আসল বন্ধু

আসল বন্ধু

আশেপাশের প্রচুর বন্ধুর ভিড়ে আসল বন্ধু চিনবেন কিভাবে? খুবই সহজ একটা পদ্ধতি বাতলে দিচ্ছি। এই পরীক্ষা করার জন্যে আপনাকে দাঁড়াতে হবে একটা ইলেকট্রিক তারের নিচে, যে তারে অনেক কাক বসা। এইবার বন্ধুদের সাথে আড্ডার ফাঁকে আপনার মাথায় কাক যদি তার প্রিয় কর্মটি সেরে ফেলে, তখন যেই বন্ধু, ‘ওহ! তোর মাথায় দেখি কাক ইয়ে করে দিছে, দাঁড়া আমি মুছে দিচ্ছি’ বলে টিস্যু নিয়ে এগিয়ে আসবে সে আপনার আসল বন্ধু না। ঐ সময়ে যে বন্ধু, ‘ওরে খোদারে! তোরে দেখি কাকে হাগু করে দিছে!’ বলে গলা কাপিয়ে হো হো করে হেসে ফেলবে, সেই আপনার আসল বন্ধু। অবাক হওয়ার কিছু নাই। আসল বন্ধুরা ভান জানে না। হাসির সময় তারা হাসবেই। আপনি রাগ করলে, ওদের ওটা দেখতে বয়েই গেছে।

যখন স্কুলে পড়তাম এরকম অসংখ্য খাঁটি বন্ধু আমাকে ঘিরে ছিল। আমার ছোট ছোট ভুলে আর দুর্ঘটনায় গা দুলিয়ে হাসা ছিল যাদের নিয়মিত কাজ। হয়তো খেলতে গিয়ে মাঠে পা পিছলে পড়ে গেলাম, তারা হেসে ফেলত। একদিন টিফিন ছুটিতে সিঁড়ি দিয়ে তাড়াহুড়ো করে নামতে গিয়ে প্যান্ট ফেটে গেল। টিফিন ছুটির পর ক্লাস শুরু হলে আমি বেঞ্চে বসে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলাম। টিচার এসে জিজ্ঞাসা করল কি হয়েছে আমার। আমি জবাব দেয়ার আগে আমার পিছনে বসা আমার বন্ধু মকবুল দাঁড়িয়ে একগাল হেসে বলল, ‘আপা ওর পোস্টঅফিস পুরাটাই খুইলা গেছে।’ ওর কথা শুনে ক্লাসের সবাই, টিচার সহ হেসে ফেলল। এরপর স্কুলে আমার নামই হয়ে গেল ‘খোলা পোস্টঅফিস!’ কি ভয়ানক!
স্কুলে থাকতে কমিকস পড়তাম। কি মজার মজার সব কমিকস! চাচা চৌধুরী, বিল্লু, পিঙ্কি, টিনটিন। কমিকসের রঙিন দুনিয়াই হারিয়ে গেলে মনে থাকতো না কিছুই। এরপর একটু বড় হলে ধরলাম তিন গোয়েন্দা। কি নেশা সেই বইয়ের। ক্লাসের মধ্যে স্কুল বইয়ের ফাঁকে, নিঝুম দুপুরে শুয়ে শুয়ে গোগ্রাসে গিলতাম সে সব বই। কত বকা আর মার যে খেয়েছি এই বই পড়ার জন্যে তার হিসাব নেই। আজকালকার ছেলেমেয়েদের দেখে মায়াই লাগে। ডরিমন, ইন্টারনেটে কি মশগুল! কি মজা যে হারিয়ে ফেলছে জীবন থেকে, বেকুবগুলি বুঝেই না।

ক্লাস নাইনে উঠতেই পুরো পৃথিবীটাই রঙিন হয়ে গেল। কেউ যেন চোখে একটা রঙিন চশমা পড়িয়ে দিয়েছে। যাই দেখি রঙিন লাগে। দেরী করে বাসায় আসলে আম্মা যখন বলতো, ‘এতক্ষনে ইবলিশের আসার সময় হইলো, না?’ আমার মনে হত, ‘ওমা! আম্মা কি সুন্দর করেই না আমাকে ইবলিশ ডাকছে!’ পাড়ার কোন মেয়ে কয়টাই, কোন ড্রেস পড়ে স্কুলে যায় তা ছিল আমাদের নখদর্পণে। ওদের টাইম টেবিল মনে হয় তাদের মা বাবারাও অত ভালো জানত না, আমরা যতটা জানতাম। দেখা যেত এক মেয়েকেই সাত আট বন্ধু পছন্দ করে বসে আছি। ঐ এক মেয়েকে নিয়ে সবার মাঝেই চলত ঝগড়া। কিন্তু ঐ মেয়ে নিজেই জানত না যে আমরা ওকে পছন্দ করি। কি ছেলেমানুষই না ছিলাম। কোন সুন্দরী মেয়ের বাবা আমাদের সালাম পেতে পেতে বিরক্ত হয়ে যেত। আসতে যেতে সালাম। উঠতে বসতে সালাম। উনি কি আর জানত এত স্রদ্ধা কেন উনাকে দেয়া হচ্ছে? ঈদের সময় কোন মেয়ে বাড়িতে চলে গেলে আমাদের মন খারাপ হয়ে যেত। পরে যখন দেখতাম ওদের বাসায় লাইট জ্বলছে তার মানে ঐ মেয়েরা বাসায় ফিরেছে। আমাদের খুশি কে দেখে? ঈদের মতই আবার সবাই কোলাকুলি করে ফেলতাম।

পরে কলেজে উঠলাম অনেক বন্ধুর সাথে যোগাযোগ কমে গেল। একবার খুব অসুস্থ হয়ে পড়লাম। রক্ত লাগবে অনেক। আত্মীয় স্বজনদের খবর দেয়া হচ্ছে। এই সময় আমার এক স্কুল বন্ধু এসে হাজির। কোথা থেকে খবর পেয়েছে কে জানে? স্কুলে থাকতে রেড ক্রিসেন্ট করার সময় জানত আমার রক্তের গ্রুপ ওর সাথে মিল আছে। এসেই আমাকে বলল, ‘কিরে হারামজাদা আমারে খবর দেস নাই ক্যান?’ আমি মলিন হাসলাম। সে বলল, ‘আরে, ব্যাটা দেখি কাব্যিক হাসি দেয়। এক চড় দিব শালা খোলা পোস্টঅফিস। রক্ত লাগলে আমাকে বলবি না?’ সে রক্ত দিল। যাওয়ার সময় আম্মাকে বলে গেল, ‘আন্টি রক্ত লাগলেই আমাকে খবর দিবেন, রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরও দিব। এই ব্যাটাকে দাঁড়া করিয়ে ছাড়বো ইনশাল্লাহ।’ আম্মা হেসে ফেলল। হেসে ফেলল ডাক্তার সহ নার্সরা। সেই বন্ধু যাওয়ার আগে আমাকে কানে কানে বলে গেল, ‘কিরে শালা, নার্সতো সুন্দর পাইছস। তোর দেখি রাজকপাল।’ আমি হেসে ফেললাম। আমার অসুখ যেন অনেক ভাল হয়ে গেল। এরাই আসল বন্ধু। কিন্তু এরাই ছিল সে দলে, যারা আমাকে ‘খোলা পোস্টঅফিস’ ডেকে ডেকে আমার জীবন অতিষ্ঠ করে দিয়েছিল।

এরপর ভার্সিটিতে গেলাম। ভার্সিটি শেষ হল। অনেক বন্ধু দেশের বাইরে গেল, কেউ কেউ চাকরি করল, কোন কোন ইঁচড়েপাকা বিয়ে সেরে ফেলল। অনেক সময় গভীর রাতে যখন বারান্দায় বসে থাকি সেই স্কুল জীবন, স্কুল জীবনের বন্ধুরা, কত স্মৃতি হুড়মুড়িয়ে মনে আসে। কখনো হেসে ফেলি, কখনো অজান্তেই ভিজে যায় চোখ। একটা বার যদি পারতাম ফিরে যেতে ঐ জীবনে। লাগত না আর কিছুই। তখন ওরা যদি আমাকে ‘খোলা পোস্টঅফিস’ বলতো আর খেপে উঠতাম না। কারণ আমি তো জানি ওরাই আমার আসল বন্ধু। একেবারে খাঁটি, জানের দোস্ত।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত