কবির কবিতা

কবির কবিতা

‘এই শুনছেন’
মিষ্টি কণ্ঠের ডাক শুনে পেছনে ফিরে তাকালো নিলয়। নিলয়ের কাঁধে একটা ব্যাগ ঝোলানো। হাতে একটা ডায়েরী, সাথে কলম।
ছেলেটার সর্বাঙ্গে কবি কবি ছাপ। ছাপ বললে চরম ভুল বলা হবে, কবিই তো। সবসময় সকলের চোখের আড়ালে কী যেন লিখে যায়। নিলয় ক্লাসে সকলেরই হাসির খোরাক। মোটা ফ্রেমে চশমাটা দিয়ে কোনো কোনো সময় অপলক দৃষ্টিতে কোনো গাছ, লতাপাতা কিংবা অপরূপ দৃশ্যের দিকে তাকিয়ে কী যেন ভাবে!
মিষ্টি কণ্ঠে ডাকা মেয়েটি হাস্যেজ্বল মুখ অবয়বে নিলয়ের সামনে দাঁড়ায়। নিলয় প্রশ্ন করে, ‘আমাকে ডাকছেন?’
হাস্যেজ্বল মুখটা হঠাৎ যেন কালো মেঘে ঢেকে যায়। খানিকটা বিরক্ত হয়ে মেয়েটি বলে, ‘আমি মিষ্টি, আপনি তো নিলয়।’
নরম কণ্ঠে নিলয় বলে, ‘আমি আপনার নাম জানি।’

মুখটা হাস করে দ্রুতই বন্ধ করে বলে, ‘আমার নাম জানলেন কেমনে? আমি তো কখনো আপনার সাথে কথা বলিনি।’
ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসি এঁকে নিলয় বললো, ‘কথা না বললে বুঝি নাম জানা যায় না?’
‘নাহ।’
‘আসলে তখন ওই মেয়েটা আপনাকে মনে হয় মিষ্টি নামে ডাকছিল, তখনি শুনেছি।’
‘ভারী অন্যায় করেছেন। তখন বুঝি কবিতা লেখা ছেড়ে কার কী নাম সেটা শুনছিলেন?’
‘ঠিক তা নয়। নামটা কানের মধ্যে ভেসে আসতেই তাকিয়ে দেখি আপনি।’
‘ওকে বাদ দেন। এই যে আমরা ক্লাসে নতুন এসেছি, একই ডিপার্টমেন্টে পড়ছি, কই আপনি তো কারো সাথে মেশেন না। দেখেন না আমরা এই অল্প দিনেই কেমন সবার সাথে নিজেকে মানিয়ে নিয়েছি।’
নিলয় খানিকটা হাসে, ‘আসলে আমার চিল্লাচিল্লি খুব বেশি পছন্দের নয়। একা থাকতেই ভালেবাসি। একাকী থাকার সময় কবিতা লিখি, আর কী!’
‘চলেন ওই বট গাছটার নিচে বসি।’

নিলয় মিষ্টির কথায় সম্মতি দেয়। হাঁটতে হাঁটতে বটগাছের নিচে এসে বসে পড়ে। মিষ্টি একেরপর এক আজেবাজে প্রশ্ন করেই যাচ্ছে, অন্যদিকে নিলয় বেচারা ভ্যাবলাকান্তের মতো উত্তর দিয়েই যাচ্ছিলো।
উত্তর দিতে দিতে খানিকটা বিরক্তবোধ করছিল সে। কিন্তু মেয়েটা রাগ দেখাতে পারছে না। নিলয় মনে মনে ভাবছে, ‘এজন্যই মেয়েদের সাথে মিশতে চাই না, এত কথা কোথা থেকে বলে!’
নিলয়ের অাঁকু-পাঁকু দেখে মিষ্টি বুঝতে পারছিল নিলয় একটু বিরক্ত হচ্ছে। মনে মনে শয়তানী বুদ্ধি হাতছানি দিচ্ছে। একটু চুপ করে নিলয়ের ডায়েরীর দিকে তাকিয়ে রইলো। ইতিমধ্যে নিলয় ডায়েরীতে কী যেন লেখতে শুরু করেছে। গলা খাঁকড় দিয়ে মিষ্টি বললো, ‘আমাকে একটা কবিতা লিখে দিবেন?’
মুচকি হেসে নিলয় মিষ্টির দিকে তাকায়। চোখে চোখ পড়াতে মিষ্টি খানিকটা লজ্জা পায়। কিছুক্ষণ পর নিলয় বলে, ‘কোন বিষয়ে লিখবো?’
নিলয়ের কথা শুনে মিষ্টি দ্রুত বলে উঠে, ‘সমকামিতার ওপর।’
কথাটা বলেই মিষ্টি চোখ ঘুরিয়ে হাসতে লাগলো। নিলয় এবার সত্যি সত্যি বিরক্ত হয়ে উঠে অন্যদিকে হাঁটতে লাগলো। নিলয়েরও বুঝতে বাকি রইলো না মিষ্টি ওর সঙ্গে মজা করছে। এভাবে মজা করতে থাকলে কবিতা লেখা হবে না। আজকের মধ্যে আরো কয়েকটা কবিতা লিখে শেষ করতে হবে। কাল রায়হান ভাইকে জমা দিতে হবে। বইমেলার তো আর বেশি দেরি নেই।
মিষ্টি একটু হেসে জোরে জোরে বলতে লাগলো, ‘কী দিবে না লিখে?’
পেছন ফিরে ভ্রু-কুঁচকে তাকিয়ে হনহন করে হাঁটতে লাগলো। মিষ্টি পেছনে বটগাছের শিখরে বসে হুহু করে হাসতে লাগলো আর ভাবতে লাগলো, ‘বেচারা নিলয় সত্যি সত্যি দারুণ জব্দ হয়েছে।’
কিছুক্ষণ হাসার পর নিজের থেকে চুপ হয়ে গেল। হঠাৎই মনটা খারাপ হয়ে গেল। বেচারা বুঝি সত্যি মন খারাপ করেছে। এই ভেবে মিষ্টিও মনটা খারাপ হয়ে গেল। আশেপাশে ভালো করে তাকিয়ে দেখে নিলয়কে খুঁজতে লাগলো। কিন্তু নাহ! নিলয়কে মিষ্টি কোথাও খুঁজে পেল না।

ক্লাস শেষ করেই ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে ক্লাস থেকে বের হয়ে হাঁটতে লাগলো। মিষ্টি নিলয়কে দেখা মাত্রই সেও ক্লাস থেকে বের হয়ে তাকে অনুকরণ করে হাঁটতে লাগলো। কিছুদূর যাওয়ার পর মিষ্টি ডাক দিলো, ‘নিলয় সাহেব,একটু দাঁড়ান প্লিজ।’
নিলয় পেছনে ফিরে মিষ্টিকে দেখা মাত্রই বড়বড় করে পা ফেলতে লাগলো। মিষ্টি বিষয়টা লক্ষ্য করে সেও দৌড়াতে লাগলো। সামনে গিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে বললো, ‘আপনাকে ডাকছি, শুনতে পারছেন না?’
চশমাটা ঠিক করে বড় বড় চোখে নিলয় বললো, ‘আবার আপনি? আবার বুঝি মজা করতে এসেছেন?’
মজা করার কথা শুনে কিছুটা লজ্জা পেল মিষ্টি। ছেলেটা তাহলে বিষয়টা এখনো মনে রেখেছে! মিষ্টি দু’হাত দিয়ে কান ধরে মুখটা বাঁকা করলো। মিষ্টির কাণ্ড দেখে নিলয় হাসতে থাকে। নিলয়ের হাসি দেখে মিষ্টি লজ্জায় মুখ লুকায়।
‘এবার মাফ করেছেন তো? কথা দিচ্ছি আর কখনো এভাবে আপনার সাথে মজা করবো না।’
নিলয় মুচকি হেসে হাঁটতে থাকে। মিষ্টিও তার সাথে তাল মিলিয়ে হাঁটতে লাগলো। নিলয় জানে মিষ্টি ক্লাসে সকলের সাথে সবসময় মজা করে। যদিও সবসময় ক্লাসে থাকে না তবুও যেটুকু সময় থাকে ততটুকু সময়েই বোঝা যায়।
‘আপনি এখন কোথায় যাচ্ছেন?’
আড়চোখে নিলয়ের দিকে তাকায় মিষ্টি।
‘আমার একটা পছন্দের জায়গা আছে, সেখানেই। আমি ওখানে বসে কবিতা লিখতে পছন্দ করি।’
‘আমাকে সাথে নেবেন কবি?’
নিলয় মুচকি হাসে। অতঃপর রিকশায় করে নিলয় মিষ্টিকে নিয়ে চলে যায় সেই নদীর পাড়ে। যে স্থানটা খুব প্রিয় নিলয়ের। সামনে বিস্তর নদী, উপরে আকাশ, নদীর পাশ দিয়ে কাশফুল। এমন একটা জায়গা পেয়ে খুব খুশি হয় মিষ্টি, খুব সুন্দর স্থান। কবিতা লেখার জন্য পারফেক্ট।
নিলয়ের বুকের একপাশটা এখনো ধুকধুক করছে। কারণ কোনদিনই সে কোনো মেয়ের সাথে একা রিকশায় ওঠেনি।
‘আচ্ছা আপনি তো কবি। কবিরা তো খুব দ্রুত মানুষের মন বুঝতে পারে। আমাকে দেখে আপনার কেমন মনে হয়?’
‘সত্যি কথা বলতে, আমার মনে হয় যে মানুষগুলো উপরে সবসময় হাসি-খুশি থাকে তার ভেতরে খুব কষ্ট।’
মিষ্টি মেকি হাসে, কোনো কথা বলে না। নিলয় কবিতা লেখতে থাকে। মিষ্টি নদীর দিকে তাকিয়ে থাকে। নিলয় বলে, ‘আপনি কি মন খারাপ করেছেন?’
‘কিছু কিছু স্মৃতিকে মানুষ ভুলতে চাইলেও ভুলতে পারে না। যত ভুলতে থাকে ততই মনের মধ্যে ভেসে থাকে।’
মিষ্টির কথার মধ্যে রহস্য খুঁজে পায় নিলয়। নিলয় বিশ্বাস করে, পৃথিবীর মানুষগুলো বড়ই রহস্যময়। একেকজনের ভেতরে একেকটা রহস্যের বাস। কেউ সেটা প্রকাশ করে আবার কেউ তা প্রকাশ করতে না পেরে হতাশার জলপ্রপাতে নিমজ্জত হয়। আবার কেউ কেউ মাত্রাতিরিক্ত হতাশার কারণে অাত্মহননের পথ বেছে নেয়।

কথাগুলো ভাসতেই রহস্যময় হাসি ভেসে ওঠে নিলয়ের মুখে। নিলয় বলে, ‘আপনি পারলে আমার সাথে আপনার কথাগুলো শেয়ার করতে পারেন। শুনেছি, কষ্ট-দুঃখ মানুষের সাথে ভাগাভাগি করে নিলে নাকি সেই কষ্ট-দুঃখ কমে যায়।’
কিছুক্ষণ কী যেন ভাবে মিষ্টি। ঘাসের উপরে মাটির কয়েকটা ঢেলা পেয়ে নদীর দিকে ছুঁড়তে থাকে, ‘শুনেছি কবিরা অল্প কথায় সবকিছু বুঝতে পারে। আমার মনে হয় মানুষের জীবনটা একটা গল্প। একেকজনের জীবন একেকটা গল্প। খুব ছোটবেলায় মাকে হারিয়ে ফেলি। সৎ মায়ের সংসারে মানুষ আমার দু’বোন। আদর-সোহাগ তেমন পাইনি। অনাদরের মধ্যেই বাড়তে থাকি। আমি তখন ক্লাস এইটে পড়ি। হঠাৎ আপুর লাশ দেখে অবাক হয়ে যাই। আমার সৎ মা গোপনে হেসেছিল। আপু মারা যাবার পর পৃথিবীতে একটা মানুষই কেঁদেছিল, সেটাই আমি। ছোট্ট একটা ডায়েরীতে কয়েকটা কথা লেখা দেখেছিলাম,
‘নিহানের প্রেমের জালে আসক্ত হয়ে নিজের সবকিছু বিসর্জন দিয়েছি। তবুও আমি তাকে ভালোবাসি। জীবনে কাউকে ভালোবেসে তার প্রেমে প্রেমান্ধত্ব হয়ে জীবন বিসর্জন দিতে হবে, সেটা কখনোই ভাবিনি।’
জানেন তো, আমি ডায়েরীটার কথাগুলো দেখে অবাক হয়েছিলাম। নিহান নামের ছেলেকেটা কখনোই দেখিনি। আমার মনে হয়, আপু তার অভিনয়কৃত প্রেমের কাছে প্রেমান্ধত্ব হয়ে তার সতীত্ব দিয়েছিল।’
কথাগুলো বলেই বড় ধরণের একটা নিশ্বাস ছাড়লো মিষ্টি। এতক্ষণ কথা শোনার সময় নিলয় মিষ্টির দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল।

এই প্রথম সে ভালোভাবে মিষ্টির দিকে তাকালো। মানুষ এত সুন্দর হয়? আজকে তার মুখে মায়ামাখা ভাব। চোখাচোখি হতেই লজ্জায় মুখটা সরিয়ে নিলো মিষ্টি।

প্রায়ই নিলয়ের সাথে নদীর পাড়ে এসে বসে থাকতো মিষ্টি। সম্পর্কটা আস্তে আস্তে আপনি থেকে তুমিতে গড়ায়। সেটা অবশ্য নিলয়ের সম্মতিতে। কিছুদিন পর মিষ্টি বুঝলো নিলয় মিশুক, তবে সবার সাথে না। পরিচিত কাউকে পেলে মনের ভাবগুলো ক্রমান্বয়ে প্রকাশ করতে থাকে।
‘আজকে একটু নদীর পাড়ে আসবে?’
মিষ্টি উত্তর দেয়, ‘কেন নয়! আমি ঠিক সময়ে চলে আসবো।’
নিলয় নদীর পাড়ে বসে আছে। আজকে আর সে কবিতা লিখছে না। মিষ্টিকে তার দিকে আসতে দেখলো নিলয়। মিষ্টি ইদানিং খুব শুকাচ্ছে। নিলয় বেশকিছু দিন আগ থেকে বিষয়টা লক্ষ্য করলেও জিজ্ঞাসা করা হচ্ছে না।
ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা টেনে বললো, ‘বইমেলা চলছে, শুনলাম তোমার বই বের হয়েছে। বইমেলায় না থেকে হঠাৎ এখানে আসলে যে!’
ব্যাগ থেকে একটা বই বের করে মিষ্টির হাতে ধরিয়ে দেয় নিলয়। বইটা পেয়ে মনে মনে খুশি হয় মিষ্টি। এই প্রথম কারো কাছে সে বই উপহার পেল। নিলয়ের প্রথমবারের মতো এই বইটাই এককভাবে প্রকাশিত। বেশ ভালোই সেল হচ্ছে। মিষ্টি বইটা হাতে নিয়ে গন্ধ শুঁকে কলমটা ব্যাগ থেকে বের করে নিলয়ের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলে, ‘অটোগ্রাফ প্লিজ।’
মিষ্টির চোখ ছলছল করতে থাকে।

নিলয়ের চোখ বেয়েও নেমে আসে অশ্রুকণা। দু’জনই দ্রুত চোখের জল মুছে ফেলে। মেকি হেসে বইটাতে একটা অটোগ্রাফ দেয় নিলয়। মিষ্টি কয়েকটা কবিতা দেখার পর শেষ পৃষ্টায় দেখে একটা কবিতা, ‘সমকামিতা’ শিরোনামে লেখা কবিতা পড়ে অবাক হয় মিষ্টি। কত চমৎকার শব্দশৈলী, শব্দ বুনন। সমকামিতার বিরুদ্ধে কবিতা পড়ে প্রথম থেকে পাতা উল্টাতে থাকে মিষ্টি। আনন্দে অশ্রুকণা এবার বাঁধ মানে না মিষ্টির। কারণ বইটা মিষ্টি ও তার অাপুকে উৎসর্গ করে লেখা।
নিলয় বলে, ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি মিষ্টি। প্লিজ তুমি আমাকে ফিরিয়ে দিও না। তুমি যেমন ঠিক তেমনি একজনকে আমি খুঁজি।’

এবার নিলয়কে জড়িয়ে ধরে মিষ্টি বলে, ‘আমি তোমার সাথে হাজার বছর বাঁচতে চাই নিলয়। তোমার প্রেমান্ধত্বে বারবার মরতে চাই। তুমি আমাকে জড়িয়ে রাখো প্লিজ, আমি তোমাতে কিছুক্ষণ সিক্ত হয়ে সুখ অনুভব করতে চাই।’
নিলয় ভালোবাসার মানুষকে কাছে পেয়ে যেমনটা খুশি হয়েছে ততটাই ব্যথাতুর হয়ে বুকটা জ্বলে যাচ্ছে মিষ্টির। মিষ্টি চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি ফেলছে। নিলয় ভাবছে এ সুখের অশ্রু। মিষ্টিও ভাবছে, তবে এ চোখের পানির মধ্যে কতটা ব্যথা লুকিয়ে আছে সেটা সে বুঝাতে ব্যর্থ হয়েছে। মিষ্টি কখনোই চায়নি নিলয় কষ্ট পাক। মৃত্যুর পর নিলয়ের কবিতা আবৃত্তি খুব মিস করবে। মিষ্টি জানে, নিলয় তাকে ভালোবাসে, সেটা খুব বেশিই।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত