পঞ্চু প্রধানের দোয়ায়

পঞ্চু প্রধানের দোয়ায়

রাজপুর কলকাতা থেকে শ’খানেক কিলোমিটার দূরে। জায়গাটা সম্প্রতি গ্রাম ছাড়িয়ে গঞ্জ হয়ে উঠছে, মিউনিসিপালিটির অধীনেও এসেছে। তবু আশেপাশে রয়ে গেছে কিছু ফাঁকা মাঠ, জঙ্গল।

তপন রাজপুরের এক বছর সতেরোর ছেলে। ফার্স্ট ডিভিশনে দশ ক্লাস পাশ করে বারো পড়ছে। সঙ্গে কম্পিউটারও শিখছে। তবু লোকে তাকে বলে হাবা তপন। কারণ তার বুদ্ধি নাকি উল্টোবাগে ধায়। উদ্ভট সব কাজ করে অনবরত কেস খায়।

সেদিন তপন কম্পিউটার ক্লাসে তার অ্যাসাইনমেন্ট শেষ করতে একটু দেরি করে ফেলেছিল। বেরোতে বেরোতে সন্ধে হয়ে গেল। ফেরার পথে শর্টকাট করতে সে গোশালার মাঠের পথ ধরেছিল। জায়গাটা আসলে ভাগাড়, লোকে মরা জীবজন্তু ফেলে যায়। তাই চট করে কেউ ওখানে পা দেয় না। বিশেষত রাতবিরেতে নাকি কীসব ভয়ডর আছে।

তা, হাবা তপন অতশত বোঝে না। সে নিশ্চিন্তে চলেছে। চারপাশে পচা গন্ধ, তাই নাকে রুমাল দিয়েছে। কিন্তু হঠাৎ যেন দুর্গন্ধটা মাত্রা ছাড়িয়ে রুমাল ভেদ করে নাকে ধাক্কা দিল। কাছেপিঠে কোনও মরা জন্তু আছে নাকি? ভাবতে ভাবতেই দেখে চারপাশে কতগুলি কালো কালো ছায়া ঘনিয়ে আসছে। তাদের দেখা যায়, আবার যায়ও না। ভালো করে বুঝে ওঠার আগে শুনতে পেল নাকি সুরে, “বাঁবা তঁপন, এঁকটু থেমে যাঁবি? আঁমাদের যে ভাঁরি এক সমিঁস্যে হঁয়েছে।”

ওঃ, তেনারা! হাবা তপনের শরীরে অন্য অনেক অনুভূতির মতো ভয় বস্তুটারও খামতি ছিল। তবু এহেন পরিস্থিতিতে একদম না ভড়কালে ব্যাকরণে ভুল হয়। তাই সে একটু কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, “সব ছেড়ে আমাকে কেন? আমি হাবা তপন, আপনাদের সমস্যায় কী কাজে আসব বলুন তো?”

“তোকেই আমাদের চাই। তুই কম্পোটার শিখছিস, আমাদের সমিস্যেটাও বলতে গেলে তাই নিয়ে।” (পড়ার সুবিধের জন্য এরপর তেনাদের উচ্চারণের চন্দ্রবিন্দুগুলি বাদ দিয়ে লেখা হচ্ছে।)

সর্বনাশ, দুনিয়া কী রেটে এগোচ্ছে! ভূতেদের সমস্যাও কম্পিউটার নিয়ে! তপন একটু ভেবেচিন্তে বলল, “কিন্তু আপনি কে – ‘গু-গা-বা-বা’র মতো কোনও ভূতের রাজা? আমি যদি সমস্যার সমাধান করতে পারি আমাকে আমার ইচ্ছেমতো বর দেবেন?”

অন্ধকারে তপন শুনল এক দীর্ঘশ্বাস, “নারে, আমি অমন লাটবেলাট নই, আমার খ্যামতাও কম। আমি শুধু এই মাঠের ভূতেদের মোড়ল। তোদের নাকি মুন্সিপাল হয়েছে। তা আমরা এখনও ওই কী বলে, পঞ্চায়েতে।”

“মানে আপনি পঞ্চায়েতের হেড। তাহলে আপনাকে পঞ্চু প্রধান বলে ডাকি?”

