প্র্যাকটিক্যাল

প্র্যাকটিক্যাল

“ভূ মানে পৃথিবী। ভূগোল মানে পৃথিবী গোল। এই ভূগোল অর্থাৎ জিওগ্রাফি বিষয়টা বড়ই মজার সাবজেক্ট। এখানে পৃথিবীর নানা জায়গা, সেখানকার প্রকৃতি পরিবেশ জলবায়ু ইত্যাদি নানা বিষয় বিভিন্ন অধ্যায়ে আলোচনা করা হয়েছে। তোমাদের খুব ভালো লাগবে পড়তে, ইন্টারেস্টিং। ভূগোল-ভীতি বা ভয়ের কোনো ব্যাপার নেই ,দেখো। জানো তো ‘ভূগোলেতে গোল’ যতই বলা হোক-না কেন, ভূগোলে কেউ কিন্তু গোল মানে শূন্য পায়না! দাদা-দিদিদের জিগ্‌গেস করে দেখো।”

জিও-আন্টির কথা শুনে তমাল হাসল। উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “আন্টি আমার দিদি সেদিন আমায় বলল যে, পৃথিবীর আকার অনেকটা চ্যাপ্টা শূন্যের মতো। শুনে বাবা দিদিকে বকল, ‘অমন লিখলে শূন্যই পাবি।’ ”

জিও-আন্টি মুচকি হাসেন, “ঠিক গোলাকার নয়। দু-দিকটা চ্যাপ্টা। এই যেমন ধরো কমলালেবু, অরেঞ্জ।”

কমলালেবু শুনলেই কুন্তলের ভূগোল গুলিয়ে যায় কেমন! ভাই একবার ওর চোখে কমলালেবুর খোসা চেপে দিয়েছিল। উঃ কী জ্বালা! চোখ থেকে টপটপ জল পড়তে লাগল। ওর ভাইয়ের চোখেও জল এল। ভাই ইচ্ছা করে করেনি, বাঁ-হাতে লেবু ধরে ডানহাতে দাদাকে কোয়া খাওয়াতে যায়। অসাবধানে বাঁ-হাত কুন্তলের চোখে চেপে বসে! খোসার রস চোখে ঢুকতেই চোখ জ্বালা। জ্বালা করলেও ভাইকে বকেনি। ভাই ওকে যে খুব ভালোবাসে। সেই থেকে কমলালেবুর উপর কুন্তলের অ্যালার্জি।

কুন্তল তমালের কানে ফিসফিস করে বলে, “কমলালেবুর জায়গায় অন্য কিছু বলা যায় না?”

“কুন্তল..” আন্টি বেশ গম্ভীর গলায় বলেন, “দাঁড়াও, স্ট্যান্ড-আপ।”

আন্টি ঠিক নজর করেছেন, কুন্তল ক্লাশে কথা বলেছে। অপরাধীর মতো পাংশু মুখ নিয়ে কুন্তল উঠে দাঁড়াল।

“তোমার বুঝতে অসুবিধা হলে আমাকে বলো,” আন্টি এবার হাসেন, “ক্লাশ চলার সময় কেউ কারো সঙ্গে কথা বলবে না। মনে থাকবে?”

সবাই ঘাড় নেড়ে হ্যাঁ বলে।

আন্টি কুন্তলের কাছে গিয়ে ওর মাথায় হাত রাখেন, “বোসো।”

তমাল দাঁড়িয়ে পড়ে বলে, “আন্টি ও আমাকে বলল, কমলালেবু ও ভালোবাসে না। ও খায় না।”

আন্টি মুচকি হাসেন। তমালের গাল টিপে আদর করেন। ওকে বসিয়ে নিজের পড়ানোর জায়গায় ফিরে বলেন, “আর কার কার কমলালেবু বা অরেঞ্জ ভালো লাগে না?”

কুন্তল অবাক হল— একজনও হাত তুলল না। মনে মনে বলল, হুঁ, একবার চোখে খোসার রস পড়ুক না! তখন মজা বুঝবি!

আন্টি বোর্ডে কমলালেবু আঁকলেন। পাশে গোল মতো আরেকটা কী যেন আঁকছেন; দেখা যাচ্ছেনা; আন্টির শরীরে আড়াল হচ্ছে।

কুন্তল ঘাড় কাত করে দেখার চেষ্টা করে। দেখতে পায় না। ওর নজর আটকে যায় আন্টির খোঁপায়। আন্টির চুল খুব লম্বা। আজ খোঁপা বেঁধেছেন। গোল। কুন্তল ভাবে কমলালেবু-টেবু না-এঁকে খোঁপা বলতে পারতেন আন্টি! মাঝখানে বেশ চ্যাপ্টা মতো আছে। তমালকে কনুইয়ের গুঁতো দিয়ে চোখের ইশারা করে। ওকে আন্টির খোঁপা দেখতে বলে।

খোঁপা দেখে তমাল ফিক করে হেসে ফেলে।

ইতিমধ্যে আঁকা শেষ করে আন্টি ঘুরে দাঁড়ান। তমালের দিকে কড়া চোখে তাকিয়ে বলেন, “তমাল? এবার তুমি, হাসছ কেন?”

তমাল বেশ ডাকাবুকো। দাঁড়িয়ে সত্যি কথাটাই জানিয়ে দেয়, “আন্টি, পৃথিবী কি খোঁপার মতো বলা যায়?”

আন্টি জোরে হোহো হেসে ওঠেন।

ক্লাশের সবাই হোহো

হাসি থামিয়ে আন্টি বলেন, “তা হতে পারে। হয়তো এখন বলা যেতে পারে! কিন্তু সবসময় হবে না।”

কুন্তলের ভাবনা মিলে যাওয়ায় ও বেশি উৎসাহিত। লাফ দিয়ে বলে ওঠে, “কেন আন্টি?”

আন্টি মুচকি হাসেন। তমালকে বলেন, “তোমার কমলালেবুতে অ্যালার্জি থাকতেই পারে। তবু ওটাই মনে রেখো। আজ প্রথম ক্লাশ। পরে গ্লোব এনে বুঝিয়ে দেব।”

সৌম্য বলে ওঠে, “গ্লোব মানে পৃথিবী, আমি জানি।”

“ঠিক বলেছ সৌম্য,” ইশারায় সৌম্যকে বসতে বলে আন্টি বুঝিয়ে দেন, “পৃথিবীর ছোট্ট রূপ। পরে একদিন দেখাব। খোঁপা নিয়ে ফাঁপড় আছে। আমার খোঁপা যদি খুলে যায়, তখন পৃথিবী লম্বা হয়ে যাবে!”

গোটা ক্লাশ হোহো করে ওঠে।

সৌরভ খুব আস্তে বলে, “জিও-আন্টি যুগ যুগ জিও।”

‘জিও’ মানে বেঁচে থাকা, সৌরভ মিছিলে শুনেছে। ক্লাশ শেষে বন্ধুদের বুঝিয়ে বলে, “এ-সব হচ্ছে স্লোগান।”

*****

“এসো। দেখো একে একে।” ক্লাশে গ্লোব এনে জিও-আন্টি বুঝিয়ে দিলেন, “এই হল পৃথিবী। ঘোরাও। এটা ইন্ডিয়া, মানে ভারতবর্ষ আমাদের দেশ। এই হচ্ছে কোলকাতা”

*****

কুন্তলের মুখে সব শুনে বাবা বলেন, “এভাবে শেখার নাম প্র্যাকটিক্যাল। বাংলায় বলা হয় হাতে-কলমে। সমস্ত পৃথিবীটাই ছোট্ট গ্লোবে দেখেছ।”

যেদিন আন্টি ‘দিগন্ত’ পড়ালেন, কুন্তল ভাবল, যদি প্র্যাকটিক্যাল হতো! আকাশ কোথায় মাটিতে মিশেছে? ওদের বাড়ির ছাদ থেকে কেবল গোল আকাশ দেখা যায়। সে-আকাশ মাটি ছোঁয়নি! আন্টিকে সে-কথা বলতে উনি হেসে বলেন, “আকাশ মাটি ছুঁয়ে থাকে। কোলকাতায় বোঝা যায় না। গ্রামের দিকে ফাঁকা জায়গায় কখনো গেলে দেখতে পাবে দিগন্ত-বিস্তৃত মাঠ”

কুন্তলদের পূর্বপুরুষের আদি বাসস্থান গ্রামেই। সেখানকার বাড়িতে দুর্গাপুজো হয়। প্রতি বছর ওরা সবাই মিলে যায়। সেখানে অনেক বড় মাঠ আছে, কুন্তল জানে। ধানজমি আছে। ওর বাবা গ্রামকে বলেন ‘দেশ।’

পুজো আসতেই কুন্তলরা সবাই দেশ-এ গেল। ভাণ্ডারখোলা। বনগাঁ থেকে বাসে চাপল। বাস-রাস্তার দু-পাশে ধানক্ষেত দেখা যাচ্ছে। কুন্তল মুখ তুলে দিগন্ত দেখার চেষ্টা করল। বাস জোরে ছুটছে। ধানজমিও ছুটে যাচ্ছে চোখের সামনে ! কিন্তু দিগন্ত দেখা যাচ্ছে না।

ছোটকা, মানে ছোট-কাকার ছেলে রতন, দাদা হলেও কুন্তলের বন্ধু। কুন্তল গ্রামের অনেক কিছুই জানে না, অথচ রতনদা শহরের প্রায় সব কিছু জানে! রতনদা টিভি দেখে দেখে শিখেছে।

অষ্টমী-পুজোয় বাড়িতে লুচি হচ্ছে। বড়রা ওদিকে ব্যস্ত। গোটা গ্রামে এই একটাই পুজো। অনেক মানুষ দুপুরে খেতে আসে। এই রীতি কুন্তলের প্রপিতামহ অর্থাৎ ঠাকুরদার বাবার আমলের। উনিই বাড়িতে দুর্গাপুজো প্রচলন করেন।

কুন্তল দেখল এই সুযোগ! রতনদাকে ডাকল, “দাদা তুই আমায় দিগন্ত দেখাতে পারিস?”

ক্লাথ-থ্রির ভাইয়ের কথা শুনে ফাইভের দাদা রতন হাসল, “এক্ষুনি চল। বিলপাড়ায় বিশাল মাঠ। মাঠের ওপারে আকাশ মাটিতে নেমে এসেছে। দেখতে পাবি দিগন্ত।”

চুপিসাড়ে দুই ভাই বেরিয়ে পড়ে।

হাঁটতে হাঁটতে রতন কুন্তলকে প্রশ্ন করে, “সন্ধি জানিস?”

কুন্তল মাথা নেড়ে না বলে।

রতন হাসে, “হি হি তুইতো থ্রি। ফাইভে আছে। ব্যাকরণ, মানে গ্রামার। দিক+অন্ত=দিগন্ত। বুঝলি?”

কুন্তল বুঝল না দেখে রতন বুঝিয়ে বলে, “দিকের অন্ত। ঐ যে পশ্চিম দিক”

বিশাল ধানক্ষেতের সামনে এসে কুন্তলের চোখে কেমন যেন ঘোর লাগে। রতনকে বলে, “উরিব্বাস! দাদা, একেই কি তেপান্তরের মাঠ বলে?”

“না। বিলপাড়ার মাঠ। বর্ষাকালে জলে ডুবে যায়। নীচু জমি তো। তখন আর মাঠ থাকেনা, বিল হয়ে যায়। বিল বুঝিস?”

কুন্তল মাথা নাড়ে।

“খাল-বিল শুনিসনি?”

ঘাড় নেড়ে সায় দিয়ে কুন্তল বলে, “শুনেছি। মিলিয়ে বলে নদী-নালা খাল-বিল।”

“বাঃ, তুই তো ভালো বাংলা জানিস! ইংলিশ-মিডিয়ামে পড়িস তো?”

কুন্তল মুখ ভার করে বলে, “না, সবাই তাই পড়ে। কিন্তু আমাকে বাবা বাংলা স্কুলে ভর্তি করেছে। জোর করে।”

“জোর করে মানে?” রতন ভাইকে বলে, “তুই কি ইংলিশে পড়তে চেয়েছিলিস? স্কুলটা কি পছন্দ নয় তোর?”

“না না দাদা, আমাদের স্কুল খুব ভালো। ইংলিশও পড়ায়। আমাকে ভর্তি করা নিয়ে মায়ের সাথে বাবার খুব একচোট হয়েছিল! আমি তো কেজিতে পড়তাম। ওয়ানে ভর্তির সময় মা চেয়েছিল ইংলিশ মিডিয়াম”

রতন হাসল, “জেঠু তোকে সরকারি স্কুলে দিল”

“দাদা, বর্ষায় মাছরাঙা আসে?”

ভাইয়ের পিঠ চাপড়ে রতন বলে, “মাছরাঙা পাখি তো? সে তোকে আজকেই দেখাব।”

“জানিস, আমি পড়েছি, ‘মাছরাঙা ঝুপ করে পড়ে এসে জলে’ ”

“এই বিল মাঠ ডুবে গেলে কত মাছ ! চ্যাং, ল্যাঠা, খলসে, সরপুঁটি, বেলে, কই, কুচেযে ধরতে পারে মাছ তার।”

মাছের নাম শুনে কুন্তল হাঁ হয়ে যায়। এ সব কী মাছ, খাওয়া দূরের ব্যাপার, চোখেই দেখেনি ও!

কুন্তলের মুখ দেখে রতন হাসে। বলে, “নাম শুনিসনি তো? শুনবি কী করে, তোরা তো খাস ভেড়ির মাছ আর চালানি মাছ! আর আমরা? একবার গামছা পরে বিলে নেমে পড়লেই হল। বঁড়শি, ছিপ, বর্শা, খেপলা, ঘুরনি, খালুই, জালযে যা পারে তাই দিয়ে মাছ ধরে।”

“আচ্ছা দাদা, তুই মাছ ধরিস?”

“হ্যাঁ,” রতন হেসে বলে, “ছিপ আছে আমার।”

“আমাকে শেখাবি মাছ-ধরা?”

“বর্ষাকালে আয় না একবার!”

“আসব,” কুন্তল লাফিয়ে উঠে বলে, “এই দাদা, ওই তো দিগন্ত! ঐ যে দূরেনীল আকাশ মাটিকে চুমু খাচ্ছে! দাদা, চল না কাছে গিয়ে একবার দেখি?”

রতন কিছুক্ষণ ভাবে। বলে, “ওদিকের গ্রামের নাম দিঘাড়ি। পাশে সাতাশি। আমি যাইনি কোনোদিন, বাবার মুখে নাম শুনেছি।”

কুন্তল অনুনয় করে, “চল না দাদা!”

“তুই হাঁটতে পারবি? কম দূর নয়!”

কুন্তলের চোখমুখ চকচক করছে। আনন্দে বলে ওঠে, “খুব পারব! জানিস কোলকাতার রাস্তায় মাঝেমাঝে এমন জ্যাম হয় যে আমাদের স্কুলে পৌঁছুতে দেরি হবে বুঝে মা বাস থেকে নেমে পড়ে। অনেকটা হাঁটি তখন। আমি ছুটতেও পারি। দেখবি? তবে দেখ”

কুন্তল মাঠের আলপথ ধরে ছুটতে শুরু করে। রতন পিছনে চেঁচাচ্ছে, “ভাই দাঁড়াপড়ে যাবিযাস না”

কুন্তল আরো জোরে দৌড়াচ্ছে।

রতন বুঝল ও সহজে থামবেনা, ওকে ধরতে হবে। মাঠে নেমে ভাইয়ের পিছু ধাওয়া করল।

কুন্তল পিছনে তাকাচ্ছেই না। মনের আনন্দে ছুটে চলেছে ধানজমির আল বরাবর। দিগন্ত ছোঁয়ার নেশা ওকে টেনে নিয়ে চলেছে। খুব জোরে ছুটছে। প্রথমবার, আলপথ ধরে দিকচক্রবালের দিকে

রতন গ্রামের ছেলে। আলপথে ছোটার অভ্যাস ওর থাকলেও কেন যেন দৌড়ে শহুরে ভাইয়ের থেকে ক্রমশ পিছিয়ে পড়ছে! একবার আছাড় খেল। উঠে দাঁড়াল। বুক ভরে দম নিল। ভাইকে ডাকতে গিয়ে বুঝল ভাই এতদূর এগিয়ে গেছে যে ওর ডাক শুনতে পাবে না। তাই যত জোরে পারে দৌড়ানোর চেষ্টা করল। কিন্তু ভাই অসম্ভব গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে দিঘাড়ির দিগন্তের দিকে।

রতন হাঁপিয়ে গেল। দাঁড়িয়ে পড়ল। কেঁদে ফেলল। ওর ভয় করতে লাগল ভাই যদি হারিয়ে যায়! ভাই ক্রমশ ছোট হয়ে আসছে! দুই হাত মুখের পাশে চোঙের মতো করে প্রাণপণ চিৎকার করল, “ভাই-ই-ই-ই.কুন্তল-ল-ল! ফিরে আয় ভাই”

ভাই কি শুনতে পেল? ছায়ামূর্তির মতো ঝাপসা ভাই ওর দিকে ঘুরে কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে মনে হচ্ছে।

হাতের ইশারায় রতন ভাইকে ওখানে দাঁড়িয়ে থাকতে বলল। বুক ভরে শ্বাস নিল। পা ব্যথা করছে, আর ছোটার শক্তি অবশিষ্ট নেই রতনের! হাত নেড়ে কুন্তলকে ওর কাছে আসতে বলে হাঁটতে লাগল। হাঁটছে আর কুন্তলকে ডাকছে। মাঝেমাঝে হাত তুলে কুন্তলকে নিষেধ করছে ও যেন ফের এগিয়ে না যায়!

দাদাকে এগিয়ে আসতে দেখে কুন্তল ভাবল যে ওর দাদাও দিগন্ত ছুঁতে চায়। দম ফুরিয়ে গেছে হয়তো, তাই না-দৌড়ে হেঁটে আসছে। দাদাকে দ্রুত আসতে ইশারা করে। ঘুরে যায়।

মাথার উপর সূর্যের তাত বাড়ছে। তবু কুন্তল দমবার পাত্র নয়, আজ দিগন্ত সে ছোঁবেই! পিছনে দাদা আসছেওর আগেই দিগন্তে পোঁছাতে হবে! কুন্তল ছুটতে শুরু করল— দিগন্তের দিকে।

ভাইকে এত করেও দূর থেকে থামাতে না-পেরে রতন ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করে। তেষ্টায় ওর বুক ফেটে যাচ্ছে। চোখের সামনে কুন্তলভাই আরো ছোট হয়ে যাচ্ছে। ঝাপসা হয়ে আসছে! পিছন দিকে ঘুরল। হ্যাঁ, ওদের বিলপাড়ার ছোট ছোট বাড়ি দেখা যাচ্ছে এখনো। দেখে ফের ঘুরে গেল। না, কুন্তলকে আর দেখতে পেল না। ওর ভাই দিগন্তে মিলিয়ে গেল!

ওদিকে কুন্তল ছুটেই চলেছে। দিগন্ত আরো দূর আরো দূর কত দূর? যতই ছুটছে দিগন্ত যেন সরে সরে যাচ্ছে ! এতটা দূরে জানলে রতনদার জন্য অপেক্ষা করত। দুই ভাই পাশাপাশি ছুটলে বেশি মজা হত! পিছনে তাকিয়ে দাদাকে দেখতে পেল না। রতনদা কি অন্য রাস্তা জানে? নিশ্চয় জানে, ও-তো দেখল দাদা ওর দিকেই আসছিল। নির্ঘাত ওকে বোকা বানিয়ে দাদা শর্টকাট রাস্তা ধরে এতক্ষণে দিগন্তে পোঁছে গেছে ! ও গিয়ে দেখবে দাদা ওর জন্য হাত বাড়িয়ে আছে! সে যাক, ও দিগন্ত ছোঁবেই। ছুট ছুট! কুন্তল ছুটছে। ছুটতে ছুটতে ধানগাছের শরীরে হাত ছুঁয়ে দিচ্ছে। ধানগাছ মাথা দুলিয়ে ওর আদর গ্রহণ করছে। বেলা পড়ে আসছে। শরতের আলো নরম হচ্ছে। কুন্তলের আর তেমন কষ্ট হচ্ছেনা। ও আকাশে তাকায়। সূর্য যেন মৃদু হাসছে। ওকে দিগন্তে আহ্বান করছে, “এসো কুন্তল। ”

নতুন পোশাক-পরা এক বালককে আলপথ ধরে ছুটে যেতে দেখে জনৈক কৃষক অবাক হলেন। তিনি ডাকলেন, “এই ছেলে কোথায় যাচ্ছ? ছুটছ কেন?”

ছেলেটা থামল না দেখে তিনি হাল-বলদ ছেড়ে ছুট লাগালেন। ছেলেটাকে জাপটে ধরলেন। হাঁফাতে হাঁফাতে প্রশ্ন করেন, “তুই কাদের ছেলে? কোন গাঁয়ের? ছুটছিস কেন?”

কুন্তল অচেনা লোকটার হাত থেকে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করেও পারল না।

লোকটা ধমক লাগালেন, “বাড়ি কোথায় তোর?”

কুন্তল একটু ভয় পেল। মিনতি করল, “আমাকে ছেড়ে দিন প্লিজ!”

লোকটা ওকে আদর করে নরম গলায় বলেন, “তুমি কাদের ছেলে? তোমার বাড়ি কোথায় বাবা?”

“কোলকাতা।” কুন্তল আবার মিনতি করে, “আমাকে ছেড়ে দিন স্যার!”

কৃষক বুঝলেন এই ছেলেকে বেশি প্রশ্ন করে লাভ নেই। এ নিশ্চিত বেড়াতে এসে পথ হারিয়ে ফেলেছে! একে নবীন মাস্টারের হাতে তুলে দিতে হবে। মাঠে হাল-বলদ পড়ে আছে। একে ছেড়ে রেখে ওসব আনতে গেলে ফের দৌড় লাগাবে! গরু পালায় না, মনিবের কথা শোনে, মাঠেই থাকবে। নবীন মাস্টারই পারবে এই ছেলের বিহিত করতে। ভেবে নিজে বসে পড়েন। একপ্রকার জোর করে ছেলেটাকে কাঁধে তুলে হাঁটতে থাকেন।

কুন্তল কখনো এ-ভাবে কারো ঘাড়ে চাপেনি। লোকটা মন্দ নয়। নিজের মাথার দু’দিকে কুন্তলের দুই পা ধরে রেখেছেন, ও যাতে পড়ে না-যায়। কুন্তল ঠিক যেন ঘোড়সওয়ার।

মেঠোপথে লোকটা কোনো প্রশ্ন করলেন না। কেবল বললেন, “দেখো বাপু, তোমারে আমি দিঘাড়ি নিয়ে যাচ্ছি। ভয় পেয়ো না। নবীন মাস্টার ঠিক বাড়ি পৌঁচায় দেবে।”

নবীন মাস্টারকে কুন্তল সব খুলে বলল। ও দিগন্ত ছুঁতে চায়। নবীনবাবু কুন্তলের বাবার নাম শুনে হাসেন। ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন, “তুমি শিবুর ছেলে! ও আমার ক্লাসমেট ছিল। তা গ্রামে এসে নিজের বাড়ি কোলকাতা বলছ কেন? বলো ভাণ্ডারখোলা। এটাই তোমার আসল দেশ বাবা।”

কুন্তল মনে মনে হাসল। বাবাও বলেন, দেশ।

“শোনো বাবা। নবীনকাকু বলেন, তুমি চক্রবর্তী বাড়ির ছেলে। গাঁ-গঞ্জের মানুষজন পরিবার মানে ফ্যামিলির পরিচয়ে সবাইকে চেনে। চলো তোমাকে বাড়ি পৌঁছে দিই। এতক্ষণে নিশ্চয় খোঁজাখুঁজি শুরু হয়েছে।”

নবীনকাকুর সাইকেলে চেপে কুন্তল বাড়ি ফিরছে। গল্প করছে।

“কাকু, দিগন্ত কি ছোঁয়া যায় না?”

“নিশ্চয় ছোঁয়া যায় বাবা!”

সাইকেলের রডে বসে কুন্তল ঘাড় ঘোরায়। নবীনকাকুর মুখের দিকে চেয়ে প্রশ্ন করে, “যায় তো আমি কেন ছুঁতে পারলাম না? এত ছুটলাম!”

“সামনে দেখো কুন্তল।” স্নেহ-মাখা কণ্ঠে নবীনকাকু বলেন, “দিগন্ত ছোঁয়া যায় বাবা, তবে ঐ আকাশ-মাটির দিগন্ত নয়। যত বড় হবে দেখবে কতো দিগন্ত…নতুন নতুন…তোমার চোখে ভেসে উঠবে। আর সেই সকল দিগন্ত ছোঁয়ার লক্ষ্যেই মানুষ পড়াশোনা করে, বড় হয়।”

নবীনকাকুর কথা কুন্তল ঠিক বুঝে উঠতে পারে না। বোঝার তাগিদে বলে, “কিন্তু আমি মাঠে নামার আগে স্পষ্ট দেখলাম মাঠের শেষে আকাশ মাটি স্পর্শ করেছে!”

“তুমি ঠিকই দেখেছ।” প্যাডেলে জোরে চাপ দিয়ে নবীনকাকু বলেন, “ওটা দৃষ্টি-বিভ্রম। ইলিউশন। চোখের ভুল।”

ঘাড় ঘুরিয়ে কুন্তল বলে, “যেমন মরীচিকা?”

“বাঃ, বেশ বলেছ তুমি!” নবীনকাকু তারিফ করে বলেন, “অনেকটা ও-রকম।”

গল্পে-কথায় কুন্তলকে নিয়ে নবীনবাবু ভাণ্ডারখোলায় পৌঁছে গেলেন।

চক্রবর্তী বাড়িতে অষ্টমী-পুজোর ঢাক থেমে আছে। মহিলামহলে কান্না। রতন বাড়ি ফিরে এসে সব বলার পরেই বাড়ির পুরুষেরা মাঠে নেমে পড়েন। শিবুজেঠু কার একটা বাইকে চেপে মূল রাস্তা দিয়ে দিঘাড়ির দিকে কুন্তলকে খুঁজতে বেরিয়েছেন। জ্যাম্মার চোখে জল। রতনকে বাবা প্রায় মারতে উঠেছিলেন, বকলেন, “ভাই বলল, অমনি দিগন্ত দেখাতে নিয়ে গেলি! এটা সত্যি যে রতন ভাইকে দিগন্ত দেখাতে নিয়ে গিয়েছিল, কিন্তু ভাই যে দিগন্ত ছুঁতে যাবে তা ও ভাবতে পারেনি। তাছাড়া ভাই ওর কথা শুনল কোথায়!”

বাড়ির সামনে রাস্তায় রতন ঠায় দাঁড়িয়ে। কুন্তলের ফেরার আশায়। হঠাৎ দেখে সোমু বাঘা সুলতান রামু ছুটে আসছে। ওদের সবার মুখে হাসি। রতন বুঝে গেল, সুখবর। এগিয়ে গেল। রাস্তার বাঁকে একজনের সাইকেলে কুন্তলভাই! দেখেই ঘুরে বাড়ির দিকে ছুটছে আর চিৎকার করছে, “ভাই আসছে। কুন্তলভাই…”

নবীনকাকুর সাইকেল থেকে নেমে কুন্তল মাকে জড়িয়ে ধরল। মা কাঁদছে। মায়ের কোলে ছোট ভাই হাসছে! ভাই তো জানে না বোঝেই না যে ওর দাদা হারিয়ে গিয়েছিল! কুন্তল ওর ভাইকে কোলে তুলে নিয়ে রতনদার খোঁজ করে। কোথায় গেল? ওর মন কু ডাকে, দাদা কি তবে মাঠে হারিয়ে গেল! পর মুহূতের্ই নিজেকে প্রবোধ দেয়, ওর তো সব চেনাপথঘাট। হারাবে কেন? এদিক ওদিক চোখ ঘুরিয়ে দেখে। ঐ তো ঠাকুরের সামনে ! হাত জড়ো করে বিড়বিড় করে কী সব বলছে রতনদা! ভাইকে মায়ের কোলে ফিরিয়ে দিয়ে কুন্তল দাদার পাশে গিয়ে দাঁড়াল। হাত জোড় করল। মনে মনে বলল, “ঠাকুর, আমাকে ক্ষমা করে দাও মাগো! আমি আর এরকম ভুল করব না।”

রতন হেসে কুন্তলকে কনুইয়ের গুঁতো দিল। কুন্তল ওর দাদাকে জড়িয়ে ধরল।

রতন কুন্তলের কানে কানে বলল, “ঐ লোকটা কে, যার সাইকেলে এলি?”

কুন্তল ঘাড় ঘুরিয়ে নবীনকাকুকে দেখতে পেল। হেসে বলল, “উনি আমার বাবার বন্ধু। নবীন স্যার। মাস্টারমশাই।

মাস্টার?”

“কী পড়ায়?” রতন জানতে চায়, “কীসের মাস্টার?”

তাই তো! এতক্ষণে কুন্তলের খেয়াল পড়ল, এটা তো জানা হয়নি! ও দেখল নবীনকাকু সাইকেলে চাপছেন। চলে যাচ্ছেন। পিছনে চেঁচিয়ে উঠল, “কাকু তুমি কীসের টিচার? ভূগোলের?”

প্যাডেলে চাপ দিয়ে নবীনবাবু হাসলেন, “না কুন্তলবাবু, ভূগোলের নই। প্র্যাকটিক্যালের।”

গোটা বাড়ি হেসে উঠল।

দুপুর থেকে নীরব পড়ে-থাকা ঢাকে কাঠির বাড়ি মারল রতন—ঢ্যাম-কুড়া-কুড়।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত