“সিক্সার!”
হাত তুলে চিৎকার করল ইশু। ফুলটস্ বলটা উড়ে গিয়ে পড়ল অফ্ সাইডে।
“উফ্ কি দিলি রে মাহী!”
ইশু-র উচ্ছ্বাস দেখে মাহী-র চোখ দুটো খুশিতে চকচক করল বটে। তবে মাথা চুলকে চুপসানো বেলুনের মত মুখ করে বলল, “কেল করেছে! এবার কী হবে? ওদিকে তো…”
“ভুজুং এদিকে আয়!”
ইশু-র ডাকে এগিয়ে এল নাদুস নুদুস চেহারার ভুজুং, “আমি… আমি কিন্তু ওদিকে যাব না। “
“যাবি না মানে! তোর ঘাড় যাবে। অফ্ লাইনের ফিল্ডার ছিলিস ভুলে যাস না। “ বলবতে বলতেই নিমরাজি ভুজুং –এর দিকে তেড়ে এল বারো বছর বয়সি লেডি আম্পায়ার।
“সব হয়েছে এই মাহীটার জন্য। কে বলেছিল তোকে এভাবে বল পেটাতে?”ভুজুং-এর মুখের চর্বিগুলো রাগে থলথল করে উঠল।
“দ্যাখ, ভালো হচ্ছে না কিন্তু বলে দিচ্ছি। “
“নিজে মেরেছিস তো নিজেই যা না। দেখব কত দম তোর। “
“মামদোবাজি পেয়েছিস নাকি! কুমড়োপটাশ একটা!”
“কী বললি! আমি কুমড়ো পটাশ?”
“বেশ করেছি। দিন দিন চর্বির বস্তা যা বাড়াচ্ছিস!”
“তবে রে…”
“উফ্, থামবি তোরা। ভুজুং বেশি ওস্তাদি করিস না। দৌড়ে যা, বলটা চটপট নিয়ে আয়। “
“কিন্তু আমি ওখানে…”
“ওখানে কি বাঘ না ভাল্লুক আছে যে তোকে গিলে ফেলবে?”
ইশারা-র কথায় মহীরুহ ওরফে মাহী, টুবলাই, আর আয়ুধ মুখ টিপে হাসল। তবে ভুজুং-এর টায়ার পাংচার হবার জোগাড় তা ওর পুরুষ্টু পেশির আড়ষ্টতা আর শঙ্কায় ভরা মুখ দেখলেই বোঝা যাচ্ছে।
অগত্যা আর কী! জড়ানো পায়ে ইঁটের অস্থায়ী বাউন্ডারি টপকে ভুজুং এগিয়ে গেল।
জায়গাটায় আগাছায় ভর্তি। বছরদশেক কি তারও বেশি এলাকাবাসী কারোই হাত পড়েনি বোঝাই যায়। বেল, শেওড়া, আম আরও নানা বেশ বড়োসড়ো আকারের গাছের দল দখল করেছে বিঘাতিনেক জমি। মাথা উঁচু করে শুধু ভাঙা লালচে পোড়ো বাড়িটা দেখা যাচ্ছে। এককালে নাকি কোনো এক মজুমদার বংশের অস্তিত্ব ছিল এমনটা শোনা যায়। বর্তমানে তাদের অস্তিত্ব কোথায়, আদৌ তারা কোথায় আছেন কেউই জানে না। কৌতূহল আর রকমারি ভূত-ভূতুড়ে গল্প মিলে এদিকটায় কথা কানাকানি হলেও মানুষ চলাচল কমই বলা যায়।
“আচ্ছা ইশু তুই কোনোদিন ওদিকটায় গেছিস?” মাহির প্রশ্ন শুনে ইশুর ভুরুদুটো সামনের দিকে এগিয়ে এল।
“না। কেন বলতো?”
“দাদু বলে, ওদিকে গেলে হাওয়া বাতাস লাগে। “
“হা হা হা! হাওয়া? সে তো এখানেও লাগছে আমার গায়। “
“এ হাওয়া সে হাওয়া নয় রে!” মাহী বোঝাতে চেষ্টা করল। আর ঠিক সেই সময়ই ভুজুং একেবারে হামাগুড়ি দিয়ে বেরিয়ে এল ঝাঁকড়া মাথা গাছের পাশ থেকে। ডানহাতে ক্যাম্বিসের রংচটা বলটা উঁচু করে ধরে থাকলেও হাফপ্যান্টের ঘষা দাগ, আর মুখের থেঁতোভাবে বোঝা যাচ্ছে বেদম ধাক্কা খেয়েছে। আয়ুধ, টুবলাই একটু এগোতেই ভুজুং জোরে জোরে শ্বাস নিতে লাগল ওদের পিঠ ধরে।
“কী হয়েছে ভুজুং!”
“আর পারছি না। আমাকে এক গ্লাস জল দিতে পারিস তোরা? ইশু আমাকে আর কোনোদিন ওখানে পাঠাবি না। আর কখনো যদি বল পড়ে তো মাহী যাবে। “
“কী হল বলবি তো?” ধমক দেয় ইশারা।
“বলছি! আজ খুব বেঁচে গেছি। আসলে আমার গলায় হনুমানজির লকেটটা আছে তো!” ভুজুং, ওর গলার একটা গোল লকেটটা ইশারায় দেখাল।
“বলবি? না এক গাট্টা মারবো?” এগিয়ে আসে মাহী।
“কি! মজা দেখাচ্ছি!”
“উফ্ তোরা আবার শুরু করলি!”
ভুজুং বলতে শুরু করল –
“ওই যে বাদামি ঝুরোপাতার গাছটা দেখছিস, ওটা পেরোতেই ভাঙা দালানের সামনেই বলটা পড়েছিল। আমি হাত-চারেক দূর থেকেই দেখতে পেয়েছিলাম। ভাবলাম ভালোই তো! খুঁজতে হল না। এগিয়ে গিয়ে যেই না উঠোনে পা দেব, সঙ্গে সঙ্গে মাথার উপরে দু – তিনটে লাথি। চোখ তুলে দেখবো কী, আমার তো ওখানেই মাথা ঘুরে পড়ে যাবার জোগাড়! কোনরকমে লকেট মুঠো করে রামনাম জপ করতে করতে পালিয়ে এলাম। না হলে ওরা আজ আমাকে খেয়েই নিত। “
“লাথি? কীসের?” মাহী প্রশ্ন করল।
“কীসের বুঝিনি। তবে ওপরদিকে তাকাতেই দেখি অনেকগুলো কালো পর্দা ঝটপটিয়ে উড়ে গেল উঠোনের একপাশে।“
“কালো পর্দা?” আয়ুধ, আর টুবলাই একসঙ্গে বলে উঠল।
“আরে কিছু না! বাদুড় হবে হয়ত! ইশারা আশ্বস্ত করল।
“মোটেই না। খুব জোরে লেগেছে আমার। এই দেখ, মাথার ব্রহ্মতালুটা কেমন গরম এখনো। “ ভুজুং মাথায় হাত দিয়ে ওদের সামনে এল।
“উফ্! ভুজুং তোর গপ্পগুলো তোর ঝুলিতেই রাখ। অ্যাই টুবু হাঁ করে কী গিলছিস? উইকেট গোটা। কটা বাজে খেয়াল আছে? সাড়ে ছ’টা। আমার অঙ্কের স্যার আসবে। চল চল। “
টুবলাই আর আয়ুধ ইঁটের ফাঁক থেকে উইকেট তুলে নিল বগলে করে। ভুজুং ওর গপ্পোকে আরো একটু নাটকীয়তা এনে ওদের মশগুলো করল। ইশু আর মাহী পা বাড়াল বাড়ির দিকে। বয়সে বড়ো আর জ্ঞানগম্মি কিঞ্চিৎ বেশি থাকায় ইশারাকে বিশেষ প্রশ্ন না করলেও মাহী মানে মহীরুহর মনের আনাচে কানাচে একটাই জিনিস ঘুরতে লাগল কি আর কেন?
ভুজুং – এর কথা যদি সত্যিই হয়! তবে কে লাথি মারল ওকে?
সত্যি সত্যি কী দেখেছিল ভুজুং?
২
“সত্যি বাবা, ভুজুং আজ ওদের লাথি খেয়েছে। খুব ভয় পেয়েছিল ও। বল না বাবা ওখানে কী থাকে?” বাড়ি ফিরে বাবার কাছ থেকে পুরো ব্যাপারটা জানতে উদগ্রীব হয়ে উঠল মাহী।
“কী মুশকিল বলতো। তোর বন্ধু কোথায়, কার লাথি খেয়েছে তা আমি বলব কী করে!”
“তুমি তো অনেক কিছু জানো বাবা। বল না প্লিজ বাবা। প্লিজ।“ মহীরুহের বাবা কুণালবাবু হাই স্কুলের শিক্ষক, তাই অজানা সব বিষয়েই ছেলের আগ্রহ মেটাতে হয় তাঁকেই।
“কী আর হবে। আমার জন্মের আগে থেকেই শুনি ওই মজুমদার বাড়ি ভগ্নপ্রায়। পোকামাকড়, শেয়াল, বাদুড়ের উৎপাত তো হতেই পারে। ওদিকটা তো পুরো জঙ্গলের মত আগাছায় ভরে গেছে। “
“বাবা তুমি বুঝতে পারছ না। ভুজুং মাথায় লাথি খেয়েছে। কালো কিছু একটা ওকে মেরেছে। “
“লাথি? ও তাহলে বাদুড়ই হবে। “
“বাদুড় লাথি মারে?’
“আরে পাগল ছেলে। লাথি মারবে কেন? পোড়ো, অন্ধকার জায়গায়, গুহায়, গাছের কোটরে বাদুড় থাকে জানো না তুমি? ক্লাস থ্রি-তে এটুকু বুদ্ধি হয়েছে নিশ্চই। বাদুড় কি জাতীয় প্রাণী বলতো!”
“স্তন্যপায়ী,” ঢোঁক গিলে উত্তর দেয় মাহী। ও জানে বাবা একবার প্রশ্ন শুরু করলে আর থামবে না।
কিন্তু বাবা ভুজুং-কে দেখে ওরা অমন করবে কেন? ওরা কি কামড়ায়!”
“হা হা হা,” কুনালবাবু খানিক হেসে নিয়ে বললেন, “হুম্!, তা কামড়ায় বটে, তবে আমাদের এই শান্তিপুরের ঘোষপাড়ায় তেনাদের দেখা পাওয়া যাবে বলে তো আমাদের মনে হয় না। ভ্যাম্পায়ার তেনাদের নাম। শুনেছ তুমি?”
“দাঁতওয়ালা ভ্যাম্পায়ার?”
“সেরকমটাই তো জানি। পূর্ব ইউরোপে প্রথম ভ্যাম্পায়ারের গল্প শোনা যায়। Bram Stoker প্রথম এই নিয়ে গল্প লেখেন ‘ ড্রাকুলা ‘তারপর আরো অনেক সিনেমা, গল্প তৈরি হয় এসব নিয়ে। Count Drakula, Son of Drakula, Saint Drakula.”
“ওরা কী করে বাবা?”
“গল্পে যেটুকু পড়েছিলাম তাতে এমন বেশিরভাগ ভ্যাম্পায়ারই প্রয়োজনে রূপ বদল করতে পারে। আর সুযোগ বুঝে নিজেদের খিদে মেটাতে দাঁত বসায় অন্যান্য প্রাণীর ঘাড়ে, গলায় কিম্বা দেহের অন্যান্য অংশেও। “
“মানুষেরও?”
“হুমম, তবে এ ধরনের ব্যাট বা ভ্যাম্পায়ার খুবই কম সংখ্যায় থাকে। বিজ্ঞানীদের মতে, সাউথ আফ্রিকার জঙ্গলে এদের দেখা মেলে। আবার কিছু ছোট ছোট ব্রাউন ব্যাট আছে। যারা এক ঘণ্টায় ১০০০টি মশা খেতে পারে। তাইতো জলা জায়গায় এদের দেখা যায়। “
“ভ্যাম্পায়ার মশা খায়?”
“ভ্যাম্পায়ার মশা খাবে কেন? সাধারণত ৭০শতাংশ বাদুড় ফল খায়। তাছাড়া পাখির আয়তনের ব্যাটেরা কখনো কখনো মাছও খেয়ে থাকে। “
“বাবা ওরা ভাঙা দালানে কী করছিল?”
“পুরোনো যে সমস্ত জায়গায় সচরাচর লোকজনের বসতি কম, সে সমস্ত আস্তানায় ওরা বসতি করে। তোর বন্ধুকে দেখে হয়তো ওরাও ভয় পেয়ে উড়ে গেছে। আর ওদেরই পাখার ঝাপটা খেয়েছে তোর বন্ধু। “
“বাবার কথা মন দিয়ে শুনল মাহী। তবু সন্দেহটা যেন গেড়ে বসেই থাকল মনের আবডালে। স্পষ্ট, যথাযথ উত্তরগুলো যেন স্বাধীনভাবে ডানা মেলতে পারল না। বারবার মনে হতে থাকল ভ্যাম্পায়ার, ড্রাকুলা, বাদুড় কি একই? ওরা কী করে রূপ বদলায়? কী খায় ওরা? রক্ত না অন্যকিছু! মানুষের রক্ত খায়? নানান প্রশ্ন খিচুড়ি হয়ে একটা বলে উঠল মাহী, “আমাকে একটা ভ্যাম্পায়ারের স্টোরি বুক কিনে দেবে বাবা!”
“সে দেবো। আপাতত তোমার পড়ার সময় হল। পড়তে বসো। “
মাহী বসার ঘরের থেকে বেরিয়ে আস্তে আস্তে এগিয়ে গেল ওর পড়ার টেবিলের দিকে। ডাঁই করা বই আর খাতার মাঝ থেকে উঁকি দিচ্ছে লাল, হলুদ মলাটের একটা চৌকো বই। শক্ত মলাটের বইটির প্রচ্ছদে দুজন রাজকুমারী অবাক চোখে তাকিয়ে আকাশের দিকে। আর নীল আকাশে চাঁদের পাশ দিয়ে ডানাজোড়া চোখ জ্বলজ্বল করছে। যার পাখনাদুটো কালো চাদরের মত বিশাল। আর মুখের দুদিকে লম্বা সাদা দাঁত বেরিয়ে…
৩
স্কুল থেকে বেরিয়ে বাড়ি আসতে সময় লাগে দশ থেকে পনেরো মিনিট। বাহাদুর পুকুর পেরিয়ে রিমঝিমদের বাড়ি। তারপর ট্যাঙ্কের মাঠ পেরোলেই সেই পরিত্যক্ত এলাকা পড়বে। তার থেকে সামান্য এগোলেই মাহীদের বাড়ি। আজ সাইকেলে ওঠার পর থেকেই কেমন যেন একটা গা শিরশিরানি ঠান্ডা হাওয়া ঘুরে বেড়াচ্ছে। মেঘ করে এসেছে। মা বলে, রথের সময় এলেই আকাশ মুখ গোমড়া করে থাকে। রথ আসতে এখনও দিন দশেক দেরি।
কী জানি বৃষ্টি আসবে হয়তো। মাহী, প্যাডেলে চাপ দিয়ে সাইকেলের গতিবেগ বাড়াল। ওর কান, নাকের পাশ দিয়ে ছুরির মত তীক্ষ্ম হাওয়া সরে যাচ্ছিল একটু একটু করে। অদ্ভুত একটা থমথমে ভাব আজকে। এ-সময়টায় বিলু, রামি ওরা তো প্রায়ই ট্যাঙ্কের মাঠে আসে। ওদের মর্নিং স্কুল। তাই এই সময়টায় ওদের সঙ্গে দেখা হয়ে যায়। আজ ওরাও তো কেউ নেই। কী হল? গেল কোথায় সব?
ইস্ ঠান্ডা জল হাওয়াটা আরো খানিকটা বাড়ল মনে হল। কালভার্টটা পেরিয়ে ডানদিকে ঘুরল মাহী। দু’চার ফোঁটা জল পিঠের ব্যাগের উপর ডুব ডাব ছোট ছোট শব্দ করে পড়তে শুরু করল।
এই রে! যাহ! সাইকেলের চেনটা পড়ে গেল যে! কী হবে এবার?
পা দিয়ে রাস্তা ছুঁয়ে মাহী দাঁড় করাল সাইকেলটা। নিচু হয়ে বসে চেনটা তুলল ডানহাতে। এদিকে পিচের রাস্তার ছাইরঙা চাপা পড়ে যাচ্ছে ফোঁটাদের মিছিলে। তাড়াতাড়ি চেন তুলে সিটে উঠে বসল ও।
ডান পা, বাঁ পায়ে প্যাডেল ঘুরিয়ে খানিকটা এগোতেই সজোরে ধাক্কা। ডান পায়ের বুড়ো আঙুলটা কনকন করে উঠল। কী হল? কে ছিল ওটা? সাইক্লোনের মত কালো একটা চাদর চোখের নিমেষে ঢুকে পড়ল ঝোপের আড়ালে। আর সাইকেলের চাকা তাতেই ধাক্কা খেয়ে টাল সামলাতে না পেরে হেলে গেল একদিকে। কে ঢুকল ওভাবে?
সমস্ত ঘটনাটাই এত দ্রুত হয়েছে যে মাহী বুঝে উঠতে পারল না ঠিক কী হয়েছে। শুধু কানে এল খচখচ, সরসর শব্দ। যেন একসঙ্গে আগাছাগুলো পাশ কাটিয়ে সশব্দে এগিয়ে চলেছে কেউ। কিন্তু ভালো করে তাকাবার জো নেই। চোখের পাতায় জল পড়ে আবছা হচ্ছে ক্রমশ। বুকের মধ্যে সজোরে হাতুড়ি পেটার মত একদলা আতঙ্ক।
কে ছিল ওটা? ওভাবেই বা ওখানে ঢুকল কেন? কাঁটার মত প্রশ্নগুলো বিঁধতে থাকল এক এক করে। নাহ, আর দেরি করা ঠিক হবে না। মা চিন্তা করবে। মাহী এগোয়। তবু মনের ভিতরটা খচখচ করে। ল্যাম্পপোস্টের আলোগুলো আনত মুখে ঝুঁকে পড়েছে রাস্তার একধারে। সন্ধ্যার অন্ধকার আস্তে আস্তে গিলে খাচ্ছে সামনের পথটাকে। ঘোষপাড়ার চেনা পথটা হঠাৎই বড্ড অচেনা লাগছে। মনে হচ্ছে প্রাচীন এক গুহাপথে আচ্ছন্ন আতঙ্কে ও চলেছে।
“মাহী ও মাহীবাবু, ইয়ে দুধ জারা তুমহারা মাম্মি কো দে দেনা!”
বাড়ির কলাপসিবল ঠেলে ঢুকতে গিয়ে আচমকা একটা খ্যানখ্যানে গলা টোকা মারল ওর কানে। পিছন ফিরে তাকাতেই খোঁচাদাড়ির বছর পঞ্চাশের এক আধভেজা প্রৌঢ় দুধের ক্যান হাতে মাহীর দিকে এগিয়ে এল।
“ও রামু কাকা, এক মিনিট দাঁড়াও। আমি মা-কে ডেকে দিচ্ছি। “
“নেহি বেটা, আজ মেরা একদম টাইম নেহি হ্যায়। জলদি জানেকো হ্যায়। দো তিনদিন সে মেরা পের কা ফল কোঈ চুরা লে রাহে হ্যায়। অব তো শাম হোনে লাগা। যানা হৈ বেটা।“
“কি হল রে মাহী। কার সঙ্গে কথা বলছিস!”মাহী আর রামুর কথোপকথনে স্নিগ্ধাদেবী উঁকি দিলেন ঘর থেকে।
“রামরাম বিবিজি, আজ ম্যায় যা রাহা হু। “
বলে রামুকাকা পিছন ফিরে একহাতে মাথা ঢেকে বৃষ্টির মধ্যে ছপছপ শব্দ করে চলে গেল। মার হাতে ক্যান ধরিয়ে মাহী ড্রইং ছেড়ে এক দৌড়ে ওর ঘরে গেল। বুকের মধ্যে তখনও কেমন যেন একটা ধকধক শব্দ করে চলেছে। কী হল? কেন হল? কে ছিল ওটা? মুখ, চোখ কোনো কিছুই স্পষ্ট করে দেখতে পায়নি সে। যত ভাবতে চেষ্টা করছে তত একটি কালো চাদর চলে যাচ্ছে চোখের সামনে দিয়ে।
আনমনাভাবে মাহী তাকাল ওদের ফুলগাছের বাগানের দিকে। জানলা দিয়ে দেখা যাচ্ছে অস্পষ্ট দুটো কদমগাছ। জলে ভেজা ডালপালাগুলো ঝুঁকে পড়েছে নিচের দিকে। কিন্তু ওটা কী? বাগানের হলুদ ভেপারের আলোয় খানিকটা স্পষ্ট অথচ অস্পষ্টভাবে কিছু একটু ঝুলে আছে ঝাঁকড়া ডালের সঙ্গে। মাহি এগিয়ে গিয়ে জানলার গ্রিলটা ধরল। শিরশিরানি ভাবটা আবারও যেন আষ্টেপৃষ্টে বাঁধতে লাগল ওকে। মাহী প্রাণপণে দেখার চেষ্টা করতে লাগল। মুখ বাড়িয়ে চোখের পাতা টানটান করে আরো, আরো খানিকটা বোঝার চেষ্টা করল। কী লেগে গাছের সঙ্গে? কী নড়ছে ওটা? ও বেশ বুঝতে পারল কালো একটা থলি যেন আটকে রয়েছে গাছের সঙ্গে। মাঝে মাঝে অল্প অল্প দুলছে।
বেশ কিছুক্ষণ অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে থাকায় ওর চোখটা সয়ে এল। ও দেখল দুটো লাল চোখ যেন কালো পর্দার আড়াল থেকে উঁকি মারছে। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিল না ও। কী ওটা? একটা নয়, দুটো কি তিনটে এমনি কালো থলি পাশাপাশি ঝুলে রয়েছে। তীক্ষ্ম জুলজুলে চোখগুলো মনে হচ্ছে তাকিয়ে আছে ওই আবছা আলোর দিকে।
ওর হাতদুটো ঘামে ভিজে এসেছে। ভয় আর আতঙ্ক মিলেমিশে জমাট বাঁধছে গলায়। ঘিনঘিনে ভাবনাগুলো ওই কালো পর্দাকে ঘিরে ঘুরে চলেছে। জিজ্ঞাসার চিহ্নগুলো অস্ফুটে বলছে, “মাহী তুমি যা দেখেছ, তা ঠিক নয়। এর আড়ালে রয়েছে অন্য কিছু।”
৪
“অন্য কিছু নয়, ওটা বাদুড়-ই ছিল। দাপটের সঙ্গে বলে উঠল ইশু।
“বাদুড়?” মুখ হাঁ করল মাহী।
“তা নয়ত কী! তোদের ছাতিম গাছে আর কী থাকতে পারে শুনি!”
“কিন্তু ওভাবে? আমি তো এর আগে কোনোদিন…”
“দেখিসনি তো এখন দ্যাখ। কী রে তুই মাহি? বিশ্রামের সময় বাদুড় পিছনের পায়ের নখ দিয়ে আটকে নিচের দিকে ঝুলে থাকে। তখন ওদের ভাঁজ করা ডানাগুলো শরীর ঢেকে রাখে,” ইশারা বলে।
“আর ওই কালো পর্দাটা! আমার সঙ্গে যেটা ধাক্কা খেল!”
“ভ্যাম্পায়ার!”আয়ুধ বলল।
“এক গাঁট্টা খাবি বাজে বকলে!”তেড়ে এল ইশু।
“কেন? আয়ুধ তো ঠিকই বলেছে!”জোর গলায় চেঁচিয়ে উঠল ভুজুং।
“যা ভাগ, ফালতু বকিস না?”ধমকালো ইশু।
“মাইরি বলছি, আমি দেখেছি ফিল্মে। ওরা যখন তখন রূপ বদল করতে পারে। আর রূপ বদল করে ওরা মানুষের ঘাড় কামড়ে রক্ত খায়। “
“তাই? কোন সিনেমা শুনি? নাকি তোর বানানো গপ্প?” ইশু ব্যঙ্গ করে।
“মোটেই না। উম্ম….মাথা চুলকায় ভুজুং। মনে পড়ে গেছে। Hotel Transylvania। ওখানে বাদুড়গুলো ওইরকম। মানুষ হয়, আবার সেকেন্ডে বাদুড় হয়।
“তবে ওরা সূর্যের আলোতে খুব ভয় পায়। সূর্যের তেজ সহ্য করতে না পেরে ওরা পুড়েও যায়। “
“সর্বনাশ!”আয়ুধ আর টুবলাই এক সঙ্গে বলে ওঠে
“অ্যাই তোদের গল্পের ঝাঁপিগুলো বন্ধ করবি? দেখছিস মাহীর মুখটা কেমন শুকিয়ে গেছে। “
“কে বলেছে আমার মুখ শুকিয়ে গেছে?” ব্যাট- এ চাপড় মেরে বলে মাহি।
“নে নে খেলা শুরু কর!” ইশু তাড়া দেয়।
খটাস করে সপাটে একটা শব্দ। আর তারপরেই সবাই দেখল টুবলাই-এর ব্যাটের গুঁতো খেয়ে বলটা পুনরায় গিয়ে ঝোপের আড়ালে।
“বেশ হয়েছে, বেশ হয়েছে।“ বলে ভুজুং প্রায় নেচে উঠল। কারণ আজ অফ্ লাইনে মাহী দাঁড়িয়ে।
“আমি পারব না যাহ্। “
“পারবি না মানে? যেতেই হবে তোকে। “ দিদির মত অভিভাবকের সুরে খানিকটা গলায় আদর ঢেলে বলে ইশু, “ভয় পাচ্ছিস কেন। দৌড়ে যা, ছুটে গিয়ে বলটা নিয়ে আয়। কিচ্ছু হবে না। আমি বলছি। “
মাহী ইতস্তত পায়ে ঘাস জড়ো করতে লাগল।
“উফ আর দেরি করিস না। যা যা দৌড়ে যা। “
ইশুর তাড়া খেয়ে মাহি টুবলাই এর হাত ধরে এক হ্যাঁচকা টান মারল। টুবলাই একবার কাঁদো কাঁদো মুখে তাকাল বাকি সবার দিকে। কিন্তু মাহী –র তাড়নায় এক সেকেন্ডও দাঁড়াতে পারল না।
টুবু আর মাহী দুজনে হাত ধরাধরি করে ঝোপ মাড়িয়ে এগোতে লাগল পোড়ো ইটের দিকে। এদিক ওদিক চেয়ে কোনো দিকেই লাল বলের হদিশ পেল না ওরা। বুকের ভিতরের শব্দটা মাহী বাইরে থেকে যেন শুনতে পাচ্ছিল।
“কেন আনলি আমায়? একা আসতে পারলি না!”গলায় জোর এনে বলার চেষ্টা করল টুবলাই।
“বেশ করেছি। চুপ কর।“ হিস্ হিস্ করে বলল মাহি।
এক পা, দু পা করে ওরা যেই কলাগাছ টপকে দাঁত বের করা উঠোনে পা দিয়েছে, হঠাৎ পিছন থেকে শনশন শব্দে তিরের মত মাহী –র মাথার উপর দিয়ে উড়ে গিয়ে আচমকা কিছু একটা ভিতরে ঢুকে গেল। আর ঠিক তখনই টুবলাই বেদম ধাক্কা খেয়ে বাবা গো বলে ছিটকে পড়ল সামনে। দৌড়ে এসে টুবলাইকে তুলতে যাবে কী, চোখ চলে গেল সোজা বাইরের ভাঙা দরজার দিকে। চোখের সামনে দিয়ে দৌড় দিল কালো চাদর। হাওয়ার বেগে মিলিয়ে গেল বাগানের পশ্চিম দিকে। যেদিকটায় শেওড়া গাছ মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে।
“আমি আর এক মুহূর্ত থাকব না। টুবলাই কেঁদে ফেলল। কী রে তুই যাবি, না এখানেই থাকার প্ল্যান করেছিস? মাহী?” ওর কাঁধ ধরে ঝাঁকালো টুবলাই।
“অ্যাঁ….” ও হাত তুলে সোজা দেখাল পশ্চিমদিকের জঙ্গলে।
টুবলাই হাত বরাবর তাকিয়ে কিছু দেখতে পেল না বটে। কিন্তু আধভেজানো দরজার পাল্লার দড়াম আওয়াজটা ও পড়ে গিয়েও শুনতে পেয়েছিল। কোনরকমে টুবলাই, মাহীকে নিয়ে দৌড় দিল ওদের খেলার মাঠের দিকে। বল তো দুর অস্ত্। প্রাণ বাঁচানো দায়। মাহী কি দেখেছে? এসব নিয়ে ভাববার সময় বিন্দুমাত্র ছিল না। শনশন আওয়াজটা শুধু ঘুরে ঘুরে বারে বারে প্রতিধ্বনিত হয়ে আতঙ্ক হয়ে ফিরে আসছিল দুজনের মনে। দমবন্ধ করা একটা পরিস্থিতি নিয়ে ওরা এসে পৌঁছাল ইশুদের মাঝখানে।
“তোরা এখান দিয়ে কাউকে যেতে দেখেছিস?” জোরে শ্বাস নিতে নিতে মাহী বলে উঠল।
“কে যাবে? তোরাই তো এলি!” ইশু বলল।
“ঠিক জানিস!”টুবলাই আবারো জিজ্ঞেস করল।
“কী বলছিস পরিষ্কার করে বল।“
ঘটনাটা ওরা আদ্যোপান্ত উগরে দিল এবার বাকি বন্ধুদের কাছে। আয়ুধ আর ভুজুং হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থাকল। যেন ঘাড় সোজা করে পাশ ফেরার সাহসটুকু ওদের কাছে নেই। ভুজুং এর মুখ থেকে একটা শব্দই বেরিয়ে এল, “বাদুড় মানুষ।”
৫
“বাদুড় মানুষ কি আমাদের ক্ষতি করে মা?”
“এসব কথা কে বলল তোমায়?”
“সত্যি সত্যি মা, আমি দেখেছি কালো চাদরের মানুষটাকে। দু-দুবার আমার সামনে দিয়ে দৌড়েছে। বিশ্বাস করো। আর তাছাড়া ভুজুং- ও…”
“তোমার কথা কিচ্ছু ঢুকছে না আমার মাথায়!”
“সেদিন স্কুল থেকে আসার সময় খুব জোরে ধাক্কা খেয়েছি আমি। কী ছিল মা ওটা? ওরা কি মানুষকে কামড়ায়!”
“তেমনটা তো কিছু জানি না। পুরাণে লিলিথের গল্প শোনা যায়। আদমের এক স্ত্রীর সন্তানেরা নাকি ভ্যাম্পায়ার ছিল। ছোটবেলায় বিদেশি গল্পে জেনেছিলাম কবর বা গোরস্থান থেকে ভ্যাম্পায়ার উঠে রাতে ঘোরে। আর কখনো কখনো…..
“কখনো কখনো কী মা!”
“কিচ্ছু না। আরব্য রজনী, রামায়ণ, মহাভারত যেমন রূপকথা, এসবও তেমনি বাবু। এগুলো নিয়ে এত ভেবো না।“
“তবে ওটা কী ছিল মা?”
“কিচ্ছু না!” মাহীর মা ওর মাথায় আলোতো করে হাত বোলাতে লাগলেন।
ওর সন্তুষ্টি হল না। চোখের সামনে বার বার ভেসে উঠল কালো চাদরের একটা অবয়ব। মুখ, চোখ, হাত, পা কিছুই স্পষ্ট করে দেখা যাচ্ছে না। অথচ কি ভীষণ দ্রুততা। ভয় লাগে। জড়সড় হাত পা ভিজে ওঠে ঘামে। কিন্তু কৌতুহলকে ও আগল দিতে পারে না। খুব জানতে ইচ্ছে করে।
আজ সন্ধেবেলায় ফেরার সময় ও ছাতিম গাছের কাছে গেছিল। আশপাশের বাড়িতে তখন সন্ধ্যার শঙ্খধ্বনি। কাছ থেকে, খুব কাছ থেকে দেখেছিল দু’জোড়া সবুজ চোখ। আর অদ্ভুত এক জ্বলন্ত দৃষ্টি। ওর অস্তিত্ব যে একেবারেই ওদের পছন্দ নয় মনে হচ্ছিল এমনটা। মনে হচ্ছিল, সবুজ চোখ জোড়া দিয়ে যেন ভিতরটা ছিন্নভিন্ন করে দিতে পারে যেকোনো সময়। স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিল ও। ভয় জাপটে ধরছিল ক্রমশ। আর তারপর মাহী শুনল এক সশব্দ শঙ্খধ্বনি…..
দূরের চোখজোড়া বড়ো হয়ে এগোতে থাকল ওর দিকে। এগিয়ে আর একটু এগিয়ে ক্রমশ কাছে আসতে লাগল কালো একটা চাদর। বাগানের হলুদ ভেপার ঢেকে যেতে লাগল। সামনে স্পষ্ট হল দু’জোড়া সবুজ চোখ আর….আর কী ওটা? দুহাত দিয়ে আড়াল করতে চেষ্টা করল নিজেকে। প্রাণপণে পালাতে চেষ্টা করল। কিন্তু ততক্ষণে ওর পা দুটো প্রায় মাটির সঙ্গে গেঁথে গেছে। ও কিছুতেই নিজেকে ছাড়াতে পারছে না। আর ইঞ্চিখানেক ব্যবধান। আর একটু এগোলেই…..সর্বনাশ….
গলা দিয়ে আওয়াজ বেরোনো বন্ধ। ও দেখতে পাচ্ছে খিলখিলিয়ে হাসছে দুটো দাঁত। এগিয়ে আসছে ক্রমশ। আরো দূরে কোথাও খুব শোরগোল হচ্ছে। কারা যেন চিৎকার করে, নিষেধ করে চলেছে। একসঙ্গে অনেকগুলো কথা যেন ওকেই কিছু বলতে চাইছে। তীক্ষ্ম খুব তীক্ষ্ম ধারাল বাঁকানো দুটো সাদা দাঁত ওর খুব কাছে। আর কিছুতেই পারছে না মাহী। বাঁচতেই হবে। যে করে হোক বাঁচতেই হবে। দম বন্ধ হয়ে আসছে। প্রাণ বাঁচাতে পাগলের মত চিৎকার করে বলে উঠল মাহী, “বাঁচাও, বাঁচাও……ও আমাকে খেতে আসছে……”
নিজের চিৎকারে নিজেই চমকে উঠে চোখ খুলল মাহী। আর চোখ খুলেই বুঝল খুব জোরে জোরে কয়েকজন কথা বলছে। খাট থেকে পা নামিয়ে জানলার কাছে গেল ও। দেখল ও, আবীরকাকু দুধওয়ালাকাকু আরো কয়েকজন কী বিষয়ে খুব কথা বলছে। তার ভেতর একটা শব্দ বারবার ওর কানে আসছিল, বাদুড়। আর সঙ্গে সঙ্গে আপনা থেকেই ওর চোখ চলে গেল ছাতিম গাছটার দিকে। সেই ডাল এখনো তেমনি। কিন্তু কই? কিছু তো নেই ওখানে! কালো চাদর, ঝুলে থাকা চোখজোড়া নেই…..কিচ্ছুটি নেই….
৬
“কঁহিপর কুছ ভি নহি হৈ বাবুজি। মার ডালা মেরে বাছরেকো। “
কাঁদতে কাঁদতে কুনালবাবুকে বলে উঠল রামুকাকা। সবাই ভিড় করে দাঁড়িয়েছিল মরা বাছুরটাকে ঘিরে। এক সপ্তাহ হল বাছুরটা হয়েছে। তাই গোয়ালঘর থেকেই ওকে বের করা হত না। বড়োদের পাশ কাটিয়ে মাহী খানিকটা এগিয়ে এল। দেখল খড়ের উপর শুয়ে আছে বাছুরটি। আর ওর গলায় যেখানটা দড়ি বাঁধা আছে, তার একপাশে একটা লাল ছিদ্র। যেটা দিয়ে রক্ত বেরিয়ে শুকিয়ে রয়েছে সামনের খড়ের কিছুটায়। মাহী শিউরে উঠল। আতঙ্ক আর ভয়গুলো যেন হুড়মুড়িয়ে ঢুকে পড়ল ওর চারপাশে।
“দেখিয়ে বাবুজি, চামগাদার নে কেয়া কিয়া। মেরা সব ফল খা গ্যায়ে। খতম হো গ্যায়ে সাব। খতম হো গ্যায়া। বাছ্রা ভি আউর ফল ভি।“
রামুকাকার আঙুল লক্ষ করে ও তাকাল সামনের লিচু গাছটায়। একটা ফল ও আর অবশিষ্ট নেই। এইতো সেদিন ও দেখেছিল গাছ ভর্তি ফল। ওদের সবাইকে চার – পাঁচটা খেতেও দিয়েছিল রামুকাকা।
নাহ্, আর কোনো উপায় নেই। ঝিম ধরা হাত, পায়ে সাহস সঞ্চয় করে মাহী দৌড়াল ইশুর বাড়ির দিকে। ওকে জানাতেই হবে।
“কাকিমা ও কাকিমা, ইশু আছে?” নিচ থেকে চিৎকার করে ডাকতে লাগল ও।
“কী হয়েছে রে ?” জানালা দিয়ে মুখ বাড়াল ইশু।
“তাড়াতাড়ি আয়। সাংঘাতিক কান্ড হয়ে গেছে। বাদুড় মেরে ফেলেছে রামুকাকার বাছুরটাকে আর ফলগুলোও খেয়ে গেছে সব। “
“কী বলিস রে!”
“সত্যি বলছি তুই নাম।“
“মা আমি এক্ষুনি আসছি।“ বলেই ইশু পায়ে চটি গলিয়ে ছুট দিল ওর সঙ্গে। মনে মনে সে বিশ্বাস করল না ঠিকই। কিন্তু কোথাও যেন একটা শঙ্কা দেখা দিয়েছে ওর মনেও।
“কী বলিস রে? বাদুড় বাছুর মেরে ফেলেছে? কে বলেছে তোকে?”
“আমি তো নিজেই দেখলাম বাছুরটার গলায় ছোট ফুটো। যেখানে দাঁত ফুটিয়ে রক্ত চুষেছে। আর জানিস, এখন ছাতিমের ডালেও কোনো বাদুড় নেই। পালিয়েছে। নয়তো….
“নয়তো….? চল তবে…!” ইশু, মাহীকে টেনে ডানদিকের মোড়ের মাথার দিকে ঘুরল।
“আমি বলছি কি, টুবলাই আর আয়ুধকে সঙ্গে নিলে হত না?”
“হয়, তবে ব্যাপারটা একদম পাঁচকান করবি না। “
“সে করব না। কিন্তু আমার যেন কেমন একটা লাগছে। শুনেছি ওরা খুব সাংঘাতিক হয়। “
“আজ সাংঘাতিকদের মজা দেখাচ্ছি দাঁড়া। “ ইশু, টুবলাই দের বাড়ি থেকে ব্যাট আর উইকেট ক’টা নিয়ে দৌড় দিল।
“হে ভগবান রক্ষা করো। হনুমানজি রক্ষা করো আমাদের।“ ভুজুং লকেটটা ধরে ক্রমাগত রামনাম জপ করতে শুরু করল।
“কনসেন্ট্রেশন ব্রেক করিস না। ধমক দিল ইশারা।
মিনিট সাতেক। ওরা এসে পৌঁছল শেওড়া গাছের দক্ষিণ কোণে। এখান থেকে পরিষ্কার দেখা যায় পোড়ো বাড়ি ও দালানের একাংশ। ইশুর পাশাপাশি হেঁটে ঢুকল ও। পিছনে ভুজুং, টুবলাই আর আয়ুধ। শুকনো পাতা মাড়িয়ে ওরা দালানে পা দিতেই শনশন শব্দে মাথার উপরে চক্কর কাটতে লাগল চার পাঁচটা কালো ডানার বাদুড়। পাখার ঝাপটা আর গোলাকারে ঘুরে বেড়ানো শব্দগুলো ক্রমশ নিচে নামতে লাগল। আর অপেক্ষা নয়। ইশু আর মাহী ওদের হাতের ব্যাট তুলে সজোরে ডানা লক্ষ করে ঝপাট করে একটা শব্দ করতেই বাদুড় গুলো এ, ওর গায়ে ধাক্কা খেয়ে ঝটপটিয়ে ঢুকে পড়ল নাক বরাবর একটা অন্ধকার ঘরের মধ্যে।
“আজ শেষ করে ফেলবো শয়তানগুলোকে। রাগে গরগর করতে করতে ইশু সোজা ঢুকে গেল ঘরটায়।
“যাস না প্লিজ,” ভয়ে থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে ভুজুং বলল, “আজ আমাদের কেউ বাঁচব না। কেউ না। “
“ইশুকে একা ছাড়া ঠিক হবে না।“ বলতে বলতে মাহী দৌড়ল পিছন পিছন। বাকিরাও পিছন নিল উপায় না দেখে।
অন্ধকার ঘরে ঢুকতেই বাইরের শব্দগুলো কেমন থম মেরে গেল। চারপাশটা নিশ্চুপ একটা স্যাঁতস্যাঁতে একটা ভাব। দেওয়ালের ধারে চারকোনা একটা আলো। কাছে যেতেই মাহি ঠাওর করল ওটা একটা জানলা। ঝুল আর মাকড়সার জালে স্পষ্ট করে দেখা যাচ্ছেনা ঠিকই, কিন্তু উপর দিকে চাইতেই চোখে পড়ল কড়িকাঠের এক কোণে দলা পাকিয়ে জমাট বাঁধা কিছু কালো।
“শয়তানগুলো ঐখানে ঘাঁটি গেড়েছে। শেষ করে ফেলব আজ। “
“ইশু, ওই দ্যাখ ঐদিকে কী একটা দৌড়ে ঢুকল।“ মাহী দরজার দিকে হাত দেখাল।
“ওরে বাবা ভ্যাম্পায়ার। “
ভুজুংকে সরিয়ে মাহী আর ইশু দৌড়াল দালানের সোজাসুজি উল্টো দিকের ঘরটায়। ভেজানো দরজা ভিতর থেকে বন্ধ। ওরা খুব জোরে ধাক্কা দিতে লাগল। ব্যাট দিয়ে কয়েক চাপড় মারতেই ভাঙাচোরা দরজার পাল্লাটা ফাঁক হতেই, আচমকা সজোরে ধাক্কা মেরে চাদর মুড়ি দেওয়া কেউ একটা পালাল। ভুজুং হুমড়ি খেয়ে পড়ল চৌকাঠে।
“ধর শিগগিরি ধর।“ টুবলাই, আয়ুধ ছুট লাগাল।
ভুজুংকে হাত ধরে তুলে ইশু আরেকটা আঘাত দিল দরজায়। বেঁকে গেল একটা পাল্লা। ও মাকড়সার জাল ছিঁড়ে ছিঁড়ে ঢুকল ঘরের ভিতরে। আঁশটে একটা গন্ধে গা গুলিয়ে উঠল মাহির। কোনমতে নাক চেপে ঘরে ঢুকতেই একটা বিশাল কালো পর্দায় চোখ আটকে গেল।
শিরশিরানি ভাবটা, শিরদাঁড়া বেয়ে নামতে শুরু করল। “ওটা কী রে?” হাত দেখাল মাহী।
দেওয়াল জুড়ে বেশ বড় মাপের কিছু একটা। নিচের দিকটা সরু হয়ে মাথার মত। সর্বনাশ। এটাই কি তবে সেই ভাম্পায়ার! ঢোক গেলার ক্ষমতা হারিয়ে ওরা শুধু দেখেই যাচ্ছে।
হঠাৎ সমস্ত সাহস সঞ্চয় করে জিনিসটার গায়ে ব্যাট দিয়ে সপাটে একটা আঘাত করল ইশু। আর ঠিক তখনই হুড়মুড়িয়ে ঝরঝর ফটফট করে কী সমস্ত ঝরে পড়তে লাগল পর্দার আড়াল থেকে। একটা নয়, দুটো নয় অজস্র। আর সবশেষে একটা বস্তা প্রায় উপুড় হয়ে ধুস শব্দ করে পড়ল ওদেরই চোখের সামনে। নিচু হয়ে হাতে তুলে নিল ইশু। আরে এগুলো তো লিচু? ভুজুং আর মাহীও দেখল। সত্যি তাই তো।
“এবার বুঝতে পারছিস তোদের ভ্যাম্পায়ার কী করেছে?” ইশু, কোমরে হাত গুঁজে বলল।
“তাহলে ওটা কী?” মাহী বাইরের দিকে হাত দেখাল।
“আয়, শিগগিরই আয়। “আয়ুধ আর টুবলাই প্রায় টানতে টানতে নিয়ে আসছে কাউকে।
“ভুজুং, মাহী, ইশু এই দ্যাখ!”
চৌকাঠ পেরিয়ে দালানে পা রাখতেই তাপ্পি মারা শাল মোড়া একটা লোককে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল মাহী।
“এটা কে রে?” ইশু এগিয়ে এক হেঁচকা টানে লোকটার মুখের ঢাকা অংশ।
“আরে এটা ওপাড়ার দাগী বিল্টুদা না?”
ওরা সবাই ঘিরে ধরল বিল্টুকে। জোর করে টানতে টানতে নিয়ে গেল রামুকাকার বাড়ির দিকে।
রামুগোয়ালা তখন মাথায় হাত দিয়ে উঠোনে বসে। ঘোষপাড়ার চৌহুদ্দিতে এই একটা মাত্র গোয়ালা যে ফল আর দুধের ব্যবসা করে। এই ক্ষতির দরুন খুবই ভেঙে পড়েছে দেখেই বোঝা যায়।
“এই নাও কাকা তোমার আসামি?” লোকটাকে সামনে এনে ফেলল ইশু।
“ইয়ে কৌন হ্যায়?”
“এ তোমার ফল চুরি করেছে। ওই পোড়ো বাড়িতে লুকিয়ে রেখেছে তোমার গাছের সমস্ত ফল। ব্যাটা এতদিন ওখানে লুকিয়ে থাকতো। একদিন মাহীর সঙ্গে ধাক্কা খেয়েছিল। ও ভয় পেয়েছিল বাদুড় মানুষ ভেবে।“
রামুকাকা এগিয়ে এসে কষিয়ে থাপ্পড় মারল বিল্টুদাকে। এ-পাড়া, ও-পাড়ায় ছোটোখাটো চুরি করায় সবাই ওকে দাগী বিল্টু বলেই চেনে। দুবার জেলেও গেছিল।
ওরা বিল্টুকে ধরেছে জানাজানি হওয়ায় মা, বাপিও চলে এসেছে। হরিহরকাকা, সমীরণদাদুও এসেছে। বেশ একটা ছোটোখাটো জমায়েত হয়ে গেছে। সবাই বাহবা দিচ্ছে ওদের। তাও কোথাও একটা খচখচ করতে লাগল। মাহী পায়ে পায়ে এগিয়ে গেল গোয়ালঘরের দিকে। বাছুরটা আর নেই। রামুকাকা হয়তো কবর দিয়ে দিয়েছে। কিন্তু এখনও শুকনো লাল দাগটা লেগে আছে। মাহী বুঝতে পারছিল না বাছুরটাকে কে মারল? কাকার এক ছেলেকে দেখে দৌড়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, “সামুদা কে মারল তোমাদের বাছুর?”
“ক্যায়া বাতায়ে বাবুজি। পাতা নেহি। কোই চিজ নে কাট লিয়া হোগা। “
ঘুণ ধরা শঙ্কাটা ক্রমশ মাহীর মন জুড়ে আস্তানা গাড়তে লাগল। চারপাশে সবুজ গাছ আর খড়ের বিছানা। উঠোন পেরোতেই একটা খসখস শব্দে পিছন ফিরে তাকালো মাহি। দেখল চার পাঁচটা গাছের পরে লম্বা আমগাছের ডালে উড়ে এসে বসেছে একটা কালো থলি। আর তার মধ্যে থেকে একটা সবুজ চোখ যেন ওরই দিকে তাকিয়ে…