“খাসা বলেছিস!” খ্যাক খ্যাক হাসি, তারপর শোনা গেল, “বেশ, তাই ডাকিস। তা, আমার তোকে ইচ্ছেমতো বর দেওয়ার সাধ্যি নেই। তবে তুই যদি আমাদের খুশি করতে পারিস, আমি কথা দিচ্ছি তুইও খুশি হয়ে বাড়ি ফিরবি।”

“বেশ, এবার কী চান চটপট বলে ফেলুন দেখি। বাড়ি ফিরে আবার আমাকে হোম ওয়ার্কে বসতে হবে।”

পঞ্চুর ইঙ্গিতে এবার দু’টি কচি ভূত এগিয়ে এল। তাদের কথা শুনে তো তপনের আক্কেল গুড়ুম। ভূতেরাও যে এতটা প্রযুক্তি-সচেতন, কে জানত! তারা কম্পিউটার, ই-মেল ছেড়ে সম্প্রতি স্মার্টফোন, হোয়াটসঅ্যাপে বার্তাবিনিময় শুরু করেছে। নতুন প্রজন্মের ভূতেদের আবার খুব মাতৃভাষাপ্রীতি। অনেক চেষ্টায় তারা বাংলায় মেসেজ, ফাইল পাঠাতে শিখেছে। কিন্তু সেখানেই একটা গোলমাল হচ্ছে।

“আমরা চন্দ্রবিন্দুটা কী করে দিতে হয় খুঁজে পাচ্ছি না, তপনদা। তার ফলে –”

“সব ঘেঁটে ঘ হয়ে যাচ্ছে।” তপন সহানুভূতির সুরে বলল, “স্বাভাবিক, চন্দ্রবিন্দু ছাড়া তো অনেক সময় মানেই বদলে যায়। যেমন কাঁদা মানে ভ্যাঁ-ভ্যাঁ আর কাদা হচ্ছে ‘ম্যাগো, পায়ে কী লাগল’। ছাঁদ যেমন ‘ছিরি-ছাঁদ’-এ আর ছাদ হচ্ছে যা তোদের মাথার ওপর নেই।”

“সে প্রবলেম তো আছেই। সে নয় ধীরে ধীরে মানিয়ে নেওয়া যেত। কিন্তু আমাদের সমিস্যে আরও গভীর। শুনতেই পাচ্ছেন, আমরা একটু বেশি চন্দ্রবিন্দু দিয়ে কথা বলি। সেইমতো একটু বেশি চন্দ্রবিন্দু দিয়ে লিখেও থাকি। তাই চন্দ্রবিন্দু বাদ দিয়ে লেখা আমাদের মেসেজগুলি ভৌতিক না হয়ে মানবিক হয়ে যাচ্ছে। যারা সে-সব পাচ্ছে, ভাবছে ওগুলো মানুষের পাঠানো।”

“তাতে অসুবিধাটা কী?”

“মানুষ নেটওয়ার্কে ঢুকে পড়েছে ভেবে ভূতেদের মধ্যে প্রবল আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ছে। অনেক দুর্বল ধাতের ভূত তো মুচ্ছোও যাচ্ছে।”

“তোরা আবার মানুষকে ভয় পাস নাকি? আমি তো বরং শুনেছিলাম তোরা বাগে পেলে আমাদের ঘাড় মটকাস।”

“সেসব শুধু গল্পকথা রে, ভাই।” এবার শোনা গেল পঞ্চুর গলা, “আমাদের ছায়ার শরীল, সাধ্যি কী কারও ঘাড় মটকাই! কিছু লোক ভয় পেয়ে পালাতে গিয়ে পড়ে ঘাড় ভাঙে আর দোষ যায় আমাদের নামে। তা, এখন তো সেসবও গেছে। তোরা আর আমাদের ডরাস না। উল্টে আমরাই মানুষের ভয়ে কাঁটা হয়ে থাকি।”

“না না, এই দেখুন না এখানে এসে আমার গায়ে কেমন কাঁটা দিয়েছে।” তপন তাড়াতাড়ি বলল।

“সে তো খোলা মাঠের ঠাণ্ডা হাওয়ায়।” পঞ্চু আবার দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “সে যাক বাবা, এবার কুচোগুলোকে বলে দে কী করে ঐ চন্দরবিন্দুর লাগাতে হয়।”

“দেখি, তোরা কী প্ল্যাটফর্ম ইউজ করছিস।” তপন এক ছানা ভূতের হাত থেকে স্মার্টফোনটা নিয়ে একটু ঘাঁটাঘাঁটি করে একগাল হেসে বলল, “খুব সহজ। অক্ষরের পর দু’বার q দিলেই চন্দ্রবিন্দু। যেমন ধর c a q q d হচ্ছে চাঁদ।”

হঠাৎ সব শুনশান, শুধু পুটপুট মোবাইলের মৃদু শব্দ। একটু পর চারদিক “ই-য়ে-য়ে-য়ে” উল্লাসধ্বনিতে মুখরিত হয়ে উঠল আর কিছু ছেলেবুড়ো ভূত তপনকে ঘিরে উদ্বাহু হয়ে নৃত্য করতে লাগল।

ভূতেদের কেত্তনে একটু ভাটা পড়লে পর পঞ্চু প্রধান এগিয়ে এসে গদগদ স্বরে বলল, “বড় উবগার করলি, বাপ। তোকে ঢালাও বর দেওয়ার সাধ্যি আমার নেই। তবু বলছি, তোর ভালো হবে। বুদ্ধিভাষ্যের তো খামতি নেই, তুই নিয্যস জেবনে উন্নতি করবি।”

“বুদ্ধি থাকলে কী হবে, আমার মাথায় যে একগাদা বিটকেলে আইডিয়া কিলবিল করে। তাতেই তো সব গুবলেট হয়ে যায়।”

“ওরে, বিটকেলে আইডিয়াতেই তো পিত্থিমোটা পাল্টায়। আমি কথা দিচ্ছি, ঐসব আইডিয়া কাজে লাগিয়েই তুই নাম করবি। শুধু নিজের ওপর ভরসা রাখিস। আর – একটা টুকটুকে রাজকন্যে চাই?”

“ধ্যাৎ, কী যে বলেন! এখন আবার ওসব হয় নাকি?” তপন লজ্জা পেল।

“হয়, হয়। শুধু সময়মতো ঐ কী যেন বলে – হ্যাঁ, ‘কলার টিউন’এ খেয়াল রাখিস।”

মানেটা কী? তপন জিগ্যেস করতে যাচ্ছিল। কিন্তু তার আগেই হু-স্‌ করে একটা ঠাণ্ডা হাওয়া আর সঙ্গে সঙ্গে তপনের সব কিছু কেমন গুলিয়ে গেল। হুঁশ ফিরলে চোখ কচলাতে কচলাতে দেখে, ফাঁকা মাঠে একা দাঁড়িয়ে।

তাহলে কি সে চলতে চলতে ঘুমিয়ে পড়েছিল আর দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই স্বপ্ন দেখছিল? এমনটাও হয় নাকি? ভাবতে ভাবতে তপন বাড়ির দিকে পা বাড়াল। তবে সন্দেহ নেই, স্বপ্নটা বেশ জম্পেশ।

পরদিন সকালে তপন তার গত সন্ধের বিচিত্র অভিজ্ঞতার কথা ভাবছিল। পঞ্চু প্রধান – মনে করেই আজ হাসি পাচ্ছে। পঞ্চু অবশ্য তাকে গালভরা কোনও প্রতিশ্রুতি দেয়নি। শুধু বলেছে, তার আইডিয়াগুলি এবার থেকে ফলবে। বেশ, দেখা যাক। চেষ্টা করতে তো দোষ নেই। আর শেষে রাজকন্যে না কী যেন একটা বলছিল? ওসবে অবশ্য তপনের মাথাব্যথা নেই। তার ছোটবেলার খেলার বন্ধু পাশের পাড়ার বুলি – তার সঙ্গে তপনের বিয়ে তো দু’জনের বাবা-মা মিলে কবে থেকেই ঠিক করে রেখেছে। শুধু ওদের লেখাপড়া শিখে নিজেদের পায়ে দাঁড়াবার অপেক্ষা। ভাবতে ভাবতে তপনের গাল লাল হয়ে উঠল।

বুলি অবশ্য এখন আর এ পাড়ায় বা তপনদের বাড়ি তেমন ঘন ঘন আসে না। ও পড়াশোনায় খুব ভালো। শোনা যায়, তাই নিয়ে ব্যস্ত। যাক, তপনের মাথাতেও এখন অনেক চিন্তা। কলেজ, কম্পিউটার ক্লাসের হোম ওয়ার্ক সারতে সারতে হঠাৎ ওর মনে পড়ল, শহরে একটা ‘টেক ফেস্ট’ হবে, যেখানে ছাত্ররা মডেল জমা দিতে পারে। এবারকার থিম ‘শক্তি সংরক্ষণ’। প্রজেক্টের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা আর প্রাথমিক একটা মডেল কিছুদিনের মধ্যে জমা দিতে হবে। সেটা পাস হলে কয়েক মাস পর ফেস্ট, তার আগে চূড়ান্ত মডেল জমা দিতে হবে। তদ্দিনে ওর পরীক্ষা শেষ হয়ে যাবে। দেখবে না কি একবার চেষ্টা করে?

ভাবতে ভাবতে আবার ওর মনে এক আজগুবি চিন্তা এল। কিন্তু কিছুতেই যে সব সূত্রগুলি মিলছে না? অনেক মগজমারির পর শেষে মোটামুটি একটা দাঁড়াল। জানে, এটা জমা দিলে সে আবার খোরাক হবে। তবু পঞ্চু প্রধানের কথা ভেবে তপন শেষ অব্দি খাতাকলম নিয়ে বসল। একটা নকশাও এঁকে ফেলল। মডেলটা কী করে বানানো যায় ভাবছে। এমন সময় ভাই স্বপন এসে বলল, “দাদা, বুলিদি তোকে ডাকছে।”

“ডাকছে? ঘরে বসতে বল, আমি এক্ষুণি আসছি।” তপন ব্যস্ত হয়ে উঠল।

“ঘরে আসবে না। ঐ গাছতলায় দাঁড়িয়ে আছে।”

তপন গিয়ে দেখল, বুলি হাতে একটা ক্যারি ব্যাগ নিয়ে দাঁড়িয়ে। অনেক দিন পর বুলির সঙ্গে দেখা হল। তপন কিন্তু-কিন্তু করে বলল, “কী ব্যাপার?”

“এগুলো ফেরত দিতে এলাম।” বুলি ব্যাগটা এগিয়ে ধরল। তপন অবাক হয়ে দেখল, তাতে ছোট ছোট অনেকগুলি জিনিস। এসব ছোটবেলায় বিভিন্ন সময় ওর বুলিকে যত্ন করে বানিয়ে দেওয়া উপহার। বড় হওয়ার পর যখন তপন শুনল বুলি ওর বৌ হবে, তখন থেকে লজ্জায় আর কিছু দিতে পারেনি।

“কী ব্যাপার, ফেরত দিচ্ছিস যে?” তপন অবাক হল।

“আসলে আমি এখন পড়াশুনোয় খুব ব্যস্ত থাকব। হয়তো কিছুদিন পর হস্টেলে চলে যাব। এসব তো পড়ে পড়ে নষ্ট হবে, তাই –”

তপন আপত্তি করতে যাচ্ছিল। কিন্তু তার আগেই বুলির ফোন বেজে উঠল। তাড়াতাড়ি ধরেই বুলি বলল, “সরি, আমাকে এক্ষুণি যেতে হচ্ছে।” তারপর তপন কিছু বোঝার আগে তার হাতে ব্যাগটা ধরিয়ে দিয়ে কেটে পড়ল।

তপন ভ্যাবলার মতো দাঁড়িয়ে রইল। এত কিছুর মধ্যেও সে ভাবছিল, বুলির ফোনে বেজে ওঠা কলার টিউনের গানটা কী? কলার টিউন খেয়াল রাখতে বলেছিল না পঞ্চু প্রধান?

ক’দিন বাদে অবশ্য সে বুলির আচরণের মানে বুঝতে পারল, বাবা-মা’র উত্তেজিত আলোচনা থেকে। বুলিরা নাকি কলকাতায় থাকবে বলে রাতারাতি বাড়িঘর বিক্রি করে পাড়া ছেড়ে চলে গেছে। বাবা তাড়াতাড়ি গিয়েছিলেন তাঁদের ঠিকানা জানতে, পরে যোগাযোগ রাখবেন বলে। কিন্তু সেটা তাঁদের ইচ্ছে নয়। বুলি নাকি বলেছে, কবে কী কথা হয়েছিল তার জন্য সে এক হাবাকে বিয়ে করতে পারবে না।

আড়াল থেকে এসব শুনল তপন। বুলিও তাকে হাবা মনে করে দূরে সরে গেল ভেবে একটু দুঃখও হল। হঠাৎ তার মনে পড়ে গেল, বুলির মোবাইলে যে কলার টিউনটা বেজে উঠেছিল তার গানটা হচ্ছে “আমি চিরতরে দূরে চলে যাব, তবু আমারে দেব না ভুলিতে।” তাহলে পঞ্চু প্রধান যে কলার টিউনে খেয়াল রাখতে বলেছিল, সেটা খুব ভুল নয়? তবে কি পঞ্চু আর যা বলেছিল সেটাও ফলবে?

এই ভেবে সে বুলির কথা ভুলে টেক-ফেস্টের মডেলে মন দেওয়ার চেষ্টা করতে লাগল।

তপনের আইডিয়াটা হচ্ছে এক অভিনব ওয়াশিং মেশিনের, যা বিদ্যুৎ ছাড়া চলবে। হাতে কাচাকুচির মূল অসুবিধা হচ্ছে আজকাল আমরা মাটিতে উবু হয়ে বসে কাচতে পারি না আর হাতে কাপড়গুলিকে মেশিনের মতো ঘোরাতেও পারি না। তপনের মতে, এই দুই সমস্যার সমাধানে বিদ্যুতের দরকার নেই। সে এমন যন্ত্রের প্ল্যান করেছে যাতে বৈদ্যুতিক যন্ত্রের মতোই একটা চেম্বার থাকবে। কিন্তু কাপড়গুলি ঘোরাবে দু’জন মানুষ, যারা একসঙ্গে হাঁটবে বা দৌড়োবে। আজকাল অনেকেই মেদ ঝরাতে হনহনিয়ে হাঁটেন বা ট্রেডমিল করেন। এই যন্ত্রে দু’জনের একত্রে ব্যায়াম হবে আর সেই ফাঁকে কাপড় কাচাও হয়ে যাবে।

তপন নিশ্চিত ছিল, তার উদ্ভট মডেলটা বাতিল হবে আর কেউ খবরটা ফাঁস করে দিয়ে তাকে যথারীতি খোরাক করবে। কিন্তু সে প্রথম ধাক্কা খেল যখন তার প্ল্যান পাস হল। পঞ্চুর কথাটা ভেবে সে অনেক পরিশ্রম করে ফাইনাল মডেল তৈরি করল। বাড়িতে কাউকে না বলে করা, তাই এর ফলে নিজের হাতখরচের জমানো টাকা ফতুর হয়ে গেল। তবে জিনিসটা দাঁড়াল ভালো।

ফেস্ট-এর দিন তপন দুরু দুরু বুকে গেছে। তার ভয়, চেনাজানা কেউ যেন না গিয়ে পড়ে। তাহলে পাড়ায় এ নিয়ে হাসাহাসি শুরু হবে। কিন্তু গিয়েই দেখল, তাদের ফার্স্ট বয় আদিত্য সেখানে এক সোলার পাওয়ার সিস্টেমের মডেল নিয়ে বসে আছে। স্বভাবতই আদিত্যর বন্ধুবান্ধব, মানে তপনের অন্য অনেক ক্লাস ফ্রেন্ড দেখতে এল। তারা তপনকে দেখে অবাক হলেও তার মডেল খুব যত্ন করে দেখল। তারপর ফিকফিক করে হাসতে হাসতে চলে গেল।

তপন লজ্জায় অধোবদন হয়ে ভাবছে এবার পাততাড়ি গুটোবে কিনা। এমন সময় উদ্যোক্তারা ঘোষণা করলেন যে প্রধান বিচারক সুধীর মিত্তল এসে গেছেন। তিনি আই-আই-টি’র প্রাক্তনী, এখন এক বড় কোম্পানির কর্ণধার। তপন ঠিক করল, তাঁকে অন্তত একবার চোখের দেখা দেখে তবেই যাবে।

তিনি এসে প্রতিটি মডেল খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলেন। কিন্তু তপনের মডেলের কাছে এসে তাঁর চোখেমুখে ফুটে উঠল এক অবাক খুশির ভাব। বললেন, “তুমি নিজে এটা করেছ?”

তপন থতমত খেয়ে সাধ্যমতো ভালো ইংরেজিতে বলল, “হ্যাঁ। ভালো হয়নি, তাই না? আসলে আমি লেখাপড়ায় তেমন ভালো নই কিনা।”

“ভাগ্যিস তুমি লেখাপড়ায় ভালো না, তাই মুখস্থবিদ্যা আউড়ে যাওনি। এখন তো সেটাই চলছে। দ্যাখো, কত ভালো ছেলেরা কত কী করেছে। তবে তার সবই প্রচলিত জিনিসগুলির একটু এদিক-ওদিক। তোমার মধ্যে কিন্তু এখনও একটা সৃজনশীল মন রয়ে গেছে। এটাকে নষ্ট হতে দিও না।”

অভিভূত তপন বলল, “স্যার, আমাকে আগে কেউ এভাবে বলেনি।”

“আমি বলছি, তুমি জীবনে উন্নতি করবে। অবশ্য তোমার প্ল্যানে অনেকগুলি প্রযুক্তিগত ফাঁক রয়ে গেছে। কিন্তু তুমি যদি এটা আমার হাতে তুলে দিতে রাজি থাকো, আমরা সেসব দূর করে যন্ত্রটা বাজারে ছাড়ব। গ্রামে তো বটেই, শহরেও এটা হৈ-হৈ করে চলবে আর প্রচুর বিদ্যুৎ বাঁচাবে।”

“সে আমার সৌভাগ্য, স্যার।”

“তবে বিনেপয়সায় আমি এটা নেব না। তুমি এরজন্য উপযুক্ত সম্মানমূল্য পাবে। আর, তোমার যদি আপত্তি না থাকে তবে এরপর তোমার লেখাপড়ার দায়িত্বও আমরা নেব। তারপর তুমি হবে আমাদের সংস্থার একজন সম্মানীয় কর্মী। না, তোমাকে ইঞ্জিনিয়ার হতে হবে না। দক্ষ ইঞ্জিনিয়ার আমাদের অনেক আছে। তুমি শুধু মানুষের সমস্যা দেখবে, ভাববে আর আমাদের আইডিয়া দেবে। সেগুলো রূপায়ণের ভার আমাদের।”

তপনের চোখ ছলছল করে উঠল। সে মিত্তলকে ঢিপ করে একটা প্রণাম করল।

তারপর – ঐ যে ইংরেজিতে বলে না – বাকিটা ইতিহাস। মিত্তলের ছত্রছায়ায় তপন উপযুক্ত লেখাপড়া শেখার সঙ্গে সঙ্গে একের পর এক উদ্ভাবন করে তাক লাগিয়ে দিতে লাগল। তার সবটা সবাই না জানলেও একটু একটু করে তপনের নাম ছড়াতে লাগল।

দু-একটা নমুনা দেওয়া যাক। বেশ কিছু বাড়িতেই সে দেখেছে কেউ এসি পছন্দ করে না, কিন্তু ডেস্কটপ বা ল্যাপটপ কম্পিউটার অতিরিক্ত গরম হয়ে যাবে বা ডিস্ক ধুলো লেগে নষ্ট হয়ে যাবে এই ভয়ে ঘরে এ-সি লাগাতেই হয়। এর ফলে অনেক বিদ্যুতের অপচয় হয়। এই সমস্যার সমাধানে তপনের পরামর্শ – প্রতি নতুন বাড়িতে রাখতে হবে একটা ছোট্ট ঘর, যাতে থাকবে শুধু একটা ডেস্কটপ বা ল্যাপটপ টেবিল, একটা চেয়ার, বইপত্রের একটা দেয়াল আলমারি আর মাঝে মাঝে একটু গড়িয়ে নেওয়ার জন্য একটা সোফা-কাম-বেড। সেই ছোট্ট ঘরে চলবে কম ক্ষমতার মিনি-এসি। ডিজাইনটি মিত্তলের কোম্পানি খুব তাড়াতাড়ি প্রচার করে মিনি-এসির প্রাথমিক বাজারটা ধরে ফেলল। বিল্ডাররাও দেখল, আইডিয়াটা বিশেষত স্বল্পবিত্তদের ফ্ল্যাটে খুব জনপ্রিয় হবে। নতুন প্রজেক্টগুলির প্ল্যান তারা সেইভাবে করতে লাগল। এমনকি অনেকে এই উদ্দেশ্যে পুরনো ঘরও পার্টিশন করে ছোট করে নিল। আর এভাবে আবার বিদ্যুতের অপচয় রোধে সাহায্য করে তপন পেল সরকারি মেডেল।

এছাড়া তপন একটা অভিনব ছড়ির ডিজাইন করেও তাক লাগিয়ে দিয়েছিল। একদিন সে পার্কে দেখল একজন বৃদ্ধ মানুষ মোবাইলে ফুলের ছবি তোলার চেষ্টা করছেন, এমন সময় এক দুর্বৃত্ত তার হাত থেকে মোবাইল ছিনিয়ে দৌড় দিল। ভদ্রলোকের চিৎকারে আকৃষ্ট হয়ে কিছু লোক ছুটে এল, তাদের মধ্যে তপনও ছিল। শেষ অবধি সে-ই লোকটাকে জাপটে ধরে মোবাইলটা উদ্ধার করল।

কিন্তু এই ঘটনার পর তার ভাবতে ভাবতে মনে হল, ঐ বৃদ্ধ ব্যক্তিটির হাতের ছড়িটির ডিজাইনে যদি কিছু অদলবদল করা যায় তবে তা হাঁটার সহায়ের সঙ্গে সঙ্গে আত্মরক্ষার অস্ত্রও হতে পারে। যেমন, তার একদিকে ভারী ধাতুপিণ্ড বসিয়ে সেটাকে আক্রমণকারীকে দু’ঘা দেওয়ার কাজে ব্যবহার করা যেতে পারে। সঙ্গে একটা লুকনো ক্যামেরা ও জিপিএস সিস্টেম থাকবে, যাতে একটি বোতাম টিপলেই পুলিশের কাছে একটা নম্বরে খবর চলে যাবে যে ঠিক এই জায়গায় একজন আক্রান্ত হয়েছেন। আবার যদি কেউ ফটো তুলতে চান তবে ছড়িটাকে সেলফি স্টিক হিসেবেও ব্যবহার করা যাবে।

এই ‘ইলেকট্রনিক’ ছড়ির আইডিয়া নিয়ে মিত্তল প্রশাসন ও পুলিশের উচ্চস্তরে কথা বলেছেন। তাঁরা একবাক্যে স্বীকার করেছেন প্রস্তাবটা খুবই ভালো, তবে তা কার্যকর করতে একটু সময় লাগবে। আশা করা যাচ্ছে বছরখানেকের মধ্যে জিনিসটা চালু হবে।

সব মিলিয়ে, তপন এখন একজন কেউকেটা ব্যক্তি। রাজপুরে নয়, এখন তারা কলকাতায় থাকে। মাঝে মাঝেই তাকে কাজের জন্য এ-শহর, ও-শহরও করতে হয়। যারা তাকে হাবা বলত, দৈবাৎ দেখা হলে তারা মাথা ঝুঁকিয়ে ‘স্যার’ বলে। যদিও তপন নিজে জানে, সে আগে যা ছিল এখনও তাই আছে। তার মাথায় নানা আইডিয়া কিলবিল করে, যা সত্যিই উদ্ভট। তবে কি, এখন সেগুলো প্রায়ই লেগে যায়।

তাহলে কি এর জন্য ধন্যবাদ মিঃ মিত্তলের প্রাপ্য – যিনি খনিতে পাওয়া না-কাটা হিরেটাকে ঠিক চিনতে পেরেছিলেন? নাকি পঞ্চু প্রধানের দোয়াতেই আজ হাবা ছেলেটার ভাগ্য খুলে গেল? আবার এক এক সময় মনে হয় – সত্যিই পঞ্চু প্রধান বলে কেউ ছিল তো, নাকি সব তার কল্পনা? যে কল্পনার জোরে আত্মবিশ্বাসের দরজা খুলে গিয়ে সে এই জায়গায় পৌঁছতে পেরেছে?

এত নামডাক হয়েও কিন্তু তপনের একটা আশা অপূর্ণ রয়ে গেছে। সে বুলির সঙ্গে আর একবার দেখা করতে চায়। না, সে আর বুলিকে বিয়ে করতে চায় না। কিন্তু তার সামনে দাঁড়িয়ে জানতে চায় – সে কি তাকে এখনও হাবা মনে করে?

কিন্তু নানাভাবে চেষ্টা করেও তপন তার হদিস পায়নি। তবু সে চেষ্টা ছাড়েনি।

সম্প্রতি আর একটা আইডিয়া দিয়ে তপন বলা যায় খ্যাতির শীর্ষে উঠেছে। একটি আলোচনাচক্রে একজন জাপানি বিজ্ঞানী ব্যাখ্যা করছিলেন কীভাবে বিছানার সুষ্ঠু ডিজাইন করে মানুষের ঘুম যাতে ভালো হয় তার ব্যবস্থা করা যায়। ব্যাপারটার মূলে রয়েছে শরীরের ভারটাকে সঠিক ও সুষমভাবে সাপোর্ট দেওয়ার ব্যবস্থা করা, যাতে মানুষের নিজেকে হালকা লাগে। এটা শোনার পর তপন বলল, “স্যার, একই পদ্ধতি কি উপযুক্ত রদবদল করে বসা মানুষদের ওপরও প্রয়োগ করা যায় না?”

“বসা মানুষ? মানুষ বসে বসে ঘুমোবে?” বিজ্ঞানী অবাক হলেন।

“হ্যাঁ, স্যার। আজকাল অজস্র মানুষ প্লেনে বা ট্রেনের চেয়ার কারে দীর্ঘ সময় বসে বসে যাত্রা করতে বাধ্য হয়। ইচ্ছে থাকলেও তাদের অধিকাংশই ঘুমোতে পারে না। তাদের শরীরের ভারকে উপযুক্তভাবে সাপোর্ট দিতে পারলে তারাও হালকা হয়ে ঘুমোতে পারবে। আবার ট্রেন বা প্লেনের চলনের ছন্দকে কিছু গীয়ার ইত্যাদির সাহায্যে এদিক-ওদিক করে উপযুক্তভাবে প্রয়োগ করলে সেটা ঐ যাত্রীদের ঘুমেরও সাহায্য করবে। যেমন দোলনায় বাচ্চাদের দুলিয়ে ঘুম পাড়ানো হয়।”

“আইডিয়াটা দারুণ।” বিজ্ঞানী অবাক খুশিতে বললেন, “এর বিজ্ঞানের দিকটা আমরা অবশ্যই দেখতে পারি। কিন্তু পুরো যান্ত্রিক ব্যবস্থাটা খুব জটিল হবে। তাছাড়া –”

“সেটাকে খুব সহজ করে সাধারণ মানুষের ব্যবহারের উপযুক্ত ছোট্ট যন্ত্রে পরিণত করতে হবে, যে যন্ত্রটা ধরুন একটা বা দুটো বেল্টের সাহায্যে পরে নেওয়া যায়।” মিত্তল উত্তেজিত হয়ে বললেন, “কিন্তু এই চ্যালেঞ্জ আমরা নিলাম। এক বছরের মধ্যেই আমরা পেটেন্ট নেব আর সেটা হবে এই উদ্ভাবক তপনের নামে।”

খবরটা মিডিয়ায় রটে গেল আর তারপর তপনকে নিয়ে শুরু হল নাচানাচি। কাগজে কাগজে লেখালিখি, ইন্টারভিউ। তার থেকে পালাতে তপন একদিন প্রায় গা ঢাকা দিয়ে রাজপুরে চলে গেল, উঠল এক হোটেলে। কিন্তু যে যে উদ্দেশ্যে সেখানে গিয়েছিল, তার কোনওটাই পূরণ হল না।

সন্ধ্যা হলে সে গোশালার মাঠে গেল, যদি পঞ্চু প্রধানের দেখা পায়! কিন্তু অ্যাদ্দিনে সেখানকার ভোলই পাল্টে গেছে। মাঠ সাফ করে বড় বড় বাড়ি উঠছে, রাতেও তার কাজ চলছে। তবে কি পঞ্চুরা বাস্তুহারা হয়েছে? নাকি সে অ্যাদ্দিনে ‘মুন্সিপাল’-এর প্রধান হয়েছে? যাই হোক, এই তুমুল আলোয়, হট্টরোলে তার দেখা পাওয়া অসম্ভব।

এরপর সে বুলির খোঁজও করেছিল। কিন্তু সেটাও কেউ জানে না। তাই বিফল হয়েই সে রাতের ট্রেনে কলকাতা ফিরল।

পরদিন সকালে উঠতে একটু দেরি হল। যথারীতি দোতলার বেডরুম থেকে নিচের হলঘরে নেমে এসেছে খবরের কাগজ দেখবার জন্য। হঠাৎ শোনে দরজার বাইরে একটা ফোনে অজানা কলার টিউন বাজছে। কার ফোন? একটু পরই দরজা খুলে ঢুকল তার সেক্রেটারি ধীরেন। বিব্রতমুখে বলল, “স্যার, এক মহিলা সাংবাদিক, সকাল পাঁচটার থেকে বসে আছে। অ্যাপয়েন্টমেন্ট নেই, তবু বলছে আপনার সঙ্গে দেখা না করে ফিরবে না।”

তপন অসহায়ের মতো কী বলতে যাচ্ছিল, ইতিমধ্যে দেখে একটি স্মার্ট মেয়ে ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে। মোবাইলে বলছে, “হ্যাঁ বস, আমি ওঁর ইন্টারভিউ নিয়েই ফিরব।” তারপর তপনের দিকে চেয়ে বলল, “স্যার, আমি ‘ওয়েক আপ’ চ্যানেল থেকে আসছি। আপনাকে একটা ছোট্ট ইন্টারভিউ দিতেই হবে।”

মেয়েটির দিকে চেয়ে তপনের মনে হল, তাকে খুব চেনা লাগছে, কিন্তু কিছুতেই মনে পড়ছে না। হঠাৎ তার খেয়াল হল – একটু আগে মেয়েটির যে ‘কলার টিউন’টা সে শুনেছিল তার গানটা হচ্ছে ‘ফিরে যে আসিবে না, ভোলো তাহারে। চাহ তাহার পানে দাঁড়ায়ে যে দ্বারে।”

মেয়েটিকে ইঙ্গিত করে তপন বলল, “ভেতরে এসে বসুন। বলুন, কী জানতে চান।”

একটু ইতস্তত করে মেয়েটি বলল, “স্যার, প্রথমে যদি আমার চ্যানেলের শ্রোতাদের জন্য একটা মেসেজ দেন?”

“মেসেজ নয়, বন্ধুত্বপূর্ণ পরামর্শ।” তপন অনেক কষ্টে হাসি চেপে বলল, “কেউ আপনাকে হাবা বললে দুঃখ পাবেন না। মহাবিজ্ঞানী ডারউইন, আইনস্টাইনেরও হাবা আখ্যা জুটেছিল।”

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত