সঞ্চয়

সঞ্চয়

আম্মার বেশিরভাগ মুরগী ই ডিম দেওয়ার সময়ে মারা যেত বিভিন্ন অসুখে। এই নিয়ে আম্মাকে কখনোই বিচলিত হতে দেখিনি। আম্মার আশা ছিল প্রবল। হাসি হাসি গাল করে বলত ” দেখিস বাপ, একদিন আমার মুরগি ডিম দিবই”। প্রত্যুত্তরে আমি তাচ্ছিল্য করে বলতাম ” ডিম দিবে না ছাই “।
আম্মারা জ্যোতিষি হয়। তাই আম্মার কথাটা ফলে গেল।

এক সকালে আম্মা চোখ ভর্তি জল নিয়ে আমার সামনে এসে দাড়াল। কাঁদো কাঁদো গলায় আমার চোখের সামনে ধবধবে সাদা ডিমটা নাড়িয়ে গলায় উৎসব এনে বলল – ” দেখ বাপ দেখ, আমার মুরগী আজকে সত্য ই ডিম দিছে “।

কোন এক অদ্ভুত কারণে সেদিনের পর থেকে আম্মার কোন মুরগীর মরার খবর পাইনি আর। যদিও ডিম দিত কি দিত না তার খোজ আমার কাছে আর আসত না। আমার আন্দাজ ছিল আম্মার মুরগী ঐ একবার ই ডিম দিয়েছে। কারণ ঐ একবার ই খুব উৎসব করে আমার পাতে ডিম ভাজি তুলে দিয়ে বলেছিলেন ” নে এবার এটা মাখিয়ে পেট পুড়ে চারটা ভাত খা”। এরপর আর কোন দিন ডিম ভাজি তো দূরের কথা ডিমের গন্ধ ও নাকের বারান্দায় আসেনি।

মেট্রিক পরীক্ষার বাকী তিন মাস। স্কুলের হেডমাস্টার বললেন ” আর পাঁচদিনের মধ্যে যারা যারা ফর্মফিলাপের টাকা দাওনি অতি অবশ্যই নিয়ে আসবে, টাকা না দিলে ফর্ম ফিলাপ হবে না।”

মাথায় বাজ পড়ল। এত টাকা কই পাব। আব্বা গত হয়ে গেছেন অনেক বছর। আম্মা একা টেনে টুনে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে কোনরকম তিনবেলা পেটের ভাত জোটান। সে কড়া ঘা’র উপর হঠাত ফর্ম ফিলাপের এতগুলা টাকার কথা আম্মা কে বলাটা বড্ড বেমানান ঠেকছিল। বললেও এতগুলা টাকা যে আম্মার পক্ষে দেয়া অসম্ভব জানা ছিল।

এক দিন গেল। দুদিন গেল। দেখতে দেখতে চার দিন ই চলে গেল। না, টাকা টা আর যোগাড় হল না। মনে মনে স্বিদ্ধান্ত নিলাম পরীক্ষা দিব না। দু একদিনের মধ্যে জেঠার খামারে কাজে লেগে মা কে সাহায্য করব।

রওনা দিলাম স্কুলে। সোজা গিয়ে দাঁড়ালাম হেডমাস্টারের সামনে। উনি আমার দিকে ছল ছল করে তাকিয়ে বললেন ” কিছু বলবি? আমি মাথাটা নুইয়ে যখন কথা বলতে লাগলাম ততক্ষণে আমার গলায় কান্না জড়িয়ে গেল। বলতে লাগলাম – ” আমার আর পড়া হবে না, টাকাটা জোগাড় হয়নায়, আপনি স্যার আমারে লিস্ট থেইকা বাদ দিয়া দেন”। স্যার আমার কথা কেড়ে নিয়ে অবাক করে দিয়ে বললেন – ” কি বলিস আবোল – তাবোল? তোর টাকা তো জমা হয়ে গেছে আজ সকালেই, তুই বরং কেরানীর রুমে গিয়া স্বাক্ষরপত্রে স্বাক্ষর করে আয়।”

স্যারের মুখে কথাটা শুনে আমার কানকে তীব্র অবিশ্বাস হতে লাগল। ভাবলাম স্যার মজা করছে নাতো আমার সাথে? বিস্ময় কাটিয়ে স্যারকে প্রশ্ন করলাম ” কি বলেন স্যার, কে দিবে আমার এতগুলা টাকা? আমিতো কোন টাকা ই জোগাড় করতে পারিনি।
স্যার গালে বিস্ময় এনে জবাব দিলেন ” কেন রে, তোর মা ই তো আজ সকালে এসে টাকাটা জমা দিয়ে গেলেন, তুই জানিস না?”
একটা ধাক্কা খেলাম। মুহূর্তেই আমার গলার কান্নারা সরে গিয়ে সেখানে বিশ্বাসের সুর এসে আমায় আলতো করে বলিয়ে দিল “মা”।
এক ঝুড়ি প্রশ্ন আর কোতূহল নিয়ে দৌড়ে ছুটতে লাগলাম আম্মার কাছে। প্রশ্ন তাড়া করছে। এত টাকা মা কোথায় পেল? কিভাবে ই বা জানলেন আজ ক ফর্ম ফিল আপের টাকা জমা দেয়ার শেষ তারিখ?

ঘরে ঢুকতেই দেখি আম্মা বিছানায় জড়সড় হয়ে এক কোণে শুয়ে আছে। হাঁপাতে হাঁপাতে গিয়ে আম্মার একদম মাথার কাছটায় গিয়ে বসলাম। কপালে হাত দিয়ে বুঝলাম কপাল পুড়ে যাচ্ছে জ্বরে। আমার হাতের স্পর্শে আম্মা চোখ মেলে আমার দিকে তাকালেন মায়া চোখে। চটজলদি ঠোট নাড়িয়ে একের পর এক প্রশ্ন গুলো করতে যাব ঠিক সেই মুহুর্তে আম্মা আমাকে মাথার কাছে টেনে কপালে চুমু খেয়ে হেসে বলতে লাগলেন-

” বাপধন, তোর মনে আছে ঐ একটা মুরগীর ডিমের কথা? জানিস, সেদিনের পর থেইকা রোজ দুইটা মুরগী ডিম দিত। তোকে লুকাইয়া ডিম গুলা আমি জমায় রাখতাম। জমতে জমতে ডিম এক কুড়ি দুই কুড়ি হইতে লাগল। তোরে না জানাইয়া লুকায় লুকায় ঐগুলান বেইচা দিতাম। যে টাকা পাইতাম ঐগুলা বিছানার তলে লুকাইয়া রাখতাম। আজ সকালেই হিসাব কইরা দেখি মেলা টাকা। ঐগুলা দিয়াই আজ তোর ফরম ফিলাফের টাকাটা জমা দিয়া আসলাম। তুই কিন্তু মন দিয়া পড়িস বাপ। ”
মার মায়ামাখা শ্যামলা মুখমন্ডলের দিকে তাকিয়ে মুগ্ধ হয়ে কথাগুলা শুনতে লাগলাম। কিন্তু বিন্দুমাত্র অবাক হলাম না। একবারের জন্যে আর জিজ্ঞাসা করলাম না তুমি কিভাবে জানলা আজকে যে আমার ফর্ম ফিলাপের শেষ তারিখ ছিল?

কারণ আমিতো জানি “আম্মারা জ্যোতিষি হয় “।
দৌড়ে গিয়ে ডাক্তার নিয়ে এলাম। রাতে আম্মার জ্বর পড়ে গেল।
ওষধ খাইয়ে আপেল আর মাল্টার টুকরা খাওয়াতে লাগলাম। আম্মা আপেলের টুকরাটা গালে তোলার আগে আমার দিকে বিস্ময় দৃষ্টি করে তাকালেন। আমি এবার আম্মার কপালে একটা চুমু খেয়ে হেসে হেসে বলতে লাগলাম-
” আম্মা ঐ যে তোমার দেয়া একদিনের ঐ পাঁচটাকার কথা মনে আছে? তারপর থেকে রোজ তুমি আমাকে পাঁচ টাকা করে দিতে। টিফিনে আমি টাকাটা কোনদিন ই ভাঙাতাম না। রেখে দিতাম বিছানার তলে। একটু আগে গুণে দেখলাম মেলা টাকা। ঐগুলা দিয়াই ডাক্তার খরচ, ঔষধ খরচ, আর চারটা আপেল কমলা নিয়া আসছি তোমার লাইগা”।

আম্মা হাসলেন। যখন আম্মা খুব আরাম পান তখন এই হাসিটা হাসেন। আপেলের টুকরাটা চিবুতে চিবুতে আম্মা আমাকে বুকে জড়িয়ে নিলেন। আমিও চুপ হয়ে বুকে লুকিয়ে গেলাম শান্ত ছেলের মতন।
আর কিছুই বললাম না। আমার আর কিচ্ছু বলাও লাগেনা।
কারণ “আম্মারা তো জ্যোতিষি হয়”।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত