মুক্তির স্বাদ

মুক্তির স্বাদ

কিছু বুঝে ওঠার আগেই মা বাবা আমার বিয়ে দিয়ে দিয়েছিলেন । আমি সবে মাত্র এস.এস.সি. পরীক্ষা দিয়েছি । লম্বা ছুটি কীভাবে কাটাবো তার প্ল্যান করছি । এরই মাঝে হঠাৎ শুনি কাল আমার বিয়ে । আমার ছোট ভাই বোন কান্না শুরু করলো । অথচ আমার মনে মনে খুব আনন্দ হচ্ছিল তখন । কিশোর বয়সটা পার করে তারুণ্যের দোলা প্রায় লাগলো বলে । তাই বুঝি আমারও খুব শিহরণ লাগছিলো ।

এই তড়িঘড়ির বিয়ের একটা কারণ ছিলো অবশ্য । আমার ছোটবেলা থেকেই আমি বুঝে গিয়েছিলাম, আমি ভীষণ সুন্দরী । স্কুল হোক, কোনো অনুষ্ঠান কিংবা বন্ধুদের খেলার মাঝে আমাকে যেন একটু আলাদাভাবে দেখা হতো । একটু বাড়তি খাতির । একটু ছোঁয়াছুঁয়ি, যেটা বয়স বাড়ার সাথে সাথে কেবল বাড়ছিলোই । শুরু শুরুতে বিষয়টা উপভোগ করলেও পরে সেটাই যন্ত্রণার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল । মা বিপদগুলো টের পাচ্ছিলেন । আমার বাড়ির বাইরে বেড়োনো কমে গেলো । কোনো বন্ধুর জন্মদিন বা দল বেঁধে কোথাও বেড়াতে যাওয়া, এগুলো আমার জন্য বন্ধ হয়ে গেলো । খুব মন খারাপ হতো । কান্না গুলো গলার কাছে দলা পাকিয়ে উঠতো । খুব অভিমান হতো মা’র ওপর । অথচ এখন বুঝি, মা আসলে হায়নার ছোবল থেকে বাঁচানোর জন্যই ঐ কাজগুলো করতেন ।

তখন নিজের এই সুন্দর চেহারা নিয়েও খুব রাগ হতো । কী হতো আর একটু কম সুন্দর হলে ? বন্ধুরাও অনেকে হিংসা করে । রাগ করে আমার ওপর । অথচ নিজের চেহারার পেছনে আমার তো কোনো হাত নেই । আমি নিজেও তো চাই এই সৌন্দর্য্য কমে যাক । আমিও জীবনটা উপভোগ করি ।

সে কারনেই বিয়ের কথায় আমি সাথে সাথে রাজি । মনে হলো, এই তো মুক্তি মিলবে এবার । আর ধুঁকে ধুঁকে বাঁচতে হবে না । আর কোনো লোভীর হাত হুট করে ছুঁয়ে দিতে পারবে না আমায় । মনে মনে নিজেকে বউয়ের বেশে সাজিয়ে নিচ্ছি । কতো কল্পনা, কতো পরিকল্পনা শুরু করে দিলাম এর মাঝেই । বরের নাম শুনলাম নির্ঝর । বাবার বন্ধুর ছেলে । বাড়ির সবাই ছেলেকে দেখেছে । ছেলেকে সবার ভীষণ পছন্দ । আর আমি তো নাম শুনেই মুগ্ধ হয়ে গেলাম । যার নামটাই এতো সুন্দর, সেই মানুষটা না জানি কতোটা চমৎকার হয়!

বিয়ের পর আমি আমাদের বাড়িতেই থাকবো । অনার্সের শেষ দিকে শ্বশুরবাড়ি যাবো । এই প্রস্তাবটাও ওদের বাড়ি থেকেই আসলো । আমিতো খুশিতে আত্মহারা । বরও পাবো আবার মা বাবার সাথেও থাকতে পারবো, এর চেয়ে আনন্দের আর কিছু হতে পারে জীবনে ?

তেমন ঘটা করে নয়, একটু নিরালাতেই বিয়ে হয়ে গেলো আমার । বিয়েটা তো তখন বাল্য বিবাহের পর্যায়েই পড়ে । আমার চেয়ে বেশী ওজনের বেনারসি গায়ে জড়িয়ে বউ সেজে বসে আছি অথচ বিয়ের কোনো অনুভূতি হচ্ছে না । সুটকেস খুলে বার বার নাড়াচাড়া করছি, এত্তো এত্তো সব কসমেটিকস আর শাড়ি, জামা । সব আমার! সব!

ছবি তোলার জন্য একবার মিলার কাছে মেরুন রঙের লিপস্টিক চেয়েছিলাম । ও লিপস্টিকটা আমাকে ধরতে পর্যন্ত দেয়নি । নিজের হাতে আমার ঠোঁটে লাগিয়ে সাথে সাথে ব্যাগে রেখে দিয়েছিলো । সকাল হলেই আগে ওকে আসতে বলবো । ওকে দেখাবো, আমিও এখন বিশাল বড় এই মেকআপ বক্সটার মালিক ।

মা খুব কাঁদছিলো বিয়ে পড়ানোর সময় । বাবার মুখটাও কেমন থমথমে । আমার মামাতো,খালাতো বোনেরা খুব বকছিলো আমাকে এই বলে – তুই এতো বেহায়া কেন রে ? চোখ দিয়ে এক ফোঁটা পানিও পড়লো না তোর ? এতোটা বিয়ে পাগলা তুই ?

আচ্ছা জোর করে কী কাঁদা যায় ? আমার মনে তো তখন খুশীর জোয়ার বইছে । অথচ তখন কী বুঝেছিলাম, কতোটা কান্না জমা হয়ে আছে হিসেবের খাতায় ?

বিয়ে পড়ানোর পর নির্ঝর যখন এসে বসলো আমার পাশে, সেই প্রথম কেমন একটা শিহরণ জাগলো মনে । ওর হাতটা যখন আমার হাতের ওপর রাখলো, মনে হলো শরীরে একটা ঝাঁকুনি লাগলো । সেই প্রথম মনে হলো, বিয়ে হয়েছে আমার । এতক্ষণ বক বক করতে থাকা সেই আমি হঠাৎ যেন নির্বাক হয়ে গেলাম । কী এক লজ্জায় চোখ তুলে তাকাতেই পারছিলাম না ওর দিকে । অথচ চোখ, মন সবাই চাইছে ওকে দেখতে ।

নিজের ভেতরে এমন পরিবর্তন দেখে নিজেই হতবাক হয়ে গেলাম । এ কেমন অনুভূতি! এতো ভালো লাগছে কিন্তু মুখ ফুটে বলতে পারছি না । ভাই বোন, আত্মীয়স্বজন সবাই ঘিরে আছে আমাদের অথচ আমার কেবলই মনে হচ্ছে, এই না দেখা মানুষটা, যে একটু আগে আমার হাতটা ছুঁয়ে ছিলো, এর চেয়ে আপন আর কেউ নেই । বার বার মনে হচ্ছিল ও আর একবার আমার হাতটা ধরুক । আর একবার সেই অনুভূতিতে আমি ভেসে যাই ।

তা আর হলো না । খাওয়াদাওয়া, হৈহল্লা সবকিছুর শেষে এবার যাবার পালা । সবাই চলে যাচ্ছে সাথে নির্ঝরও । যাওয়ার আগে আর একবার আমার পাশে এসে বসলো ও । আলতো করে কাঁধে হাত রেখে বলেছিলো –

কাল কথা হবে, এখন যাই কেমন । কিছু তো বল । একটা কথাও তো বললে না তুমি । আমার দিকে তাকালেও না একবারও । কাকে বিয়ে করলে, একবার তো চোখ তুলে তাকাও ।

ইশ,, কী সুন্দর করে কথা বলছে । এতো ভালো লাগছে শুনতে । মন চাইছে ওর কথা চলুক সারারাত আর আমি তন্ময় হয়ে শুনি । আজ আমার কী হলো ? গলা দিয়ে একটা শব্দও বের হচ্ছে না । ঘাড়টা কে যেন চেপে ধরেছে যে একবারও মাথা উঁচু করতে পর্যন্ত পারলাম না । চলে গেলো নির্ঝর ।

আমার শ্বশুর, যিনি এতোদিন আমার নাঈম চাচা ছিলেন, তাঁর আগ্রহেই আসলে আমাদের বিয়েটা হয়েছিলো । তিনি আমাকে ভীষণ আদর করতেন । আর আমার শ্বাশুড়ি মা, তাঁকে আমি বিয়ের দিনই প্রথম দেখলাম । একবার মাত্র চোখাচোখি হয়েছিলো ওনার সঙ্গে, মনে হলো কোনো কারণে খুব রেগে আছেন ।

পরদিন ভোর থেকে অপেক্ষায় আছি ফোনের । অকারণে ফোনের পাশ দিয়ে ঘোরাঘুরি করছি । সেই ফোন আসলো বেলা বারোটায় । আমি তো কী বলবো না বলবো কিছুই বুঝতে পারছি না । শুধু শুনছি । নির্ঝর বলছে ওর কথা । আমাকে কিছু জিজ্ঞেস করলে হ্যা – না’র মধ্যেই কথা চালাচ্ছি । ফোন রাখার আগে নির্ঝর বলল, বিকেলে আসব আজ । তারপর থেকে উত্তেজনা চরমে । এতোটা অপেক্ষা আর কোনো বিকেলের জন্য করিনি আমি ।

সেই বিকেলে শুরু হয়েছিলো ভালো লাগার নতুন অধ্যায়ের । ঐদিনই প্রথম ভালোভাবে দেখেছিলাম ওকে । ধীরে ধীরে জড়তা কাটছিলো আমার । নির্ঝরের কারণেই খুব দ্রুত সহজ হয়েছিলো সম্পর্কটা আমাদের । ও যেন একদম বন্ধুর মতো হয়ে গেলো আমার । আমাদের বাড়ির সকলেও খুব দ্রুতই আপন করে নিলো ওকে ।

আমরা দুজন খুব বেড়াতাম । এই শহরের যতো খোলা প্রান্তর, যতো বেড়ানোর জায়গা তার সবগুলোতেই ঘুরে বেড়াতাম আমরা । মা’র ওপর জমে থাকা অভিমানগুলো তখন শেষ হয়ে গেলো । রাস্তার ধারে ফুচকা খাওয়া, থিয়েটারে নাটক দেখা, ঝুম বৃষ্টিতে হুড খোলা রিক্সায় বেড়ানো । সে যে কী আনন্দ বলে বোঝানো যাবে না । আনন্দ যেন উপচে পড়তে লাগলো ।

এর মাঝে রেজাল্ট বের হলো । কলেজে ভর্তি হলাম । নির্ঝরও তখন অনার্স ফাইনাল দেবে । ও সবসময় বাসায় আসে কিন্তু কখনোই আমাকে বলে না ওদের বাসায় যাওয়ার কথা । আমার শ্বশুর মাঝে মধ্যেই চলে আসেন । ফোন করে আমার লেখাপড়ার খোঁজ নেন । আমার শ্বাশুড়ি বিয়ের পর আর কখনো আসলেন না আমাদের বাসায় । মা দুদিন ফোন করেছিলো কিন্তু কথা হয়নি । উনি কোনো কাজে ভীষণ ব্যস্ত ছিলেন । নির্ঝরের কাছে জানতে চাওয়ায় ও বলেছিলো – মা সোস্যাল ওয়ার্ক করেন তো তাই খুব ব্যস্ত থাকেন ।

কম লেখাপড়া, বেশী ঘুরে বেড়ানো এই নিয়ে চলছিলো জীবন । তখনকার জীবনটা ছিলো প্রেমিক- প্রেমিকার মতো । কেউ প্রেম করে বিয়ে করে, কেউ বিয়ের পর প্রেম । আমাদের চলছিলো বিবাহ পরবর্তী প্রেম । জীবন বুঝি এতোটাও সুন্দর হয়! এতো আবেগ, এতো ভালবাসা আমার মতো ছোট মানুষ যেন সামাল দিতে হিমসিম খাচ্ছিলো ।

হঠাৎ একদিন শ্বাশুড়ি ফোন করলেন । দু মিনিট মাত্র কথা বলেছিলেন বাবার সাথে । তিনি বললেন – ছেলেমেয়ে লেখাপড়া বাদ দিয়ে এতো বেশী ঘোরাঘুরি করছে যে দুজনের রেজাল্টই খারাপ হবে । তাই আগামী মাসেই অনুষ্ঠান করে আপনার মেয়েকে নিয়ে আসবো আমার এখানে ।

কিন্তু আপা, আমার মেয়েটা এখনো অনেক ছোট । অন্তত অনার্সটা পড়া শুরু করুক । সেরকমই কথা হয়েছিলো বিয়ের সময় । নির্ঝরের বাবা যাবে আপনার ওখানে । কথা বলে ডেট ঠিক করে নেবেন । আপনার মেয়ে যেন অনার্স পড়তে পারে সেই ব্যবস্থাই করছি ।

তিনি এমনভাবে কথাগুলো বলেছিলেন, ঠিক যেন হুকুম ছিলো । অনুরোধ তো মোটেও ছিলো না । ওনার ওটুকু কথায় বাবা হয়ত বুঝে গিয়েছিলেন, এরপর আর কথা বাড়িয়ে লাভ নেই । নাঈম চাচা সেদিন সন্ধ্যায়ই এলেন বাসায় । শ্বাশুড়ি মা ডেট ঠিক করেই দিয়েছিলেন । ঐদিনই অনুষ্ঠান হবে ঠিক হলো ।

আমার খুব মন খারাপ হয়ে গেলো । ভেতর থেকে কেউ একজন যেন বলে উঠছিলো, অনেক আনন্দ করা হয়েছে এবার তৈরী হও পরবর্তী অধ্যায়ের জন্য ।

কেমন ভয়ের একটা অনুভতি হচ্ছে ভেতরে ভেতরে । এই যে নির্ঝরের সাথে সারাক্ষণ থাকতে চাওয়ার ইচ্ছা যেটা এখন পূরণ হওয়ার পথে কিন্তু কেন জানি কোনো আনন্দ হলো না । অজানা একটা ভয় মনটাকে খারাপ করে দিচ্ছে বার বার ।

যাই হোক এই একটা মাস খুব দ্রুত কেটে গেলো । লেখাপড়া, বিয়ের কেনাকাটা, ঘুরে বেড়ানো সব কিছু মিলে দারুণ কাটলো সময়টা । সে কারনেই অজানা ভয়টাও চাপা পড়ে গেলো মনের গহীনে । খুব আয়োজন করেই সব কটা অনুষ্ঠান করা হলো । বিদায় নিলাম বাবার বাড়ি থেকে, আমার এতো বছরের ঠিকানা পাল্টে গেলো । নির্ঝরের সাথে চললাম নতুন ঠিকানায় । পেছনে পড়ে রইল আমার আজন্মের সব স্মৃতিরা, মা, ভাইবোনের কান্না আর বাবার অসহায় চাহুনী ।

এসে পড়লাম নতুন এক পরিবেশে । আমার চিরচেনা পরিবেশ থেকে একদম আলাদা । কেমন যেন দমবন্ধ করা অবস্থা । এখানে সবাই যার যার মতো ব্যস্ত, পারমিশন ছাড়া কেউ কারো রুমে ঢোকে না, অকারনে কেউ ঘুরে বেড়ায় না । সবকিছু চলে ঘড়ির কাঁটায় । এগুলো বুঝতে আমার একটু সময় লেগেছিলো । পরদিন সকালে আমি যখন রুম থেকে বের হলাম, নির্ঝর তখনো ঘুমিয়ে । আমি ঘুরে ঘুরে সব দেখছি । বিশাল বাড়ি । এতো এতো রুম, কোনটা কার কে জানে? কী সুন্দর করে সব কিছু সাজানো ! কোথাও কোনো শব্দ নেই । সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতে যাবো ঠিক তখনই দেখা হলো শ্বাশুড়ির সাথে । গতকালও তিনি আমার সাথে একটাও কথা বলেননি । আমাকে দেখে থমকে দাঁড়ালেন যেন । বললেন – তুমি এখানে কী করছো ?

জ্বী, ঘুম ভেঙে গেলো তো । তাই এভাবে যখন তখন ঘুরে বেড়াবে না । ব্রেকফাস্টের সময় খবর দেয়া হবে । আর হ্যাঁ, একা কোথাও যেতে পারবে না । ড্রাইভার আছে, যেখানে যাবে গাড়িতে যাবে । আর যেখানে সেখানে যাবেই বা কেন ? কলেজ ছাড়া তো আর কোথাও যাওয়ার প্রয়োজন নেই । জ্বী । আর এ বাড়ির কিছু নিয়ম কানুন আছে । আসমা সব বলে দেবে । এতোদিন যা তা ভাবে চলেছো বলে এখনো যা খুশী তাই করা যাবে না । আসমা টা কে বুঝলাম না ।জিজ্ঞেস করতে সাহস হলো না । শুধু বললাম, আপনি চা খাবেন মা ? চা বানাবো ? এখানে সব কাজের জন্য লোক আছে । রান্নার কাজের বাবুর্চি আছে । নিজের রুমে যাও । কোনো কিছুতে হাত দেবে না ।

মন খারাপ করে রুমে চলে আসলাম । উনি এখনো খুব রেগে আছেন । কেন? কার ওপর? কিছুই বুঝলাম না । বাড়ির কথা খুব মনে পড়ছে । কান্না আসছে ভীষণ । কিছুই করার নেই । নিজের জিনিষপত্রগুলো সব দেখছি আর নির্ঝরের ওঠার অপেক্ষায় আছি । নির্ঝর উঠলো ন’টায় । এ যেন এক নতুন মানুষ ! একটু আগে মা যেগুলো বলে গেলেন তারই প্রতিফলন দেখতে পেলাম । সব কাজ ঘড়ির কাঁটায় । সেও যেন একটু ভয়েই আছে । এতোদিনের চেনা, প্রানখোলা সেই মানুষটা কেমন যেন জড়সড় ।

সকালে নাস্তার টেবিলে সেদিন বুঝেছিলাম, এ বাড়িতে আমার শ্বাশুড়ির কথাই শেষ কথা । ওনার প্রবল ব্যক্তিত্বের কাছে সবাই নতজানু । আর তিনি সবার সাথে ভালো করে কথা বললেও কেবল আমার বেলাতেই কেমন রুক্ষ হয়ে যাচ্ছিলেন । কিছুই বুঝতে পারছি না । কী ছিলো আমার দোষ?

প্রতিদিন নাস্তার পরই সবাই বেরিয়ে যেতো যার যার কাজে । আমার শ্বাশুড়ি নির্ঝরকে সাথে নিয়ে বের হতেন । আমার তখন কলেজ বন্ধ । বাবার বাড়ি যাওয়ার পারমিশন নেই । রুম থেকে বের হতে পারিনা ভয়ে । আমার রুমের সাথে এক চিলতে বারান্দায় ঘুরেফিরে যাওয়া আসা করি বার বার । আর আসমা খালা আসেন মাঝে মাঝে । তিনি এ বাড়িতে আছেন বিশ বছর ধরে । একমাত্র তাঁর সাথে কথা বলেই আমি শান্তি পাই । আসমা খালাকেই জিজ্ঞেস করলাম একদিন –

আচ্ছা খালা বলেন তো মা সবসময় এতো রেগে থাকেন কেন আমার ওপর? কই নাতো । রাগ করবে কেন ? কিন্তু আমার তো তাই মনেহয় । আপার তো এমনিতেই একটু বেশী রাগ । না, কিন্তু আমাকে দেখলে মনেহয় আরো রেগে যান । আসমা খালা প্রথমে বলতে চান না । কথার ফাঁকে কোনো এক সময় বলে ফেলেন, এই বিয়েতে মা একদম রাজি ছিলেন না । উনি তার বান্ধবীর মেয়েকে পছন্দ করেছিলেন ছেলের সাথে বিয়ে দেবেন বলে । শুধুমাত্র বাবার জেদের কারনে তিনি রাজি হয়েছেন । সে কারণেই তিনি আমাকে সহ্য করতে পারেন না ।

আমাদের বাইরে বেড়ানো একদম বন্ধ হয়ে গেলো । নির্ঝরের অনার্স পরীক্ষা শেষ । ও প্রতিদিন মা’র সাথে সকালে বেরিয়ে যায় । ব্যবসার কাজগুলো শিখে নিচ্ছে । মা’র অফিস, বাবা’র অফিস সব শেষ করে তাঁদের সাথে ফেরে সন্ধ্যার পর । আমার কলেজ খুললো ছুটি শেষে । আবার শুরু করলাম কলেজে যাওয়া । যেন প্রাণ ফিরে পেলাম আবার । মনে মনে ভেবে রেখেছিলাম, কলেজ যাওয়া আসার ফাঁকে একবার বাড়িতে দেখা করে যাবো সবার সাথে । কতোদিন দেখিনা সবাইকে কিন্তু সেই সুযোগ হয় না । কলেজ গেটে ড্রাইভার দাঁড়ানো থাকে । তাকে বলেও কোনো লাভ হয় না । জানিয়ে দেয়, পারমিশন নাই ।

ছুটির দিনগুলোর অপেক্ষায় থাকি । নির্ঝর নিশ্চয়ই আমাকে নিয়ে আবার বেড়াতে যাবে । তা আর হয় না । সেদিনও কোনো কাজ দিয়ে ওকে ব্যস্ত রাখা হয় । আমি যেন হাঁপিয়ে উঠি । বাবা মাকে না দেখে এতোদিন থাকা অসহ্য লাগে যেন । অনেক কষ্টে রাজি করিয়ে বাড়িতে আসলাম পুরো চার মাস পর । খুব রাগ করি সবার সাথে, একবারও কেন দেখতে গেলো মা আমাকে । ছোট ভাই চিৎকার করে বলে ওঠে – আপু আমরা গিয়েছিলাম তো তিন দিন । তুমি তো একদিনও ছিলে না বাসায় ।

মা’র দিকে জিজ্ঞাসার চোখ নিয়ে তাকাই । মা, তোমার সাথে আমার রোজ কথা হয় । কই তুমি তো একদিনও বলোনি আমাকে একথা ! বলতে একদম ভুলে গেছি রে । মা’র মিথ্যে বলা নিমিষেই বুঝে যাই । মা যখন মিথ্যে বলে, চোখের দিকে তাকাতে পারে না । মা বোধহয় আঁচ করতে পেরেছে আমার শ্বশুরবাড়ির অবস্থা । তাই আমাকে আর জানায়নি কথাটা । জানলে তো আমি শুধু কষ্টই পাবো ।

দিন দিন ও বাড়িতে থাকা যেন অসম্ভব হয়ে যাচ্ছিল । নির্ঝর কোনো এক কারণে আগের মতো কথা বলে না । রুমে ঢুকেই মোবাইল নিয়ে ব্যস্ত হয়ে যায় । কারণটা জানতে চাইলাম সেদিন – আচ্ছা তোমার কী হয়েছে বলতো ? আগে তো তুমি এমন ছিলে না । কিছু না, এমনি । কিছু ভালো লাগে না ।

সেটাই বলছি । কেন ভালো লাগেনা বলবে আমাকে ? আমতা আমতা করেও শেষ পর্যন্ত নির্ঝর বলে ফেলে কথাটা, নীলিমা, বিয়ের আগে তুমি কী অনেক ছেলেদের সাথে ঘুরে বেড়িয়েছো ? মানে কী? এগুলো কী ধরনের কথা ? আমি কিছু কথা শুনেছি । তোমার অনেক ডিমান্ড ছিলো । অনেক কাড়াকাড়ি চলতো তোমার এলাকায় তোমাকে নিয়ে। তুমি খুব এনজয় করতে বিষয়গুলো ।

তুমি কী বল এইসব ! কে বলেছে তোমাকে এগুলো ? যেই বলুক, মিথ্যে বলেছে ? শোনো নির্ঝর, আমার মা আমাকে অনেক যত্ন করে, অনেক আড়াল দিয়ে বড় করেছে । আমাকে অনেকে অনেকভাবে বিরক্ত করেছে কিন্তু তাতে আমার তো কোনো দোষ নেই । কী জানি । কথাগুলো শুনে ভালো লাগলো না আমার । কে বলেছে বল ? কাছে এসে নির্ঝরের গলাটা জড়িয়ে ধরি । ও আস্তে করে হাতটা সরিয়ে দেয় ।

কেউ বলেনি । বাদ দাও । শুয়ে পরো । সকালে কলেজ আছে । আর শোনো, কলেজ থেকে সোজা বাসায় আসো তো? কেউ আবার কলেজ মোড়ে অপেক্ষায় থাকে না তো তোমার জন্য? কী বলে এইসব ! ভয়ে বুকটা কাঁপতে থাকে । কী হলো ওর কিছুই বুঝতে পারিনা আমি । ঘুমের ভান করে পড়ে থাকি, ঘুম আসে না । আগের দিনগুলোর কথা মনে হয় । সেই মানুষটার সাথে আজকের এর কোনো মিল নেই । কেন এমন হলো ? খুব ইচ্ছে করে ওকে একটু জড়িয়ে ধরি । যদি আবার দুরে ঠেলে দেয় এই ভয়ে আর কাছে যাই না । সবার সাথে শুধু খাবার টেবিলেই দেখা হয় । কেউ আমার সাথে তেমন কোনো কথা বলেল না । আব্বা শুধু খোঁজ খবর রাখেন । তাঁর আদরটাই কেবল আগের মতো আছে । লেখাপড়ার খোঁজ খবর নেন ।

একদিন কলেজ শেষে বেরিয়েই দেখি মাহি ভাই দাঁড়ানো । মাহি আমার খালাতো ভাই । মা আমার জন্য একটা ড্রেস আর কিছু খাবার পাঠিয়েছেন । ভাইয়াকে দেখে খুব ভালো লেগেছিল । কতোদিন আপন কাউকে দেখিনা । টুকটাক কিছু কথার পর ভাইয়া চলে গেলো । আমিও ফিরে এলাম বাসায় । রাতে নির্ঝর ফিরলো অনেক দেরিতে । কোনো বন্ধুর পার্টি ছিলো ।দু’একটা কথার পরেই হঠাৎ বললো-আজ কলেজ গেটে কে এসেছিলো? তোমার কয় নাম্বার প্রেমিক ?

কষ্ট আর অভিমানে ভেতরটা নীল হয়ে গেলো যেন । তবুও হাসিমুখে বললাম, ওতো মাহি ভাই । তোমার সাথে তো পরিচয় আছেই । এইসব প্রেমিক ভাই আমি অনেক দেখেছি । তো লুকিয়ে লুকিয়ে কী দিয়ে গেলো? তুমি এভাবে কথা বলছো কেন আমার সাথে? আমার দোষটা কোথায় ? শোনো তোমার দোষ হলো, তুমি সুন্দরী । সুন্দরীদের চরিত্র ঠিক থাকে না । তোমার কী মাথাটা খারাপ হলো? কী বলো এইসব ? মাথাটা আগে খারাপ ছিলো । তাই বাবার কথায় বোকার মতো রাজি হয়েছিলাম । মা আসলে ঠিকই বলেছে, সুন্দরীদের চরিত্র ভালো থাকে না । ওরা সৌন্দর্য্য ভাঙিয়ে খায় ।

তুমি কী বলবে এই কথাগুলো আজ কেন বলছো ? প্রায় বছর হয়ে আসলো আমাদের সম্পর্কের । কী ভীষণ আনন্দে কেটেছে আমাদের এতোগুলো দিন । কোনো কারণ ছাড়া তুমি এভাবে আমাকে দোষ দিও না প্লিজ । তুমি বলতে চাও তুমি গন্ডা গন্ডা প্রেম করে বেড়াওনি? তাহলে এইসব চিঠি কেন আসে আমার অফিসে ? নির্ঝর কতোগুলো কাগজ ছুঁড়ে মারে আমার দিকে ।

কাগজগুলো হাতে নিয়ে চেয়ে থাকি । এতো নোংরা ভাষায় কেউ লিখতে পারে ! কী করব বুঝতে পারিনা । যতই বলি যে আমি জানিনা, চিনিনা এদের কারোকে, নির্ঝর আমার কথা বিশ্বাস করে না । দিন দিন সম্পর্কটা খারাপের দিকেই যাচ্ছে । মন খারাপ লাগলে মা’র সাথে কথা বলি কিন্তু মাকেও বলতে পারিনা কথাগুলো । মাঝে মাঝে আসমা খালার সাথে বলি । জানতে চাই কী করবো এখন? খালাও মন খারাপ করে । বলে-

মা গো এতো বড়লোকের ঘরে বিয়ে দেয়ার আগে তোমার বাবা মার চিন্তা করা দরকার ছিলো । তোমার শ্বাশুড়ি আগেই বলেছিলো, তোমাকে শান্তিতে থাকতে দিবে না । এখন আল্লাহর ওপর ভরসা রাখো আর অপেক্ষায় থাকো ভালো কিছু হওয়ার । তাহলে কী মা এইসব করাচ্ছে ? নির্ঝরকে জিজ্ঞেস করব খালা? আব্বাকে জানাবো ? এই কাজ ভুলেও কোরো না । তার কাজে কোনো খুঁত থাকে না মা । নির্ঝর বাবারে বললে তুমি আরো বিপদে পরবা । তারে বুঝাতে চেষ্টা কর ।

পালানোর পথ খুঁজি আমি । আমার ছোট মাথা থেকে আর কোনো বুদ্ধি আসে না । মনেহয় নিজ বাড়ি ফিরে যেয়ে লুকিয়ে থাকি । আর কোনোদিন আসবো না এখানে । সেদিন রাতেই যে এমন পরিস্থিতি হবে কে জানতো? একটু আগেই ফিরলো নির্ঝর । রুমে ঢুকেই আমার দিকে একটা ব্যাগ ছুঁড়ে দিলো । নে তোর আরেক প্রেমিকের গিফট এসেছে । তার সাথে কী কী করেছিলি তার রগরগে বর্ণনা দেয়া আছে । আমি আর সহ্য করতে পারি না । চিৎকার করে উঠি । আমি এসব কিছুই করিনি, কখনোই না । এইসব তোমার মা করাচ্ছে লোক দিয়ে । আসমা খালার নিষেধ সত্ত্বেও কথাটা বের হয়ে যায় মুখ ফসকে । কথাটা শুনে ও যেন পাগল হয়ে যায় ।

কী বললি তুই ? আমার মা ! তুই এখনো টিকে আছিস আমার মা’র কারণে । এই পার্সেলটা আমি মা’কে দেখাতেই মা বললো, সুন্দরীদের এধরনের অতীত থাকেই । এডজাস্ট করে নিতে হয় । আমার খুব ভুল হয়েছিলো মা’র কথা না শুনে বাবার কথায় বিয়েতে রাজি হওয়া । কথাগুলো বলেই ছুটে এসে আমার গলাটা চেপে ধরলো ও । নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিলো আমার। বাঁচার আকাঙ্ক্ষায় সর্বশক্তি দিয়ে ধাক্কা দিলাম ওকে ।

ঠিক করলাম শ্বাশুড়ির সাথে কথা বলবো । আমার আর ভয়ের কিছু নেই । নির্ঝরের মাথাটা পুরোই গেছে । ও আর একফোঁটাও বিশ্বাস করে না আমাকে । এভাবে বাঁচার কোনো মানেই হয় না । কোনো দোষ না করেও এতোদিন মুখ বুজে সহ্য করাটাই আমার অপরাধ হয়েছে । শ্বাশুড়ির ফেরার অপেক্ষা করতে থাকলাম ।

সেদিন আমার শ্বশুর আগে ফিরলেন । তাঁর সাথে আমার ছোটবেলা থেকেই পরিচয় । কথাগুলো প্রথমে ওনাকেই বললাম – আব্বা, নির্ঝর আমাকে কেমন এলোমেলো সব কথা বলছে । এমন কোনো কাজ তো আমি কখনো করিনি । ওনার সামনে গিফ্ট, চিঠি সবই রাখলাম ।

মা’রে তোকে তো ছোটবেলা থেকে দেখেছি কিন্তু কখনো তো বুঝিনি তুই এমন কিছুও করতে পারিস । তোর যদি মত না ই ছিলো তবে কেন রাজি হয়েছিলি বিয়েতে বলতো মা ? আব্বা আমি এমন কিছু করিনি সত্যি বলছি । আমি তোর চিঠিপত্রগুলো দেখেছি । কিছু বলার নেই রে মা । নির্ঝরের মায়ের কাছে ছোট হয়ে গেলাম রে আমি । এখন তার যা ডিসিশন, সেটাই আমার কথা । রুমে যা ।

চুপচাপ রুমে চলে এলাম । তার কিছুক্ষণ পরেই শ্বাশুড়ি এলেন । আসমা খালাকে দিয়ে ডেকে পাঠালেন আমাকে । তাঁর রুমে যেয়ে দাঁড়ালাম ওনার সামনে । ভয়ে গলা শুকিয়ে যাচ্ছে । কোনো কথাই বলতে পারছিলাম না । উনি নিজেই শুরু করেছিলেন কথা – কিছু বলতে চাও তুমি ? জ্বী, আমি এ কাজগুলো করিনি ।

আমি জানি তুমি করোনি । আবার করতেও পারো । কে জানে ? যাই হোক, শোনো, আমি নাঈমকে একটা শিক্ষা দিতে চেয়েছিলাম । আমার সংসারে আমার কথার পরে আর কোনো কথা থাকে না । আমি বুঝলাম না হঠাৎ নাঈমের মাথায় কী পোকা ঢুকলো আর আমার ছেলেটাকেও বশ করে ফেললো । তোমার মা-বাবার ও খুব ওড়ার শখ হয়েছিলো বোধহয় । নিজের অবস্থান ভুলে তারা অনেক বেশী উঁচুতে উঠতে চেয়েছিলেন । এই শিক্ষাটা তাদেরও দরকার ছিলো । তোমার বাবাকে বলে দিও, নিজের সীমানার বাইরে উড়তে গেলে এমনই মুখ থুবড়ে পরতে হয় ।

আমি চুপ করে দাঁড়িয়ে আছি । পাথরের মূর্তি যেন । তিনি বলেই চলেছেন । ড্রাইভার তোমাকে বাড়ি পৌঁছে দেবে । তোমার গার্ডিয়ান যেন কোনোরকম ঝামেলা করার চেষ্টা না করে । তাতে তারাই বিপদে পরবেন । আর শোনো নির্ঝরকে একদম বিরক্ত করবে না যাওয়ার সময় । তোমার জিনিষপত্র সব নিয়ে যাও । কিছু যেন না থাকে ।

আমি শুধু শুনেই গেলাম কথাগুলো । কিছুই বলতে পারলাম না । আসলে ঐ বয়সে আমি কী ই বা বলতে পারতাম? আমি তো মা’র ছায়া থেকেই বের হতে পারিনি তখনো । এতো কঠিন পৃথিবী মোকাবেলা করবো কী করে ? নিজের রুমে ফিরে এলাম । মাকে ফোন করে বললাম সব কথা । সবকিছু শুনে মা শুধু বললো – তোর মামাকে পাঠাচ্ছি, চলে আয় ।

না মা, কাউকে পাঠাতে হবে না । ড্রাইভার পৌঁছে দেবে । কথাই বলতে পারছিলাম না । কান্নার দমকে কথাগুলো সব কেমন শোনাচ্ছে । মা আমাকে বললো, চলে আয় । তোর বাড়ি, তোর রুম সবাই তোর জন্য অপেক্ষা করে আছে । এরই মাঝে আসমা খালা সব গুছিয়ে দিলেন । খালাও খুব কেঁদেছিলেন সেদিন । আসার সময় নির্ঝরকে কোথাও দেখলাম না । অন্যদেরও না । আসমা খালা সাথেই আসলেন । হয়ত তাকে এভাবেই বলা হয়েছে । গাড়িতে উঠে বসলাম । আশ্চর্য! গাড়িতে ওঠার সাথে সাথে মনটা ভালো হয়ে গেলো । আসমা খালা আমাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে চলে গেলেন ।

বাড়িতে এলাম । সবাই এমন ভান করছে যেন কিছুই হয়নি । যেন আমি কলেজ শেষ করে ফিরলাম মাত্র । আমার ছোট ভাইবোনগুলো এতো বড় হয়ে গেলো কোন ফাঁকে ! কী দারুণ অভিনয় ! সেদিন রাতে কারো আর ঘুমই হলো না । অনেকদিন পর সবাই মিলে প্রানখুলে হাসছে । তবে আমি ঠিকই দেখেছিলাম, মা আর বাবার চোখে পানি চিকচিক করছিলো । নির্ঝরের বাড়ি থেকে কাগজপত্র সব রেডি করে পাঠিয়েছিলো । একটা নির্দিষ্ট সময় পরে ডিভোর্স হয়ে গেলো আমাদের ।

আমি পুরোদমে লেখাপড়ার মধ্যে ঢুকে গেলাম । কলেজে যাই, বাসায় এসে মা’র কাজে কখনো সাহায্য করি, ভাইবোনের সাথে খুনসুটি, এভাবেই কেটে গেলো দিনগুলো । তীব্র জেদের কারণেই বোধহয়, এইচএসসি তে আমার খুব ভালো রেজাল্ট হয়েছিলো । সবাই খুব খুশী । নির্ঝরকে ভুলে গেছি একদম । সারাদিনে কখনো মনে পড়ে না । শুধু রাত গভীর হলে, সব যখন সুনসান তখন খুব অস্থির লাগে । দিনগুলো মনে পড়ে যায় । নির্ঝেরের হাসিমাখা মুখটা ভেসে ওঠে চোখের সামনে ।

এরপর আমি আমার পছন্দের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে গেলাম । এ যেন জীবনের আরো একটা নতুন দিক । কী বিশাল ক্যাম্পাস! লেখাপড়ার পাশাপাশি আরো কতো রকম কাজের সুযোগ । নিজেকে সবকিছুর মধ্যে চরম ব্যস্ত করে ফেললাম । নির্ঝরের স্মৃতি যেন ঝাপসা হয়ে আসছিলো আস্তে আস্তে । এমন সময়ই একদিন দেখা হয়ে গেলো ওর সাথে । আমার ক্যাম্পাসেই ওয়েট করছিলো । আমাকে দেখেই সামনে এসে দাঁড়ালো । বললো –

কেমন আছো নীলিমা? ভালো । তুমি কিন্তু আরো সুন্দর হয়েছো । হাসলাম একটু । মনে মনে বললাম,এই সুন্দরের কারণেই তো জীবনটা নষ্ট হতে বসেছিলো আমার । কিছু বলো ? আমি কেমন আছি জানতে চাইলে না তো ? আমি কিছু জানতে চাই না । তবে এটুকু চাই সবাই নিজের মতো ভালো থাকুক আর আমার পথে কেউ অপেক্ষা না করুক ।

নির্ঝর একটু হাসলো । কেমন মন খারাপের হাসি । আর কিছু বললো না । সরে দাঁড়ালো । আমি চলে এলাম । এরপরও আমি ওকে আমার ক্যাম্পাসে কয়েকবার দেখেছি । ও কিন্তু আমাকে দেখা দিতে চায়নি । একটু দুরে আড়াল করে দাঁড়িয়ে থাকতো ।

দেখতে দেখতে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনটাও শেষ হয়ে গেলো । এখানেও অনেক যন্ত্রণা, অগনিত প্রেমের প্রস্তাব সব পাশ কাটিয়ে দিনগুলো পার করলাম । এর মধ্যে বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব এসেছে ডজনখানেক । নতুন কোনো সম্পর্কে জড়ানোর মতো ইচ্ছে বা সাহস কোনোটাই আমার নেই এখন । মা এবার কোনো পাত্তাই দিলো না । তাঁর এক কথা – আগে আমার মেয়ে লেখাপড়া শেষ করবে তারপর অন্য কিছু ।

চাকরীতে জয়েন করলাম । মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি । আমার অফিস রুমটা আমার খুব পছন্দ হলো । অফিসের পাশেই একটা পার্ক আছে । আমার রুমের জানালা দিয়ে পার্কটা দেখা যায় । সবচেয়ে ভালো লাগে, বিকেলের সূর্যটা যখন হেলে পড়ে । গাছের পাতাগুলো ভীষণ সুন্দর দেখায় ।

অফিসের পরিবেশটা চমৎকার । কাজের ফাঁকে লাঞ্চ টাইমে দারুণ আড্ডা জমে । এই অফিসে এসে পেয়ে গেলাম আলমাস ভাইকে । বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার ডিপার্টমেন্টেই সিনিয়র ছিলেন তিনি । খুব জ্বালিয়েছেন সেই সময় । এমনিতে খুব ভালো মানুষ । ওকে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করি । লাভ হয় না । লাঞ্চ টাইমে দেখা যায় আমার জন্যেও খাবার অর্ডার করলেন । কাজ বুঝতে সাহায্য করেন সবসময় । ছুটির পর অহেতুক ডেস্ক গোছানোর ভান করেন । যদিও ওনার ডেস্কটা সবসময়ই গোছানো থাকে । আমি ওনার সামনে আসা মাত্র বলবেন – ওহ নীলিমা, একটু দাঁড়াও । আমার গোছানো শেষ, আমিও যাবো ।

রাগ রাগ চোখে তাকাই যে তোমার চালাকি আমি ধরে ফেলেছি । তখনই এতো সুন্দর একটা হাসি দেয় যে আর রাগ করতে পারি না । যেতে যেতে টুকটাক কথা হয় । আলমাস ভাই জানে আমার জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনাটা । আমিই বলেছিলাম । ভেবেছিলাম জানলে পিছিয়ে যাবে । বলে কোনো লাভই হয়নি । শুধু বলেছিলো -এটা কোনো ব্যাপারই না । এটুকুর জন্য তুমি জীবনকে বঞ্চিত করতে পারো না , আমাকেও না । আমি আসলে ভয় পাই । আমি আর কখনোই কোনো সম্পর্কে জড়াতে চাই না । চাওয়া তোমার লাগবেই । আমি কী শেষ পর্যন্ত বুড়া বয়সে ব্যাচেলর হয়ে মরবো নাকি ! কী বলেন সব অদ্ভুত কথা ! আপনার জন্য কতো মেয়ে অপেক্ষায় ছিলো ক্যাম্পাসে, জানি তো । তাদের অনেকেই এখনো অপেক্ষায় আছে । আর আমি অপেক্ষায় আছি তোমার । থাকবো শেষ পর্যন্ত ।

আমি হাঁটা দেই আমার গন্তব্যে । আলমাস ভাই তখনো দাঁড়িয়ে থাকে । বুঝতে পারি এই বান্দা সহজে সরবে না । আমিও কী মনে মনে দূর্বল হয়ে যাচ্ছি তার প্রতি ? তার অকারন কথাবার্তা শুনতেও কেমন যেন ভালো লাগে এখন । আমি বুঝতে পারিনা কী করা উচিৎ আমার । আবার নতুন কোনো সম্পর্ক, আবার যদি তেমন ভয়াবহ কোনো অভিজ্ঞতা হয় ? এবার আর সহ্য করতে পারবো না । মা’র সাথে কথা বলি । মা বিষয়টা আমার ওপরই ছেড়ে দেয় । শুধু বলে –

সব মানুষ তো একরকম না রে । আর এখন তুই বড় হয়েছিস । ভালোমন্দ তো তুই নিজেই বুঝবি । তোর যেটা ভালো লাগে, তোর যাতে ভালো হয়, আমরা শুধু এটুকুই চাই । আমার খুব ভয় লাগে মা । জীবনে চলার পথে এরচেয়েও অনেক বড় বড় বিপদে পড়ে মানুষ । আবার তারা ঘুরে দাঁড়ায় । এর নামই তো জীবন রে মা ।

আজ আমার বিয়ে । হুম, আলমাসকে ফেরাতে পারলাম না । আসলে আমিও হয়ত চেয়েছিলাম ওর বাড়ানো হাতটা ধরতে । ওর সাথে এর মধ্যে অনেক কথা বলেছি নিজের দ্বিধা কাটাতে । মানুষটা যে আমাকে পাগলের মতো ভালোবাসে সেটা বেশ বুঝতে পারি । ও কখনো আমাকে জোর করেনি । বার বার একই কথা বলেছে – তোমার যতোটা সময় প্রয়োজন, তুমি নাও । আমি অপেক্ষায় আছি । হাত বাড়ালেই ছুঁতে পারবে । আমি অপেক্ষায় থাকবো নীলিমা, অনন্তকাল ।

মানুষটাকে ভাল না বেসে পারিনি আমি । আমি বউ সেজে বসে আছি আলমাসের অপেক্ষায় । বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে খুব । কী আশ্চর্য! সেদিনও বৃষ্টি হয়েছিলো । সেদিনও আশ্বিন মাস ছিলো । সেদিনও আমি বউ সেজে বসেছিলাম । অন্য কারো অপেক্ষায় । তবে আজ যেন আমার মুক্তির খুশিতে প্রকৃতিও কাঁদছে আমার সাথে ।

আমি একটা গল্প বলা চেষ্টা করেছি । লেখার ফাঁকে বার বার স্মৃতি কাতর হয়ে পড়েছি । এরকমই একটা ঘটনা আমার খুব কাছের দুজন মানুষের জীবনে ঘটেছিলো । আর ওদের দু’জনের মা’দের খেয়াল খুশিতে, অল্প বয়সে ওদের বিয়েটা যেমন হয়েছিলো, ঠিক তেমনি ছাড়াছাড়িও হয়েছিলো ।

গল্পে নিজের ইচ্ছামত অনেক কিছু সাজানো যায় । বাস্তব বড়ই কঠিন । গল্পে নীলিমার সাথে নির্ঝরের আর কখনো দেখা হয়নি । বাস্তবেও হয়নি আর দেখা । নীলিমা শুধু শুনেছিলো, নির্ঝর আমেরিকা চলে গেছে । নির্ঝর সত্যি চলে গেছে বাইরে । এখন পর্যন্ত ফেরেনি । ও যেখানে আছে, ওদের দেশে সেটাকে কী নামে ডাকে আমি ঠিক জানি না তবে আমাদের দেশে আমরা বলি – ” পাগলা গারদ ” ।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত