চাঁদ ওঠার পর

চাঁদ ওঠার পর

পেটের কাছে একটা মৃদু কম্পন অনুভূত হওয়ায় চমকে উঠল লোপা। একটা ঠান্ডা হিম স্রোত ওর সারা দেহে ছড়িয়ে পড়ল। লাফ দিয়ে খাট থেকে নামল। বাড়িতে আজ ও একাই আছে। বাবা-মা, মায়ের খুড়তুতো ভাইয়ের বিয়েতে গিয়েছেন। ফিরতে রাত হবে। ও যায়নি। ফাঁকা বাড়িতে সব দরজা জানালা বন্ধ করে বিছানায় উপুড় হয়ে একটা ভূতের গল্প পড়ছিল। এমন সময় পেটের কাছে গোঁ গোঁ করে কী যেন একটা কেঁপে ওঠায় পড়ায় ব্যাঘাত ঘটল।

খাট থেকে নেমে দেখল মোবাইলটা কাঁপছে। দেখল মা ফোন করেছে। ভাইব্রেট মোডে থাকায় কোনো আওয়াজ হয়নি। ভুল করে মোবাইলের উপর শুয়ে ছিল ও। কল রিসিভ করার আগেই কেটে গেল। মোবাইলটা নর্মাল মোডে সেট করে আবার উপুড় হয়ে গল্পটায় মন দিল লোপা।

কিছু কিছু মানুষ আছে যারা সবার সামনে বলে বেড়ায়, “আমরা ভূতে বিশ্বাস করি না। তাই ভূতের গল্প পড়ে সময় নষ্ট করার কোনো মানে হয় না। ভূতের গল্প পড়লে আমার হাসি পায়।” আবার রাত্রে ভূতের গল্প বা কোনো হরর সিনেমা দেখে তারাই ক্ষণে ক্ষণে চমকে ওঠে। লোপা তাদের মধ্যেই একজন। ভূতের গল্প পড়ে ভয় লাগছে আবার পড়া থামাতে পারছে না।

একটা বিদঘুটে আওয়াজ শুনে আবার চমকে উঠল লোপা। মোবাইলটা বাজছে। মোবাইলটা হাতে নিয়ে দেখল একটা আননোন নম্বর। লোপা জানে বাবা মা নয়, কারণ তারা জানে কোনো অচেনা নম্বর থেকে ফোন এলে লোপা রিসিভ করবে না। তাহলে কে হতে পারে? আজেবাজে কেউ নয় তো! ইদানীং কলেজের একটি ছেলে খুব জ্বালাচ্ছে লোপাকে। কিন্তু তার কাছে তো লোপার মোবাইল নম্বর নেই! বন্ধুদের মধ্যে কেউ দেয়নি তো!

ধরবে না ধরবে না করেও শেষটা ফোন রিসিভ করল লোপা, “হ্যালো?”

“হ্যালো। আমি কি লোপামুদ্রা মিত্রর সঙ্গে কথা বলছি?”

একজন মহিলা কথা বলছেন। লোপা বলল, “হ্যাঁ আমি লোমামুদ্রা।”

মহিলার শ্বাসের শব্দ শুনে লোপা বুঝল তিনি স্বস্তি পেলেন। তার পরেই তিনি হড়বড় করে বললেন, এই মুহূর্তে তাঁর লোপাকে খুব প্রয়োজন। একটা বিশেষ কাজে তাঁকে একটু বাইরে যেতে হবে। লোপা যদি তাঁর বাচ্চকে ঘণ্টাদুয়েকের জন্য একটু দেখে তিনি খুবই কৃতজ্ঞ বোধ করবেন। তিনি লোপাদের অ্যাপার্টমেন্টে থেকে কিছুদূরে যে নতুন অ্যাপার্টমেন্ট হয়েছে সেখানেই থাকেন।

লোপা জিজ্ঞাসা করে জানল, মহিলার নাম তিন্নি সেন। তিনি লোপার নম্বর দেবলিনা দত্তর কাছ থেকে পেয়েছেন।

দেবলিনা দত্ত লোপাদের প্রতিবেশি। লোপা তাঁকে দেবী আন্টি বলে ডাকে। এবারের গরমের ছুটিতে লোপা কোথাও বেড়াতে যায়নি। সময় কাটানোর জন্য দেবী আন্টির বেবি-কেয়ার সেন্টারে বেবি সিটিং এর কাজ করেছে। সেই সঙ্গে এই ছুটিতে একটা ভালোরকমের হাতখরচও পেয়েছে। কিন্তু সে তো দিনের বেলায় কয়েক ঘণ্টার জন্য বেবিসিটিং করে। রাত্রে কোনোদিন করেনি।

লোপার কণ্ঠে দ্বিধা লক্ষ করে তিন্নি সেন এমন একটা পারিশ্রমিকের প্রস্তাব দিলেন যেটা এতদিন দেবী আন্টির বেবি কেয়ার সেন্টার কাজ করে পাওয়া টাকার সমান। লোপা আর দ্বিধা করলনা। লোপা রাজি হয়ায় তিন্নি সেন যেন স্বস্তি পেলেন। তিনি জানালেন দশ মিনিটের মধ্যে তিনি লোপাদের বাড়ির কাছে পৌঁছে ফোন করবেন।

লোপা জানে বিয়ের অনুষ্ঠান খাওয়াদাওয়া সেরে বাবা মায়ের ফিরতে মধ্যরাত হবে। সে ঘড়ির দিকে তাকাল। এখন বাজে সাড়ে আটটা। দু’ঘন্টার একটু বেশি সময় লাগলেও সাড়ে এগারটার মধ্যে বাড়ি ফিরতে পারবে।

ঠিক দশ মিনিট পর লোপাকে ফোন করে তিন্নি সেন জানালেন, তিনি ওদের অ্যাপার্টমেন্টের মেন গেটের কাছে দাঁড়িয়ে আছেন। লোপা যেন তৈরি হয়ে নেমে আসে। লোপা ঘরে তালা দিয়ে নিচে নেমে এল।

লোপাদের অ্যপার্টমেন্টের বিপরীত দিকে ল্যাম্প পোস্টের নিচে ভদ্র মহিলা দাঁড়িয়েছিলেন। অল্প আলোয় তাঁর দুধে আলতা গায়ের রঙ লোপার মনে একটা হালকা হিংসার ভাব জাগিয়ে তুলেছিল। তার উপর মহিলা একটা হালকা লাল রঙের শাড়ি পরে আছেন যা তার রূপকে আরো সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছে।

রাস্তায় যেতে যেতে তিন্নি জানালেন,এক্ষুনি ওঁকে একবার হসপিটাল যেতে হবে। ওঁর এক বান্ধবি সেখানে ভর্তি আছেন। ওঁর স্বামী এই মুহুর্তে দেশে নেই। আর অত ছোট বাচ্চাকে নিয়ে এট রাতে হসপিটাল যাওয়া ঠিক হবেনা। আসে পাশে ওঁর পরিচিত তেমন কেউ নেই। তাই তিনি লোপাকে ফোন করেছেন। তবে ওঁর ছেলেকে লোপার খুব ভালো লাগবে। মাত্র আট মাস বয়স।

লোপা জিজ্ঞাসা করল, “আপনার ছেলে কি এখন জেগে আছে?”

তিন্নি হেসে বললেন, “না। বাবু এখন ঘুমিয়ে আছে। তবে যদি বাবুর ঘুম ভেঙে যায়, ফিডিং বোতলটা ওর মুখে ধরবে। ওটা রান্নাঘরে কোনের তাকে রাখা আছে। এবং ওটা অটোমেটিক ফিডিং বোতল। দুধ ভরে টেম্পারেচার সেট করা আছে। তোমাকে দুধ আলাদা করে গরম করতে হবে না। শুধু ছিপি খুলে খোকার মুখে ধরতে হবে। কি পারবে তো?”

লোপা কিছু বলল না। শুধ ঘাড় নাড়িয়ে জানিয়ে দিল সে পারবে। অ্যাডভেঞ্চারের নেশায় রাজি হয়েছিল লোপা। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে সে ভুল করেছে। রাজি না হলেই হত। এই অন্ধকারে বিল্ডিংগুলোর মাঝে দু’চারটে ফ্ল্যাটেই আলো জ্বলছে। লোপা এখানে থাকবে কী করে?

লোপার দিকে তাকিয়ে তিন্নি বললেন, “কী ব্যাপার? ভয় পাচ্ছো? এখানে ভয়ের কিছু নেই। এইতো আমি আমার ছেলেকে নিয়ে থাকি। ওপারে দেখ ওই পারের ফ্ল্যটে থাকেন মিসেস দত্তগুপ্ত। ওঁরা আজ একটা বিয়েবাড়িতে গিয়েছেন। তা না হলে আমাকে এত চিন্তা করতে হত না। বাকি আরো অনেক আছেন তবে সবার সঙ্গে এখনো ভালো ভাবে পরিচয় হয়ে ওঠেনি।”

লোপাকে নিজের ফ্ল্যটে রেখে তিন্নি সেন চলে গেলেন। লোপা উপলব্ধি করল এই বিল্ডিঙে আপাতত সে একা। আর আছে ওই দোলায় শোয়ানো আট মাসের খোকা। সবার আগে ভালো করে দরজাটা ভাল করে বন্ধ করল সে। তারপর গেল খোকার কাছে। সে তখনো ঘুমাচ্ছে। খোকা ঘুমাচ্ছে দেখে লোপা ভাবল আওয়াজ কমিয়ে টিভিটা চালিয়ে দেবে। তাহলে নিজের একাকিত্ব খানিকটা হলেও দূর হবে।

কিন্তু লোপার কপাল মন্দ। টিভি চালানোর কিছুক্ষণের মধ্যেই কারেন্ট চলে গেল। কারেন্ট চলে যাওয়ায় এই নিকষ আঁধারে লোপা দিশেহারা হয়ে পড়ল। প্রথমে কী করবে বুঝতে পারল না। পরে ফোনের ফ্ল্যাশলাইট জ্বালিয়ে এমার্জেন্সি লাইট খুঁজতে লাগল। কিন্তু না। পেল না। রান্নাঘরে গিয়ে দেখল অনেকগুলো বড় বড় মোমবাতি রাখা আছে। লোপা তার থেকে চারটে জ্বালিয়ে ঘরের বিভিন্ন জায়গায় রাখল। এতে অন্ধকার কিছুটা হলেও কমল। নিজের ব্যাগে করে অর্ধসমাপ্ত গল্পের বইটা লোপা নিয়ে এসেছিল। তবে এই পরিবেশে সেটা আর বার করতে ইচ্ছ করলনা লোপার সে চুপচাপ এক জায়গায় বসে রইল।

হঠাৎ তীক্ষ্ণ একটা আওজে লোপা লাফ দিয়ে উঠল। তারপর বুঝতে পারল খোকার ঘুম ভেঙেছে। সে কাঁদছে।

তাড়াতাড়ি রান্না ঘর থেকে সেই ফিডিং বোতলটা এনে খোকার মুখে ধরল লোপা। জানালা দিয়ে একরাশ ঠান্ডা হাওয়া এসে কয়েকটা বাতি নিভিয়ে দিল। লোপা ছুটে গিয়ে জানালা বন্ধ করতে গেল। আর সেখানেই গিয়ে যা দেখল সেটা দেখেই সে ভয়ে কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে গেল। সামনেই একটা কবরখানা। ঝোপ জঙ্গল আগাছা ভর্তি। আর সেখানে ঘুরে বেড়াচ্ছে বিরাট বিড়াট কুকুর। লোপাকে জানালায় দেখতে পেয়ে একটা কুকুর ওর দিকে ঘুরে তাকাল। তার জিভ বার করে নিজের মুখটা একবার চেটে নিয়ে চেঁচিয়ে উঠল।

ডাক শুনেই লোপা বুঝতে পারল এটা আর যাই হোক কুকুর কোনোদিনই নয়। এমন সময় আরো একটা দমকা হাওয়ায় বাকি বাতিগুলোও নিভে গেল। লোপা তাড়াতাড়ি জানালা বন্ধ করে ছিটকে সেখান থেকে সরে এল। তার পর রান্নাঘর থেকে দেশলাই এনে একে একে সব মোমবাতি গুলো আবার জ্বালাল।

এমন সময় থপ করে একটা শব্দ শুনে জানালার দিকে ঘাড় ঘোরালো লোপা। দেখল একটা বাদুড় জানালার কাচে সেঁটে আছে। পরক্ষণেই আরো একটা থপ করে শব্দ হল। লোপা দেখল আরো একটা বাদুড় উড়ে এসে জানালার গায়ে সেঁটে গেছে। এবং এইভাবে একের পর এক বাদুড় এসে জানালাটা পুরো অন্ধকার করে দিল। এবং তার পরেই শুরু হল ওদের আসল খেলা। একসঙ্গে তিনচারটে বাদুড় উড়ে একটু দূরে যায় এবং পরক্ষণেই এসে জানালার কাচে ধাক্কা মারে। তারপর আবার একদল উড়ে যায় ফিরে এসে জানালার কাচে ধাক্কা মারে। যেন জানালার কাচ ওরা আজকে ভেঙে দেবে।

ঘরের ভিতরে একটা ঠং করে শব্দ হওয়ায় লোপার সম্বিত ফেরে। খোকার হাত থেকে দুধের বোতল মেঝেতে পড়ে গেছে। কয়েকফোঁটা দুধ গড়িয়ে মেঝেতে পড়েছে। মোমের আলোয় সেগুলো কেমন কালচে লাগছে।

বোতলটা মেঝেয় পড়ে যাওয়ায় খোকা কান্না শুরু করল। লোপা বোতলটা নিয়ে আবার খোকার মুখে ধরল। কিন্তু সে বোতলটা মুখে নিল না। বদলে তার কান্না আর বেড়ে গেল। লোপা খোকাকে নিজের কোলে তুলে নিল। খোকার কান্না থেমে গেল। কিন্তু তার পরেই পিছনের কবরখানা থেকে একটা রক্ত জল করা ডাক ভেসে এল। লোপা জানে এটা নেকড়ের ডাক। সে খোকাকে আরো জোরে নিজের সঙ্গে চেপে ধরল।

জানালায় সেঁটে থাকা বাদুরগুলো কোনো অজানা ভয়ে সবাই একসঙ্গে উড়ে চলে গেল। বাইরে চাঁদ উঠেছে। চাঁদের আলোয় চারপাশ ভেসে যাচ্ছে। এতক্ষণ তো চাঁদটা ছিল না! তবে কি বাইরে মেঘ করে ছিল? লোপা জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখল। সেই নেকড়েটা জানালার দিকে মুখ করে বসে আছে। লোপাকে দেখে সে একবার মুখ হাঁ করল। যেন লোপাকে দেখে হাসল।

খোকা মুখ দিয়ে ব্রু,ব্রু করে একটা আওয়াজ করছে। খোকার শরীরটাও যেন আগের থেকে ভারী লাগছে। এই বয়সে খোকার গায়ে কত লোম। বাইরে নেকড়েটা লোপার দিকে তাকিয়ে একটা অদ্ভুত শব্দ করল। খোকার মুখ থেকেও একটা অন্যরকম আওয়াজ বের হচ্ছে। হঠাৎই লোপার গলার কাছটা কেমন জ্বালা করে উঠল।

লোপা যখন ব্যাপারটা কী ঘটছে সেটা বুঝতে পারল তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। খোকার ছোট ছোট শ্বদন্ত ততক্ষণে লোপার গলায় গভীরভাবে বসে গেছে। জানালার বাইরে থেকে তখন ভেসে আসছে সমবেত অনেকগুলো নেকড়ের ডাক।

একমাস পর

“হ্যালো।” একরাশ বিরক্তি নিয়ে ফোন ধরল নন্দিনী।

“হ্যালো। আমি কি নন্দিনী বিশ্বাসের সঙ্গে কথা বলছি?”

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত