মেডেল

মেডেল

সংগ্রামপুরের ক্রীড়াপ্রেমী বলে জন্মে খ্যাতি ছিল না। বলতে কি, মেচেদা থেকে সাড়ে সাত কিলোমিটার উজিয়ে আসতে হয় যে গ্রামে, তার নাম সংগ্রামপুর না হয়ে ধ্যাদ্ধেরেপুর হলেই মানাত ভাল। কিন্তু নাম যেকালে রাখা হয়েছে সেকালে না ছিল ইস্টিশন না ছিল কোন যোগাযোগ ব্যবস্থা। কঠিন সংগ্রাম করে জীবন চালাতে হত বলেই হয়ত কোন সুরসিক জমিদার এই নাম দিয়ে দিয়েছিলেন মোরগ-গরু-ছাগল-পুঁইমাচা শোভিত, এঁদো ডোবা-সজ্জিত, মশকবিনন্দিত এই গ্রামটার।

আর এখন আরেক জমিদার গ্রামশোধন করার উদ্দেশ্যে সবাইকে ফুটবল খেলা ধরিয়েছেন। নাহয় আট-আনার জমিদার-ই হলেন তিনি, তবু মরা হাতি লাখ টাকা, ওয়ান্স আ জমিন্দার অলওয়েজ আ জমিন্দার। এসব আওড়াতেন অবশ্য ভজগৌরাঙ্গ তালুকদার, মানে ত্রিবিক্রম তালুকদারের পূজনীয় পিতৃদেব।

কথায় বলে না, নামমাহাত্ম্য? ত্রিবিক্রম তালুকদারের সেই কেস। সুখী নধর চেহারা, ফরসা মুখে টুসটুসে হাসি আর আদুরে নোয়াপাতি ভুঁড়ি দেখে যতই যশোদা কা নন্দলালা মনে হোক না কেন, তাঁর হুংকারে এখনো জমিদারবাড়ির পিছনের শ্যাওলাপুকুর, থুড়ি, দেখেছো দুষ্টু ছেলেপুলের কথা শুনে শুনে আমারই ভুল হয়ে যাচ্ছে, মানে পিছনের শাপলা-পুকুরে বাঘা-গরুতে একঘাটে জল খায়। বাঘা ত্রিবিক্রমের পোষা অ্যালশেসিয়ান। গরুটা অবশ্য ভ্যারিয়েবল, যেদিন যে ঐ পুকুরপারের মাঠে চরাতে ছেড়ে যায় তার।

এই যে দুষ্টু ছেলেগুলো হো হো করে সারাক্ষণ ওই মাঠে কাবাডি আর গোল্লাছুট খেলত, যারা তালুকদার বাড়ির এত সাধের শাপলা পুকুর কে শ্যাওলাপুকুর, ‘সাধন নিবাস’কে ‘ধন্যি বাসা এত্ত মশা’, ‘সরোজসুন্দরী প্রাইমারি শালা’ কে ‘রোজের জ্বালা’, মায় স্বয়ং ত্রিবিক্রম তালুকদার, এম এ ইংলিশ, কে ‘তিড়বিড়ে বুড়ো’ নাম দিয়েছে, সেই হতভাগাগুলোকে ঢিট করতেই ত্রিবিক্রম গ্রামে ফুটবল টুর্নামেন্টের আমদানি করেছেন। ব্যাটাদের ব্যস্ত না রাখলেই সারা গ্রামকে জ্বালিয়ে মারবে। তাঁর নিজের অবশ্য ইচ্ছে ছিল পুষ্করিণী সংস্কার, জঙ্গল বিদূরণ ইত্যাদি হোক, অথবা কোন সাহিত্যসভা। কিন্তু সাহিত্যের নাম শুনেই রে রে করে তেড়ে এলেন তাঁর অর্ধাঙ্গিনী, “ফের লোক ডেকে নিজের উনোমুখো কবতেগুলো শোনানোর চেষ্টা করছো তো? কেউ আসবে না বলে দিলুম, যাও না যাও, স্টেজে চড়ে কবতে পড়ো, আমি দায়িত্ব নিয়ে সারা গ্রামকে বাড়িতে ডেকে সেই সময়ে লুচি হালুয়া খাওয়াব বলে দিলাম হ্যাঁ!”

সাধে কি বলে ঘরশত্রু বিভীষণ!

আর সংস্কার ইত্যাদির কথা শুনে ছেলেগুলো হ্যা হ্যা করে হেসে দিল, “মালকড়ি কত দেবেন দাদু, অত খাটনি মিনিমাগনায় পোষাবে না।”

ফুটবল ম্যাচটা ওদেরই আইডিয়া। শ্যাওলা-পুকুর সাফ করে দেবে ওরা, কিন্তু তার বদলে ম্যাচ করতে হবে স্কুলের মাঠে, ট্রফি দিতে হবে, ফুটবলের সরঞ্জাম কিনে দিতে হবে আর রাতে মাংস ভাত।

মন্দ লাগেনি কথাটা। একবার ফুটবল কিনে দিলে অনেকদিনের জন্য রেহাই, স্কুলের মাঠেই খেলবে এরা এবার থেকে, বাড়ির পাশের সারাক্ষণের ক্যাচর-ম্যাচর থেকে রেহাই পাওয়া যাবে। আর পুকুরটাও সাফ তো হচ্ছেই। রাজি হয়ে গেছিলেন তিনি।

খালি একটা শর্তে। ম্যাচের দিন প্রধান অতিথি করে কোন খ্যাতনামা সাহিত্যিককে আনতে হবে, আর সেটা এই ছেলেগুলোর দায়িত্ব ব্যবস্থা করার।

 

“এই বিশু, খুব যে রাজি হলি বুড়োর কথায়, তা সাহিত্যিক পাবি কই? এমন হয়ে যাবে হয়ে যাবে বলে দিলি যেন পকেটে নিয়ে ঘুরছিস চাট্টে সাহিত্যিক।”

“তুই কত বেশি ভাবিস রে মিল্টে! পকেট ছাড়, চারটে সাহিত্যিকের নাম বলতে বল বিশুকে!”

মনে মনে তো সেটাই ভাবছিল বিশু। ফুটবলের লোভে পড়ে রাজি তো হয়ে গেল, এখন সাহিত্যিক জোটায় কোথা থেকে!

“কলকাতা চলে যা, বুঝলি! সাহিত্যিক গুলো সব কলকাতায় ঠেক করে, শুনেছি আমি।“

রবিকে এমনিতে পাত্তা দেয় না বিশেষ, ল্যাকপেকে হেঁড়ে মাথা ছোকরা পড়ায় ভাল হলে কি হবে, না পারে গাছ বাইতে, না পারে জোরে দৌড়তে। খেলায় যে টিমেই নেবে সেটাই উইক হয়ে যাবে। কিন্তু আপাতত সাহিত্যিক পাকড়াও করা বেশি জরুরী, নইলে ফুটবল হবে না। তাই রবিকেই আঁকড়ে ধরে বিশু খড়কুটোর মত।

“তুইও চ’ তাহলে। আমি তো অত জানি চিনি না, হয়তো দেখেও বুঝব না”

সেইমত দুজনে রওনা দিল পরদিন। টাকা ত্রিবিক্রমই দিয়েছিলেন, বলা বাহুল্য। গিন্নির মুখঝামটার ভয় না থাকলে তিনি নিজেও যেতেন ওদের সঙ্গে।

 

অরণির বহু দিনের শখ সামনের ঘেমো জামা আর খাকি প্যান্ট পরা লোকটার মত, ফুটপাথে উবু হয়ে বসে বেছে বেছে বই তুলবে, পাতা নাড়বে, গন্ধ শুঁকবে, আবার রেখে দিয়ে আরেকটা বই হাতে তুলে নেবে। কিন্তু ফ্ল্যাট-ফুট হবার ফলে সে উবু হয়ে বসতে পারে না। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চেয়েচিন্তে বই নিয়ে দেখে ঐ সুখটা ঠিক হয় না। এখন, কফি হাউসের সামনেটায় বরুণের জন্য অপেক্ষা করতে করতে তার লোকটাকে দেখে খুব হিংসে হচ্ছিল।

এরকম কত কিছু শখ এ জীবনে আর হয়ে উঠল না! এই যে সেই কোন ছোটবেলায় পান্তুমামা শুনিয়েছিল, “লিখতে লিখতে সরে, আর … তা তুই যখন পরেরটা, আগেরটাও চেষ্টা করলে হয়ে যেতেই পারিস!” অরণি একটু পেটরোগা ছিল বটে, ফটিকের চুরমুর কি বিহারীদার ঘুগনি খেলেই তার পেট ছাড়ত অবধারিত। কিন্তু প্রবাদের প্রথম আদ্ধেক তার মনে এতই রেখাপাত করেছিল যে সে সেদিনই মায়ের থেকে টাকা আদায় করে একটা মোটা লাইন টানা খাতা এনে লেখালেখি শুরু করে দিয়েছিল।

তারপর চোদ্দ বছরে সতেরোটা খাতা আর ডায়রি ভরপুর করে ফেলেছে সে। কাঁধের ল্যাপটপ ব্যাগে তাঁর শেষতমটা আছে আজ। তার ফর্সা, সৌম্য, মোটা ফ্রেমের চশমা আর হালকা দাড়িওলা চেহারার এই একটা বেজায় সুবিধে। শার্ট প্যান্ট টাই পরে অফিস গেলে দিব্যি ব্যাঙ্কের ইয়ং এক্সিকিউটিভ হিসেবে মানিয়ে যায়, আবার আজকের মত পাঞ্জাবি-জিন্স চাপালে মার্কামারা তরুণ কবি। তবে কিনা অরণি দত্ত অফিসে প্রায় কাউক্কে বলেনি যে সে লেখক, নিয়মিত কোষ্ঠ সাফ করার মতই নিষ্ঠায় গল্প লেখে।

মুশকিল হচ্ছে, সে গল্পগুলো অরণির মতে জম্পেশ হলেও, কেউ ঠিক শুনতে বা পড়তে চায় না। এই ছোটবেলার বন্ধু বরুণ ছাড়া এক। কিন্তু বরুণের সময়জ্ঞান সাংঘাতিক। গত পঁয়ত্রিশ মিনিট ধরে অরণি একবার বাঁ পা আর একবার ডান পায়ে ভর দিয়ে যে দাঁড়াচ্ছে, উনি সবে বাগবাজার থেকে শ্যামবাজার অবধি এসেছেন এর মধ্যে খবর পাওয়া গেছে।

এই ছেলে দুটো এই নিয়ে তৃতীয়বার ওর সামনে দিয়ে এদিক ওদিক চাইতে চাইতে গেল। রাস্তা ফাস্তা হারিয়ে ফেলেছে নাকি? বরুণের ফোন সুইচ অফ আসছে এবার। মহা বিরক্ত লাগছে। কাঁধের ব্যাগটা সাপটে ধরে রাস্তা পেরোলো অরণি, আর দাঁড়ানো যাচ্ছে না, কফি হাউসে গিয়ে বসা যাক।

অরণি ঢুকে যাবার মিনিট দুই পর, পরস্পরকে প্রচুর ঠেলাঠেলি ও গুজগুজ পরামর্শের শেষে ছেলে দুটোও দরজা দিয়ে ঢুকে পড়ল।

 

“হুঁ হুঁ গিন্নী, বুঝেছ, একদম সবচেয়ে নামজাদা উদীয়মান গল্পলেখক। অরণি দত্ত। নামটা শুনলেই বোঝা যায় একদিন এ-নাম দিকে দিগন্তে ছড়িয়ে পড়বে। তাকে নিয়ে আসছি ফাংশনে, বুঝেছ? তারপর আমার কয়েকটা কবিতা যদি তাকে শোনাতে পারি, তার যদি ভালো লাগে…হুঁ হুঁ!”

ত্রিবিক্রমের গিন্নী অবশ্য পাত্তা দেন না বিশেষ, “তোমার ঐ খাটাস মার্কা কবিতা যদি কারো ভালো লাগে তবে সে নিজেও খাটাস” গোছের খুবই নিম্নরুচির একটা মন্তব্য করে ঘরে থেকে বেরিয়ে যান। তবে ত্রিবিক্রমকে দমানো এত সহজ নয়। তিনি পরদিন থেকেই মহা উৎসাহে পুকুর সাফের তত্ত্বাবধান, ফুটবল ইত্যাদি কেনার জমাখরচ এবং প্রাণ ঢেলে কবিতা লেখা শুরু করে দেন।

সময় মাত্র সাতদিন ছিল। তারই মধ্যে খোকন, রবি, বিশু, সুরজিৎরা পুকুরটা বেশ ঝকঝকে সাফ করে, ফুটবলের সরঞ্জাম কিনে এনে, চোঙা নিয়ে চারপাশে প্রচার করে, মাঠে স্টেজ বাঁধার ব্যবস্থা করে একদম হুলুস্থূল ফেলে দিল। এমনকী ত্রিবিক্রমের গিন্নির দুপুরের আড্ডাতেও আর আসন্ন ফুটবল ম্যাচ আর কলকাতার সাহিত্যিক ছাড়া কথা নেই।

কাল রোববার অনুষ্ঠান। সকাল হলেই রবি আর হারানকাকা চলে যাবে মেচেদা, কথা আছে অরণি ওই অবধি নিজে চলে আসবে, বাকিটা এরা সঙ্গে করে নিয়ে আসবে। দশটায় হেডস্যারের বক্তৃতা, তারপর অরণি দত্তের বক্তৃতা, তারপর ম্যাচ শুরু। ত্রিবিক্রমবাবুও বক্তৃতা দেবেন, কিন্তু তাঁকে আগে স্টেজ ছাড়লে কবিতার পর কবিতা আউড়ে ঘন্টা পার করে দিতে পারে। কাজেই তাঁর বক্তৃতা রাখা হয়েছে শেষকালে, ধন্যবাদজ্ঞাপনের নামে।

শেষ তোড়জোড় করছিল বিশুরা মাঠে। হঠাৎ রবির মাথাতেই কথাটা এল। টাকার হিসেব টায়েটোয়ে মিলিয়ে দিয়েছে সে একটু আগে, ফুল আর মালার বরাত বুঝে নিতে মতিপিসি এসেছিল যখন।

“হ্যাঁ রে, লোকটাকে যে এদ্দূর থেকে আনা হবে, ঐ একটা গাঁদার মালা ছাড়া কিছু দেওয়া হবে না?”

কথাটা শুনে বিশুদের সবার একগাল মাছি। তাই তো! এটা তো একদমই হিসেবে ধরা হয়নি! কত কিছু দেওয়া হয় প্রধান অতিথি আর সভাপতিকে, উত্তরীয়, কিংবা উপহার, কিংবা কোনো মেমেন্টো – তা সভাপতি নয় ত্রিবিক্রম স্বয়ং, তাঁকে বাদ দেওয়া যায়। তাই বলে, বাইরে থেকে আমন্ত্রণ করে আনা প্রধান অতিথিকেও দেওয়া হবে না!

এঃ! আগে খেয়াল হলে, ট্রফির সঙ্গে সঙ্গে এটাও কিনে আনত মেচেদা থেকে। এখন তো আর গিয়ে কিছু কিনে আনারও সময় নেই!

ত্রিবিক্রমবাবুও শুনে ভেবলে যান। এরা নাহয় বাচ্চা ছেলে, তিনিই বা কোন আক্কেলে ভুলে গেলেন! আ ছি ছি, খালি হাতে ফেরত যাবে? তাহলে আর তাঁর কবিতাগুলোরই কি কোনো গতি হবে!

“টাকা নিয়ে ভাবিস না, দ্যাখ না বাবা যদি কিছু আনা যায়…”

এত রাতে, কোথায় আর কী পাবে! ছেলেগুলো মুখ চাওয়াচাউই করে। তখনই মেডেলটার কথা ত্রিবিক্রমের মনে পড়ে। তাঁর পূর্বপুরুষ তিমিরবিনাশ তালুকদারের মেডেল।

তাঁর ঠাকুর্দার বাবা (নাকি, বাবার ঠাকুর্দা বলা ঠিক?) তিমিরবিনাশ তালুকদার এক সাংঘাতিক চরিত্র ছিলেন। সে আমলে তো জমিদারের দাপট থাকা খুবই সাধারণ কথা, তিমিরবিনাশ ছিলেন তার এককাঠি বাড়া। শুধু ঘোর দাপুটে, চারজন লাঠিয়াল পোষা, নিজে কুস্তিগীর, খালি হাতে একসাথে তিনটে লোককে শুইয়ে দেবার মত বলশালী জমিদারই নন, এর ওপর তিমিরবিনাশ নাকি ছিলেন তান্ত্রিক সাধক। লোকে বলত তুক-তাক মন্ত্র-বিদ্যা অনেক কিছু জানা ছিল তাঁর। এই সাধন নিবাসের তিনতলার একটা বড় ঘর এখনো তাঁর আমলের জিনিসপত্রে বোঝাই। বিশাল আরামকেদারা, রূপো বাঁধানো হুঁকো গড়গড়া, গাঁটে গাঁটে পেতল বাঁধানো মজবুত লাঠি, সিন্দুক, আরো কত কী যে আছে সে ঘরে!

সেই ঘরের কুলুঙ্গিতে মেডেলটা আছে। সম্ভবত তাঁর যৌবনের কোন কুস্তির প্রতিযোগিতায় পাওয়া। সে আমলে বোধহয় এত লেখাজোকার বালাই ছিল না, একদম ল্যাপাপোঁছা মেডেল, দুপিঠে কিছুই নেই ধারবরাবর লতাপাতা কাটা কারুকার্য ছাড়া। রুপোর মনে হয়, কিন্তু ইয়া বড় আর বেজায় ভারি। ছোটবেলায় ঐ ঘরটা বেশ খেলার জায়গা ছিল ত্রিবিক্রমের, মনে আছে এটা তাঁর হাতের মুঠোয় আঁটত না এত বড় ছিল।

ভিতরে এসে, গিন্নির থেকে চাবি চেয়ে নিয়ে সেটা পেড়ে আনলেন ত্রিবিক্রম। হাঁটুটা আজকাল তিনতলা উঠতেও জানান দিচ্ছে রে বাবা! মেডেলটার ধুলো মুছতে মুছতে মনে হ’ল আগে যেন সাইজটা আরো বড় লাগত। তবে, নিজের হাতই আসলে ছোট ছিল তো তখন!

“দ্যাখ, মহীর দোকানে বলেকয়ে একটু কিছু যদি ওপরে লিখিয়ে নিতে পারিস!”

পুরোনো হলেও, মেডেলটা বেশ চকচকে ছিল। মহীদা গাঁইগুঁই করল, আবার যত্ন করে ‘সংগ্রামপুরের শুভেচ্ছা সহ’ কথাটা লিখেও দিল মেডেলটার এক পিঠে।

 

পরদিন যখন এই মেডেল গলায় পরিয়ে দেওয়া হচ্ছে, অরণির তখন ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি দশা। সেই কোন সকালে বাড়ি থেকে বেরিয়েছিল। আটটা সতেরোর মেচেদা লোকাল যে এই লেভেলের ধ্যাদ্ধেরে ট্রেন, অরণির কোন ধারণাই ছিল না। তারপর আবার অতক্ষণ ধরে ভ্যান রিকশায় জার্নি। হাড়গোড় তখনই খুলে হাতে চলে আসছে মনে হচ্ছিল। তারপর, উঃ তারপরটা ভাবলেও দাঁত কিড়মিড় করতে ইচ্ছে করছে তার।

না, আদর আপ্যায়ন যে এরা খারাপ কিছু করেছে, তা নয়। আসামাত্তর বড় স্টিলের প্লেটে কচুরী আলুর তরকারি জিলিপি। তারপর ধোঁয়া ওঠা চা বড় কাচের গ্লাসে। অরণি সবে আয়েস করে একটা চুমুক দিয়ে ভাবছিল সিগারেটের প্যাকেটটা বার করবে, এমন সময়ে একগাল হাসি নিয়ে তিনি সামনে এসে বসলেন।

তিনি যে কে সেটা এখন জেনেছে অরণি। স্টেজে ওঠার পর দেখছে তিনিও তার পাশে একটা চেয়ারে জাজ্বল্যমান, এবং অন্য পাশে বসা স্কুলের হেড স্যার ফিসফিস করে জানিয়েছেন ইনি হলেন এখানকার একদা জমিদার বাড়ির হেড, ত্রিবিক্রম তালুকদার। অন্য সময়ে হলে ত-এর অনুপ্রাসের জন্য নামটার তারিফ করত অরণি, কিন্তু বিগত দেড় ঘন্টা এঁর সামনে বসে থাকতে বাধ্য হবার পর গালাগালি ছাড়া আর কিছু মনে আসছিল না তার।

ঊফ্‌! এত ভয়ানক কবিতাও মানুষ লিখতে পারে!

আর দেড় ঘন্টা ধরে ইনিয়ে বিনিয়ে ইনি শুধু সে কবিতা শোনাননি, সেগুলো লেখার অনুপ্রেরণা, সময়, তখনকার সামাজিক পরিস্থিতি অথবা তাঁর নিজের শারীরিক অবস্থা (সেই যেবার সারা গায়ে খোশপাঁচড়া হয়েছিল, এমন ব্যথা – আর জানেনই তো বেদনা থেকেই কবিতার জন্ম), কবিতার অন্তর্নিহিত অর্থ, নামকরণের সার্থকতা, মানে প্রায় ইতিহাস ভূগোল সব পাখিপড়া করে ব্যাখ্যা করেছেন। হ্যাঁ, দেড় ঘন্টা। দশটার বদলে পৌনে বারোটায় যখন দু দল মাঠে নামল, ততক্ষণে অরণির মাথা ঝনঝন, কান কটকট, চোখে সর্ষেফুল সব হয়ে গেছে বললে কম বলা হয়। সে তখন মিনিটে পৌনে এক বার ঘড়ি দেখছে আর নিজেকেই গালি দিচ্ছে মনে মনে।

 

সেদিন বরুণ না এলেও হয়ত বেঁচে যেত। দিব্যি কফি হাউসে ঢুকে, জানলা ঘেঁষে এক টেবিলে নিজের মত এক কাপ ইনফিউশন আর চিকেন কাটলেট নিয়ে খাতাটা খুলে বসেছিল অরণি… এমন সময় ষষ্ঠেন্দ্রিয় বলল সে আর একা নয়।

চোখ তুলে দেখে, সেই যে দুই ছোকরা সমানে তাঁর সামনে দিয়ে ঘুরঘুর করছিল রাস্তায়। একজন বেশ গায়েগতরে হট্টাকট্টা, গুণ্ডা মার্কা, অন্যজন রোগাপটকা। দুজনেই কেমন বিহ্বল মুগ্ধ চোখে তার দিকে চেয়ে ছিল, সে চোখ তুলতেই একান থেকে ওকান অবধি হেসে ফেলল।

“আপনি লেখক। লেখেন।”

তারিয়ে তারিয়ে কথাটা বলল বেঁটে ছেলেটি, যেন তেঁতুলের হজমি লজেন্স খাচ্ছে। অন্যজনের চোখে তখন পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্য দেখার বিভা।

বেশ একটু আত্মপ্রসাদ লাভ করছিল অরণি। মুখে একটু মৃদু হাসি এনে, হ্যাঁ সূচক ঘাড় নাড়ল সে।

অমনি, থেমে না থেমে, হড়বড় করে, হোঁচট খেয়ে, খেই টেইয়ের মাথামুণ্ডু না রেখে, দুজনে মিলে যা বক্তব্য পেশ করল তাতে অরণির আক্কেল গুড়ুম হয়ে গেল। এরা এসেছে কি যেন একটা গ্রাম থেকে, সেখানে ফুটবল ম্যাচের প্রধান অতিথি করতে চায় কোন সাহিত্যিককে, আর অরণিকে বড়মাপের লেখক ঠাউরে নিয়ে তাকেই সে প্রস্তাব করছে।

অরণি আর্তনাদ করে বলতে যাচ্ছিল, আমি না, আমি না, আমি অমন কেউ নই! হতচ্ছাড়া বরুণকে তখনই সামনে এসে দাঁড়াতে হল।

আর কী যে হল অরণির, এদ্দিন ধরে তার লেখা শোনার সৌভাগ্য পেয়েও যে বরুণ তার প্রতিভা চিনতে পারেনি, সেই সুপ্ত ক্ষোভেই হয়তো সে দুম করে বলে বসল, “ঠিক আছে ভাই, তোমরা যখন এত করে বলছ, প্রধান অতিথি হব নাহয় তোমাদের। ডিটেল লিখে দিয়ে যাও, আর হ্যাঁ একটা অগ্রন্থিত গল্প পড়ে শোনাব নাহয় সেদিন!”

বরুণের হতভম্ব মুখের সামনে ছেলে দুটো ঠিকানা লিখে, তাকে প্রণাম করে চলে গেছিল। সেদিন সারাক্ষণ কেমন ভ্যাবলার মত কেমন বসে রইল বরুণ।

কিন্তু এসে এই অত্যাচারের মুখে পড়বে জানলে…যাকগে খেলা শুরু হয়ে গেছে। ছেলেগুলোর স্কিল না থাকলেও, উৎসাহ প্রচুর। অরণি মাঠে মনোনিবেশ করে।

 

রবি বলেই রেখেছিল ফেরার সময়ে সে আর যাবে না, খেলার পরের ভালমন্দ খ্যাঁটনটা মিস করা বোকামি হবে। তাছাড়া চেনা তো হয়েই গেছে, হারানকাকা একাই ভ্যানে করে স্টেশনে ছেড়ে আসবে কলকাতার লেখককে।

সেইমত, পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান শেষ করেই অরণি রওনা দিয়ে দিয়েছে। ত্রিবিক্রম বাবু মনঃক্ষুণ্ণ হয়েছিলেন সভা শেষ হবার আগেই চলে যাচ্ছে বলে, কিন্তু আর দেরি করলে ট্রেন পাব না ইত্যাদি বলে জোরজার করেই বেরিয়ে এসেছে সে।

নির্জন রাস্তা দিয়ে ভ্যানটা যাচ্ছিল, চারদিকে গাছপালা জঙ্গল প্রায়। দুরন্ত রোমান্টিক লাগছিল অরণির, এরকম খোলা সবুজ চারদিকে, এরকম নীল আকাশ, ঝোপে লাল ফুল, মলয় সমীরণ, ঝাঁকুনি…

প্রবল ঝাঁকুনি দিয়ে ভ্যানটা দাঁড়িয়ে গেছে। কী হচ্ছে বোঝার আগেই অরণি দেখল ভ্যানচালক লুঙ্গি সামলাতে সামলাতে ‘দাদা একটু বসুন আমি এইইই গেলাআআম আর এলাআআআআম…’ বলে ঝোপঝাড় ভেদ করে হাওয়া।

কাণ্ড দেখে হেসে ফেলার পর টের পেল, তার নিজেরও একটু হালকা হওয়া দরকার। এদের দেওয়া মালাটালা কাঁধের ব্যাগে আঁটেনি, আলাদা একটা প্লাস্টিকে ভরে নিয়েছিল। ব্যাগ আর প্লাস্টিক দুটোই ভ্যানে রেখে, পাশের গাবদা গাছটার দিকে এগিয়ে গেল অরণি।

ইইক!! এ কী! কাজ সেরে পিছন ফিরতেই দ্যাখে একটা ছোট সাদা ধুতি পরা লোক তার ব্যাগ হাতড়াচ্ছে! চোর নাকি! আরে, ঐ ব্যাগেই তার লেখার খাতাটা আছে!

“এই খবোদ্দার!” বলে বিকট চেঁচিয়ে তেড়ে গেল সে।

লোকটা একটু হকচকিয়ে দু পা পিছিয়ে ঘুরে দাঁড়াল। একমুখ দাড়িগোঁফের জঙ্গল, খায় কি করে ওর ফাঁক দিয়ে! কিন্তু ঝাঁকড়া চুলের নিচে চোখদুটো ধ্বক ধ্বক করে জ্বলছে, যেন আগুনের কুচি। তাকানো যায় না সোজা।

হাতটা অরণির দিকে বাড়িয়ে দিল সে মূর্তি।

“দে! দিয়ে যা বলছি!”

হতভম্ব অরণি কিছু বলার আগেই পিছন থেকে ভ্যানচালকের গলা ভেসে এল, “এই যে এসে গেছি দাদাভাই…”

অমনি, লোকটা ঘুরে দাঁড়িয়ে হাওয়া হয়ে গেল অন্যদিকের ঝোপঝাড়ে।

পাগলই হবে নির্ঘাৎ। টাকাপয়সা চাইছিল ঐভাবে। অরণি আর কিছু বলে না এ নিয়ে, সব জায়গায়ই এমন মক্কেল থাকে দু চার পিস।

 

উল্টোডাঙায় অরণির ছোট্ট এক কামরার ফ্ল্যাট। পাখির বাসা বললে তাই, তা বেশ লাগে ওর। বেডরুমের একপাশে টেবিল চেয়ার পেতে পড়াশুনো, বন্ধুবান্ধব এলে বসার ঘরের গদিতে, মেঝেতে শতরঞ্চি পেতে দেদার আড্ডা। আর কী চাই! একসেট চাবি দেওয়া আছে কাজের দিদিকে, দুপুরে এসে সাফসুতরো বাসন মাজা কাপড় কাচা করে দিয়ে যায়।

ছুটির দিনগুলো সাধারণত রান্নার এক্সপেরিমেন্ট করে অরণি। কচুসেদ্ধর সঙ্গে ম্যাগির তেঁতুলের চাটনি মাখা, সয়াবীনের বড়ি দিয়ে শালগমের ঝোল – এইসব। আজ তো সারাদিন এইসবে চলে গেল, স্টেশনে নেমে রুটি-মাংস কিনে নিয়ে বাড়ি এল একেবারে।

ধকল ভালই গেছে। স্নান করে এসে ঠিক করল আজ আর রাত জাগবে না, খেয়েই ঘুমিয়ে পড়বে। হাই উঠছে অলরেডি।

তারপর মাংসের ভাঁড়টার মুখ খুলতেই, আহা, সে কী সুঘ্রাণ!

রাতে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে ত্রিবিক্রমের বিভিন্ন ভঙ্গির মুখ স্বপ্ন দেখল সে। সকালে ঘুম ভাঙতে সেসব ভেবে হেসে ফেলল। উফ, কাল যা গেছে!

বেরোনোর আগে প্লাস্টিকের ব্যাগটা চোখে পড়ল, ওঃ, মালাটা ফেলে দিতে হবে, নইলে পচে গন্ধ ছাড়বে।

সেটা বার করতে গিয়ে মেডেলটার কথা খেয়াল হল, ভুলেই গেছিল এতক্ষণ। কিসের কে জানে, বেশ ভারি, আর বেশ এলিগ্যান্ট দেখতে। বইয়ের তাকের সামনে যত্ন করে সাজিয়ে রাখতে গিয়েও, হঠাৎ, লোভ হল খুব। প্যান্টের পকেটে ঢুকিয়ে নিল ওটা। লাঞ্চে চুপিচুপি সুশ্রুতকে দেখাবে, যেমন এক আধটা গল্প দেখায়।

*****

বাসন মাজতে মাজতে গলা ছেড়ে নিজের কপালকে গালি দিচ্ছিল কমলী। এই যদি আজ ফুলুর বাপ বেঁচে থাকত তাকে এমন ঝিগিরি করে পেট চালাতে হত নাকি!

ফুলুর বাপ ঘোর নেশাখোর, কাজে অষ্টরম্ভা চিজ ছিল। মারা গেছেও লিভার পচে। সে বেঁচে থাকলে কমলীর কী সুরাহা যে হত কে জানে, কিন্তু বাসন মাজতে বসলেই তার নিত্যদিন এই আক্ষেপ শুরু হয়। গলাটাও তেমনি খ্যানখেনে মাথার ঝিঁকুট নাড়ার মত। কাজেই, কমলী ঘর ঝাঁট দিতে ঢুকলেই ত্রিবিক্রম বাবু পত্রপাঠ বাইরের ঘরে পালান – যতটা দূরে থাকা যায় আর কী।

আজও সেখানে বসে কাগজের শব্দছকটা ধরেছিলেন, হঠাৎ মনে হল সেদিন মেডেলটা আনতে গিয়ে দেখেছিলেন ঘরটা বড় ঝুল ময়লা হয়ে আছে। কমলীকে ঐটে সাফ করে দিতে বলতে এসে এসব কাঁদুনি শুনে পিত্তি জ্বলে গেল তাঁর।

“বলি, বাজে না বকে দুটো কাজের কাজ কর তো! এই নে চাবি, ওপরের কত্তাবাবার ঘরটা ধুলো ময়লায় পিশাচ হয়ে আছে, যা সাফ করে দিয়ে আয় আজ!”

নাঃ, জীবনে আর সুখ নেই। বলতে না বলতে গিন্নির মুখঝামটা ভেসে এল রান্নাঘর থেকে – “বলি ওসব করতে আমার লোক নিয়ে গেলে আজ নুন দিয়ে ভাত খাবে বলে রাখছি। কমলী বাটনা সব করে দিয়ে তবে যাবি এখান থেকে!”

পঞ্চাকে দিয়েই সাফ করাতে হবে হয়তো অগত্যা। কমলীর মুখ যেমন, হাতও তেমন খরখর করে চলে, কাজ দেখতে হয় না। আর পঞ্চাটা হ’ল ফাঁকিবাজ অপদার্থ, হাতটানও আছে লোকে বলে থাকে। তাকে দিয়ে করানো মানে এক মুহুর্তও চোখের আড়াল করা যাবে না। ভাবতেই ব্যথা হাঁটু টনটনিয়ে ওঠে ত্রিবিক্রমের।

তাও করতে রাজি ছিলেন, কিন্তু পঞ্চাটা হাড় বজ্জাত। “ও জেঠু, ও ঘরে ঢুকলেই কেমন গা ছমছম করে গো। ওনার জিনিসে হাত দিয়েছি বলে যদি উনি চটে যান?” এসব বাহানা করে করে কিছুতেই রাজি হ’ল না।

 

আজও বুলির সঙ্গে মিত্তিরবুড়ির খিটিমিটি হয়েছে। রাগে গসগস করতে করতে সে তাই এবাড়ির দাদাবাবুর জামা কাপড় ধোবিপাট মারছিল। মানে বুড়িটাকে তো আর এমন তুলে আছাড় মারতে পারবে না! সাহস দ্যাখো, বলে কিনা “কত্তে তো হয় শুয়ে বসে কাজ, না আমাদের আমলের কয়লা ভাঙা উনুন ধরানো, না শিলে বাটনা বাটা, তাও তোরা পোস্কার করে কত্তে পারিস না!”

শুয়ে বসে কাজই বটে। অত বড় দুতলা বাড়ি, মুছে চকচকে করে দেয় বুলি। মাজা ভেঙে যায় সিঁড়ি ভাঙতে ভাঙতে, বলে কিনা শুয়ে বসে!

দুড়ুম করে প্যান্টটা আছড়াতেই ভারি কী একটা ছিটকে বেরোল পকেট থেকে। দাদাবাবুটাকে নিয়ে আর পারা যায় না! এর আগে এরকম জামা প্যান্টের পকেট থেকে পেন, ঘড়ি, হজমিগুলি, বাচ্চাদের খেলার মার্বল (খুব লজ্জা পেয়েছিল দেখে), টাকার নোট, হিজিবিজি লেখা কাগজ (এইটের শোকে কপাল চাপড়ানোর কোন মানে বুলি খুঁজে পায়নি বাপু, বিশেষ করে আগের দিনই যখন দেখালো একশো টাকার নোট ধুয়ে সাফ হয়ে মড়মড়ে হয়ে এসেছে তখন খালি জিভ কাটল শুধু আর কিসের কী লেখা কাগজ তা নিয়ে হা-হুতাশ!)

আজ আবার কী বেরোল দেখার আগেই প্যান্টটার ফিরতি ধাক্কায় বাথরুম ঘষা অ্যাসিডের বোতলটা পড়ে আদ্ধেক খালি হয়ে গেল! ইশ! ঢাকনা লাগাতে ভুলে গেছিল রে!

তড়িঘড়ি সব গুছিয়ে তুলে রাখে বুলি। দাদাবাবু রোববার স্পোর্টস করতে গেছিল নাকি কোথাও, এমন একটা ইস্কুল মার্কা মেডেল নিয়ে এসেছে! এহহ, অ্যাসিড লেগে গেল মনে হয়, ঝট করে ধুয়ে মুছে পড়ার টেবিলে রেখে আসে বুলি।

আর কাজে মন লাগে না, দায়সারা ভাবে প্যান্টটা কেচে, কাপড়গুলো মেলে দিয়ে চলে যায় ঘর না মুছেই।

 

রাতের ঘুমটা জম্পেশ হচ্ছিল অরণির। বেশ একটা নতুন গল্পের গা ছমছমে প্লট স্বপ্নে আসছিল যেন। পাশ ফিরে শুতেই সেটা হুট করে ছানা কেটে গেল। উসখুস করতে করতে শেষমেশ চোখ খুলতে বাধ্য হ’ল সে, পর্দাটা কি টেনে দিতে ভুলে গেছে শোবার আগে? চোখে আলো লাগছে কেন?

ঘর যেমন পর্দাটানা ছিল তেমনই আছে। কিন্তু অন্ধকার নয়। ঠিক ওর চোখ বরাবর, একটা মৃদু নীলাভ সাদা আলো টেবিলের ওপর থেকে ছড়িয়ে পড়ছে।

ফোন? সে তো বালিশের পাশে। উঠে ঘুম টলোমলো পায়ে সামনে যেতেই এক ঝটকায় ঘুম টুম হাওয়া কেমন।

মেডেলটা।

ঘরের আলো জ্বেলে দেখল, রুপোর পালিশটা কিভাবে যেন ক্ষয়ে গেছে কিছু কিছু জায়গায়। সেই ফাঁক দিয়ে উঁকি মারছে সাদা পালিশ করা হাতির দাঁতের মত কী যেন জিনিসের কারুকার্যের টুকরো।

সেটাই আলো নেভালে গ্লো করছে।

কেমন গা শিরশিরে আলোটা।

বাকি রাতটা বসার ঘরের গদিতে কাটল অরণির। মনের ভুল কিনা জানে না, ভোররাতে মনে হ’ল এঘরে খুটখাট আওয়াজ পাচ্ছিল।

 

পরদিনটা প্রবল অস্বস্তিতে কাটল। সারাদিন ধরে মনে হচ্ছিল কে যেন আড়াল থেকে ওর ওপর চোখ রাখছে। প্রথমে ভেবেছিল ওদের নতুন বস, বিবস্বান বড়ুয়া। যেমন কাঠখোট্টা লোক, তেমনি ক্যাঁটকেঁটে কথা। লোকটাকে দেখে অবধি অরণির ধারণা এ কাঠি হাতে নিয়ে বসে থাকে লোকের পিছনে লাগবে বলে। কিন্তু সুশ্রুত বলল বসের পেট ছেড়েছে, সকাল থেকে নাকি টয়লেটেই বসে আছে। গাড়ি এসে নিচে দাঁড়িয়ে আছে কিন্তু পনেরো মিনিটের রাস্তাও গাড়িতে যাবার রিস্ক নিতে পারছে না, এমন দশা।

আর, সে যদি কোন গোপন যন্ত্র দিয়ে টয়লেটে বসেই ওদের ওপর নজর রেখেও থাকে, বাড়ি ফেরার পথে অটোতে বা ফ্ল্যাটের লিফটে নিশ্চয় রাখতে পারে না। অথচ ঘাড়ের লোম শিরশির করা অনুভূতিটা সারাক্ষণ হয়ে গেল অরণির।

মেডেলটা আজও পকেটে করে নিয়ে গেছিল অরণি। সুশ্রুত ছাড়া কাকেই বা বলবে এসব। ছোকরা বেশ ঠাণ্ডামাথার, গুচ্ছ ডিটেকটিভ বইয়ের পোকা তার ওপর। রহস্য টহস্য কিছু থাকলে ও-ই উদ্ধার করে দিতে পারবে। তবে সে-ও মেডেলটা অনেকক্ষণ ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখেও কিছু বুঝতে পারল না সেরকম, “এই ব্যাঁকাটা গণেশের শুঁড় হতে পারে জানিস, সম্ভবত ঠাকুর দেবতা কিছু খোদাই করা আছে সেমি-প্রেশাস কোন পাথর দিয়ে যা অন্ধকারে জ্বলজ্বল করে। রেখে দে যত্ন করে।”

সেইমত, মেডেলটা আজ বইয়ের তাকে ভালো করে সাজিয়ে রাখল অরণি। কী ভেবে একটা নমস্কারও করে ফেলল ভক্তিভরে।

কিন্তু তাতে মেডেলের ঠাকুরের মন গলল না। রাতে আবার সেই আলো তো বটেই, সমানে খুটখাট আওয়াজটা হয়েই চলল জানলার বাইরে। অরণি “আমি বীর, আমি অকুতোভয়, আমি ভয় করব না ভাই করব না” ইত্যাদি ভেবে ভেবেও বালিশ নিয়ে বাইরের ঘরে চলে যেতে বাধ্য হল ঘন্টাখানেক পরে।

সকালে দেখল, মেডেলটা নিজে নিজেই মাটিতে পড়ে গড়াগড়ি খাচ্ছে।

সেটা শনিবার। অফিস ছিল না। বেলা নটায় সুশ্রুতকে ফোন করে বলল চলে আসতে। আরো একটা রাত এইভাবে চললে তার মাথা খারাপ হয়ে যাবে। কিন্তু সুশ্রুতটা ঢ্যাঁড়শের মত ল্যাদ খেয়ে আবার ঘুমিয়ে টুমিয়ে পড়ে ফের ফোন করল বেলা বারোটায়।

ঘরে বসে বসে বিরক্ত লাগছিল অরণির। একে তো সেদিনের প্লটটা উড়ে গেছে, কিছুতেই আর আসছে না। তায় বুলিদি কাজ করতে এসে দুম করে ওর প্রিয় কাচের কাপটা ভেঙে দিল আজ। ও শুধু জিগ্যেস করতে গেছিল মেডেলটা দেখেছে কিনা, মনে সুপ্ত ইচ্ছা ছিল বুলিদির কাছে জাঁক করে একটু প্রশংসা শোনার, তা সে অমনি কেঁপে ঝেঁপে হাত থেকে কাপটা ফেলে দিল। কোনো মানে হয়! সুশ্রুত বলতেই তাই তৈরি হয়ে বেরিয়ে গেল অরণি, আরসালানে খাবে আজ দুপুরে।

খেয়েদেয়ে, একটা জঘন্য সিনেমা দেখে মাথা ধরিয়ে, অরণির ফ্ল্যাটে ঢুকল দুজনে প্রায় সন্ধে। সিঁড়ি দিয়ে উঠতে গিয়ে সুশ্রুত হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ে বলল, তোদের কি এখানেও সিসিটিভি আছে নাকি রে?

তাই তো! ওটা তো খেয়ালই করেনি অরণি! সদ্য বসানো হয়েছে তো। ঐজন্য কেউ দেখছে দেখছে মনে হচ্ছে খালি! এই না হলে গোয়েন্দা বই গুলে খাওয়া পাবলিক!

হালকা পায়ে বাকি সিঁড়ি টপকে দরজা খুলে ঢুকেই স্ট্যাচু হয়ে যায়।

ছি ছি ছি, কিছুই বলে না বলে বুলিদি আজকাল এসব কী শুরু করেছে! ঘর সাফ তো করেইনি, উলটে গদির চাদর তুলে, জুতোর র‍্যাক কাত করে ফেলে হাণ্ডুল পাণ্ডুল করে গেছে ঘরটা একদম। এইবার কড়া ভাবে বকতে হবে বোঝা যাচ্ছে।

সুশ্রুত মেসে থাকে বোঝা যায়, কারণ নির্বিকার ভাবে ঐ দলা পাকানো চাদরেই ধপাস করে বসে পড়ে বলে, “যা যা নিয়ে আয় দেখি তোর সেই মহামূল্যবান সম্পদ।”

মেডেলটা হাতে নিয়ে আবারও ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে দুজনে মিলে। কিচ্ছু বোঝা যাচ্ছে না।

“বলছি কি, পুরো লেয়ারটা উঠিয়ে দেব রে? দেখি না কী মূর্তি খোদাই করা? বলা যায় না, হয়তো বিখ্যাত হয়ে যাবি ওটার দৌলতে!”

অরণির মন্দ লাগে না প্রস্তাবটা। রুপোটা নষ্ট হবে অবশ্য। কিন্তু কৌতূহলের টান বড় টান। বাথরুমে বুলিদি অ্যাসিড রাখে ও জানে, নিয়ে আসে।

 

সাঁড়াশিটাও গেল মনে হয়। সুশ্রুত ওটা নিয়ে এসেছে অ্যাসিড ভেজা মেডেল হ্যাণ্ডল করার জন্য। যাকগে, অরণির এখন কৌতূহল চরমে পৌঁছে গেছে। বলা তো যায় না, সত্যিই হয়তো কোন দুর্লভ জিনিস এটা। তেমন হলে মিউজিয়মে যোগাযোগ করতে হবে।

সাবধানে তুলে তাকিয়ে দেখামাত্র আঁতকে উঠে সাঁড়াশিশুদ্ধু মেডেলটা হাত থেকে ফেলে দিল সুশ্রুত। অরণির গলা থেকেও ফ্যাঁসফেঁসে যে চীৎকারটা বেরোল তাকে আর্তনাদ ছাড়া কিছু বলা যায় না।

সাদা বস্তুটা হ’ল মেডেলের ওপর খোদাই করা একটা ছোট্ট নরকরোটি।

কী বীভৎস দেখতে সে করোটি, আর এই সন্ধ্যার প্রায়ান্ধকার ঘরে, তার চোখের জায়গাটা কিছু না থাকা সত্ত্বেও যেন ধ্বক ধ্বক করে জ্বলছে।

কোথায় দেখেছে আগে এই চোখ?

হৃৎপিণ্ড লাফ মেরে গলার কাছে উঠে আসে অরণির। ওদিকে সুশ্রুত কেমন দমবন্ধ ভাবে গোঁ গোঁ করছে শুনতে পায়।

একটা চুনোট পাঞ্জাবি পরা হাত ওদের সামনে এগিয়ে এসেছে। ফ্ল্যাটের দরজা যেমন বন্ধ ছিল তেমনই আছে যদিও।

সেই ঝাঁকড়া চুল। দাড়িগোঁফ। সেই চোখ। সেই গলা।

“যার জিনিস তাকে ফেরত দে।”

অরণির গলা নেই। শুধু চোখ আছে। চোখ, যা কিনা সেই গনগনে চোখে আটকে আছে।

“দে! সাধনচক্রের সামগ্রী নিয়ে তুই কি করবি রে, দিয়ে দে! ওর শক্তি বোঝা তোর কম্মো নয়।”

অরণি তবুও পাথর। সুশ্রুতর সাড়াশব্দ নেই, কী হ’ল কে জানে! লোকটার গলায় এবার একটু অনুনয় মেশে, “দে বাবা, দে! হাতে করে তুলে না দিলে যে ও জিনিস ফেরত নেওয়া যায় না!”

থরথর করে কাঁপা হাতে কোনমতে মেডেলের ফিতেটা ধরে তুলে দেয় অরণি। সুশ্রুত সটান শুয়ে আছে, মুচ্ছো গেছে মনে হয়।

বাড়ানো হাতটা মেডেলটা ধরার আগেই, অরণিও হাত পা এলিয়ে ঢলে পড়ে।

 

পরদিন কমলীর মেজাজটা ভাল ছিল। নিজে থেকেই বাবুর থেকে চাবি চেয়ে এনে তিনতলার জাদুঘর সাফ করে দিচ্ছিল সে। সিন্দুকটা মুছতে মুছতে তার একবার যেন মনে হ’ল কেউ আরো ঢুকেছে ঘরে। তা কর্তাবাবার কত ভূতপ্রেত নিয়ে কারবার ছিল, হবে তেনাদের কেউ! ওসবে ভয় পেলে কি আর গরিব মানুষের চলে!

নাঃ, থামলে চলবে না, এ ঘর সেরে আবার নিচে রান্নাঘরে ডিউটি আছে, আজ জমিয়ে পাঁঠার মাংস হচ্ছে, তারও আজ এখানে নেমন্তন্ন দুপুরে। ওপর থেকেও মাংসের ঝোলের সুবাস পাচ্ছে সে, গিন্নিমার রান্নার হাতটা বাপু বড় ভাল।

কোণায় টাঙানো ঝাঁকড়া চুল, জ্বলজ্বলে চোখ আর একমুখ দাড়িগোঁফের কর্তাবাবার ছবির দিকে ঘুরে একটা আলগোছে পেন্নাম ঠুকে আবার হাত চালিয়ে কুলুঙ্গির পুরোনো মেডেলটা মুছতে লেগে যায় কমলী।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত