বছর পাঁচেক হল আমি high school এ সহকারী শিক্ষকের পদে জয়েন করেছি। স্কুলটা বাড়ি থেকে অনেকটাই দূর। প্রথমে বাসে করে এক ঘন্টা যেতে হয় তারপর সাইকেল নিয়ে পাক্কা 45 মিনিট। মাঝে একটা ছোট্ট নদী পড়ে। বেশিরভাগ সময়ই জল থাকে না। কিন্তু বর্ষাকালে চরম ভোগান্তি হয়। নদীর জল দুকূল ছাপিয়ে যায়। রাস্তাঘাট এমন কাদায় ভরে যায় যে মাঝে মাঝে সাইকেল প্রায় ঘাড়ে করে নিয়ে যাওয়ার মত অবস্থা হয়। বৈশাখের কোন এক দিনে আমি স্কুল থেকে একটু তাড়াতাড়িই বেরিয়ে পড়লাম।
আকাশে মেঘ দেখে হেডমাস্টারকে একটু ম্যানেজ করে ছুটি হওয়ার মিনিট পনেরো আগেই বের হলাম। রাস্তায় জোরে জোরে সাইকেল চালিয়ে যখন মোহনপুর বাসস্ট্যান্ডে এলাম তখন আকাশের মেঘ কেটে গেছে। সাইকেলটা গ্যারেজে রেখে বাসে উঠলাম। এই একটামাত্র বাস যেটা এখান থেকেই ছাড়ে। ফলে জায়গা পেতে অসুবিধা হয় না। অন্যান্য বাসগুলো দূর থেকে আসে। প্রচন্ড ভিড় হয়। কিন্তু এই বাসটা প্রায় ফাঁকাই থাকে। পিছনের দিকে জানালার ধারে একটা সিটে এসে বসলাম। এমন সময় 12 কি 13 বছরের একটি ছেলে হাতে একটা বাঁকানো বৃত্তাকার তারে বাদাম আর লজেন্সের প্যাকেট নিয়ে বাসে উঠল। “বাদাম, বাদাম…লজেন্স, সল্টেস লজেন্স হবে।”
ছেলেটি আমার কাছে আসতেই বললাম
—-তোর নাম কি?
—-ছোটন, সবাই ছোটনা বলে ডাকে।
—-বাদাম, লজেন্স বিক্রি করছিস; স্কুলে যাস কখন?
—–স্কুল তো কবেই যাওয়া ছেড়ে দিয়েছি।
—–সেকি রে? স্কুলে যাস না? তোর বাবা কি করে?
—– বাবা আগে লজেন্স, বাদাম বিচতো। দুবছর আগে বাস থেকে নামতে গিয়ে পড়ে যায়। মাথায় খুব লাগে। অনেক রক্ত পড়ে। হাসপাতালে নিয়ে গেলে ডাক্তার বলে মরে গেছে। তারপর থেকে স্কুল বন্ধ করে আমি বাদাম বিচ্ছি।
কথাগুলো সোনার পর মনটা একটু ভারী হয়ে এলো। ছেলেটি যতটা স্বচ্ছন্দে কথাগুলো বলল তাতে মনে হল ঘটনাটা খুব সিরিয়াস কিছু নয়। হয়তবা বাস্তবতাকে মেনে নিয়েছে আর পিতৃ বিয়োগের যন্ত্রনা কালের নিয়মে তার কাছে ফিকে হয়ে এসেছে। যাইহোক একটু সামলে নিয়ে আমি পুনরায় প্রশ্ন করলাম।
—তোর মা কি করে?
—-মা আগে খুব খাটতে পারতো। চার পাঁচটা বাবুদের বাড়ি কাজ করতো। বাবা বাদাম বিক্রি করে যে টাকা পেত সবই মদ খেয়ে উড়িয়ে দিত।
তারপরে শেষ হয়ে গেলে মাকে চাইত। না দিলেই খুব মারতো। এখন মা আর বেশি কাজ করতে পারে না। সব সময় হাঁপায়। বাবা মরে যাওয়ার পর মাকে বললাম এবার আমি বাদাম বিচবো। মা প্রথমে রাজি হয়নি। কিন্তু একদিন মায়ের খুবই হাঁপানি বেড়ে গেলে আমি মাকে রেগে গিয়ে বললাম “এবার যদি আমাকে বাদাম বিচতে না দাও তাহলে আমি বাড়ি ছেড়ে লেবার খাটতে কেরালা পালাবো।” তারপর থেকে মা আর কিছু বলেনি। আমি ফাইভে পড়া ছেড়ে দিয়ে বাদাম বেচা শুরু করলাম। মা এখন শুধু একটা বাড়িতে কাজ করে।
ছেলেটি এক নিঃশ্বাসে কথা গুলো বলে ফেলল।
—-মা ছাড়া আর কে আছে?
— একটা বোন আছে। প্রাইমারি স্কুলে পড়ে।
—-তুই স্কুলে গেলে তো মিড-ডে-মিলের ভাত খেতে পেতিস। আরো অনেক টাকা পয়সা সাহায্য আসে। স্কুলে না গিয়ে বাদাম বিক্রি করলে সেগুলো তো আর পাবি না।
ছেলেটি একটু হেসে বলল
—-স্কুলে তো একবেলা খাবার দেয়। রাতে কি খাবো? মা কি খাবে? মায়ের ওষুধ, কাপড়-চোপড় এসব তো আর স্কুল থেকে দেবে না। মা স্কুলে গিয়ে হেডমাস্টারকে বলেছিল “মাস্টারমশাই ছোটনের নামটা কেটে দিবেন না, SC এর টাকাটা তাহলে পাওয়া যাবে। মাঝে মাঝে স্কুলে আসবে।” হেডমাস্টার খুব কড়া। মাকে বলেছে ছেলে নিয়মিত স্কুলে না এলে কোনোরকম সরকারি সাহায্য পাবে না। সপ্তাহে অন্তত একদিন তো আসতেই হবে। মা আমাকে বলেছিল সপ্তাহে একদিন করে যেতে। কিন্তু আমার আর যেতে ভাল লাগেনি।
একদিন করে গিয়ে কি পড়ব বলেন বাবু। পরীক্ষাতে কিছুই লিখতে পারবো না। ফেল করে পরের ক্লাসে উঠে গেলে খুব লজ্জা লাগবে। বন্ধুরা খুব খ্যাপাবে। এমনিতেই যখন বাদাম বিচে বাড়ি যায় স্কুলের ছেলেরা বলে “এই বাদামবালা তোর বাদাম কত করে কিলো রে? এক কিলো দে তো। কাল টাকা নিবি”। স্কুলে গেলে ওরা তাহলে কি করবে! এই ভয়ে আমি আর স্কুলে যাই নি।
কথাগুলো সোনার পর নিজেকে একটু সামলে নিয়ে পুনরায় প্রশ্ন করলাম
— আগে তো তোকে কোনোদিন দেখিনি
—-আমি তো আগে মোহনপুরের ওই মোড়ে থাকতাম। ভাল বিক্রি হত না। কাল থেকে এই মোড়টা ধরেছি। এখানে যে বাদাম বেচে ওই হারেন কাকা খুব বজ্জাত। আমাকে বলেছে এই মোড়ে তুই কেন এলি? নিজের জায়গায় না গেলে তোকে মেরে পাঠাবো।
—–তুই কি বলেছিস?
—– আমি বলেছি যা খুশি করো, যাব না, এটা তোমার বাবার জায়গা নাকি? এই শুনে লোকটার খুব রাগ।
তারপর একটু মাথার ঘাম মুছে ছেলেটি বলল
—-বাবু, আপনি কিছু নেবেন? আজ সেরকম বিক্রি করার খদ্দের পেলাম না। গরমে সবাই পেপসি কিনে খাচ্ছে। লজেন্স, বাদাম কেউ কিনছে না। আপনি নেবেন একটা? যা নেবেন সবই পাঁচ টাকা করে।
কথাগুলো শুনতে শুনতে কেমন যেন আনমনা হয়ে পড়েছিলাম। বুকের ভেতরটা একটু মোচড় দিয়ে উঠল। প্রশ্ন করলাম
—-হ্যাঁ, নেব নেব। তুই আমাকে দুই প্যাকেট বাদাম আর তিন প্যাকেট লজেন্স দে।
—- এখুনি দিচ্ছি। লজেন্স গুলো খেয়ে দেখবেন খুব ভাল খেতে।
তারপর ছেলেটি হাতের প্যাঁচানো তার থেকে দুই প্যাকেট বাদাম আর তিন প্যাকেট লজেন্স ছিঁড়ে আমার দিকে বাড়িয়ে দিল।
আমি একটা লজেন্সের প্যাকেট থেকে দুটি লজেন্স বের করে বললাম
—–একটু হাঁ কর তো দেখি।
——না না বাবু, আপনি কিনেছেন আমাকে দেবেন কেন?
আমি বললাম
—-আমি দিচ্ছি তুই খেয়ে নে।
ছেলেটি মুখ বাড়িয়ে দিল, তারপর লজেন্স দুটো মুখে পুরে দিতেই সঙ্গে সঙ্গে চিবোতে লাগল।
—–দারুন খেতে বাবু, আপনি খেয়ে দেখুন।
—–আচ্ছা খাচ্ছি।
বুঝলাম আজ মনে হয় ছেলেটি পেট ভরে ভাত খায় নি, কিংবা হয়ত কিছু না খেয়েই আছে।
—বাবু তাড়াতাড়ি করুন পরের বাস এখুনি ঢুকবে।
আমি মোট পঁচিশ টাকা ছেলেটিকে দিতে ও টাকাটা নিয়ে তাড়াতাড়ি নেমে গেল। সাথে বলতে বলতে গেল, “বাদাম, বাদাম আছে; লজেন্স, সল্টেস লজেন্স হবে”
মনে মনে ভাবলাম এইটুকু বয়েসে ছেলেটি কতটা অভিজ্ঞ হয়ে গেছে। জীবনে বেঁচে থাকার তাগিদে ও সবকিছু শিখে গেছে। জানালা দিয়ে দেখলাম ছেলেটি বাস থেকে নেমে সামনের একটি চায়ের দোকানের জাগ থেকে একটু জল খেয়ে নিয়ে পকেট থেকে একটা ময়লা রুমাল বের করে মাথার ঘাম মুছল। তার জড়ানো লজেন্স আর বাদামগুলো দোকানের বেঞ্চে রেখে ছেলেটি মাটিতে বসল।
এবার বেঞ্চে ঘাড়টা হেলান দিয়ে একটু ঝিমোতে শুরু করল। চোখে ঘুম ঘুম ভাব। তারপর হটাৎ পিছন থেকে একটা বাস হর্ন দিতেই ছেলেটি ধড়পড় করে উঠে দাঁড়াল। হাতের মধ্যে তারটা জড়িয়ে নিয়ে দ্রুত দৌড়াতে শুরু করল। এদিকে পিছনের বাসটা আসতেই আমাদের বাসটা ছেড়ে যাওয়ার জন্য স্টার্ট দিল। জানালা দিয়ে ছেলেটিকে যতখানি লক্ষ্য করা যায় সেটা করলাম। দেখলাম পিছনের বাসটি থামতে না থামতেই ছেলেটি এদিক ওদিক ছুটে বেড়াচ্ছে। কখনো বাসের ছাদ লক্ষ্য করে বা কখনো বাসের ভেতর লক্ষ্য করে চিৎকার করে বলে যাচ্ছে,”বাদাম, বাদাম, লজেন্স…
গাড়ি ছুটতে শুরু করল। ছেলেটি ক্রমে মিলিয়ে গেল দূর আকাশের নিচে। আমি জানালা থেকে মুখ সরিয়ে ব্যাগ থেকে বোতলটা বের করে দুই ঢোক জল পান করলাম। তারপর রুমাল দিয়ে মুখটা মুছে বাসের সিটে হেলান দিয়ে চোখ বুঝলাম। ভাবতে লাগলাম কোন সমাজে, কোন দেশে বাস করছি আমরা? চলন্ত বাসের মত আমাদের উন্নয়নশীল দেশও এগিয়ে চলেছে সামনের দিকে।
শিক্ষাখাতে বিপুল ব্যায়। দেশের তৈরি যান পৌঁছে যাচ্ছে মঙ্গলে, কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে তৈরি হচ্ছে রাস্তাঘাট, শপিং মল। অনেক সরকারি টাকাপয়সা ব্যয় হচ্ছে বিভিন্ন উন্নয়নমূলক খাতে, শিশুশ্রম বন্ধ করার জন্য বিস্তর আইন তৈরি হচ্ছে দেশে, তবুও ছোটনের মত ছেলেদেরকে এখনো রাস্তায় রাস্তায় বাদাম বিক্রি করতে হচ্ছে। শুধু দেশ বা সরকারকে দোষ দিয়ে তো লাভ নেই, আমরাই বা কম দোষী নাকি।
আমি যখন summer vacation এ বাড়িতে দুপুর বেলায় ac ঘরে ঘুম দেব তখন ছোটন ঘর্মাক্ত গায়ে ছুটে বেড়াবে রাস্তার এপার ওপার। কোন এক রোম্যান্টিক রাতে প্রেমিকার সাথে ঝাঁ চকচকে রেস্তোরাঁতে বসে ডিনার করবো তখন হয়ত ছোটন আধপেটা খেয়ে ঘুমিয়ে পড়বে। শপিং মলে গিয়ে নিত্য নতুন প্যান্ট কিনবো আর ছোটনের সেই ছেঁড়া হাফ প্যান্ট তার মা বসে বসে সেলাই করবে। প্রতি মাসে 500 টাকার নেট রিচার্জ করে যখন সোশ্যাল মিডিয়াতে জ্ঞান ফলবো তখন ছেলেটি মায়ের চিকিৎসার জন্য একটি একটি করে পয়সা জমিয়ে যাবে।
আর ছুটির দিনে এলার্ম ঘড়ি বন্ধ করে যখন আবার পাশ ফিরে ঘুমিয়ে পড়ব ঠিক তখনই বিনা এলার্মে ছোটন উঠে গিয়ে দ্রুত তার বাদাম আর লজেন্স এর পাকেটগুলো নিয়ে বেরিয়ে পড়বে মোহনপুর বাসস্ট্যান্ডের দিকে। স্কুলে পড়া ছেলেগুলো যখন টিফিনে আয়েস করে আইসক্রিম খাবে ঠিক সেই সময় ছোটন পেপসিওয়ালার দিকে লোলুপ দৃষ্টিতে চেয়ে থাকবে। এসব কিছু ভাবতে ভাবতে আমার চোখে একটু তন্দ্রা ভাব এল। তীব্র গতিতে পিচ রাস্তার উপর দিয়ে বাস এগিয়ে চলেছে। ইঞ্জিন আর বাসের ঝাঁকানির শব্দের মাঝেও আমি তখনও স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছিলাম কেউ যেন আমার কানের কাছে এসে বলে চলেছে বাদাম, বাদাম…. লজেন্স, সল্টেস লজেন্স….
সমাপ্ত