদের সাহায্য চাইতে লাগলেন তিনি।
কাজের কাজ খুব একটা অবশ্য হল না। নিজেকে খুব অসহায় লাগছিল তখন করিমদাদুর। ঠিক সময়েই ছেলেটার আচম্বিত আবির্ভাব। বছর চব্বিশ-পঁচিশের ছেলেটা একটু আলুথালু ভঙ্গীতে করিমদাদুর দিকে এগিয়ে এসে শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করল, “আপনার কেউ হয়?”
“না তো।” করিমদাদু বলে ওঠেন।
“হ্যাপা এড়াতে সবাই গুটি গুটি পায়ে কেটে পড়ল, আপনি গেলেন না যে?”
“যেতে পারলাম না।”
“সব লোক তাহলে পাষাণ হয়ে যায়নি এখনও।” বলতে বলতে রাস্তার ওপরে পড়ে থাকা লোকটার পাশে বসে পড়ল ছেলেটা। যত্ন করে তাঁর মাথাটা নিজের কোলে তুলে নিল। পকেট থেকে কী একটা শিশি বের করে একটা আরকের মতন কী জিনিস ঢেলে দিল ভদ্রলোকের মুখে। তারপর হাঁ করে চেয়ে রইল অচৈতন্য মানুষটার মুখের দিকে।
মিনিট খানেক পরেই স্পন্দন ফিরল মানুষটার শরীরে। তার কয়েক সেকেন্ড পরে চোখ খুললেন তিনি। তারপর উঠে বসলেন।
করিমদাদু চুপ করে ম্যাজিকটা দেখছিলেন এতক্ষণ। এবার কথা বলে উঠলেন, “তুমি করেই বলছি বাপু। বয়েসে তুমি আমার হাফেরও কম হয়তো…”
“নিশ্চিন্তে।” ছেলেটা হাসল। তার হাসিটা ভারি সরল আর নিষ্পাপ।
রাস্তার মাঝখানে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ে যাওয়া লোকটা তখন দিব্যি সুস্থ। হাতে পায়ে বলও ফিরে এসেছে অনেকখানি। পাশের চায়ের দোকান থেকে কিনে দেওয়া দুধটুকু খেয়ে বেশ চাঙ্গা বলেই মনে হচ্ছে তাঁকে। লোকটা করিমদাদু আর তাঁর সঙ্গের ছেলেটির দিকে চেয়ে বললেন, “এবারে পারব আশা করি। আমি ঠিক আছি। একাই বাড়ি চলে যেতে পারব। থ্যাঙ্ক ইউ।”
করিমদাদু সন্দিগ্ধ চোখে ছেলেটার দিকে চাইলেন। “ছাড়া উচিত হবে? পারবে একা একা বাড়ি ফিরতে?”
“পারবে।” প্রত্যয়ের সঙ্গে বলে ছেলেটা, “আর অসুবিধা হবে না। এটা মহৌষধ। চোখের সামনে দেখলেন তো!”
“জিনিসটা কী বলো দেখি? তুমি তো ওটা দিয়ে একেবারে মিরাকেল করে দিলে দেখছি।”
“সেটা বলা যাবে না। টপ সিক্রেট। জড়িবুটি। আমার তৈরি। এইসব নিয়েই তো আছি। অদ্ভুত অদ্ভুত সব ওষুধ তৈরি করি গাছগাছড়া, ধুলো-মাটি-জল থেকে। কয়েকটা ওষুধ পরীক্ষিত। কিন্তু সব ওষুধই তো আর তা নয়, তাদের গুণাগুণ সম্পর্কে আমি নিজেই এখনও নিশ্চিত নই। এখনও তারা এক্সপেরিমেন্টের স্তরেই আছে। সুযোগ মতন ব্যবহার করে দেখতে হবে কোনটা সত্যি সত্যি কতটা উপযোগী।”
“তুমি কি ডাক্তার?”
“উঁহু।”
“তবে?”
“বৈজ্ঞানিক। অবশ্য আমার বাবা সেটা মানেন না।”
“বুঝলাম না ঠিক।”
ছেলেটা উদাস চোখে খানিকক্ষণ আকাশের দিকে চেয়ে রইল। তারপর বলল, “রোদ ভালোই চড়েছে। চলুন, আমরা বরং ওই গাছটার ছাওয়ায় গিয়ে বসি। গাছটা খুব উচ্চ মনের। ওর সংস্কার ভালো। ওর তলায় বসলে মনের উদারতা বাড়বে।”
করিমদাদু হাঁ করে ছেলেটার মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। ছেলেটা তাঁর দিকে চেয়ে আবার হাসল মিষ্টি করে। “কী, আমার কথাটা বিশ্বাস হল না তো?”
“ব্যাপারটা ঠিক বিশ্বাস-অবিশ্বাসের নয় হে।” মাথা চুলকে বলেন করিমদাদু, “আমার মাথাটা কেমন যেন গুলিয়ে যাচ্ছে তোমার কথা শুনে।”
“গুলিয়ে যাওয়াটা আশ্চর্যের নয়।” গাছতলার বাঁধানো বেদিটার দিকে এগোতে এগোতে বলে ছেলেটা, “আমার বাবাই আমার কথা ভালো মনে নিতে না পেরে আমায় পাগল ঠাওরে চিকিৎসা করাতে শুরু করে দিয়েছিল আমার অগোচরে। তারপর একদিন ভাত খেতে বসেছি, ডালের বাটি থেকে থালায় ডাল ঢেলে সবে গরাস মুখে তুলতে গেছি, আমাদের ডাইনিং হলের জানালার পাশে জামগাছের যে ডালটা উঠে এসেছে, সে এমন পাতা নাড়িয়ে প্রতিবাদ করতে শুরু করল যে আমি বুঝলাম কিছু একটা গন্ডগোল আছে। ব্যস, তক্কে তক্কে থেকে দেখে ফেললাম আমার খাবারের সঙ্গে ওষুধ মেশানো হচ্ছে। ডাক্তারিটা পড়েছিলাম কিছুদিন। মায়ের দেরাজ হাঁচা করে ওষুধটা বের করেই বুঝতে পারলাম কীসের ওষুধ ওটা।”
“তুমি ডাক্তারিও পড়েছিলে তাহলে!” অবাক হয়ে বলেন করিমদাদু।
ছেলেটা গাছের নিচে বসে আরাম করে। হাতের ইশারায় করিমদাদুকে পাশে বসতে বলে। তারপর শান্ত গলায় বলতে শুরু করে, “পড়েছিলাম কিছুদিন। আসলে বাবার খুব ইচ্ছে ছিল আমি ডাক্তার হই। কিন্তু আমার পোষাল না। মনে হল, এইসব ওষুধের চেয়েও কার্যকর ওষুধ ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে আমাদের চারপাশে। কাজেই পড়াটা ছেড়ে দিলাম। তখন থেকেই বাবা ধরে নিয়েছিল, মাথাটা গেছে আমার। তারপর যত দিন যেতে লাগল, আমার আদাড়ে-বাদাড়ে ঘোরা আর অদ্ভুত সব পরীক্ষানিরীক্ষা দেখে বাবার বিশ্বাসটা আরও পাকা হল। আর কিছুদিন বাড়িতে থাকলে আমার পাগল হওয়াই কপালে লেখা ছিল। ঠিক কোনও না কোনও অ্যাসাইলামে ঢুকিয়ে দিত আমাকে আমার বাবা। আমি সেই ভয়ংকর বিড়ম্বনা এড়াতে বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছি।”
“বলো কী হে? বাড়ি থেকে পালিয়েছ তুমি?”
“হ্যাঁ।”
“বাড়ির লোক খুঁজবে না?”
“খুঁজবে হয়তো, কিন্তু পাবে না।”
“কী করে বুঝলে?”
“একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ ইচ্ছে করে হারিয়ে যেতে চাইলে তাকে খুঁজে বের করা যে ভারি কঠিন ব্যাপার।”
“তা ঠিক। কিন্তু তোমার কাছে মোবাইল ফোন নেই?”
“পাগল নাকি? ওসব গোলমেলে জিনিস কাছে রেখে কেউ হারিয়ে যায় নাকি?”
“তুমি সেল ফোন ব্যবহার কর না?”
“নাহ্।”
“তোমার বাড়ি কোথায়?”
“বলব না।”
“বাবার পরিচয়? বাড়ির বাকিরা?”
“ওসব বলা যাবে না।”
“কেন?”
“আপনি আমাকে ধরিয়ে দেন যদি?”
“তুমি কি অপরাধী? খুন-টুন করে পালিয়েছ নাকি যে তোমায় ধরিয়ে দেব?” করিমদাদু হেসে বললেন।
“তা নয়। কিন্তু আমার বাবাকে তো আপনি চেনেন না। একবার যদি জানতে পারে কথায় গা ঢাকা দিয়েছি আমি, তাহলে আর রক্ষে নেই। ঠিক ধরে নিয়ে গিয়ে পাগলাগারদে পুরে দেবে আমায়। পাঁচজনের কাছে প্রমাণ করে ছাড়বে আমার এই বাড়ি থেকে পালিয়ে আসাটাও উন্মাদ রোগেরই একটা লক্ষণ।”
“তাই বলে কখনও কোনওদিনই আর বাড়ির সঙ্গে যোগাযোগ রাখবে না তুমি?”
“রাখব, কিন্তু তার আগে এমন কিছু একটা কাজ করতে হবে যাতে বাবাকে দেখিয়ে দিতে পারি যে আমার এইসব গাছপালা-জল-মাটি নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষাগুলো নিছক পাগলামি নয়।”
কথা বলতে বলতে ক্রমশই ছেলেটাকে ভালোবেসেছিলেন করিমদাদু। বুকের মধ্যেটা স্নেহে ভরে উঠছিল ক্রমাগত। তার কাঁধে হাত রেখে বললেন করিমদাদু, “আমার আক্কেলটা দেখেছ? এতক্ষণ কথা বলছি তোমার সঙ্গে, কিন্তু তোমার নামটাই জিজ্ঞেস করিনি এখনও।”
“আমার একটা পোশাকি নাম আছে বটে, তা নামটা বেশ ভারিক্কি। ডাকবার পক্ষেও একটু খটমট। আমার মা আমাকে দেবু বলে ডাকে। আপনিও সেই নামেই ডাকতে পারেন আমায়।”
“বেশ। তা বাবা দেবু, বাড়ি থেকে তো পালিয়েছ বললে। তা এখন কোথায় থাকবে-টাকবে কিছু ভেবেছ?”
“আজ্ঞে, না।”
“আর খাওয়াদাওয়া?”
“সে যা হোক জুটে যাবে’খন এদিক সেদিক।”
“তার মানে ওটারও কোনও স্থিরতা নেই।”
দেবু হা হা করে হাসে। করিমদাদু আবার বলেন, “কালিয়া পোলাও ছাড়া মুখে অন্যকিছু জোটে?”
“আজ্ঞে, যেগুলো বললেন ওইগুলোই বরং পেটে সয় না।”
“ডাল-ভাত চলে?”
“দিব্যি।”
“কাঁচা পেঁয়াজ দিয়ে মাখা আলুভাতে?”
“সে তো অমৃত।”
“যুক্তিফুলের বড়া, নিমপাতা ভাজা ছোটো ছোটো করে কাটা বেগুন দিয়ে?”
“এবারে থামুন। জিভে জল এসে গেছে।”
“তাহলে ওঠো। চলো আমার সঙ্গে।”
“কোথায়?”
“আমার বাড়ি। আমাদের গ্রামে। ওখানেই থাকবে তুমি।”
“ওখানে থাকব?”
“আলবাত থাকবে। তোমাকে খুব দরকার আমাদের। তোমাদের মতন মানুষই তো আমরা খুঁজে বেড়াচ্ছি আমরা রাত্রিদিন।”
“কেন?”
“সব কেনরই কি উত্তর দেওয়া যায় রে বাপু অমন ঝট করে? তবে এটুকু বলতে পারি, ওখানে গেলে তোমার কাজে-কম্মে সুবিধে বৈ অসুবিধে হবে না। নন্দপুরে দেদার গাছপালা-পুকুর-মাঠ-ঝোপ-জঙ্গল। তুমি চুটিয়ে গবেষণা করবে সেখানে আর প্রয়োজনে গ্রামের মানুষের চিকিৎসা করবে।”
“কিন্তু…”
“কোনও কিন্তু নয়।” মাঝপথেই দেবুকে থামিয়ে দিয়ে বলেন করিমদাদু, “অনেক দেরি হয়ে গেছে এর মধ্যেই। অনেকটা পথ পাড়ি দিতে হবে এখন আমাদের। নন্দপুর খুব কাছে নয়।”
করিমদাদু হাঁটা লাগান দ্রুতপায়ে। একটু ইতস্তত করে দেবুও হাঁটতে শুরু করে দেয় তাঁর পিছন পিছন। সূর্য মাথার ওপরে উঠেছে। ঘাম হচ্ছে। তবুও হাঁটতে থাকেন তাঁরা। হাঁটতেই থাকেন।
।।ছয়।।
আগে এমনটা হত না। রাতভর একদমে কাজ করে যেতে পারত ঘনশ্যাম। কিন্তু সুড়ঙ্গটা খুঁড়ে হালদার বাড়ির অন্দরমহলে ঢুকতে আজ বেশ হাঁপিয়েই গেল সে। পলেস্তারা খসা একটা পিলারের আড়ালে দাঁড়িয়ে বড়ো করে একটা শ্বাস ছাড়ে ঘনশ্যাম। তারপর সন্ধানী চোখ বুলোতে থাকে চারদিকে। প্রথমটা তেমন কিছু নজরে এল না। ভরসা করে আরও খানিক এগিয়ে চোখ বন্ধ করে আকাশের দিকে মুখ করে বড়ো করে শ্বাস নিল সে। হ্যাঁ বেশ পাওয়া যাচ্ছে এবার গন্ধটা। গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল ঘনশ্যামের। এই গন্ধটাকে সে চিনতে পারছে না হাজার চেষ্টা করেও। ঘনশ্যাম দীর্ঘ অধ্যাবসায় আর অভিজ্ঞতায় ভূতের গন্ধ চিনতে পারে, চোর-ছিনতাইবাজ, ডাকাত-জোচ্চরের গন্ধ চিনতেও বেগ পেতে হয় না তাকে। এমনকি ভালো মানুষ, বোকা মানুষ, সরল মানুষ কিংবা জটিল প্যাঁচালো মানুষের গন্ধও তার জানা। কিন্তু এই গন্ধটা সব চেনা গন্ধের বাইরে।
পায়ে পায়ে এগিয়ে যায় ঘনশ্যাম গন্ধ অনুসরণ করে। তারপর একটা দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়ায় নিজেকে অন্ধকারের সঙ্গে মিশিয়ে দিয়ে। ঘরটা থেকে একটা হালকা গোলাপি আলো ভেসে আসছে। আলোটা ভারি অদ্ভুত। ঠিক ইলেকট্রিকের আলোর মতন নয়, অথচ লন্ঠনের আলোর রঙ এমন হবার নয় কোনওভাবেই। কৌতূহলী ঘনশ্যাম আধখোলা দরজা দিয়ে একটু মুখ বাড়াতেই হাঁ হয়ে গেল একেবারে। বোঁ করে মাথাটা পাক দিয়ে উঠল তার। আর একটু হলে পড়েই যাচ্ছিল সে, কিন্তু নেহাত ঘনশ্যাম বলেই সে বোধহয় নিজেকে সামলাতে পারল। ঘরের ভেতরে যে দু’জন বসে আছে তারা জন্তু নয় কোনওমতেই। তারা দিব্যি জামাকাপড় পরে আছে। অথচ তাদের মানুষ বলতেও বড্ড বাধো বাধো ঠেকে। আনাড়ি লোক হলে তাদের ভূত ভেবেই ভিরমি খেয়ে যেত, কিন্তু গন্ধ বিচার করে ঘনশ্যাম নিশ্চিত হয়ে গেল এরা ভূত নয়। লোকদুটোর কান দু’খানা খাড়া খাড়া আর বেশ লম্বা। মাথাটা শরীরের তুলনায় বেখাপ্পা রকমের বড়ো। মাথায় চুল প্রায় নেই। দুটো ড্যাবডেবে বড়ো চোখ ছাড়াও কপালের মাঝখানে আরও একটা চোখের মতন কী রয়েছে। সেখান থেকেই ঠিকরে আসছে সেই আশ্চর্য গোলাপি আলোটা। একটা অচেনা ভাষায় নিজেদের মধ্যে কথা বলছিল তারা আর উত্তেজিতভাবে হাত-পা, মাথা নাড়াচ্ছিল ঘন ঘন।
হঠাৎ তাদের একজন সরু আর সুরেলা গলায় স্পষ্ট বাংলা ভাষায় বলে উঠল, “পেয়েছি। এই ভাষাটা।”
আরেকটা লোক মাথা নাড়তে নাড়তে কিচিরমিচির করে কীসব বলে যেতে লাগল। আগের লোকটা বলে উঠল, “হচ্ছে না রে, বিং। তরঙ্গগুলো ঠিক করে ডিকোড কর।”
“এইটে না রে, চিং?” বিং বলে উঠল হাসিমুখে।
হাসল বটে লোকটা, কিন্তু ঘনশ্যাম দেখল তারই মতন এ-লোকটাও ফোকলা। ঘনশ্যাম ভাবছিল এরা কারা, কোথা থেকেই বা এসে উদয় হল এখানে? কী এদের উদ্দেশ্য?
বিং বলে উঠল, “কাজ মনে আছে তো?”
“কাজ তো শুরু করে দিইছি।”
“শুধু তরঙ্গ পাঠিয়ে সবটা হবে না।”
“হচ্ছে তো। কয়েকজনের মনকে তো প্রভাবিত করে ফেলেছি এর মধ্যেই।”
“কয়েকজনের, কিন্তু সকলের তো নয়। দেখেছিস তো, এদের অনেকের মনেই তোর পাঠানো তরঙ্গ কোনও ছায়া ফেলতে পারেনি।”
“ওরা বড্ড ভালো মানুষ। মনে মনে সৎ, সত্যবাদী এবং মানুষের মতন মানুষ হবার শুভ বাসনাটা এতই শক্তপোক্ত যে আমার তরঙ্গ ওদের মনের দেওয়াল ভেঙে কিছুতেই ভেতরে ঢুকতে পারছে না।”
“তাহলে উপায়?”
“এই তো ভাষা শিখে ফেললাম। এদের মধ্যে এইবার একেবারে মিশে গিয়ে লোভ, হিংসা, অসততা, ভেদবুদ্ধি ঢুকিয়ে দেব আস্তে আস্তে।”
“আস্তে আস্তে কী রে? তোর হাতে কি অনন্ত সময়?”
“জানি রে বাবা, জানি। আসলে কয়েকজনের মধ্যে এই কালচে ময়লা তরঙ্গগুলো যদি ঠিক মতন কাজ করতে শুরু করে, দেখবি অন্যদের আলো তরঙ্গ আর ভালো তরঙ্গগুলো তাসের ঘরের মতন হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ে যাবে। ব্যস, মহামারীর মতন ছড়িয়ে পড়বে দাঙ্গা, রাহাজানি, বিদ্বেষ, অসহিষ্ণুতা। আমাদেরও কেল্লা ফতে। সততা আর সংহতির পথ থেকে এরা যত সরবে, এই গ্রহটা দখলে নিতে ততই সুবিধে হবে আমাদের।”
“পারবি?”
“পারা না পারাটা তো আমাদের ব্যাপার নয়, আমরা এসেছি মার্কেট সার্ভে করতে। এখানে কিছু মানুষের ওপরে ক্ষেত্র সমীক্ষা করে কিং বেনকে বলতে হবে এই গ্রহ অধিকার করার যুদ্ধ করাটা ঠিক হবে কি না। যদি দেখা যায় এখানকার মানুষের সততা আর পারস্পরিক সহায়তার পথ ছাড়ছে না, তাহলে আমাদের অন্য গ্রহে গিয়ে ক্ষেত্র সমীক্ষা করতে আবার।”
“কিন্তু এখানকার এই ক’টা লোককে দেখে পুরো গ্রহটার মানুষজনকে বিচার করাটা কি বুদ্ধির কাজ হবে?”
“মেলা বকিসনি বাপু। হাঁড়ির একটা চাল টিপলেই সব ভাতের চরিত্তির বোঝা যায়।”
“বেড়ে শিখে গেলি কিন্তু ভাষাটা।”
“না শিখলে উপায় আছে? নে, এবার আরেকটা কাজ কর দেখি।”
“কী?”
“চেহারাটা পালটে ফেল। এই মানুষগুলোর মতন চেহারা করে নিতে হবে আমাদের। নইলে এদের সঙ্গে মিশতে পারবি না ঠিকঠাক।”
“ওরকম কিম্ভূত চেহারা নিয়ে থাকতে হবে আমাদের?”
“ওরে হাঁদারাম, এরাই আমাদের চেহারা দেখলে কিম্ভূত ভাববে।”
“তাহলে কী করব এখন?”
“শরীরটা পালটে নে খানিক। তারপর রি-প্রোগ্রামিং করে নে শরীর গঠনকারী তরঙ্গগুলোকে।”
ঘনশ্যামের চোখের সামনেই অদ্ভুত দেখতে লোকদুটো ক্রমশ আর পাঁচটা সাধারণ মানুষের মতন দেখতে হয়ে গেল। ঘনশ্যাম বেশ ঘাবড়ে গেল। এদের সবকথা মাথায় না ঢুকলেও এটুকু সে দিব্যি বুঝল যে একটা ভয়ংকর ষড়যন্ত্রের নক্সা বানিয়েছে এরা যার ওপরে এই পুরো পৃথিবীটারই বাঁচা-মরা নির্ভর করছে বলতে গেলে। খুবই দুশিন্তা নিয়ে ফিরতি পথে পা বাড়াল ঘনশ্যাম। তার মনে হল, দেরি করা মোটেও ঠিক হবে না। খবরটা এক্ষুনি করিমভাইয়ের কাছে পৌঁছনো দরকার। সে ঠান্ডা মাথার লোক। ঠিক একটা না একটা উপায় সে খুঁজে বের করে ফেলবে। দ্রুত পা ফেলে দালানটা পার করে সুড়ঙ্গের মুখের দিকে এগোতেই একটা লালচে আলো ছুটে এসে পথ আটকে দাঁড়াল ঘনশ্যামের। সে কিছুতেই ওই আলোর রেখাটাকে অতিক্রম করতে পারল না। বেশ কিছুক্ষণ আপ্রাণ চেষ্টা করেও সফল হতে না পেরে ঘনশ্যাম বুঝতে পারল, ওই আলোর দড়িতে সে আসলে বন্দী হয়ে গেছে। এখান থেকে বাইরে বের হওয়া এখন আর তার ইচ্ছাধীন নয়।
।।সাত।।
কয়েকদিন ধরে সারা গাঁ জুড়ে যেন একটা হুলুস্থুল পড়ে গেছে। কী এক অজানা কারণে গাঁয়ের বেশ কিছু মানুষজনের স্বভাবে, মেজাজে, মানসিকতায় একটা অস্বাস্থ্যকর পরিবর্তন চোখে পড়ছে। অন্য কোনও জনপদে ব্যাপারটা হয়তো কিছুই নয়। আরও স্পষ্ট করে বললে, অনেক জায়গাতেই মানুষের স্বাভাবিক প্রকৃতিটাই এখন হয়তো অমনই। কিন্তু আর পাঁচটা গ্রামের সঙ্গে এই গ্রামকে মেলানো তো কাজের কথা নয়।
করিমদাদু খুব গভীরভাবে ভাবছিলেন। কপালে তিন-তিনখানা ঘোরালো রেখা ফুটে উঠেছে এখন তাঁর। ম্যাজিক ছাড়া এত দ্রুত একই তারে বাঁধা গ্রামের মানুষগুলোর কেউ কেউ এমন বেসুরো গাইতে লাগল কেন? চরিত্রের শুদ্ধি যেমন ঝপ করে একবেলার মধ্যে হয় না, ধীরে ধীরে অভ্যাস আর মূল্যবোধ দিয়ে তা গড়ে তুলতে হয়, অশুদ্ধির ক্ষেত্রেও তো তেমনই হওয়া উচিত। দুম করে একটা আপাদমস্তক সৎ লোক কি দু-তিনদিনের মধ্যে অসৎ হয়ে যেতে পারে! হয় না সাধারণত, কিন্তু এখানে তেমন ঘটনাই ঘটছে। উদাহরণগুলোর সংখ্যা এখনও খুব বেশি নয়, কিন্তু সেই সংখ্যা প্রতিদিন বাড়ছে। সংক্রামক রোগের মতন এক মানুষ থেকে অন্য মানুষে ছড়িয়ে পড়ছে এই বিচ্ছিরি প্রবণতা।
নিতাই হালদার অত্যন্ত সজ্জন। ভালো ব্যবসায়ী হিসেবে খুবই সুনাম তার। অথচ পরশু নিকুঞ্জ মাস্টারমশাইকে পাঁচ কেজি আটায় অন্তত চারশো গ্রাম কম দিয়েছে সে। থলে হাতে নিয়ে সন্দেহ হওয়ায় অন্য জায়গায় গিয়ে মাপাতেই ব্যাপারটা চোখে পড়ে যায় তাঁর।
সইফুল ফল বিক্কিরি করে ইস্কুলের পাশের মোড়ে দোকান করে। কাল তরমুজে ইঞ্জেকশন দিয়ে লাল রঙ ঢোকাতে গিয়ে হাতেনাতে ধরা পড়েছে সে।
খেলার মাঠে ছেলেরা খেলতে গিয়ে চুরি করছে, অঙ্ক ক্লাশে এ ওর খাতা দেখে অঙ্ক কষছে, মুদি ঠকাচ্ছে, মাছের ব্যাপারী পচা মাছ টাটকা বলে চালাতে চাইছে, গোয়ালা দুধে জল মেশাচ্ছে, মিষ্টির দোকানদার বাথরুম পরিষ্কার করার অ্যাসিড দিয়ে ছানা কাটাচ্ছে… এখানে এসব ঘটনা স্বপ্নেরও অতীত ছিল। অন্যের মুখে এইসব ঘটনা শুনে এই গ্রাম চিরকাল ছি ছি করেছে। অথচ ক’দিনের মধ্যে কী এমন ঘটে গেল…
গ্রামের প্রবীণ মৌলবিদাদু বললেন, “যাই বলো করিম সাহেব, ওই নতুন ছেলেটাকে রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে এসে এই গ্রামে ঢোকানোটা ঠিক হয়নি তোমার। দিনরাত বনে-বাদাড়ে ঘুরছে। কী মতলব আছে মনে মনে কে জানে। বলতে নেই, ও আসার পর থেকেই কিন্তু এই উপদ্রব এতখানি বেড়ে গেছে।”
পুবপাড়ার কালীমন্দিরের পুরোহিত নগেন ভট্টাচার্যও মাথা নেড়ে সায় দিলেন তাঁর কথায়। কিন্তু করিমদাদু সমানে মাথা নেড়ে চললেন দু’দিকে, “না না, দেবু বড়ো গুণী ছেলে। ভারি ভালো মানুষ সে। লোক চিনতে আমার এত বড়ো ভুল হতেই পারে না।”
“তাহলে এর কারণটা কী মনে হচ্ছে আপনার?” বিশু পাল জিজ্ঞেস করলেন।
“ভাবতে হবে। কিন্তু তার আগে বলুন দেখি ঘনশ্যামের কী খবর? সে নাকি আজকাল আর নিশিকুটুমের ভোগ নিচ্ছে না?”
“ঠিকই শুনেছেন।” কালু সামন্ত বললেন মাথা চুলকে, “তবে অনেকে আজকাল নাকি এই ভোগ রাখছে না ঠিক মতন। রাখলেও এঁটোকাঁটা উদ্বৃত্ত উদবৃত্ত বা নষ্ট হওয়া জিনিস রেখে দিচ্ছে বাড়ির বাইরে।”
“কিন্তু সকলেই তো আর তেমন করছে না!”
“তা নয়।”
“যারা করছে না, তাদের দেওয়া ভোগ ঘনশ্যাম নিচ্ছে না কেন?”
“ঠিক কথা, ঠিক কথা।” মাথা নাড়ে সব্বাই, “করিম সাহেবের কথায় যুক্তি আছে।”
“ঘনশ্যামদাদুকে বাড়িতে পাওয়া যাচ্ছে না।” জাইদুল বলে ওঠে, “আমাদের বাড়ি থেকে তো বরাবর টাটকা খেতের সবজি দেওয়া হয় দাদুকে। ক’দিন নিচ্ছে না বলে আমি পর পর দু’দিন গেছি দাদুর খোঁজ নিতে, কিন্তু ঘনশ্যামদাদুর দেখা পাইনি।”
“সে কী হে!” উদ্বেগের সঙ্গে বলে ওঠেন করিমদাদু, “একথাটা আগে বলবে তো হে? এ তো ভারি চিন্তার কথা। ঘনশ্যাম তো দিনের বেলা বাড়ির বাইরে যায় না কক্ষনও। কোথায় যেতে পারে ও? ওর কোনও আত্মীয়স্বজনের কথাও শুনিনি কারও কাছে।”
“গত পঞ্চাশ বছরে গ্রাম ছেড়ে অন্য কোথাও গিয়ে থাকতে দেখিনি ওকে।” বুড়ো হরি মিত্তির বললেন দু’বার কেশে।
“ব্যাপারটা কেমন যেন ঘোরালো ঠেকছে হে। মনে হচ্ছে গ্রামের মধ্যে কোনও একটা বিপদ দানা বাঁধছে।” হাই ইস্কুলের মাধবস্যার বলে উঠলেন একটিপ নস্যি নাকে পুরে দিয়ে, “স্কুল যাওয়া আসার পথে দিন দুই হল অচেনা দু’জন লোককে ঘুরঘুর করতে দেখছি। এ-গ্রামের লোক তো নয়ই, আশেপাশের গ্রামের লোক বলেও মনে হয় না তাদের। বড়ো অদ্ভুত তাদের চোখের দৃষ্টি।”
“কীরকম?”
“আমি একবারই চোখের ওপরে চোখ রেখেছিলাম একটা লোকের। মনে হল যেন একটা আলোর রেখা ঠিকরে এল তার চোখ থেকে। সেই আলোয় কেমন যেন একটা সম্মোহন আছে। মাথার মধ্যে ঢুকে গিয়ে সেই আলো সব কেমন তালগোল পাকিয়ে দিল আমার। মনে হল, আজ ইস্কুলে গিয়ে বরং একটু ফাঁকি দিই। ছেলেপুলেদের অঙ্ক কষতে দিয়ে চোখ বুজে ঘুমিয়ে নিই খানিক। ব্যাপারটায় মজা হবে খুব। হেডমাস্টার ধরতেও পারবেন না আমি আসলে পড়াচ্ছি, না…”
“তারপর, তারপর?” অবাক হয়ে বলেন করিমদাদু।
“এক ঝটকায় তার চোখ থেকে চোখ সরিয়ে নিলাম আমি। ভাবলাম, একি অলক্ষুণে কথা ভাবছি!”
“লোকদুটো কেমন দেখতে মনে আছে?”
“মানুষেরই মতন। স্পেশাল ফিচার কিছু নেই।”
“লম্বা, না বেঁটে?”
“লম্বা বলা যাবে না ঠিক। আবার বেঁটেও নয়।”
“মোটাসোটা?”
“উঁহু।”
“কালো, না ফর্সা?”
“কালোই, তবে ফর্সার দিকে।”
“হুঁ।” বলে চিন্তান্বিত মুখে উঠে দাঁড়ালেন করিমদাদু। তারপর সকলের দিকে তাকিয়ে বললেন, “সকলেই সতর্ক থাকুন। অচেনা লোকদুটোকে চিহ্নিত করার চেষ্টা করুন। আর হ্যাঁ, মনে মনে আসুন সকলে মিলে প্রতিজ্ঞা করি অন্তত আমরা এই ক’জনে শত প্রলোভন এবং প্ররোচনাতেও অন্যায়ের পথে পা বাড়াব না।”
“বেশ, করলাম।” সকলেই বললেন আন্তরিকভাবে, “কিন্তু যারা অন্যায় করা শুরু করে দিয়েছে এর মধ্যে, তাদের কি ন্যায়ের পথে, সত্যের পথে আবার ফিরিয়ে নেওয়া সম্ভব নয়?”
“সম্ভব করতেই হবে।” চোখদুটো চকচক করে উঠল করিমদাদুর, “নাহলে আমার স্বপ্নগুলোই যে মিথ্যে হয়ে যাবে। এই গ্রাম থেকেই ক্রমশ অন্য গ্রাম, অন্য শহরে ছড়িয়ে দেব আমরা একদিন এই আদর্শ জীবনযাপন।”
“এই স্বপ্ন বাস্তব হওয়া বড়ো কঠিন, করিমভাই।” আবার বলেন মৌলবিসাহেব।
“কঠিন, কিন্তু অসম্ভব তো নয়।” বলে উঠে পড়েন করিমদাদু, “সকলে মিলে চেষ্টা করলে, আর সেই চেষ্টায় আন্তরিকতা থাকলে অসম্ভবও সম্ভব হয়ে যায় একদিন।”
।।আট।।
মাথার ওপরে ইলেকট্রিক পাখা নেই। তবুও দিব্যি ঘুমোচ্ছিল দেবু। দখিনা হাওয়া এসে মাথার চুল উড়িয়ে দিচ্ছে মাঝে মাঝে। হাওয়ার সঙ্গে জংলি গাছপালার গন্ধ এসে লাগছে নাকে। বুদ্ধিটা করিমদাদুই দিয়েছিলেন। খাওয়াদাওয়ার পর তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে বলেছিলেন, “দেবু ভায়া, পুঁইশাক চচ্চড়ি দিয়ে মুসুরির ডালটা যা জমেছিল না, এরপর আর বসে থাকা যায় না। চোখের ওপর ঘুম দৌড়ে এসে বসে পড়ছে হে। তা ঘরে যা গুমোট, চলো ঘরে না শুয়ে আজ বরং দাওয়ায় বিছানা পাতি।”
“পাতুন।” হাই তুলে বলে দেবু।
বিছানায় শুয়েই বেঘোরে ঘুম। কতক্ষণ ঘুমিয়েছে কে জানে। এখন কত রাত তা জানারও উপায় নেই। ঘুমটা চট করে কেন ভেঙে গেল ভাবতে গিয়েই একটা আজব অস্বস্তি টের পেল সে। মনে হল, আবছা আঁধারে মিশে থেকে খুব কাছে বসে কে যেন এক নাগাড়ে খুঁটিয়ে লক্ষ করছে তাকে। কথাটা মনে আসতেই গা শিরশির করে উঠল দেবুর। কিন্তু কী আশ্চর্য, ভয়টা বেশিক্ষণ স্থায়ী হল না। বরং মনে হল, সেই অজানা বাতাসের মতন মিহি শরীরওলা অবয়বটার সঙ্গে দুটো কথা বলতে পেলে মন্দ হত না।
আবছা শরীরটা আরও একটু কাছে ঘেঁষে এল তার। তারপর ফিসফিস করে বলল, “নাহ, একটুও ভুল নেই। এতদিনে পেয়েছি।”
“কী?” দেবুও বলে ওঠে নিচু গলায়।
“তোমাকে।”
“আমাকে!” অবাক হয়ে বলে দেবু।
“হ্যাঁ গো সোনা, তোমাকে। তোমার জন্যেই যে হা-পিত্যেশ করে বসে আছি এতকাল।”
“কেন?”
“কেন কী গো, নইলে এই বাড়ি, বিষয়-আশয় কার হাতে দিয়ে যাব? ওয়ারিশন পাচ্ছি না বলে যক্ষের মতন সব আগলে বসে আছি। কিন্তু কতকাল আর এমন ভূত হয়ে ঘুরে বেড়াব বলো দেখি? সবকিছুরই তো একটা সীমা থাকে। একটা সময়ের পরে সব কাজেই ক্লান্তি আসে, একঘেঁয়েমি আসে। আমারও এসেছে। ভূত হয়ে থাকতে আর ভাল্লাগছে না বাপু। বাড়িঘর তোমায় দিয়ে এবার নিশ্চিন্ত হই।”
“বুঝলাম। কিন্তু আমাকে সব দিতে চাইছেন কেন আপনি?”
“আর কাকে দেব?” ছায়ামূর্তি বলে, “তুমিই যে আমার বংশধর।”
“বাজে কথা। এই গ্রামে আগে কখনও আমি আসিইনি।”
“তাতে কী? তোমার পূর্বপুরুষেরা ছিলেন একসময়। তুমিই তো দেবশংকর?”
“আজ্ঞে, হ্যাঁ।”
“জটাশংকরের নাতি?”
“আজ্ঞে।”
“ব্যস, এই তো মিলে গেল। জটা আমার ভারি স্নেহের। তার বংশধর মানে তুমি আমারই রক্তের। আমি হরিশংকর হালদার। এই হালদার ভিলা বানিয়েছিলাম একসময়। এখন তোমার হাতে বাড়িটা ছেড়ে দিতে পারলে তবে আমার ছুটি।”
“আপনাকে তো ভালো করে দেখতেই পাচ্ছি না।”
“কী আর দেখবি যাদু? শরীর তো নেই আর। কবেই সেসব চুকে বুকে গেছে।”
“হুঁ।” দেবু খানিক ভাবে। তারপর বলে, “কিন্তু অত বড়ো বাড়ি নিয়ে আমি করব কী? ওই পেল্লায় বাড়ি মেরামত করার আর সংরক্ষণ করার খরচ জানেন? পাব কোথায় আমি?”
“বাড়ি বাপু তোমার খুবই দরকার। নইলে ওষুধের ফ্যাক্টরিটা হবেটা কোথায়?”
“ওষুধের ফ্যাক্টরি?”
“নইলে কী? এই যে দিনরাত বনে-বাদাড়ে, শ্মশানে, গোরস্তানে ঘুরে গাছ, মাটি, জল, পাথর খুঁজে বেড়াচ্ছ আর জড়িবুটি বানিয়ে শিশি বোঝাই করছ তা কি এইভাবেই চলতে থাকবে আজীবন?”
“একথাটা ঠিকই বলেছেন।”
“আমি ঠিক কথাই বলি। কিন্তু বাড়িটা নেবার আগে তোমায় যে একটা উৎপাত হটাতে হবে।”
“কী উৎপাত?”
“দিন কয়েক হল দুই বেটা ভিনগ্রহী ওখানে ডেরা বানিয়েছে। দু’জনেই ভারি বিটকেল। অত্যন্ত বিপজ্জনক চিন্তাভাবনা নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে তারা।”
“বলেন কী!”
“তা নইলে আর বলছি কী?”
“কী চায় ওরা?”
“এই গ্রহটা।”
“মানে?”
“ওরা সার্ভে করছে এখন। যদি এখানকার মানুষ অসৎ, মিথ্যেবাদী, অসহিষ্ণু, বিভেদকামী হয় তাহলে গ্রহটা কিছুদিন পরে ওরা দখল করে নিয়ে আমাদের হয় মেরে ফেলবে, নাহলে আমাদের ক্রীতদাস বানিয়ে রাখবে। কাজেই ওরা মানুষে মানুষে বিশ্বাস, আস্থা, সংহতি এগুলো নষ্ট করে দিতে চাইছে প্রাণপণে।”
“সর্বনাশ!”
‘ঘনশ্যামকে ওরা হালদার ভিলাতে আলোর শেকলে বেঁধে রেখে দিয়েছে। আজ তিন-চারদিন হয়ে গেল ঘনশ্যাম ওদের কাছে বন্দী।”
“এখন উপায়?”
“উপায় একটাই।”
“কী বলুন দেখি?”
“পজিটিভ এনার্জির স্রোত দিয়ে ওদের নেগেটিভ এনার্জির বর্মটা ভেঙেচুরে দিতে হবে।”
“কী করে এটা হওয়া সম্ভব?”
“তোমার আশ্চর্য ওষুধে। হ্যাঁ, তোমার ওষুধে। একদিন জগত ধন্য ধন্য করবে তোমার এই আবিষ্কারের জন্যে।”
“কোন ওষুধটার কথা বলছেন বুঝতে পারছি না তো।”
“যে ওষুধটা এক্ষুনি বানাবে তুমি।”
“মানে?”
“সবকথার অত মানে বোঝার দরকার কী বাপু? যা বলছি শোনো।”
“বলুন।”
“তোমার ঘরের উত্তরদিকের তাকে দু’নম্বর সারিতে যে সবুজ শিশিটা আছে ওইটে নিয়ে এসো।”
“ওই ওষুধটা এখনও তৈরি হয়নি।”
“এবার হয়ে যাবে।”
“এই রাতে?”
“হ্যাঁ, এই রাতেই। অন্ধকারের মধ্যেই তো অন্ধকার বিনাশের নিদান প্রস্তুত হবে আজ।”
“আসলে আমি ওটা দিয়ে বোবাকে কথা বলানোর ওষুধ তৈরির গবেষণা চালাচ্ছিলাম।”
“ওই ওষুধটাকেই পালটে দিতে হবে একটু। আমার সঙ্গে চলো। একটা গাছের শিকড় তুলে আনি চলো দু’জনে মিলে। ওর রস এই আরকের সঙ্গে মিশিয়ে দাও। সঙ্গে আমাদের এই গ্রামের খানিক খাঁটি মাটি। তারপর ঠিকঠাক জিনিসটা তৈরি করে এ-গ্রামের মানুষের মনে ও মস্তিষ্কে একটা শক্ত বর্ম সেঁটে দিতে পারলেই কাজ হাসিল। আর তাদের কোনওভাবেই নেগেটিভ এনার্জি দিয়ে আকৃষ্ট করা যাবে না।”
“কিন্তু গ্রামের লোকেদের ওপরে এটা প্রয়োগ করব কী করে?”
“সবই কি আমি বলে দেব?” হরিশংকর বিরক্ত হয়ে বলেন, “এটুকু উপস্থিত বুদ্ধি না থাকলে এত বড়ো কারখানা চালাবে কী করে? তাছাড়া এই কারখানা থেকেই তো আগামীতে সারা দেশ তারপরে বলতে নেই সারা পৃথিবী একদিন আদর্শ মানুষ তৈরির আরক নিতে লাইন লাগাবে। পেটেন্টটা নিও ঠিক মতন। তবে এটাও মনে রেখো, বাকি যা ওষুধপত্তর বানাবে তা সেবার কাজেও লাগিও।”
দেবশংকর হেসে ফেলে। হরিশংকর আবছা অবয়বের মধ্যেও চোখ কোঁচকান, “হাসছ যে বড়ো?”
“আমাকে বাদ দিয়ে কি আমার ওষুধ কাজ করবে? আমি নিজেও তো আদর্শ মানুষ হয়ে যাব আমার এই ওষুধের গুণে। তখন কি আর শুধু লাভের কথা মাথায় রেখে পথচলার উপায় থাকবে আর?”
“তা অবশ্য ঠিক।” তার কথায় সায় দেন হরিশংকর। তারপরেই জোর তাড়া লাগান তাকে, “আর সময় নেই। চলো। রাত ফুরিয়ে এলে আমার শক্তিও ফুরিয়ে আসবে। মাথা কাজ করবে না তখন। জিনিসটা বানিয়ে নিয়ে গ্রামের চারদিকে চারখানা টেপা কল আছে, তার মধ্যে ঢেলে দিও। ওই জলই খায় সব্বাই। খানিকটা আরক পুকুরের জল আর গ্রামের মাটিতেও দিও। গাছপালা, শস্য সকলেই শুদ্ধ হবে তাহলে।”
“যে আজ্ঞে।” বলে উঠে পড়ে দেবশংকর। চলতে থাকে হরিশংকরের ছায়ামূর্তির পিছন পিছন।
।।নয়।।
ঘনশ্যামের অসহায় লাগছিল। এমন জীবনে সে কক্ষনও পড়েনি আগে। লোকদুটো আজব এক অস্ত্রে বেঁধে রেখেছে তাকে। আলোর অস্ত্র। দড়িদড়া হলে নিমেষের মধ্যে নিজেকে মুক্ত করে ফেলতে পারত ঘনশ্যাম। দড়ির কষি বাঁধার সময় নিজেকে ফুলিয়ে রেখে পরে সময় মতন দেহ হালকা করে বেরিয়ে গেলেই হয়। এইসব শ্বাস-প্রশ্বাসের নিয়ন্ত্রণ কাজ শেখার সময়েই রপ্ত করে নিয়েছিল সে। কিন্তু আলোর বলয় থেকে মুক্তি পাবার কোনও উপায় শেখা নেই তার।
আরও একটা বিপজ্জনক সংকট থেকে অবশ্য নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে পেরেছে সে এখনও পর্যন্ত। লোকগুলো চোখ দিয়ে বশ করতে চেয়েছে তাকে বহুবার। পারেনি। প্রত্যেকবার মনটাকে অন্য জায়গায় ফেলে রেখেছে সে। তারপর থেকে ক্রমাগত তাকে বুঝিয়ে চলেছে লোকগুলো যে তার কেন পুরনো পেশায় ফিরে যাওয়া উচিত। এরা তাকে টাকার লোভ দেখাচ্ছে। বড়ো বাড়ি, ভালো খাবারদাবারের স্বপ্ন দেখাচ্ছে ক’দিন ধরেই। পারছে না অবশ্য। যতই পারছে না, ঘনশ্যাম বুঝতে পারছিল আলোর ফাঁসটা ক্রমশই আলগা হয়ে যাচ্ছে তার শরীর থেকে। লোকদুটোর চোখে মুখেও ক্রমশ বিপুল হতাশা ফুটে উঠছিল।
কাল থেকে একটা কথা বলছে ওরা ঘনশ্যামকে। বিং আর চিং ঘনশ্যামকে ওদের গ্রহে নিয়ে যাবে বলেছে। ওরা বলেছে সে এক আজব গ্রহ। সেখানে কেউ বুড়ো হয় না, মরে যায় না। কারও খিদে পায় না, ঘুম পায় না। খুব শীতও নয়, আবার খুব গরমও নয় সেই জায়গা। শুনে বড়ো লোভ হয়েছিল ঘনশ্যামের। মনে হয়েছিল শরীরটা বড়োই নড়বড়ে হয়ে গেছে ইদানিং। ওদের সঙ্গে চলে গেলে সেই পুরনো চেহারাটা হয়তো ফেরত পাওয়া যাবে আবার।
কিন্তু আজ ঘনশ্যামের মনটা যেন অন্যরকম ভাবছে ভোর থেকে। মনে হচ্ছে এই গ্রহটা, তাদের পৃথিবীটাই বা খারাপ কীসের? খিদে-তেষ্টা-ঘুম না থাকলে কি এমন ভালো? খাবার দরকার না থাকলে কেউ রান্নাই করবে না। তখন ঝিঙেপোস্ত, কিংবা বিউলির ডাল অথবা শোলমাছের টক খাবার ইচ্ছে হলে পাবে কোথায়? শীত জাঁকিয়ে না পড়লে নলেনগুড় ওঠে না। গুড় না হলে পিঠেপুলি-পায়েস-পাটালি সব গেল। তাছাড়া বয়েস ফিরে পেলেও সেখেনে গিয়ে করিম ভাই, মৌলবি সাহেব, ব্রজেন দারোগা, বিধু ভটচাজ এমনকি বুড়ো ভূত হরিশংকরের সঙ্গে দেখা হবারও যে আর কোনও সুযোগ থাকবে না। কাজেই এই বাড়তি বাঁচার লোভ মন থেকে সরে গেল ঘনশ্যামের। আর যেই লোভটা সরে গেল অমনি আলোর বাঁধন আলগা হয়ে গেল। বিং আর চিং সেদিকে তাকিয়ে কেমন যেন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল।
আলোর রেখা মাড়িয়ে উঠে দাঁড়াল ঘনশ্যাম। একগাল হেসে বলল, “তোমাদের জারিজুরি শেষ। বুঝতে পেরেছি, লোভ করেছিলাম বলেই বেঁধে রাখতে পেরেছিলে এতদিন আমায়। আর আমার মনে লোভ নেই। কাজেই আমাকে বন্দী করে রাখাও আর সম্ভব নয় তোমাদের।”
বিং আর চিং নিজেদের দুর্বোধ্য ভাষায় কীসব বলে যেতে লাগল খানিকক্ষণ। তারপর এগিয়ে এসে ধরতে গেল ঘনশ্যামকে। আর ঠিক তখনই বাইরে তুমুল চিৎকার আর হই-হল্লা শোনা গেল।
রিয়ান, বুকান, পিকাই, সইদুল, করিমদাদু, ললিতদাদু, ঠাকুরমা, মৌলবি সাহেব সক্কলে এগিয়ে আসছে তখন হালদারদের পুরনো বাড়ির বাইরে বহুদিন ধরে জমা হয়ে থাকা শুকনো পাতা মাড়িয়ে মাড়িয়ে। তাদের সকলের সামনে দেবশংকর। তাদের সকলের চোখ থেকেই আজ বড়ো স্নিগ্ধ, বড়ো সুন্দর আলো বেরিয়ে এসে সকালের রোদ্দুরের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে। সেই সম্মিলিত আলোর সামনে দাঁড়ানো বিং আর চিং-এর পক্ষে অসম্ভব। তারা তড়িঘড়ি ঘর থেকে বেরিয়ে বাগানের ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে রাখা টু সিটার স্পেস-শিপে চেপে পাড়ি দিল নিজের গ্রহে। এই পৃথিবী তাদের পদানত হবে না বুঝে ফেলেছে তারা। লোভ, হিংসা, বিদ্বেষ এবং অসততা এখনও পুরোপুরি গ্রাস করেনি এখানকার মানুষকে। রিয়ান, বুকান, পিকাইদের তেমন মানুষ কখনও হতেই দেবেন না করিমদাদু আর দেবুদাদা।
পরিশিষ্ট
দেবশংকরের ফ্যাক্টরি জমে গেছে। প্রাকৃতিক উপাদান দিয়ে নিত্যনতুন নানানরকম জড়িবুটি ওষুধ তৈরি করে তাক লাগিয়ে দিচ্ছে সে সব্বাইকে। তার মা-বাবাও এসে দেখা করে গেছেন তার সঙ্গে। তাকে নিয়ে তাঁদের মনে আর কোনও উদ্বেগ বা আফশোস নেই।
ঘনশ্যামদাদু দেবশংকরের গবেষণাগারেই কাজ নিয়েছে। দেবশংকরের আশ্চর্য ওষুধের গুণে তার চোখ ভালো হয়ে গেছে। পুরনো দৃষ্টি আবার ফিরে পেয়ে বেজায় খুশি সে।
মাঝেসাঝে রাত ঘন হলে হরিশংকর আসেন। বদলে যাওয়া ঝকমকে হালদার বাড়ির অন্দরমহলে বসে ঘনশ্যামের সঙ্গে সুখ দুঃখের গল্প করেন। দেবশংকরকেও নানান বিষয়ে সুযোগ পেলেই পরামর্শ দেন তিনি। কিন্তু দেবশংকর কিছুতেই ঘনশ্যামের মতন অমন স্পষ্ট করে দেখতে পায় না তাঁকে। নিজের কোনও ওষুধেই ভূত দেখার বা ভূতের গন্ধ পাওয়ার ক্ষমতা সে অর্জন করতে পারেনি আজও।